প্রশ্নঃ হুজূর, মাসিক ‘আদর্শ নারী’ (জানুয়ারি, সংখ্যা-১২৫) ম্যাগাজিনে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছেন ‘‘কোন আশা পূরণকে সামনে রেখে কোন ওলী আল্লাহর মাযারে গমন করা জায়েয হবে কি? উত্তরে বলা হয়েছে-
না, আশা ও মাকসূদ পূরণের উদ্দেশ্যে কোন পীর বা ওলী-বুযুর্গের কবর বা মাযারে গমন করা জায়িয হবে না। এককমাত্র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে এবং আখিরাতের স্মরণের লক্ষ্যেই কবর যিয়ারত করা জায়িয। কবর-মাযারে গিয়ে নিজের হাজত চাওয়া সম্পূর্ণ হারাম ও মারাত্মক শির্ক গুনাহ্। বস্তুতঃ মাকসূদ বা আশা পূরণে একমাত্র মহান আল্লাহর নিকট চাইতে হবে, অন্য কারো কাছে নয়। সে জন্য মাযারে যাওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। বরং নিজের ঘরে বা মসজিদে ইবাদত-বন্দেগী করে কিংবা সালাতুল হাজাত পড়ে মহান আল্লাহর নিকট নিজের হাজত পেশ করে দুজ্ঞআ করবে। [আহ্সানুল ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড]
• এখন আমার প্রশ্ন ওই উত্তর কতটুকু গ্রহণীয়? যদি সঠিক না হয় তাহলে কোরআন-হাদীসের দলীলসহ উত্তর দিলে ধন্য হবো।
উত্তরঃ যে কোন বৈধ আশা ও মাকসূদ পূরণের উদ্দেশ্যে কোন হক্কানী কামিল পীর-মুর্শিদ বা ওলী-বুযর্গের মাযার শরীফে গমন করা এবং আল্লাহ্ তা’আলা প্রদত্ত বিশেষ রূহানী ক্ষমতার অধিকারী মনে করে তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে মূলত সাহায্যের মূল উৎস হচ্ছে মহান আল্লাহ্। আর সম্মানিত নবীগণ ও আল্লাহর পুণ্যাত্মা ওলীগণ হলেন ওই সাহায্যের বিকাশস্থল মাত্র। প্রকৃত মুসলমানগণ এ সহীহ আক্বীদা পোষণ করে থাকেন। সুতরাং আল্লাহর পুণ্যাত্মা বান্দাদের মাযারে গিয়ে নিজের হাজত প্রার্থনা করাকে ‘হারাম ও শির্ক’ বলা মুসলমানদের উপর জঘন্য অপবাদ এবং মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের সর্বজনমান্য মুহাদ্দিস হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহ্লভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত ‘আশি‘আতুল লুমআত’ গ্রন্থে হযরত ইমাম গায্যালী রহমাতুল্লাহি আলাইহির উক্তি নকল করে বলেন, قَالَ الْاِمَامُ الْغَزَّالِی مَنْ یُّسْتَمَدُّ فِیْ حَیَاتِہٖ یُسْتَمَدُّ بَعْدَ وَفَاتِہٖ ‘‘ইমাম গায্যালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, যাঁর কাছ থেকে জীবদ্দশায় সাহায্য চাওয়া যায়, তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে।’’ [আশইআতুল লুমআত, যিয়ারাতুল কুবূর অধ্যায়]
হযরত আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত জ্ঞতাফসীর-ই আযীযী, সূরা বাক্বারাহ্-এর আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘‘আল্লাহর সচরাচর কার্যাবলী যেমন, সন্তানদান, রুজি-রোজগার বৃদ্ধিকরণ, রোগমুক্তিদান ও এ ধরনের অন্য সব কার্যাবলীকে মুশরিকগণ দুষ্ট ও পাপী আত্মা এবং প্রতিমার সাথে সম্পর্কযুক্ত করে থাকে, ফলে তারা কাফির বলে গণ্য হয়। আর মুসলমান এসব বিষয়কে আল্লাহর হুকুম বা তাঁর সৃষ্ট জীবের বিশেষত্বের ফলশ্রুতি বলে মনে করেন কিংবা তাঁর নেক বান্দাহ্গণের দুজ্ঞআ। আল্লাহর এ নেকবান্দাহ্গণ মহান রবের কাছে প্রার্থনা করে জনগণের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। এতে এই সব মুসলমানের ঈমানের কোন ক্ষতি হয় না।’’ [তাফসীরে আযীযী, পৃষ্ঠা ৪৬০]
ফতোয়া-ই শামীতে ‘কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখ আছে যে, ‘‘ইমাম শাফেঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, যখনই আমি কোন সমস্যার সম্মুখীন হতাম তখনই ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযারে চলে যেতাম, তাঁর বরকতেই আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যেত।’’
দেওবন্দের শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসান দেওবন্দী স্বীয় ‘তারজমায়ে কোরআন’ সূরা ফাতিহায় اِیَّاکَ نَسْتَعِیْنٌ আয়াতের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন যে, ‘‘যদি কোন প্রিয়বান্দাকে রহমতে ইলাহীর মাধ্যম মনে করে তাঁকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সত্ত্বাগতভাবে সাহায্যকারী জ্ঞান না করে তাঁর কাছ থেকে বাহ্যিক সাহায্য ভিক্ষা করা হয়, তা হলে তা বৈধ। কেননা, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া মূলতঃ আল্লাহ্ তা’আলার কাছ থেকেই সাহায্য প্রার্থনার নামান্তর ‘’
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীরা কোন নবী বা ওলীকে আল্লাহ্ কিংবা্ আল্লাহর পুত্র জ্ঞান করে না। কেবল ‘ওসীলা বা মাধ্যম’ বলে বিশ্বাস করে। তাই তাঁদের কাছে গিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা এবং তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা সম্পূর্ণ জায়েয ও বরকতময়। তদুপরি সরকারে দো’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘যদি তোমাদের ঘোড়া বা সাওয়ারি সফরে বা জঙ্গলে হারিয়ে যায়, অথবা কোন মুসীবতের শিকার হয়ে যাও আর সাহায্যপ্রার্থনা করার বাহ্যিকভাবে যদি কেউ পাওয়া না যায়, তবে তোমরা এ বলে সাহায্য প্রার্থণা কর اَعِیْنُوْنِیْ یَاعِبَادَ اللّٰہ অর্থাৎ, ‘‘হে আল্লাহর প্রিয়বান্দাগণ! আমাকে সাহায্য করুন’’ (তাবরানী শরীফ)। এই হাদীসে স্বয়ং রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের কঠিন মুহূর্তে মুসীবতের শিকার হলে আল্লাহর প্রিয় বন্ধুগণ থেকে সাহায্য চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। যেহেতু আল্লাহর রহমত, করুণা, কৃপা ও সাহায্য লাভ করার ওসীলা ও মাধ্যম হলেন আউলিয়া-ই কেরাম তথা আল্লাহর খাস বান্দাগণ। সুতরাং তাঁদের নিকট তাঁদেরকে ওসীলা মনে করে সাহায্য প্রার্থনা করা শির্ক নয় বরং প্রিয়নবীর পবিত্র হাদীস শরীফের উপর বাস্তব আমল। একে শির্ক ও হারাম ইত্যাদি বলা কোরআন ও হাদীস শরীফ সম্পর্কে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও আউলিয়া কেরামের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করার নামান্তর।
[তাবরানী শরীফ, তাফসীরে আযীযী ও আশিআতুল লুম’আত ইত্যাদি।] [সূত্র. যুগ-জিজ্ঞাসা, পৃ.৪০-৪১]