ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ইমাম গাযযালী (رحمة الله)’র প্রণীত “এহইয়াও উলুমিদ্দীন” গ্রন্থটি ইসলামে সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর একটি হিসেবে পরিগণিত, যা (যুগে যুগে) উলামাবৃন্দের প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং মুসলমান সমাজের কাছেও সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে। এর প্রশংসাকারী অগণিত আলেম-উলামার একজন ইমাম সাফাদী (رحمة الله) বলেন:
لَو لم يكن للنَّاس فِي الْكتب الَّتِي صنفها الْفُقَهَاء الجامعون فِي تصانيفهم بَين النَّقْل وَالنَّظَر والفكر والأثر غَيره لكفى
“এটা সবচেয়ে অভিজাত ও সেরা (ইসলামী) গ্রন্থগুলোর একটা; তা এমনই এক পর্যায়ের যে এর সম্পর্কে কথিত আছে, ইসলামের সমস্ত বই-ও যদি হারিয়ে যায় কিন্তু ‘এহইয়া’ টিকে থাকে, তাহলে এটা হারানো সব কিছুর জন্যে যথেষ্ট হবে।”[নোট-১]
[ নোট-১: ইমাম ইবনে সুবকী কৃত ‘তাবাক্বাত আল-শা’ফিইয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৩]
বিভিন্ন কারণে ‘এহইয়া’ পুস্তকটি সমালোচিতও হয়েছে;
এগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল ও জাল হাদীস/রওয়ায়াত উদ্ধৃত করার অভিযোগ। এর একটি তালিকা পেশ করেছেন ইমাম ইবনে সুবকী, যিনি গুরুত্বারোপ করেন যে ইমাম গাযযালী (رحمة الله) কখনোই হাদীসশাস্ত্রে উৎকর্ষ সাধন করেননি ।[নোট-২]
[নোট-২: প্রাগুক্ত ‘তাবাক্বাত,’ ৬: ২৮৭-৩৮৯]
আবূ আবদিল্লাহ মা’যারী মালেকী ভুলভাবে ‘আল-কাশফ ওয়াল-ইনবা’আ ‘আন কিতা’ব আল-এহইয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে ‘এহইয়া’ পুস্তকটিতে উদ্ধৃত বেশির ভাগ বর্ণনা-ই নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্নে ‘ওয়া’হিন’ তথা ত্রুটিপূর্ণ। অপর দিকে আরেক সমালোচক মালেকী আলেম আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে আল-ওয়ালীদ আল-তুরতূশী (ইন্তেক্বাল: ৪২০ হিজরী) ইবনে জা’ফির আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদির রহমান ইবনে আতিয়্যা’কে লেখা পত্রে বিস্ময় প্রকাশ করেন: “তিনি (আল-গাযযালী) তাঁর বইটি জাল বর্ণনা দ্বারা পরিপূর্ণ করেছেন!”
ইমাম ইবনে সুবকী (رحمة الله) প্রত্যুত্তর দেন:
আল-মা’যারী ছিলেন আশআরী মতবাদের একজন আবেগপ্রবণ প্রবক্তা – কর্তৃত্বশীল ও মাঝারি, বড় ও ছোট উভয় ক্ষেত্রেই; যে ব্যক্তি এগুলোকে অতিক্রম করতেন, তাঁকেই অাল-মা’যারী বেদআতী ঘোষণা করতেন। অধিকন্তু, তিনি নিজের মালেকী মাযহাবের প্রতি ছিলেন পক্ষপাতিত্বপূর্ণ, যে পক্ষ তিনি তেজোদ্দীপ্তভাবে সমর্থন করতেন। পক্ষান্তরে, আল-জুওয়াইনী (رحمة الله) ও আল-গাযযালী (رحمة الله) এমন এক জ্ঞান ও দক্ষতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যে প্রত্যেক নিরপেক্ষ গবেষক/পর্যবেক্ষক-ই এ কথা স্বীকার করতে সক্ষম যে তাঁদের পরে ওই ক্ষেত্রে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার; আর তাঁরা কালা’মশাস্ত্রের প্রশ্নে ইমাম আবূল হাসান আশআরী (رحمة الله)’র সাথে ভিন্নমত পোষণ করাকে হয়তাে যথাযথ বিবেচনা করে থাকতে পারেন (এর দরুন)। আশআরীবৃন্দ, বিশেষ করে ওই মাযহাবের মরক্কোবাসী অনুসারীবৃন্দ এটাকে সহজভাবে নেন না এবং তাঁরা কাউকেই ইমাম আবূল হাসান (رحمة الله)’এর মতাদর্শের সামান্যতম লঙ্ঘনও করতে দিতে চান না ।[নোট-৩]
[নোট-৩: দেখুন ইমাম গাযযালী (رحمة الله)’র ‘ফায়সাল আল-তাফরিক্বা’ {রাসা’ইল ৩:৭৫-৯৯} শীর্ষক পত্র, যেটা সেসব আশআরী’র জবাবে লেখা হয়েছে যারা ইমাম অাবূল হাসানের এমন কী এজতেহাদ-সহ সকল নীতিমালা হতে বিচ্যুত যে কারো প্রতি তাকফির/ধর্মচ্যুতির ফতোয়া জারি করেন। এই পত্রে ইমাম গাযযালী (رحمة الله) লেখেন: “জেনে রেখো, ইসলামী জ্ঞানের শাখাগুলোতে কোনো তাকফির নেই স্রেফ একটি বিষয় ব্যতিরেকে, আর তা হলো অামাদের কাছে ব্যাপক (জনশ্রুত) বর্ণনার মাধ্যমে আগত ধর্মের উসূল/মূলনীতিমালার যে কোনো একটির অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান। অন্যান্য বিষয়গুলোর বেলায় ’ফিক্বীয়্যা’ তথা শরঈ বিধানশাস্ত্রে ‘তাখতিয়া’ তথা অসত্যতা বা ভুলভ্রান্তির ফতোয়া হতে পারে; আর অন্য ক্ষেত্রে ‘তাবদী’ (বেদআত/নতুন প্রচলন) হতে পারে; যেমনটি ইমাম পদবীর ব্যাপারে ভ্রান্তি সম্পর্কিত হওয়া {মানে চার খলীফা (رضي الله عنه)ম-বিষয়ক ভ্রান্তি ও হুযূরের (ﷺ) সাহাবাবৃন্দের (رضي الله عنه)ম অবস্থা সম্পর্কে ভ্রান্তি}]
আরো জটিলতা সৃষ্টি করেছে আল-জুওয়াইনী (رحمة الله) ও আল-গাযযালী (رحمة الله) কর্তৃক কিছু বিষয়ে ইমাম মালেক (رحمة الله)’এর সিদ্ধান্তকে দুর্বল করে ফেলা, যেমন – জনকল্যাণ বিষয়ে দেয়া রায়গুলো [নোট-৪],
[নোট-৪: হানাফী ও মালেকী ফক্বীহ-মণ্ডলী কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে জনকল্যাণ (আল-মাসা’লিহ আল-মুরসালা) ক্ষেত্রে নেয়া এসতেহসা’ন (সুবিবেচনাপূর্ণ বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত) ও রায়কে ইসলামী বিধানের বৈধ উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা ওই সব বিষয়ে নস (শরঈ দলিল), এজমা’ (উলামাবৃন্দের ঐকমত্য) ও ক্বেয়াসের (গবেষণামূলক সিদ্ধান্তের) অনুপস্থিতিতে গৃহীত হতো। দেখুন – আবূ এসহা’ক্ব আল-শীরা’যী কৃত ‘অাল-লুমা’আ ফী উসূল আল-ফেক্বাহ (১২১ পৃষ্ঠা), আল-শা’তিবী প্রণীত ‘আল-মুওয়া’ফাক্বাত ফী উসূল আল-ফেক্বাহ’ (৩:৭৫-৭৭), আল-আমিদী রচিত ‘আল-এহকা’ম ফী উসূল আল-আহকা’ম’ (৪:৩২f, ৪:১৬৭f), আল-রা’যী লিখিত ‘আল-মাহসুল ফী ’এলম আল-উসূল’ (৬:২১৮-২২৫) এবং ইবনে বাদরান কৃত ‘আল-মাদখাল ইলা’ মাযহাব আল-ইমাম আহমদ’ (২৯৫-২৯৬ পৃষ্ঠা)। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আল-হাসান আল-শায়বানী (رحمة الله) একটি বই রচনা করেন ‘আল-এসতেহসা’ন’ শিরোনামে যা ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) খণ্ডন করেন তাঁর প্রণীত ‘এবতাল আল-এসতেহসা’ন’ পুস্তকে]
অথবা কোনো মাযহাবের চেয়ে অন্য আরেকটি মাযহাবকে বেশি পছন্দ করা……আর আল-মা’যারী’র ব্যক্ত
وَأما قَوْله الْغَزالِيّ لَيْسَ بالمتبحر فِي علم الْكَلَام فَأَنا أوافقه على ذَلِك لكني أَقُول إِن قدمه فِيهِ راسخ وَلَكِن لَا بِالنِّسْبَةِ إِلَى قدمه فِي بَقِيَّة علومه هَذَا ظَنِّي
“ইমাম গাযযালী (رحمة الله) কালা’মশাস্ত্রে কোনো মুতাবাহহির তথা অগ্রগণ্য পণ্ডিত নন” মর্মে কথাটির সাথে আমি একমত; তবে আমি আরো যোগ করবো: এতে নিশ্চয়ই তাঁর ছিলো সুদৃঢ় দখল/পদচারণা, যদিও আমার মতে অন্যান্য বিদ্যাশাস্ত্রে তাঁর দখলের তুলনায় এটা তেমন দৃঢ় ছিলো না।
আর আল-মা’যারীর ব্যক্ত
وَأما قَوْله إِنَّه اشْتغل فِي الفلسفة قبل استبحاره فِي فن الْأُصُول فَلَيْسَ الْأَمر كَذَلِك بل لم ينظر فِي الفلسفة إِلَّا بعد مَا استبحر فِي فن الْأُصُول وَقد أَشَارَ هُوَ أَعنِي الْغَزالِيّ إِلَى ذَلِك فِي كِتَابه المنقذ من الضلال وَصرح بِأَنَّهُ توغل فِي علم الْكَلَام قبل الفسلفة
“উসূলের শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনের আগে ইমাম গাযযালী (رحمة الله) দর্শনশাস্ত্রে প্রবৃত্ত হন” মর্মে কথাটি প্রসঙ্গে বলতে হয়, ঘটনা তা নয়। তিনি উসূল-শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরই কেবল দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন আরম্ভ করেন; এবং তিনি তাঁর ‘আল-মুনক্বিয মিন আল-দালা’ল’ পুস্তকে এটা উল্লেখও করেছেন এ কথা যোগ করে যে, তিনি কালা’ম-শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেই দর্শনশাস্ত্রের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন।
وَأما ابْن سينا فالغزالي يكفره فَكيف يُقَال إِنَّه يقْتَدى بِهِ
আর ইবনে সীনা’র ক্ষেত্রে আল-গাযযালী (رحمة الله) তাঁকে অবিশ্বাসী ঘোষণা করেন; এমতাবস্থায় তাঁর (ইবনে সীনার) ওপর কীভাবে তিনি নির্ভর করতে পারেন?
‘এহইয়া’ গ্রন্থে কিছু বর্ণনা উদ্ধৃত করার ব্যাপারে ইমাম গাযযালী (رحمة الله)’র প্রতি দোষারোপ প্রসঙ্গে জানা যায় যে তাঁর হাদীসশাস্ত্রে কোনো দক্ষতা ছিলো না, আর অধিকাংশ বর্ণনা ও ঘটনা তিনি তাঁর পূর্বসূরী সূফীবৃন্দ ও ফক্বীহ-মণ্ডলী হতে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বয়ং একটি এসনাদ/সনদ-ও পেশ করেননি; কিন্তু আমাদের একজন সাথী (ইমাম যাইনউদ্দীন এরাক্বী) যত্নসহকারে ‘এহইয়া’র বর্ণনাগুলোর এসনাদ সপ্রমাণ করেছেন; স্রেফ কিছু সংখ্যক বিবরণকে শা‘যয তথা ত্রুটিপূর্ণ অভিহিত করা হয়েছে। আমি উপকারার্থে সেগুলো উদ্ধৃত করবো….আল-গাযযালী (رحمة الله)’র কথিত ‘রাসূল (ﷺ) এরশাদ ফরমান’ বাক্যটিও তাঁর (হুযূরের) প্রতি নিশ্চিতভাবে অারোপিত অর্থে নয়, বরঞ্চ তা এমন এক আরোপিত কথা যা নিশ্চিত বলে দৃশ্যমান হয়। কেননা তিনি যদি এটাকে সত্য বলে ধরে না নিতেন, তাহলে তিনি তা বলতেন না। বিষয়টি তিনি যেভাবে ভেবেছিলেন, সে মোতাবেক ছিলো না; আর এটাই মোদ্দা কথা। ’এহইয়া’ গ্রন্থে প্রাপ্ত বানোয়াট বিবরণ সম্পর্কে তুরতূশী’র অভিযোগ প্রসঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করি, ইমাম গাযযালী (رحمة الله)-ই কি সেগুলো বানিয়েছেন যে তাঁকে এর জন্যে দোষারোপ করা যাবে? সেগুলোর জন্যে তাঁকে দোষারোপ করা নিশ্চিতভাবে অসার উগ্রতা ছাড়া কিছু নয়। এটা এমনই এক বিরুদ্ধাচরণ যা কোনো চিন্তাশীল গবেষক গ্রহণ করবেন না। [নোট-৫]
[নোট-৫: প্রাগুক্ত ‘তাবাক্বা’ত আল-শা’ফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৪৪-, ২৪৯, ২৫২]
ইমাম যাহাবী ইমাম আল-হা’রিস্ আল-মুহা’সেবী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে, যেখানে তিনি ওই ইমামের প্রতি মুহাদ্দীস আবূ যুর’আ’র আরোপিত কুৎসার উদ্ধৃতি দেন, সেখানে তিনি নিজেও কিছু সূফীবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং বিস্ময়ভরে উচ্চারণ করেন:
وأين مثل الحارث، فكيف لو رأى أبو زرعة تصانيف المتأخرين كالقوت لأبي طالب، وأين مثل القوت! كيف لو رأى بهجة الاسرار لابن جهضم، وحقائق التفسير للسلمى لطار لبه.
كيف لو رأى تصانيف أبي حامد الطوسى في ذلك على كثرة ما في الاحياء من الموضوعات.
আল-হা’রিস্ অাল-মুহা’সেবীর মতো লোকেরা কোথায়? কী হতো যদি আবূ যুর’আ হযরত আবূ তালেব (আল-মক্কী)’এর লেখা ‘ক্বূত আল-ক্বুলূব’ বইটির মতো পরবর্তীকালের সূফীদের বইপত্র দেখতে পেতেন? অার ’ক্বূত’ বইটির মতো বইপত্র কোথায়? কী হতো যদি তিনি (আবূ যুর’আ) আবূ জাহদামের ‘বাহজাত আল-আসরা’র’ ও আল-সুলামী’র ‘হাক্বায়েক্ব আল-তাফসীর’ পুস্তকগুলো দেখতে পেতেন? তিনি নিশ্চয় ছাদ পর্যন্ত লাফিয়ে উঠতেন! কী হতো যদি তিনি আবূ হা’মিদ আল-তূসী (ইমাম গাযযালী)’র কিতা’বগুলো দেখতে পেতেন? শায়খ আবদুল ক্বা’দির (আল-জীলা’নী)’এর ‘গুনইয়া’…. (ইবনে অারবীর) ‘ফুসূস আল-হিকাম’ ও ‘ফুতূহাত আল-মক্কীয়া’ দেখতে পেতেন?! [নোট-৬]
[নোট-৬: আল-যাহাবী কৃত ‘মীযা’ন’, ১:৪৩০ #১৬০৬]
ইমা’ম আল-সৈয়ূতী (رحمة الله) তেজোদ্দীপ্তভাবে আল-যাহাবীর প্রতি জবাব দেন:
আল-যাহাবীর মিন মিন যেনো আপনাদের ধোকা না দেয়। কেননা তার মিন মিন ইমাম ফখরুদ্দীন ইবনে আল-খতীব (আল-রা’যী) এবং ওই ইমামের চেয়েও মহান ‘ক্বূত আল-ক্বুলূব’ গ্রন্থপ্রণেতা হযরত আবূ তা’লেব মক্কী (رحمة الله)’র বিরুদ্ধে গিয়েছে; আর তা হযরত আবূ তা’লেব মক্কীর চেয়েও মহান শায়খ আবূল হাসান আল-আশআরী, যাঁর প্রসিদ্ধি আসমান (জমিন) পর্যন্ত ছড়িয়েছে, তাঁরও বিরুদ্ধে গিয়েছে! উপরন্তু, তার লেখা ‘আল-মীযা’ন’, ‘আল-তা’রীখ’ ও ‘সিয়্যার আল-নুবালা’ বইগুলো ওরকম সমালোচনায় পরিপূর্ণ। আপনারা কি উক্ত ইমামবৃন্দের মোকাবেলায় তার কথাকে মানবেন? আল্লাহর শপথ, কখনোই নয়! তাঁদের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণীয় নয়। বরঞ্চ আমাদের ওপর তাঁদের হক্ব/অধিকারকে আমরা সম্মান করি এবং তাঁদের প্রতি তা পরিপূর্ণভাবে আদায়ও করি। [নোট-৭]
[নোট-৭: আল-সৈয়ূতী, ‘ক্বাম’ আল-মু’আরিদ বি-নুসরাত ইবনে আল-ফা’রিদ’ (আল-ফারিদের সত্যতা প্রতিপাদন দ্বারা আপত্তিকারীকে বশীভূতকরণ) যা তাঁরই ‘মাক্বা’মাত’ গ্রন্থে (২:৯১৭-১৮) বিদ্যমান; আল-লাখনৌভীও নিজ ‘আল-রাফ’ ওয়াল-তাকমীল ফীল-জারহ ওয়াল-তা’দীল’ (৩১৯-৩২০ পৃষ্ঠায়) পুস্তকে এটা উদ্ধৃত করেন।]
সূফীদের প্রতি কুৎসা রটনাকারী ইবনে আল-জাওযীও একইভাবে ‘এহইয়া’কে নিজের রচিত নিম্নোল্লিখিত চারটি বইয়ে প্রত্যাখ্যান করেন: ‘এ’লাম আল-আহএয়া’ বি-অাগলা’ত আল-এহইয়া’ (এহইয়া’র ভ্রান্তি সম্পর্কে জীবিতদেরকে অবহিতকরণ), ‘তালবীস-এ-ইবলীস’, ‘আল-ক্বুসসা’স’ [নোট-৮] এবং তার ইতিহাস পুস্তক ‘আল-মুনতাযাম ফী তা’রীখ আল-মুলূক ওয়াল উমাম’ [নোট-৯] ।
[নোট-৮: ইবনে আল-জাওযী, ‘আল-ক্বুসসা’স ওয়াল-মুযাককেরীন’, ২০১ পৃষ্ঠা]
[নোট-৯: ইবনে আল-জাওযী, ‘আল-মুনতাযাম’, ৯:১৬৯]
তার এসব মতামত ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্যদের প্রভাবিত করেছিলো। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি এও ছিলো যে ইমাম গাযযালী (رحمة الله) অত্যধিক পরিমাণ দুর্বল ও ভিত্তিহীন হাদীস ব্যবহার করেছিলেন। আবদুল ফাত্তা’হ আবূ গুদ্দা বলেন:
আমাদের আস্থাশীলতা আল্লাহর প্রতি! ইবনে আল-জাওযী জাল হাদীস-বিষয়ক একটি বিশালাকৃতির গ্রন্থ লেখেন যেনো ফক্বীহ, ধর্মপ্রচারক ও অন্যান্যরা সেগুলো এড়াতে পারেন। অতঃপর আপনারা তাকে নিজের উপদেশমূলক বইপত্রে জাল হাদীস ও প্রত্যাখ্যাত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে আগামাথা ছাড়া, শরমহীনভাবে কিংবা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা ব্যতিরেকেই উদ্ধৃতি দিতে দেখবেন। পরিশেষে প্রত্যেক পাঠক অনুভব করবেন যে ইবনে আল-জাওযী দু জন ব্যক্তি, একজন নন! ….এ কারণেই ইবনে আল-আসীর নিজস্ব ‘আল-কা’মিল’ ইতিহাসগ্রন্থে তাকে দোষারোপ করেন এই বলে:
الْإِمَامِ أَبِي حَامِدٍ مُحَمَّدٍ، وَقَدْ ذَمَّهُ أَبُو الْفَرَجِ بْنُ الْجَوْزِيِّ بِأَشْيَاءَ كَثِيرَةٍ مِنْهَا: رِوَايَتُهُ فِي وَعْظِهِ الْأَحَادِيثِ الَّتِي لَيْسَتْ بِصَحِيحَةٍ، وَالْعَجَبُ أَنَّهُ يَقْدَحُ فِيهِ بِهَذَا، وَتَصَانِيفُهُ هُوَ وَوَعْظُهُ مَحْشُوٌّ بِهِ، مَمْلُوءَةٌ مِنْهُ
ইবনে আল-জাওযী অনেক কিছুর জন্যে ইমাম গাযযালী (رحمة الله)’কে দোষারোপ করেন, যেগুলোর মধ্যে হযরত ইমামের উপদেশে নিহিত অ-সহীহ হাদীসসমূহের বর্ণনা। কী আজব যে ইবনে আল-জাওযী এর জন্যে তাঁর সমালোচনা করতে পেরেছেন! কেননা তার নিজের বইপত্র ও উপদেশমূলক লেখালেখিতেই ওই রকম জাল হাদীস ভরপুর [নোট-১০]!
[নোট-১০: ইবনে আল-আসীর, ‘আল-কা’মিল ফীল-তা’রীখ’ (দা’র সা’দির সংস্করণ, ১০:২২৮; ইলমিয়্যা সংস্করণ ৯:২৪০]
অধিকন্তু, হাদীস-শাস্ত্র বিশারদ আল-সাখাভী (رحمة الله) ‘শরহ আল-আলফিয়্যা’ পুস্তকে বলেন:
حَيْثُ قَالَ فِي تَصْنِيفَيْهِ (الْمَوْضُوعَاتُ وَالْعِلَلُ الْمُتَنَاهِيَةُ)
“ইবনে আল-জাওযী নিজের উপদেশমূলক বইপত্রে প্রচুর পরিমাণে জাল ও অনুরূপ হাদীস উদ্ধৃত করেন।” [নোট-১১]
[নোট-১১: আবদ আল-ফাত্তা’হ আবূ গুদ্দা, ‘আল-লাখনৌভীর আল-রাফ’ ওয়াল-তাকমিল পুস্তকের টীকা’, ৪২০-৪২১ পৃষ্ঠা]
অন্যান্য মধ্যমপন্থী মুহাদ্দীস-ইমাম ‘এহইয়া’ পুস্তকের প্রতিটি হাদীসকে (এসনাদ-সহ) সপ্রমাণ করেছেন, আর এর সামগ্রিক উপকারিতার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলেননি; তাঁরা মুসলমানদের মাঝে বইটির অসীম গুরুত্ব স্বীকার করেছেন এবং এর সৌন্দর্য বর্ধনে ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের সারগ্রন্থ হিসেবে এর প্রচার-প্রসারে অবদান রেখেছেন। এই আলেম-উলামার মধ্যে রয়েছেন:
* ইমাম যাইন আল-দ্বীন আল-এরাক্বী (বেসাল: ৮০৬ হিজরী): ‘এখবা’র আল-আহইয়া’ বি-আখবা’র আল-এহইয়া’, যেটা চার খণ্ডে সমাপ্ত; এতে তিনি ইমাম গাযযালী (رحمة الله) ও তাঁর বইয়ের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন; এটা ছিলো বিশ হতে ত্রিশ বছরের মধ্যবর্তী বয়সী আল-এরাক্বীর কৃত ‘এহইয়া’র বিবরণগুলোর ওপর সর্ববৃহৎ প্রামাণিক দলিল, যা তিনি মধ্যম আকৃতির ‘আল-কাশফ আল-মুবীন ‘আন তাখরীজে এহইয়া’ উলূম আল-দ্বীন’ বইয়ে এবং ক্ষুদ্রাকৃতির ‘অাল মুগনী ‘আন হামল আল-আসফা’র’ পুস্তিকায় সংস্কৃত করেন। [নোট-১২]
[নোট-১২: ‘লাহয আল-আলহা’য বি-দায়ল তাযকিরাত আল-হুফফা’য’ (২২৮ পৃষ্ঠায়) বর্ণিত ইবনে ফাহদের ভাষ্যানুযায়ী; আল-যাহাবীর মূল ‘তাযকিরাত আল-হুফফায’ পুস্তকের পঞ্চম খণ্ড];
* ইমাম এরাক্বী (رحمة الله)’র ছাত্র ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله): ‘আল-এসতেদরা’ক ‘আলা তাখরিজ আহা’দীস আল-এহইয়া’;
* আল-ক্বা’সিম ইবনে ক্বুতলূবাগা’ আল-হানাফী: ‘তোহফাত আল-আহএয়া ফী মা’ ফা’তা মিন তাখরীজ আহা’দীস আল-এহইয়া’;
* সাইয়্যেদ মুরতাদা’ আল-যাবীদী আল-হুসাইনী (বেসাল: ১২০৫ হিজরী): ‘এখতেলা’ফ আল-সা’দাত আল-মুত্তাক্বীন ফী শারহ আসরা’র এহইয়া’ উলূম আল-দ্বীন’; (এখানে উল্লেখিত) প্রত্যেক আলেম তাঁর পূর্ববর্তী আলেমের প্রামাণিক দলিলকে সুসম্পন্ন করেন।
অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, হাদীস-শাস্ত্রবিশেষজ্ঞ উলামাবৃন্দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই শরঈ-বিধান প্রণয়নমূলক বিষয়াদি ভিন্ন অপরাপর বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে যয়ীফ/দুর্বল হাদীসের ব্যবহারকে জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত বিবেচনা করেন; উদাহরণস্বরূপ, উত্তম বিষয়কে উৎসাহদান ও মন্দ বিষয়কে নিরুৎসাহিত করা (আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব), যেমনটি অগণিত মুহাদ্দেসীন ও ইমাম সাফাদী (رحمة الله)’র মতো অন্যান্য উলামা ইঙ্গিত করেছেন ।[নোট-১৩]
[নোট-১৩: দেখুন আল-হা’কিম কৃত ‘আল-মাদখাল লি-ইলম আল-হাদীস (অবতরণিকা); আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘দালা’য়েল আল-নুবুওয়া’ (ভূমিকা); আল-নববী রচিত ‘আল-তিবএয়া’ন ফী আদব হামালাত আল-ক্বুরআন’ (১৭ পৃষ্ঠা); ইমাম নববী বলেন, ‘নেক আমল তথা পুণ্যদায়ক কর্মের অনুশীলনের পক্ষে দুর্বল হাদীস ব্যবহারের বৈধতার ব্যাপারে উলামাবৃন্দ একমত।’ ইমাম সাখাভী উলামাদের এতদসংক্রান্ত সর্বসম্মতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তাঁরই ‘আল-ক্বাওল আল-বদী’ (২৪৫-২৪৬ পৃষ্ঠা) গ্রন্থের উপসংহারে]।
এটা বোঝা উচিত যে ইমাম গাযযালী (رحمة الله) তাঁর নীতি-শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যের জন্যে উপকারী হিসেবে যেসব উপকরণকে বিবেচনা করেছিলেন, সেগুলো তিনি বেছে নিয়েছিলেন সারমর্মের ভিত্তিতেই, বর্ণনার উৎস বা এসনাদ/পরম্পরার ভিত্তিতে নয়; ‘এহইয়া’ পুস্তকের বৃহত্তর অংশ গঠিত হয়েছে ক্বুরঅান, হাদীস ও আল-গাযযালী (رحمة الله) ছাড়া অন্যান্যদের বাণীর উদ্ধৃতি দ্বারা; তাঁর নিজের লেখনী মূল বইয়ের ৩৫%-এর চেয়েও কম অংশ জুড়ে বিরাজমান ।[নোট-১৪]
[নোট-১৪: টি, জে, উইনটার, Ghazali’s “Remembrance of Death” অনুবাদগ্রন্থ, ক্যামব্রিজ ইসলামিক টেক্সট্ সোসাইটি, ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দ) পরিচিতি (xxixn. ৬৩ পৃষ্ঠা)]; আর এই বিশাল সংখ্যক উদ্ধৃত হাদীসের মাঝে তিন-চতুর্থাংশই মূলতঃ সহীহ [নোট-১৫: ইমাম ইবনে সুবকী (رحمة الله)’র দুর্বল, অতি দুর্বল অথবা জাল হাদীসের তালিকায় বিরাজমান এক সহস্রেরও কম বর্ণনা, অথচ ‘এহইয়া’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে চার সহস্রাধিক হাদীস]
হানাফী মুহাদ্দীস ও অগ্রবর্তী অভিধান রচয়িতা মুরতাদা’ আল-যাবীদী (رحمة الله) ‘এহইয়া’র ওপর তাঁর কৃত বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থের সূচনা করেন একটি ব্যাখ্যা দিয়ে, যা’তে তিনি বিবৃত করেন যে ইমাম গাযযালী (رحمة الله) কর্তৃক হাদীসের কথা হুবহু বর্ণনার পরিবর্তে সেটার সাধারণ অর্থ উদ্ধৃত করার পদ্ধতিটি সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)ম ও সালা’ফবৃন্দের আচরিত রীতিরই ওপর ভিত্তিশীল ছিলো। তিনি বলেন: রওয়ায়াত/বিবরণগুলোর হুবহু কথাসমূহ যাচাই করা ইমাম গাযযালী (رحمة الله)’র জন্যে বাধ্যতামূলক ছিলো না। তিনি সাধারণ অর্থ বিবৃত করেছেন বাণীগুলোর বিভিন্ন ইপ্সিত অর্থ ও সেগুলোর পারস্পরিক বিরোধ সম্পর্কে সচেতন হয়েই এবং সেগুলোর মধ্যে যাতে পরস্পরবিরোধী অর্থ সংযোজন না হয় তা এড়িয়েই।
وَرُوِيَ إِجَازَةً التَّحْدِيثُ عَلَى الْمَعْنَى
কিছু সংখ্যক সাহাবা (رضي الله عنه) প্রিয়নবী (ﷺ)’র হুবহু আহাদীস/বাণী (রেওয়া’য়া বিল-আলফা’য)’র পরিবর্তে সেগুলোর অর্থ (রেওয়া’য়া বিল-মা’আনা’) বিবৃত করার পক্ষে অনুমতি দিয়েছেন।
এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছেন: সর্ব-হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু, ইবনে অব্বাস (رضي الله عنه), আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه), আবূদ্ দারদা (رضي الله عنه), ওয়া’সিলা ইবনে আল-আক্বসা (رضي الله عنه) ও আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) ।[নোট-১৫]
[নোট-১৫: আল-খতীব তাঁর ‘আল-জামে’ ফী আখলা’ক্ব আল-রা’ওয়ী’ (২:২৪, ২:২৬-২৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه), আবূদ্ দারদা (رضي الله عنه), আনাস (رضي الله عنه), আয়েশা (رضي الله عنه), আমর ইবনে দীনা’র (رضي الله عنه) আমির আল-শা’বী (رضي الله عنه), ইবরা’হীম আল-নাখাঈ (رضي الله عنه), ইবনে আবী নুজায়হ (رضي الله عنه), আমর ইবনে মুর্রা (رضي الله عنه), জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী (رضي الله عنه), সুফিয়ান ইবনে উবায়না (رضي الله عنه) ও এয়াহইয়া ইবনে সাঈদ অাল-ক্বাত্তা’ন (رضي الله عنه) ওই পন্থায় হাদীস বর্ণনার অনুমতি দিয়েছিলেন। লেখক সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (# ১১১৩), আবূদ্ দারদা (# ১১১৪-১১১৫) ও আনাস (# ১১১৬-১১১৭) হতে এর সপক্ষে উদাহরণ পেশ করেন। তিনি আরো বর্ণনা করেন ইমাম ওয়াকী’ (২:২৪ # ১১১০৮) ও ইমাম মালেক (২:২৫ # ১১১০-১১১১) হতে আহাদীসের মূল শব্দচয়ন ব্যতিরেকে অন্য শব্দচয়নে তা বর্ণনার ওপর নিষেধাজ্ঞার কথাও। আল-খতীব এ বিষয়টির বিস্তারিত প্রামাণ্য দলিল পেশ করেন ‘আল-কেফা’য়া’ গ্রন্থে (২০৩-২১১ পৃষ্ঠা)]
এছাড়াও তাঁদের বৃহত্তর সংখ্যক উত্তরসূরী ওই মত গ্রহণ করেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন: ইমামবৃন্দের ইমাম হযরত হাসান আল-বসরী (رحمة الله), সর্ব-হযরত আল-শা’বী (رضي الله عنه), আমর ইবনে দীনা’র (رضي الله عنه), ইবরাহীম আল-নাখাঈ (رضي الله عنه), মুজাহিদ (رضي الله عنه) ও একরিমা (رضي الله عنه) প্রমুখ…..ইবনে সীরীন (رضي الله عنه) বলেন, “আমি দশজন পৃথক পৃথক ব্যক্তি হতে কোনো একটি হাদীস শুনতাম, যার অর্থ একই কিন্তু শব্দচয়ন একে অপর থেকে ভিন্ন” ।[নোট-১৬]
[নোট-১৬: আবূল আহওয়াস্ মুহাম্মদ ইবনে আল-হায়তাম হতে আল-খতীব কর্তৃক ‘আল-জামে’ লি-আখলাক্ব আল-রা’ওয়ী’ (২:২১ # ১০৯৯) গ্রন্থেও উদ্ধৃত]
অনুরূপভাবে, সাহাবাবৃন্দের (رضي الله عنه)ম মধ্যেও মহানবী (ﷺ)’র হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে শব্দচয়নের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তাঁদের কেউ কেউ পুরোটুকু বিবরণ হুবহু উদ্ধৃত করেছেন; কেউ কেউ শুধু সারমর্ম বর্ণনা করেছেন; অপরাপর সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنه) সংস্কৃত অংশ পেশ করেছেন; অন্যরা আবার নির্দিষ্ট কিছু শব্দের সমার্থক শব্দ দ্বারা পরিবর্তন সাধন করেছেন এই বিবেচনায় যে মূল অর্থের বিকৃতি এতে সাধিত হবে না। তাঁদের কেউই মিথ্যে আরোপকে উদ্দেশ্য করেননি, বরঞ্চ সত্যবাদিতাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন; আর তাঁরা বর্ণনা করেছেন যা শুনেছিলেন। সে কারণেই তাঁদের তা করার অবকাশ ছিলো। তাঁরা বলতেন:
إِنَّمَا الْكَذِبُ عَلَى مَنْ تَعَمَّدَهُ
“অসত্য বিবরণ প্রদান তখন-ই হবে, যখন কেউ ইচ্ছাকৃকভাবে মিথ্যেকে উদ্দেশ্য করে” ।[নোট-১৭]
[নোট-১৭: দেখুন আল-খতীব, ‘আল-কেফা’য়া’, ১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩৯-২৪৭ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ২০৪-২১১ পৃষ্ঠা]
ইমরা’ন ইবনে মুসলিম (আল-ক্বাসীর) বর্ণনা করেন যে জনৈক ব্যক্তি ইমাম হাসান আল-বসরী (رحمة الله)’কে বলেন:
قِيلَ لِلْحَسَنِ: يَا أَبَا سَعِيدٍ , إِنَّكَ تُحَدِّثُنَا بِالْحَدِيثِ الْيَوْمَ وَتُحَدِّثُ مِنَ الْغَدِ بِكَلَامٍ آخَرَ؟ فَقَالَ: «لَا بَأْسَ بِالْحَدِيثِ إِذَا أَصَبْتُ الْمَعْنَى
“হে আবূ সাঈদ! আপনি যখন কোনো হাদীস বর্ণনা করেন, তখন আমাদের কারো দ্বারা ওই হাদীস বর্ণনার চেয়ে আপনি আরো শ্রেয়তর ও প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত করেন।” তিনি উত্তরে বলেন: “তাতে কোনো ক্ষতি নেই যতোক্ষণ না তুমি তার অর্থ পুরোপুরি ব্যক্ত করেছো” ।[নোট-১৮]
[নোট-১৮: আল-খতীব কর্তৃক ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৪৩ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ ২০৭ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে ও ‘আল-জামে’ (২:২২ #১১০১-১১০২) পুস্তকে বর্ণিত। তুলনা করুন আল-শাফেঈ (رحمة الله)’র পুস্তক ‘আল-রেসা’লা’ (২৭৫ পৃষ্ঠা) যা’তে আল-হাসান বসরী (رحمة الله) বা আল-যুহরী’র নামের উল্লেখ নেই]
আল-নাদর ইবনে শুমায়ল (বেসাল: ২০৮ হিজরী) বলেন: “হুশায়ম (বেসাল: ১৮৩ হিজরী) অারবীতে অনেক ভুল করতেন, তাই আমি তাঁর করা বর্ণনাগুলোকে তোমাদের জন্যে সুন্দর বস্ত্রাবৃত করেছি” – এ কথার অর্থ হলো, তিনি সেগুলোকে উন্নত আরবী ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন, কেননা নাদর ছিলেন একজন ‘নাহউয়ী’ তথা ভাষাতত্ত্ববিদ ।[নোট-১৯]
[নোট-১৯: ইসমাঈল ইবনে উমাইয়া বলেন: “আমরা (উমর (رضي الله عنه)’র মুক্ত করা গোলাম) না’ফীর ভাষাগত ভুল শুধরে দিতাম, যখনই তিনি (বর্ণনাগুলোতে) তা সংঘটন করতেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলতেন, ‘এটা আমি হুবহু যা শুনেছিলাম, তা ছাড়া কিছু নয়’।” আল-যাহাবীও ‘সিয়্যার’ পুস্তকে এর উদ্ধৃতি দেন (৫:৫৬৭)]
হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله) বলতেন: “তোমরা যখন হাদীসের শব্দের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন করতে কাউকে দেখতে পাও, তখন জানবে যে ওই লোক নিজের প্রদর্শনী দিচ্ছে।” তিনি বর্ণনা করেন যে একবার এক ব্যক্তি হযরত এয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-ক্বাত্তা’ন (বেসাল: ১৯৮ হিজরী)’কে একটি হাদীসের কোনো এক নির্দিষ্ট শব্দের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে। এয়াহইয়া তাকে বলেন: “এয়া ফুলা’ন! সারা পৃথিবীতে আল্লাহর কিতা’বের মতো শ্রেষ্ঠ আর কোনো কিছু নেই, অথচ তিনি সাতটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানিক বাচনে এর (পঠনের) অনুমতি দিয়েছেন। অতএব, অতোটা কঠোর হয়ো না” [নোট-২০]!
[নোট-২০: মিলিয়ে দেখুন আল-শাফেঈ, ‘আল-রেসা’লা’, (২৭৪ পৃষ্ঠা)]
হাদীস-শাস্ত্রবিশারদ আল-সৈয়ূতী (رحمة الله)-এর ব্যাখ্যা
হাদীস-শাস্ত্রবিশারদ আল-সৈয়ূতী (رحمة الله) তাঁর কৃত (ইমাম নববী’র) ‘আল-তাক্বরীব’ গ্রন্থের ব্যাখ্যামূলক পুস্তকের ৪র্থ খণ্ডের ২৬তম শিরোনামে [নোট-২১]
[নোট-২১: আল-সৈয়ূতী, ‘তাদরীব আল-রা‘ওয়ী ফী শারহ তাক্বরীব আল-নববী (১:৫৩২-৫৩৯)]
যা বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:
إِنْ لَمْ يَكُنِ الرَّاوِي عَالِمًا بِالْأَلْفَاظِ) وَمَدْلُولَاتِهَا (وَمَقَاصِدِهَا خَبِيرًا بِمَا يُحِيلُ مَعَانِيَهَا) بَصِيرًا بِمَقَادِيرِ التَّفَاوُتِ بَيْنَهُمَا، (لَمْ تَجُزْ لَهُ الرِّوَايَةُ) لِمَا سَمِعَهُ (بِالْمَعْنَى
কোনো বর্ণনাকারী (হাদীসের) শব্দের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ না হলে এবং শব্দের অর্থ অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হলে স্রেফ অর্থের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন, তা বর্ণনা করার কোনো অনুমতি তার নেই।
এ বিষয়ে (উলামাদের মাঝে) কোনো মতপার্থক্য নেই। তাকে অবশ্যই তিনি যা শুনেছেন হুবহু তা-ই (শাব্দিকভাবে) বর্ণনা করতে হবে। তিনি যদি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন, (মতান্তর বিদ্যমান) তাহলে হাদীস, ফেক্বাহ ও উসূল-শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের একটি বড় দল অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে হুবহু শব্দচয়ন ছাড়া অন্য কোনোভাবে হাদীস বর্ণনার অনুমতি তার নেই। এই মত ব্যক্ত করেন ইবনে সীরীন, তা’লাব ও হানাফী পণ্ডিত আবূ বকর রা’যী [নোট-২২]।
[নোট-২২: মিলিয়ে দেখুন আল-খতীব কৃত ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ ২৪২ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ ২০৭ পৃষ্ঠা); তিনি তাতে আরো উল্লেখ করেন ইবরা’হীম ইবনে মায়সারা, আল-ক্বাসেম ইবনে মুহাম্মদ, রাজা ইবনে হায়এয়া ও ইবনে তাউসের নাম]
হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-ও এই মত পোষণ করেন।
{তাবেঈ উবায়দ ইবনে উমাইর আল-মারওয়াযী একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه)’এর উপস্থিতিতে মদীনাবাসীদের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে মহানবী (ﷺ) এরশাদ করেছেন:
قَالَ: مَثَلُ الْمُنَافِقِ كَشَاةٍ بَيْنِ رَبِيضَيْنِ إِذَا أَتَتْ هَؤُلاَءِ نَطَحْنَهَا ، وَإِذَا أَتَتْ هَؤُلاَءِ نَطَحْنَهَا . فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ : لَيْسَ كَذَلِكَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، إِنَّمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : كَشَاةٍ بَيْنَ غَنَمَيْنِ قَالَ : فَاحْتَفَظَ الشَّيْخُ وَغَضِبَ ، فَلَمَّا رَأَى ذَلِكَ عَبْدُ اللهِ قَالَ : أَمَا إِنِّي لَوْ لَمْ أَسْمَعْهُ لَمْ أَرُدَّ ذَلِكَ عَلَيْكَ.
“মোনাফেক্বের উপমা হলো দুটো ভেড়ার খোঁয়াড়ের (রাবীদাইন) মধ্যখানে একটা ভেড়ার মতো; যখন সেটা একটা খোঁয়াড়ে যায়, ওই ভেড়ার দল ঢুঁ মারে (মানে তাড়িয়ে দেয়); আবার যখন সেটা অপর খোঁয়াড়ে যায়, সেখানেও ভেড়ার দল ঢুঁ মারে (তাড়িয়ে দেয়)।” হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বাধা দিয়ে বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ কথা বলেননি। তিনি যা বলেছিলেন তা হলো, ‘দুটো ভেড়ার পালের (গানামাইন) মাঝখানে একটা ভেড়ার মতো।’ শায়খ (মারওয়াযী) এতে রাগান্বিত বোধ করেন। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) তা দেখে অতঃপর বলেন, “নিশ্চয় আমি যদি তা না শুনতাম, তাহলে তুমি যা বলেছো তা শুধরে দিতাম না।” [নোট-২৩]
[নোট-২৩: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) বর্ণিত]
ইমাম মুহাম্মদ আল-বাক্বের (رحمة الله) হতে বর্ণিত আরেকটি ভাষ্যে এসেছে যে উবায়দ ইবনে উমাইর আল-মারওয়াযী বলেছিলেন,
“দুটো ভেড়ার পালের (গানামাইন) মাঝখানে একটা ভেড়া,” আর হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বাধা দিয়ে বলেন যে সঠিক বিবরণটি ছিলো “দুটো ভেড়ার খোঁয়াড়ের (রাবীদাইন) মাঝখানে একটা ভেড়া।” আবদুল্লাহ ইবনে সাফওয়া’ন যখন হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)’কে জানান যে দুটো বাক্য একই অর্থবোধক, তখন তিনি উত্তর দেন, “আমি এটাই শুনেছিলাম।” তৃতীয় আরেকটি ভাষ্যে তাঁর আরো কিছু কথা যুক্ত হয়: “আফসোস তোমার জন্যে! রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর ব্যাপারে মিথ্যে বোলো না!” এই তিনটি সংস্করণ-ই সহীহ সনদে ইমাম আহমদ (رحمة الله)’এর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও ‘সালাফ’ (পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মাবৃন্দ) ও ‘খালাফ’ (তৎপরবর্তী পুণ্যাত্মাবৃন্দ)’এর বিভিন্ন দল, যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন (চার মাযহাবের) চার ইমামমণ্ডলীও, তাঁদের একচেটিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্ণনাসমূহের অর্থগত বিষয়ে উপরোল্লিখিত সকল ক্ষেত্রকেই অনুমতি দেন, শুধু শর্ত এই যে প্রত্যেককে বর্ণনার (হুবহু) অর্থ তুলে ধরতে হবে । [নোট-২৪]
[নোট-২৪: আল-সৈয়ূতী লিখিত ‘তাদরীব আল-রা’উয়ী’ (১:৫৩২-৫৩৩, মিলিয়ে দেখুন ‘তাক্বরীব’, ৭৭-৭৮ পৃষ্ঠা); আল-নববী নিজ ‘তাক্বরীব’ পুস্তকে বলেন: “এটা হাদীস সংকলন (মুসান্নাফা’ত) ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোনো হাদীস সংকলনের পরিবর্তন অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, এমন কী তা একই অর্থের হলেও। অধিকন্তু, যে ব্যক্তি অর্থের দিক থেকে বর্ণনা পেশ করেন, তাঁর জন্যে বর্ণনার শেষে অত্যাবশ্যক হবে এ কথা বলা: ‘অথবা অনুরূপ কোনো কথা’ (أو كما قال، أو نحوه، أو شبهه) কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো অভিব্যক্তি।” ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله) প্রামাণ্য দলিল পেশ করেন যে এর অনুশীলন করতেন সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه), আবূদ্ দারদা (رضي الله عنه) ও আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه)। এই ব্যাপারে অতিরিক্ত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করেন ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) তাঁর ‘অাল-’এলাল আল-কবীর’ পুস্তকে এবং ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (رحمة الله) কৃত উক্ত পুস্তকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শারহ ‘এলাল অাল-তিরমিযী (১:১৪৫-১৫২); আল-খতীব আপন ‘অাল-কেফা’য়া’ কিতাবে (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩২-২৪৭ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ১৯৮-২১১ পৃষ্ঠা) এবং ইমাম কাজী আয়ায (رحمة الله) তাঁর ‘আল-’এলমা’ (১৭৪-১৭৮ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে। এছাড়াও দেখুন ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله)’এর এতদসংক্রান্ত আলোচনা এবং তার ওপর মোল্লা আলী ক্বা’রীর ব্যাখ্যামূলক ’শরহু শরহে নুখবাত আল-ফিকার’ কিতা’বটি (৪৯৭-৫০২ পৃষ্ঠা)]
এই প্রয়োগ পদ্ধতি সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)ম ও সালাফ-মণ্ডলীর (رحمة الله)ম আচরিত রীতির মাঝে প্রত্যক্ষ করা হয়েছিলো, যা তাঁদের দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট একটি বর্ণনার বিভিন্ন বাক্যবিন্যাসে প্রদর্শিত হয়েছিলো।
প্রিয়নবী (ﷺ)’এর এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস বিরাজমান, যা আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইমা’ন ইবনে আকতাম [নোট-২৫]} হতে বর্ণনা করেছেন
[নোট-২৫: আল-যাবীদী’র লিপিতে এটা একটা ভুল বানান] আল-লায়সী {অাবদুল্লা’হ ইবনে সুলাইম ইবনে উকায়মা[নোট-২৭: ইমাম ইবনে হাজরের ‘আল-এসা’বা’ ও ‘তা’জীল আল-মানফা’আ’ গ্রন্থ দুটোতে যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে, আল-হুসাইনী ‘আল-একমাল’ (৫৬৫ পৃষ্ঠা #১২১১) পুস্তকে ভুল করেছিলেন যখনই তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله)’এর ‘মুসনাদ’ কিতাবে উদ্ধৃত ইবনে উকায়মা’কে আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম ইবনে উকায়মা হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন; কেননা ‘সুনান’, ‘মুওয়াত্তা’ ও ইমাম আহমদ (رحمة الله)’এর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত ইবনে উকায়মা’কে ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) নিজ ‘সুনান’ গ্রন্থে এবং অন্যান্য পণ্ডিতবৃন্দ উমারা অথবা ‘আম্মার ইবনে উকায়মা আল-লায়সী বলে চিহ্নিত করেন। উপরন্তু, তাঁকে ইমাম মুসলিম নিজ ‘সহীহ’ গ্রন্থে (৩:১৫৬৬), ইবনে হিব্বা’ন (৫:১৫৮, ১৩:২৩৮-২৩৯), আবূ এয়া’লা আপন ‘মুসনাদ’ বইয়ে (১২:৩৪৮) এবং ইবনে ‘আবদিল বার্র ’আল-তামহীদ’ কিতাবে (১৭:২৩৭) ’আমর ইবনে মুসলিম ইবনে আম্মা’র ইবনে উকায়মা আল-লায়সী বলে চিহ্নিত করেন। তাঁরা সবাই একমত হন যে তিনি কোনো সাহাবী ছিলেন না, বরঞ্চ উত্তরসূরী ছিলেন, যিনি সর্ব-হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) ও সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه) উভয়ের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছিলেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম (-য়ান) ইবনে উকায়মা যিনি আল-তাবারা’নী (رحمة الله)’র কাছ থেকে বর্ণনা করেছিলেন, তিনি এক অপরিচিত জন]
ইবনে মানদাহ নিজ ‘মা’রেফাত আল-সাহা’বা’ পুস্তকে এবং ইমাম তাবারা’নী আপন ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে, যিনি বলেন:
قَالَ: أَتَيْنَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْنَا لَهُ: بِآبَائِنَا أَنْتَ وَأُمَّهَاتِنَا يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّا نَسْمَعُ مِنْكَ الْحَدِيثَ , فَلَا نَقْدِرُ أَنْ نُؤَدِّيَهُ كَمَا سَمِعْنَاهُ؟ فَقَالَ: «إِذَا لَمْ تُحِلُّوا حَرَامًا، وَلَمْ تُحَرِّمُوا حَلَالًا، وَأَصَبْتُمُ الْمَعْنَى , فَلَا بَأْسَ
আমি আরয করলাম, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! নিশ্চয় আমি যখন আপনার কাছ থেকে কোনো হাদীস শুনি, তখন তা যেভাবে আপনার কাছে শুনেছিলাম সেভাবে আবার বর্ণনা করতে পারি না।” অর্থাৎ, তিনি তাতে সংযোজন বা বিয়োজন করেন। প্রিয়নবী (ﷺ) উত্তর দেন: “যতোক্ষণ তুমি হারাম/অবৈধকে হালাল/বৈধ না করো, বা হালালকে হারাম সাব্যস্ত না করো, আর যতোক্ষণ এর অর্থকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করো, ততোক্ষণ এতে কোনো ক্ষতি নেই” ।[নোট-২৬]
[নোট-২৬: আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইমা’ন ইবনে উকায়মা হতে ইমাম তাবারা’নী তাঁর ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে (৭:১০০ #৬৪৯১, ১১৭) এবং ইবনে ক্বা’নী (ইন্তেক্বাল: ৩৫১ হিজরী) নিজ ‘মু’জাম আল-সাহা’বা’ বইয়ে (৩:১৭) বর্ণিত; উভয়ের সনদেই দু জন অপরিচিত বর্ণনাকারী আছেন – এয়া’ক্বূব ইবনে অাবদিল্লাহ ইবনে সুলাইম (-য়ান) ইবনে উকায়মা ও তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম (-য়ান), যেমনটি বিবৃত করেছেন আল-হায়তামী (১:১৫৪); মিলিয়ে দেখুন আল-সাখাভী কৃত ‘ফাতহুল মুগীস’ (৩:১৪৫)। ইমাম জু’রাক্বা’নী (ইন্তেক্বাল: ৫৪৩ হিজরী)-ও নিজ ‘আল-আবা’তীল’ পুস্তকে (১:৯০-৯৭) এটা বর্ণনা করেছেন, যা’তে তিনি বলেন: “এই হাদীস বা’তেল, আর এর সনদের মধ্যে এদতেরা’ব তথা বিভ্রান্তি বিদ্যমান।” তথাপিও আল-খতীব তাঁর ‘আল-কেফা’য়া’ গ্রন্থে (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩৪ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ১৯৮ পৃষ্ঠা) অর্থগতভাবে হাদীস বর্ণনার অনুমতি প্রসঙ্গে দুটি অনুরূপ এসনাদ দ্বারা এটা পেশ করেছেন; এর পাশাপাশি মোল্লা আলী ক্বারীও ‘শরহ শরহে নুখবাত আল-ফিকার’ (৪৯৮ পৃষ্ঠা) কিতাবে তা উপস্থাপন করেন। হযরত সালামা ইবনে অাল-আকওয়া হতেও এটা বর্ণনা করেন ইবনে আসাকির (رحمة الله), যেমনটি বিবৃত করেন ইবনে হামজা আল-হুসাইনী নিজ ‘আল-বয়া’ন ওয়াল-তা’রিফ’ পুস্তকে (২:৭৭-৭৮)। ইবনে হাজর (رحمة الله) এটা বর্ণনা করেন ‘আল-এসা’বা গ্রন্থে (৩:১৬৬ #৩৪৩৬, ৬:৩৪১ #৮৫৩২) এবং বলেন: “ইবনুল জাওযী এটাকে জাল হাদীসগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এর জন্যে আল-ওয়ালীদ ইবনে সালামা’কে দোষারোপ করেন; কিন্তু তিনি যে দাবি করেছিলেন, বিষয়টি তা নয়। কেননা ইবনে মানদাহ এটা বর্ণনা করেন (’মা’রেফাত আল-সাহা’বা’ পুস্তকে) আরেকটি এসনাদে, যা বর্ণনা করেছেন উমর ইবনে ইবরাহীম, তিনি মুহাম্মদ ইবনে এসহা’ক্ব ইবনে উকায়মা হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর পিতামহ হতে – এই জাতীয় বাক্যের সমর্থন দিয়ে। তবে উমর হলেন আল-ওয়ালীদেরই সমসাময়িক। ইবনে মানদাহ এটা আরেকটা সনদে উমর ইবনে ইবরাহীম হতে বর্ণনা করেন এবং বলেন: ‘মুহাম্মদ ইবনে এসহাক্ব ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে সুলাইম হতে বর্ণিত।’ তিনি তাঁর বংশে আবদুল্লাহ’কে যোগ করেন। অতঃপর তিনি আবদুল্লাহ’র নামে এই এসনাদ-টি বর্ণনা করেন।এটা আবূল ক্বা’সেম ইবনে মানদাহ-ও বর্ণনা করেন তাঁর ‘আল-ওয়াসিয়্যা’ পুস্তকে, যা দুটি এসনাদে ফেরত গিয়েছে আল-ওয়ালীদ ইবনে সালামা পর্যন্ত; তিনি এসহাক্ব ইবনে এয়াক্বূব ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে উকায়মা হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর পিতামহ হতে।’ অন্যান্য অসঙ্গতিও এতে বিরাজমান….আবূ মূসা ‘আল-দায়ল’ পুস্তকে এবং ইবনে মারদূএয়াহ-ও ‘কিতা’ব আল-এলম’ গ্রন্থে আবদা’ন আল-মারওয়াযী হতে এটা বর্ণনা করেছেন…আমার বিশ্বাস কিছু অদল-বদল সাধিত হয়েছে এবং সঠিক এসনাদ হলো: মুহাম্মদ ইবনে এসহা’ক্ব, হতে অাবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম ইবনে উকায়মা, হতে তাঁর পিতা, হতে তাঁর পিতামহ।” ‘তা’জিল আল-মানফা’আ’ (৫৩১ পৃষ্ঠা #১৪৪০) কিতাবে ইবনে হাজর (رحمة الله) ইবনে মানদাহ’র এসনাদকে ওয়া’হিয়্যা তথা হাল্কা বা নড়বড়ে ঘোষণা করেন। ফলে তিনি এই হাদীসকে যয়ীফ/দুর্বল বিবেচনা করেন, কিন্তু জাল নয়। এর মূলপাঠ মহানবী (ﷺ)’র অন্য দুটি হাদীস দ্বারা তুলে ধরেন আল-খতীব, যার প্রথমটি ঘোষণা করে: “যতোক্ষণ কেউ অর্থ (যথাযথভাবে) প্রকাশ করে থাকে, ততোক্ষণ যেনো সে বর্ণনা করে।” দ্বিতীয় হাদীসটি ফরমায়: “আমি নিষেধ করিনি তা (মানে হুবহু বর্ণনা), বরং স্রেফ এই কারণে (করেছি) যে কেউ আমি যা বলিনি তা আমি বলেছি মর্মে মিথ্যে দাবি করে বসে, আর তার উদ্দেশ্য হয় আমাকে শরমিন্দায় ফেলা এবং ইসলামকে খাটো করা, বা আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করে ইসলামকে শরম দেয়া।” এটা যথাক্রমে বর্ণিত হয়েছে হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) ও অজ্ঞাতনামা এক সাহাবী হতে আল-খতীব কৃত ‘আল-কেফা’য়া’ বইয়ে (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩৪-২৩৫ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ১৯৮ পৃষ্ঠা)। হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত: “মহানবী (ﷺ)’কে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যিনি বাক্যের বিন্যাস পরিবর্তন করেন (হাদীসের বর্ণনাকালে)। হুযূর করীম (ﷺ) উত্তর দেন: ‘যতোক্ষণ সে অর্খ তুলে ধরতে সক্ষম, ততোক্ষণ এতে কোনো ক্ষতি নেই’।” এটা আল-হাকিম আল-তিরমিযী (رحمة الله) তাঁর ‘নওয়া’দির আল-উসূল’ পুস্তকে উদ্ধৃত করেন (৩৮৯ পৃষ্ঠা)। অতএব, সহীহ অাল-বুখারী (কিতাবুল এলম) গ্রন্থে উদ্ধৃত হযরত সালামা ইবনে আল-আকওয়া (رضي الله عنه) কর্তৃক ব্যাপকভাবে বর্ণিত (মোতাওয়াতের) হাদীস – “আমি যা বলিনি তা যে ব্যক্তি উচ্চারণ করে, সে যেনো জাহান্নামের আগুনে বসতির জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়” মর্মে সতর্কবাণীটিকে অবশ্যঅবশ্য অন্যান্য ওই সব (ওপরে উদ্ধৃত) হাদীসের আলোকে উপলব্ধি করতে হবে। এটা আল-যাবীদী বর্ণিত সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের বক্তব্য এবং আল-হাকিম আত্ তিরমিযী কৃত ‘নওয়া’দির আল-উসূল’ পুস্তকে (৩৮৯-৩৯০ পৃষ্ঠা, আসল #২৬৮) ব্যক্ত সালাফবৃন্দের আচরিত প্রথা দ্বারা সমর্থিত; যেমনটি পুরোপিুরিভাবে উদ্ধৃত হয়েছে আল-ক্বা’সেমী’র রচিত ‘ক্বাওয়াইদ আল-তাহদীস’ (২২৩-২২৪ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে। আর আল্লাহতা’লাই সবচেয়ে ভালো জানেন]
এই ব্যাপারে যখন ইমাম আল-হাসান (رضي الله عنه)’এর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি বলেন: “এটা যদি না হতো, তাহলে আমরা কোনো কিছুই বর্ণনা করতাম না” ।[নোট-২৭]
[নোট-২৭: আল-খতীব প্রণীত ‘আল-জামে’ (২:২১-২২ #১১০০) ও ‘আল-কেফা’য়া’ (মদীনা সংস্করণ, ২০৭ পৃষ্ঠা]।
ইমাম শাফেঈ [নোট-২৮]এই বিষয়ের পক্ষে নিজ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন নিম্নোক্ত হাদীসখানা:
إِنَّ القُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ
“ক্বুরআন মজীদ প্রকাশিত হয়েছে সাতটি স্থানিক বাচনে” ।[নোট-২৯]
[নোট-২৮: ‘আল-রেসা’লা’, ২৭৪ পৃষ্ঠা]
[নোট-২৯: সর্ব-হযরত উমর (رضي الله عنه) ও ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আল-বুখারী (رحمة الله), মুসলিম (رحمة الله) ও আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله); এছাড়াও ‘সুনান’ পুস্তকে হযরত উবাই ইবনে কা’আব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত]
আল-বায়হাক্বী (رحمة الله) বর্ণনা করেন মাখূল হতে, যিনি বলেন যে তিনি ও আবূ আল-আযহার দেখা করতে গিয়েছিলেন হযরত ওয়া’সিলা ইবনে আল-আসক্বা (رضي الله عنه)’র সাথে; তাঁকে তাঁরা বলেন:
قَالَ دَخَلْنَا عَلَى وَاثِلَةَ بْنِ الْأَسْقَعِ فَقُلْنَا: يَا أَبَا الْأَسْقَعِ , حَدِّثْنَا حَدِيثًا سَمِعْتَهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَّ , لَيْسَ فِيهِ وَهْمٌ وَلَا نِسْيَانٌ , فَقَالَ , هَلْ قَرَأَ أَحَدٌ مِنْكُمُ اللَّيْلَةَ مِنَ الْقُرْآنِ شَيْئًا؟ قَالُوا: نَعَمْ , قَالَ: فَهَلْ زِدْتُمْ أَلِفًا أَوْ وَاوًا أَوْ شَيْئًا؟ فَقُلْتُ: إِنَّا لَنَزِيدُ وَنَنْقُصُ , وَمَا نَحْنُ بِأُولَئِكَ فِي الْحِفْظِ؟ فَقَالَ: فَهَذَا الْقُرْآنُ بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ وَأَنْتُمْ تَدْرُسُونَهُ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ , فَكَيْفَ وَنَحْنُ نُحَدِّثُ بِحَدِيثٍ سَمِعْنَاهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَّ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ , إِذَا حَدَّثْتُكُمْ عَلَى مَعْنَاهُ فَحَسْبُكُمْ “
“মহানবী (ﷺ)’র এমন একটি হাদীস আমাদের কাছে বর্ণনা করুন যার মধ্যে নেই কোনো বিয়োজন, সংযোজন ও বিস্মৃত অংশ।” তিনি উত্তর দেন: “তোমাদের কেউ কি ক্বুরআন মজীদ হতে কোনো কিছু তেলাওয়াত করেছো?” তাঁরা বলেন: “জি, কিন্তু আমরা তা খুব ভালোভাবে হেফয্ তথা মুখস্থ করিনি। আমরা কখনো কখনো ‘এবং’ অথবা ‘আলিফ’ অক্ষরটি যোগ করি, কিংবা কোনো কিছু বিয়োজন করে ফেলি।” তিনি উত্তরে বলেন: “তোমরা যদি তোমাদের সামনে লিপিবদ্ধ ক্বুরআন-ই মুখস্থ করতে না পারো, আর তাতে সংযোজন বা বিয়োজন করে থাকো, তাহলে মহানবী (ﷺ) হতে আমাদের শ্রুত আহাদীসের বেলায় কী হতে পারে, যার কোনো কোনোটি আবার স্রেফ একবার শুনেছিলাম? অতএব, আমরা যখনই সেগুলো তোমাদের কাছে বর্ণনা করি, তখন সেগুলোর সাধারণ অর্থ গ্রহণেই তোমরা সন্তুষ্ট থেকো” ![নোট-৩০]
[নোট-৩০: আল-খতীব কর্তৃক ‘আল-জামে’ (২:২০-২১ #১০৯৮) ও ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ ২৩৯ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ ২০৪ পৃষ্ঠা) গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত; তিনি ক্বুতায়বা (رضي الله عنه) হতেও অনুরূপ কিছু বর্ণনা করেছেন। হা’কিম তিরমিযী’র কৃত ‘নওয়া’দিরুল উসূল’ (৩৮৯ পৃষ্ঠা) সংস্করণে মাখূল জিজ্ঞেস করেন: “আপনাদের কেউ কি রাতে দীর্ঘ নামাযে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন?”]
ইমাম বায়হাক্বী ‘আল-মাদখাল’ পুস্তকে হযরত জা’বের ইবনে আবদিল্লাহ (رضي الله عنه) হতেও অনুরূপ কিছু বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “হুযায়ফা (رضي الله عنه) আমাদের বলেন, ‘আমরা হলাম বেদুঈন আরব; আমরা যথাযথ ক্রম ব্যতিরেকেই কোনো বাণী উদ্ধৃত করতে পারি’।” আল-বায়হাক্বী আরো বর্ণনা করেন শু’য়াইব ইবনে আল-হাজ্জা’ব হতে, যিনি বলেন: আমি আবদানকে সাথে নিয়ে ইমাম আল-হাসান (رضي الله عنه)’এর সাথে দেখা করতে যাই। আমরা তাঁকে বলি:
يَا أَبَا سَعِيدٍ الرَّجُلُ , يُحَدِّثُ بِالْحَدِيثِ فَلَا يُحَدِّثُهُ كَمَا سَمِعَهُ يَزِيدُ فِيهِ وَيَنْقُصُ , فَقَالَ الْحَسَنُ: «إِنَّمَا الْكَذِبُ عَلَى مَنْ تَعَمَّدَهُ»
‘হে আবূ সাঈদ! কেউ হয়তো এমন কোনো হাদীস বর্ণনা করতে পারেন, যার মধ্যে তিনি কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করেছেন।’ তিনি উত্তর দেন: ‘মিথ্যে হলো যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এটাকে উদ্দেশ্য করে’” ।[নোট-৩১] {তিনি এ ছাড়াও অনুরূপ কিছু বর্ণনা গ্রহণ করেন হতে ইবরাহীম আল-নাখাঈ [নোট-৩২], আল-শা’বী [নোট-৩৩], আল-যুহরী [নোট-৩৪], সুফিয়া’ন [নোট-৩৫], আমর ইবনে দীনা’র [নোট-৩৬]এবং ওয়াকী [নোট-৩৭]}। [নোট-৩৮]
[নোট-৩১: আল-খতীব প্রণীত ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৪৪ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ২০৮ পৃষ্ঠা]
[নোট-৩২: দেখুন নোট-১৫]
[নোট-৩৩: দেখুন নোট-১৫]
[নোট-৩৪: আল-খতীব, ‘আল-জামে’, ২:২২ #১১০৩]
[নোট-৩৫: আল-খতীব, ‘আল-জামে’, ২:২৩ #১১০৪-১১০৬]
[নোট-৩৬: দেখুন নোট-১৬]
মুহাদ্দেসীন উলামাবৃন্দ ‘অর্থের ভিত্তিতে বর্ণনা’ গ্রহণের ব্যাপারে সর্বসম্মতি পোষণ করেন, তবে শর্ত স্রেফ এই যে আরবীতে বর্ণনাকারীর দক্ষতা থাকতে হবে এবং অন্যান্য শর্তের মাঝে এ-ও শর্ত থাকবে যে
فإنهم يشترطون في الحديث الصحيح والحسن انتفاء الشذوذ والعلة منه
তাঁর বিবরণে যেনো কোনো বিচ্যুতি কিংবা শুযূয/ভুলভ্রান্তি না থাকে ।[নোট-৩৯] প্রিয়নবী (ﷺ)’র আহাদীস/বাণী হুবহু বর্ণনার পরিবর্তে সেগুলোর অর্থগত বর্ণনা জায়েয/বৈধ মর্মে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-উলামার মতামতকে সপ্রমাণকারী আল-যাবীদীর মতো একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন ইবনে আল-সালাহ-ও নিজ ‘মুক্বাদ্দামা’ গ্রন্থে; তবে তিনি তা ফিরিয়ে নেন এই কারণে যে এ প্রয়োগ-পদ্ধতি আর বর্তমান সময়ে প্রযোজ্য নয়,
فِيمَا تَضَمَّنَتْهُ بُطُونُ الْكُتُبِ
কেননা সমস্ত হাদীস-ই এখন বইপত্রে পাওয়া যাচ্ছে ।[নোট-৪০] শায়খ নূর আল-দ্বীন ’এতর শেষোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে বলেন:
وشرطُهُ أَنْ يقعَ التَّصريحُ بالسَّماعِ في مَوْضِعِ الزِّيادةِ، وإِلاَّ؛ فمتى كانَ مُعَنْعَناً – مثلاً -؛ ترجَّحَتِ الزِّيادةُ.
ليس مقصورًا على نقل اللفظ، بل النقل بالمعنى من غير تغيير، أداء كما سمع، فإنه أدى المعنى كما سمع لفظه، وفهمه منه نظيره أن الشاهد والمترجم إذا أدى المعنى من غير زيادة ولا نقصان،
“এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, স্রেফ অর্থের ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনাকে (আজকে) নিষেধ করতে হবে, কেননা সমস্ত বর্ণনা হাদীসগ্রন্থগুলোতে সংকলন করা হয়েছে, যা দ্বারা ওই প্রয়োগ-পদ্ধতি অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।[নোট-৪১]
ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله)’র বেসালপ্রাপ্তির মাত্র কয়েকদিন আগে ৫০৩ হিজরী সালের শুরুতে মুরা’বিত সুলতান (স্পেনের মুসলিম রাজা) আলী ইবনে ইঊসুফ ইবনে তা’শফীন (ইমাম গাজ্জালীর) ‘এহইয়া’ গ্রন্থটিকে কর্ডোবার ক্বা’জী আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হামদাইন (মৃত্যু: ৫০৮ হিজরী) ও অন্যান্য ফক্বীহ উলামার সর্বসম্মত রায় অনুযায়ী কর্ডোবায় পুড়িয়ে ফেলেন। ইবনে আল-ক্বাত্তা’ন আল-মার্রাকেশী (বেসাল: ৬৪৮ হিজরী) নিজ ’নুযূম আল-জুমা’ন’ পুস্তকে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেন এবং আরো যোগ করেন: “ওই গণ্ডমূর্খের দল কর্তৃক এই অতুলনীয় মহান গ্রন্থখানি পোড়ানো তাদের শাসনের ইতি, পতন ও মূলোৎপাটনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়” ।[নোট-৪২] কপট লোকেরা অবশ্য ওই বই থেকে তাঁর কোনো উদ্ধৃতি দেয়ার সময় এ কথা যে তিনি বলেছিলেন, তা সযত্নে এড়িয়ে যায়! ইবনে আল-ক্বাত্তা’ন এবং অন্যান্য উলামা আরো বর্ণনা করেন যে বাগদাদে ইবনে তূমা’র্তের উপস্থিতিতে [নোট-৪৩] ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) হাত উত্তোলন করে জালিমদের শাসনের পতন কামনা করে দোয়া করেন, যখনই তাদের (বই পোড়ানোর) দুষ্কর্মের সংবাদটি তাঁর কাছে পৌঁছে। এর অল্প কিছু কাল পরেই মরক্কোবাসী মুসলমানবৃন্দ বইটির পুনঃপ্রচলন করেন, যেমনটি বিবৃত করেছেন শায়খুল ইসলাম তক্বীউদ্দীন আল-সুবকী (رحمة الله) তাঁরই দীর্ঘ এক কবিতায় যার সূচনা হয়েছে এ কথা দ্বারা –
أباحامد أَنْت الْمُخَصّص بِالْحَمْد … وَأَنت الَّذِي علمتنا سنَن الرشد
“আবূ হা’মিদ! আপনি সত্যি সে (সৎ) জন, যিনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য” ।[নোট-৪৪]
[নোট-৩৭: এছাড়াও আল-হাম্মা’দ ইবনে যায়দ, যেমনটি বর্ণনা করেছেন আল-খতীব নিজ ‘আল-জামে’ পুস্তকে (২:২৩-২৪ #১১০৭; তবে বর্ণনাসমূহ ইঙ্গিত করে যে ইমাম মালেক (رحمة الله)’এর মতো ওয়াকী-ও ‘আল-রিওয়া’য়া বিল-লাফয’কে বারণ করেছিলেন এবং সুনির্দিষ্ট মূল কথার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন; মিলিয়ে দেখুন নোট-১৫]
[নোট-৩৮: আল-যাবীদী রচিত ‘এসা’ফ আল-সা’আদত আল-মুত্তাক্বীন’, ১:৪৮-৪৯]
[নোট-৩৯: এতর কৃত ‘মানহাজ আল-নাক্বদ’ ২২৭-২৩০ পৃষ্ঠা]
[নোট-৪০: ইবনে আল-সালা’হ, ‘উলূম আল-হাদীস’, ২১৪ পৃষ্ঠা]
[নোট-৪১: নূর অাল-দ্বীন ’এতর সম্পাদিত ইবনে হাজরের ‘শরহু আল-নুখবা নুযহাত আল-নাযার ফী তাওদিহ নুখবাত আল-ফিকার’, (৯৫ পৃষ্ঠা, নং-১); মিলিয়ে দেখুন আল-ক্বাসেমী’র ‘ক্বাওয়াঈদ আল-তাহদিস্ (২২৩-২২৫ পৃষ্ঠা) এবং তা’হির আল-জাযা’ইরী কৃত ‘তাওজিহ আল-নাযার’ (২৯৮-৩১২ পৃষ্ঠা)]
[নোট-৪২: ইবনে অাল-ক্বাত্তা’ন, ‘নুযূম আল-জুমা’ন, ৭০-৭২ পৃষ্ঠা]
[নোট-৪৩: উদ্ধৃত পুস্তকের ৭৩ পৃষ্ঠা; আল-হিলা’ল আল-মূশিয়া’, ১০৪-১০৫ পৃষ্ঠা; এবং আল-ওয়ানশারীসী কৃত ‘আল-মিয়্যা’র আল-মু’আর্রাব, ১২:১৮৫]
[নোট-৪৪: ‘তাবাক্বা’ত আল-শা’ফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৪]
ইবনে আল-সুবকী নিজ এসনাদে বর্ণনা করেন ইমাম আবূল হাসান শা’যিলী (رحمة الله) হতে এই মর্মে যে, ইবনে হিরযাহম নামের জনৈক মরোক্কীয় শায়খ ‘এহইয়া’ পুস্তকটি পোড়ানোর ইচ্ছা করেছিলেন; এমতাবস্থায় তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’কে স্বপ্নে দেখেন, যিনি ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله)’র সামনে বইটির প্রশংসা করেন এবং ইবনে হিরযাহম’কে কুৎসা রটনার দায়ে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন। পাঁচটি আঘাতের পরে তাঁকে ক্ষমা করা হয় এবং
فَلَمَّا اسْتَيْقَظَ من مَنَامه وَأصْبح أعلم أَصْحَابه بِمَا جرى
তিনি জেগে ওঠে বেত্রাঘাতের চিহ্নস্বরূপ (শরীরে) ব্যথা অনুভব করেন। অতঃপর তিনি (’এহইয়া’) বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। [নোট-৪৫]
’এহইয়া’ গ্রন্থটির সমালোচকদের আরেকটি হৈচৈয়ের বিষয় হলো, এতে জ্বেহাদের প্রসঙ্গে কোনো উপদেশ নিহিত নেই; আর এর লেখক (ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহে আলাইহে) ৪৮৮-৪৯৯ হিজরী সালে নির্জনবাসে ছিলেন; এটা ঠিক এমনি এক সময়ে ঘটেছিলো যখন ক্রুসেডার বাহিনী এনটিওক ও আল-কুদস্ বিধ্বস্ত করেছিলো এবং সহস্র সহস্র মুসলমানকে করেছিলো শহীদ। এই সমালোচকেরা ভুলে যান যে আল-ক্বুরআনে বিধৃত বৃহত্তর জ্বেহাদের (আল-জ্বিহা’দ আল-আকবর) মৌলিক মর্মবাণী হলো, যারা ধর্মকে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রথমতঃ এবং সর্বাগ্রে ক্বুরআনকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম করা:
فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا
“সুতরাং তুমি কাফেরদের কথা মান্য কোরো না এবং এ ক্বুরআনের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ করো – বড় জ্বিহাদ” (আল-ক্বুরআন, ২৫:৫২)।
[নোট-৪৫: ‘তাবাক্বা’ত আল-শাফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৮-২৬০]
ড: ইঊসুফ কারাযা‘ভী সমালোচকদের এসব কটাক্ষের জবাবে বলেন:
মহান ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله)’র ওজর হতে পারে এই যে, তাঁর সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো সর্বপ্রথমে তাঁর নিজের সত্তার পরিশুদ্ধি লাভ করা; কেননা কারো ব্যক্তিগত দুর্নীতি-ই বাহ্যিক দূষণের পথ খুলে দেয়, যেমনটি ইঙ্গিত করা হয়েছে সূরা ইসরা’র প্রারম্ভে। ইসরাঈলী জাতি যখনই দুর্নীতিগ্রস্ত হতো এবং দুনিয়ার বুকে দুর্নীতি ছড়াতো, তৎক্ষণাৎ তাদের ওপর তাদের শত্রুরা আধিপত্য বিস্তার করতো। আবার যখনই তারা ভালো কাজ করতো এবং নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করতো, অমনি তারা তাদের শত্রুদের ওপর আধিপত্য ফিরে পেতো। ব্যক্তিসত্তা যা সমাজের মর্মবস্তু গঠন করে থাকে, তার পরিশুদ্ধির প্রতি ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন। কোনো ব্যক্তির পরিশুদ্ধি কেবল তার অন্তর ও চিন্তা-মননের পরিশুদ্ধি দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব। স্রেফ ওই পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই তার কর্ম ও আচরণ এবং তার গোটা জীবন উন্নত করা সম্ভব। এটাই সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তি, যার প্রতি আল-ক্বুরঅান আমাদেরকে পরিচালিত করে এই ঘোষণা দ্বারা:
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
“নিশ্চয় আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তাঁর নেআমতের পরিবর্তন করেন না যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে না” (আল-ক্বুরআন, ১৩:১১)। [নোট-৪৬]
ওপরে প্রদত্ত বক্তব্যের চেয়েও স্পষ্টভাষী কথা হলো হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله)’র, যাঁকে কিছু লোক জিজ্ঞেস করেছিলো কেন তিনি তাঁর সময়কার দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেননি। তিনি উত্তরে বলেন: “কেননা তারা ইসলামের বাধ্যবাধকতামূলক বিষয়গুলোতে শিথিল বা সেগুলোর অবহেলাকারী” ।[নোট-৪৭] ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) স্বয়ং বলেন:
أما الوعظ فلست أرى نفسي له أهلا، لأن الوعظ زكاة نصابه الإتعاظ، ومن لا نصاب له كيف يخرج الزكاة؟!. وهل يستقيم الظل والعود أعوج؟
“ওযা’য তথা উপদেশের বেলায় আমি নিজেকে এর জন্যে যোগ্য বিবেচনা করি না। কেননা ওয়া’য-নসীহত (উপদেশ) হচ্ছে এক সংশোধন বা পরিশুদ্ধিমূলক কর (যাকা’ত), যার নিসা’ব তথা ন্যূনতম করারোপ-অযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ হলো ‘আল-এত্তে’আয (মানে আত্মোপদেশ)। যে ব্যক্তির কোনো ন্যূনতম করারোপ-অযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ-ই নেই, তিনি আবার তাঁর কর পরিশোধ করবেন কীভাবে? গাছ যদি বাঁকা হয়, তাহলে তার ছায়া কি সরল বা সোজা হবে?” [নোট-৪৮]
এছাড়া আরো স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, ইমাম গাযযালী (رحمة الله) তাঁর সময়কার মুসলমানদের অধঃপতিত অবস্থার ব্যাপারে নিজেই গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও চিন্তিত ছিলেন, যা তাঁর রচিত ‘আল-মুনক্বিয মিনাদ্ দালা’ল’ (ভ্রষ্টতা হতে মুক্তি) পুস্তকের শেষে তিনি আপন ভাষায় ব্যক্ত করেন; নিচে তা উদ্ধৃত করা হলো:
আমি যখন দেখলাম নানা ধরনের মানুষের ঈমান-আক্বীদা সবচেয়ে দুর্বল পর্যায়ে পৌঁছেছে….তখন আমার আত্মা পুরোপুরিভাবে এই ত্রুটির মূল কারণ খোঁজার কাজে প্রবৃত্ত হয়। এমতাবস্থায় এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ করাটা আমার জন্যে পানি পানের চেয়েও সহজতর হয়ে যায়; কেননা আমি তাদের জ্ঞান-বিদ্যা ও পথ সম্পর্কে গভীরভাবে পরিচিত। আমি এখানে বোঝাচ্ছি সূফী-দরবেশবৃন্দ, দার্শনিকবর্গ, আল-তা’লীমিয়্যা তথা বিদ্বান/পণ্ডিত ও সেসব লোক যারা আলেম-উলামা’র বাহ্যিক চিহ্ন বহন করেন। আমি নিশ্চিত হলাম যে এটা (মানে এই দুর্বলতা) নির্দিষ্টভাবে আমাদের যুগেরই এক অবধারিত/অনিবার্য (বাস্তব) পরিস্থিতি। এই অবস্থায় নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা ও নির্জন-বাস (আল-খালওয়া ওয়াল-’উযলা) করাতে আপনাদের কী ফায়দা হবে, যেখানে সংক্রমণ এতোই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে চিকিৎসকরা নিজেরাই অসুস্থ এবং মানবজাতি ধ্বংসের উপক্রম? অতঃপর আমি নিজেকে বল্লাম: তুমি কবে এই মসীবত অপসারণে ও মহা অন্ধকার মোকাবেলায় তোমাকে নিয়োজিত করবে? কিন্তু এ তো হলো দুর্বল মুহূর্ত, যখন মিথ্যের রাজত্ব বহাল। তুমি মানুষদেরকে তাদের মিথ্যে পথগুলো হতে সত্যের দিকে আহ্বান করলে তারা সবাই তোমার বিরোধিতা করবে। তুমি কীভাবে তাদের মোকাবেলা করবে, আবার একই সময়ে তাদের সাথে একত্রে বসবাস করবে? এটা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হতে পারে না, শুধুমাত্র কোনো শুভক্ষণ ও ক্ষমতাবান সুলতান ব্যতিরেকে।
অতঃপর ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) ‘খালওয়া’য় অবস্থান করেন যতোক্ষণ না তিনি ওই ধরনের সুলতানের আলামত দেখতে পান; এর পরপর-ই তিনি বেরিয়ে আসেন এবং তাঁকে (সুলতানকে) পরামর্শ দিতে যান।
শায়খ তকীউদ্দীন সুবকী (رحمة الله) ‘এহইয়া’ গ্রন্থের নিন্দুকদের সম্পর্কে বলেন: আমি তাদেরকে ধার্মিক ও একান্ত অনুরক্ত মানুষদের একটি দলের মতো বিবেচনা করি [নোট-৪৯]
فَرَأَوْا فَارِسًا عَظِيما من الْمُسلمين قد رأى عدوا عَظِيما لأهل الْإِسْلَام فَحمل عَلَيْهِم وانغمس فِي صفوفهم وَمَا زَالَ فِي غمرتهم حَتَّى فل شوكتهم وكسرهم وَفرق جموعهم شذر بذر وفلق هام كَثِيرَة مِنْهُم فَأَصَابَهُ يسير من دِمَائِهِمْ وَعَاد سالما فرأوه وَهُوَ يغسل الدَّم عَنهُ ثمَّ دخل مَعَهم فِي صلَاتهم وعبادتهم فتوهموا أَيْضا أثر الدَّم عَلَيْهِ فأنكروا عَلَيْهِ
যারা মুসলমানদের সারির মধ্যে কোনো মহান যোদ্ধার আবির্ভাব ও তাঁদের শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর রণমূর্তি দেখেছেন এবং প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর দ্বারা শত্রুদের পরাস্তকরণ ও ধ্বংসসাধন। অতঃপর শত্রুদের রক্ত-মাখা অবস্থায় তিনি বিজয়ীর বেশে নিজেকে ধুয়ে পরিষ্কার হয়েছেন, আর মুসলমানদের সাথে এবাদতগাহে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু ওই দলটি ভেবেছে তাঁর গায়ে তখনো শত্রুদের কিছু রক্ত লেগে আছে, আর তাই তারা এর জন্যে তাঁর সমালোচনামুখর হয়েছে।[নোট-৫০]
[নোট-৪৬: আল-ক্বারাযা’ভী প্রণীত ‘আল-ইমা’ম আল-গাজ্জা’লী, ১৭৪ পৃষ্ঠা]
[নোট-৪৭: আল-যাহাবী কর্তৃক নিজ ‘সিয়্যার’ (৭:২০৩) পুস্তকে আল-খুরায়বী হতে উদ্ধৃত]
[নোট-৪৮: ইবনে আল-মুলাক্কিন কৃত ‘তাবাক্বা’ত আল-আউলিয়া, ১০৪ পৃষ্ঠা]
[নোট-৪৯: তবে বর্তমানের নিন্দুকবর্গ আগের দিনের ‘ধার্মিক ও একান্ত অনুরক্ত’ নয়, বরঞ্চ অলস নিরর্থক শয়তানী কর্মকাণ্ড ও অনুপকারী জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত, আর এই জগতের ময়লা জঞ্জালের জন্যে লালায়িত],
[নোট-৫০: ‘তাবাক্বা’ত আল-শাফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৪]
তাঁর (ইমাম সুবকীর) পুত্র ইবনে আল-সুবকী বলেন:
وَهُوَ من الْكتب الَّتِي يَنْبَغِي للْمُسلمين الاعتناء بهَا وإشاعتها ليهتدي بهَا كثير من الْخلق وقلما ينظر فِيهِ نَاظرا إِلَّا وتيقظ بِهِ فِي الْحَال رزقنا الله بَصِيرَة ترينا وَجه الصَّوَاب ووقانا شَرّ مَا هُوَ بَيْننَا وَبَينه حجاب
এই বইটি (এহইয়া) সেসব বইয়ের সারিতে অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোর প্রতি মুসলমানদের যত্ন নেয়া উচিত এবং যেগুলোর প্রচার-প্রসার করা উচিত এমনিভাবে যাতে প্রচুর মানুষ তা পড়ে হেদায়াত পান। এই বইটি পড়ে এর কল্যাণে তৎক্ষণাৎ জাগ্রত না হওয়ার ঘটনা বিরল। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে সত্যপথে পরিচালিত হবার অন্তর্দৃষ্টি মঞ্জুর করুন এবং সত্য ও আমাদের মাঝে পর্দাস্বরূপ যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা হতে আমাদের রক্ষা করুন। [নোট-৫১]
[নোট-৫১: ‘তাবাক্বা’ত আল-শা’ফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৩]
’এহইয়া’ গ্রন্থখানির সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাখ্যামূলক বইগুলোর মধ্যে রয়েছে:
* মুহাদ্দীস মুরতদা আল-যাবীদী’র ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘এতহা’ফ আল-সাআদাত আল-মুত্তাক্বীন শরহ এহইয়া উলূম আল-দ্বীন’ (খোদভীরু তাপসদের অকাতর দান: আল-গাজ্জালী’র রচিত ধর্মীয় জ্ঞানের পুনরুজ্জীবন সংক্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ’), যা’তে অাল-গাজ্জালী (رحمة الله)’র উদ্ধৃত হাদীসগুলোর সামগ্রিক দলিলাদি সপ্রমাণ করা হয়েছে। {ইরাক্বী ওহাবী মাহমূদ শুকরী আলূসী (মৃত্যু: ১৩৪২ হিজরী)’র কুৎসা দ্বারা আপনারা প্রতারিত হবেন না। কেননা এই লোক একই নামের অধিকারী ক্বুরঅান-তাফসীরকারক মাহমূদ আলূসী, যিনি নিজ ‘রূহুল মা’আনী’ তাফসীরগ্রন্থ লিখতে ‘এহইয়া’র ওপর নির্ভর করেছেন, তিনি নন।}
* আবদুল ক্বা’দির ইবনে আবদিল্লাহ আল-’আয়দারূস্ বা’ আলাউয়ী প্রণীত ‘তা’রীফ আল-আহএয়া’ বি-ফাদা’ইল আল-এয়াহইয়া’ (এহইয়া পুস্তকের জীবন্ত মহা-কল্যাণের মূল্যায়ন)।
* মোল্লা আলী ক্বা’রী লিখিত ‘শরহ আইন আল-এলম ওয়া যাইন আল-হিলম’ (জ্ঞানের ঝর্না ও সৌন্দর্য-অলঙ্করণের উপলব্ধি) যা (এহইয়া’র) সংস্কৃত কপির ওপর লেখা। আলী ক্বারী সূচনায় লেখেন:
আমি এই ব্যাখ্যামূলক বই লিখেছি এহইয়া পুস্তকের সংস্কৃত কপির ওপর, ইসলামের প্রামাণিকতা ও সৃষ্টিকুলের (বিদ্বানদের) প্রত্যয়নের ভিত্তিতেই; তা এই আশায় যে খোদাজ্ঞানীদের বাণী হতে প্রবাহিত কিছু আশীর্বাদের প্রাপক হতে আমি সক্ষম হবো, অার মাশায়েখ ও দরবেশমণ্ডলীর (বইয়ের) পাতাগুলো হতে যে উপহার ঝরে পড়ে তা দ্বারাও লাভবান হবো, যাতে আমাকে তাঁদের সংখ্যা মাঝে উল্লেখ করা হয় এবং তাঁদেরই সমাবেশে পুনরুত্থিত করা হয়; যদিও তাঁদের অনুসরণে ও খেদমতে আমার ঘাটতি বিদ্যমান। কেননা আমি তাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসার ওপরই নির্ভর করি এবং তাঁদেরই সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষী হই। [নোট-৫২]
[নোট-৫২: আল-ক্বা’রী রচিত ‘শরহু আইন আল-’এলম’, ১:১]
আল্লাহতা’লা ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله)’র প্রতি করুণাশীল হোন এবং তাঁকে সকল গুণে গুণান্বিত করুন যার সমালোচনায় মুখর তাঁর নিন্দুকবর্গ এবং সেসব লোক, যাদেরকে শয়তান ব্যস্ত রেখেছে আল্লাহর আউলিয়া (رحمة الله)’র কুৎসা রটনায়; কেননা তারা একেবারে বেহায়া-নির্লজ্জ।