সূর্যদেব যতই ঊর্ধ্বে উঠিতেছেন, তাপাংশ ততই বৃদ্ধি হইতেছে। হোসেনের পরিজনেরা বিন্দুমাত্র জলের জন্য লালায়িত হইতেছে, শত শত বীরপুরুষ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিতেছে। ভ্রাতা, পুত্র, স্বামীর শোণিতাক্ত কলেবর দেখিয়া কামিনীরা সময়ে সময়ে পিপাসায় কাতর হইতেছেন, চক্ষুতে জলের নামমাত্রও নাই, সে যেন এক প্রকার বিকৃত ভাব, কাঁদিবারও বেশি শক্তি নাই। হোসেন চতুর্দিক চাহিয়া দেখিলেন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আর কেহই নাই। রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া জয়লাভের জন্য শত্রুসম্মুখীন হইতে আদেশ অপেক্ষায় তাঁহার সম্মুখে আর কেহই আসিতেছেন না। হোসেন এক দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “হায়! একমাত্র বারি প্রত্যাশায় এত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব হারাইলাম, তথাচ পরিজনগণের পিপাসা নিবারণ করিতে পারিলাম না। কারবালা ভূমিতে রক্তস্রোত বহিতেছে, তথাচ স্রোতস্বতী ফোরাত শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিতে পারিলাম না। এক্ষণে আর বাঁচিবার ভরসা নাই, আশাও নাই, আকাঙ্খাও নাই।”
হাসানপুত্র কাসেম পিতৃব্যের এই কথা শুনিয়া সুসজ্জিত বেশে সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, “তাত! কাসেম এখনো জীবিত আছে। আপনার আজ্ঞাবহ চিরদাস আপনার সম্মুখে দণ্ডায়মান আছে। অনুমতি করুন, শত্রুকুল নির্মূল করি।”
হোসেন বলিলেন, “কাসেম! তুমি পিতৃহীন; তোমার মাতার তুমিই একমাত্র সন্তান; তোমায় এই ভয়ানক শত্রুদল মধ্যে কোন্ প্রাণে পাঠাইব?”
কাসেম বলিল, “ভয়ানক!-আপনি কাহাকে ভয়ানক শত্রু জ্ঞান করেন? পথের ক্ষুদ্র মক্ষিকা, পথের ক্ষুদ্র পিপীলিকাকে আমি যেমন ক্ষুদ্র জ্ঞান করি, আপনার অনুমতি পাইলে এজিদের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সৈন্যধ্যগণকেও সেইরূপ তৃণজ্ঞান করিতে পারি। কাসেম যদি বিপক্ষ ভয়ে ভয়ার্তচিত্ত হয়, হাসানের নাম ডুবিবে, আপনারও নাম ডুবিবে। অনুমতি করুন, একা আমি সশস্ত্র হইয়া সহস্র সহস্র লক্ষ লক্ষ রিপু বিনাশ সমর্থ।”
হোসেন বলিলেন, “প্রাণাধিক! আমার বংশে তুমি সকলের প্রধান, তুমি ইমাম বংশের বহুমূল্য রত্ন, তুমি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুমি সৈয়দ বংশের অমূল্য নিধি। তুমি তোমার মাতার একমাত্র সন্তান, তাঁহার সম্মুখে থাকিয়া তাঁহাকে এবং সমুদয় পরিজনকে সান্ত্বনা কর। আমি নিজেই যুদ্ধ করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধার করিতেছি।”
কাসেম বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, কাসেমের প্রাণ দেহে থাকিতে আপনাকে অস্ত্র ধারণ করিতে হইবে না। কাসেম এজিদের সৈন্য দেখিয়া কখনোই ভীত হইবে না। যদি ফোরাতকূল উদ্ধার করিতে না পারি, তবে ফোরাতনদী আজ লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়া এজিদের সৈন্য-শোণিতে যোগ দিয়া মহাসমুদ্রে প্রবাহিত হইবে।”
হোসেন বলিলেন, “বৎস! আমার মুখে এ-কথার উত্তর নাই। তোমার মাতার আদেশ লইয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”
হাসনেবানুর পদধূলি গ্রহণ করিয়া মহাবীর কাসেম যুদ্ধযাত্রা প্রার্থনা জানাইলে তিনি কাসেমের মস্তক চুম্বন করিয়া আশীর্বাচন প্রয়োগপূর্বক বলিলেন, “যাও বাছা! যুদ্ধে যাও! তোমার পিতৃঋণ পরিশোধ কর। পিতৃশত্রু এজিদের সৈন্যগণের মস্তক চূর্ণ কর, যুদ্ধে জয়ী হইয়া ফোরাতকূল উদ্ধার কর, তোমার পিতৃবাক্য রক্ষা কর। তোমার আর আর ভ্রাতা-ভগ্নীগণ তোমার মুখাপেক্ষা করিয়া রহিল। যাও বাপ! তোমায় আজ ঈশ্বরের পদতলে সমর্পণ করিলাম।”
হাসনেবানুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া পিতৃব্যের পদচুম্বনপূর্বক কাসেম অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিবেন, এমন সময়ে হোসেন বলিলেন, “কাসেম! একটু বিলম্ব কর।”
অনুজ্ঞা শ্রবণমাত্র অশ্ববল্গা ছাড়িয়া কাসেম তৎক্ষণাৎ পিতৃব্যসম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তোমার পিতার নিকট আমি এক প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি, আমাকে সেই প্রতিজ্ঞা হইতে উদ্ধার করিয়া যুদ্ধে গমন কর। যুদ্ধে যাইতে আমার আর কোন আপত্তি নাই। তোমার পিতা প্রাণবিয়োগের কিছু পূর্বে আমাকে করারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, আমার কন্যা সখিনার সহিত তোমার বিবাহ দিব। তুমি সখিনাকে বিবাহ না করিয়া যুদ্ধে যাইতে পারিবে না। তোমার পিতার আজ্ঞা প্রতিপালন, আমাকেও প্রতিজ্ঞা হইতে রক্ষা কর, উভয়ই তোমার সমতুল্য কার্য।”
কাসেম মহা বিপদে পড়িলেন। এতাদৃশ মহাবিপদসময়ে বিবাহ করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়াই অস্থিরচিত্ত। কী করেন কোন উপায় না করিয়া মাতার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত বলিলেন।
হাসনেবানু বলিলেন, “কাসেম! আমিও জানি, আমার সম্মুখে তোমার পিতা তোমার পিতৃব্যের নিকট এই বিবাহের প্রস্তাব করিয়া তাঁহাকে করারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। শোক তাপ এবং উপস্থিত বিপদে আমি সমুদয় ভুলিয়া গিয়াছিলাম। ঈশ্বরানুগ্রহে তোমার পিতৃব্যের স্মরণ ছিল বলিয়াই তোমার পিতার উপদেশ প্রতিপালিত হইবে বোধ হইতেছে। ইহাতে আর কোন আপত্তি উত্থাপন করিয়ো না। এখনই বিবাহ হউক। প্রাণাধিক, এই বিষাদ-সমুদ্র মধ্যে ক্ষণকালের জন্য একবার আনন্দস্রোত বহিয়া যাউক্।”
কাসেম বলিলেন, “জননী! পিতা মৃত্যুকালে আমাকে একখানি কবচ দিয়া বলিয়া গিয়াছেন যে, যে সময় তুমি কোন বিপদে পড়িবে, নিজ বুদ্ধির দ্বারা যখন কিছুই উপায় স্থির করিতে না পারিবে, সেই সময় এই কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিয়া তদুপদেশমত কার্য করিয়ো। আমার দক্ষিণহস্তে যে কবচ দেখিতেছেন, ইহাই সেই কবচ। আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে আজ এই মহাঘোর বিপদসময়ে কবচের অপর পৃষ্ঠ পাঠ করিয়া দেখি কি লেখা আছে!”
হাসনেবানু বলিলেন, “এখনই দেখ! তোমার আজিকার বিপদের ন্যায় আর কোন বিপদই হইবে না। কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিবার উপযুক্ত সময়ই এই।” এই কথা বলিয়াই হাসনেবানু কাসেমের হস্ত হইতে কবচ খুলিয়া কাসেমের হস্তে দিলেন। কাসেম সম্মানের সহিত কবচ চুম্বন করিয়া অপর পৃষ্ঠ দেখিয়াই বলিলেন, “মা! আমার আর কোন আপত্তি নাই। এই দেখুন, কবচে কি লেখা আছে।”-পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, কবচে লেখা আছে-“এখনই সখিনাকে বিবাহ কর।” কাসেম বলিলেন, “আর আমার কোন আপত্তি নাই; এই বেশেই বিবাহ করিয়া পিতার আজ্ঞা পালন ও পিতৃব্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব।”
প্রিয় পাঠকগণ! ঈশ্বরানুগ্রহে লেখনী-সহায়ে আপনাদের সহিত আমি অনেক দূর আসিয়াছি। কোন দিন ভাবি নাই, একটু চিন্তাও করি নাই, লেখনীর অবিশ্রান্ত গতি ক্রমেই আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদ-সিন্ধুর পঞ্চবিংশ প্রবাহ পর্যন্ত আসিয়াছি। আজ কাসেমের বিবাহ-প্রবাহ মহাবিপদে পড়িলাম। কি লিখি কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না।
হাসনেবানু বলিয়াছেন, ‘বিষাদ-সমুদ্রে আনন্দস্রোত!’ এমন কঠিন বিষয় বর্ণনা করিতে মস্তক ঘুরিতেছে, লেখনী অসাড় হইতেছে, চিন্তার গতিরোধ হইতেছে, কল্পনাশক্তি শিথিল হইতেছে। যে শিবিরে স্ত্রীপুরুষেরা, বালকবালিকারা দিবা রাত্রি মাথা ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতেছে, পুত্রমিত্রশোকে জগৎসংসার অন্ধকার দেখিতেছে, প্রাণপতির চিরবিরহে সতী নারীর প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে, ভ্রাতার বিয়োগযন্ত্রণায় অধীর হইয়া প্রিয় ভ্রাতা বক্ষ বিদারণ করিতেছে, শোকে তাপে স্ত্রীপুরুষ একত্রে দিবানিশি হায় হায় রবে কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে; আবার মুহূর্ত পরেই পিপাসা, সেই পিপাসারও শান্তি হইল না;-সেই শিবিরেই আজ বিবাহ! সেই পরিজন মধ্যেই এখন বিবাহ উৎসব।-বিষাদ-সিন্ধুতে হাসিবার কোন কথা নাই, রহস্যের নামমাত্র নাই, আমোদ-আহ্লাদের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নাই, আদ্যন্ত কেবল বিষাদ, ছত্রে ছত্রে বিষাদ, বিষাদেই আরম্ভ এবং বিষাদেই সম্পূর্ণ। কাসেমের ঘটনা বড় ভয়ানক। পূর্বেই বলিয়াছি যে, মহাবীর কাসেমের ঘটনা বিষাদ-সিন্ধুর একটি প্রধান তরঙ্গ।
কাহার মুখে হাসি নাই, কাহারো মুখে সন্তোষের চিহ্ন নাই। বিবাহ, অথচ বিষাদ! পুরবাসিগণ সখিনাকে ঘিরিয়া বসিলেন। রণবাদ্য তখন সাদীয়ানা বাদ্যের কার্য করিতে লাগিল। অঙ্গরাগাদি সুগন্ধি দ্রব্যের কথা কাহারো স্মরণ হইল না;-কেবল কণ্ঠবিনির্গত নেত্রজলেই সখিনার অঙ্গ ধৌত করিয়া পুরবাসিনীরা পরিষ্কৃত বসনে সখিনাকে সজ্জিত করিলেন। কেশগুচ্ছ পরিপাটী করিয়া বাঁধিয়া দিলেন, সভ্য প্রদেশ প্রচলিত বিবাহের চিহ্ন স্বরূপ দুই একখানি অলঙ্কার সখিনার অঙ্গে ধারণ করাইলেন। সখিনা পূর্ণবয়স্কা, সকলই বুঝিতেছেন। কাসেম অপরিচিত নহে। প্রণয়, ভালবাসা উভয়েরই রহিয়াছে। ভ্রাতাভগ্নী মধ্যে যেরূপ বিশুদ্ধ ও পবিত্র প্রণয় হইয়া থাকে, তাহা কাসেম-সখিনার বাল্যকাল হইতেই রহিয়াছে। কাহার স্বভাব কাহারো অজানা নাই, বাল্যকাল হইতেই এই উপস্থিত যৌবনকাল পর্যন্ত একত্র ক্রীড়া, একত্রে ভ্রমণ, একত্র বাসনিবন্ধন উভয়েরই মনে সবিশেষ সরল প্রণয় জন্মিয়াছে। উভয়েই এক পরিবার, এক বংশসম্ভূত, উভয়ের পিতা পরস্পর সহোদর ভ্রাতা, সুতরাং লজ্জা, মান, অভিমান অপর স্বামী-স্ত্রীতে যেরূপ হইবার সম্ভাবনা, তাহা উহাদের নাই। লগ্ন সুস্থির হইল। ওদিকে এজিদের সৈন্য মধ্যে ঘোর রবে যুদ্ধবাজনা বাজিতে লাগিল। ফোরাত-নদীর কূল উদ্ধার করিতে আর কোন বীরপুরুষই হোসেনের পক্ষ হইতে আসিতেছে না দেখিয়া আজিকার যুদ্ধে জয়সম্ভব বিবেচনায় তুমুল শব্দে বাজনা বাজিতে লাগিল। সেই শব্দে ফোরাতকূল হইতে কারবালার অন্তসীমা পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। হোসেনের শিবিরে পতিপুত্রশোকাতুরা অবলাগণের কাতরনিনাদে সপ্ততল আকাশ ভেদ করিতে লাগিল। সেই কাতরধ্বনি ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত যাইতে লাগিল। হোসেন বাধ্য হইয়া এই নিদারুণ দুঃখের সময় কাসেমের হস্তে প্রাণাধিকা দুহিতা সখিনাকে সমর্পণ করিলেন। বিধিমত বিবাহ কার্য সম্পন্ন হইল। শুভ কার্যের পর আনন্দাশ্রু অনেকের চক্ষে দেখা যায়, কিন্তু হোসেনের শিবিরস্থ পরিজনগণের চক্ষে কোন প্রকার অশ্রুই দেখা যায় নাই। কিন্তু কাসেমের বিবাহ বিষাদ-সিন্ধুর সর্বাপেক্ষা প্রধান তরঙ্গ। সেই ভীষণ তরঙ্গে সকলেরই অন্তর ভাসিয়া যাইতেছিল। বরকন্যা উভয়েই সমবয়স্ক। স্বামী-স্ত্রীতে দুই দণ্ড নির্জনে কথাবার্তা কহিতেও আর সময় হইল না। বিবাহকার্য সম্পন্ন করিয়াই গুরুজনগণের চরণ বন্দনা করিয়া, মহাবীর কাসেম অসিহস্তে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন, “এখন কাসেম শত্রু-নিপাতে চলিল।” হাসেনবানু কাসেমের মুখে শত শত চুম্বন দিয়া আর আর সকলের সহিত দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে করুণাময় জগদীশ্বর! কাসেমকে রক্ষা করিয়ো। আজ কাসেম বিবাহ-সজ্জা, বাসরসজ্জা পরিত্যাগ করিয়া চিরশত্রুসৈন্যসম্মুখে যুদ্ধসজ্জায় চলিল। পরমেশ্বর! তুমিই রক্ষাকর্তা; তুমিই রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হইয়া পিতৃহীন কাসেমকে এ বিপদে রক্ষা কর!”
কাসেম যাইতে অগ্রসর হইলেন; হাসনেবানু বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! একটু অপেক্ষা কর। আমার চিরমনসাধ আমি পূর্ণ করি। তোমাদের দুইজনকে একত্রে নির্জনে বসাইয়া আমি একটু দেখিয়া লই। উভয়কে একত্রে দেখিতে আমার নিতান্তই সাধ হইয়াছে।” এই বলিয়া সখিনা ও কাসেমকে বস্ত্রাবাস মধ্যে একত্র বসাইয়া বলিলেন, “কাসেম! তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় লও।” হাসনেবানু শিরে করাঘাত করিতে করিতে তথা হইতে বাহির হইয়া কাসেমের গম্য পথে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
কাসেম সখিনার হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কাহারো মুখে কোন কথা নাই। কেবল সখিনার মুখপানে চাহিয়া কাসেম স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে কাসেম বলিলেন, “সখিনা! প্রণয়-পরিচয়ের ভিখারী আমরা নহি; এক্ষণে নূতন সম্বন্ধে পূর্ব প্রণয় নূতন ভাবে আজীবন কাল পর্যন্ত সমভাবে রক্ষার জন্যই বিধাতা এই নূতন সম্বন্ধ সৃষ্টি করাইলেন। তুমি বীরকন্যা-বীরজায়া; এ সময় তোমার মৌনী হইয়া থাকা আমার অধিকতর দুঃখের কারণ। পবিত্র প্রণয় তো পূর্ব হইতেই ছিল, এক্ষণে তাহার উপর পরিণয়সূত্রে বন্ধন হইল, আর আশা কি? অস্থায়ী জগতে আর কি সুখ আছে বল তো?”
সখিনা বলিলেন, “কাসেম! তুমি আমাকে প্রবোধ দিতে পারিবে না। তবে এইমাত্র বলি, যেখানে শত্রুর নাম নাই, এজিদের ভয় নাই, কারবালা প্রান্তরও নাই, ফোরাতজলের পিপাসাও যেখানে নাই, সেই স্থানে যেন আমি তোমাকে পাই, আমার প্রার্থনা। প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কী আশা?”-কাসেমের হস্ত ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সখিনা পুনঃপুনঃ বলিলেন, “কাসেম! প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কী আশা?”
প্রিয়তমা ভার্যাকে অতি স্নেহসহকারে আলিঙ্গন করিয়া মুখের নিকটে মুখ রাখিয়া কাসেম বলিতে লাগিলেন, “আমি যুদ্ধযাত্রী, শত্রু-শোণিত-পিপাসু, আজ সপ্তদিবস একবিন্দুমাত্র-জলও গ্রহণ করি নাই, কিন্তু এখন আমার ক্ষুধা পিপাসা কিছুই নাই। তবে যে পিপাসায় কাতর হইয়া চলিলাম, বোধ হয় এ জীবনে তাহার তৃপ্তি নাই, হইবেও না। তুমি কাঁদিয়ো না। মনের আনন্দে আমাকে বিদায় কর। একবার কান পাতিয়া শুন দেখি, শত্রুদলের রণবাদ্য কেমন ঘোর রবে বাদিত হইতেছে। তোমার স্বামী মহাবীর হাসানের পুত্র, হজরত আলীর পৌত্র কাসেম তোমার স্বামী, এই কাসেম কি ঐ বাদ্য শুনিয়া নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া বসিয়া থাকিতে পারে? সখিনা! আমি এক্ষণে বিদায় হই।”
সখিনা বলিতে লাগিলেন, “তোমাকে ঈশ্বরে সঁপিলাম। যাও কাসেম!-যুদ্ধে যাও! প্রথম মিলন রজনীর সমাগম আশয়ে অস্তমিত সূর্যের মলিন ভাব দেখিয়া প্রফুল্ল হওয়া সখিনায় ভাগ্যে নাই। যাও কাসেম! যুদ্ধে যাও!”
কাসেম আর সখিনার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলেন না। আয়তলোচনে বিষাদিত ভাব চক্ষে দেখিতে আর ক্ষমতা হইল না। কোমলপ্রাণা সখিনার সুকোমল হস্ত ধরিয়া বারংবার চুম্বন করিয়া বিদায় হইলেন। সখিনার আশা-ভরসা যে মুহূর্তে অঙ্কুরিত হইল সেই মুহূর্তেই শুকাইয়া গেল। কাসেম দ্রুতপদে শিবির হইতে বাহির হইয়া এক লম্ফে অশ্বে আরোহণপূর্বক সজোরে অশ্বপৃষ্ঠে কশাঘাত করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে দৌড়িয়া চলিল।-সখিনা চমকিয়া উঠিলেন-হৃদয়ে বেদনা লাগিল।
বিঃদ্রঃ মীর মশাররফ হোসেনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’র একটি আবেগময় অথচ বীরত্বব্যঞ্জক অংশ চয়ন হয়েছে এ পাঠটিতে।কারবালা যুদ্ধের সপ্তম দিনে দুর্বিনীত এজিদ বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য হজরত আলী (রাঃ) পৌ্ত্র প্রয়াত ইমাম হাসানের সুযোগ্য পুত্র মহাবীর কাশেম যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প ব্যাক্ত করে পিতৃব্যের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন।হোসেন কাশেমকে তার একটি প্রতিজ্ঞা এবং ইমাম হাসানের আজ্ঞার কথা জানান।ইমাম হোসেনের কন্যা সখিনার সঙ্গে কাসেমের বিয়ের ব্যাপারে দুই ভাই হাসান-হোসেন পূর্বেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন।কাসেম যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে এ বিয়েতে রাজি হন।যুদ্ধের দামামা পরিণত হলো বিয়ের বাদ্যে।হঠাৎ করেই অত্যন্ত সাদামাটাভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো।অপরদিকে ফোরাত নদীর কূ্লে এজিদ শিবিরে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাজনা।কাসেম বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করেন।বিবাহসজ্জা, বাসরসজ্জা সকল প্রকার লৌ্কিকতা পরিহার করে কাসেম মায়ের কাছে যান বিদায় নিতে।মা তাঁকে নিয়ে যান সখিনার কাছে।দুজনকে একসাথে দেখাই ছিল তার সাধ।যেখানে শত্রু নেই, বিরোধ নেই, যুদ্ধ নেই সেরকম স্থান পরিবেশে সখিনা স্বামীর সঙ্গে মিলনের কথা ব্যাক্ত করেন।একে একে গুরুজন, মাতা, বধুর কাছে বিদায় নিয়ে শত্রুকে পরাভূত করতে অশ্বপৃষ্ঠে ওঠেন মহাবীর কাসেম।কাসেমের দায়িত্ববোধ, পরিমিতিবোধ,সংযত আবেগ, সংকল্পে দৃঢ়তা প্রভৃতির সমবায়ে এ রচনাটি তাৎপর্য লাভ করেছে।