আবু আবদুল্লাহ্ নাব্বাহী থেকে কথিত আছে, তিনি বলেন, একদা আমি উটে আরোহণ করে সফরে যাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গীগণের মধ্যে একজন লোক এমন ছিলো যে, তার বদনযর লাগতো। সে কোনো জিনিসের প্রতি ভালোভাবে নযর করলেই তা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। আব্দুল্লাহ ইবনে নাব্বাহীকে লোকেরা উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে বললো, আপনার উটকে উক্ত ব্যক্তির বদনযর থেকে হেফাজতে রাখবেন। ইবনে নাব্বাহী বললেন, সে আমার উটের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। ইবনে নাব্বাহীর কথা উক্ত ব্যক্তি শুনতে পেয়ে এই সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলো যে, ইবনে নাব্বাহী এদিক সেদিক কোথাও গেলেই তার উটের উপর সে বদনযর করবে। ইবনে নাব্বাহী একবার দূরে কোথাও চলে গেলে সে যথাস্থানে এসে উটের উপর বদনযর করলো। গাছ কেটে দিলে যেমন মাটিতে ধপাশ করে পড়ে যায়, ঠিক তেমনি উটটি ধরাশায়ী হয়ে গেলো।
ইবনে নাব্বাহীর নিকট যখন এ খবর পৌঁছলো, তখন তিনি এসে বদনযরকারী লোকটিকে দেখে এই রাকিয়া পাঠ করলেন।
ﺑِﺴْﻢِ اﷲِ ﺣَﺒْﺲٍ ﺣَﺎﺑِﺲٍ وَﺷَﺠَﺮٍ ﯾﱠﺎﺑِﺲٍ وﱠ ﺷِﮭَﺎبٍ ﻗَﺎﺑِﺲٍ رُدﱠتْ ﻋَﯿْﻦُ
ْاﻟﻌَﺎﺋِﻦِ وَﻋَﻠﻲ اَﺣَﺐﱢ اﻟﻨﱠﺎسِ اِﻟَﯿْﮫِ ﻓِﺎرْﺟِﻊِ اﻟْﺒَﺼَﺮَ ھَﻞْ ﺗَﺮَا ﻣِﻦْ
اﻟْﺒَﺼَﺮَ ﻛَﺮﱠﺗَﯿْﻦِ ﯾَﻨْﻘَﻠِﺐْ اِﻟَﯿْﻚَ اﻟْﺒَﺼَﺮُ ﺧَﺎﺳِﺌًﺎ
ﺛُﻢﱠ ارﱠﺟِ ِﻊ
ﻓُﻄُﻮْرِ–
وَھُﻮَ ﺣَﺴِﯿْﺮٌ –
দোয়াটি পাঠ করার পর বদনযরকারীর চোখ দু’টি কোটর থেকে বেরিয়ে পড়লো এবং উট সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলো। বদনযরের ক্ষেত্রে উক্ত রাকিয়ার আমলটিও করা যায়। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে ইবনে কাইয়্যুম (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, বদনযর থেকে বেঁচে থাকার জন্য বদনযরকারী থেকে দূরে থাকা জায়েয। আর সুুন্দর বস্তু, ব্যক্তি বা প্রাণীকে বদনযর থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তার মধ্যে এমন কোনো কিছু ব্যবহার করা যাতে নযর ফিরে যায়, এরকম করাও জায়েয।
ইমাম বাগবী (رحمة الله)শারহে সুন্নাহ কিতাবে এরকম উলেখ করেছেন।
হজরত ওছমান (رضي الله عنه) এক সুন্দর ফুটফুটে শিশু দেখে বলেছিলেন, এর থুতনীতে কালো বিন্দু লাগিয়ে দাও, যাতে বদনযর লাগতে না পারে। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবেও এরকম বর্ণনা আছে। এখানে অবশ্য একটি কথা উল্লেখ্য যে, শিশুর থুতনীতে কালো বিন্দু লাগিয়ে দিলে তার দেহের সৌন্দর্য ¤ান হয় না। তবু তাই করতে বলা হয়েছে। এটাও একটি ভেদের ব্যাপার যা বোধগম্য নয়। তবে এদ্বারা বদনযর থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এটাও একপ্রকার রাকিয়ার আমল। আল্লাহ্পাকই ভালো জানেন।
রসুলে আকরম (ﷺ) হজরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) এর গৃহে একটি কন্যা সন্তান দেখতে পেয়ে বললেন, এর উপর জ্বীনের বদনযরের আছর রয়েছে। বোখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে, রসুলেপাক (ﷺ) মেয়েটিকে দেখলেন, তার চেহারা হলুদ হয়ে গিয়েছে। বললেন, এ মেয়েটির জন্য দোয়া কালাম পড়ো। এর উপর জ্বীনের বদনযর রয়েছে।
এ দ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষের বদনযরের মতো জ্বীনেরও বদনযর পড়তে পারে। আর বলা হয়ে থাকে, মানুষের নযর থেকে জ্বীনের নযর তীব্রতর। আরেক হাদীছে এসেছে, রসুলেপাক (ﷺ) হজরত উম্মে সালামা (رضي الله عنه) এর ঘরে গেলেন। সেখানে তিনি একটি কন্যাকে দেখতে পেলেন। তার গায়ের রঙ হলুদ হয়ে গিয়েছিলো। লোকেরা বললো, এর উপর বদনযর হয়েছে। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তবে বদনযরের দোয়া কালাম পড়লে না কেনো?
বলা হয়ে থাকে, সুন্দর কিছু দেখে বিস্মিত হলেই তার উপর নযর লেগে থাকে। দুশমনী এবং হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে নাও হতে পারে। কোনো নেককার লোকের মহব্বতের দৃষ্টিতেও নযর লাগতে পারে। যেমন সাহল ইবনে হানিফ (رضي الله عنه) এর উপর আমের ইবনে বারীআর বদনযর পড়েছিলো। সহসা যার বদনযর লেগে যায়, তার উচিত সুন্দর মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য দোয়া খায়ের করা। হেফাজতের জন্য এটিও একটি আমল।
শাসকের উপর কর্তব্য, যে ব্যক্তির বদনযর লাগে তাকে সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করতে না দেয়া। ঘরের বাইরে তাকে যেতে দেয়া উচিত নয়। সে দরিদ্র হলে তাকে জীবনধারণযোগ্য জীবিকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কেনোনা এ ব্যক্তির মাধ্যমে যে ক্ষতি সাধিত হয়, কুষ্ঠ রোগীর সাথে মেলামেশা করাতেও সেরকম ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে না। হজরত ওমর (رضي الله عنه) এ ধরনের লোককে সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করতে দিতেন না। মানুষের সঙ্গে একত্রে খানাপিনা করতে এবং জামাতে নামাজ পড়তেও তাদেরকে মানা করতেন।
বদনযরের কারণে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুকে হত্যার সাথে তুলনা করে হত্যাকারীর কাছ থেকে দিয়ত আদায় করা যাবে কিনা – এ সম্পর্কে উলামা কেরামের মতভেদ রয়েছে। ফেকাহ ও হাদীছ শাস্ত্রের বিখ্যাত আলেম ইমাম কুরতুবী বলেন, বদনযরকারীর নযরে কোনো বস্তু নষ্ট হয়ে গেলে তার উপর ক্ষতিপূরণ ওয়াজিব হবে। আর বদনযরের মাধ্যমে কাউকে মেরে ফেললে, কেসাস নিতে হবে- দিয়ত নয়। বদনযরকারীর দ্বারা যদি কোনো ঘটনা দুবার সংঘটিত হয়, তাহলে সে একাজে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে ধরে নিতে হবে এবং যাদুকরের যে বিধান সেইরূপ তাকে শাস্তি দিতে হবে।
ইমাম নববী (رحمة الله) রউযাহ নামক কিতাবে বলেছেন, বদনযরকারী থেকে দিয়ত বা কাফ্ফারা কিছুই নেয়া যাবে না। কেনোনা কাজটি কোনো সাধারণ রীতির কাজ নয়, এটা ব্যাপক ব্যাপারও নয়। ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা এটা হয়ে থাকে। আবার এমনও হয় যে, কোনো কোনো অবস্থায় বদনযর লাগেও না। যে লোকটির জীবন নাশ হয়ে গেলো, তা যে এর মাধ্যমেই হয়েছে- তা নির্দিষ্ট ও অকাট্যভাবে বলাও যায় না। আবার কখনও এমন হয়, বদনযরকারী কাজটি করলেও ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে করে না। তাই এর ফলে কোনোকিছু ওয়াজিব হবে না।
রসুলে আকরম (ﷺ) দৈহিক সমস্ত ব্যাধির জন্য রাকিয়ার আমল করতেন এবং দোয়া করতেন। যেমন জ্বর, কাঁপুনি রোগ, সর্দি, ভয়-ভীতি, অনিদ্রা, লু হাওয়ার আক্রমণ, দুশ্চিন্তা, ব্যথা-যন্ত্রণা, বিপদাপদ, দূরাবস্থা, শরীর ব্যথা, দারিদ্র, ঋণগ্রস্ততা, দাঁত ব্যথা, যবান বন্ধ হওয়া, খুজলি- পাচড়া, তাকছীর, প্রসবকষ্ট ইত্যাদি সর্বপ্রকারের অসুখ বিসুখ ও বিপদাপদে তিনি দোয়া করতেন, কাফিয়া বা ঝাড় ফুঁক দিতেন এবং তাবিয প্রদান করতেন। এসবের বর্ণনা হাদীছ শরীফে রয়েছে। দৈহিক ব্যাধির চিকিৎসা করার সাথে সাথে মানসিক ব্যাধির চিকিৎসাও তিনি করতেন। তবে এখানে মানসিক ব্যাধি থেকে কেবল যাদুর বিষয়টি আমরা আলোচনা করবো। কেনোনা, জনৈক ইহুদী রসুলেপাক (ﷺ) কে যাদু করেছিলো। তাই এ ব্যাপারে কিছু জানা প্রয়োজন বিধায় যাদুর আলোচনাটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অন্যসব বিষয়ের আলোচনা জরুরী নয়।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]