এরই নাম খাঁটি তওবা – সালাবা (রাঃ) এর তাওবার ঘটনা!
হিজরতের পর আনসার আর মুহাজিরদের মাঝে গড়ে উঠেছে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। মদীনার আনসারগণ মুহাজির ভাইদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানীর অপূর্ব নজির পেশ করছেন। তাদের আরাম ও শান্তির জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ সকল ধরনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন ৷ এমনকি একাধিক স্ত্রী থাকলে মুহাজির ভাইয়ের পছন্দমত কোনো একজনকে তালাক দিয়ে তাকে তার হাতে তুলে দেয়ার আগ্রহও পেশ করছেন । মোট কথা মক্কা থেকে আগমনকারী মুহাজির ভাইদের কোনো প্রকার কষ্ট ও অসুবিধা যাতে না হয় সেদিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে চলছেন মদীনার আনসারগণ।
আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ং রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি একেকজন মুহাজিরকে একেকজন আনসারীর ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে আনসারগণ এতটাই আনন্দচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন যে, পূর্বে কারো দুই ভাই থাকলে এখন তিনি মনে করতেন, আমার ভাই তিনজন। এক কথায় আনসারগণ মুহাজিরদেরকে আপন ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মান দিতেন।
সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান ছিলেন মুহাজির সাহাবী । হিজরতের পর তিনি ও সালাবাতুল আনসারী (রা.)-এর মাঝে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাবূক অভিযানে গেলেন, তখন তাঁর সাথে গমন করেছিলেন হযরত সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান (রা.)। আর সালাবাতুল আনসারী (রা.) পেয়েছিলেন সাঈদ (রা.) – এর বাড়িঘর দেখাশুনার দায়িত্ব।
সালাবা (রা.) প্রত্যহ সাঈদ (রা.) এর বাড়িতে আসতেন । খোঁজ- খবর নিতেন। কোনো কাজ থাকলে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন।
একদিনের ঘটনা।
সালাবা (রা.) সাঈদ (রা.) এর বাড়ী আসলেন। খোঁজ খবর নিলেন। এ সময় বাড়ীতে সাঈদ (রা.) -এর সুন্দরী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। এ সুযোগে সালাবা (রা.) কে অভিশপ্ত শয়তান ফুসলাতে লাগল । বারবার ধোঁকা দিল। হযরত সালাবা (রা.) শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গেলেন। তিনি অগ্র-পশ্চাত না ভেবে পর্দা সরিয়ে ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর সাঈদ (রা.)-এর স্ত্রীর হাত স্পর্শ করলেন।
এ অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিক আচরণে সাঈদ (রা.)-এর স্ত্রীর বুক থর থর করে কেঁপে উঠে। শিউরে উঠে তার শরীর। বিবর্ণ হয়ে উঠে মুখমণ্ডল। চোখ দু’টোতে ফুটে উঠে ভয়ার্ত ভাব। তিনি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন-
‘হে আল্লাহর বান্দা! আপনার যে ভাই খোদার রাহে জিহাদে গিয়েছেন, আপনি কি তার আমানতে খেয়ানত করতে উদ্যত হয়েছেন?”
এতটুকু কথা সালাবা (রা.)-এর অন্তরে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু করল । একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন দোলা দিয়ে গেল তার হৃদয় মনে। কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা । তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।
ভুল বুঝতে পেরে তিনি এক মুহূর্ত কাল বিলম্ব করলেন না । সাথে সাথে ক্ষমা, ক্ষমা বলে চিৎকার করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। বারবার প্রচণ্ড আওয়াজে বলতে লাগলেন- “ইলাহী! আমি পাপী। আমি গুনাহগার। কিন্তু তুমি ক্ষমাশীল দয়াবান ।”
ঘটনার কয়েকদিন পর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক অভিযান শেষে সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় তাশরীফ আনলেন। তখন মদীনায় যারা ছিলেন তাদের সকলেই গাজী ভাইদের সংবর্ধনার জন্য এগিয়ে এলেন। কিন্তু সালাবা (রা.)-কে কোথাও দেখা গেল না। তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির আশায় পাগলের ন্যায় এদিক সেদিক উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে লাগলেন।
সাঈদ (রা.) বাড়ি এসে সব কিছু শুনলেন। সালাবা (রা.)-এর উপর চরম অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু যখন তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির ব্যাপারে তার নজিরবিহীন অস্থিরতার কথা শুনলেন তখন তার রাগ পড়ে গেল। তিনি ভাবলেন, শয়তানের ধোঁকায় পড়েই সালাবা এমনটি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সুতরাং এখন তার অনুসন্ধান করা দরকার।
সাঈদ (রা.) সালাবা (রা.)-কে এখানে সেখানে সর্বত্র খুঁজে ফিরলেন। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে পেয়ে বললেন- ভাই সালাবা! তুমি আমার সঙ্গে চল । আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি ।
সালাবা (রা.) বললেন, না, আমি এভাবে যাব না। যদি তুমি আমার হাতকে ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে সেই রশি ধরে আমাকে একটি অপমানিত গোলামের ন্যায় টেনে নিয়ে যাও, তবেই আমি যাব, অন্যথায় নয় ৷
: এরূপ করার কোনো প্রয়োজন নেই । তুমি আমার সাথে এমনি চল ।
: না, এভাবে আমি যাব না। যেতে পারি না। কারণ আমি যে মারাত্মক পাপ করেছি তার পরিণতি আমি দুনিয়াতেই ভোগ করতে চাই, আখিরাতে নয় ।
: মাফ করে দিলে তো সেই পাপের ফল ভোগ করার কোনো প্রয়োজন থাকে না ৷
: তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আমি তোমার আমানতে হাত দিয়ে যে জঘন্য অপরাধ করেছি, তার অপমানজনক শাস্তি ভোগ না করলে আমার অস্থির মন কখনোই শান্ত হবে না। অতএব আমাকে নিতে চাইলে আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবেই তোমাকে নিতে হবে ।
সালাবা (রা.)-এর দৃঢ়তায় সাঈদ (রা.) বিপদে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত অপারগ হয়ে তিনি তাই করলেন ।
সালাবা (রা.) হাত ঘাড়ের সাথে বাঁধা অবস্থায় সর্বপ্রথম হযরত উমর (রা.) এর কাছে পৌঁছলেন। বললেন-আমি এরূপ পাপ করেছি। আমার এ অন্যায়ের জন্য তওবার কোন ব্যবস্থা আছে কি?
ঘটনা শুনে উমর (রা.)-এর সুন্দর মুখমণ্ডল রাগে রক্তাক্ত হয়ে উঠে। উজ্জ্বল দীপ্ত চোখ দু’টোতে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অধর দংশন করেন তিনি। অবশেষে দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, বেরিয়ে যাও এখান থেকে । আমার নিকট তোমার কোনো তওবার ব্যবস্থা নেই ।
এরপর তারা হাজির হলেন হযরত আবূ বকর (রা.)-এর দরবারে। তাঁর নিকট সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর তওবার পন্থা বাতলানোর অনুরোধ করলে তিনিও তা প্রত্যাখ্যান করেন ।
সেখান থেকে নিরাশ হয়ে তারা হযরত আলী (রা.)-এর দরবারে পৌঁছলেন। কিন্তু তিনিও তাদেরকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, আমার নিকট তোমার জন্য তওবার কোনো ব্যবস্থা নেই ৷
তারপর সালাবা (রা.) এক বুক আশা নিয়ে দয়ার সাগর রাহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হলেন । তিনি ভাই সাঈদকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই সাঈদ! আশা করি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিরাশ করবেন না ।
সেখানে যাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাবা (রা.)-এর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকালেন। বললেন, সালাবা! তুমি তো আমাকে দোজখের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ।
তখন সালাবা (রা.) বিনীত কণ্ঠে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতামাতা আপনার উপর কুরবান হোক। আমি আমার মুহাজির ভাইয়ের স্ত্রীর হস্ত স্পর্শ করেছি। এ জন্য আমি অনুতপ্ত । চরমভাবে লজ্জিত। আমি তওবা করতে চাই। আমার তওবার কোনো ব্যবস্থা আছে কি?
সালাবা (রা.)-এর গুরুতর অপরাধের কথা শুনে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সীমাহীন বিস্মিত হলেন। তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠে ক্রুদ্ধভাব। তিনি কঠিন কণ্ঠে বললেন-সালাবা। এখান থেকে বেরিয়ে যাও । তোমার জন্য তওবা নেই ৷
সর্বশেষ আশ্রয়স্থল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবার থেকে নিরাশ হয়ে সালাবা (রা.) আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন। মনের অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে মুখভাবে। এবার কি করবেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। চরম পর্যায়ের পেরেশান হয়ে কখনও মাথার চুল টানছেন, কখনো বা অধর দংশন করে চলছেন।
এ অবস্থায় চলে গেল বেশ সময়। অতঃপর এক পর্যায়ে তিনি কি যেন ভেবে পাহাড়ের দিকে দৌড়ে পালালেন। তারপর উচ্চঃস্বরে বলতে লাগলেন-
হে দয়াময় প্রভু! আমি ওমরের নিকট হাজির হয়েছি, তিনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আবূ বকর ও আলীর নিকট উপস্থিত হয়েছি, তারাও আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সর্বশেষ আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে বড় আশা নিয়ে হাজির হয়েছি, কিন্তু তিনিও আমাকে নিরাশ করেছেন।
কিন্তু হে দীন দুনিয়ার প্রভু! তুমি আমার মালিক, আর আমি তোমার গোলাম । তোমার সুমহান-সুউচ্চ দরবারে তোমার গোলাম হাজির হয়েছে। যদি তুমি আমাকে ক্ষমা কর, তবে আমার খুশির সীমা থাকবে না । আর যদি তুমিও আমাকে নিরাশ কর, তবে আমার ন্যায় হতভাগা আর কেউ নেই ৷
এসব কথা বলে তিনি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং ছোট্ট শিশুটির মতো আকুলভাবে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ফিরতেন ।
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে একজন ফেরেশ্তা হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ পাক আপনাকে জিজ্ঞেস করেছেন, এই বিশ্ব জগত ও সমগ্র মানব জাতিকে কি তিনি সৃষ্টি করেছেন না আপনি?
রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিঃসন্দেহে সব কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ্ তা’আলা। এরপর ফেরেশ্তা বললেন, আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন- আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করেছি, এ সংবাদ তাঁকে পৌঁছে দিন।
ক্ষমার ঘোষণায় অপরিসীম এক আনন্দ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মনে দোলা দিয়ে যায়। তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠে একটা অনাবিল মধুর হাসি । তিনি বললেন, এমন কে আছ, যে সালাবাকে আমার নিকট নিয়ে আসবে?
হযরত আবূ বকর ও উমর (রা.) সেখানেই ছিলেন। তাঁরা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা তাঁকে নিয়ে আসি।
এমন সময় হযরত আলী ও হযরত সালমান ফারসী (রা.) বলে উঠলেন, হে আল্লাহর নবী! সালাবাকে আমরা নিয়ে আসি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে হযরত আলী ও হযরত সালমান ফারসী (রা.) দেরি করলেন না। তারা সালাবা (রা.)-এর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। তালাশ করলেন, মদীনার পথে-প্রান্তরে, অলিতে-গলিতে। কিন্তু না, তাঁকে কোথাও পাওয়া গেল না। অবশেষে মদীনার উপকণ্ঠে কৃষি কর্মে লিপ্ত লোকদেরকে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে কৃষকরা বলল, আপনারা কি জাহান্নাম থেকে পলায়নকারী ব্যক্তির সন্ধান করছেন?
তাঁরা বললেন, হ্যাঁ।
তখন কৃষকদের একজন বলল, তিনি রাত্রি কালে এখানে আসেন । এ বৃক্ষতলে উপস্থিত হয়ে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দু’চোখ থেকে দরদর করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা ।
হযরত আলী ও সালমান ফারসী (রা.) তাই নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন। যখন রাত হলো, তখন সালাবা (রা.) সেই বৃক্ষের নিচে উপস্থিত হলেন। তারপর মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
রাতের নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকারে এতক্ষণ তারা সালাবা (রা.)- কে দেখতে পাননি। যখন তিনি ভূপৃষ্ঠের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, তখন তারা কান্নার আওয়াজে বুঝতে পারলেন যে, নিশ্চয়ই সালাবা এসেছেন; আর কান্নার এ করুণ সূর তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকেই উৎসারিত হচ্ছে।
তারা দ্রুতপদে সেদিকে গেলেন, যেদিক থেকে মর্মস্পর্শী কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল।
নিকটে গিয়ে তারা ডাকলেন-সালাবা! মস্তক উত্তোলন কর। কান্না থামাও ৷ চল । আল্লাহ পাক তোমাকে ক্ষমা করেছেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন- আল্লাহর পেয়ারা হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপনারা কি অবস্থায় দেখে এসেছেন?
তাঁরা বললেন- আমরা তাঁকে এমন অবস্থায় দেখে এসেছি, যেমন আল্লাহ পাকের পছন্দ ও তোমার আন্তরিক কামনা।
তারপর তাঁকে নিয়ে তাঁরা মসজিদে নববীতে হাজির হলেন। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হযরত বিলাল (রা.) ইকামত বলছেন। এখনই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীরে তাহরীমা বেঁধে নামাজ শুরু করবেন । তাঁরা তিনজন সর্বশেষ কাতারে শরিক হলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন সূরা ফাতিহা শেষ করে সূরা তাকাসুর শুরু করলেন । হযরত সালাবা (রা.) সূরার প্রথম অংশটুকু শ্রবণ করতেই চিৎকার দিয়ে উঠলেন। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হাতা-যুরতুমুল মাকাবির’ পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন তিনি আরো একটি বিকট চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।
নামাজ শেষে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাবা (রা.)-এর নিকট এলেন। হযরত সালমান ফারসী (রা.)- কে বললেন, তার মুখে একটু পানির ছিটা দাও।
সালমান (রা.) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সালাবা আর এ জগতে নেই । সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে।
এমন সময় সালবা (রা.)- এর কন্যা খামসানা এসে পিতার মৃতদেহ দেখে কাঁদতে লাগল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন-
হে খামসানা! তুমি এতে খুশি নও যে, আমি তোমার পিতা হই এবং ফাতিমা হবে তোমার বোন?
সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি অবশ্যই রাজি আছি ।
জানাজা শেষে সালাবা (রা.)-এর লাশ কবরস্থানে পৌঁছানো হলো। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজার সাথে রইলেন। কবরস্থানে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পূর্ণ কদম মোবারক মাটিতে রাখছিলেন না, বরং পায়ের উপর ভর করেই তিনি হাঁটছিলেন ।
দাফন কার্য সমাপ্তির পর হযরত ওমর (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- কে এ অস্বাভাবিক চলার কারণ জিজ্ঞেস করলেন । জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ওমর! কবর স্থানে এত অধিক পরিমাণে ফেরেশ্তা জমা হয়েছিল যে, মাটিতে পা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না ।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আপনারা একটু লক্ষ্য করে দেখেছেন কি ? একজন মানুষের মধ্যে কি পরিমাণ আল্লাহর ভয় থাকলে, সে একটি মাত্র গুনাহ করে এত বেশি পরিমাণে অস্থির হয়ে পড়তে পারে? বস্তুত হযরত সাহাবায়ে কেরাম আর আমাদের মাঝে মূল পার্থক্য এখানেই। তাঁরা অনিচ্ছায় কিংবা ভুলবশত কোনো পাপ করে ফেললেও তা মাফের জন্য যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকতেন। যে কোনো কষ্ট হাসি মুখে বরণ করে নিতেন। আর আমরা অবলীলায় হাজারো গুনাহ করে যাচ্ছি। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ অহরহ অমান্য করছি। কিন্তু কই? আমাদের মাঝে তো এমন পরিবর্তন আসে না! গুনাহ হয়েছে জানার পরও তা মাফের জন্য এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ি না । যেমন ধরুন আপনি হয়ত আগে জানতেন না, দাড়ি সেভ করলে, অধীনস্থ মেয়েদেরকে বেপর্দায় রাখলে, গান শুনলে, টিভি দেখলে, কবীরা বা জঘন্য রকমের গুনাহ হয়। কিন্তু যখন জানলেন যে, এসব কাজ করলে কবীরা গোনাহ হবে, সম্মুখীন হতে হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির- তখন কি আপনি সাথে সাথে তাওবা করেন? আপনি কি তখন প্রতিজ্ঞা করেন যে, এসব কাজ আর কোন দিন করব না- দাড়ি কাট-ছাট করব না, বেপর্দায় চলব না, নামাজ ছাড়ব না, অধীনস্থ মহিলাদেরকে পর্দাহীন ভাবে ঘুরতে দেব না, টিভি, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ভিসিডি দেখব না? ইত্যাদি । যদি এরূপ প্রতিজ্ঞা করতেন এবং সাথে সাথে তা বাস্তবায়ন করার জন্য যথাসম্ভব সবকিছুই করতেন, তবে কি আল্লাহ তাআলা আপনার উপর অধিক খুশি হতেন না? এরূপ প্রতিজ্ঞা কি আপনার দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বয়ে আনত না? অবশ্যই । অবশ্যই ।
মুহতারাম সুধী! আমরা নিষ্পাপ নই। নিষ্পাপ থাকা সম্ভবও নয় । কারণ, আমাদের দু’টো ভয়ানক শত্রু আছে। তন্মধ্যে একটি হলো মন- রিপু, আর আরেকটি হলো খোদাদ্রোহী শয়তান। উভয়ের বিষাক্ত দংশনে মানুষ অনেক সময় মোহগ্রস্ত ও নির্বোধ হয়ে পড়ে। জৈবিক উন্মাদনায় তার মনুষ্যত্ব লোপ পায়। নেমে আসে পশুত্বের কাতারে। অতঃপর সে কখনো হিংস্র হায়েনার রূপ ধারণ করে, কখনো বিষাক্ত সাপের রূপ পরিগ্রহণ করে। তখন তার নিষ্ঠুরতম হিংস্র থাবা কিংবা বিষাক্ত ছোবলে শুধু মানুষ নয়, গোটা সৃষ্টিজগত নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে।
কিন্তু প্রকৃত মু’মিন ও আল্লাহর খাঁটি বান্দা তো তারাই যারা মোহ কেটে যাওয়ার সাথে সাথে অনুতপ্ত হয়। অনুশোচনার জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গে দগ্ধ হতে থাকে। বারবার হায় হুতাশ করে চোখের পানি ফেলে বলতে থাকে, হে করুণাময় খোদা! আমার ভুল হয়ে গেছে। এ জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত। আমি তোমার নিকট তওবা করছি। অনুগ্রহ করে আমায় ক্ষমা করে দাও ।
তখন তার অনুশোচনা ও চোখের পানি আল্লাহর ক্রোধকে ঠাণ্ডা করে দেয়। নিভিয়ে দেয় জাহান্নামের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। এদিকে ইঙ্গিত করেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- গুনাহ থেকে সত্যিকার তওবাকারীর উদাহরণ ঠিক তেমন যেন তার কোনো গুনাহই নেই ৷
পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা তওবাকারীকে ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন ।
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আদম সন্তান সবাই ভুলকারী-গুনাহগার। কিন্তু উত্তম তারা, যারা ভুল করার পর, পাপ করার পর তাওবা করে ৷
মোটকথা, মানুষ হিসেবে কখনো কখনো হয়তো আমাদের দ্বারা ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তখনই আমরা হযরত সাহাবায়ে কেরামের প্রকৃত অনুসারী বলে বিবেচিত হব; আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিগণিত হব যখন ভুল বুঝার সাথে সাথে তওবা করে নিব ।
তওবা-ইস্তিগফার দ্বারা যেমন গুনাহ মাফ হয়, তেমনি এর দ্বারা আল্লাহর দরবারে মর্তবাও বুলন্দ হয়। তাই কোনো গুনাহ না হলেও আল্লাহ পাকের শান অনুযায়ী ইবাদতের হক পূর্ণরূপে আদায়ে অক্ষমতার কথা ভেবে সকলের সদা সর্বদা তওবা-ইস্তিগফার করা কর্তব্য । আল্লাহ পাক বান্দার তওবা ইস্তিগফারে বড়ই খুশি হন। এ জন্যই তো রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেগুনা মাসূম হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক সত্তর বারেরও বেশি তওবা-ইস্তিগফার করতেন ।
তওবা করলে আল্লাহ পাক খুশি হওয়ার কারণ হচ্ছে, এর দ্বারা তওবাকারী নিজের ক্ষুদ্রত্ব এবং আল্লাহপাকের বড়ত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ করে থাকে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ছোট মনে করে বিনয় এখতিয়ার করে, আল্লাহ তা’আলা তার দরজা উঁচু করে দেন। সুতরাং মনে রাখতে হবে, তওবা মু’মিনের মর্যাদার প্রতীক-সাফল্যের সোপান ।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে উপরোক্ত ঘটনা ও বর্ণিত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে শিক্ষা নিয়ে খাঁটি মনে তওবা করার তৌফিক নসীব করুন। আমীন।
স্মরনীয় বাণী!
যে ব্যক্তি আমার দোষ ত্রুটি সম্পর্কে আমাকে অবগত করে তার উপর আল্লাহর রহমত হউক। – হযরত উমর (রাঃ)