ইসলামী সুফীতত্ত্ব: আত্মিক উৎকর্ষের পথে

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

আহমাদ আবদুল হালিম
সুফী:
১. সুফী শব্দটি (পশম) থেকে উদগত হয়েছে। কারণ, সুফীরা সাধারণ জীবন যাপনের জন্যে পশমী কাপড় পরিধান করতেন- । ড. রোনাল্ড এ নিকলসনের মতে পশমী পোষাক পরিচ্ছেদ পরিধানও আত্মার বিশুদ্ধতার জন্য জরুরী এবং সূফীরা তা পরতেন বিধায় তারা সুফী নামে পরিচিতি।
২. মোল্লা জামী বলেন, শব্দটি (পবিত্রতা ও স্বচ্ছতা) থেকে নির্গত হয়েছে। যেহেতু তারা পূতপবিত্র ও স্বচ্ছ জীবনযাপন করতেন –
৩. আবার কেউ কেউ বলেন, সুফী শব্দটি গ্রীক সাফিয়া শব্দ থেকে উদ্ভাবিত। সাফিয়া অর্থ জ্ঞান। সুফীরা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী বলে এ নামে খ্যাত।
সুফীবাদের সংজ্ঞা:
মারূফ আল-কারখী বলেন, “সুফীবাদ ঐশী সত্তার উপলব্ধি।”
জুনায়েদ বাগদাদী বলেন, “জীবন, মৃত্যু ও অন্য সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর ওপর নির্ভরতাই সুফীবাদ।”
কারো কারো মতে,“ পরমত্মার সাথে জীবাত্মা মিল সাধন।”
আল কুরাইশী বলেন, “বাহ্য ও অন্তর্জীবনের পরিশুদ্ধিই হল সুফীবাদ।”
জাকারিয়া আনসারী বলেন, “চিরন্তন ও নিখুঁত আনন্দ লাভের জন্য ব্যক্তিসত্ত¡াকে শুদ্ধিকরণ, নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বিধান এবং বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ জীবনকে সঠিকভাবে গড়ে তোলাই সুফীবাদ।”
সুফীবাদের স্তর পরিক্রমা :
১. শরীয়ত। ২. তরীকত। ৩. মা’রিফত। ৪. হাকিকত।
শরীয়ত:
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় বিধানকে শরীয়ত বলা হয়। সর্বপ্রথম শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী হতে হয়। শরীয়তের যাবতীয় বিধানের মধ্য দিয়ে সুফী তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আত্মার অনুগত করেন। শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কেউ সুফী হতে পারবে না।
তরীকতের পরিচয় : সুফীদের পরিভাষায় তরীকত হচ্ছে; শরীয়তের যাবতীয় বিধান অনুশীলনের পর তাকে আধ্যাত্মিক গুরুর শরনাপন্ন হতে হবে। বিনা প্রশ্নে গুরুর আনুগত্য করতে হবে।
মা’রিফতের পরিচয় : সুফীদের পরিভাষায় মা’রিফত হচ্ছে, এমন একস্তর যার মধ্যে বান্দাহ উপনীত হলে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অবগতি অর্জন করতে পারে। এ স্তরে পৌঁছতে পারলে তার অন্তর আলোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তখন তিনি বস্তুর নিকট তত্ত¡ উপলব্ধি করতে শুরু করেন। মানব জীবন ও সৃষ্টি জীবনের গুপ্ত রহস্য তার নিকট স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।
হাকিকতের পরিচয় : আন্তরিকভাবে খোদার প্রেমের স্বাদ ও পরমাত্মার সাথে তার যোগাযোগ হয়। এটা হচ্ছে সুফী সাধনার চুড়ান্ত স্তর। এ স্তরে উন্নীত হলে সুফী ধ্যানের মাধ্যমে নিজস্ব অস্তিত্ব খোদার নিকট বিলীন করে দেন।
সুফীবাদের উৎপত্তি :
উৎপত্তি নিয়ে মতবেদ রয়েছে-
বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব থেকে এর উৎপত্তি।
ঈসায়ী ও নিউপ্লেটনিক প্রভাব থেকে এর উৎপত্তি।
পারসিক প্রভাব হতে তার উৎপত্তি।
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এর উৎপত্তি।
বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব থেকে এর উৎপত্তি : এইচ মোর্টন ও গোন্ড জীহার বলেন, মুসলমানদের সুফীবাদ ভারতীয় বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের শিক্ষা হতে উদ্ভব হয়েছে। এমনকি বৌদ্ধদের “নির্বাণ” থেকেই মুসলমান এর আবিষ্কার করেছে। কিন্তু ভারতে আসার আগেও মুসলমানদের মাঝে সুফীবাদ প্রচলিত ছিল ।
ঈসায়ী বা নিউপ্লেটনিক প্রভাব থেকে এর উৎপত্তি : অধ্যাপক নিকলসন ও ভনক্রেমারের মতে ঈমারী বা খ্রিস্টাব্দে মরমীবাদের প্রভাব থেকে সুফীবাদের উদ্ভব হয়েছে। নবম শতাব্দীতে মুসলমানগণ সিরিয়া, মিসর, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে খ্রীষ্টীয়বাদের সংস্পর্শে আসে। তার প্রভাবেই মুসলমানদের মধ্যে সুফীবাদ জন্ম লাভ করে। তবে এটাও গ্রহণযোগ্য মত নয়। কারণ, ইসলামের প্রথম থেকেই সুফীতত্তে¡ও রেশ ছিলো। সত্যিকারর্থে পরবর্তী সময়ে এর দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলো।
পারসিক প্রভাব থেকে এর উৎপত্তি : দার্শনিক ব্রাউন ও তার অনুসারীদের মতে সুফীবাদ পারসকি প্রভাব থেকে উদগত হয়েছে। মুসলমানদের হাতে পারস্য সামাজ্যের পতনের পর পারসিকরা বিশ্ববিরাগ ও ধর্মীয় রহস্যবাদ গ্রহণ করে। এ মতবাদও সঠিক নয়।
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এর উৎপত্তি : ইসলামী সুফীবাদ পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ভব হয়েছে। কুরআন ও হাদীসের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকায় সুফীবাদের প্রকাশ রাসূল সা. সাহাবী, আহলুসসুফফা ও তাবেঈগণের মধ্যে হয়েছিল। অধ্যাপক পি,কে, হিট্টি বলেন, “কুরআনের আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মুসলমানদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুফীবাদের মধ্যে দিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে।”
সুফীবাদের ক্রমবিকাশ :
১ রাসূলের যুগে সুফীবাদ : রাসূল সা.’র জীবদ্দশায় এর সূত্রপাত ঘটে। তিনি হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। একদল সাহাবী মসজিদে নববীর এক পার্শ্বে উপাসনা ও আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন ।
২. খোলাফায়ে রাশেদার যুগে : খলীফাগণ বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও পার্থিব সুখ-শান্তি কামনা করতেন না তাঁরা আল্লাহর চিন্তায় ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তাদের অনুসরণ করে একদল সাহাবী ও তাবেঈ মোরাকাবা ও মোশাহাদায় সর্বদা লিপ্ত থাকতেন।
৩. উমাইয়া শাসনামলে সুফীবাদ : উমাইয়া শাসনামলে সুফীবাদের চরম উৎকর্ষ সাধন হয়। এ সময়ে কয়েকজন সুফী আল্লাহর ধ্যান-ধারণাকেই জীবনে চরম ও পরম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এ সকল ধর্মতাপদেশের মধ্যে ইমাম হাসান আল-বসরী, আবু হাশিম, জাবির ইবনে হাইয়ান, রাবেয়া বসরী, ইব্রাহিম ইবনে আদহাম, মারূফ আল-কারখী অন্যতম।
৪. আব্বাসীয় শাসনামলে সুফীবাদ : আব্বাসীয় শাসনামলে সুফী মতবাদ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে থাকে এ যুগকে ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ যুগে সুফী মতবাদের ওপর বিদেশী প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এক পর্যায়ে সুফীদের মধ্যে দু’টি দলের সৃষ্টি হয়।
ক. ইনকিশাফী দল : এদলে পুরোধা ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহ., জুনায়েদ বাগদাদী রহ. প্রমুখ।
খ. ইসতিদলালী দল : এ দলের সুফীদের মধ্যে স্পেনের মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী ও রূমের মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহ. অন্যতম।
৫. এ স্তরে ইমাম গাজ্জালীর খেদমত অপরিসীম। তিনি সুফীমতবাদের ওপর অনেকগুলো বই রচনা করেন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি সুফীমতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
সুফীবাদের প্রথম উৎপত্তি আরবে পরে এটা ইরানে প্রসারিত হয় এবং ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করে। ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, সাদী, জামী, প্রমুখ সুফী ইরানেই জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর এই সুফীমতবাদ ভারতবর্ষেও অনুপ্রবেশ করে। বর্তমানে প্রায় সকল দেশে তরীকাতের ইমামগণ সুফীমতবাদ প্রচার করে চলেছে। উপমহাদেশে এর খ্যাতি ও প্রসিদ্ধ আরবদেশগুলোর তুলনায় বেশি।
সুফীবাদের মূলনীতিসমূহ: সুফীবাদ এক প্রকার রহস্যময় হৃদয়ভিত্তিক ও আত্মোপলব্ধিমূলক মতবাদ। একে রুহানী প্রশিক্ষণও বলা হয়। ব্যক্তির আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরম সত্তার সন্ধানই এর লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সুফীগণ কতগুলো মূলনীতি তৈরি করেছেন। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলোÑ
সুফীবাদের মূলনীতিসমূহ :
১. তাওবা : অন্যায় ও পাপের ওপর আন্তরিক অনুশোচনা, অন্যায়ের স্বীকৃতি ও ভবিষ্যতে এ কাজ না করার দীপ্ত শপথ। তাওবা হচ্ছে সুফী মতবাদের প্রথম মূলনীতি।
২. তাওয়াক্কুল : সর্বাবস্থায় দয়াময় আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করাই তাওয়াক্কুল।
৩. পরিবর্জন: এ প্রসঙ্গে নিজামুদ্দীন আওলীয়া বলেন, “স্বল্প আহার, স্বল্প কথন, স্বল্প মেলামেশা, স্বল্প নিদ্রার মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের পূর্ণতা।”
৪. সবর : যে কোন অবস্থায় অস্থির না হয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে মেনে নেয়াই সবরের একমাত্র দাবী।
৫. আত্মসমর্পণ : গুরুও কাছে নিজ আত্মাকে সোপর্দ করে দিতে হবে।
৬. ইখলাস : নিছক আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সব কাজ করতে হবে।
৭. আল্লাহর প্রেম : অন্তরে পার্থিব জগতের কোনকিছুর প্রেম ও মোহ থাকতে পারে না। সর্বক্ষণ আল্লাহকে পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকতে হবে।
৮. আল্লাহর যিকর : আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন ও অন্তরকে পরিশুদ্ধি করার জন্য সর্বদা আল্লাহর যিকর । এ প্রসঙ্গে
৯: শুকুর : আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান ও আনুগত্যকরণ শুকর বলা হয়।
১০. কাশফ : সুফীগণ যখন আধ্যাত্মিক সাধনার চরম পর্যায়ে উপনীত হন তখন তার অন্তদৃষ্টি খুলে যায় এবং তার সামনে গোপনীয় সকল রহস্যদ্বার খুলে যায়। এক পর্যায়ে তিনি আল্লাহর অসীমতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন।
১১. ফানা ও বাকা : ফানা ফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহ হচ্ছে সুফী সাধনার সর্বোচ্চ স্তর। এ স্তরে পৌঁছলে সুফী নিজের ব্যক্তিগত চেতনাকে মুছে দিয়ে ঐশী চেতনায় উন্নীত হন। ব্যক্তিগত চৈতন্য খোদার ধ্যান ও প্রেমে সমাহিত হয়। তাই আত্মচেতনার অবলুপ্তিকেই বলা হয় ফানা।
ফানার শেষ পর্যায়ে শুরু হয় বাকার প্রাথমিক পর্যায়। এ স্তরে সুফী সাধক আল্লাহর চিরন্তন সত্তার অবস্থান করেন।

সুফীবাদের বিভিন্ন তরীকাসমূহের বিবরণ:
খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে আধ্যাত্মিক সাধনার পদ্ধতি নিয়ে সুফীদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয়। যার কারণে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে প্রত্যেক দলই হযরত মুহাম্মদ সা. কে প্রথম ও শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করে এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎস বলে স্বীকার করে। নিম্নে সুফীবাদের তরীকাসমূহ আলোচনা করা হলোÑ
সুফীবাদের তরীকাসমূহ :
১. কাদেরীয়া তরীকা।
২. নকশবন্দীয়া তরীকা।
৩. চিশতিয়া তরীকা।
৪. মুজাদ্দেদীয়া তরীকা।
৫. সোহরাওয়ার্দী তরীকা।
৬. মৌলবীয়া তরীকা।
৭. সান্তারীয়া তরীকা।
৮.মাইজভান্ডার তরীকা.

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment