ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

অধঃপতনের যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পার্থিব লোভ-লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাদের ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র পদস্খলন ঘটাতে পারেনি; যারা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোনো দিন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন যারা পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যারা জালেম সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন, ইমাম আবু হানিফা  তাঁদের অন্যতম।

জন্ম ও শিক্ষা
ইমাম আবু হানিফা  ৮০ হিজরি মোতাবেক ৭০২ খ্রিস্টাব্দে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হলো নু’মান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। বাল্যকালে তাঁর ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তিনি ইমাম আজম নামেও সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধিশালী নগর কুফায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ইমাম আবু হানিফা  ১৪-১৫ বছর বয়সে একদিন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তৎকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শা’বী  তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছ? উত্তরে তিনি বিষাদের স্বরে বললেন, ‘আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।’ ইমাম শা’বী  বললেন, ‘আমি যেন তোমার মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। ভালো আলেমের নিকট তোমার লেখাপড়া শেখা উচিত।’ ইমাম শা’বী  -এর উপদেশ ও অনুপ্রেরণায় ইমাম আবু হানিফা  ইমাম হাম¥াদ  ইমাম আতা ইবনে রবিয়া  ও ইমাম জাফর সাদিক  -এর মতো তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞান লাভের জন্য তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা এবং কুফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত আলেমগণের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে হাদিসের অমূল্য রতœ সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করেন। উল্লেখ্য, তিনি চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইমাম সাহেব বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণীগুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপণিকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেওও যাতায়াত শুরু করলাম। [মুয়াফেক, আবু জোহরা]

ইমাম আবু হানিফা  তাবেয়ী ছিলেন
কারো কারো মতে, ইমাম আবু হানিফা  তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবী জীবিত ছিলেন। ১০২ হিজরিতে তিনি যখন মদিনা গমন করেন তখন মদিনায় দু’জন সাহাবী হযরত সোলাইমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা  তাঁদের দর্শন লাভ করেন। তবে তাবে তাবেয়ী হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। ইমাম আবু হানিফা  -এর শিক্ষকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁদের মাত্র একটি মধ্যস্থতা অবলম্বন করতে হতো। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিসসমূহ সম্পূর্ণ সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কারণে তিনি একজন তাবেঈ। ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যূন সাতজন সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন- ১. হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী) ২. আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী) ৩. সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী) ৪. আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী) ৫. আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী) ৬. জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী) ৭. ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)।
হাদিস শাস্ত্রের ‘আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন, নোমান (আবু হানীফা) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।

শিক্ষাদান পদ্ধতি
ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানিফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুণী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফা  এর দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জাযরিরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফা রঃ এর নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।
মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞান তৃষ্ণা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানিফা  ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম আযমের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছিলো, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক। ইমাম আযমের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধিক ব্যক্তি মুফতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।
প্রথম আব্বাসীয় খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি) চারবছর নয় মাস ইমাম আবু হানিফা  মক্কা শরীফে স্বেচ্ছনির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানিফা  -এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসীয়দের শাসন-ব্যবস্থা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখগণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যবস্থার পুনঃ প্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ করে ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগণের সে আকাক্সক্ষা নস্যাৎ করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্থান মোটেও নিরাপদ ছিল না। শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকাল (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কা শরীফেই অবস্থান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা  নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেজ যাহাবীর রঃ বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।

তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য
তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহশাস্ত্রেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামি আইনগুলোকে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফি মাজহাবের অনুসারী। ফিকাহশাস্ত্রে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ইমাম মুহাম্মদ , ইমাম আবু ইউসুফ  ও ইমাম যুফার  প্রমুখ।

ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে অনুসৃত নীতি
যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা  -এর অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করা। তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আসারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। [তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান]
ইমাম ইবনে হাযম  বলেন, আবু হানীফা  -এর সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দুর্বল সনদযুক্ত এক হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মূল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হবে। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবত এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার  মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী  -এর বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী  হারামাইন শরীফে কাশফ যোগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাকে অবগত করেছেন যে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানিফা  -এর সিদ্ধান্তগুলো সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। [ফুযুলুল-হারামাইন]
ইমাম আবু ইউসুফ  লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা  কেবল কারাগারে বসেই ১২ লাখ ৯০ হাজারের অধিক মাসআলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা  বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।

তীক্ষ্ম বুদ্ধি, ধী-শক্তি ও গভীর জ্ঞান
ইমাম আযম যেমন তীক্ষè বুদ্ধির অধিকারী ও ধী-শক্তিসম্পন্ন ছিলেন তেমনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা তা অনুমান করা সম্ভব হবে।
‘একদিন ইমাম আবু হানীফা  কিরাত ও হাদীস বর্ণনায় প্রসিদ্ধ তাবেই হযরত আমাশ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় কোন একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মতামত জিজ্ঞেস করা হল। জবাবে তিনি তার মতামত জানালেন। হযরত আমাশ  জিজ্ঞেস করলেন- এ দলীল তুমি কোথায় পেয়েছ? জবাবে ইমাম সাহেব বললেন যে আপনিই তো আমাদেরকে হাদীস শুনিয়েছেন,। এভাবে ইমাম সাহেব তারই বর্ণনাকৃত আরও চারটি হাদীস শুনালেন। ইমাম আমাশ বললেন- যথেষ্ট হয়েছে, আর শুনাতে হবে না। আমি তোমাকে একশত দিনে যা বলেছি তুমি এক ঘন্টায় তা শুনিয়ে দিলে। আমার ধারণাও ছিল না যে তুমি এ হাদীসগুলোর উপর আমল করে থাক। ‘সত্যিই তোমরা ফকীহরা হলে ডাক্তারতুল্য, আর আমরা হলাম ওষুধের দোকানদার।’’ আর তুমি তো উভয় দিকই হাসিল করেছ।
[আল জাওয়াহের আল মুদিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৮৪]
‘ইমাম আবু হানিফা  ও তার শাগরিদদেরকে যারা পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হাফিজে হাদীস ফাযল ইবনি মূসা আস সিনানীকে জিজ্ঞাসা করা হল- ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে যারা অপবাদ গেয়ে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি বললেন- আসল ব্যাপার হল ইমাম আবু হানীফা  তাদের সামনে এমন তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করেছেন যার সবটা তারা বুঝতে সক্ষম হয়নি। আর তিনি তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তারা ইমাম সাহেবের সাথে হিংসা আরম্ভ করেছেন’। ইমাম আবু ইউসুফ  বর্ণনা করেন-‘হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানিফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দূরদর্শী ছিলেন’।
ইমাম আবু হানিফা  কুফা শহরের উলামাদের সংগৃহীত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন- ইমাম বুখারী  -এর জনৈক উস্তাদ ইয়াহইয়া ইবনি আদাম তার সহীহ গ্রন্থে বলেন- ‘ইমাম আবু হানীফা  নিজ শহরের সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন এবং তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শেষ জীবনের হাদীসগুলোর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল (অর্থাৎ বিভিন্নমুখী হাদীসগুলোর মধ্যে সর্বশেষ হাদীস কোনটি ছিল)। যার দ্বারা অন্যান্য রহিত সাব্যস্ত করা সহজ হয়।

মোটকথা
ইমাম আবু হানিফা  কুফা শহরের উলামাদের হাসিলকৃত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি বরং কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- মদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা- মদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল উলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফক্বীহদের কেন্দ্রস্থল ছিল, কাজেই এক কথায় বলা চলে যে মক্কা-মদীনা ছিল ইলমের মারকায। আর তার মত অসাধারণ ধী-শক্তিসম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর যাবত মক্কা-মদীনায় ইলম হাসিল করা নিঃসন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়। এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
[উকূদুল জামান, পৃ- ২২০]
প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা-মদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন বলে বিভিন্ন লেখক মন্তব্য করেছেন।
[আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩, খইরতুল হিসান, পৃ- ২৩। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনি ইউসূফ আস সালেহী ‘উকূদুল জামান গ্রন্থে
দীর্ঘ ২৪ পৃষ্ঠায় ইমাম সাহেবের মাশায়েখদের
একটা ফিরিস্তি পেশ করেছেন, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩- ৮৭]
আল্লামা আলী আল কারী, মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ’র বরাত দিয়ে বলেছেন- ‘আবু হানিফা  তার রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের ঊর্ধ্বে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর ‘আল আছার’ গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন’। [আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৭৩]
ইয়াহইয়া ইবনি নাসর বলেন- ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানিফার ঘরে প্রবেশ করি যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন- এগুলো হাদীসের কিতাব, এর মধ্যে সামান্য কিছুই আমি বর্ণনা করেছি যেগুলো ফলপ্রদ’।
[আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদু জাওয়াহিরিল মুনীফাহ, ১, ৩১]
ইমাম আবু হানিফা  এর যদিও অন্যান্য মুহাদ্দিসদের মত হাদীস শিক্ষা দেয়ার জন্য কোন মজলিস ছিল না এবং হাদীস শাস্ত্রে কোন কিতাব সংকলন করেননি, যেমন ইমাম মালিক  করেছেন। [মুআত্তা মালিক]
কিন্তু তার শাগরিদগণ তার বর্ণিত হাদীসগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন কিতাব ও মুসনাদ সংকলন করেছেন যার সংখ্যা দশের ঊর্ধ্বে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হল- ইমাম আবু ইউসুফ রচিত ‘কিতাবুল আসার’, ইমাম মুহাম্মাদ রচিত ‘কিতাবুল আসার আল মারফুআহ’ ও ‘আল আসারুল মারফুআহ ওয়াল মাওকুফাহ’, মুসনাদুল হাসান ইবনি যিয়াদ আল লু- লুঈ, মুসনাদে হাম্মাদ ইবনি আবু হানিফা ইত্যাদি।
ইমাম বোখারীর অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম (ওফাত-২১৫ হি.) যার সনদে ইমাম বুখারী  অধিকাংশ ‘সুলাসিয়্যাত হাদীস’ বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম  ইমাম আবু হানীফা  এর ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা  সম্পর্কে বলেন, “আবু হানিফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন”।
[মানাক্বেবে ইমাম আজম রহ. ১/৯৫]
আবার হাফিয মযযী  বলেন, মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানিফা  সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি তাঁর কালের সবচে’ বড় আলিম ছিলেন। তাহবীবুত তাহযীব-এর টীকা- ১০ম খণ্ড, ৪৫২ পৃ. ইমাম আবু দাউদ বলেন, নিঃসন্দেহে আবু হানিফা ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ ইমাম। তাহজীব ১/৪৪৫ জরহে তাদিলের (সনদ পর্যালোচনা শাস্ত্র) অন্যতম ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন (ওফাত- ২৩৩হি.) বলেন, “আবু হানিফা ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি।”- (তাহবীবুত্তাহজীব ৫/৬৩০) আলী ইবনে মাদানী (ওফাত- ২৩৪ হি.) বলেন, “আবু হানীফা হাদীস শাস্ত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন দোষক্রুটি ছিল না।
[জামঈ বয়ানিল ইল্ম ২/১০৮৩]
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিজ ইয়াহ্ইয়া বিন হারুন (ওফাত- ২০৬ হি.) বলেন, “আবু হানিফা ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সত্যবাদী”। [আহবারে আবু হানীফা ৩৬]
আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী  বলেন- “ইমাম আবু হানিফা রহ.-র মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রহ. গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো”। [তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১, পৃ: ৪৫০]
একবার হযরত ইয়াহয়া ইবনে মুঈনকে প্রশ্ন করা হলো- হাদীসশাস্ত্রে আবু হানীফা রহ. কি আস্থাভাজন ব্যক্তি? সম্ভবত প্রচ্ছন্ন সংশয় আঁচ করতে পেরে দৃপ্তকন্ঠে তিনি উত্তর দিলেন- হ্যা, অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন!
[মানাকিবুল ইমামমুল আ’যামি লিলমাওয়াফিক- খন্ড:১, পৃষ্ঠা ১৯২]
ইমাম শাফেয়ী  বলেছেন, ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফা  -এর পরিবারভুক্ত।
[আছারুল ফিকহিল ইসলামী, পৃ: ২২৩]
হাফেজ যাহাবী রহ. তার কিতাবে ইমাম আবু হানিফা  কে হাফেজে হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
[তাযকিরাতুল হুফফাজ, পৃ: ১৬০]
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক রহ. বলেছেন, কোন ব্যক্তি অনুসরণীয় হওয়ার দিক থেকে ইমাম আজম আবু হানিফা রহ.-এর চেয়ে অধিক যোগ্য নয়। কেননা আবু হানিফা ইমাম, খোদাভীরু, মুত্তাকী, আলেম ছিলেন। তীক্ষ্ম মেধা ও বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে ইলমকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যে ইতিপূর্বে কেউ তা করতে পারে নি।
[খাইরাতুল হিসান, লেখক: ইবনে হাজার হায়ছামী শাফেয়ী]

খোদাভীরুতা
তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার নামাজের ওজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এতে এটাই বোঝা যায় যে, তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদত, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। কতিপয় কর্মচারীর দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্য তিনি কর্মচারীদের সব সময় সতর্ক করতেন। একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, ‘ক্রেতার নিকট যখন এগুলো বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলো দেখিয়ে দেবে এবং এর মূল্য কম রাখবে।’ কিন্তু পরবর্তী কর্মচারীগণ ভুলক্রমে ক্রেতাকে কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেরে খুব ব্যথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেন এবং বিক্রীত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।

ইন্তিকাল
খলিফা মনসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার তাকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয় । কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়িতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফার ওফাত হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান যে খলিফা মনুসর জনগণের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মাণ করেছে সে এলাকায় যেন ইন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়।
কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ইমাম আবু হানিফা  বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরির ১ শা’বান এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
ইমাম আবু হানিফা  -এর মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুতের গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্তরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তাঁর জানাজায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশ গ্রহণ করেছিল। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী বিজরান কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment