একসময় পুরো পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুসলিম শাসকরা। বিস্তৃত করে গেছেন মুসলিম সাম্রাজ্যের। তাদের মেধা, রণকৌশল ছিলো বিস্মত করার মতো। নিচে কয়েকজন খ্যাতনামা বীরের গল্প উল্লেখ করা হলো- যারা মুসলিমদের গৌরব ইতিহাস লিখে গেছেন।
সুলতান মালিক শাহ
মালিক শাহের জন্ম ১০৫৫ সালে। জন্মকালে তার নাম ছিলো- জালাল আদ-দৌলা মালিক বেগ। তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন। ১০৭২ সালে তার পিতা সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের উত্তরাধিকারী হয়ে সিংহাসনে বসেন এবং গ্রহণ করেন মালিক শাহ উপাধি। মালিক শাহ ১০৯২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার শাসনামলে সেলজুক সাম্রাজ্য অর্ধপৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, সিরিয়া, মিসর ও তুর্কিসহ প্রায় ২৫টি রাষ্ট্র তৎকালীন সেলজুক সাম্রজ্যের অধীনে ছিলো।
মালিক শাহের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই সময়েই ইস্পাহান পর্যবেক্ষণে জালালি ক্যালেন্ডারের সংস্কার করা হয়। মালিক শাহ ছিলেন তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। কিন্তু তা হওয়া সত্ত্বেও, মালিক শাহ ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং বিনয়ী। যখন মালিক শাহ কোনো অভিযানে জয়ী হতেন তখন তিনি তার সাম্রাজ্যের শক্তিতে অভিভূত হতেন। মালিক শাহের অতি বিনয়ীর খেসারত দিতে হয় প্রথম ক্রুসেডে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। এতে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের বিরাট অংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তবে মালিক শাহ তার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা দিয়ে অসংখ্য যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন।
নিজামুল মুলক
নিজামুল মুলক জন্মগ্রহণ করেন ১০১৭ সালে। তার প্রকৃত নাম আবু আলি আল হাসান আত তুসী। আল্প আরসালান ও মালিক শাহ এই দুই সেলজুক শাসকের অধীনে ৩০ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন নিজামুল মুলক। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি অনুপম দক্ষতার পরিচয় দেন। সেলজুক সাম্রাজ্যকে উন্নত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অবদান রাখায় তাকে নিজামুল মুলক বলে ডাকা হতো। বলা যায়, তাকে ছাড়া সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
নিজামুল মুলক তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা দিতে রচনা করেন ‘সিয়াসাত নামা’ নামে গ্রন্থ। নিজামুল মুলকের নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ফসল আজকের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা। ইতিহাসে এত বেশি অবদান রাখা সত্ত্বেও বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তাকে স্মরণ করা হয় না এবং অনেক ডিগ্রিধারী লোক জানে না নিজামুলক কে? রাষ্ট্র এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য আনা এই মহান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে ১০৯২ সালে।
সালাউদ্দীন আইয়ুবী
সালাউদ্দীন আইয়ুবী শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১১৩৮ সালে। বেঁচে ছিলেন ৫৫ বছর এবং রাজত্ব করেন ১১৭৪ থেকে ১১৯৩ সাল পর্যন্ত। তিনি ছিলেন মিসর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সালাউদ্দীন আইয়ুবী তার জীবদ্দসায় তৈরি করে গেছেন অতুলনীয় বীরত্বের রুপরেখা। যার মধ্যে একটি হলো- বায়তুল মোকাদ্দাস জয়। বায়তুল মোকাদ্দাস বহুকাল ধরে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ছিল। ১০৯৯ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বায়তুল মোকাদ্দাস অবরোধ করে মুসলিমদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। ১১৮৭ সালে বীর সেনাপতি সালাউদ্দীন আইয়ুবীর নেতৃত্বে বায়তুল মোকাদ্দাস পুণরায় মুসলিমদের দখলে আসে। ১১৯৩ সালে মিসরের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান নামে খ্যাত এই বীরের মৃত্যু হয়।
রুকনুদ্দিন বাইবার্স
রুকনুদ্দিন বাইবার্স ১২২৩ সালে কিপচাক উপত্যকার (বর্তমান কাজখস্তান) কুমান গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। কিপচাক উপত্যকায় বসবাস ছিলো জাজাবর সম্প্রদায়ের। বাইবার্সের বাল্যজীবন তেমন একটা সুখকর ছিলো না। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও কর্মচঞ্চল। দুই ঘোড়ার পিঠে চড়ে তীর ছুঁড়াটাও ছিলো বাইবার্সের পারদর্শীতার একটি। বাইবার্সের সাহসিকতার একটি হলো- চেঙ্গিস খানের গঠিত মঙ্গোল বাহিনীর পরাজয় বরণ। মোঙ্গলরা ছিলো সব যুদ্ধে অপারেজয়। কিন্তু সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের কাছে তারা হারতে বাধ্য হয়।
মোঙ্গলরা এমন এক দুর্যোগের নাম, যেখান থেকে মানুষ কেবল পালানোর কথাই ভাবতে পারে। কিন্তু সুলতান বাইবার্স সেই ভাবনা পাল্টে দিয়ে গেছেন ইতিহাসে। আর সেটা শুরু হয় ঐতিহাসিক আইন জালুত যুদ্ধ দিয়ে। যেটা ছিলো ইতিহাসের এক অন্যতম রণক্ষেত্র। যে রণক্ষেত্রে অপারেজয় মোঙ্গলদের শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়। এই লড়াই ছিলো- মঙ্গোলদের কাছ থেকে মুসলিমদের প্রথম বিজয় এবং ইতিহাসের বাঁকবিন্দু।
অন্যদিকে ক্রুসেডাররা যখন গোটা আরব গিলে নিতে চক্রান্ত করছিলো, তখন উত্থান হয় বাইবার্স ঝড়ের। ১২৬০ সালের পরে এসে চারিদিকে মোঙ্গল-ক্রুসেডারদের কাছে বাইবার্স হয়ে যায় একটি প্রলয়ংকারী ঝড়ের নাম। যে সব অবিচারের প্রতিশোধ নিতে ফুঁসিয়ে ওঠে মোঙ্গল-ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে। এতে বিভিন্ন যুদ্ধে মোঙ্গল-ক্রুসেডারদের বরণ করতে হয় শোচনীয় পরাজয়। ১২৭৭ সালে এই মহান বীরের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাইবার্স বেঁচে ছিলেন চুয়ান্ন বছর। তিনি এই জীবনে দেখিয়ে গেছেন মুসলিমরা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জাতি।
মুহাম্মদ আল ফাতেহ
১৪৩২ সালে মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম বীর মুহাম্মদ আল ফাতেহ জন্মগ্রহণ করেন। মুহাম্মদ ছিলো মেধা ও যোগ্যতায় অতুলনীয়। মুহাম্মদের বয়স যখন ১১ তখন তার পিতা দ্বিতীয় মুরাদ উসমানি সালাতানাতের গুরুভার মুহাম্মদের ওপর অর্পণ করেন। কিন্তু তার বয়সের অপরিপকক্কতার কারণে পুণরায় ক্ষমতা বাবার ওপর হস্তান্তর করেন। ১৪৫১ সালে দ্বিতীয় মুরাদের মৃত্যুর কারণে ক্ষমতা মুহাম্মদের ঘাড়ে এসে পড়ে এবং ওই সময় তিনি ছিলেন ১৯ বছরের টগবগে যুবক। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যতবাণী করে গিয়েছিলেন, কনস্ট্যান্টিপল মুসলিমরা একদিন জয় করবে এবং বলেছিলেন কতই না অপূর্ব সেই বিজয়ী সেনাপতি ও তার সেনাবাহিনী। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে রুপ দিতে মুহাম্মদ আল ফাতেহর আগে তার পূর্বপূরষরা কনস্ট্যান্টিপল জয়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। তবে মুহাম্মদ আল ফাতেহ ক্ষমতা হাতে পেয়ে চেষ্টা চালাতে থাকেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে রুপ দিতে। এতে মুহাম্মদ আল ফাতেহ সফল হন। ১৪৫৩ সালে ২১ বছরের সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক টানা ৫৩ দিন যুদ্ধের মাধ্যমে অধিকার করে নেন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিপল। এর মাধ্যমে পতন হয় খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যের এবং মুসলিমদের হতে চলে আসে ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম নগরী ও তাকে উপাধী দেওয়া হয় আল ফাতেহ। অর্থাৎ বিজেতা! কনস্ট্যান্টিপল জয়েই মুহাম্মদ আল ফাতেহ ইতিহাসের পাতায় এখনও অমর হয়ে আছেন। তার শাসনামলে উসমানীয় সাম্রাজ্য কনস্টান্টিনোপল, এশিয়া মাইনর, সার্বিয়া, আলবেনিয়া, ইতালি ও ক্রিমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ১৪৮১ সালে ৪৯ বছর বয়সে এই মহান বীর মৃত্যুবরণ করেন।