ইসলাম হল আদব-নির্ভর, বেয়াদবদের ইসলামে কোন স্থান নেই।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন, “আর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।” (সূরা হজ্জ্ব, আয়াত ৩২)
“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উচ্চ করো না। তোমরা নিজেরা পরস্পরে যেমন উচ্চ আওয়াজে কথা বল, তাঁর সঙ্গে সে রকম উচ্চ আওয়াজে কথা বলো না। তা করলে তোমাদের (যাবতীয়) আমল নিস্ফল হয়ে যাবে, আর তোমরা একটু টেরও পাবে না। (সূরা হুজরাতঃ ২)
(উক্ত আয়াত নাযিলের পর) হযরত উমার (রাঃ) যখন নবী ﷺ এঁর সঙ্গে কোন কথা বলতেন, তখন (আওয়াজ উচ্চ হয়ে যাওয়ার ভয়ে) গোপন বিষয়ের আলাপকারীর মত চুপে চুপে বলতেন, এমন কি তা শোনা যেত না যতক্ষণ না নবী ﷺ তাকে আবার জিজ্ঞেস করতেন। (সহিহ বুখারী ৭৩০২)
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, একদা নবী ﷺ সাবিত ইবনু কায়স (রাঃ) কে খুঁজে পেলেন না। একজন সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি আপনার কাছে তাঁর সংবাদ নিয়ে আসছি। তারপর তিনি তাঁর কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি তাঁর ঘরে মাথা নীচু করে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী অবস্থা? তিনি বললেন, অত্যন্ত খারাপ। কারণ (এই অধম), তার আওয়াজ (স্বর) নবী ﷺ এঁর আওয়াজ হতে উচ্চ হয়েছিল। ফলে, তার ‘আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। [এগুলো তিনি আশংকার কারণে বলছিলেন কেননা জন্মগতভাবেই তাঁর আওয়াজ উচ্চ ছিল। আর তিনি হলেন সেই সাহাবী যাঁকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এঁর খতীব বলা হত। আহ! ইনাদের কেমন আল্লাহভীতি এবং প্রিয় নবী ﷺ এঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল!] তারপর ঐ সাহাবী নবী ﷺ এঁর কাছে ফিরে এসে খবর দিলেন যে, তিনি এমন এমন কথা বলছেন। মূসা ইবনু আনাস রহঃ বলেন, এরপর ঐ সাহাবী এক মহা সুসংবাদ নিয়ে তাঁর [সাবিত ইবনু কায়স (রাঃ)] কাছে ফিরে গেলেন (এবং বললেন) নবী ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যাও এবং তাকে বল, তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত নও বরং তুমি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত। (সহিহ বুখারী ৩৬১৩, ৪৮৪৬)
উক্ত আয়াতের তাফসীরে উলামায়ে কেরাম বলেন, প্রিয় নবী ﷺ কে কষ্ট দেয়া, তার শানে বেয়াদবী করা কুফর যার কারণে সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। অথচ ঐসব তথাকথিত লাগামহীন বক্তাদের অবস্থা কেমন..!
সূরা হুজরাতের ২-৩ নং আয়াতের তাফসীরে, তাফসীরে জালালাইনের হাশিয়াতে (অনলাইন ভার্শন) উল্লেখ রয়েছে, বস্তুত ইসলামের মহা নিদর্শনাবলি চারটি। যথাঃ ১. কুরআনুল কারীম, ২. নবী করীম ﷺ, ৩. বায়তুল্লাহ (কাবা শরীফ) ৪. নামাজ। এগুলোর প্রতি তারাই সম্মান প্রদর্শন করবে, যাদের অন্তরে পূর্ণমাত্রায় খোদাভীতি বিদ্যামান। আরো উল্লেখ করা হয়েছে,
রাসূল ﷺ এঁর প্রতি আদব প্রদর্শন ও তাকওয়া (আল্লাহভীতি) পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাদের অন্তরে যত বেশি খোদাভীতি রয়েছে তারা নবী করীম ﷺ এঁর প্রতি ততবেশি আদব প্রদর্শন করবে, তাঁকে ভালবাসবে, তাঁর অনুগত থাকবে। পক্ষান্তরে যাদের অন্তরে খোদাভীতির বালাই নেই তারা যে, নবী করীম ﷺ এঁর প্রতি শুধু অশ্রদ্ধাই পোষণ করবে তা-ই নয়, তাঁকে অপমানিত করতেও কুন্ঠিত হবে না। নবী করীম ﷺ এঁর সাথে বেয়াদবী করা অন্তরে খোদাভীতির অনুপস্থিতিকেই প্রমাণিত করে, যা মূলত কুফরীরই লক্ষণ।
অথচ আজ চারদিকে বেয়াদবদের ছড়াছড়ি। স্বয়ং আল্লাহ, রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, আউলিয়ায়ে কেরামের শানে প্রতিনিয়ত অসংখ্য বেয়াদবীমূলক শব্দ উচ্চারণ করা হচ্ছে। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ যদি থুথু ফেলতেন, তখন তা কোন সাহাবীর হাতে পড়ত এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন, তিনি ওযু করলে তাঁর ওযুর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়; এমনও বর্ণনা পাওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর চুল কাটা হচ্ছে আর সাহাবীরা তাঁর চতুর্পাশ ঘিরে রেখেছেন। তাঁরা চাইতেন যে, কোন চুল যেন মাটিতে না পড়ে তা যেন কারো না কারো হাতে পড়ে। নবীজি ﷺ এঁর ঘাম মোবারককে সাহাবায়ে কেরাম সুগন্ধি তথা আতর হিসেবে ব্যবহার করতেন কিংবা আতরের সঙ্গে মিশাতেন।
এমন কর্মকান্ডের প্রতি অবগত হয়ে উরওয়াহ ইবনে মাসউদ রাঃ (যিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন) কুরাইশদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-
“হে আমার কওম, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা-বাদশাহর দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার, কিসরা ও নাজাশী সম্রাটের দরবারে দূত হিসেবে গিয়েছি; কিন্তু আল্লাহর কসম করে বলতে পারি যে, কোন রাজা বাদশাহকেই তার অনুসারীদের মত এত সম্মান করতে দেখিনি, যেমন মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাঁকে করে থাকে। (সহিহ বুখারী ২৭৩২)
একদিন সাহাবায়ে কেরাম নবী ﷺ এঁর উযূর পানি স্বীয় শরীরে মর্দন করতে লাগলে, নবী ﷺ তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কিসে তোমাদেরকে এ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করল? সাহাবায়ে কেরাম বলেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ এঁর ভালবাসা।…. [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার (كتاب الآداب), হাদিস নম্বরঃ ৪৯৯০]
এগুলো ইনারা কোথায় পেয়েছেন…!
এগুলো কি ফরয, ওয়াজিব…….
না,
কিন্তু হ্যাঁ, এটাই তাঁর প্রতি তাজিম, আদব, সম্মান, ভালবাসা। এই তাজিম, আদব, সম্মান, ভালবাসা কিন্তু ফরয। তাঁকে সকল কিছুর চেয়ে বেশি ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ। ভালবাসা থেকেই তো তাজিম, আদব, সম্মানের জন্ম।
আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা সালামুল্লাহি আলাইহা দুইবার তালাক খাওয়া বুড়ি ছিলেন না বরং উনার ১ম স্বামী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় স্বামী এবং দ্বিতীয় স্বামী মারা যাওয়ার আমাদের প্রিয় নবী ﷺ এঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আরো উল্লেখ্য যে, উনার ২য় স্বামী অনেক ধনাঢ্য ছিলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি অনেক সম্পত্তি লাভ করেন। অথচ আমাদের দেশটা এমনসব বেয়াদবে ভরপুর হয়েছে যে, ইনাদের শানেও বেয়াদবী করে এমন বক্তাদের বিরোধিতা করলেও আমাদেরকে বেয়াদব, মাজারপুজারী, কবরপুজারী বলা হয়।
সূরা আহযাবের ৬ নং আয়াতঃ “নবী (ﷺ) মুমিনদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক প্রিয়/ নিকটবর্তী এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা-স্বরূপ।”- এর প্রসঙ্গে তাফসীরে জালালাইনের হাশিয়াতে (অনলাইন ভার্শন) উল্লেখিত হয়েছে, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলাে যে, নবীজী ﷺ এঁর পুণ্যবতী বিবিগণের মধ্যে কারাে প্রতি সামান্যতম বেআদবী ও অশিষ্টাচারও এজন্য হারাম যে, তারা উম্মতের মা উপরন্তু তাদেরকে দুঃখ দিলে নবীজী ﷺ কে দুঃখ দেওয়া হয়, যা চরমভাবে হারাম।
আমার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আরো বলেন,
“নিশ্চয় যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, তাদের উপর আল্লাহর লানত (অভিসম্পাত) দুনিয়া ও আখিরাতে এবং আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্চনার শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” (সূরা আহযাবঃ ৫৭)
“তোমরা রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের একে অপরের আহ্বানের মত গণ্য কর না/ তোমরা পরস্পরকে যেভাবে ডাকো রাসূলকে সেভাবে ডেকো না; তোমাদের মধ্যে যারা চুপিসারে সরে পড়ে আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে জানেন। অতএব যারা তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে।” (সূরা নূর, আয়াত ৬৩)
হে মুমিনগণ! তোমরা (মুহাম্মাদ ﷺ এঁর দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য) ‘রায়িনা’ বলো না (যার বিকৃত অর্থ আমাদের রাখাল) বরং বল ‘উনযুরনা’ (আমাদের দিকে আপনার নেকদৃষ্টি দান করুন) এবং (তাঁর নির্দেশ) শুনতে থাক। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। (সূরা বাক্বারাহ : আয়াত ১০৪)
এক জায়গায় দেখলাম ডিজাইন করে লেখা হয়েছে, “আমরা মনে করি কিবলার দিকে পা রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষেধ। অথচ এ ব্যাপারে ইসলামে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। বরং কিবলার দিকে থুথু নিক্ষেপের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দেখুন ইবনু হিব্বান : ১৬৩৮।”
এমনকি আরো দেখা যায় যে, কুরআনুল কারীমকে চুমু খাওয়া নিয়েও আপত্তি করা হয়।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কিবলার দিকে থুথু নিক্ষেপের ব্যাপারে কেন কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে!! থুথু তো পবিত্র জিনিস। উত্তর আসে, এটা হল কিবলার প্রতি সম্মান, আদব। কিবলার দিক পশ্চিম দিকে পা না দেওয়াটাও আদবের সাথে জড়িত। কিন্তু বেখায়ালে পা দিলে কিংবা অপারগতার সম্মুখীন হয়ে, শুয়ে শুয়ে নামাজ পড়তে হলে তো কিবলার দিকে পা যাবেই,
ইসলাম অপারগতাতে ছাড় দেয় কিন্তু বেয়াদবীতে নয়।
আমাদের মাজহাবের ইমাম, ইমামে আজম আবূ হানিফা রহঃ এমন আদববান ছিলেন যে, তিনি কিবলা তো দূরের কথা, জীবনে কখনাে নিজের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হযরত সায়্যিদুনা ইমাম হাম্মাদ রহঃ এঁর সম্মানিত ঘরের দিকেও পা প্রসারিত করে ঘুমাননি। অথচ তাঁর ঘর ও তাঁর সম্মানিত উস্তাদের ঘরের মধ্যে প্রায় সাতটি গলির ব্যবধান ছিল। (আল খায়রাতুল হিসান ৮২ পৃষ্ঠা) (তিনি উনার একমাত্র পুত্রের নামও রাখেন হাম্মাদ)
ইনি হলেন সেই ইমামে আজম আবূ হানিফা রহঃ, যার সম্পর্কে সালাফীদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব ইবনে কাছীর উল্লেখ করেন, ইমাম শাফিঈ রহঃ বলেনঃ “যে কেউ ফিকহ জানতে ইচ্ছা করে, সে আবূ হানীফা রাঃ এঁর মুখাপেক্ষী।” (আল ফিকহুল আকবার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৮ পৃষ্ঠাঃ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১০/১০৭)
মালেকী মাযহাবের ইমাম, বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ “মুয়াত্তা”র সংকলক ইমাম মালিক ইবনে আনাস র., যিনি ফরয হজ্ব আদায় করার পর আর কখনো মদীনা শরীফ থেকে বের হতেন না এই আশঙ্কায় যে, মদীনা শরীফের বাইরে যদি তাঁর মৃত্যু এসে যায়; যিনি তাঁর সুস্থ জীবনে কখনো মদীনা শরীফের হারাম সীমার মধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেননি। অবশ্য অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি এক্ষেত্রে অপারগ ছিলেন। যিনি মদীনায় বাহনে (ঘোড়ায়) আরোহণ করতেন না। তিনি বলতেন, যে মাটিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ শায়িত, তাকে সওয়ারির খুর দ্বারা দলিত করতে আমার লজ্জাবোধ হয়।
মুসআব বিন আবদুল্লাহ রহঃ বলেন, তাঁকে (ইমাম মালিক রহঃ কে) কোন হাদিস জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ওযূ করে ভাল পোষাক পড়ে সুন্দরভাবে প্রস্তুতি নিতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন এ হল রাসূল ﷺ এঁর হাদিসের জন্য সম্মান প্রদর্শন। (কাযী আয়াজ রহঃ, তারতীবুল মাদারিক ১/১৫৪ পৃষ্ঠা)
হ্যা, ইতিহাসও এটা বলে যে, আদববানরা উঁচুতে পৌঁছে আর বেয়াদবরা যুগে যুগে লাঞ্চিত হয়, লানতপ্রাপ্ত হয়।
উর্দূতে বলা হয়ে থাকে,
বা আদব বা নসিব, বে আদব বদ নসিব।