পঞ্চম শতাব্দীতে একবার ‘সমরকন্দ’ অঞ্চলে খরা দেখা দেয়। মানুষজন যথাসাধ্য চেষ্টা করেন; কেউ কেউ সালাতুল ইস্তেসকা (বৃষ্টির জন্যে নামায-দোয়া) পড়েন, তারপরেও বৃষ্টি নামেনি।
এমতাবস্থায় ‘সালেহ’ নামের এক প্রসিদ্ধ নেককার ব্যক্তি শহরের কাজী (বিচারক)-এর কাছে উপস্থিত হন। তিনি কাজী সাহেবকে পরামর্শ দিলেন— “আমার মতে আপনার এবং সর্বসাধারণ মুসলমানদের উচিত ইমাম বুখারী রহ.’র মাযার শরীফ যেয়ারত করা। তাঁর মাযার শরীফ ‘খারতাংক’ এলাকায় অবস্থিত। ওখানে মাযারের কাছে গিয়ে বৃষ্টি চাইলে আল্লাহ তায়ালা হয়তো বৃষ্টি মঞ্জুর করতেও পারেন।”
অতঃপর বিচারক ওই পুণ্যবান ব্যক্তির পরামর্শে সায় দেন। এবং মানুষজনকে সাথে নিয়ে ইমাম বুখারী রহ.’র মাযারে যান।
সেখানে (মাযারে) বিচারক সবাইকে সাথে নিয়ে একটি দোয়া পাঠ করেন। এ সময় মানুষেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং ইমাম বুখারী রহ.কে দোয়ার মধ্যে অসীলা হিসেবে গ্রহণ করেন। আর অমনি আল্লাহ তায়ালা মেঘমালা পাঠিয়ে ভারি বর্ষণ অবতীর্ণ করেন।
সবাই ‘খারতাংক’ এলাকায় অর্থাৎ ইমাম বুখারী রহ. এর দরবারে ৭ দিন যাবত অবস্থান করেন এবং তাঁদের কেউ-ই ‘সমরকন্দ’ ফিরে যেতে চাননি। অথচ এই দুটি স্থানের দূরত্ব মাত্র ৩ মাইল। [ইমাম যাহাবী রহঃ কৃত সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড, ৪৬৯ পৃষ্ঠা]
সহীহ বুখারীর প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার, মুজাদ্দিদ ইবনে হাজর আসকালানী রহঃ সহীহ বুখারীর ১০১০ হাদিস (যে হাদিসে হযরত উমার রাঃ নবীজির চাচা হযরত আব্বাস রাঃ এঁর উসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন বলে উল্লেখ আছে) এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন,
মদিনাবাসীগণ একবার হযরত উমার (রা.) এঁর খেলাফতকালে অনাবৃষ্টির কারনে দূর্ভিক্ষে পতিত হন। হযরত বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) নামক জনৈক সাহাবী নবী করিম ﷺ-এঁর রওজা মােবারকে গিয়ে আরজ করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ্ ﷺ! আপনার উম্মতেরা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। আপনি তাঁদের জন্য বৃষ্টির দোয়া করুন। অতঃপর রাত্রে স্বপ্নে এসে নবী করিম ﷺ বেলাল (রা.) কে বললেনঃ তুমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) এঁর নিকট গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে বলো- তাঁরা বৃষ্টি পাবে। স্বপ্ন দেখে বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) হযরত উমার (রা.) কে এ শুভ সংবাদ দিলেন। হযরত উমার (রা.) এ সংবাদ শুনে কেঁদে ফেললেন। মদিনাবাসীগণ রহমতের বৃষ্টি লাভ করলেন।
(এছাড়াও এই হাদিস শরীফ রয়েছে মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহ হা/৩২৬৬৫/৩২০০২, ইমাম বায়হাক্বীঃ দালায়েলুন নবুয়াত, হা/ ৩০৩০/ ২৯৭৪)
আরো উল্লেখ্য যে, ইবনে হাজর আসকালানী রহঃ শরহে বুখারীতে ঐ হাদিসের (১০১০) ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ করেন যে, হযরত আব্বাস রাঃ এঁর ঘটনা দ্বারা জানা গেল যে, নবীর পরিবার ও নেককার বুযুর্গদের উসিলায় সুপারিশ (দোয়া) অন্বেষণ মুস্তাহাব।
এভাবে যুগ যুগ ধরেই সম্মানিত ব্যক্তিদের উসিলা দিয়ে আল্লাহ’র কাছে দোয়া করার পদ্ধতি প্রচলিত আছে এবং থাকবে।
ইমাম শাফেঈ রহঃ বলেন, “নিশ্চয়ই আমি ইমাম আবু হানিফা রহঃ হতে বরকত হাসিল করি। যখন আমার কোন সমস্যা দেখা দেয় তখন আমি উনার মাজার শরীফে এসে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। অতঃপর উনার উসীলা দিয়ে আল্লাহ পাকের নিকট সমস্যা সমাধানের জন্য প্রার্থনা করি। তা অতি তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে যায়।(ফতোয়ায়ে শামী, মুকাদ্দিমা ১ম খন্ড ৫৫ পৃষ্ঠা। তারিখে বাগদাদ,১ম খন্ড, পৃঃ ১২৩। রুদ্দুল মুখতার, ১ম খন্ড,পৃঃ৩৮)
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহঃ) লিখেন, উলামা ও যাদের প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে এই আচার সবসময়ই চালু ছিল যে তাঁরা ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এঁর মাজারে যেতেন এবং নিজেদের অসুবিধা দূর করার জন্যে তাঁর মাধ্যমে দোয়া করতেন। এ সকল ব্যক্তি এটাকে সাফল্য লাভের একটা উসিলা মনে করতেন এবং এর অনুশীলন দ্বারা বড় ধরনের পুরস্কার লাভ করতেন। বাগদাদে থাকাকালীন সব সময়েই ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাজারে যেতেন এবং তাঁর কাছে আশীর্বাদ তালাশ করতেন। যখন আমার (ইমাম ইবনে হাজর মক্কী রহঃ) কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আমি দু’রাকাত নামাজ আদায় করে তাঁর মাযারে যাই এবং তাঁর ওসীলায় দোয়া করি। ফলে আমার অসুবিধা তক্ষণি দূর হয়ে যায়।(খায়রাত আল্ হিসান, ১৬৬ পৃষ্ঠা)
খতীব বাগদাদী রহঃ লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী রহঃ বাগদাদে থাকতে ইমামে আজম আবূ হানীফার কবর জিয়ারত করতেন এবং তাঁকে উসীলা করে দোয়া করতেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার মাজার শরীফের বরকত সম্পর্কে নিজের পরীক্ষিত আমল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: “আমি ইমাম আবূ হানীফার উসীলায় বরকত লাভ করি এবং প্রতিদিন তাঁর কবর জিয়ারত করি। যখন আমার কোনো প্রয়োজন বা সমস্যা হয়–তখন আমি দু’রাকাত নামায আদায় করে তাঁর কবরের কাছে এসে, এর পাশে দাঁড়িয়ে হাজত (প্রয়োজন) পূরণের জন্যে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে দোয়া করি। এরপরে আমি সেখান থেকে ফিরতে না ফিরতেই আমার হাজত পূরণ হয়ে যায়!”
(তারিখে বাগদাদ,১ম খন্ড, ১২৩ পৃষ্ঠা)
স্বয়ং নবীজি ﷺ ই উসিলা দিয়ে দোয়া করা শিখিয়ে ছিলেন যা সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী সকল বুযূর্গগণসহ এখনও বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। এছাড়াও আমাদের নবী দুনিয়ার জমিনে আগমনের পূর্বেও উনার উসিলায় দোয়া করা হত এমনকি আদম আলায়হিস সালামও আমাদের নবীর উসিলায় দোয়া করেন (এখানে উল্লেখ্য যে, সর্বপ্রথম সৃষ্টি আমাদের নবীর নূর মোবারক, কিন্তু দুনিয়ায় প্রেরণের দিক দিয়ে আমাদের নবী সর্বশেষ)
উসিলা দিয়ে দোয়া করার শিক্ষাঃ
উসমান ইবনু হুনাইফ রাঃ থেকে বর্ণিত। এক অন্ধ সাহাবী নবী ﷺ এঁর নিকট এসে আরজ করল, আপনি আল্লাহ্র কাছে আমার জন্য দুআ করুন। তিনি যেন আমাকে রোগমুক্তি দান করেন। তিনি বলেনঃ তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দুআ করতে বিলম্ব করবো, আর তা হবে কল্যাণকর। আর তুমি চাইলে আমি দুআ করবো। সে বললো, তাঁর নিকট দুআ করুন। তিনি তাকে উত্তমরূপে উযূ করার পর দু রাকআত সালাত পড়ে এ দুআ করতে বলেনঃ
হে আল্লাহ্! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, রহমতের নবী মুহাম্মাদ ﷺ এঁর উসীলা দিয়ে, আমি তোমার প্রতি মুতাওয়াজ্জু হচ্ছি/ মনোনিবেশ করলাম। ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আমার চাহিদা পূরণের জন্য আমি আপনার উসীলা দিয়ে আমার রবের প্রতি মনযোগী/ মুতাওয়াজ্জু হলাম যাতে আমার প্রয়োজন মিটে।
হে আল্লাহ্! আমার জন্য তাঁর সুপারিশ কবূল করো। (অতঃপর তার অন্ধত্ব দূর হয়। বর্তমানে এর উপর আমল করতে চাইলে, “ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ” এর স্থলে “ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ” বলতে বলা হয়েছে) (সুনানে ইবনে মাজাহ ১৩৮৫, সুনান আত তিরমিযি ৩৫৭৮)
প্রিয় নবী ﷺ এঁর ওফাতের পর এক ব্যক্তি এই উসমান বিন হানিফ রাঃ এঁর কাছে হাজত পূরণের জন্য এলে তিনি তাকে একইভাবে দোয়া করতে শিখিয়ে দেন। তিনি বলেন, উত্তমরুপে ওযু করে দু’রাকাত নামায পড়ুন এবং এ দো’আ করুন-
“হে আল্লাহ্! তোমার কাছে প্রার্থনা করছি ও তোমার দিকে মুতাওয়াজ্জু হচ্ছি রহমতের নবী মুহাম্মদ ﷺ এঁর বদৌলতে বা উসিলায়। ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আমি আপনার উসিলায় আল্লাহ্র দিকে মুতাওয়াজ্জু হলাম তিনি যেন আমার প্রয়োজন পূরণ করে দেন”। (মুজামুল কাবির লিল তাবরানি, হা/৮৩১১; মুজামুস সাগির, হা/৫০৮; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৩৬৬৮)
একবার মদীনাবাসী ভীষণ অনাবৃষ্টির কবলে পড়েছিল। লোকজন আম্মাজান আয়িশা রাঃ এঁর নিকট অভিযোগ করলে তিনি বলেন, নবী ﷺ এঁর রওজার দিকে দেখ (যাও), আর তাতে আসমানের দিকে একটি ফুটো করে দাও, যেন আসমান ও তাঁর মাঝে কোনো আচ্ছাদন না থাকে। তখন তারা তা-ই করলো। ফলে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হল। সেই বৃষ্টিতে এত বেশি ঘাস জন্মেছিল যে, উট হৃষ্টপুষ্ট হয়ে মনে হয় যেন চর্বিতে ফেটে পড়বে। ফলে সেই বছরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘উর্বরতার বছর’। (সুনান আদ-দারেমী ৯৩, মিশকাত ৫৯৫০)
আম্মাজান আয়িশা রাঃ এঁর কাছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর ব্যবহৃত জুব্বা মুবারক সংরক্ষিত ছিল যা রোগ নিরাময়ের উসিলা হিসেবে ব্যবহৃত হত যেভাবে আমরা আল্লাহ’র হুকুমে ওষুধ সেবন করে সুস্থ হয়।
বর্ণিত আছে যে,
হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) এঁর নিকট রাসুলুল্লাহ ﷺ এঁর ব্যবহৃত সবুজ রঙের জুব্বা ছিল। তিনি বলেন, এটি আয়িশা (রা.) এঁর ওফাত পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিল। তাঁর ওফাতের পর আমি এটি নিয়েছি। নবী ﷺ এটি পরিধান করতেন। তাই আমরা রোগীদের শেফা হাসিলের জন্য এটি ধৌত করি এবং সে পানি তাদের কে পান করিয়ে থাকি। (সহীহ মুসলিম ৫৩০২)
সবকিছুই মহাপরাক্রমশালী, সর্ব ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তায়ালা দান করেন। এসব হচ্ছে উসিলা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,
“তিনি (ঈসা আলায়হিস সালাম) বলবেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিদর্শনসহ তোমাদের নিকট এসেছি, আমি তোমাদের জন্য মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুঁক দেব, আল্লাহর হুকুমে পাখি হয়ে যাবে, আল্লাহ’র হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগী আরোগ্য করবো এবং মৃতকে জীবিত করবো এবং আমি তোমাদেরকে বলে দেব তোমাদের গৃহে তোমরা যা আহার কর এবং সঞ্চয় করে রাখ; নিশ্চয়ই এ কাজে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মু’মিন হও।” (সূরা আলে ইমরান ৪৯)
তিনি আরো বলেন,
“কাফেলা যখন (মিশর থেকে ইউসুফ আ. এঁর জামা নিয়ে) বেরিয়ে পড়ল, এমন সময়ে তাদের পিতা (ইয়াকুব আ., বাড়ীর লোকজনকে) বললেন, ‘তোমরা আমাকে বয়োবৃদ্ধ দিশেহারা মনে না করলে (তোমরা জেনে রাখ) আমি অবশ্যই ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি।’ উপস্থিত ব্যক্তিরা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আপনি তো আপনার সেই পুরানো বিভ্রান্তিতেই (পুত্রস্নেহের মধ্যে বিভোর) আছেন দেখছি।’ (অতঃপর) সুসংবাদদাতা যখন (ইউসুফ আ. এঁর জামা নিয়ে) এসে হাযির হল, তখন সে জামাটি ইয়াকুব (আঃ) এঁর মুখমন্ডলের উপর রাখল, তাতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। তিনি (ইয়াকুব আ.) বললেন, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমি আল্লাহর নিকট হতে যা জানি তা তোমরা জান না।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৯৪-৯৬)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাঁর প্রিয় হাবিব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর উসিলায় ইমাম বুখারীর উপর অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করুক। ইমাম বুখারী রহঃ এঁর উসিলায় আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুক।