ইশকে রাসূল–৫: যিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলনা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা: বা:

ফজল ও কামাল তথা মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব

—————————————————————————

কাউকে ভালবাসার তৃতীয় কারণ হচ্ছে, তাঁর সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব। নবী করিম ﷺ-কে আল্লাহ তাআলা সীমাহীন মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাঁর ঘোষণা দিয়ে বলেছেন,

وَكَانَ فَضْلُ اللّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا

‘আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম।’

তাঁর সেই ফজল ও করমের কিছু নমুনা নিচে দেয়া গেল–

১. এক বর্ণনায় রয়েছে, নবী করিম ﷺ বলেছেন, ‘তোমরা মন দিয়ে শোনো! আমি আল্লাহ পাকের হাবিব। এজন্য কোনো গর্ব করছি না। কিয়ামতের দিন প্রশংসার পতাকা আমার হাতে থাকবে। সেই পতাকা তলে হযরত আদম আ.-সহ সমস্ত নবী সমবেত হবেন। এতে গৌরবের কিছু নেই। কিয়ামতের দিন প্রথম শাফায়াতকারী হব আমি। আর সবার আগে যার শাফায়াত কবুল করা হবে সে হব আমি। আর এজন্য কোনো গর্ব করছি না। জান্নাতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করব আমি এবং আমার গরিব উম্মতেরা। এতেও গর্বের কিছু নেই। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সকল সৃষ্টির মাঝে আমিই সর্ব শ্রেষ্ঠ সম্মানী এবং মর্যাদাবান। এতেও কোনো গর্ব করছি না।’

২. অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী করিম ﷺ বলেছেন,

أَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي

‘আমি শেষ নবী। আমার পরে কোনো নবী নেই।’

কোনো অনুষ্ঠানে যেমন প্রধান অতিথি সবার শেষে আসেন। অনুরূপভাবে এই জগতের বৈচিত্রময় রঙ-রূপ সাজানো হয়েছে তাঁর জন্য। ধারাবাহিকভাবে নবীগণ এসেছেন। অবশেষে এসেছেন হযরত ঈসা আ.। তিনি আরো দীপ্তভাবে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, আমার পরে সর্ব শেষ যে নবীর আবির্ভাব হবে তার নাম আহমাদ। এরপর আখেরী নবীর আবির্ভাবকালে গোটা সৃৃষ্টিজগতে যে অনবদ্য দৃশ্যের অবতারণা হয় তা কোনো চোখ আগেও দেখে নি পরেও দেখবে না। হুজুর পাক ﷺ বলেছেন, ‘আমি আর কিয়ামত এভাবে মিলিত যেমন এই হাতের দুই আঙ্গুল পাশাপাশি মিলিত।’ এর কারণ ছিল , যখন প্রাধান অতিথি আসন ত্যাগ করে চলে যান তখন চেয়ার টেবিলসহ গোটা মঞ্চ ও প্যান্ডেল গুটিয়ে নেয়ার কাজ বাকি রয়ে যায়। সুতরাং করিম ﷺ-এর পবিত্র সত্ত্বা অন্য সকল নবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাঁর কাছে প্রেরিত কিতাব সকল কিতাবের চেয়ে উত্তম। সর্বোপরি তাঁর উম্মত অন্য নবীদের উম্মত থেকে উত্তম ও মর্যাদাবান।

৩. নবী করিম ﷺ-কে আল্লাহ পাক ইসরা এবং মেরাজের ফজিলত দান করেছেন। তাঁর প্রিয়পাত্রকে আরশে আজিমে ডেকে নিয়ে তার খাজানা দেখিয়েছেন। স্বীয় দিদার লাভে ধন্য করেছেন। তারপর–فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى ‘আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবার, তা প্রত্যাদেশ করলেন’–এর সম্মানে ভূষিত করেছেন।

হযরত মুসা আ. আল্লাহকে বলেছিলেন, رَبِّ أَرِنِي أَنظُرْ إِلَيْكَ ‘হে আমার প্রভু, আপনার দিদার আমাকে দিন, যেন আমি আপনাকে দেখতে পাই।’ জবাবে আল্লাহ বলেছিলেন, لَن تَرَانِي ‘তুমি আমাকে কিছুতেই দেখতে পাবে না।’

অথচ আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর প্রিয় রাসুল ﷺ-কে দিদার দানের জন্য আরশে আজিমে আমন্ত্রণ জানান। আর তখন হযরত মুসা আ. তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে আসমানে অপেক্ষা করতে থাকেন। নবী করিম ﷺ নামাজের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য বার বার আরশে যাতায়াত করতে থাকেন। সুযোগ কাজে লাগিয়ে হযরত মুসা আ.ও প্রতিবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে থাকেন। উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু মুসা আ. দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের দিদার লাভ করতে পারেন নি, তাই তার সাথে সরাসরী সাক্ষাৎ করে আসা নবী করিম ﷺ-এর সাথে দেখা করে ধন্য হওয়া। সুবহানাল্লাহ!

৪. আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসুল ﷺ-কে হাবিবুল্লাহ উপাধী দান করেছেন। মেশকাত শরিফের টিকায় লেখা আছে, হাবিবুল্লাহ উপাধী সবচে বেশি সম্মানী। সবচে উঁচু। কারণ খলিলুল্লাহ, কালিমুল্লাহ, রুহুল্লাহ ইত্যাদি সবগুলোই হাবিবুল্লাহর অন্তর্গত। কবি বলেন,

حسنِ يوسف يدِ بيضا،دمِ عيسی داری

آنچه خوباں همه دارند تو يكجا داری

‘ইউসুফ আ.-এর সৌন্দর্য, ঈসা আ.-এর ফুৎকার , মুসা আ.-এর শুভ্র হাত এর সবগুলোই আপনার মাঝে আছে। এছাড়াও সবার মাঝে যতসব সৌন্দর্য বিদ্যমান ছিল তার সব কিছু সমাহার ঘটেছে আপনার মাঝে।’

৫. আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে তাঁর প্রিয় রাসুল ﷺ-কে ‘উম্মী-নবী’ উপাধী দান করেছেন। যেন দৃশ্যত তিনি কারো শাগরেদ হয়ে ছোট হতে না হয়। কেননা, তাঁর শিক্ষক তো হলেন স্বয়ং রাব্বুল আলামীন। তিনি রাব্বুল আলামীন থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্ববাসীকে তা শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا

‘এবং আপনাকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা আপনি জানতেন না। আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা বিশাল।’

যখন কোন মহান ব্যক্তিত্ব কোন বস্তুকে ‘বিশাল’ বা বড় বলে স্বীকৃতি দে্ন তখন সেই বস্তুর মূল্য ও মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যায় এবং আক্ষরিক অর্থে তা বিশাল বা বড় বলে গণ্য হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবের শানে এই  عَظِيمًا (বিশাল বা বড়) শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন, ‘আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা বিশাল।’

এজন্য নবী করিম ﷺ-এর ইলমের ব্যাপারে মাওলানা জুফার আলী খান লিখেছেন,

ﺟﻮ ﻓﻠﺴﻔﻴﻮں سے ﮐﻬﻞ نہ سڪا اور نڪته وروں سے حل نہ ہوا

وہ راز اک کملی والے نے سمجهادیا چند اشاروں میں‎

‘বিশ্বের মহা জ্ঞানী-গুণী দার্শনিকরা যে সব বিষয়ের রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে নবী করিম ﷺ এক ইশারাতেই সে সবের রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছেন।’

يتيمے كہ نا كرده قرآں درست

کتب خانہ چند ملت بشست

‘যে এতিম শিশু কারও কাছে একটি অক্ষরও শিক্ষা লাভ করে নি সে সকল মাজহাবের সমস্ত কিতাবখানা বা পাঠাগার ধুয়ে দিয়েছে। সব কিছু রপ্ত করে নিয়েছে।’

জনৈক কবি এই ভাবকে অন্য শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন এভাবে–

نـگارِ من کہ بہ مکتب نہ رفت و خط نہ نوشت
بہ غمـــزہ مسئلــہ آمــوزِ صــد مــدرس شــد

‘আমার প্রিয়তম যিনি কখনও মক্তবে পর্যন্ত যান নি। লিখতেও শিখেন নি। তিনি তার ইশারায় হাজার হাজার উস্তাদের উস্তাদে পরিণত হয়েছেন।’

৬. নবী করিম ﷺ-কে সুন্দর ও উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন,

إِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ

‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’

তিনি তাঁর চরিত্র-মাধুর্যের মাধ্যমে মাত্র দশ বছরেরও কম সময়ে গোটা বিশ্বে ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, فتحت المدينة بالأخلاق ‘উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে পবিত্র মদিনা শরিফ জয় করা হয়েছে।’ পৃথিবী তলোয়ারের মোকাবেলা করতে পারে কিন্তু চরিত্রের মোকাবেলা করতে পারে না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে চরিত্র অতি সাধারণ বস্তু বলে মনে হলেও এর মাধ্যমে অনেক বড় বড় বস্তু খরিদ করা যায়। মক্কার কুরাইশরা যখন নবী করিম ﷺ-এর কাছে তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণ চাইল, তখন তিনি তার প্রমাণ হিসেবে আপন চরিত্রকে উপস্থাপন করে বলেছিলেন,

قَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِّن قَبْلِهِ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

‘আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না?’

নবী করিম ﷺ-এর অস্তিত্বটাই গোট বিশ্ববাসীর জন্য আপাদমস্তক রহমত ছিল।

جو عاصى كو كملى میں ا پنى چھپا  لے

جو دشمن كو بھى زخم كھاكر د عا دے

ا سے اور كيا نام ديگا زمانہ

وہ رحمت نہيں ہے تو پہر اور كيا ہے

‘যিনি পাপীকে তাঁর উদারতার চাদরে ঢেকে নিয়েছেন। যিনি দুশমনের হাতে আঘাত খেয়েও তাদের জন্য দোয়া করেছেন। যামানা তাঁর আর কী নাম দিবে ‘রহমাতুল লিল আলামীন’ ছাড়া!’

৭. পূর্ববর্তী নবীগণ বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও অঞ্চলকেন্দ্রিক প্রেরিত হয়েছেন। তাঁরা ছিলেন স্থানীয় এবং আঞ্চলিক নবী। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ-কে আল্লাহ পাক আন্তর্জাতিকভাবে গোটা বিশ্বের জিন-ইনসান-ফেরেশতা তথা সকল মাখলুুকের জন্য পাঠিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্তের জন্য পাঠিয়েছেন। তাঁর উত্তম চরিত্র ও গুণাবলী সম্পর্কে আল্লামা শেখ সাদী রহ. কালজয়ী পংক্তি রচনা করেছেন,

بلغَ العُلى بكمالِه

كـشـف الدجى بجمالهِ

حـسُـنـت جميعُ خصالهِ

صـلـوا عـلـيه و آلهِ

‘সুউচ্চ শিখরে সমাসীন তিনি নিজ মহিমায়,
তিমির-তমসা কাটিল তার রূপের প্রভায়,
সুন্দর আর সুন্দর তাঁর স্বভাব চরিত্র তামাম
জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের ‘উপরে দরূদ-সালাম।’

হযরত মির্জা মাজহার জানেজানা শহিদ রহ. নবী করিম ﷺ-এর উদ্দেশ্যে নিচের কবিতাগুলো পেশ করেন,

خدا در انتظار حمد ما نیست

محمد ﷺ چشم بر راہ ثنا نیست

خدا مدح فرین مصطفٰے بس

محمد ﷺ حامد حمد خدا بس

منا جاتے اگر باید بیاں کرد

بہ بیتے ہم قناعت میتواں کرد

محمد ﷺ از تو میخواہم خدارا

خدا یا از تو عشق مصطفٰے را

‘আল্লাহ পাক আমাদের প্রশংসার অপেক্ষা করেন না। হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺও তার অপেক্ষা করেন না। মুহাম্মাদ মোস্তফা –এর প্রশংসার জন্য স্বয়ং আল্লাহ আর মহান আল্লাহ পাকের প্রশংসার জন্য খোদ হযরত মহাম্মাদ –ই যথেষ্ট। যদি কোনো মোনাজাত পেশ করতে হয় তাহলে আমি এক কথায় এভাবেই বলব, হে মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ আমি আপনার মাধ্যমে আল্লাহকে চাই। আর হে খোদা, তোমার মাধ্যমে আমি হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা –এর ভালবাসা কামনা করি।’

যদি মহানবী -এর যাবতীয় কামালাতকে সামনে রেখে চিন্তা করা যায়, তাহলে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা -কে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালবাসা বাস্তবতার দাবী। একান্ত আবশ্যক।

কৃপা ও অনুগ্রহ

—————————————————————————

কাউকে ভালবাসার চতুর্থ কারণ বা উপাদান হচ্ছে, কৃপা-অনুগ্রহ। আরবীতে প্রসিদ্ধ প্রবাদ বাক্য রয়েছে, الإنسان عبد الإحسان ‘মানুষ কৃপার দাস।’ যেটিকে অন্য শব্দে এভাবে বলা হয়েছে, جُبِلَتِ الْقُلُوبُ عَلَى حُبِّ مَنْ أَحْسَنَ إِلَيْهَا হৃদয়কে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার প্রতি কৃপাকারীকে ভালবাসার জন্য।

নবী করিম  উম্মতের প্রতি অপরিসীম কৃপা ও অনুগ্রহ করেছেন, যা বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। এখানে অল্প কিছু তুলে ধরা হল–

১. আল্লাহ তাআলার ঘোষণা–

لَقَدْ جَاءكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ

‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’

নবী করিম  তার মুমিনদের প্রতি এত স্নেহশীল যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পিতা মাতা যেমন দৈহিক সম্পর্কের কারণে সন্তানদের প্রতি অপরিমেয়স্নেহশীল। তেমনি নবী করিম  নিজের উম্মতের প্রতি এত অফুরানকরুণাপরায়ণ ছিলেন রুহানী তথা আত্মিক সম্পর্কের কারণে।

২. নবী করিম  বলেছেন,

إِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللَّهُ يُعْطِي

‘আল্লাহ পাক দানকারী আর আমি তা বন্টনকারী।’

আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে যেসব ইলম, নূর ও মা’রেফাত মহানবী -এর কাছে প্রেরিত হত। তিনি তা সাহাবাদের মাঝে বন্টন করে দিতেন। এক হাদিসে এসেছে, নবী করিম  বলেছেন,

ما صب الله في صدري شيئاً إلآ وصببته في صدر أبي بكر

‘আল্লাহ পাক যা কিছু আমার অন্তওে প্রদান করেছেন তা আমি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাযি.-এর অন্তরে স্থানান্তরিত করে দিয়েছি।’

এই কারণেই নবী করিম –কে ‘কাসেমুল উলুম’ বলা হয়। উম্মতের অন্তরে যেসব ইলম, নূর, বরকত, মারেফাত পৌঁছে সেগুলো নবী করিম -এর কলব থেকেই স্থানান্তরিত হয়ে আসে। নবী করিম -এর এমন ইহসান তথা অনুকম্পার কাছে আমরা আপাদমস্তক ঋণী। মুহাম্মাদ রিয়াজ রাম চমৎকার বলেছেন,

وه جو شيريں سخنى ہے ميرے مكى مدنى

تيرے ہونٹوں كى چہنى ہے ميرے مكى مدنى

تيرا پهيلاو بهت ہے تيرا قامت ہے بلند

تيرى چھاوں بهى گهنى ہے ميرے مكى مدنى

دست قدرت نے تيرى بعد پهر ايسے تصوير

نہ بنا ئى بنى ہے ميرے مكى مدنى

نسل در نسل تيرى ذات كے مقروض ہيں ہم

تو غنى ابن غنى ہے ميرے مكى مدنى

‘হে মক্কি ও মাদানি নবী! পৃথিবীর বুকে যত মিষ্টি কথা আছে তার সব কিছু আপনার কোমল ঠোঁটের পরশের কারণে হয়েছে। হে মক্কি ও মাদানি নবী! আপনার পরিচিতি ও বিস্তৃতি ব্যাপক। আপনার দেহের গঠন সুন্দর, মজবুত, উঁচু। আপনার ছায়া খুব ঘন। হে আমার মক্কি ও মাদানি! আল্লাহ পাকের কুদরতি হাত আপনার পরে আর কাউকে এমন আকৃতি দিয়ে তৈরি করে নি। করবেও না। হে আমার মক্কি ও মাদানি! আমরা বংশ পরম্পরায় আপনার সত্ত্বার কাছে চরঋণী। আপনি সম্পন্ন সত্ত্বার  সন্তান সম্পন্ন সত্তা, হে আমার মক্কি ও মাদানি!’

৩. নবী করিম  অনেক সময় গোটা রাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন। আর তাঁর পাপী উম্মতের পাপ মার্জনার জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করতেন। যদ্দরুণ তাঁর পবিত্র পায়ে পানি জমে ফুলে যেত।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযি. বর্ণনা করেন, নবী করিম  একবার গোটা রাত শুধু এই আয়াত তেলাওয়াত করতে থাকেন–

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার বান্দা এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।’

৪. এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করিম  বলেছেন, হে লোক সকল! তোমরা জাহান্নামের দিকে ছুটে চলেছ। আর আমি তোমাদের কোমর ধরে ধরে পেছনে টেনে আনছি।’ নবী করিম  তাঁর উম্মত পর্যন্ত আল্লাহ পাকের পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য কত দুঃখ যাতনাইনা সহ্য করেছেন।

رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا

‘হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি দাওয়াত দিয়েছি।’

এই আয়াতের আলোকেই তিনি তাঁর গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। বিদায় হজের সময় আরাফার ময়দানে তার জন্য জীবন উৎসর্গকারী সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে লোক সকল! আমি কি আমার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছি? আল্লাহ পাকের পবিত্র দীনকে পূর্ণরূপে তোমাদের সামনে পৌছে দিয়েছি?’ তখন সমবেত সাহাবায়ে কেরাম এক বাক্যে বলে ওঠেন, ‘আপনি পরিপূর্ণরূপে আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আল্লাহ বিধানকে পূর্ণরূপে আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।’ তখন নবী করিম  স্বীয় শাহাদাত আঙ্গুল আসমানের দিকে তুলে ধরে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষি থাকো। হে আল্লাহ তুমি সাক্ষি থেকো। হে আল্লাহ তুমি সাক্ষি থেকো।’

৫. নবী করিম  মেরাজে গেলে আল্লাহ তাআলা উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ হাদিয়া দেন। নবী করিম  আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার দূর্বল উম্মত প্রতিদিন এতগুলো নামাজ আদায় করতে পারবে না। তাই দয়া করে তা কমিয়ে দিন। এভাবে কমাতে কমাতে এক পর্যায়ে এসে পাঁচ ওয়াক্তে স্থির হয়। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আমার প্রিয় রাসুল! আপনার উম্মত প্রতিদিন মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে কিন্তু আমি তাদেরকে পুরা পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই সওয়াব দান করব।’

সুবহানাল্লাহ, গুনাহগার উম্মতের ওপর আল্লাহ ও তার রাসুল –এর কত বড় ইহসান!! কেমন অনুগ্রহ!!

৬. মেশকাত শরিফে এসেছে, আরাফার ময়দানে নবী করিম  উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে ফরিয়াদ করে বলেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মতের যাবতীয় গুনাহ চাই হককুল্লাহ বা হককুল ইবাদ–যাই হোক সব ক্ষমা করে দিন।’ আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করে বলেন, ‘হে প্রিয় রাসুল! আপনার উম্মতের হক্কুল্লাহ সংক্রান্ত যত গুনাহ রয়েছে, তা আরাফাতে আগমণকারী হাজীদের জন্য ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু হককুল ইবাদের সম্পর্ক যেহেতু বান্দার সঙ্গে, তাই সেগুলো আদায় করতেই হবে।’

এরপর নবী করিম  আরাফার ময়দান থেকে গেলেন মুজদালিফায়। এখানে এসে তিনি পুনরায় দোয়া করলেন যে, ‘হে আল্লাহ! আপনি তো সবই পারেন। বান্দার হক তলবকারীদের প্রতি বিশেষ দয়া দেখাতে পারেন। তাদেরকে এই পরিমাণ দান করতে পারেন যে, তারা খুশি হয়ে তাদের প্রতি অন্যায়কারীদেরকে আপনাআপনি ক্ষমা করে দিতে পারে।’

আল্লাহ তাআলা তখন তাঁর এই দোয়া কবুল করে নেন এবং বলেন, ‘প্রিয় আমার! আপনার যে উম্মত আরাফার ময়দানে হাজির হবে, আমি আমার হক-সংক্রান্ত অন্যায়গুলো তার ক্ষমা করে দিব। আর অন্য বান্দার প্রতি অন্যায় সংক্রান্ত গুনাহগুলো আমার রহমতে ক্ষমা করিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করে দিব।’

সুবহানাল্লাহ! এটা উম্মতের প্রতি কত বিশাল অনুগ্রহ!

أُمةٌ مذنبةٌ وربٌّ غفور

‘উম্মত গুনাহগার আর প্রভু ক্ষমাকারী।’

৭.  একবার নবী করিম ﷺ তাঁর উম্মতের মাগফেরাতের জন্য দীর্ঘক্ষণ যাবৎ সেজদায় পড়ে মোনাজাত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ওহী নাজিল হয় যে, হে আমার প্রিয় রাসুল! আপনি কাঁদছেন কেন? আমি আপনাকে এমন দেয়া দিব যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যান।

وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى

‘আপনার পালনকর্তা সত্বরই আপনাকে দান করবেন, অতঃপর আপনি সন্তুষ্ট হবেন।’

উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী করিম ﷺ বলেন, ‘আমার সর্ব শেষ উম্মত জান্নাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট হব না।’

نہ ﺁﺧــﺮ ﺭﺣــﻤــﺖ ﻟــﻠــﻌــﺎﻟــﻤــﯿـﻨـﯽ

ز ﻣـﺤــﺮﻭﻣـﺎﻥ ﭼــﺮﺍ ﻓـﺎﺭﻍ ﻧـﺸــﯿـﻨـﯽ

‘যাই কিছু হোকনা কেন আপনি তো বিশ্বের রহমত। তাই বঞ্চিতদের থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারেন না।।’

৮. একবার নবী করিম ﷺ সাহাবাদের লক্ষ করে বলেন, আল্লাহ পাক প্রত্যেক নবীকেই এমন একটি বিশেষ দোয়া করার এখতিয়ার দিয়েছেন যা তিনি অবশ্যই কবুল করবেন। সকল নবীই সেই দোয়া করে ফেলেছেন। সাহাবাগণ আরজ করলেন, হে আল্লহর প্রিয় রাসুল ﷺ ! আপনিও কি সেই বিশেষ দোয়াটি করে ফেলেছেন? নবী করিম ﷺ বললেন, না, না করি নি, বরং সেই দোয়া আমি রেখে দিয়েছি আখেরাতের সঞ্চয় হিসাবে। কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ যখন আল্লাহ পাকের দরবারে উপস্থিত হবে তখন আমি আল্লাহর কাছে সেই দোয়াটি করব, যেন আমার সর্ব শেষ উম্মতটিকেও জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। অর্থাৎ আমার একজন উম্মতও যেন জাহান্নাতে না থাকে।

হযরত কাসেম নানুতবী রহ. নবী করিম -এর শানে চমৎকার কবিতা রচনা করেছেন,

عجب نہيں تيرى خاطر سے تيرى امت كے

گناه ہوويں قيامت ميں اطاعتوں ميں شمار

بكيں گےﺁپ كى امت كے ميں جرم ايسے گراں

كہ لاكہوں مغفرتيں ہوں گى كم سے كم پہ نثار

‘আশ্চর্য নয় যে, কিয়ামতের দিন আপনার উম্মতের পাপগুলো সওয়াব হিসাবে গণ্য হবে। আপনার উম্মতের পাপগুলো এমন চড়া দামে বিক্রি হবে যে, সামান্যের বিনিময়ে লাখ লাখ মাগফেরাত করা হবে।’

যদি ইহসান বা কৃপার দৃষ্টিকোণ থেকেও বিচার করা হয় তাহলেও প্রত্যেক উম্মতের জন্য সায়্যিদুল মুরসালিন খাতামুন নাবিয়্যিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা -কে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবেসে যাওয়া একান্ত কর্তব্য।

এই আলোচনার মাধ্যমে এ কথা পরিস্কার হয়ে গেল যে, কাউকে ভালোবাসার জন্য তাঁর মধ্যে যতগুলো কারণ আর উপাদান থাকা দরকার তার সবগুলোই হুজুর পাক -এর মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যমান আছে। তাই এত কিছুর পরও কেউ যদি নবী করিম -কে মনে-প্রাণে ভাল না বাসে তাহলে সে মুমিন হিসাবেই গণ্য হবে না। সে সব হতভাগার অন্তরে আল্লহ পাক মোহর মেরে আর চোখে পট্টি লাগিয়ে দিয়েছেন, যারা নবী করিম -কে ভালবাসার পরিবর্তে উল্টো আরও যারা তাকে ভালবাসে তাদের বিরুদ্ধে নানা উপহাস করে।

যাই হোক, আমাদের মত দুর্বলচিত্ত্ব সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য ইশকে নববী ছাড়া আর কী ই বা পুঁজি আছে! আলহামদুলিল্লাহ! আমরা এই বণ্টনে সন্তুষ্ট এবং যদি সারা দুনিয়ার সমস্ত নেয়ামতের পরিবর্তে শুধু নবী করিম -এর দরজার দারোয়ানের চাকুরী ভাগ্যে জুটে যায় তাহলে সে জন্যও সদা প্রস্তুত।
কবিরাতো তাদের প্রিয়তমার কপালের বিনিময়ে সমরকন্দ আর বুখারা পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত ছিল। সেখানে আমি একজন সামান্য ফকির, দেয়ার কিছুই নেই। শুধু প্রাণটা রয়েছে, তবে আরব ও আজমের বাদশাহর শুধু একটি অনাবিল দৃষ্টির জন্য সেই প্রাণটুকুও বিলিয়ে দিতে তৈরি আছি।

‘গরিব আমি নিশ্চয় দেয়ার কিছু নেই।
আছে শুধু ভালবাসা গ্রহণ কর তাই।’

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment