আমাদের অনেকেরই জীবনে অনেক গুলো নামাজ ক্বাযা হয়ে গেছে। এই ক্বাযা নামাজ আদায় করে দেওয়া আমাদের জন্য অবশ্যই ফরজ। অনেকেই হয়ত পাঁচ-দশ বছরের নামাজ ক্বাযা বাকী রয়েছে। এত নামাজ কিভাবে আদায় করব?? সেইটা ভেবে হয়ত আদায় করছেন না।
আজ ইনশাআল্লাহ এই ক্বাযা নামাজ গুলো খুব সহজ ভাবে আদায়ের সঠিক নিয়মাবলী জানিয়ে দিব। ক্বাযা নামাজের ব্যাপারে মারাত্মক ভুল ধারণা হল, অনেকে মনে করে তাওবা করলে অতীতের সকল ক্বাযা মাফ হয়ে যাবে অথবা অনেকে আবার একটি ভুল সমাধান দেয় যে, চার রাকাত নামাজ জুম্মা বারে অমুক নিয়মে পড়লে ওমরী ক্বাযা আদায় হয়ে যাবে। সেইটা একেবারেই মিথ্যা, বানোয়াট এবং মোটেও শরীয়ত সম্মত না।
যাই হোক, আপনাকে নামাজ গুলো আদায় করতে হবে, এজন্য ফোকাহায়ে কেরাম একটি সহজ পদ্ধতি বলে দিয়েছেন, সেইটা নিচে উল্লেখ করা হবে। মনে রাখবেন, শুধুমাত্র ফরজ এবং ওয়াজিব নামাজের ক্বাযা করতে হবে, কিন্তু সুন্নাত কিংবা নফলের কোন ক্বাযা নেই। আপনি আপনার বালেগ হতে আজ পর্যন্ত কত মাসের নামাজ আদায় করেননি, সেইটা হিসাব করবেন।
মনে রাখবেন, শরীয়তের দৃষ্টিতে ছেলেদের বালেগ হওয়ার বয়স (১২ থেকে ১৫) বছর এবং মেয়েদের বালেগ হওয়ার বয়স (৯ থেকে ১৫) বছর। ছেলেদের বালেগ হওয়ার পরিচয় হল স্বপ্নযোগে কাহারও সহিত সঙ্গম করার ফলে বীর্যপাত হইলে অর্থাৎ, স্বপ্নদোষ হলে তখন হইতেই ছেলেকে বালেগ বলিয়া ধরিতে হইবে।মেয়েদের বালেগা হওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরিচয় হইল হায়েজ বা ঋতুস্রাব অথবা স্বপ্নদোষ হওয়া। এই ক্ষেত্রে আপনি গভীর ভাবে অনুমান করে সেইটা বের করবেন, সেই অনুযায়ী নামাজ আদায় করে দিলে ইনশাআল্লাহ আপনার এই ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
মনে করুন, আপনি চিন্তা করলেন আমার মোট ক্বাযা নামাজ ৫ বছর অথবা ৬ বছরের বাকী আছে। কিন্তু আপনার মন বলছে ৬ বছরের নামাজ বাকী আছে, তাহলে আপনি ৬ বছরের নামাজ ধীরে ধীরে আদায় করে নিবেন, আপনি যতক্ষণ ক্বাযা নামাজ আদায় করবেন না আপনার কোন নফল নামাজ কবুল হবে না। এজন্য আজ থেকে আপনি সাহস করে ক্বাযা নামাজ শুরু করে দিন, ইনশাআল্লাহ এক সময় দেখবেন সব ক্বাযা আদায় করে ফেলেছেন।
আপনি চাইলে ক্বাযা নামাজ ধারাবাহিক ভাবে আদায় করতে পারেন (যেমন- ফজর,যোহর,আছর এভাবে) অথবা প্রথমে শুধু ফজর পড়বেন, তারপর যোহর এর ক্বাযা গুলো পড়বেন এইভাবে৷ কতদিন এর ক্বাযা নামাজ পড়া হয়ে গেছে সেইটা অবশ্যই কোন খাতায় নোট করে রাখবেন। নামাজের মাকরূহ ওয়াক্ত তিনটি, এই সময় নামাজ পড়া যাবে না, বাকী যেকোন সময় আপনার সুবিধা মত ক্বাযা নামাজ গুলো পড়তে পারবেন। এই তিনটি সময় হল- ১. সূর্য উঠার পর ২০ মিনিট পর্যন্ত, ২. জাওয়ালের সময়, সূর্য যখন ঠিক মাঝখানে আসে তখন থেকে যোহর এর ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত (নামাজের ক্যলেন্ডার দেখে নিবেন) ( সম্ভাব্য সময় সকাল ১১- দুপুর ১২ পর্যন্ত, এটা পরিবর্তন হয়ে থাকে, সময়ের সাথে সাথে) ৩. সূর্য ডোবার ২০ মিনিট আগ থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত।
প্রত্যেক দিনের কাযা হয় মাত্র ২০ রাকাত। ফজরের ২ রাকাত, জোহরের ৪ রাকাত, আছরের ৪ রাকাত, মাগরিবের ৩ রাকাত, ইশার ৪ রাকাত এবং বিতরের ৩ রাকাত মিলে মোট ২০ রাকাত। আর এভাবেই নিয়্যত করবে যে; “সর্বপ্রথম ফযরের যে নামায আমার উপর কাযা রয়েছে তা আমি আদায় করে দিচ্ছি।” প্রত্যেক নামাযে এভাবেই নিয়্যত করবে।
আর যার যিম্মায় অধিক নামায কাযা রয়েছে সে সহজের জন্য এভাবে পড়লেও জায়েয হবে যে, প্রত্যেক রুকু ও সিজদাতে ৩+৩ বার ﺳُﺒْﺤٰﻦَ ﺭَﺑِّﻰَ ﺍﻟْﻌَﻈِﻴْﻢ , ﺳُﺒْﺤٰﻦَ ﺭَﺑِّﻰَ ﺍﻟْﺎَ ﻋْﻠٰﻰ পড়ার পরিবর্তে মাত্র ১+১ বার পড়বে। কিন্তু সর্বদা এবং সব ধরণের নামাযে এটা খেয়াল রাখা বাঞ্চনীয় যে, রুকুতে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছার পরেই “ﺳُﺒْﺤٰﻦَ”এর সীন শুরু করবে (এর আগে নয়।) এবং “ﻋَﻈِﻴْﻢ ” শব্দের মীম পড়া শেষ করেই রুকু থেকে মাথা উঠাবে। এরূপ সিজদাতেও করতে হবে। সহজতার এক পদ্ধতি তো এটা হলো।
আর “দ্বিতীয় পদ্ধতি” এই যে, ফরয নামায সমূহের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতের মধ্যে ﺍَﻟْﺤَﻤْﺪُ পড়ার পরিবর্তে শুধুমাত্র ৩ বার সুবহানাল্লাহ পড়ে রুকুতে চলে যাবে। কিন্তু বিতরের প্রত্যেক রাকাতেই ﺍَﻟْﺤَﻤْﺪُ এবং সুরা অবশ্যই পড়তে হবে।
আর “তৃতীয় সহজতর পদ্ধতি” এই যে, শেষ বৈঠকে তাশাহুদ অর্থাৎ আত্তাহিয়্যাত এর পরে উভয় দরূদ শরীফ এবং দোয়ায়ে মাছুরার পরিবর্তে শুধু ﺍَﻟﻠّٰﮩُﻢَّ ﺻَﻞِّ ﻋَﻠٰﯽ ﻣُﺤَﻤَّﺪٍ ﻭَّﺍٰﻟِﻪٖ পড়ে সালাম ফিরিয়ে নিবে। আর “চতুর্থ সহজতর পদ্ধতি হলো, বিতরের ৩য় রাকাতের মধ্যে দোয়ায়ে কুনুত এর পরিবর্তে “ ﺍَﻟﻠﻪُ ﺍَﮐْﺒَﺮُ ” বলে মাত্র একবার কিংবা তিনবার ﺭَﺏِّ ﺍﻏْﻔِﺮْ ﻟِﻰْ পড়ে নিবে। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া হতে সংগৃহীত, ৮ম খন্ড, ১৫৭ পৃষ্ঠা)
যদি সফর অবস্থায় কাযাকৃত নামায ইকামত (স্থায়ী বসবাসকালীন) অবস্থায় পড়ে দেয়ার ইচ্ছা করেন তাহলে কসরই পড়তে হবে। আর ইকামত অবস্থায় কাযাকৃত নামায সফরকালীন সময়ে আদায় করলে সম্পূর্ণ নামাযই পড়তে হবে। কসর পড়া যাবে না। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১২১ পৃষ্ঠা)
ফতোওয়ায়ে শামীতে বর্ণিত আছে: কাযা নামায আদায় করা নফল নামায আদায় করা থেকে উত্তম এবং গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, চাশতের নামায, সালাতুত তাসবীহ এবং ঐ নামায যেগুলোর ব্যাপারে হাদীসে মোবারকায় বর্ণিত আছে। যেমন- তাহাইয়াতুল মসজিদ, আসরের প্রথম চার রাকাত (সুন্নাতে গাইর মুয়াক্কাদা) এবং মাগরিবের পরে ছয় রাকাত আদায় করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ৬৪৬ পৃষ্ঠা)
কাযা নামায আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা নেই। যখনই আদায় করা হবে তখনই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও দ্বিপ্রহর এ তিন সময়ে নামায আদায় করা যাবে না। কেননা, উক্ত সময়গুলোর মধ্যে নামায আদায় করা জায়েয নেই। (আলমগীরী, ১ম খন্ড, ৫২ পৃষ্ঠা। বাহারে শরীয়াত, ১ম খন্ড, ৭০২ পৃষ্ঠা)
যে ব্যক্তি (আল্লাহর পানাহ) ধর্মদ্রোহী হয়ে গেছে অতঃপর পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তার উপর ধর্মদ্রোহীতা কালীন নামায সমূহ কাযা আদায় করা আবশ্যক নয়। তবে মুরতাদ হওয়ার পূর্বে ইসলাম ধর্মে থাকা কালীন সময়ে যে নামাযগুলো সে পড়েনি, তা (ওয়াজীব) অবশ্যই তাকে কাযা আদায়করে দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড,৬৪৭ পৃষ্ঠা)
এমন অসুস্থ ব্যক্তি যে ইশারায় নামায আদায় করতে পারছে না। তার এ অবস্থা যদি একাধারে ছয় ওয়াক্ত নামাযের সময় পর্যন্ত থাকে, তাহলে এমন অসুস্থ অবস্থায় তার যে সব নামায ছুটে গিয়েছে তার কাযা ওয়াজীব হবে না। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১২১ পৃষ্ঠা)
আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত, মাওলানা শাহ আহমদ রযা খাঁন ﺭَﺣْﻤَۃُ ﺍﻟﻠّٰﮧِﺗَﻌَﺎﻟٰﯽ ﻋَﻠَﯿْﮧِ বলেন: আমাদের মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম স্পষ্ট বর্ণনাকরেছেন: ‘কাযা’ নামায ‘আদা’ নামাযের নিয়্যত দ্বারা, অনুরূপ ‘আদা’ নামায ‘কাযা’ নামাযের নিয়্যত দ্বারা আদায় করলে উভয়ই সহীহ ও বিশুদ্ধ হবে। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া (সংশোধিত) , ৮ম খন্ড, ১৬১ পৃষ্ঠা)
যদি জোহরের ফরয নামায আগে পড়ে নেন, তবে জোহরের পরের দুই রাকাত সুন্নাত আদায় করেই পূর্বেই চার রাকাত সুন্নাত পড়ে নিবেন। যেমন- আ’লা হযরত ﺭَﺣْﻤَۃُ ﺍﻟﻠّٰﮧِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﯽ ﻋَﻠَﯿْﮧ ِ বর্ণনা করেন: জোহরের চার রাকাত সুন্নাত যদি ফরযের পূর্বে আদায় করা না হয়, তাহলে ফরযের পরে বরং গ্রহণযোগ্য মতানুসারে জোহরের পরের দুই রাকাত সুন্নাত আদায় করেই পূর্বের চার রাকাত সুন্নাত আদায় করতে হবে। তবে শর্ত হলো, তখনও জোহরের সময় অবশিষ্ট থাকতে হবে। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া (সংশোধিত) , ৮ম খন্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা)
বিশেষ_দ্রষ্টব্যঃ কোন কিছু না বুঝে থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাবেন।