ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে জুলুস বা আনন্দ মিছিল করা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী

………………………………………….

সৈয়দে আলম রাসূলে আকরাম (দ.) এই ধরার বুকে আগমন সকল সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত এবং আনন্দের বিষয়। আর সেই আগমনের আনন্দকে উদযাপন করার অন্যতম পন্থা হল জশনে জুলুস করা। কেননা, হিজরতের দিন মদিনার নারী-পুরুষ ও শিশুও প্রিয় নবীজি(দ.) এর আগমনে আনন্দিত হয়ে মদিনার রাস্তায় ও ঘরের ছাদে “ইয়া মুহাম্মদ” “ইয়া রাসূলাল্লাহ” শ্লোগানের দ্বারা বরণ করেছিলেন এবং মদিনার আকাশ বাতাস মুখরিত করেছিল। যেমন হাদীসে আছে –

فَقَدِمْنَا الْمَدِينَةَ لَيْلاً فَتَنَازَعُوا أَيُّهُمْ يَنْزِلُ عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏”‏ أَنْزِلُ عَلَى بَنِي النَّجَّارِ أَخْوَالِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ أُكْرِمُهُمْ بِذَلِكَ ‏”‏ ‏.‏ فَصَعِدَ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ فَوْقَ الْبُيُوتِ وَتَفَرَّقَ الْغِلْمَانُ وَالْخَدَمُ فِي الطُّرُقِ يُنَادُونَ يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللَّهِ يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ‏.‏

“হজরত আবু বকর (রা:) বলেন, রাত্রে আমরা মদিনায় পৌঁছলাম। রাসূলে পাক(দ.) কার বাড়িতে অবস্থান করবেন এই নিয়ে লোকদের মাঝে বিতর্ক শুরু হল। তখন তিনি বললেন, আমি আব্দুল মুত্তালিবের মামার বংশ বনু নাজ্জারে অবতরণ করব। রাসুল (দ.) তাদের গোত্রে অবতরণ করত: তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। অতপর পুরুষ লোকেরা পাহাড়ে আরোহণ করে মহিলারা গৃহের ছাদে এবং যুবক ও ক্রীতদাসগণ রাস্তায় এই আওয়াজে স্লোগান বা আহ্বান করতে লাগলেন: “ইয়া মোহাম্মদ” “ইয়া রাসূলাল্লাহ” “ইয়া রাসূলাল্লাহ” ।

(সহিহ মুসলিম: খন্ড নং -২ : ৪১৯ হাদিস নং ৭২৪১ باب في حديث الهجرة : মুসনাদে আবী ইয়ালা: হাদিস নং ১১৬)

এই হাদীস থেকে বুঝা যায়, মদিনার সাহাবীরা প্রিয় নবীজির আগমনে আনন্দিত হয়ে রাস্তায় বের হয়ে আনন্দ মিছিল করে “ইয়া মোহাম্মদ” “ইয়া রাসূলাল্লাহ” “ইয়া মোহাম্মদ” “ইয়া রাসেলাল্লাহ” স্লোগান দিয়েছে। সুতরাং রাসূলে পাক(দ.) এর মিলাদ বা আগমনের দিনে এরূপ আনন্দ মিছিল করা ও ইয়া মোহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ ইয়া মোহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ স্লোগান দেওয়া মদিনার সাহাবীদের আমলে সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈধ আমল। মদিনা সাহাবীদের আমল যে প্রিয় নবী(দ.) এর আগমনে খুশি ও আনন্দিত হয়ে এরূপ করেছিল তার আরও একটি প্রমাণ নিচের হাদিসটি। যেমন:-

عن ابي اسحاق، قال: سميت البراء، قال…..ثم جاء رسول الله صلى الله عليه وسلم، فما رايت اهل المدينة فرحوا بشيء قط فرحهم به، حتى رايت الولاءد والصبيان يقولون: هذا رسول الله صلى الله عليه وسلم قد جاء.

“তাবেঈ ইমাম আবু ইসহাক সাবাঈ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি হযরত বারা ইবনে আযেব (র.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন…… অতঃপর আল্লাহর রাসূল(দ.) মদীনায় আসলেন। তিনি বলেন, আমি মদিনা বাসীকে ইতিপূর্বে কোন বিষয়ে এরূপ আনন্দ প্রকাশ করতে দেখি নি। মদিনার পিতাগণ ও শিশুরা বলতে লাগলো ইনি আল্লাহর রাসূল অবশ্যই আমাদের কাছে এসেছেন।

(মুসনাদে আহমদ: হাদিস নং ১৯৫১২, ১৮৫৬৮; সহি বুখারী: হাদিস নং ৩৯২৫ ও ৪৯৪১; ইমাম বায়হাকী: সুনানে কোবরা, হাদীস নং ১৭৭৩৮; ইমাম নাসায়ী: সুনানে কোবরা, হাদিস নং ১১৬০২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: হাদীস নং ৩৫৭৯০; মেশকাত শরীফ: হাদিস নং ৫৯৫৬; ইমাম ইবনে সালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৩য় খন্ড, ২৭২পৃ:; সিরাতে নববীয়্যাতু ছাহিহিয়্যাতু, ১ম খন্ড, ২১৯পৃ:; সুবুলুছ ছালাম মিন ছাহিহী সিরাতি খাইরিল আনাম, ১ম খন্ড, ২২৭পৃ:)

এই হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, মদীনাবাসী আল্লাহর রাসূল(দ.)কে পেয়ে আনন্দিত হয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন এবং আনন্দের শ্লোগান ইয়া মোহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ ইয়া মোহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ বলেছেন। এ সম্পর্কে আরেকটি রেওয়াত লক্ষ্য করুন–

عن انس قال: لما كان اليوم الذي قدم فيه رسول الله صلى الله عليه وسلم المدينة اضاء منها كل شيء.

“হযরত আনাস (রা:) বলেন, যেদিন রাসূলে পাক(দ.) মদীনায় আগমন করলেন সেদিন আনন্দে সকল কিছু আলোকিত হয়ে গেছিল।

(মুসনাদে আহমদ: হাদীস নং ১৩৮৩০; তিরমিজি শরিফ: হাদিস নং ৩৬১৮; মুসনাদে আবী ইয়ালা: হাদিস নং ৩২৯৬; সুনানে ইবনে মাজাহ: হাদিস নং ১৬৩১; সুনানে বাযযার: হাদীস নং ৬৮৭১; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, হাদীস নং ৩৮৩৩; ইমাম ইবনে সালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৩য় খন্ড, ২৭২পৃ:; ইমাম সুয়ূতী: খাসায়েসুল কুবরা, ১ম খন্ড, ৩১২পৃ)‌। ইমাম তিরমিজি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

অনুরূপ আরেকটি রেওয়াত ইমাম জিয়াউদ্দিন মাকদেছী(রহ:) ওফাত ৬৪৩ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেছেন–

عن انس وذكر النبي صلى الله عليه وسلم قال شهدت يوم دخل المدينة فما رايت يوما قط کان أحسن منه ولا أضوأ .

“হযরত আনাস (রা:) নবী করীম(দ.)এর সম্পর্কে বলেন, আমি সেদিন মদিনায় উপস্থিত ছিলাম যেদিন আল্লাহর নবী মদীনায় আগমন করেন। আমি ওই দিনের চেয়ে এত সুন্দর ও আলোকিত দিন আর কখনো দেখিনি।

(ইমাম মাকদেছী: আহাদিছুল মুখতারা, হাদীস নং ১৬৯০; ইমাম ইবনে সালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৩য় খন্ড, ২৭২পৃ:)

عَن الْبَراء قَالَ: أَوَّلُ مَنْ قَدِمَ عَلَيْنَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ وَابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ فَجَعَلَا يُقْرِآنِنَا الْقُرْآنَ ثُمَّ جَاءَ عَمَّارٌ وَبِلَالٌ وَسَعْدٌ ثُمَّ جَاءَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فِي عِشْرِينَ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ جَاءَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَا رَأَيْتُ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرِحُوا بِشَيْءٍ فَرَحَهُمْ بِهِ حَتَّى رَأَيْتُ الْوَلَائِدَ وَالصِّبْيَانَ يَقُولُونَ: هَذَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ جَاءَ فَمَا جَاءَ حَتَّى قرأتُ: [سبِّح اسْم ربِّك الْأَعْلَى] فِي سُوَرٍ مِثْلِهَا مِنَ الْمُفَصَّلِ. رَوَاهُ البُخَارِيّ رواہ البخاری (4941) ۔ (صَحِيح)

৫৯৫৬-[১] বারা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) -এর সাহাবীদের মাঝে সর্বপ্রথম যারা হিজরত করে মদীনায় আমাদের কাছে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন মুসআব ইবনু উমায়র এবং (আবদুল্লাহ) ইবনু উম্ম মাকতুম (রাঃ)। তাঁরা দুজন এসেই আমাদেরকে কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। এরপর আসলেন ‘আম্মার, বিলাল ও সাদ (রাঃ)। তারপর আসলেন ‘উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) যিনি নবী (সা.) -এর বিশজন সাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর (সর্বশেষ) আসলেন নবী (দ.)।

নবী (সা.) -এর আগমনে আমি মদীনাবাসীকে এত বেশি খুশি হতে দেখেছি যে, অন্য কোন জিনিসে তাদেরকে ততটা আনন্দিত হতে আর কখনো দেখিনি। এমনকি আমি দেখেছি, মদীনার ছোট ছোট মেয়ে এবং ছেলেরা পর্যন্ত খুশিতে বলতে লাগল, ইনিই তা সেই আল্লাহর রাসূল (সা.), যিনি আমাদের মাঝে আগমন করেছেন। বারা (রাঃ) বলেন, তিনি আসার আগেই আমি “সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ’লা-” (সূরাহ আ’লা-) ও অনুরূপ আরো কতিপয় ছোট ছোট সূরাহ্ শিখে ফেলেছিলাম। (সহীহ: বুখারী ৪৯৪১, মুসনাদে আহমাদ ১৮৫৩৫, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ১১৬৬৬, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৫৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৮১৯৪।)

عَن أَنَسٍ قَالَ: لَمَّا قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ لَعِبَتِ الْحَبَشَةُ بِحِرَابِهِمْ فَرَحًا لِقُدُومِهِ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَفِي رِوَايَةِ الدَّارِمِيِّ (صَحِيح) قَالَ: مَا رَأَيْتُ يَوْمًا قَطُّ كَانَ أَحْسَنَ وَلَا أَضْوَأَ مِنْ يَوْمٍ دَخَلَ عَلَيْنَا فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَا رَأَيْت يَوْمًا كَانَ أقبح وأظلم مِنْ يَوْمٍ مَاتَ فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِي رِوَايَةِ التِّرْمِذِيِّ قَالَ: لَمَّا كَانَ الْيَوْمُ الَّذِي دَخَلَ فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ أَضَاءَ مِنْهَا كُلُّ شَيْءٍ فَلَمَّا كَانَ الْيَوْمُ الَّذِي مَاتَ فِيهِ أَظْلَمَ مِنْهَا كُلُّ شَيْءٍ وَمَا نَفَضْنَا أَيْدِيَنَا عَنِ التُّرَابِ وَإِنَّا لَفِي دَفْنِهِ حَتَّى أَنْكَرْنَا قُلُوبنَا اسنادہ صحیح ، رواہ ابوداؤد (4923) و الدارمی (1 / 41 ح 89) و الترمذی (3618 وقال : صحیح غریب) * سند ابی داود صحیح علی شرط الشیخین و سند الدارمی صحیح و سند الترمذی : حسن ۔ (صَحِيح)

৫৯৬২-[৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ.) যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন হাবশী লোকেরা তাঁর আগমনে উৎফুল্ল হয়ে নিজ বর্শা দিয়ে খেল-তামাশা প্রদর্শন করল। (আবূ দাউদ)

দারিমীর এক বর্ণনাতে আছে, আনাস (রাঃ) বলেন: যেদিন রাসূলুল্লাহ (দ.) (মদীনায়) আমাদের মাঝে আগমন করলেন, সেদিনের তুলনায় অধিক উত্তম ও উজ্জ্বলতম দিন আমি কখনো দেখতে পাইনি এবং যেদিন রাসূলুল্লাহ (দ.) ইন্তিকাল করেছেন, সেদিনের তুলনায় অধিক মন্দ ও তিমিরময় দিন আমি দেখতে পাইনি।

তিরমিযীর বর্ণনায় আছে, আনাস (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (দ.) যেদিন মদীনায় আগমন করেছেন, সেদিন তার সবকিছু আলোকিত হয়ে যায়। আর যেদিন তিনি ইন্তিকাল করেছেন, সেদিন তার সবকিছু আধারে ঢেকে যায়। (তিনি আরো বলেছেন,) রাসূলুল্লাহ (দ.) -কে দাফন করে আমরা আমাদের হাত হতে মাটি ঝেড়ে না নিতেই আমরা স্বীয় অন্তরে উদাসীনতা অনুভব করতে লাগলাম।

(সনদ সহীহ: আবূ দাউদ ৪৯২৩, মুসনাদে আহমাদ ১২৬৭০, মুসনাদে আদ ইবনু হুমায়দ ১২৩৯, আবূ ইয়া’লা ৩৪৫৯, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৩৯১১।)

অতএব, রাসূলে করীম (দরুদ) মদীনায় আগমনের দিনটি ছিল মদিনাবাসীর আনন্দ ও খুশির দিন। এই কারণে তারা এত আনন্দিত হয়ে তারা আনন্দ মিছিল, আনন্দ শ্লোগান দিয়ে মদিনার আকাশ ও জমিন মুখরিত করেছিল। তাই রাসুলে পাক(দরুদ)এর আগমন বা মিলাদ উপলক্ষে আনন্দ মিছিল করা ও আনন্দ স্লোগান দেওয়া মদিনার সাহাবীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আমল।

————————

বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) বইটি পড়তে পারেন ।

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী

ঢাকা।

১৫. ০৯. ২০২৩ ইং

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment