আটান্নতম অধ্যায়ঃ কাফন দাফনের অগ্রীম সংবাদঃ
প্রসঙ্গঃ গোসল ও কাফন-দাফনঃ
============
নবী করিম [ﷺ] অসুস্থ অবস্থায়ই নিজের ইন্তিকালের পরবর্তীকালের সমস্ত অনুষ্ঠানাদির বিস্তারিত বিবরণ অগ্রিম বলে যান। কখন ইন্তিকাল হবে, কে গোসল দেবে, কোন্ দেশীয় কাপড় দিয়ে কাফন দেয়া হবে, কোন্ স্থানের পানি দিয়ে গোসল করানো হবে, কে প্রথম জানাযার সালাত আদায় করবে, কোন ধরণের জানাযা বা সালাত পড়া হবে, কে হুযুর [ﷺ]-কে রওযা মোবারকে নামাবে – ইত্যাদি বিষয়ে হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)-এঁর প্রশ্নের জবাবে নবী করিম [ﷺ] অগ্রিম বলে গেছেন। ইমাম বায়হাকী কর্তৃক সংগৃহীত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণিত ইলমে গায়েব সম্বলিত এই হাদীসখানা ইবনে কাছির – ইবনে তাইমিয়ার অনুসারী হয়েও, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। তার অনুবাদ নিচে পেশ করা হলো।
হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণনাঃ
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, যখন নবী করিম [ﷺ] অসুস্থতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়লেন, তখন আমরা কতিপয় ঘনিষ্ট সাহাবী হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) -এঁর গৃহে একত্রিত হলাম। আমাদেরকে দেখে নবী করিম [ﷺ]-এঁর দুচোখ পানিতে ভরে উঠলো। তিনি আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ-
“বিদায়কাল অতি নিকটবর্তী। তোমাদের শুভ হোক। আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তমভাবে জীবিত রাখুন। আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত দান করুন। তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করুন। তোমাদেরকে উপকৃত করুন। তোমাদেরকে উত্তম কাজের তৌফিক দিন। দ্বীনের পথে তোমাদেরকে দৃঢ় রাখুন। তোমাদেরকে তিনি হেফাযত করুন। তোমাদেরকে সাহায্য করুন। তোমাদেরকে কবুল করুন। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর প্রতি ভয়-ভীতির জন্য অসিয়ত করে যাচ্ছি। আমার ইন্তিকালের পর তোমাদের জন্য আল্লাহকে হেফাযতকারী রেখে গেলাম। আমি তোমাদের জন্য তাঁর পক্ষ হতে সুস্পষ্ট সতর্ককারী। তোমরা আল্লাহর বান্দার ব্যাপারে এবং আল্লাহর রাজত্বে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করবে না।”
তারপর তিনি পরকালের শান্তি ও শাস্তি সম্পর্কিত দুটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন। ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, আমরা আরয করলাম – ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার ইন্তিকাল কখন হবে? উত্তরে নবী করিম [ﷺ] বললেন “নির্ধারিত সময় নিকটবর্তী। উত্তম বিছানা, পরিপূর্ণ পানপাত্র, সিদরাতুল মুনতাহা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘনিয়ে আসছে।”
আমরা পুনরায় আরয করলাম – ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনাকে গোসল দেবে কে? হুযুর [ﷺ] বললেন – “আমার আহলে বাইতের পুরুষগণ; অতি নিকটজন, তারপর ক্রমান্বয়ে অন্যরা। সাথে থাকবে অনেক ফেরেশতা। তারা তোমাদেরকে দেখেন, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখোনা।“
আমরা আরয করলাম – ইয়া রাসুলুল্লাহ! কোন্ ধরণের কাপড় দিয়ে আপনার কাফন পরানো হবে? এরশাদ করলেন, “আমার পরিধানের জামা দ্বারা এবং ইয়ামেন দেশীয় কাপড় দ্বারা অথবা মিশরীয় সাদা কাপড় দ্বারা।”
আমরা আরয করলাম – ইয়া রাসুলুল্লাহ! কে আপনার উপর সালাত বা জানাযা আদায় করবে? একথা শুনে তিনি কাঁদলেন, আমরাও কাঁদলাম। অতঃপর তিনি বললেন – “এ প্রসঙ্গ বাদ দাও। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন এবং তোমাদের নবীর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তিনি উত্তম পুরস্কার দান করুন। শুনো! যখন তোমরা আমাকে গোসল দিয়ে সুগন্ধি লাগাবে এবং কাফন পরাবে, তখন তোমরা আমাকে আমার রওযার কিনারে রেখে কিছুক্ষণের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। কেননা, এ সময়ে আমার দুই বন্ধু – জিবরাঈল ও মিকাঈল, এরপর ইস্রাফীল, তারপর মালাকুল মউত অন্যান্য ফেরেশতাগণকে সাথে নিয়ে আমার উপর দুরুদ পাঠ করবে। এরপর প্রথমে আমার আহলে বাইত বা পরিবারবর্গের পুরুষেরা আমার উপর দুরুদ পাঠ করবে। এরপর আমার পরিবারের মহিলাগণ দরুদ পড়বে। এরপর তোমরা ভাগে ভাগে আমার গৃহে প্রবেশ করে দরুদ পড়বে অথবা একা একা এসে দরুদ পড়বে। রোনাজারীকারিনী কোন মহিলা দ্বারা আমাকে কষ্ট দিও না। আমার যেসব সাহাবী উপস্থিত হতে পারবে না, তাঁদের কাছে আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিও। আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি – যারা ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত করবে, যারা আমার দ্বীনের বিষয়ে আমার অনুসরণ করবে, আমি তাদের সকলকে সালাম দিয়ে গেলাম।”
আমরা পুনরায় আরয করলাম – ইয়া রাসুলুল্লাহ! কে আপনাকে রওযা মোবারকে নামাবে? নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করলেন – “আমার পরিবারস্থ পুরুষ লোকজন, নিকটতম ব্যক্তি, তারপর ক্রমানুসারে অন্যরা। সাথে অনেক ফেরেশতা প্রবেশ করবে – যারা তোমাদেরকে দেখছেন, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাচ্ছোনা।” (বায়হাকী সূত্রে আলবেদায়া ও নেয়াহায়া ৫ম খ- ২৫৩ পৃষ্ঠা)।
দাফনের বিলম্বের কারণঃ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী করিম [ﷺ]-এঁর গোসল ও কাফন-দাফনের পূর্বে খলিফা নির্বাচন করা ছিল রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খলিফা নির্বাচনের পূর্বে এসব কাজ কার নেতৃত্বে করা হবে – এ নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তদুপরি, খলিফা নির্বাচন না করে কাফন-দাফন করে ফেললে প্রশাসনে শূন্যতা দেখা দিবে। তাই খলিফা নির্বাচন করা ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিলম্বের এটাই একমাত্র কারণ। সোমবারের অর্ধদিন এবং মঙ্গলবারের প্রথমভাগে উক্ত রাষ্ট্রীয় কাজ সমাধা করে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর নেতৃত্বে এবং তাঁর আদেশে গোসল ও কাফন-দাফনের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করেছেন, “নবীগণ যেখানে ইন্তিকাল করেন, সেখানেই তাঁদেরকে দাফন করা হয়।”
সে মোতাবেক হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) -এঁর হুযরার ভিতরে রওযা মোবারক তৈরীর নির্দেশ দিলেন। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) মদিনা শরীফের আবু তালহা ইবনে সহল আনসারী (رضي الله عنه)-কে রওযা মোবারক খনন করার জন্য আনয়ন করেন। তিনি মদিনাবাসীদের অনুকরণে বগলী কবর খনন করেন এবং উপরে কাঁচা ইটের টাইল্স দ্বারা রওযা মোবারককে আবৃত করেন।
গোসল মোবারকঃ
হযরত আলী (رضي الله عنه), হযরত আব্বাস (رضي الله عنه), তাঁর ছেলে হযরত ফযল (رضي الله عنه), অপর ছেলে কুসাম (رضي الله عنه), নবী করিম [ﷺ]-এঁর পালিত পুত্রের ছেলে হযরত উসামা (رضي الله عنه) এবং তাঁর আশ্রিত হযরত সালেহ (رضي الله عنه) গোসল দেওয়ার জন্য নির্ধারিত হলেন। মদিনার জনৈক আনসার সাহাবী হযরত আউছ ইবনে আওলা (رضي الله عنه) হযরত আলীর (رضي الله عنه) অনুমতি নিয়ে গোসলে শরীক হন। নবী করিম [ﷺ]-এঁর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক কোবার ‘গারছ’ নামক কূপ থেকে পানি আনা হলো। পানির সাথে বরই পাতা ও কাপুর দেয়া হলো।
গোসলের সময় শরীর মোবারক থেকে পরিধানের কাপড় পৃথক করা হবে কিনা – এ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করা হলো। হঠাৎ করে তাঁদের মধ্যে তন্দ্রার ভাব দেখা দিল। এমতাবস্থায় তাঁরা শুনতে পেলেন – কে যেন বলছে-“নবী করিম [ﷺ]-এঁর বদন মোবারক থেকে কাপড় সরানো যাবে না!” তাই করা হলো। কাপড়েরর উপরেই পানি ঢেলে হযরত আলী (رضي الله عنه) ডান হাত দিয়ে ধৌত করে দিলেন। নবী করিম [ﷺ]-এঁর নির্দেশ ছিল – “আলী ছাড়া অন্য কেউ যেন আমাকে গোসল না দেয়।” (গোসলের বিলম্ব সম্পর্কে শিয়াদের প্রচারণ্য মিথ্যা। কেননা, হযরত আলী (رضي الله عنه) এ কাজের একক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন)।
সেমতে হযরত আলী (رضي الله عنه) একা গোসলের কাজ সমাধা করেন। হযরত আব্বাস, ফযল ও কুসাম পিতা-পুত্রগণ নবী করিম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক এদিক সেদিক ডান-বাম করানোর কাজে সহায়তা করেন। পানি ঢালার কাজে সহায়তা করেন উসামা ও সালেহ; মতান্তরে উসামা ও আব্বাস (رضي الله عنه)। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন – মৃত ব্যক্তির মলমূত্র পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু নবী করিম [ﷺ]-এঁর ক্ষেত্রে তেমন হয় নি। কেননা, তিনি ইন্তিকালের পূর্বে ও পরে সর্বাবস্থায়ই পাক পবিত্র ছিলেন। হযরত আলী (رضي الله عنه) ডান হাত দিয়ে হুযুর [ﷺ]-এঁর শরীর মোবারক ধৌত করেছিলেন। এর বরকতে তাঁর ডান হাতে সব সময় আতরের মত সুগন্ধি পাওয়া যেত (সুবহানাল্লাহ)।
কাফন মোবারকঃ
নবী করিম [ﷺ]-কে গোসল দেয়ার পর কাফন মোবারক পরিধান করানো হয়। চেহারা মোবারক, কনুই মোবারক, হাঁটু, মোবারক এবং প্রতি অঙ্গের জোড়ায় জোড়ায় কাপুর লাগানো হয়। তারপর তিনখানা কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হয়। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها), হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه), হযরত ফযল (رضي الله عنه) ও হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে কাফনের কাপড়ের নমুনা সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদীসে দেখা যায়, নবী করিম [ﷺ] তিন ধরণের কাপড়ের মধ্যে যেকোন কাপড় দিয়ে কাফন দেয়ার কথা পূর্বেই বলে গেছেন – কাফনের কাপড় হবে ইয়েমেনের তৈরী অথবা মিশরীয় সাদা কাপড়। সে মতে দু’খানা সাদা কাপড় এবং হুযুর [ﷺ]-এঁর নিজ গায়ের জামা মোবারক দিয়ে কাফন পরিধান করানো হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণনা মতে হুযুর [ﷺ]-এঁর ইন্তিকালের সময় গায়ের জামা এবং ইয়েমেন দেশীয় দু’খানা কাপড় (একজোড়া) দিয়ে হুযুর [ﷺ]-কে কাফন পরিধান করানো হয়। পাগড়ী পরিধান করানো হয়নি। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন – আমি নিজহাতে হুযুর আকরাম [ﷺ]-কে দু’খানা সাদা কাপড় ও একখানা চাদর দ্বারা কাফন পরিধান করিয়েছি। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها)-এঁর রেওয়ায়াত মোতাবেক তিনখানা সাদা ‘সাহুলী’ কাপড় দ্বারা কাফন পরানো হয়। ফযল (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণনা মতে দু’খানা সাদা সাহুলী কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোট কথা নিজ জামাসহ তিন খানা কপড়েরই উল্লেখ পাওয়া যায়।