*কারবালার অন্যান্য দুর্বৃত্তদের মুখোশ উন্মোচন (১)*

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: মাহাজ্জা-ডট-কম

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Mahajjah’s article “Unmasking the other villains of Karbala;” translator: Kazi Saifuddin Hossain]

কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার বিবরণ পুনর্ব্যক্ত করা ঐতিহ্যগতভাবে শিয়া ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)’এর শাহাদাত বিষয়ে ইরান ও ভারত উপমহাদেশে রচিত আবেগময় নাটক, গদ্য ও পদ্য সাহিত্য এবং মুহর্রম মাসে শিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজমান শোক প্রকাশের সার্বিক পরিবেশ শিয়া ক্যালেন্ডারে এই ঘটনার গুরুত্বের স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে আশুরা’ হচ্ছে বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।

তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কারবালা’র বিষয়টি বিস্তর মনোযোগ আকর্ষণ করলেও এই ঘটনা নিরবিচ্ছিন্নভাবে দুই পক্ষীয় (বিরোধ) হিসেবে চিত্রিত হয়ে চলেছে। এটাকে সদাসর্বদা দেখানো হচ্ছে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বনাম এয়াযীদ হিসেবে; মিথ্যা ও জুলূমের বিরুদ্ধে সত্য-ন্যায়ের রুখে দাঁড়ানো হিসেবে। অনেক সুবিধাবাদী লোক আবার এমন কী এটাকে আহলে সুন্নাত (সুন্নী) ও শিয়া বিরোধের পর্যায়ে টেনে নিয়ে গিয়েছে।

কারবালার প্রকৃত ঘটনার প্রতি কেন্দ্রীভূত এই আংশিক প্রকাশ এবং এর দরুন সুবিধামতো আশূরা’র বিয়োগান্ত উপাখ্যান হতে মনোযোগ অন্যদিকে ফেরানোতে নিহিত রয়েছে আপনাআপনি আরেকটি বিয়োগান্ত উপাখ্যান। কেননা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)’এর শাহাদাতকে ঘনঘন স্মরণ করা, তাঁর বাহ্যিক বিরোধিতাকারী/শত্রু ও খুনিদের শনাক্ত করা, তাদের অভিসম্পাত দেয়া ও বিনাশ সাধন করা হলেও তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (প্রয়োজনের) মুহূর্তে যারা তাঁকে ছেড়ে পালিয়েছিলো, তাদের জন্যে কেউই ক্ষণিকের উষ্মা প্রকাশের প্রয়োজনও বোধ করেন নি। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়াতে লুকোনো লোকগুলোকেই কারবালা’র প্রকৃত দুষ্কৃতকারী আখ্যা দেয়া বিহিত; আর এই লেখাটি তাদের চেহারা আলোতে আনার উদ্দেশ্যেই রচিত।

ঘটনার সূচনা হয়েছিলো ৬০ হিজরী সালের রমযান মাসে, যখন ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (رضي الله عنه) মদীনা মোনাওয়ারা ত্যাগ করে মক্কা মোয়াযযমায় হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (رضي الله عنه)’এর গৃহে অবস্থানকালে কুফা নগরী থেকে পত্রসমূহ আসা আরম্ভ করেছিলো। এসব চিঠিতে এয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহে কুফাবাসী ‘ভক্ত-আশেক্বীন‘দেরকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে তাঁর প্রতি তাকিদ দেয়া হয়, আর তাঁকে কুফাবাসীদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের নিশ্চয়তাও দেয়া হয়। আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه) মাত্র দু মাস আগে বেসালপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর পুত্র এয়াযীদের প্রতি তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছিলো, যাকে দিয়ে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে বায়’আত গ্রহণ করানো হয়েছিলো। বিশেষ করে কুফাবাসী লোকেরা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)’এর নেতৃত্বের দিকে তাকিয়েছিলো; আর তাই সহসা কুফা হতে স্রোতের মতো চিঠিপত্র আসা আরম্ভ করে। কোনো কোনো দিনে এ রকম ৬০০ চিঠি পর্যন্ত এসে পৌঁছুতো; পত্রবাহক-বর্গ কুফাবাসীদের কাছ থেকে তিনি কেমন সমর্থন পেতে যাচ্ছেন তারও উৎসাহব্যঞ্জক বিবরণ প্রদান করতো।

কুফা ছিলো একটি অনন্য স্থান, আর কুফাবাসীদের প্রকৃতিও ছিলো অদ্ভূত। ইতিপূর্বে হিজরী ৩৭ সালে সায়্যিদুনা ইমামে আলী (كرم الله وجهه) তাঁর রাজধানী মদীনা মোনাওয়ারা হতে কুফা’য় স্থানান্তর করেছিলেন। সে সময় হতেই আহলে বায়ত (رضي الله عنهم)’এর পক্ষীয় হওয়ার দাবিদার লোকদের বসতিস্থল হয়ে ওঠে এই শহর। ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’এর সাথে হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه)’এর ৪১ হিজরী সালে সম্পাদিত সন্ধির পরে ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’এর বাহিনীর অনেক সৈন্য কুফায় বসতি স্থাপন করে। হিজরী ৬০ সালে হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه)’এর বেসালপ্রাপ্তির সময় শহরটিতে প্রচুর ইমামে আলী (كرم الله وجهه)-পক্ষীয় আবেগ-অনুভূতি বিরাজমান ছিলো। বস্তুতঃ শহরটি তখনো ইমামে আলী (كرم الله وجهه)-পক্ষীয় ছিলো। এমতাবস্থায় সুযোগ দেখা দেয়া মাত্রই কুফাবাসী, যারা নিজেদেরকে আহলে বায়ত (رضي الله عنهم)’এর শিয়া (সমর্থক) মনে করতো, তারা এয়াযীদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)’এর শরণাপন্ন হয়।

ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আক্বীল (رضي الله عنه)’কে কুফার পরিস্থিতি যাচাই করার জন্যে সেখানে পাঠাতে মনস্থ করেন। তিনি পরিস্থিতি অনুকূল পেলে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে সে কথা লিখে জানাবেন, আর হযরত ইমাম (رضي اللّٰه عنه) সপরিবার মক্কা ত্যাগ করে তাঁর সাথে (কুফায়) যোগ দেবেন। মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) যিলক্বদ মাসে কুফায় এসে পৌঁছেন। তাঁর আগমন সম্পর্কে জানতে পেরে কুফাবাসী লোকেরা মুসলিম ইবনে আওসাজাহ আল-আসাদী’র বাসভবনে উপস্থিত হয়, যেখানে মুসলিম বিন আক্বীল থাকছিলেন। সহসা ১২০০০ কুফাবাসী নিজেদের জান-মালের বিনিময়ে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর পক্ষ সমর্থন ও তাঁর সুরক্ষা দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তথা আনুগত্যের শপথ নেয়। তাদের এই সংখ্যা ১৮০০০ হলে মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে একজন সংবাদবাহককে প্রেরণ করেন কুফাবাসীর বায়’আতের বার্তা-সহ এবং তিনি ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে মক্কা হতে অগ্রসর হবার তাকিদ দেন।

কুফা নগরীতে সংঘটিত ঘটনাবলীর গুজব সহসা দামেশকে অবস্থিত এয়াযীদের কানে পৌঁছোয়। সে তৎক্ষণাৎ কুফার প্রাদেশিক শাসক নু’মান বিন বশীরকে বদলে নিষ্ঠুর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়া’দকে নিয়োগ দেয় এই আদেশসহ যেনো হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়। ইবনে যিয়া’দ কুফায় প্রবেশ করে যিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম দিকে; তার সাথে ঘোড়-সওয়ারী ছিলো (মাত্র) সতেরো জন সৈন্য। তার পাগড়ির প্রান্তভাগ মুখের ওপরে টানা থাকায় তাকে কেউই চিনতে সক্ষম হয় নি; আর কুফাবাসী লোকেরা যারা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতীক্ষায় ছিলো, তারা তাকে ভুল বশতঃ হযরত ইমাম (রা:) মনে করে সাদর অভ্যর্থনা জানায় এই বলে: “সালাম/শান্তি আপনার প্রতি (বর্ষিত হোক), হে রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم)‘এর পৌত্র!” এভাবেই ইবনে যিয়া’দ গুজব যে সত্য সে সম্পর্কে জানতে পারে। তার ঘোড়-সওয়ারী সৈনিকদের একজন যখন কুফাবাসীদের প্রতি চিৎকার করে বলে – “সরে দাঁড়াও! উনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ বিন যিয়া’দ!” – কেবল তখনই কুফাবাসী লোকেরা নিজেদের মারাত্মক ভুল বুঝতে পারে।

প্রাদেশিক শাসনকর্তার বাসভবনে পৌঁছে ইবনে যিয়া’দ তার জনৈক সেবককে ব্যাগভর্তি ৩০০০ দিরহাম দিয়ে সিরীয় হিমস্ শহর থেকে আসন্ন বিপ্লবে অংশগ্রহণেচ্ছু নবাগত ব্যক্তি সেজে হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) কোথায় অবস্থান করছেন সে খবরাখবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। ওই সেবক তাঁকে হা’নী ইবনে উরওয়াহ’র গৃহে খুঁজে পায় এবং তাঁর হাতে আনুগ্রত্যের শপথ গ্রহণ করে। নগদ অর্থটুকু সে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ আবূ সুমা’মাহ আল-আমিরী’র কাছে হস্তান্তর করে। তাঁদের সাথে কিছুদিন অবস্থান করে তাঁদের গোপন কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে যা জানার তার অধিকাংশ জেনে সে ইবনে যিয়া’দের কাছে ফিরে যায় এবং তাকে সব কিছু জানায়। হা’নী ইবনে উরওয়াহ’কে আটক করা হয়। তিনি প্রথমে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর অবস্থান জানেন না বলে অভিযোগটি অস্বীকার করেন, কিন্তু যখন ‘হিমস্ নগরী হতে নবাগত’কে তাঁর সামনে হাজির করা হয়, তখন তিনি স্বীকার করে নেন। তথাপিও তিনি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’এর অবস্থান প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।

হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) ইতোমধ্যে হা’নী ইবনে উরওয়াহ’র আটক হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে শোনেন। চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক মোকাবিলার ক্ষণ উপস্থিত বুঝে তিনি তাঁর রণ-হুঙ্কার দেন – ‘এয়া মানসূর!’ – যার ফলশ্রুতিতে তাঁর কাছে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী ৪০০০ কুফাবাসী আশপাশে জড়ো হয় এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তার দুর্গের দিকে অগ্রসর হয়। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়া’দ যখন নিজের ফটকে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’কে কুফাবাসীদের সাথে দেখতে পায়, তখন সে কুফার কিছু গোত্রপতিকে তাদের নিজেদের লোকদের (মানে ৪০০০ জনের) সাথে আলোচনা করতে এবং তাদেরকে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) হতে দূরে সরাতে প্রেরণ করে; আর দামেশক হতে সেনাবাহিনী এসে পৌঁছুলে তাদের ওপর যে ক্রোধ পতিত হবে, সে সম্পর্কেও তাদেরকে সতর্ক করতে গোত্রপতিদের পাঠানো হয়। সহসা হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে অবস্থানরত সৈন্যদের মায়েরা তাদের পুত্রদের বলে, “বাড়ি ফিরে এসো, এখানে অন্য অনেক লোক আছে।” তাদের বাবারা আপন আপন পুত্রদের ভয়-জাগানো ভাষায় সতর্ক করে, “কাল কী হবে, যখন সিরীয় সেনাবাহিনী আগমন করা শুরু করবে? তখন তোমরা কী করবে?” এয়াযীদ ও তার সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) ও আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর (মহৎ) উদ্দেশ্যকে সমর্থন ও সুরক্ষার পবিত্র শপথ যে লোকেরা নিয়েছিলো, সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তাঁর নিকটজন-সহ ঠিক ওই মুহূর্তে যাদের আনুগত্যের শপথের ওপর ভরসা রেখে কুফা অভিমুখে যাত্রারত ছিলেন, সেই কুফাবাসী লোকেরা ওই হুমকি ও নিরুৎসাহিতকরণের মুখে নিজেদের স্থির-সংকল্প ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিক শাসকের দুর্গে অবস্থিত ফটকের নিচেই তারা এক এক করে হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে ত্যাগ করে। সূর্যাস্ত নাগাদ তাঁর সাথে মাত্র ৩০ জন অবশিষ্ট থাকে। তিনি মাগরেবের নামাযে তাদের ইমামতি করেন এবং কুফার কিনদাহ বসতির দ্বারে সরে যান। সেই দ্বার দিয়ে তিনি প্রবেশ করেন মাত্র দশজনকে সাথে নিয়ে। তাঁর কোনো কিছু বোঝার আগেই কুফার রাস্তাগুলোতে তিনি নিজেকে একা দেখতে পান। ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’কে যারা এয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে এতো আগ্রহ সহকারে পত্র লিখেছিলো, আর কিছুদিন আগেও ১৮০০০ লোক যারা নিজেদের ডান হাত বাড়িয়ে প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর দৌহিত্রের যে আদর্শকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁরই পক্ষে হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه)’এর হাতে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো, তাদের কেউই ওই রাতে নিজেদের সঙ্গ দ্বারা হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে উপস্থিত ছিলো না।

হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه) অবশেষে তেষ্টায় কাতর হয়ে একটি গৃহের দরজায় টোকা দেন। বাড়িতে বসতকারিনী বৃদ্ধা তাঁর পরিচয় জানার পর তাঁকে ঘরে প্রবেশ করতে দেন। তিনি তাঁকে লুকিয়ে রাখেন; কিন্তু তাঁর পুত্র যার থেকে ওই বৃদ্ধা নারী ওয়াদা নিয়েছিলেন কারো কাছে এ কথা প্রকাশ না করতে, সে কেবল সকাল অবধি অপেক্ষা করেছিলো, যতোক্ষণ না সে প্রাদেশিক শাসনকর্তার বাসভবনে এই খবর পৌঁছে দেয়। অতঃপর হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) বুঝতে পারেন ওই ঘরটি ঘেরাও দেয়া হয়েছে। তাঁর তরবারি বের করে তিনি আক্রমণকারীদেরকে তিনবার পিছু হটিয়ে দেন; কিন্তু তারা যখন ঘরে আগুন দিতে নেয়, তখনই তিনি ঘরের বাইরে এসে তাদেরকে মোকাবিলা করতে বাধ্য হন। তাঁকে আটক করার দায়িত্বপ্রাপ্ত আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আশ’আস্ তাঁর জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরই কেবল তিনি তরবারি অবনমন করেন। এটা একটা ভুল ছিলো, কেননা তারা তাঁর তরবারি কেড়ে নেয় এবং তাঁকে ইবনে যিয়াদের কাছে নেয়ার জন্যে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে দেয়। হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) বুঝতে পারেন তাঁর শাহাদাৎ অনিবার্য। তাঁর চোখ হতে অশ্রু বেয়ে পড়ে – নিজের তাক্বদীর/ভাগ্যের জন্যে নয়, বরং ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) ও তাঁর পরিবার-সদস্যদের দুশ্চিন্তায়, যাঁরা কঠোর, নির্দয় মরু অঞ্চল পাড়ি দিয়ে আরো কঠোর ও নির্দয় তাক্বদীরের তথা নিয়তির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন; অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন এক শত্রুর দিকে, যে তাঁর (সাহসী) উদ্যোগের ইতি টানতে ছিলো বদ্ধপরিকর; আর অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন এক বিশ্বাসঘাতক পক্ষের দিকে, সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহূর্তে যাদের পক্ষত্যাগ তাঁর জীবনকে এই বিয়োগান্ত পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। হযরত মুসলিম (رضي اللّٰه عنه) ইবনে আল-আশ’আসের কাছে মিনতি করেন যাতে কেউ ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে নিম্নের বার্তাটি পৌঁছে দেন: “আপনার (হযরত ইমামের) কাছে ইবনে আক্বীল আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনাকে বলেছেন, ‘আপনার পরিবারসহ আপনি ফেরত চলে যান। কুফার লোকদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত হবেন না। তারা আপনার পিতার সেই একই সমর্থক দল, যাদের কাছ থেকে আপনার পিতা একান্তভাবে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন – বেসালপ্রাপ্তি অথবা শাহাদাৎ দ্বারা। কুফাবাসী আমার কাছে মিথ্যে বলেছে, আপনার সাথেও মিথ্যাচার করেছে; আর একজন মিথ্যুকের কোনো জ্ঞান ও অনুভূতি নেই’।”

ওই দিন, ৯ই যিলহজ্জ্ব আরাফাত দিবসের পরের বেলায়, হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (رضي اللّٰه عنه)’কে দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠানো হয়। তাঁকে সেখানে নেয়ার মুহূর্তে তিনি তসবীহ, তাহলীল, তাকবীর ও ইস্তিগফার পাঠ করেন। তাঁর শেষ কথাগুলো কুফাবাসীদের প্রতি নিজের চরম হতাশা প্রতিফলন করে: “হে আল্লাহ, আমাদের ও আমাদের লোকদের মাঝে আপনি-ই হোন বিচারক। তারা আমাদের প্রতারিত করেছে এবং আমাদের পক্ষত্যাগ করেছে।” কেল্লার সর্বোচ্চ চূড়া থেকে তাঁর শির মোবারক নিচে ধুলোয় পতিত হয় – তাদেরই জাজ্বল্যমান দৃষ্টির সম্মুখে, যাদের আমন্ত্রণ ও আনুগত্যের শপথ তাঁকে এতো আশান্বিত করেছিলো, অথচ যাদের কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে হতাশা ছাড়া কিছু এনে দেয় নি। আর ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তখন পথে….।

(চলবে)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment