কা’ব বিন আশরাফ হত্যার ঘটনা:

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

কা’ব বিন আশরাফ ছিলো একজন ইহুদী নেতা এবং খুবই প্রভাব সৃষ্টিকারী জ্বালাময়ী কবি। যখন বদরে মুসলমানদের বিজয়ের সংবাদ মদীনায় পৌছালো, তখন কা’ব বিন আশরাফ সেই সংবাদ শুনে বলল, “যদি এই সংবাদ সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের জন্য মাটির নিচে থাকাই তার উপরে থাকার চেয়ে উত্তম। অর্থাৎ মৃত্যুই আমাদের জন্য শ্রেয়। কুরাইশদের পরাজয়ের পর আর বেঁচে থেকে কি লাভ!”

সে মুশরিকদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে কবিতা রচনা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো শুরু করলো। এরপর সে মক্কায় তার কবিতা ছড়িয়ে দিলো। কুরাইশদের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করে যুদ্ধে তাদের ক্ষয়-ক্ষতিতে দুঃখ প্রকাশ করলো। শুধু এ পর্যন্তই নয়, এর থেকেও আরো বেড়ে গিয়ে সে এবার করে তার কবিতার মাধ্যমে মুসলিম নারীদেরকেও কটাক্ষ করা শুরু করলো। তাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

‎‫من لى بكعب إبن الأشرف فإنه قد أذى الله و رسوله‬‎ 

অর্থ: “কে এমন আছে? যে কা’ব ইবনে আশরাফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে! কেননা সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিচ্ছে।”

রাসূলের এই আহ্বান শুনে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রা. যিনি আউস গোত্রের একজন বিশিষ্ট আনসার সাহাবী ছিলেন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আদেশ করুন আমি আছি।

আপনি কি এটা চাচ্ছেন যে আমি তাকে হত্যা করি?” 

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে নির্দেশনা পেয়ে এবার মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রা. এবার অঙ্গীকার করলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কথা দিলেন যে তিনি নিজে কা’ব ইবনে আশরাফকে হত্যা করবেন।

 বাসায় গিয়ে বিষয়টি নিয়ে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রা. চিন্তা করতে লাগলেন। ব্যাপারটা তাঁর কাছে যেন কঠিন মনে হলো। কারণ কা’ব ইবনে আশরাফ তার সমর্থক দিয়ে পরিবেষ্টিত একটি দূর্গে থাকতেন যা ছিলো ইহুদী বসতির মধ্যে। তাই এই দুর্ভেদ্য দূর্গের ভেতর গিয়ে তাকে হত্যা করাটা ছিলো অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তিনি ভাবতে লাগলেন কিন্তু কোন কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিষয়টি তাঁর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিল। জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য সামান্য কিছু আহার্যের বাইরে তিনি পানাহার করতে পারছিলেন না। এভাবে প্রায় তিনদিন কেটে গেলো।

এই খবর আল্লাহর রাসূলের নিকট পৌছলে তিনি তাঁকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “তোমার কি হয়েছে হে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ? এটা কি সত্য যে তুমি পানাহার করা বন্ধ করে দিয়েছো?”

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ রা. বললেন, “জি হ্যাঁ।” 

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন?”

তিনি বললেন, “আমি আপনার কাছে একটি অঙ্গীকার করেছি আর সেই অঙ্গীকার পূরণ করা নিয়েই আমি চিন্তিত।”

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন,

‫إنما عليك الجهد‬‎

(অর্থ: “তোমার কাজ তো কেবল চেষ্টা করা। বাকিটা সম্পন্ন করার দায়িত্ব মহান আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও।”

প্রিয় ভাই ও বোনেরা! আসুন আমরা এ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবি। আমরা একটি মুহূর্তের জন্য থামি এবং হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়ে বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করি যে এই সাহাবী রা. কি অধিক পরিমাণ আনুগত্য ও উদ্দীপনার মধ্যে ছিল। তিনি পরিস্থিতি নিয়ে এত বেশী চিন্তিত ছিলেন যে, তিনি পাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছিলেন না। কারণ এটি ছিল তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

তিনি অঙ্গীকার করেছেন এবং তারপর তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে তিনি কি সেই অঙ্গীকার পালন করতে পারবেন কিনা ।

যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সাহস দিলেন, আশ্বস্ত করে বললেন, “তুমি তোমার চেষ্টা কর, আর বাকীটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও”, তখনই তিনি আশ্বস্ত হলেন এবং পুনরায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করলেন।

আজকে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবমাননার বিষয়টি নিয়ে আপনি কতটুকু চিন্তিত? আমরা কতটুকু উদ্বিগ্ন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মানের ব্যাপারে, ইসলামের মর্যাদা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কিতাবের বিষয়ে?

আমরা বিষয়গুলোকে কতটা গুরুত্ব সহকারে নেই ? মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রা. একাধারে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে চিন্তা করছিলেন। আজ আমরা মুসলিমদের মাঝে পুনরায় এই সাহাবীর মনোভাবেরই পুনরাবৃত্তি চাই ।

মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রা. তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য একটি পরিকল্পনা করলেন। এজন্য রাসূলের কাছে একটি বিষয়ের অনুমতি চাইলেন।

 প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে তাহলে আপনার বিরুদ্ধে কথা বলার অনুমতি দিতে হবে।” [পরিকল্পনার বিষয় হলো যে, আমাকে আপনার ব্যাপারে নেতিবাচক কথা বলতে হবে] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এ ব্যাপারে তোমাকে অনুমতি দেয়া হলো।”

এবার মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রা. আনসারদের মধ্যকার আওস গোত্র থেকে অল্প কয়েকজনকে নিয়ে ছোট একটি জামাত গঠন করলেন। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন আবূ নায়লা।

কথিত আছে যে আৰু নায়লা ছিলেন কা’ব বিন আশরাফের সৎভাই। তাঁরা কা’ব ইবন আশরাফের জন্য একটি ফাঁদ পাতলেন।

মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রা. তাঁর ক্ষুদ্র দলটি নিয়ে কা’ব ইবন আশরাফের সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন। কাব এর সাথে দেখা হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আল্লাহর রাসূলের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি কা’বকে বললেন, “এই লোকটি আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে একটি পরীক্ষা ও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে একটি দুর্যোগ এবং তাঁর জন্যই পূরো আরব আমাদের শত্রু হয়ে গেছে এবং আমাদের সাথে লড়াই করছে।” কা’ব বললো, “আমি তো এটি জানতাম। তাই তো তোমাদের আগেই বলেছি এবং সামনে তোমরা আরও বিপদে পড়বে, খারাপ সময় দেখবে।”

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ বললেন, “আমরা অপেক্ষা করতে চাই এবং দেখতে চাই এর শেষ কিভাবে হয়।” তিনি এখন কাবের সাথে একটি ভাব তৈরী করার চেষ্টা করতে লাগলেন। 

তিনি বললেন, “হ্যাঁ, কা’ব, লোকটার জন্য আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, আর্থিকভাবে একটু সমস্যায় পরে গেছি। তোমার কাছ থেকে আমরা কিছু অর্থ ধার নিতে চাই, যার বিনিময়ে প্রয়োজনে তোমার নিকট কিছু জামানাতও রাখতে রাজি আছি।” কা’ব বলল, “ঠিক আছে, তাহলে তোমাদের সন্তানদের রেখে যাও।”

তাঁরা বললো, “তোমার কাছে আমাদের সন্তানদের রেখে গেলে তাদের বাকী জীবন এই খোঁটা শুনতে হবে যে, সামান্য ঋণের জন্য তাদের পিতা তাদেরকে বন্ধক রেখেছিল। এটি তাদের সারা জীবনের জন্য একটি লজ্জাস্কর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।” কা’ব বললো, “তাহলে তোমাদের স্ত্রীদের রেখে যাও।”

তাঁরা বললো, “তোমার মতো সুদর্শন পুরুষের নিকট আমরা কিভাবে আমাদের স্ত্রীদের রেখে যাবো? তার চেয়ে বরং আমরা আমাদের অস্ত্রগুলো তোমার নিকট বন্ধক রেখে যেতে পারি।” সে বলল, “ঠিক আছে, এটি হতে পারে।”

মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ কাবের জন্য এভাবে ফাঁদ পাতলেন। যাতে তার কাছে পরের বার অস্ত্র আনতে গেলে সে সন্দেহ না করে। তিনি পরবর্তী সাক্ষাতের জন্য রাতের একটি মুহূর্তকে নির্ধারণ করলেন এবং নির্ধারিত

সেই সময়ে, গভীর রাতের উপযুক্ত এবং সঠিক সময়ে তার কাছে ফিরে এলেন। ঘরের বাইরে থেকে এবার তিনি কা’বকে ডাক দিলেন। কাবের স্ত্রী সেই আওয়াজ শুনে বলল, “আমি এই ডাকের মধ্যে রক্তের গন্ধ পাচ্ছি।”

কা’ব বলল, চিন্তা করো না, “এটি হচ্ছে আমার বন্ধু মাসলামাহ এবং আমার ভাই আবু নায়লা ।”

এতে বুঝা যায় যে, তাদের মাঝে জাহেলিয়াতের সময় থেকেই সুসম্পর্ক ছিলো, বন্ধুত্ব ছিলো।

অতঃপর সে নিচে গেলো মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ রা. ও তাঁর সাথীদের সাথে দেখা করতে। ইতোমধ্যে তাঁরা একটি সংকেত ঠিক করে নিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ তাঁদের বললেন, “আমি কৌশলে ওর মাথা ধরবো। যখন তোমরা আমাকে ওর মাথা ধরতে দেখবে, তখনই তালোয়ার দিয়ে তাকে শেষ করে দেবে।” এটাই ছিল তাদের সংকেত।

কা’ব আসতেই তারা তাকে বললেন, “আজকের রাতটি শি’ব আল আজ গিয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়?” সে বলল, “বেশ।”

এভাবে তারা তাকে তার দূর্গ থেকে বের করে শি’ব আল আযুজ নামক স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো।

সেখানে পৌঁছানোর পর, মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ কা’বকে বললেন, “বাহ! তোমার থেকে তো অনেক সুন্দর ঘ্রান আসছে। আমি কি এর মান নিতে পারি?” এটা বলে তিনি কা’বের চুলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। চুলে তেলজাতীয় কোন সুগন্ধী লাগানো ছিল। সে বলল, “হ্যাঁ, নাও । ”

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ তার হাত দিয়ে কাবের মাথাটাকে টেনে নিলেন এবং শুকে দেখলেন। তিনি বললেন, “এটাতো দারুণ। (এটি ছিল দেখার জন্য একটি পরীক্ষা।)”

তিনি বললেন, “তুমি কি আরেকবার আমাকে এর ঘ্রান নিতে দেবে? সে বলল, “হ্যাঁ, নাও ।

এবার তিনি তার মাথার চুল গুলোকে ভালোভাবে ধরলেন এবং তলোয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করতে থাকলেন। সাথে আসা আওসের সাহাবীরাও এগিয়ে এলেন। কিন্তু সেগুলো তাকে মারার জন্য যথেষ্ট ছিল না এবং সে সাহায্যে জন্য চিৎকার করে উঠল। তাৎক্ষণিকভাবে সবগুলো দূর্গতে আলো জ্বলে ওঠল। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ বললেন, “আমার মনে পড়ল যে আমার কাছে একটি ছুরি আছে। তাই আমি সেটা বের করে তা দিয়ে তার তলপেটে আঘাত করলাম। একেবারে নিম্নাংশের হাড় পর্যন্ত সেটি গেঁথে দিলাম এবং কাজ শেষ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলাম।”

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ এবং আওসের লোকেরা এভাবেই সেই পাপাচারী শয়তানকে দেখে নিয়েছিলেন, যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিরস্কার করত ।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment