মূল: মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা: বা:
অধ্যায়-২
عشق (ইশক )শব্দের বিশ্লেষণ
عشق (ইশক) শব্দের অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছুর সাথে হৃদয় জড়িয়ে যাওয়া। বিখ্যাত অভিধান আমুনজিদে বলা হয়েছে,
عشِقَ يَعشَق ، عِشْقاً ومَعْشَقاً تعلّق قلبُه به
‘যার সাথে হৃদয় জড়িয়ে যায়।’
عَشِقَ بِالشَّيْءِ : لَصِقَ بِهِ ‘সে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।’
عَشَقة (আশাকা) থেকে ইশক শব্দটি নির্গত। عَشَقة (আশাকা) এমন এক শ্রেণির উদ্ভিদকে বলা হয় যা শুরুতে খুব সবুজ-শ্যামল ও সতেজ থাকে, তবে আস্তে আস্তে তা নেতিয়ে গিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়।
হিন্দি ভাষায় এক শ্রেণির লতাজাতীয় উদ্ভিদ عشق پیچیاں (ইশকে পেঁচা) বলে। যে গুলো কোনো গাছ পেছিয়ে ধরে ধীরে ধীরে তাকে পাতা-পল্লবহীন করে ফেলে। ফলে এক পর্যায়ে এসে তা শুকিয়ে মরে যায়। উর্দু ভাষায় এজাতীয় উদ্ভিদকে ‘আকাশ বেল’ বলে। অনুরূপভাবে কোনো আশেকের অন্তরে যখন ইশক বাসা বাঁধে তখন তা ধীরে ধীরে তাকে ফ্যাকাশে আকৃতির দুর্বল বানিয়ে দেয়।
কেউ কেউ মনে করেন, ইশক শব্দটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি অন্য কোনো শব্দ থেকে নির্গত হয় নি। তবে আসল বাস্তবতা হচ্ছে এই ইশক শব্দটি পবিত্র কুরআনের কোথাও একটি বারের জন্য ব্যবহৃত হয় নি। হতে পারে মূল আরবি ভাষায় ইশক শব্দটির মাঝে কিছুটা শালীনতার ঘাটতি রয়েছে। ‘কামুস’ নামক অভিধানে ইশককে পাগলামীর একটি অংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে হাদিস শরিফে ইশক শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বল নামক কিতাবের ২০৪৭৭ নম্বর হাদিসে জনৈকা বাঁদির আলোচনায় عشقهَا শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
হযরত শায়খ মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি রহ. বলেছেন, কুরআন শরিফে ইশককে ‘মহব্বতের আধিক্য’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেজন্য মহব্বত শব্দের পূর্বে আধিক্য-জ্ঞাপক শব্দ উল্লেখ করে বলা হয়েছে,
وَالَّذِيْنَ آمَنُوْ أَشَدُّ حُبَّ لِلَّهِ
‘ঈমানদার যারা তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে প্রচণ্ড ভালোবাসা রাখে।’
যখন মানুষের অন্তরে গাঢ় ভালবাসা দানা বাঁধে তখন সে তার প্রিয়তম ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে অন্ধ হয়ে যায়। এই গভীর ভালবাসা তার গোটা শরীরের প্রতিটিা শীরা-উপশীরায় প্রবাহমান হতে থাকে। প্রতিটি বস্তুর মাঝে কেবল তার প্রিয়তমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। কবির ভাষায়,
وَاللَه ما طَلَعَت شَمسٌ وَلا غَرُبَت
إِلّا وَأَنت بِقَلبي بَينَ وِسواسي
وَلا خلوت إِلى قَومٍ أُحَدِّثُهُم
إِلّا وَأَنتَ حَديثي بَينَ جُلّاسي
وَلا هَمَمتُ بِشُربِ الماءِ مِن عَطَشٍ
إِلّا رَأَيتُ خَيالاً مِنكَ في الكَأسِ
وَلا ذَكَرتُكَ مَحزوناً وَلا فَرِحاً
إِلّا وَحُبُّكَ مَقرونٌ بِأَنفاسي
وَلَو قَدَرتُ عَلى الإِتيانِ جِئتُكُم
سَعياً عَلى الوَجهِ أَو مَشياً عَلى الرَأسِ
‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার হৃদয় রাজ্যে আর কল্পনার জগতে বিচরণ না করলে কখনও সূর্য উদিত হয় না এবং অস্তও যায় না । তোমার আলোচনা ছাড়া আমি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে কোনো কথাই বলি না। আর যখনই কোনো পেয়ালায় চুমুক দেই তখনই তাতে তোমার ছবি ভেসে ওঠে। সুখে দু:খে তোমার আলোচনা করার সময় আমার শ্বাস-প্র:স্বাসে কেবলই তোমার ভালবাসার স্পন্দন অনুরণিত হয়। হায় আফসোস! যদি তোমার সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে আসার সামর্থ থাকত তাহলে (উপুড় হয়ে হলেও) হামাগুড়ি দিয়ে তোমার কাছে এসে উপস্থিত হতাম!!’
কবির হৃদয়পাতাল থেকে উৎসারিত এমন অবস্থারই নাম রাখা হয়েছে ইশক। ভাষাবদিগণ বলেছেন, মহব্বত যখন তার সীমা অতিক্রম করে চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যায় তখন তাকে বলা হয় ইশক।
ইবনুল মনসুর রহ. ‘লিসানুল আরব’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,
العِشْقُ فرط الحب وقيل هو عُجْب المحب بالمحبوب يكون في عَفافٍ الحُبّ ودَعارته
‘মহব্বতের আধিক্যের ফলে হৃদয়ে সৃষ্টি অবস্থার নামই হচ্ছে ইশক। অর্থাৎ মহব্বতের চুড়ান্ত সীমা অতিক্রম করার পর তা ইশকে পরিণত হয়ে যায়। চাই সেই মহব্বত তথা প্রেম-ভালবাসা পবিত্র হোক বা অপবিত্র।’
হযরত আহমাদ ইবন ইয়াহইয়ার কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘ইশক এবং মহব্বতের মাঝে কোনটি বেশি প্রশংসার উপযুক্ত?’
তখন তিনি বলেছিলেন, ‘মহব্বত।’ কেননা, لأنّ العِشْق فيه إفراطٌ ইশকের মাঝে বাড়াবাড়ি আছে।
কোনো কোনো আল্লাহপ্রেমিকের বক্তব্য হচ্ছে,
العشق: تجاوز الحد في المحبة
‘ইশক মানে ভালবাসার ক্ষেত্রে মহব্বতের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া।’
কেউ কেউ বলেন,
العِشْق عبارة عن إفراط المحبة وشدّتها والمحبة إذ ااشتدت وقويت سميت عِشْقاً
‘ভালবাসার অতিরঞ্জনের নাম ইশক। ভালবাসা যখন একান্ত গভীর এবং গাঢ় হয়ে যায় তখন তা মহব্বতের নাম অতিক্রম করে ‘ইশক’ নাম ধারণ করে।
عشق افراط محبت گفتہ اند
اندریں معنی چہ نیکوسفتہ اند
‘ইশক মানে ভালবাসার ক্ষেত্রে মহব্বতের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া। আর অসংখ্য নেককার ব্যক্তিও এতে লিপ্ত।’
হযরত জাওকি শাহ রহ. বলেন,
‘মানুষ হচ্ছে সবচে’ উন্নত ও শ্রেষ্ঠ জাতি। আল্লাহর পরে সৃষ্টিজীবের মাঝে সবচে’ সম্মানিত। তাই ভালবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে তথা ইশকের স্থলে আরোহন ও অবস্থান করা কেবল মানুষেরই শোভা পায়। কোনো মানুষই এর আওতামুক্ত নয়। ইশকের দহনে জ্বলে না এমন কোনো মানুষ পাওয়া অসম্ভব।’
ইশকের বরকতে আশেকের অন্তরে অস্বাভাবিক শক্তি সঞ্চিত হয়। সে সময় ও অবস্থার জনক হয়ে যায়। আকাশ-পাতাল তার যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে। মহা কবি আল্লামা ইকবাল রহ. বলেন,
عشق کی اک جست نے طے کر دیا قصہ تمام
اس زمین و آسماں کو بیکراں سمجھا تھا میں
‘ইশকের এক নেশা সব কিছু বাজিমাত করে দিয়েছে। এমনকি আমি এই আসমান-জমিনকে এক ভেবে বসেছিলাম।’
তিনি অন্যত্রে বলেন,
صدق خلیل بھی ہے عشق، صبر حسین بھی ہے عشق!
معرکۂ وجود میں بدر و حنین بھی ہے عشق
‘হযরত ইবরাহিম আ.-এর সততাও ইশক। হযরত হুসাইন রাযি.-এর ধৈর্যও ইশক। অস্তিত্বের লড়াইয়ে বদর ও হুনাইনও ইশক।’
ইশক এমন এক প্রতিষেধক, তা যদি মাটির সাথে মিশে যায় তাহলে ওই মাটিকেও সে ইতিহাসের অংশ বানিয়ে দেয়। কর্ডোভার জামে মসজিদ আর আগ্রার তাজমহল এর জ্বলন্ত প্রমাণ। কর্ডোভার জামে মসজিদ নিয়ে রচিত আল্লামা ইকবালের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘মসজিদে কুরতবা’ নিম্নরূপ–
عشق ہے اصلِ حیات، موت ہے اس پر حرام
تُند و سبک سَیر ہے گرچہ زمانے کی رَو
عشق خود اک سَیل ہے، سَیل کو لیتاہے تھام
عشق کی تقویم میں عصرِرواں کے سوا
اور زمانے بھی ہیں جن کا نہیں کوئی نام
عشق دمِ جبرئیل، عشق دلِ مصطفیٰؐ
عشق خدا کا رُسول، عشق خدا کا کلام
عشق کی مستی سے ہے پیکرِ گِل تابناک
عشق ہے صہبائے خام، عشق ہے کاسُ الکِرام
عشق فقیہِ حرم، عشق امیرِ جُنود
عشق ہے ابن السّبیل، اس کے ہزاروں مقام
عشق کے مِضراب سے نغمۂ تارِ حیات
عشق سے نُورِ حیات، عشق سے نارِ حیات
‘আল্লাহর বান্দার আমল হয় ইশক দ্বারা জ্যোতিময়। ইশক হচ্ছে জীবনের মূল। তার জন্য মরণ হারাম। যুগের দৃষ্টিতে যদিও তা চটপটে হালকা পাতলা ক্ষীণ কিন্তু ইশক হচ্ছে এক প্লাবন যা অন্য প্লাবনেরও গতি থামিয়ে দেয়। এক স্রােত যা অন্য স্রােতকে আটকে দেয়। ইশকের পঞ্জিকায় বর্তমান যুগ ছাড়াও অন্য যুগ রয়েছে। যার অন্য কোনো নাম নেই। ইশক হচ্ছে হযরত জিব্রাইল আ.-এর প্রাণ। আর মুহাম্মদ মোস্তফা ﷺ-এর হৃদয়। আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর কালাম। ইশকের মস্তিতে প্রস্ফুটিত ফুল দীপ্তিমান। ইশক হচ্ছে অপকৃক আঙ্গারের মদ। সম্মানি পেয়ালা। ইশক হচ্ছে হেরেমের মহাজ্ঞানী। ইশক হচ্ছে সেনা কমান্ডার। ইশক হচ্ছে পথের পথিক। তার রয়েছে অসংখ্য বাড়ি। ইশকের বেহালায় বীনায় সুর বাজে। ইশক হচ্ছে জীবনের আলো। ইশক হচ্ছে জীবনের আগুন।’
আশেকের অন্তরে এমন দৃঢ় আস্থা আর মজবুত ইয়াকিন সৃষ্টি হয় যার ফলে কোনো প্রকার শংকা-ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারে না। কবির ভাষায়,
مؤمن از عشق است و عشق از مؤمن ست.
عشق را ناممکن ما ممکن است
‘মুমিনের জন্য ইশক আর ইশকের জন্য মুমিন। এই ইশকের কারণেই আমাদের সকল অসম্ভব সম্ভবে পরিণত হয়ে যায়।’
আরবি সাহিত্যে (خلق) খুলুক (স্বভাবচরিত্র) শব্দের মত ইশক শব্দটাও ভাল-মন্দ উভয় অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয়। খারাপ চরিত্র বুঝানোর জন্য যেমন (سوء خلق) বা বদ আখলাক শব্দ ব্যবহার করা হয় তেমনি ইশকের ক্ষেত্রে খারাপ বা নেতিবাচক দিক বুঝানোর জন্য ‘ইশকে মাজাজী’ (পার্থিব প্রেম) বলা হয়। আর ভাল বা ইতিবাচক অর্থে বলা হয় ইশকে হাকিকী তথা প্রকৃত প্রেম।
ইশক কাকে বলে?
১. হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. তাঁর ‘লামআ’ত’ নামক কিতাবে ইশকের হাকিকত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
‘খাঁটি মুমিন বান্দা, যার দৃঢ় বিশ্বাস হল, আল্লাহ তাআলা যাবতীয় পূর্ণাঙ্গ গুণে গুণান্বিত; তাই সে তাঁর জিকির ও স্মরণের ওপর নিজের কামালাত বা পূর্ণতাকে মৌকুফ মনে করে এবং সর্বদা সে আল্লাহর নামের জিকির (স্মরণ) করে তার সমস্ত নেয়ামত ও সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করে। এবং এসব স্থায়ীভাবে সার্বক্ষণিক করার কারণে তার হৃদয়ে চাঞ্চল্য, অস্থিরতা ও ছটফটানির এক আবেগময় অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেতেই থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে এসে সে আল্লাহ তাআলার বরকতময় নাম পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন তার প্রাণ-বায়ু এক্ষুণি বের হয়ে যাবে। কবির ভাষায়,
و يدركني في ذكرها قشعر ير
لها بين جلدي والعظام دبيبُ
‘আমার প্রিয়তমাকে স্মরণ করার সময় আমার মাঝে এক ধরণের কম্পন সৃষ্টি হয় এবং আমার চামড়ার অস্থির মাঝে মৃদু স্পন্দন অনুভুত হতে থাকে।’
মোটকথা, অন্তরে যখন এমন অবস্থা স্থায়ী হয়ে যায় তখন তাতে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এক বিশেষ বস্তু প্রবিষ্ট হয়ে তাকে বিশেষ রঙে রাঙিয়ে তোলে। এটিকেই ইশক বলে আখ্যাায়িত করা হয়।
২. শায়েখ আবুল কাসেম জুনাইদ বাগদাদী রহ. বর্ণনায়,
العشق إلفة رحمانية وإلهام شوقى أوجبهما كرم الإله على كل ذى روح لتحصل به اللذة العظمى التى لا يقدر على مثلها إلا بتلك الإلفة وهى موجودة فى الأنفس بقدر مراتبها عند أربابها، فما أحد إلا عاشق لأمر يستدل به على قدر طبقته من الخلق، ولأجل ذلك كان أشرف المراتب فى الدنيا مراتب الذين زهدوا فيها مع كونها معاينة، ومالوا إلى الأخرى مع كونه مخبرا لهم عنها بصورة اللفظ
‘ইশক হল, পরম দয়াময় আল্লাহ পাকের রহমানী ভালবাসা। ইলহামী আসক্তি। যা তিনি প্রতিটি প্রাণীর মাঝে অবধারিত করে দিয়েছেন। যাতে করে অপরিমেয় মজা অনুভূব করা যায়, যা তারা অন্য কিছুর মাধ্যমে অর্জণ করতে সক্ষম হত না। আর এটি অন্তরে প্রোথিত। প্রেমিকগণের কাছে এর স্তর ও শ্রেণি বিন্যাসিত রয়েছে। তাই এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে কেউ না কারও প্রতি আশেক নয়। তবে তার মান নির্নয় হয় স্বীয় মাশুকের স্তর অনুসারে। তাই যে ব্যক্তি দুনিয়ার সব কিছু ছেড়ে শুধু আখেরাতের প্রতি আশেক হবে সে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং মর্যাদাবান বলে গণ্য হবে।’
৩. ইমাম গাজালী রহ. বলেন,
‘মানুষের করণীয় হল, সে ইশকের সাগরে ঝাঁপ দেবে। সাগরের ঢেউ যদি তাকে ধাক্কিয়ে তীরে পৌঁছিয়ে দেয় فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا তাহলে সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। আর যদি সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ তাকে গভীর তলদেশে ডুবিয়ে দেয় فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ তাহলে তার সওয়াব আল্লাহর কাছে অবধারিত হয়ে যায়।। ইশক হৃদয়ে প্রবেশ করলে রক্তাক্ত করে ছাড়ে। নয়ন যুগলে স্বর্শ করলে তাকে সমুদ্র বানিয়ে দেয়। কাপড়ে লাগলে তাকে ছিড়ে ফেলে। আর প্রাণে প্রবেশ করলে তাকে মাটি বানিয়ে দেয়। এবং সম্পদে প্রবেশ করলে তাকে বমি বানিয়ে দেয়। মূলত: ইশক হচ্ছে জুনুনে ইলাহি তথা আল্লাহর জন্য পাগলামী।
৪. হযরত শিবলী রহ. বলেন,
العشق نار يقع في القلب فأحرقت ماسوى المحبوب
‘ইশক হল এক ধরণের আগুন। তা কারো অন্তরে প্রবেশ করলে তার মাশুক ছাড়া সব কিছু পুড়ে ছারখার করে দেয়।’
৫. আল্লামা রুমী রহ. বলেন,
عشق و عاشق محوگردد ز ریں مقا م
خود ہماں معشوق مانندوالسلام
‘আশেক ইশকের মাঝে বিলীন হয়ে যায় আর ইশক বিলীন হয়ে যায় মাশুকের মাঝে। এক্ষেত্রে কেবল মাশুকই টিকে থাকে।’
৬. হযরত আলী হিজবিরী রহ. বলেন,
عشق ازمواهب است نہ از مكاسب
‘ইশক হচ্ছে একমাত্র আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামত। তা কখনও নিজ বাহু বলে বা প্রচেষ্টায় উপার্জন করা যায় না।’
কবি মির্জা গালিব রহ. উক্ত কথা এভাবে প্রকাশ করেছেন,
عشق پر زور نہیں ہے یہ وہ آتش غالبؔ
کہ لگائے نہ لگے اور بجھائے نہ بنے
‘ইশকের প্রতি জোর-জবরদস্তি চলে না। এটি সেই প্রবল শক্তিসম্পন্ন অনল শিখা। যা কিছুতে লাগাতে গেলে যেমন লাগে না, তেমনি তা নেভাতে গেলেও নিভে না।’
৭. বান্দা নেওয়াজ গেছুদারাছ রহ. বলেন, ‘ইশক হচ্ছে আল্লাহপ্রদত্ত এক বিশেষ বস্তু এবং তাঁর সবিশেষ পুরস্কার।’
عشق با زی اختيار ما نہ بود
ہر كہ ایں اخواہند بر سرمی نہند
‘ইশক-আশেকি কারও এখতিয়ারাধীন বস্তু নয়। যে এতে পতিত হয়েছে তাকে সে মাথায় তুলে নিয়েছে।’
৮. হযরত মাসউদ বেগ চিশতি নিজামী রহ. ইশকের ব্যাখ্যা এভাবে প্রদান করেছেন,
‘হে প্রিয়! ইশক যখন হৃদয়ে হানা দেয় তখন তাকে রক্তাক্ত বানিয়ে দেয়। যখন আঁখি যুগলে প্রবেশ করে তখন তাকে সিন্ধু-সাগরে পরিণত করে। কাপড়ে লাগলে ছিঁড়ে ফেলে। অন্তরে প্রবেশ করলে মাটি বানিয়ে দেয়। আর সম্পদে ঢুকে পড়লে তাকে বমি বানিয়ে ছাড়ে। প্রকৃত পক্ষে ইশক হচ্ছে এক ধরণের ‘জুনুনে ইলাহি’।’
জনৈক কবি বলেন,
كشته تیغ عشق را غسل و چه حاجت است
زا ںكہ شہید شوق توباركفن نمی شود
‘ইশকের তলোয়ারের আঘাতে শহিদ ব্যক্তির জন্য গোসল ও নতুন কাফনের প্রয়োজন নেই। কেননা, এই পথে জীবন দানকরী শহিদ কাফনের বোঝা বরদাশত করে না।’
৯. একবার জুন্নুন মিসরী রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘প্রকৃত এবং খাঁটি আশেক কে?’ তিনি জবাবে বলেন,
إذا رأيت رجلا خزين الوجه مفقودالقلب مغلوب العقل،. شديد البكاء ، طالب الموت و الفناء ومع ذلك يراعي الادب و يَتَّفِقُ الأَوْقَات فهو عاشق صادق
‘যখন তুমি এমন ব্যক্তিকে দেখবে যার চেহারা উদাসীন, অন্তর ভঙ্গুর, বিবেক জ্ঞানশূন্য , সদা ক্রন্দরত, মৃত্যু কামনাকরী। এত কিছুর পরও সে সভ্য রুচিশীল, সময়ের অনুগামী তাহলে বুঝে নিবে সেই বক্তিই নিরেট ‘আশেক’।
১০. মাখদুম শরফুদ্দিন আহমাদ ইয়াহইয়া রহ.-কে কেউ একজন কিজ্ঞেস করল, ‘হযরত! ইশক কী জিনিস?’
তিনি বলেন, ‘মহব্বতের চরম আধিক্যকে ইশক বলে। অর্থাৎ মহব্বতের চূড়ান্ত স্তর অতিক্রম করলে ইশকের জগতে পদার্পন করা যায়।’
অন্য একজন জানতে চাইল, ‘হুজুর এশকের রং কেমন?’
উত্তর দেন, ‘গোটা জগৎ ইশক থেকে রং ধরে নিয়ে নিজের রূপ ধারণ করেছে।’ অর্থাৎ গোটা জগতটাই ইশকের রঙে রঙিন। এরপর তিনি নিচের কবিতাগুলো আবৃত্তি করেন,
عشق ام كہ دردوكون ومكانم پديد نيست
عنقائےمغربم كہ نشانم پديد نيست
با آبرو وبہ غمزده جہا ں صيدكرده ام
منكرمداں كہ تيركمانم پديد نيست
چوں آفتاب دررخ ہر ذره ظاهرم
ازغايت ظهورعيانم پديد نيست
گويم بهر زبان وبهرگوش بشنوم
ايں طرفہ تركہ گوش وزبانم پديد نيست
چوں ہرچہ ہست درہمہ عالم ہمہ مانم
مانند در دو عالم از انم پديد نيست
‘আমি হলাম সেই ইশক, যা উভয় জাহানে প্রকাশিত নয়। আমি গধুলিলগ্নের (রূপকথার) আনকা পাখি, যার কোনো আকৃতি নেই। আমার নাজ ও রূপের ঝলকে উভয় জগতকে আমি শিকার করে নিয়েছি। হে আমার অস্তিত্ব অস্বীকারকারী! একথা কখনই মনে কর না যে, তীর ধনুক কখনই প্রকাশিতব্য নয়। (প্রকৃত পক্ষে) আমি প্রতিটি অনু পরমানুতে সূর্যের মত উদ্ভাসিত। আমি চূড়ান্তভাবে প্রতীয়মান তবে প্রকাশিত নয়। আমি সব ভাষাতেই কথা বলি সব ভাষাতেই কথা শুনি, তবে আজব ব্যাপার হল, আমার যবান এবং কান প্রকাশ্য নয়। গোটা সৃষ্টিজগতে যা কিছু আছে আমি সবকিছুর সমষ্টি। উভয় জাহানের তামাম কিছু আমাকে ঘিরেই, কিন্তু প্রকাশমান নয়।’
এরপর তিনি বলেন,
‘অনেকে বলে, ইশক মানে আগুন। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে আশেকের চেহারা অশ্রু-পানি দ্বারা সিক্ত থাকে কিভাবে? কেউ কেউ বলে, ইশকের অপর নাম পানি। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে হাজার হাজার আশেকের হৃদয় এই ইশকের কারণে শুস্ক কেন? কেন জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে যায় তাদের কলিজা? দগ্ধ কেন হয় তাদের অন্তর? অনেকে মনে করে ইশক এক ধরণের গরল বিষ । কিন্তু আমি জানতে চাই তাই যদি হয়, তাহলে লক্ষ লক্ষ আশেক এমন প্রাণোচ্ছল সজীব ও জীবন্ত কেন? যারা বলে ইশক মানে কষ্ট। তাদের কাছে জানতে চাইব, তাহলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণের বিনিময়ে কেন তা খরিদ করে? কেউ কেউ বলে, ইশক মানে প্রশান্তি। তাদের বলব, তাহলে এর তীব্র দহনে মানুষ দাহ্য হয় কেন? মোট কথা, সকলেই নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ইশকের সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেছে। তবে প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে কোনো ভাষা দিয়ে এর সংজ্ঞা যা ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। এটা কেবলই হৃদয় দিয়ে অনুভবের বিষয়।
তরিকতপন্থী মাশায়েখগণ এব্যাপারে একমত যে, ইশক হৃদয়কে প্রিয়তমের এই বাণী পৌছিয়ে দেয়, তুমি কখনও স্থির ও প্রশান্ত হয়ো না। আর প্রাণকে এই পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয় যে, তুমি আনন্দ উপভোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও। সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও। মাথাকে বলে, তুমি শান্তি থেকে দূরে থাক। চেহারাকে বলে, তোমার আকৃতি-অবয়ব মলিত ও বিবর্ণ করে নাও। শরীরকে বলে, তোমার শক্তিকে ছুটি দিয়ে দাও। চক্ষুকে বলে, তুমি অশ্রু বিসর্জন দিতে থাক। আর অবস্থাকে বলে, তুমি অন্ধকার হয়ে যাও। জিহ্বাকে ধ্বংস করে দাও। বন্ধু মহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও। উভয় জাহানকে তালাক দাও এবং সব কিছু থেকে বিমুখ হয়ে যাও …।
১১. কবির দৃষ্টিতে ইশক ওই শক্তি যা সিনাই পর্বতকে আভ্যন্তরিন জ্যোতি দান করে। তবে সে জন্য প্রয়োজন আল্লাহওয়ালার অন্তর থাকা। ইশক জ্ঞানীদেরকে মুজিজা স্বাদৃশ শক্তি ও যোগ্যতা দান করে। ইশকের শক্তির সামনে সব কিছু মাথা নুয়ে দেয়। এমন মনে করবেন পৃথীবরি সমস্ত কিছুই তিতা, তবে একমাত্র মিষ্টি বস্তু হচ্ছে ইশক। ইশকের আগুনেই আমাদের চিন্তা প্রখর হয়। জীবন বিসর্জন দেয়া সম্ভব হয়। মানুষ ও প্রাণী সবার জন্যই ইশক যথেষ্ট। যদি সত্য জানতে চাও, তাহলে উভয় জাহানের জন্য একমাত্র ইশকই সব কিছু। নিচের কবিতাগুলো একটু আবৃত্তি করে অপার্থিব মিষ্টতা অনুভব করুন,
عشق صیقل می زند فرهنگ را
جوهر آئینه بخشد سنگ را
اهل دل را سینهٔ سینا دهد
با هنرمندان ید بیضا دهد
پیش او هر ممکن و موجود مات
جمله عالم تلخ و او شاخ نبات
گرمی افکار ما از نار اوست
آفریدن جان دمیدن کار اوست
عشق مور و مرغ و آدم را بس است
عشق تنها هر دو عالم را بس است
‘ইশক জ্ঞানীদের আলোকিত করে দেয়। আর পাথরকে আয়না বানানোর যোগ্যতা দান করে। দিলওয়ালাদের সিনাই পর্বতের মত আলোকিত অন্তর দান করে। আশেকদের শুভ্র হাতের ক্ষমতার মত বগলে হাত দিলে তা সাদা হয়ে যাওয়ার শক্তি দান করে। তার সামনে সব কিছু ‘ফানা’ হয়ে যায়। গোটা সৃষ্টিজগত তিক্ত আর সে মিছরির টুকরো। তার আগুন থেকেই সৃষ্ট হয় আমাদের চিন্তার উত্তাপ। প্রাণ সৃষ্টি করাই তার কাজ। পিপড়া, পক্ষীকুল আর মানুষের জন্য ইশকই যথেষ্ট। বরং উভয় জাহানের জন্যই শুধু ইশকই যথেষ্ট।’
১২. এই ফকিরের মতে ইশক হচ্ছে, সেই জজবা তথা আকর্ষণ। যার কাছে পরাজিত হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এর শুরুটাই যখন জীবন বিসর্জন দিতে উদ্বুদ্ধ হওয়া তাহলে এর শেষ বা চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে নিজেই কল্পনা করুন। কেউ যদি ইশকের দর্শণ করতে চান তাহলে ‘ব্যথিত হৃয়ের’ আশেকদের তালাশ করুন। তাদের যেখানেই পাবেন সেখানেই ইশকের দর্শণ লাভ হবে। ইরাকী কত সুন্দর করে বলেছেন,
بعالم هركجاكہ درد دل بود
بہم كردندوعشقش نام كردند
‘ব্যাথিত হৃদয়ের মানুষগুলো পৃথিবীর যেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সেখান তেকে তাদের একত্রিত করে তার নামকরণ করা হয়েছে ‘ইশক’।’
আর কবি হালী এই ভাবটাকে এভাবে প্রকাশ করেছেন,
عشق سنتے تھے جسے ہم وہ یہی ہے شاید
خود بخود دل میں ہے اک شخص سمایا جاتا
‘যাকে ইশক বলা হয় শোনা যেত, হয়ত এটিই নিজে নিজে হৃদয়ে অবস্থিত এক ব্যক্তি …।’