নূরনবী ﷺ
বিবি হালিমার কোলে নবীর ইনসাফ
একাদশ অধ্যায়ঃ বিবি হালিমার কোলেঃ
প্রসঙ্গঃ দুধবোনের সাথে বকরী চড়ানো- মেঘমালার ছায়াদান- বক্ষ বিদারণ
মক্কার শরীফ খান্দানের প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেক শিশুকেই ধাত্রী মায়ের ঘরে দুধপান ও লালন পালন করানো হতো- পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। উদ্দেশ্য ছিল- শহরের কোলাহল এবং বহু লোকের সংমিশ্রণ থেকে দূরে রেখে একক বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় শিশুর প্রথম ভিত্তি স্থাপন করা। মক্কার অদুরে তায়েফের বনী ছকিফ ও বনি হাওয়াযেন গোত্র ছিল বিশুদ্ধ আরবী ভাষার অঞ্চল- যেমন আমাদের দেশের বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার অঞ্চল হলো নদীয়া- শান্তিপুর। নবী করীম [ﷺ]-এঁর বয়স যখন ১৬/১৭ দিন, তখন তায়েফের বনী ছকিফ গোত্রের হালিমা সা’দিয়া নাম্নী এক দরিদ্র মহিলা তাঁর দুধ মা হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। কবিলার অন্যান্য মহিলাদের সাথে বিবি হালিমা পালক শিশু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন। কিন্তু গরীব বলে কেউ তাকে সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব দিতে ইচ্ছুক ছিলো না। ইত্যবসরে অপেক্ষাকৃত সামর্থবান অন্যান্য সাথী মহিলাগণ ধনী ঘরের সন্তান সংগ্রহ করে ফেলেছে। ইয়াতিম ও গরীব বলে কেউ শিশুনবীকে গ্রহণ করলনা।
[নবী মাতৃগর্ভে আসিয়া – পিতৃহারা হইয়া
এতিমরূপে আসিলেন ধরায়,
পবিত্র এই মুখে- দুধ খাইলেন যার বুকে
ধন্য হলেন বিবি হালিমায়।
ওগো নবীজী-কোন্ সাধনে পাইব তোমায়!!]
এমতাবস্থায় স্বামীর সাথে পরামর্শ করে বিবি হালিমা ইয়াতীম শিশুনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-কে পালিতপুত্র হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী হলেন। বিবি হালিমা রেশমী বিছানায় ঘুমন্ত শিশুনবীর বুকে হাত স্থাপন করতেই মুচকি হাসির ঝলক ছড়িয়ে শিশুনবী জেগে উঠলেন এবং বিবি হালিমার দিকে আকর্ষণীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বিবি হালিমা বলেন, “আমি শিশুনবীর চোখ হতে একটি নূর বের হয়ে আকাশের মহাশূন্যে মিশে যেতে প্রত্যক্ষ করলাম। আমি তাঁর কপালে চুমু খেয়ে তাঁকে কোলে তুলে নিয়ে ডান স্তনের দুধ পান করতে দিলাম। শিশুনবী তৃপ্তি সহকারে দুধ পান করলেন। অতঃপর বাম স্তন থেকে দুধপান করানোর চেষ্টা করলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। দুধপানকালীন পূর্ণ সময়ই শিশুনবীর এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয়নি। কেননা, আমার কোলে আমার আপন শিশু আবদুল্লাহ তাঁর দুধ শরীক ভাই ছিল। নবী করীম [ﷺ]-এঁর এই ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা দেখে আমি অভিভূত হয়ে যেতাম।”
অন্যদের ন্যায্য হক প্রদানের নির্দেশসহ ৪০ বৎসর পর কোরআন নাযিল হয়। কিন্তু শিশুনবী [ﷺ] কোরআন নাযিলের বহু পূর্বেই কোরআনের ইনসাফপূর্ণ সম্পদ বন্টনের নীতি বাস্তবায়িত করে বিশ্বজগতকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নবীগণ আরেফ বিল্লাহ হয়েই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশুকাল থেকেই সকলের জন্য ইনসাফের আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাঁর পূর্ণ জীবনই আমাদের জন্য আদর্শ। কিন্তু মউদুদী পন্থী অধ্যাপক তাঁর রচিত ‘সিরাতুন্নবী’ সংকলনে (!) মন্তব্য করেছেন যে, “নবুয়তের ২৩ বৎসর জিন্দেগীই কেবল আমাদের জন্য আদর্শ।” এটা তার নিজস্ব আবিষ্কার ও ইসলামের অপব্যাখ্যা এবং ইসলামী আকিদার পরিপন্থী মতবাদ। পূর্ব পৃষ্ঠায় প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী করীম [ﷺ] ভূমিষ্ট হয়েই আল্লাহর তৌহিদ ও আপন রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। বুঝা গেলো- নিজের নবুয়ত সম্পর্কে তিনি পূর্ণ অবগত ছিলেন। এবং তাঁর পূর্ণ জীবনই আমাদের জন্য আদর্শ।
বিবি হালিমা বলেন, “আমাদের অঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে আমার পালিত পুত্রের বরকতে আমাদের কোন অভাব ছিলো না। অন্যান্য পরিবারের মেষ ও ছাগপালের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল খাদ্যের অভাবে। কিন্তু আমাদের ছাগ ও মেষপাল দিনের শেষে ঘরে ফিরে আসতো দুধভরা স্তন নিয়ে। আমরা ঐ দুধে সকলেই তৃপ্ত হতাম। এভাবেই আমাদের অভাব দূর হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা অধিক খাদ্যের আশায় তাদের মেষরাশি আমাদের মেষপালের সাথে একই স্থানে পাঠাতো। কিন্তু তাদের মেষপালগুলো ফিরে আসতো খালী পেটে; আর আমাদের মেষপাল আসতো ভরাপেটে- স্তনভর্তি দুধ নিয়ে। আমার স্বামী এ অবস্থা দেখে বলতেন, “হালিমা! আমাদের এ সন্তান ভবিষ্যতে অতি উঁচুদরের মানুষ হবে”।
বিবি হালিমার মেয়ে শায়মা নবী করীম [ﷺ]-কে কোলে কাঁখে করে রাখতেন। সেজন্য নবী করীম [ﷺ] তাঁকে আপন বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। ৮ম হিজরী সনে নবী করীম [ﷺ] হোনায়েন-এর যুদ্ধে বনী ছকিফ ও বনী হাওয়াজেন গোত্রের প্রায় ছয় হাজার লোককে বন্দী করেন। এমতাবস্থায় শায়মা লাঠিতে ভর করে নিজের বংশের বন্দীদের জন্য সুপারিশ করতে নবীজীর খেদমতে হাযির হলে তাঁকে দেখেই নবী করীম [ﷺ] সসম্মানে দাঁড়িয়ে যান এবং নিজের গোত্রের লোকজনদের মুক্তির জন্য আবেদন জানালে নবী করীম [ﷺ] নিজ অংশের বন্দীদের মুক্তি দিয়ে দেন। সাথে সাথে সাহাবীগণও তাঁদের অংশের সকল বন্দীকে মুক্ত করে দেন। এ ছিল গুরুজনদের প্রতি নবীজির ব্যবহারের আদর্শ। এ আদর্শ মেনে চললে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য।
মেঘমালার ছায়া দান
শায়মা বলেন- “আমি আমার কোরেশী ভাইকে নিয়ে মেষ চড়াতে গেলে দেখতে পেতাম- মরুভূমির প্রখর রৌদ্রে একখণ্ড মেঘমালা তাঁকে ছায়া দিত এবং তাঁর সাথে সাথে ঘুরে বেড়াতো। যত দিন তিনি আমাদের প্রতিপালনে ছিলেন ততদিন এরূপ অবস্থা ছিল।”
বিবি হালিমা বলেন – “শিশু অবস্থায় নবী করীম [ﷺ] কাঁদতেন না। এক বার তাঁকে কাঁদাবার ইচ্ছায় এবং কান্নার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার বাসনায় তাঁর দু’হাত রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেই।” নবী করীম [ﷺ] বলেন, আমার হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে যাওয়ার ব্যথায় আমি কান্না করতে যাবো – এমন সময় আকাশের চাঁদ আমাকে শান্তনা দিয়ে বললো- ’কাঁদবেন না’, চাঁদের একথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। মায়ের আশা পূরণ হলো না।” (যিকরে জামিল-মুফতী শফি ওকাড়ভী)।
বিবি হালিমার ঘরে নবীজী তেইশ মাস ১৩ দিন দুধপান করে দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এভাবে ২৪ মাস বা দু’ বৎসর দুধ পান করে তিনি দুধপান ছেড়ে দেন। এটা কোরআনের বিধান। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী কোরআন নাযিলের বহু পূর্বেই কোরআনী বিধান বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি কোরআনী বিধানের মুখাপেক্ষী নন। তিনি মুখাপেক্ষী শুধু আল্লাহর।
বক্ষ বিদারণঃ
বিবি হালিমার গৃহে অবস্থানকালীন সময়ে দুই বৎসর পর দু’জন ফেরেশতা এসে মাঠের মধ্যে নবী করীম [ﷺ]-এঁর সিনা মোবরক বিদীর্ণ (চাক) করে নফছে আম্মারার স্থানটুক সরিয়ে ফেলে দেন এবং নূর, হেকমত, ইসমত, আসরার- ইত্যাদি নেয়ামত তথায় স্থাপন করে দেন। এটাকে প্রথম শক্কে ছদর বলা হয়। অতঃপর চার বৎসর বয়সে তিনি আপন মায়ের কোলে ফিরে আসেন। একেবারে শিশু জীবিনের ঘটনাবলী এভাবে বর্ণনা করা কার পক্ষে সম্ভব? আল্লাহ প্রদত্ত ইলেমে লাদুন্নী বা ইলমে গায়েব ছাড়া এসব ঘটনা বলা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এতে বুঝা যায়- নবীগণের গায়েবী ইলম জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। (সীরাতুন্নবী-সুলায়মান নদভী)।