পরিশিষ্ট
=====
আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাস
=================
আমল আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লার দরবারে কবুল হওয়ার জন্য সঠিক ঈমান অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদের পূর্ণ অনুসরণ করে নিজ ঈমান ও আক্বীদা সহিহ শুদ্ধ করে নিতে হবে এবং প্রতিটি আমল আল্লাহতা’য়ালা ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির নিমিত্তে করতে হবে। সেই সাথে মহান আল্লাহপাক ও তাঁর হাবিব সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা রেখে নিজেদের ঈমান ও আমলি জিন্দেগি পরিচালনা করতে হবে। হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত এর ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
অর্থাৎ নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) তাঁর অস্তিত্বে অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরিক নেই, তিনি একক, তাঁর কোন সাদৃশ্য নেই, তিনি অভাবশূণ্য, তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তিনি সর্বসর্বা, তাঁর কোন অংশীদার নেই, তিনি অনাদি ও অসীম, সর্বক্ষণ বিরাজমান, তাঁর কোন বিরাম নেই, তিনি অনন্তকাল স্থায়ী, তাঁর কোন শেষ নেই, তিনি গৌরবের গুণে সকল সময়ই গুণান্বিত ছিলেন, আছেন ও থাকবেন, সময়ের অতীতেও তাঁর শেষ নেই। তিনি প্রথম, তিনি শেষ, তিনি প্রকাশ্য, তিনি গুপ্ত এবং সর্ববিষয়ে তিনি মহাজ্ঞানী।
তারপর ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত উক্ত কিতাবের ৫৩ পৃষ্ঠায় আরো লিখেন,
ভাবার্থ: আল্লাহ অশরিরী নিরাকার, পরিমাণশূন্য, সাদৃশ্যহীন, তকদীরহীন, অবিভাজ্য, অণু-পরমাণূশূন্য, তাঁর দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ নেই, কোন জিনিস দ্বারা তাঁর দৃষ্টান্ত দেয়া যায় না, তিনি কোন জিনিসের তুল্য নন, তাঁর ন্যায় আর কিছুই নেই। তিনি কোন জিনিসের ন্যায় নন। তিনি পরিমাণের ভেতর সীমাবদ্ধ নন, কোন স্থানের ভেতর তিনি বিবদ্ধ নন, কোন দিক তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না।
আসমান ও জমিন তাঁকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। তিনি পরিশ্রম, বিশ্রাম, স্থিতি, স্থান পরিবর্তন হতে মুক্ত। তিনি আরশের সম্মুখে অবস্থিত, যার সম্মন্ধে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, استوى على العرش আর ইসতাওয়ার অর্থ হচ্ছে, পরিশ্রম, বিশ্রাম, স্থিতি, স্থান পরিবর্তন হতে তিনি (আল্লাহ) উহা থেকে মুক্ত। আরশ তাঁকে বহন করে না (অর্থাৎ আল্লাহ আরশে বসতে পারেন না, কারণ আল্লাহ নিরাকার, অশরিরী) বরং আরশ ও তার বহনকারী (ফেরেশতা)-কে আল্লাহর কুদরতের করুণা বহন করে আসছে। সবকিছুই আল্লাহর আয়াত্তাধীন।’ তারপর তিনি বলেন,
وهو الان على ما عليه كان وانه بائن عن خلقه بصفاته ليس فى ذاته (احياء العلوم الدين جلد اول ٨۵)
অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) পূর্বে যেরূপ ছিলেন এখনও তিনি সেরূপই আছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির নিকট গুণ দ্বারা প্রকাশ, অস্তিত্ব বা জাত দ্বারা নয়। আল্লামা ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৫৪ পৃষ্ঠায় আরো বলেন,
অর্থাৎ আল্লাহপাক চক্ষু ব্যতীত দেখেন, কর্ণ ব্যতীত শুনেন, দিল ব্যতীত জ্ঞান রাখেন, হস্ত ব্যতীত ধরেন, যন্ত্র ব্যতীত সৃষ্টি করেন, তাঁর গুণ সৃষ্টির তুল্য নয়। যেরূপ তাঁর অস্তিত্ব, সৃষ্টির অস্তিত্বের তুল্য নন।
সারকথা হলো- আল্লাহর মহান গুণ হলা আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী বা মুহতাজ নন, الله الصمد আল্লাহ হলেন সমদ বা বেনিয়াজ। অর্থাৎ আল্লাহর দেখতে চোখের প্রয়োজন নেই, শুনতে কানের প্রয়োজন নেই, জ্ঞান রাখতে দিলের প্রয়োজন নেই, ধরতে হাতের প্রয়োজন নেই।
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় ‘তাকমীলুল ঈমান’ নামক কিতাবে আল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) দেহবিশিষ্ট নন, তিনি জওহর বা বস্তু বিশেষ নন, আরজ বা বস্তু বিশিষ্টও নন। তিনি আকারবিশিষ্ট নন, তিনি মুরাক্বাব নন, (তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই)।
সংখ্যা ও আধিক্যতাবিশিষ্ট নন, পরিমাণযোগ্য নন, তিনি দিকশূন্য, তিনি কোন স্থানে অবস্থান করেন না এবং তাঁর উপর কোন সময় বহে না। অর্থাৎ তিনি নিরাকার, জমান মকান ও দিক থেকে তিনি পবিত্র তারপর তিনি উক্ত কিতাবে আরো বলেন,
لا مثل له ولا شبه ولا ضد ولا ند له ولا ظهر ولا معين-
অর্থ: তিনি উপমাহীন, রূপকহীন, তাঁর সমতুল্য কেউ নেই, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, তাঁর সাহায্যকারী ও সহযোগী কেউ নেই অর্থাৎ তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার কোন প্রয়োজন নেই তিনি হলেন সমদ বা কারো মুখাপেক্ষী নন।
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরিক নেই, তিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি কোন বস্তুর মত নন, কোন বস্তুও তার মত নয়, গোটা আলম তথা আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সবই হাদিস অর্থাৎ ধ্বংসশীল।
যখন এসব কিছুই ছিল না তিনি তখনও ছিলেন আবার যখন কোন কিছুই থাকবে না তিনি তখনও থাকবেন। তিনি একাই নিজের কুদরত দ্বারা সম্পূর্ণ ‘নেই’ হতে সব কিছু সৃজন করেছেন, তথা অস্তিত্ব দান করেছেন, তিনিই হলেন আল্লাহ।
তিনি এক, একক ও অদ্বিতীয়, অনাদি, অবিনশ্বর, শাশ্বত ও চিরজীব, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা এবং স্বাধীন ও কার্যকর ইচ্ছাশক্তির মালিক।
তিনি عرض ‘আরজ’ তথা এমন বস্তু নন, যা অন্যের মাধ্যম ছাড়া স্থিতিশীল হতে পারে না। যথা, রং, গন্ধ, স্বাদ, তাপ, শীতলতা, আদ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি।
তিনি জিসিম তথা দেহবিশিষ্ট নন। কেননা দেহ বহু অবিভ্যাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ এবং স্থান দখলকারী। অথচ এ সবই নশ্বর সৃষ্টিকুলের বৈশিষ্ট্য।
তিনি মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর আকার আকৃতিবিশিষ্টও নন। কেননা ইহা (আকৃতি) দেহের বৈশিষ্ট্য, যা দেহের প্রান্তসীমা ও পরিধি তথা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধ দ্বারা অর্জিত অবস্থা তথা আয়তন ও পরিমাণ হতে সৃষ্টি হয়ে থাকে।
তিনি প্রান্ত, সীমা ও পরিধিবিশিষ্ট নন। অর্থাৎ তিনি সসীম তথা পরিমাণযোগ্য নন। বরং তিনি আদি-অন্ত-মধ্যহীন, অনন্ত, অসীম।
তিনি সংখ্যা ও আধিক্যতাবিশিষ্ট নন। অর্থাৎ তিনি গণনা ও পরিসংখ্যানযোগ্য নন। তিনি অংশ ও আংশিকতা মুক্ত। তাঁর যাত বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডে ও অংশে বিভক্ত ও বিভাজ্য হয় না।
বহু পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্র অংশে মিলিত হয়ে তাঁর জাত গড়ে উঠেনি। কেননা যার অংশ থাকে এবং যা বহু বিচ্ছিন্ন অংশ দ্বারা সংযোজিত, উহার অস্তিত্ব লাভের ক্ষেত্রে ঐসব অংশের প্রতি মুখাপেক্ষিতা অপরিহার্য। আর এই মুখাপেক্ষিতা আল্লাহর অনিবার্য সত্ত্বার পরিপন্থী।
তাঁর উপর কোন সময় বহে না। তাঁর সাথে কোন বস্তুর সাদৃশ্য নেই। তাঁর ইলম ও কুদরতের বহির্ভুত কোন বস্তু নেই। তাঁর জাতের মধ্যে অন্য কোন বস্তু স্থান পায় না এবং পেতেও পারে না। তিনি কোন বস্তুতে প্রবেশ করে না এবং তাঁর মধ্যেও কোন বস্তু প্রবেশ করে না এবং করতেও পারে না এবং কোন বস্তুর সাথে এক হয়ে যান না।
তিনি অনন্ত ও অসীম। কেননা সসীম হওয়া পরিমাণ ও পরিসংখ্যানযোগ্য বস্তুর বৈশিষ্ট্য। তিনি অংশ ও আংশিকতামুক্ত। তিনি কোন বস্তুর শ্রেণিভুক্ত নন। তিনি দেহের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুণাবলী যথা, রং, স্বাদ, গন্ধ, তাপ, শীতলতা, আদ্রতা ও শুষ্কতা ইত্যাদি হতে মহাপবিত্র। কেননা এসবই দেহ তথা সংযোজিত ও সংমিশ্রিত বস্তুর গুণ। তিনি কোন স্থানে অবস্থান করেন না।
অনুরূপ শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় ‘আল কাওলুল জামিল’ নামক কিতাবের ৩৭ পৃষ্ঠা লিখেছেন,
منزه من جميع سمات النقص والزوال من الجسمية والتحير والعرضية والجهة والالوان والاشكال-
অর্থাৎ ‘আল্লাহতা’য়ালা অপূর্ণতা ও নশ্বরতার এ জাতীয় সবকিছু থেকে মুক্ত। তিনি দেহধারী, স্থান গ্রহণকারী, কোন দিকে অবস্থানকারী, বর্ণ ও আকৃতিধারী এবং দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী নন।
‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের (উর্দু) ১১৫৮/৬২পৃষ্ঠায় মাকতুবাত নং ৬৭) উল্লেখ করেন,
اور اللہ کسی چیز سے متحد نہیں ہوتے اور نہ ھی کوئ اور چیز ان سے متحد ہوتی ہے اور اللہ تعالی کسی چیز میں حلول بھی نہیں کرتا اور نہ ھی کوئ چیز اللہ میں حلول کرتی ھے اور اللہ تعالی کے لۓ اجزاء اور حصص کا ہونا بھی محال ہے اور ترکیب وتحلیل اللہ تعالی کی بارگاہ میں ممنوع ھے اور اللہ تعالی کا کوئ مثل اور کفو نہیں ھے بیوی بچے نہیں ہیں- اسکی ذات وصفات بے چوں بے جگون اور بے شبیہ اور بے نمونہ ہیں- ھم صرف اتناجنتے ہیں کہ اللہ تعالی اور اسماء وصفات کاملہ سے جن سے اپنے آپ کی تعریف کی ہے ان سے متصف ہے ان میں جو چیز بھی ہمارے فھم وادراک اۓ اور ہم اسے سمجہ سکیں اور تصور کرسکا وہ اس سے پاک اور بلند ہے-
ভাবার্থ: আল্লাহতা’য়ালা কোন বস্তুর সাথে একত্রিত নন এবং কোন বস্তু তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যায় না। আল্লাহতা’য়ালা কোন বস্তুর ভিতর অনুপ্রবেশ করেন না। আল্লাহ তা’য়ালার জন্য খণ্ড ও অংশ হওয়া অসম্ভব। তরকীব বা সংমিশ্রণ, তাহলিল বা দ্রবীভূত হওয়া তাঁর পাকজাতে দুস্কর ও নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’য়ালার কোন অনুরূপ ও সমশ্রেণিভূক্ত কেউ নেই। তাঁর স্ত্রী পুত্র নেই। তাঁর জাতে ও সিফাত বা গুণাবলীসমূহ রকম প্রকারবিহীন এবং অনুরূপ ও নিদর্শন রহিত।
আমরা শুধু এতটুকু জানি (ঈমান রাখি) যে আল্লাহতা’য়ালা আছেন এবং তিনি যেরূপ নিজের প্রশংসা করেছেন, তদ্রুপ তাঁর নাম ও কামেল গুণাবলীতে বর্তমান আছেন।’
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা স্বেচ্ছায় অস্তিত্ববান এবং অপরাপর সবকিছুই তাঁর সৃষ্টির কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে, আল্লাহপাক আপন জাত ও সিফাত এবং কর্মকাণ্ডের মাঝে সম্পূর্ণ একা। প্রকৃতপক্ষে কোন বিষয়ে চাই উহা অস্তিত্ব হোক অথবা অস্তিত্বহীন হোক, কেউই তাঁর সঙ্গে অংশীদার নন। নামগত অংশিদারত্ব ও শব্দগত সম্পর্কে আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।
মাকতুবাত ৩/১১৫৭/৬২ পৃষ্ঠা মাকতুবাত নং ৬৭ উল্লেখ রয়েছে,
اللہ سبحانہ وتعالی اکیلا ہے ان کا کوئ شریک نہیں نہ وجوب ووجود میں اور نہ عبادت کے مستحق ہونے میں- وجود وجوب (لازمی طور پر قائم رھنا) اللہ تعالی کے سوا کسی کے لۓ لائق نہیں اور نہ عبادت کا استحقاق اس کے سوا کسی کے لۓ درست نہیں-
اللہ تعالی صفات کاملہ رکھتا ہے جن میں سے حیات- علم- قدرت- اردہ- سمع- بصر- کلام اور تکوین بھی ہیں- یہ صفات ازلی اور قدیمی ہیں- اور اللہ جل سلطانہ کی ذات کے ساتھ قائم ہیں
ভাবার্থ: আল্লাহপাক সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালা এক তাঁর কোন শরিক বা সমকক্ষ নেই। অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী হিসেবে হোক অথবা এবাদতের উপযোগী হিসেবে হোক তিনি সমকক্ষ বিহীন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউই অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের উপযোগী নয় এবং ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতাও কেউই রাখেন না।
আল্লাহ তা’য়ালার সিফাতে কামেলা বা পূর্ণাঙ্গ গুণ সর্বমোট ৮টি রয়েছে,
১. হায়াত বা জীবনী শক্তি, ২. এলম বা জ্ঞান, ৩. কুদরত বা ক্ষমতা, ৪. এরাদত বা ইচ্ছাশক্তি, ৫. ছামা বা শ্রবণশক্তি, ৬. বছর বা দর্শনশক্তি, ৭. কালাম বা বাকশক্তি, ৮. তাকবিন বা সৃষ্টিশক্তি।
এ ৮টি সিফাতসমূহ কাদীম ও আজলি বা প্রাচীন। (যার কোন আরম্ভ নেই) অনাদি (যার কোন শেষ নেই)। এ গুণসমূহ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর জাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নবজাত বস্তুসমূহের সাথে সম্পর্ক সিফাতসমূহের অনাদিত্বের মধ্যে কোনরূপ ব্যতিক্রম ঘটাতে সক্ষম হয় না। সম্পর্কিত বস্তুর নতুনত্ব ইহাদের চিরস্থায়ীত্বের প্রতিবন্ধক হয় না।’
নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম মাখলুক
মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী ৩/১৬১৩/১৫৩ পৃষ্ঠা, মকতুব নং ১২২ উল্লেখ রয়েছে,
آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی اس جاہ وجلال اور اس بلندی شان کے با وجود ہمیشہ ممکن ہیں اور ہرگز امکان سے باہر نہیں آسکتے اور نہ واجب سے مل سکتے کیونکہ یہ الوھیت سے متصف ہونے کو مستلزم ہے اور تعالی اس سے بلند ھے کہ کوئ اسکا شریک اور برابری کرنے والا ہو-
دع ما ادعتہ النصاری فی نبیھم
واحکم بما شئت مدحا فیہ واحتکم
ভাবার্থ: হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ শান-শওকত ও কুল কায়েনাতের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবসময় (চিরকালই) তিনি হচ্ছেন ممكن মমকিন বা সম্ভাব্য ও সৃষ্টবস্তু। নিশ্চয় তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ممكن মমকিন বা সম্ভাব্য হতে নি®কৃতি লাভ করেন নাই এবং আল্লাহতা’য়ালা যিনি واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল ওজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী যাতে পাকের সাথে হাবিবে খোদা মমকিন হওয়ার কারণে মিলিত হতে পারেন না, এজন্য যাতে উলুহিয়াতের সাথে মিলিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা তাঁর সমকক্ষ ও শরিক হওয়া হতে তিনি অতি উচ্চ ও পবিত্র।
কহিল নাছারা যাহা স্বীয় নবীর পরে
কহিও না তোরা তাহা মম নবী বরে।
আল্লাহর হাবিব সর্বপ্রথম সৃষ্টি নূর এবং তাঁর নূর দ্বারা আল্লাহপাক কুল কায়েনাত সৃষ্টি করেছেন। একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের ২/২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন,
ভাবার্থ: এ এক চিরন্তন বাস্তবতা যে, নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমগ্র সৃষ্টির প্রথম, সমস্ত কায়েনাতের ওসিলা, বিশ্বজগৎ এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টির মাধ্যম হচ্ছে নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সহিহ হাদিসশরীফে এসেছে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, اول ما خلق الله نورى ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নুরী’ অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালা সমস্ত মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং ঊর্ধ্ব ও অধঃজগতের সবকিছুই নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর মোবারক থেকে সৃষ্ট। তাঁর পবিত্র নূরী জাওহার থেকে সৃষ্টি হয়েছে রূহসমূহ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম, বেহেশত, দোযখ, ফেরেশতা, ইনসান, জিন, আসমান, জমিন, সাগর, পাহাড়, গাছ, বৃক্ষ এবং কুল মাখলুকাত। এ সকল কিছুর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে তাঁরই ওসিলায়। সেই হাকিকতের প্রকাশের বর্ণনায় বিজ্ঞ বিজ্ঞ আলেমগণ বিস্ময়কর ও সূক্ষè বর্ণনা পেশ করেছেন।’
এক রেওয়ায়েতে এসেছে,اول ما خلق الله العقل ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহুল আকলু’ আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম আকল সৃষ্টি করেছেন। তবে এই হাদিস মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিসগণের মতে সহিহ এর স্তরে পৌছেনি। অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে, اول ما خلق الله القلم ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু কলম’ সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা কলম সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিসটির অর্থ মুহাদ্দিসগণ এভাবে করেছেন যে, আরশ ও পানি সৃষ্টির পরে প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার কোন কোন হাদিসের ব্যাখ্যায় এ রকম এসেছে যে, পানি সৃষ্টি হয়েছিল আরশের পূর্বে وكان عرشه على الماء
এর পরপরই আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন, হাদিসশরীফে এসেছে, যখন কলম সৃষ্টির পর আল্লাহতা’য়ালা তাকে বললেন লেখ, তখন কলম বললো, কি লেখবো? আল্লাহতা’য়ালা বললেন, ما كان وما يكون الى الابد ‘মা কানা ওয়ামা ইয়াকুনু ইলাল আবাদ’ অতীত এবং ভবিষ্যতের সবকিছু লিখ।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, কলম সৃষ্টির পূর্বেও কিছু সৃষ্টি হয়ে ছিল। আলেমগণ বলেন, আরশ, কুরসি এবং রূহসমূহ সৃষ্টির পূর্বে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক প্রকাশ্য জগতে এসেছে। ما كان ‘মা কানা’ যা কিছু হয়েছিল এ অর্থই বহন করে। তাহল নূরে মুহাম্মদীর হাল ও সিফাতসমূহ। কেননা সমগ্র জগতের মধ্যে নূরে মুহাম্মদী অগ্রগণ্যতা সুসাব্যস্ত اول ما خلق الله نورى অপরদিকে وما يكون ‘ওমা ইয়াকুনু’ এর অর্থ হলো পৃথিবীর পরবর্তীতে প্রকাশিতব্য সকল কিছু। আলমে জহুর বা বাহ্যিকজগতে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত প্রমাণিত ছিল। যেমন আল্লাহর হাবিব বলেছেন, كنت نبيا وادم بين الروح والجسد অর্থ, আমি ঐ সময়ও নবী ছিলাম, যখন আদম আলাইহিস সালাম আত্মা ও দেহের মাঝামাঝিতে ছিলেন। (মাদারিজুন নবুয়ত, ২-৩ পৃষ্ঠা)
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত হাদিসের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন,
ভাবার্থ: ‘হাদিসশরীফে এসেছে, যখন নূরে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হলো এবং তাঁর নূর থেকে (আল্লাহর হাবিবের নূর থেকে) সকল নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর নূরসমূহ বের করা হল, তখন আল্লাহতায়ালা নূরে মোস্তফা আলাইহিস সালামকে বললেন, ঐ নূরসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তিনি তাই করলেন। ফলে তাঁর নূর সকল নূরের উপর প্রধান্য বিস্তার করল এবং অন্যান্য নূর হয়ে গেল আলোকবিহীন। তাঁরা নিবেদন করল হে পরওয়ার দিগারে আলম! তা কার নূর যা আমাদের সকলের নূরকে ম্লান করে দিল? আল্লাহতা’য়ালা ইরশাদ করলেন, এ নূর মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর। তোমরা যদি তাঁর উপর ঈমান আন তবে আমি তোমাদেরকে নবী বানাবো। সকলেই সমস্বরে বলল- হে আমাদের রব! আমরা তাঁর উপর ও তাঁর নবুয়তের উপর ঈমান আনলাম। আল্লাহতা’য়ালা বলেন, আমি তোমাদের এ কথার সাক্ষী রইলাম। এদিকে ইঙ্গিত করেই কোরআন মজীদের এক আয়াতে কারীমায় বলা হয়েছে,
واذ اخذ الله ميثاق النبيين لما اتيتكم من كتاب و حكمة الخ
অর্থাৎ আল্লাহ যখন নবীগণের নিকট থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করব। (মাদারিজুন নবুয়ত, ২-৩ পৃষ্ঠা)
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ৩য় জিল্দ ৮ পারা ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, অর্থাৎ আলোচ্য আয়াতে কারীমার তাফসিরে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, اول ما خلق الله نورى সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। এ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত তদীয় المستصفى من علم الاصول ‘আল মুস্তাসফা মিন ইলমিল উসূল’ নামক কিতাবের দ্বিতীয় জুজ ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, لكمال القدرة كقوله تعالى كن فيكون অর্থাৎ আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালার কুদরতে কামাল হলো ‘কুন ফাইয়াকুন’ হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। কোন উপাদানের প্রয়োজন নেই। সে প্রেক্ষাপটে تفسير روح البيان ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ ৩য় জিলদের সূরায়ে আনয়াম ১২৯ পৃষ্ঠায় আশ শায়খ ইসমাঈল হক্কী বরছয়ী আলাইহির রহমত (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) অর্থাৎ وانا اول المسلمين আমি সর্বপ্রথম মুসলমান এর অর্থ হলো- সর্বপ্রথম সৃষ্টি করার সময় আল্লাহ তা’য়ালার আদেশ كن ‘কুন’ হয়ে যাওকে আমি সর্বপ্রথম মেনে নিয়েছি। অনুরূপভাবে মহব্বতের ফয়েজ গ্রহণ করার সময় আমি সর্বপ্রথম গ্রহণ করেছি। কারণ আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেন, তিনি তাদের মহব্বত করেন। আর তাঁরা আল্লাহকে মহব্বত করেন। এ মহব্বতে ফয়েজ গ্রহণের বেলায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম, যা তাঁর বাণী ‘আল্লাহতা’য়ালা আমার নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন প্রমাণ করছে।
শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন, ভাবার্থ: নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে উন্নত ও পরিপূর্ণ মর্যাদা হল এই যে, আল্লাহতা’য়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক অন্যান্য সকল রূহ মোবারকের পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহর হাবিবের রূহ মোবারক হতে সমস্ত রূহ সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম রূহ ও জসদ বা শরিরাকৃতির মধ্যে থাকা অবস্থায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী ছিলেন। যেমন তিরমিজিশরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করা হয়েছে। অপরদিকে আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে এমনকি সমস্ত নবীগণের রূহ মোবারকগণ ও সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক হতে পূর্ণ ফয়েজ ও বরকতপ্রাপ্ত হয়েছেন।
শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় ‘ইনতেবাহ ফি সালাসিলিল আউলিয়া আল্লাহ’ নামক কিতাবের ৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
نور اول کہ آں نور محمدی ست صلی اللہ علیہ وسلم ونیز آں را شھود اول می گویند-
অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী সর্বপ্রথম সৃষ্টি। এজন্য তিনিই সর্বপ্রথম আল্লাহর একত্বের স্বাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন।
মুল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রহমত مرقاة شرح مشكوة ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
ان اول شئ خلق الله القلم وهو غير صحيح … فا الاولية اضافيه والاول الحقيقى هو النور المحمدى على ما بينته فى المورد للمولد-
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। আর সেটা হচ্ছে গায়রে সহিহ বা অশুদ্ধ। অতএব আউয়ালিয়তে এজাফি বা প্রথম। আর আউয়ালিয়তে হাকিকী প্রকৃত অর্থে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে নূরে মুহাম্মদী। এ সম্পর্কে আমি ‘মাওরিদু লিল মাওলিদ’ নামক কিতাবে সবিস্তার বর্ণনা করেছি।
স মা প্ত