মহান প্রভু আল্লাহ্ তা’লার নামে আরম্ভ করছি। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি জানাচ্ছি অসংখ্য সালাত ও সালাম। তাঁর খাঁটি ও নির্মল আহলে বায়ত (পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন), আসহাবে কেরাম (সম্মানিত সাথীবৃন্দ), আয্ওয়াজে মোতাহ্হারাত (পবিত্র বিবিগণ), সালাফে সালেহীন (পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীন), মোতা’খেরীন (পরবর্তী যুগের পুণ্যবান জ্ঞান বিশারদবৃন্দ), বুযূর্গানে দ্বীন ও আউলিয়ায়ে কামেলীনের প্রতিও জানাচ্ছি আমাদের শত সহস্র সালাত-সালাম। বিশেষ করে আহলা দরবার শরীফের মহান আউলিয়ায়ে কেরাম, কুতুবে যমান হযরত কাজী আসাদ আলী সাহেব কেবলা (রহ:), হাজতে রওয়া, মুশকিল কোশা, সুলতানুল মোনাযেরীন হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সাহেব কেবলা (রহ:) এবং আমার পীর ও মুরশিদ হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহ:)-এর প্রতি আন্তরিক সালাম ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে এ লেখার প্রয়াস পাচ্ছি।
সৃষ্টির আদিতে রাব্বুল আলামীন খোদাতা’লা ছিলেন রহস্যের গুপ্ত ভাণ্ডার। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীসে কুদসীতে তিনি এরশাদ ফরমান- “আমি ছিলাম রহস্যের গুপ্ত ভাণ্ডার। অতঃপর প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি মনস্থ করলাম।” তাঁর এ প্রকাশ হবার প্রক্রিয়ায় তিনি ধরণীর বুকে তাঁরই খলীফা বা প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্তটি পাক কালামে ঘোষণা করেছেন। এরশাদ হয়েছে-
”আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণকারী (সুরা বাকারা, ৩০ নং আয়াত)। আয়াতোল্লিখিত “প্রতিনিধি” শব্দটিকে তাফসীর গ্রন্থসমূহে আল্লাহ্ তা’লার নবী-রাসূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হযরত আদম (আ:) থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলই মহান আল্লাহ পাকের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আমাদের মহানবী (দ:) যে আল্লাহ্ পাকের মূল খলীফা বা প্রতিনিধি তা অপর এক হাদীসে কুদসীতে প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ ফরমান- “হে রাসূল! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি আসমানসমূহ তথা বিশ্বজগত সৃষ্টি করতাম না।” আমাদের উদ্ধৃত দুটো হাদীসে কুদসীতে প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ্ তা’লা বিশ্বনবী (দ:)-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হতে চেয়েছিলেন।
মাধ্যম দ্বারাই আল্লাহ্ তা’লা নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। পৃথিবীতে যা কিছু বিরাজমান তার সবই কোনো না কোনো মাধ্যম দ্বারা জারি হয়েছে বা আছে। বস্তুতঃ মহান স্রষ্টা এভাবেই সৃষ্টি প্রক্রিয়া জারি করেছিলেন এবং এখনো তা জারি আছে। আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদে এরশাদ ফরমান –
“হে মু’মিন (বিশ্বাসী)-গণ! আল্লাহকে ভয় করো (অর্থাৎ, পরহেযগার হও তথা সওয়াবদায়ক আমল পালন করো এবং হারাম বর্জন করো) ও তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্যে ওসীলা বা মাধ্যম অন্বেষণ করো (সূরা মায়েদা, ৩৮ আয়াত)।
মওলানা সূফী আবদুল হাকিম আরওয়াছী তুর্কী (রহ:) তাঁর কৃত ’রাবেতায়ে শরীফা’ শীর্ষক পুস্তিকায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ওসীলাটি যে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ্ (দ:), তা সূরা আলে ইমরানের ৩৯ আয়াতে বর্ণিত ঐশী আদেশে জানানো হয়েছে –
’যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন’ (আল্ কুরআন)। ‘উলামায়ে হাক্কানী নবী (আ:)-গণের উত্তরাধিকারী’- হাদীসটি পরিস্ফুট করে যে আউলিয়াগণও ওসীলা” (রাবেতায়ে শরীফা)।
বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা’লার ফয়েয ও মারেফাত অত্যন্ত তাজাল্লীপূর্ণ, ঠিক আগুনের মতো। কেউ যদি রুটি বানিয়ে সরাসরি আগুনে দেয়. তাহলে তা পুড়ে যাবে। কিন্তু যদি সে রুটি সেকার জন্যে তাবা ব্যবহার করে, তাহলে রুটি পুড়বে না। ঠিক তেমনি আল্লাহ্ তা’লার ফয়েয ও মারেফত অন্তরে গ্রহণ করতে হলে একজন কামেল পীর-মুরশিদের প্রয়োজন যিনি তাঁর মুরীদের অন্তরকে আল্লাহ তা’লার নূরের তাজাল্লী সহ্য করার ও গ্রহণ করার সামর্থ্য অর্জনে সহায়তা করতে সক্ষম। মুরীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, এ ক্ষেত্রে তার পীরের সাথে আত্মিক যোগাযোগ বজায় রাখা এবং তা থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া। অর্থাৎ, তাকে নিজ পীরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখতে হবে ও পূর্ণ আস্থাশীল হতে হবে।
কামেল (পূর্ণতাপ্রাপ্ত) পীরের কাছে বায়া’ত হওয়া অপরিহার্য। কেননা, সূরা মায়েদাতে ওসীলা গ্রহণের আয়াতটি আজ্ঞাসূচক। এক্ষণে বায়া’ত হবার বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবো। আরবী ‘বায়া’ত’ শব্দের অর্থ বিক্রি হয়ে যাওয়া। এর ব্যবহারিক অর্থ কোনো কামেল পীরের কাছে ইসলামী প্রথানুযায়ী মুরীদ হওয়া বা শিষ্যত্ব গ্রহণ করা। এই ইসলামী প্রথা মহানবী (দ:)-এর সময় থেকেই চালু হয়েছে। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে-
”নিশ্চয় আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন ঈমানদারদের প্রতি যখন তারা বৃক্ষের নিচে আপনার কাছে বায়া’ত গ্রহণ করছিলো (সূরা ফাতহ, ১৮ আয়াত)। একইভাবে সূরা ফাতহ ১০ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
”ওই সব মানুষ যারা আপনার কাছে বায়া’ত গ্রহণ করছে, তারা তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছেই বায়া’ত গ্রহণ করছে; তাদের হাতগুলোর ওপর রয়েছে আল্লাহ্ তা’লার কুদরতের হাত” (আল্ কুরআন)। বায়া’তের এই ইসলামী প্রথা মহানবী (দ:)-এর বেসাল তথা আল্লাহ্ তা’লার সাথে পরলোকে মিলিত হবার পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:), হযরত ওমর ফরুক (রা:), হযরত ওসমান যিন্নুরাইন (রা:) ও হযরত আলী (ক:) এবং তারও পরে তরীকতের পীর-মাশায়েখবৃন্দ জারি রাখেন। বায়া’ত কীভাবে গ্রহণ করা হতো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা:) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) ঘোষণা করতেন: তোমরা আমার কাছে প্রতিশ্রুতি দাও ও শপথ করো যে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, অবৈধ যৌনাচার করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, একে অপরের কুৎসা রটনা (গীবত) থেকে বিরত থাকবে, পাপাচার থেকে বিরত থাকবে; আর যে ব্যক্তি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, তার জন্যে পুরস্কার সর্বশিক্তমান ও মহান আল্লাহর তরফ থেকে থাকবে।’ অতঃপর আমরা মহানবী (দ:)-এর কাছে এ মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতাম ও শপথ করতাম” (আল্ বুখারী ও মুসলিম)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) এ বিষয়ে বলেন: “আমরা যখন মহানবী (দ:)-এর কাছে (খোদায়ী আজ্ঞা) শোনার ও মানার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতাম, তখন তিনি বলতেন, ‘তোমাদের সাধ্যানুযায়ী’ (আল্ বুখারী ও মুসলিম)।
বায়া’তের ইসলামী প্রথা সম্পর্কে দেওবন্দী মৌলভী আবুল হাসান নদভীও তার ’রিজালুল ফিকর ওয়াদু দাওয়া’ পুস্তকের ২৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছে, “সূফী তরীকার গাউস, হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ:), হযরত মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী (রহ:) এবং নকশবন্দী সিলসিলার পীর-মাশায়েখবৃন্দ বায়া’তের দরজা যতোটুকু সম্ভব উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, যাতে করে প্রত্যেক সত্য ও একনিষ্ঠ বিশ্বাসী ব্যক্তি তাঁর জন্যে আত্মিকভাবে মূল্যবান কোনো বস্তু খুঁজে পান এবং সবাই যেন সর্বশক্তিমান ও মহান আল্লাহ্ তা’লার সাথে তাঁদের (পূর্ব) প্রতিশ্রুতির নবায়ন করতে পারেন। নকশবন্দী সিলসিলার এবং অন্যান্য সূফী তরীকার পীর-মাশায়েখবৃন্দ তাঁদের মুরীদদেরকে এমন এক সত্যবাদিতার মাকামে (পর্যায়ে) উন্নীত করেছিলেন, যেখানে তারা বায়া’তের দায়িত্ব উপলব্ধি ও অনুভব করতে পেরেছিলেন এবং নিজেদের বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।”
• কামেল পীরের বৈশিষ্ট্য
একজন কামেল পীরের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো তাঁকে আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা (কুরবাত) ও রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর নায়েব (প্রতিনিধি) হিসেবে দ্বীনের (ধর্মের) যাহেরী (প্রকাশ্য) এবং বাতেনী (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানে একজন আলেম বা জ্ঞান বিশারদ হতে হবে। মোট কথা, ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখায় তাঁর অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে। তাঁকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কেও জানতে হবে। দ্বিতীয়তঃ তাঁকে আরেফ বা ভেদের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞানী হতে হবে। তাঁর ইহ্সান অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে, যেমন মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর এবাদত এমনভাবে করো যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো, আর যদি না দেখতে পাও তবে এটি জানো যে তিনি তোমাকে দেখছেন” (আল হাদীস)। একজন আরেফ তাঁর অন্তরে সাক্ষ্য দেবেন যে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর যাত মোবারক, গুণাবলী ও কর্মে এক ও অনন্য। তৃতীয়তঃ কামেল পীর তাঁর পীরের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যেই পরিশুদ্ধ। তাঁকে নফস তথা একগুঁয়ে সত্তার বিভিন্ন স্তর বা পর্যায়, রোগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হতে হবে। শয়তান কোন্ কোন্ পদ্ধতিতে কলব্ বা অন্তরে প্রবেশ করতে পারে তাও তাঁকে জানতে হবে। তাঁর মুরীদদের পরিশুদ্ধ করা এবং কামেলিয়াত বা পূর্ণতার পর্যায়ে উন্নীত করার সকল পদ্ধতিও তাঁর জানা থাকা প্রয়োজন। চতুর্থতঃ তরীকতের পথে অনুসারীদের পথ দেখানোর ক্ষেত্রে একজন কামেল পীরের প্রয়োজন তাঁর পীর কেবলার এজাযত বা অনুমতি। বস্তুতঃ একজন কামেল পীরের বৈশিষ্ট্য ও গুণ হলো তাঁকে দেখলেই আল্লাহর কথা স্মরণ হবে, তাঁর কথাবার্তা শুনলে ঈমান সজীব ও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।