ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইয়াযিদ (লানতুল্লাহ) 

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লি ওয়ানুসাল্লিমু আলা হাবীবিহিল কারীম ওয়ালা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া আহলে বায়তিহী আজমায়ীন । আম্মা বা’দ, 

▪ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- হে হাবীব আপনি বলে দিন এর বিনিময়ে আমি কোন প্রদিদান চাইনা; কিন্তু একমাত্র নিকটাত্মীয়দের (আহলে বায়ত) প্রতি ভালোবাসা। [১] 

এ আয়াতে নিকটাত্মীয়ের দ্বারা উদ্দেশ্য হল নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধরগণ । যে  নবী পাকের আমরা উম্মত সে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরা প্রাণপ্রিয় নাতি হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু । যিনি তাঁর নানার দীনের সম্ভ্রম রক্ষার্থে কারবালা প্রান্তরে ইয়াযিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন । উম্মতের জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কিছুই হতে পারেনা যে, সে ইমামে পাকের হত্যার আদেশদাতা পাপিষ্ঠ ইয়াযিদকে তাঁর কাতারে নিয়ে আসা, কারবালার হত্যাকান্ডকে রাজনৈতিক ও দুই শাহজাদার ঝগড়া বলা । যেখানে মর্যাদার নিরিখে ইয়াযিদ কোনভাবেই ইমামে পাকের শত ক্রোশ নিকটেও আসতে সক্ষম নয় সেখানে তাকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত পর্যন্ত বলে ফেলা । আল্লাহ হেফাজত করুন । আলোচ্য প্রবন্ধে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও অভিশপ্ত ইয়াযিদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপনের মাধ্যমে উভয়ের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ । 

হযরত সায়্যিদিনা ইমাম হুসাইন বিন আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কুনিয়ত আবু আব্দুল্লাহ । তাঁর নানা  বনী আদমের সরদার, সৃষ্টির সেরা এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । তাঁর মাতা হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণপ্রিয় কন্যা রমণীকূলের সম্রাজ্ঞী ফাতিমা যাহ্‌রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা । তাঁর পিতা আল্লাহর সিংহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু । আর তাঁর ভাই সাইয়্যেদ, রায়হানুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু । তাঁর জন্মের পর নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ডান কানে আযান দেন । 

▪ হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ফরমান, যখন ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ করেন তখন নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনেন আর ফরমান, আমার বেটাকে আমার নিকট নিয়ে আস । জিজ্ঞেস করলেন কি নাম রেখেছ ? আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইরাশাদ করেন হরব , হুযুর ইরশাদ করেন না, এর নাম হুসাইন । তিনি ইরশাদ করেন, হাসান, হুসাইন ও মুহসিন হযরত হারুন আলাইহিস সালামের পুত্রদের নামের ন্যায় । তাঁর পুত্রদের নাম ছিল শুব্বার, শুবাইর ও মুশাব্বির । [২] 

▪ ইমরান বিন সুলাইমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হাসান-হুসাইন জান্নাতী নাম, জাহেলী যুগে এ ধরণের নামকরণ ছিলনা । লাইছ বিন সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জন্ম চতুর্থ হিজরীর শাবান মাসের শেষদিন হয় । কাতাদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাঁর জন্ম ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জন্মের একবছর দশ মাস পর হয় । [৩]  

▪ ইমামে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জন্মের পূর্বে হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচী হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী নবীজীর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আজ এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি । হুযুর ফরমান, কি দেখেছ ? তিনি আরজ করলেন, আমি দেখেছি আপনার দেহ মুবারক হতে একটি অংশ কাটা হয়েছে আর তা আমার কোলে রাখা হয়েছে । হুযুর ইরশাদ করলেন তুমি খুব উত্তম স্বপ্ন দেখেছো । ইনশাল্লাহ ফাতিমার ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্ম নিবে আর তাকে তোমার কোলে রাখা হবে । [৪]

আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসনাইন কারীমাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে সীমাহীন ভালোবাসতেন । তাঁদের মর্যাদা ও ফজিলত প্রসঙ্গে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে । 

▪ এক হাদীসে ইরশাদ হয়, হযরত হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা জান্নাতি যুবকদের সর্দার । [৫]

▪ অপর হাদিসে হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের জান্নাতের ফুল বলে আখ্যায়িত করেন। ইরশাদ করেন হাসান ও হুসাইন দুনিয়াতে আমার দুটি ফুল । [৬] 

এজন্যেই আক্বা কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফুলের ন্যায় তাঁদের সুঘ্রাণ নিতেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরতেন । 

▪ আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হাসান ও হুসাইনকে ভালোবাসলো সে প্রকৃতপক্ষে আমাকে ভালোবাসলো । আর যে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল মূলত সে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল । [৭] 

▪ হযরত ইয়ালা বিন মুররা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেন, একদা আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাথে এক খানার দাওয়াতে অংশ নিতে যাই । পথিমধ্যে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাস্তায় খেলা করছিলেন, সরকার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ধরতে উদ্যত হলে তিনি  ছুটে অতঃপর হুযুর আবার হাত মেলে ধরতে গেলেন এবং তাঁর সাথে কৌতুক করলেন এবং ধরে ফেললেন, হুযুর এক হাত তাঁর চোয়ালে আর অপর হাত মাথায় রাখলেন অতঃপর ইরশাদ করলেন হুসাইন আমার থেকে আর আমি হুসাইন থেকে । যে ব্যক্তি হুসাইনকে ভালোবাসবে আল্লাহ পাক তাকে ভালোবাসবে আর হুসাইন আমার পবিত্র বংশধরদের একজন । [৮]  

▪ হযরত যায়দ বিন আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন, যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে আমি তাদের সাথে সন্ধি করব আর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব। [৯] 

▪ হযরত উম্মে ফদ্বল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একদা আমি হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার খিদমতে উপস্থিত হয়ে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর কোলে দিলাম । আমি দেখতে পেলাম হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ মুবারক হতে অশ্রু বেয়ে পড়ছে । আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতামাতা আপনার উপর কুরবান হোক, কি হয়েছে ? হুযুর ইরশাদ করলেন, জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আমার নিকট আগমন করে বলেছে যে আমার উম্মত আমার এই বংশধরকে শহীদ করে দিবে । আমি আরজ করলাম হুসাইনকে ? হুযুর ইরশাদ করলেন হ্যা । আরো ইরশাদ করলেন, জিব্রাইল ঐ স্থান (কারবালার) লাল রঙের (রক্তে রঞ্জিত) মাটিও আমার নিকট  নিয়ে এসেছে। [১০]

▪ উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আমাকে সংবাদ দিয়েছে, আমার ওফাতের পর আমার সন্তান হুসাইনকে ‘ত্বফ’ নামক স্থানের জমীনে শহীদ করে দেয়া হবে । জিব্রাইল আমার নিকট সে স্থানের মাটিও এনেছে আর এ মাটি হল হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাহাদাতের স্থানের । ত্বফ হল কূফার নিকটবর্তী ঐ স্থান যেটিকে কারাবালা বলা হয়ে থাকে । [১১] 

হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শৈশবেই তাঁর শাহাদাতের সংবাদ প্রচার হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু’আ করেননি যে। হে আল্লাহ! আমার হুসাইনকে মুসিবত থেকে রক্ষা করুন অথবা তাঁর শত্রুদের বিনাশ করুন । চোখ থেকে অশ্রুপাত তো হয়েছে কিন্তু হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে মুসিবত থেকে রক্ষার জন্য দু’আ করেননি । কেননা এটা ছিল পরীক্ষা, আর পরীক্ষায় উৎরানোর ক্ষেত্রে প্রাণ রক্ষা নয় বরং; প্রাণ বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের উদ্দেশ্য পূরণই মূখ্য । নিঃসন্দেহে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কারবালার ময়দানে যে স্বকীয় মহিমায় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ইসলামের মর্যাদা উড্ডীন রেখেছেন, তা কেবল আহলে বায়তের পক্ষেই সম্ভব । ইসলামের সংগ্রামের সুমহান ইতিহাসে শাহাদাত বরণ তো অনেক হয়েছে । শত কোটি মুজাহিদ আল্লাহর পথে আল্লাহর নামে ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছেন । কিন্তু কারবালার তপ্ত ময়দানে ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার প্রাণপ্রিয় সন্তান ইমামে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত বরণ এক অতুলনীয় ঘটনা । যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দান তো অবশ্যই বিরাট ব্যাপার; কিন্তু এর সাথে নিজের চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় আত্মীয়দের কর্তিত মস্তক মুবারক, নিজের কোলে ধরা প্রাণপ্রিয় দুধের সন্তানের রক্তমাখা লাশ, নিজের সাথে আসা কাফেলাকে পিপাসার্ত অবস্থায় দেখা, একে একে ভাই, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের শহীদ হতে দেখে বড় বড় পাথর হৃদয় বীরকেও পিছু হটতে বাধ্য করে । কিন্তু শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহজাদা কারবালার পরীক্ষাক্ষেত্রে দেখিয়ে দিলেন স্বীয় নানাজানের দীন রক্ষায় , এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে কতেক প্রাণ তো সামান্য হাজারো আলী আসগার,কাসিম ,জা’ফর আল্লাহর রাস্তায় কুরবান করে দিতে দ্বিধা নেই ।  এর আগেও হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম স্বীয় প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের গলায় আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য ছুরি চালিয়েছেন । এখানেও কুরবানী চাওয়া হয়েছিল , হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তো কুরবানী দিতে চেয়েছে কিন্তু আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষা নেয়া । আর কারাবালার ময়দানে একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটে আর ইমাম আলী মক্বাম ইসলামের জন্য আল্লাহর রাস্তায় শুধু নিজের নয় ১৮/১৯ জন আহলে বায়তের কুরবানী দিয়ে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মান নিয়ে সুমহান মক্বাম অর্জন করে নিলেন । আল্লাহু আকবর! 

ইমামে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন ইত্যাদির জন্য নয় বরং কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর নৈকট্য লাভের জন্যই ছিল । কেননা ক্ষমতা দখলের জন্য  লড়াই করার মানস থাকলে কেবল পরিবারের ৭২ জন সদস্য নিয়ে বের হতেন না । ইমাম পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খুব ভালো করেই জানতেন ইয়াযিদের হাতে তার পিতার গড়া সিরিয়ার বিশাল সাম্রাজ্য,সৈন্যবাহিনী ও অনুগত লোকবল রয়েছে যার মোকাবেলা অত সহজ হবেনা ,সুতরাং তাঁর বেরিয়ে পড়া যদি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য হত তাহলে তিনি অবশ্যই নূন্যতম লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রওনা হতেন । পরিবারের নারী শিশুদের সঙ্গে নিয়ে কি যুদ্ধের ময়দানে যাত্রা হয় ? 

 ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন-হাদীস ও ইমামগণের অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে যা ছোট এক প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয় । আলোচ্য শিরোনামের ধারাবাহিকতায় ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনার সামনে অভিশপ্ত ইয়াযিদের আলোচনা উপস্থাপনের সাথে সাথেই ইয়াযিদের অবস্থা ও অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবে এ পর্যায়ে সে আলোচনা শুরু করছি । 

ইয়াযিদ হযরত মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের সন্তান । তার মাতার নাম মাইসুন বিনতে মাদখাল কালবিয়্যাহ । তার জন্ম ২৫/২৬ হিজরী সনে । ইয়াযিদের জন্মলগ্নে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন । ইয়াযিদের শৈশব রাজকীয় পরিবেশে কাটে , মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযিদকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেন । ইয়াযিদ কাব্য সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিল । তার জীবন অনেকটা নিষ্কন্টক ছিল অভাব কষ্ট ইত্যাদির মোকাবেলা তাকে করতে হয়নি । ইয়াযিদের অবয়ব ছিল মোটা , বিশ্রী , গা ভর্তি লোম এবং মদ্যপায়ী, ফাসিক, অত্যাচারী, দুশ্চরিত্র ও বদ চরিত্রের লোক ছিল । ৬০ হিজরী সনে হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ওফাতের পর ইয়াযিদ সিংহাসনে বসেন যার মাধ্যমে ইসলামী সুশাসনের সমাপ্তি ঘটে । তার পিতার মৃত্যুকালীন সময়েও সে মদের আসরে মশগুল ছিল সেখান থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয় । মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাকে শাসন নীতি সম্পর্কে ওসিয়ত করেন এমনকি ইমামে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সন্ধি ও সম্পর্ক স্থাপন নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেন । হয়ত তিনি উপলদ্ধি করতে পারছিলেন তাঁর এই পাপিষ্ঠ সন্তান ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী নীতির স্থলে স্বকীয় নীতি ও হুকুমদারি চালাবে । এটা তাঁর তাকওয়া ছিল যে, তিনি তাঁর সন্তানকে সাবধান ও নৈতিকতার বিষয়ে নসিহত ও ওসিয়ত করে যান । বাকিটা ইয়াযিদের আমল থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় ইয়াযিদের শাসন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের নীতি অনুসারে নয় বরং প্রতি পদে পদে বিরোধী ছিল । 

▪ হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বাজারে হাটার সময়ও এই দু’আ করতেন যে, ৬০ হিজরী এবং যুবকদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর ! এই বর্ণনায় ঐ দিকেই ইঙ্গিত ছিল যে, ৬০ হিজরী সালে যে শাসক হবে সে যুবক সম্প্রদায়ের হবে আর সে ছিল ইয়াযিদ । আর হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দু’আ কবুল হয় তাঁর ওফাত ৫৯ হিজরীতে হয় । [১২]

▪ গসীলে মালাইকাহ ( যাকে ফিরিশতাগণ শাহাদাতের পর গোসল দেন ) হযরত হানযালা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, আল্লাহর শপথ! আমরা ইয়াযিদের আনুগত্য তখনই ছেড়ে দিয়েছি যখন আমাদের আশংকা হল যে, (তারই বদমায়েশীর কারণে) না জানি আমাদের উপর আসমান হতে পাথর বর্ষিত হয় কিনা । অবশ্যই এ বদ লোক ( ইয়াযিদ ) মা-বোন ও কন্যাদের সাথে বিবাহে বৈধতা দেয়, প্রকাশ্যে মদ্যপান করতে থাকে এবং নামায ত্যাগ করে । [১৩]

▪ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন আমার উম্মতের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার সুন্নাতকে পরিবর্তন করে দিবে সে হল বনু উমাইয়ার ইয়াযিদ। [১৪]

▪ আরও ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের শাসন ন্যয়সঙ্গত থাকবে অর্থাৎ শাসক ন্যয়পরায়ণ হবে । সর্বপ্রথম যে তা বিনষ্ট করবে সে হল বনু উমাইয়ার ইয়াযিদ । [১৫]

বিদায়া নিহায়া, তারিখে ত্ববারী, তারিখুল খুলাফা, ত্ববক্বাতে সা’দ, তারিখে দামেশক, মুকাদ্দামা ইবন খালদুন সহ  ইতিহাসের সকল কিতাবেই বর্ণিত ইয়াযিদের কৃতকর্মই প্রমাণ করে সে কি ছিল । এমন এক পাপিষ্ঠ যে ইমামে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বায়আত গ্রহণের উদ্দেশে , নিজের মসনদ পোক্ত রাখতে কারবালার ময়দানে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র পরিবারের সদস্যদের পানির পিপাসায় কষ্ট দিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করে দেয়, তার বাহিনী সেই ইমামে পাককে নির্মমভাবে শহীদ করে দেন যাকে হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সীমাহীন ভালোবাসতেন, তাঁর কর্তিত শির মুবারককে তার অনুচর ইবনে যিয়াদ ও নিজের দরবারে অসম্মান করা হয়, কারবালার ময়দানে আহলে বায়তের শহীদ পবিত্র সদস্যদের লাশ মুবারক ধুলায় ফেলে রাখা হয়, আহলে বায়তের পবিত্র নারীদের সকলের সামনে অসম্মান করে ইবনে যিয়াদ ও ইয়াযিদের দরবারে টেনে আনা হয় । এমন নির্মমতার পর ক্ষুদ্র ঈমানের অধিকারী মুমিনের (যদি মুমিন হয় তবে) অন্তরাত্মাও চুর চুর করে কাঁদতে বাধ্য । এখানেই শেষ নয় এই দুরাচার মক্কা-মদীনার অধিবাসীদের শায়েস্তা করতে সৈন্য প্রেরণ করে, নক্কা-মদীনাকে তার সৈন্যদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, তার সৈন্যদের হাতে অসংখ্য সাহাবা ও তাবেঈ নির্মভাবে শহীদ হয়, পবিত্র রমনীদের ইজ্জত লুন্ঠন করা হয়, উম্নুক্তভাবে অত্যাচার ও লুন্ঠন চালানো হয়, মসজিদে নববীতে ঘোড়ার আস্তাবল বানানো হয়, পাথর নিক্ষেপ করে কা’বার গিলাফ পুড়ানো হয় । এর পরেও কি কোন মুসলমানের মনে ইয়াযিদের চরিত্র নিয়ে সংশয় থাকতে পারে ? এই পাপাচারীর ফাসিক ও লা’নতী হওয়ার ব্যাপারে উলামা ও ইমামগণ প্রায় একমত । যারা নিশ্চুপ থেকেছেন তারাও তাকে অভিযোগ থেকে মুক্ত বলেননি ।  

▪ হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে, যে মদীনাবাসীদের ভীত সন্ত্রস্ত করবে, আল্লাহ তা’আলা তকেও ভীত সন্ত্রস্ত করবেন । আর তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সমগ্র মানবজাতির অভিসম্পাত । তার না কোন ফরজ ইবাদত কবুল হবে না কোন নফল ইবাদত । তাবরানীর অপর বর্ননায় বর্ণিত আছে যারা মদীনাবাসীকে কষ্ট দিবে ( آذى ) শব্দের ব্যবহার হয় । [১৬]

▪ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মদীনাবাসীদের কোন ক্ষতি করতে চাইবে, আল্লাহ তাকে এমনভাবে গলিয়ে দিবেন যেমন লবণ পানিতে গলে যায় । [১৭]

এরপরেও ইয়াযিদ প্রেমীদের সর্বশেষ আশ্রয় হল সে তো ময়দানে ছিলনা, সে সিরিয়ায় ছিল ঘটনাস্থল সম্পর্কে অবগত ছিলনা ইত্যাদি ইত্যাদি । আহ মুসলমান তার এতসব কীর্তিকলাপ জানার পরও কিভাবে এমন একচোখা হয়ে থাকতে পারো ? এখানেই শেষ নয় এরা বুখারী শরীফের আশ্রয় নিয়ে হাদীসে কুস্তুনতুনিয়ার আশ্রয় নিয়ে ইয়াযিদকে ক্ষমার সংবাদপ্রাপ্ত বলে চালিয়ে দিতে চায় । না এরা হাদীস জানে না মানে না এর নির্যাস এদের চোখে পড়ে বা অন্তরে প্রবেশ করে । করলে মিলিয়ে দেখতো ইয়াযিদ কুস্তুনতুনিয়ায় কখন কিভাবে অংশ নিয়েছে  । এর পরেও তারা তার কৃতকর্ম নিরীক্ষণ করে দেখতো অবশ্য অন্তরে যদি ঈমান অবশিষ্ট থাকতো। 

▪ নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষণা , যখন কোন পাপিষ্ঠ ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা করা হয় তখন রাব্বুল আলামীন তাতে অসন্তুষ্ট হোন এবং তার আরশ কেঁপে উঠে । [১৮] 

পরিশেষে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও সামর্থ্য নিয়ে কুরআন হাদীস ও ইতিহাসের দলীলাদি সামনে এনে দেয়ার পর অবশ্যই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, হকের উপর অবস্থান কার ছিল । খিলাফত অর্জন ও ধরে রাখার দুরভসন্ধি কার ছিল ? ইমামে পাকের অবস্থান খিলাফত অর্জন নয় বরং ইয়াযিদের ন্যায় পাপিষ্ঠ ফাসিক জালিমের বিরুদ্ধাচরণ । ইমামে পাক ইসলাম রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন বিরোধিতার জন্য নয় । এ লড়াই ক্ষমতা লাভের ছিলনা বরং হক ও বাতিলের । ইমামে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কারবালার ময়দানেই হক ও বাতিলের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিয়েছে । তাঁর এই  বিরল আত্মত্যাগই তাঁর অবস্থান প্রদর্শন করার জন্য যথেষ্ট । আর মৃত্যু, কোথায় বীরের মতো ইসলামের রাস্তায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানসে সিজদারত অবস্থায় শহীদ হওয়া আর কোথায় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ,হারামাঈনে হামলারত অবস্থায় মদের পেয়ালার পাশে মারা যাওয়া । এমন কি আছে যা দিয়ে ইমামে পাকের পাশে তো দূর শত শত মাইলের মধ্যে তূলনীয় হবে । আল্লাহ আমাদের জানার বুঝার এবং আহলে বাইতের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দিন । আমিন বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন । 

তথ্যসূত্রঃ

১. আল কুরআন সূরা শুরাঃ২৩ । 

২. বুখারী আল আদাবুল মুফরাদ ১:২৮৬ হাদীস-৮২৩, হাকেম আল মুস্তাদরাক হাদীস-৪৭৭৩, সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস- ৬৯৮৫ । 

৩. আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী রহঃ কৃত শরহে মুসলিম, ৬:৯৮৩ পৃঃ । ফরীদ বুক স্টল লাহোর । 

৪. সাদরুল আফাজিল আল্লামা নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী রহঃ কৃত সাওয়ানিহে কারবালা ১০৫ পৃঃ মাকতাবাতুল মদীনা বাবুল মদীনা করাচী । 

৫. তিরমিযি শরীফ, আবওয়াবুল মানাক্বিব ৫:৬৫৬ হাদীস-৩৭৬৮ , সহীহ ইবনে হিব্বান-৬৯৫৯ । 

৬. বুখারী শরীফ, কিতাবুল মানাক্বিব,বাবু মানাক্ববি হাসান ওয়া হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হাদীস-৩৭৫৩/৩৫৪৩, তিরমিযি শরীফ, আবওয়াবুল মানাক্বিব ৫:৬৫৭ হাদীস-৩৭৭০ । 

৭. সুনানু ইবন মাজাহ হাদীস-১৪৩, নাসাঈ আস সুনানুল কুবরা হাদীস-৮১৬৮, হাকেম আল মুস্তাদরাক হাদীস-৪৭৭৭, ইবনে আদী কৃত আল কামিল ৩:৪৩৪ । 

৮. সুনানু ইবন মাজাহ হাদীস-১৪৪, বুখারী আল আদাবুল মুফরাদ হাদীস-৩৬৪ । 

৯. সুনানু ইবন মাজাহ হাদীস-১৪৫, সুনানু তিরমিযি হাদীস-৩৮৭০, সহীহ ইবনে হিব্বান-৬৯৭৭ । 

১০. হাকেম আল মুস্তাদরাক ৩:১৯৪ হাদীস-৪৮১৮, বায়হাক্বী দালায়িলুন নবুওয়্যাহ ৬:৪৬৮-৪৬৯ । 

১১. তাবরানী আল মু’জামুল কাবীর ৩:১০৭ হাদীস-২৮১৪, বায়হাক্বী দালায়িলুন নবুওয়্যাহ ৬:৪৬৯।

১২. ইবনে হাজর আসকালানী ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী ১৩:১০ হাদীস-৭০৫৮ দারুল মা’রেফাহ বৈরুত । 

১৩. ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী তারিখুল খুলাফা ১৫৮,১৫৯ পৃঃ , ইবনে সা’দ আত ত্ববকাতুল কুবরা ৫:৬৬ দারু সাদির বৈরুত, ৫:৪৯ দারুল কুতুবিল আলামিয়্যাহ বৈরুত ।

১৪. মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদীস-৩৫৮৭৭, সওয়ায়িকুল মুহাররিকাহ ২:৬৩৩ মুয়াসসাতুর রিসালাহ লেবানন । 

১৫. সওয়ায়িকুল মুহাররিকাহ ২:৬৩৩ মুয়াসসাতুর রিসালাহ লেবানন, ইবনে আসাকির তারিখে দামেশক ৬৫:২৫০ দারুল ফিকর বৈরুত । 

১৬. নাসাঈ আস সুনানুল কুবরা হাদীস-৪২৫১, তাবরানী আল মু’জামুল কবীর ৭:১৪৩ হাদীস-৬৬৩১।   

১৭. সহীহ মুসলিম , কিতাবুল হজ্জ হাদীস -১৩৮৭, সুনানু ইবন মাজাহ হাদীস-৩১১৪ ।  

১৮. বায়হাক্বী শো’আবুল ঈমান ৬:৫১১ হাদীস-৪৫৪৪।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment