একজন ছাত্র। তালেবে ইলম। বয়সে তরুণ। দিল্লীর এক মাদরাসায় পড়াশুনা করে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার সুনাম সুখ্যাতি ইতোমধ্যেই গোটা মাদরাসায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ছেলেটি ছিল সুন্দর, সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী। সে রাত যাপন করত পাশেই একটি মসজিদে। সেখানে সে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। তার ইচ্ছা সে একজন বড় আলেম হবে। দেশ ও জাতির খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করবে।
এক রাতের ঘটনা।
পাশের মহল্লার এক যুবতী মেয়ে মসজিদের সম্মুখ দিয়ে তার কোন এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। এমন সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে লোকজন এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগল। চতুর্দিকে শুরু হলো হৈ চৈ, মারামারি, কাটাকাটি । এসব দেখে মেয়েটি ভীষণ ঘাবড়ে গেল। সে প্রাণ ভয়ে দৌড়ে গিয়ে মসজিদে আশ্রয় নিল ।
রাত অনেক হয়েছে। অন্ধকার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মসজিদে অবস্থানরত ছাত্রটি তখন গভীর পড়াশুনায় নিমগ্ন। হঠাৎ তার বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। সে বের হওয়ার সময় দেখল, একটি অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী মেয়ে মসজিদের ভিতরে বসে আছে। মেয়েটিকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সংযত করল। কিন্তু সাথে সাথে একটি যুবতী মেয়েকে রাতের অন্ধকারে একাকী দেখতে পেয়ে এক অজানা আশঙ্কায় তার মন দুরু দুরু করে কাঁপতে শুরু করল। সে ভাবল, মসজিদে এখন আমি ও এ মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নেই। খোদা না করুন, যদি কেউ এখন আমাদেরকে দেখে ফেলে তাহলে সে অবশ্যই আমাদের উপর বদগুমান করবে। এমনকি সে খারাপ হলে আমাদেরকে মিথ্যা অপবাদে জড়িয়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। তাই সে কালবিলম্ব না করে বারবার অনুরোধ করে মেয়েটিকে বলল, আপনার জন্য এখানে অবস্থান করা কিছুতেই উচিত হবে না। লোকজন দেখলে আমাকে অপবাদ দিবে। এতে আমার ইজ্জত সম্মান ভুলুণ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে মাদরাসা এবং মাদরাসার ছাত্রদের সুনামও ক্ষুন্ন হবে। মানুষ ভাববে, মাদরাসার ছাত্রদের চরিত্র বুঝি এমনই হয়। শুধু তাই নয়, তারা আমাকে মসজিদ থেকেও বের করে দিবে। ফলে এর দ্বারা আমার শিক্ষা জীবনের চরম ক্ষতি হওয়ারও প্রবল আশংকা রয়েছে।
মেয়েটি বলল, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাইরে বের হলে আমার প্রাণ নাশের সমূহ সম্ভাবনা আছে। সেই সাথে ইজ্জত ও সম্ভ্রম নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব কি না তারও আশংকা রয়েছে। এ অবস্থায় কি করে আপনি আমাকে এ স্থান থেকে তাড়িয়ে দিতে চান। মসজিদ তো আল্লাহর ঘর। এ ঘরকে আমরা নিরাপদ ঘর বলেই মনে করি। সুতরাং এখানেই যদি জীবনের নিরাপত্তা না পেলাম, তাহলে কোথায় আশ্রয় নিয়ে জীবনের নিরাপত্তাবোধ করব?
মেয়েটির এই আবেগপূর্ণ যুক্তিযুক্ত কথায় ছাত্রটি নিরুপায় হয়ে বলল,তাহলে আপনি এক কাজ করুন। আপনি মসজিদের ঐ কোণায় বসে
পড়ুন। সকাল হলে বাড়ি চলে যাবেন ।
মেয়েটি বলল, ঠিক আছে। তাই হবে। এটুকু বলে সে মসজিদের পশ্চিম দক্ষিণ কোণে বসে পড়ল।
মসজিদটি ছিল খুব ছোট। মেয়েটির যেন বেশী কষ্ট না হয়, এজন্য ছেলেটি তাকে একটি কম্বল দিল। মেয়েটি সানন্দে তা গ্রহণ করল। তবে সে খুব ভাল করে লক্ষ্য করল যে, প্রথম দৃষ্টির পর এ পর্যন্ত ছেলেটি তার দিকে আর একবারও চোখ তুলে তাকায় নি
যা হোক, মেয়েটি কম্বল ভাঁজ করে উহার উপর আরামের সাথে বসে যাওয়ার পর ছেলেটি মসজিদের অপর কোণায় গিয়ে পূর্বের ন্যায় পড়াশুনায় মশগুল হয়ে গেল। মেয়েটির কোন কাজ ছিল না। সে কেবল ভোর হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল। তবে রাতব্যাপী ছেলেটির একটি কাজ মেয়েটিকে বেশ আশ্চর্য করল। সে দেখল, ছেলেটি একটু পর পর নিজের হাতের আঙ্গুল বাতির আগুনে চেপে ধরছে। এমনিভাবে গোটা রাত অতিবাহিত হয়ে গেল।
ভোর হতে অল্প কিছুক্ষণ বাকী। ছেলেটি আপন স্থান থেকে উঠে এল। অতঃপর মেয়েটির কাছে এসে বলল, এখন চতুর্দিক শান্ত। দাঙ্গামুক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি ।
মেয়েটি বলল, আমি বাসায় যাব, কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ছি না। আমি লক্ষ্য করেছি, কিতাব অধ্যয়নকালে আপনি বারবার আপনার হাতের আঙ্গুল বাতির আগুনে চেপে ধরেছেন। এর কারণ কি?
ছেলেটি বলল, এটি আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ব্যাপারে আপনার কিছু জানার আছে বলে আমি মনে করি না।
কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। সে বার বার বিষয়টি জানার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকল। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি যখন বুঝল, মেয়েটির কাছে এ ব্যাপারে কিছু না বলার আগে সে যাবেই না, তখন সে বলতে বাধ্য হলো। সে বলল-
বোন! আপনি হয়তো জানেন যে, শয়তান আমাদের চিরশত্রু। সে আমাদেরকে বিপদগামী করে জাহান্নামে নিতে চায়। চায় লজ্জিত, বঞ্চিত ও অপমানিত করতে। আপনাকে ঐখানে বসিয়ে আসার পর থেকে সে আমাকে বারবার গুনাহের কাজে জড়িয়ে ফেলার জন্য প্ররোচিত করছিল। তাছাড়া আমার কু-প্রবৃত্তিও আমাকে বারংবার বলছিল, তুমি এক্ষুণি মেয়েটির কাছে চলে যাও। সেও তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। কিন্তু লজ্জায় মুখ খুলে কিছু বলতে পারছে না। তোমার মতো বলিষ্ঠ যুবকের ছোঁয়া পেলে সে খুশিই হবে। যাও, বিলম্ব করো না। জৈবিক চাহিদা পূর্ণ কর। এমন সুন্দর মেয়ে কখনও দেখেছ কি? সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারিও না। এমন নির্জন ও নিরাপদ পরিবেশে মনের সাধ মিটানোর সুযোগ ভবিষ্যতে কোনদিন নাও পেতে পার।
বোন! শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় যখন আমি চরম উত্তেজিত হয়ে পড়তাম, তখন বাতির আগুনে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে স্বীয় সত্তাকে উদ্দেশ্য করে বলতাম, হে নফস। এ অবৈধ কাজে লিপ্ত হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নি সর্বদা তোমাকে তাড়া করে ফিরবে। তোমাকে তো দেখছি, দুনিয়ার এই সাধারণ অগ্নির সামান্য উত্তাপ বরদাশত করতে পারছ না। তাহলে কিরূপে তুমি দুনিয়ার আগুনের চেয়ে হাজারো গুণ বেশী উত্তপ্ত জাহান্নামের দহন সহ্য করতে পারবে?
বোন! এসব কথা বলে বলে সারারাত আমি নিজেকে আপনার সংস্পর্শে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছি। এবার বুঝলেন তো, আগুনে আঙ্গুল প্রবেশ করানোর মূল রহস্য?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, বুঝেছি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আপনার মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান ছেলে জীবনে কোথাও দেখি নি। আপনার কথাগুলো শুনে আমি কেবল হতবাকই হই নি, রীতিমত বিস্মিত হয়েছি। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব যেন আপনার এই নিষ্ঠা ও সততার উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে পারি।
এতটুকু বলে মেয়েটি বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। ছেলেটি তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আপন স্থানে ফিরে এল ।
এদিকে মেয়েটি হারিয়ে যাওয়ায় বাড়ির লোকজন সীমাহীন পেরেশান। গোটা রাত মেয়েটিকে তারা এখানে সেখানে সর্বত্র খুঁজে ফিরেছে। কিন্তু তারা ধারণাই করতে পারেনি যে, মেয়েটি একাকী মসজিদে বসে সারারাত কাটিয়ে দিবে ।
বাড়ি যাওয়ার পর সকলেই মেয়েটিকে ঘিরে ধরল। সারারাত সে কোথায় কিভাবে ছিল সবাই তা জানতে চাইল। মেয়েটি সবকিছু খুলে বলল। সাথে সাথে সেই ছাত্রটির সততা ও সংযমের কথাও সকলকে জানাল। এতে উপস্থিত সবাই যারপর নাই বিস্মিত হলো, আনন্দিত হলো।
মেয়েটির পিতা একজন ধনী মানুষ। বিশাল ধন সম্পদ ও বিত্ত বৈভবের মালিক তিনি। কোন কিছুর অভাব নেই তাঁর। সেই সাথে তিনি একজন সৎ ও ধর্মভীরু মানুষ । এই ঘটনার পর মেয়েকে তিনি বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ।
চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগল, বহু উঁচু ও নামীদামী পরিবার থেকে ডিগ্রীধারী ছেলেদের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলো। কিন্তু না, মেয়ের সাফ একটাই জবাব- ঐ ছেলে ছাড়া সে কোথাও বিয়ে বসবে না। তার পদসেবা ও খেদমত করেই সে আজীবন কাটিয়ে দেবে।
পিতামাতা সহ পরিবারের লোকজন সবাই তাকে বুঝাল। বলল- দেখ, তুমি যে ছেলের কথা বলছ, সে অনেক গরিব। টাকা পয়সা, বাড়িঘর কিছুই নেই তার। তোমার মত একজন ধনীর দুলালীর কি এমন গরিব ছেলের সাথে মানাবে? তুমি কি পারবে এই সীমাহীন অভাব অনটন থেকে সুখী জীবন যাপন করতে?
মেয়েটি বলল, সুখ দুঃখ আল্লাহর হাতে। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এরূপ সৎ ও চরিত্রবান ছেলের কাছে কোন মেয়ে অসুখী হতে পারে না। আর অভাব অনটন? আমি মনে করি, এমন নিষ্ঠাবান ও ধর্মভীরু ছেলের সাথে আজীবন কুঁড়ে ঘরে কাটিয়ে দিলেও কোন সমস্যা নেই। আপনারা ভাল করে শুনে নিন, এই পরহেযগার ও আল্লাহওয়ালা ছেলের সেবা করার সুযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
মেয়ের কথায় সবাই বুঝল, ছেলেটির সততা মেয়েটিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। আসন করে নিয়েছে তার হৃদয়রাজ্যে। সুতরাং অন্যত্র জোর করে বিয়ে দিলে সে শান্তি পাবে না। সুখী হতে পারবে না কোন দিন।
যাহোক, এসব কথা চিন্তা করে ছেলের অভিভাবকদের সাথে এ ব্যাপারে তারা আলোচনা করল এবং এক পর্যায়ে দিন তারিখ ঠিক করে বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন করল।