ইখলাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইখলাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আ.স. ম এয়াকুব হোসাইন

ভূমিকা: ইখলাস বা আন্তরিকতা মুসলিম জীবনে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য বিষয়। শরয়ী আমল যা বাহ্যিক দিক ও ইখলাস বা অভ্যন্তরীণ দিক এর সমন্বয় ছাড়া কোন মানুষ পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী হতে পারে না। ঈমানের মূল কাঠামো ইখলাসের উপর নির্ভরশীল। প্রাণবিহীন ইড়ফু যেমন গুরুত্বহীন তেমনিভাবে ইখলাসবিহীন বান্দার সকল আমলের বোঝা মর্যাদাহীন বা নিস্ফল কামনা। আর বর্তমান সমাজে সাধারণ পাবলিক থেকে শুরু করে বড় বড় আল্লামা, রাজীয়ে জামান ও ইসলামিক স্কলার পর্যন্ত অধিকাংশই ঝযড়ফিড়হি বা লৌকিকতার ব্যধিতে গুরুতর আক্রান্ত। আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইখলাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য পাঠকদের সামনে তুলে ধরাই এ প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য।

اخلاص শব্দের বিশ্লেষণঃ ইখলাস শব্দটি খুলুস শব্দ থেকে উৎপন্ন বাবে افعال এর মাসদার। অভিধানিক অর্থ হল, পরিষ্কার করা, খাঁটি করা, রিয়া (লৌকিকতা) ত্যাগ করা, মুক্তি পাওয়া, অকপট, নিবেদিত হওয়া , ও ইবাদতের ক্ষেত্রে লৌকিকতা ত্যাগ করা।  ইখলাসের প্রতিশব্দ হিসেবে লিল্লাহিয়াত শব্দটি বহুল প্রচলিত, যার অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু করা।

ওলামা মাশায়েখদের দৃষ্টিতে ইখলাসঃ ইখলাস এর পরিচিতি নির্ণয়ে ওলামা মাশায়েখের বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়। নি¤েœ কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা ও অভিমত উপস্থাপন করা হলো।

             আবু ইয়াকুব আততুসী বলেন, الأخلاص سربين الله وبين العبد لا يعلمه ملك فيكتبه ولا شيطان فيفسده ولا هوى فيميله – ইখলাস হল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে এমন গোপন রহস্য যা ফেরেশতারা জানেনা, যে তারা লিখবে আর শয়তানও জানেনা যে সে নষ্ট করবে এবং অন্তর সে আমলের কারণে খুশিও হয় না।

             আল্লামা জুরজানি র. বলেন, الا خلاص الا تطلب لعملك شاهدا غير الله تعالى – ইখলাস বা লিল্লাহিয়াত হল তোমার আমলের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে স্বাক্ষী না খোঁজা।

             আল্লামা মানাবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

الاخلاص: تخليص القلب من كل شوب يكدر صفاءه فكل ما يتصور ان يشوبه غيره فاذا صفا عن شوبه وقليل الخلاص عن رؤية الاشخاص-

“ইখলাস হল অন্তরকে সকল প্রকারের কলুষতা থেকে মুক্ত করা তিনি আরো বলেন, ইখলাস হলো মানুষের দৃষ্টি থেকে আমল গুলো দূরে রাখা।

             হযরত জুনাইদ বাগদাদীকে ইখলাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন, “তোমার দৃষ্টিকে তোমার আমল বা কাজ থেকে তুলে নেয়া। ”

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও মূল বক্তব্য এক ও অভিন্ন তা হল বান্দার সকল আমল, ইবাদত-বন্দেগী লৌকিতা মূক্ত করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই সম্পাদন করাকে ইখলাস বলে।

ইখলাসের তাৎপর্যঃ ইখলাস কখনো দাবী কিংবা স্লোগান নির্ভর বিষয় হতে পারে না। বরং তা হল বান্দার অন্তরের এমন একটি অবস্থা যা সদা সর্বদা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনে নিয়োজিত আর এ ক্ষেত্রে সে কোন প্রশংসাকারীর প্রশংসা কিংবা নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা করে না। এ মহৎ গুনটি অর্জন করতে আহলুল্লাহ বা আউলিয়ায়ে কেরাম ও হাক্কানী ওলামা-মাশায়েখের সান্নিধ্যের বিকল্প নেই।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,- يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين – ‘হে মুমিনগণ! (তোমরা আল্লাহ কে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অর্ন্তভূক্ত হও’।  এ আয়াতে সাদেকীন (সত্যবাদীগণ) তথা আউলিয়ায়ে কেরামের সোহবত বা সংস্পর্শ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

প্রিয় নবীজী (দ:) বলেন,- مَثَلُ الجليس الصالحِ والجليسُ السوءِ كحامِلِ المسك، ونافخِ الكِيْرِ فحاملُ المسك: إِما أن يُحْذِيَكَ، وإِما أن تبتاع منه، وإِمَّا أن تجِدَ منه ريحا طيِّبة، ونافخُ الكير: إِما أن يَحرقَ ثِيَابَكَ، وإِما أن تجد منه ريحا خبيثَة- – সৎ সাথী ও মন্দ সাথীর উপমা মেশকধারী ও অগ্নিকুন্ডে ফুৎকার দানকারীর (কামারের) মত। মেশকধারী হয়ত তোমাকে কিছু সুগন্ধি দিবে কিংবা তুমি সুগন্ধি ক্রয় করবে আর এভাবে তুমি সুঘ্রাণ লাভ করবে। আর অগ্নিকু-ে ফুকদানকারী হয়ত তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে অথবা তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আজকের বিশ্বে হককানী আউলিয়ায়ে কেরাম ও ওলামা মাশায়েখগণের সান্নিধ্যের অভাবে, আহলে হাদীস, সালাফী, মওদুদী, নজদী, আই এস ও খারেজী প্রমুখ গুমরাহ তথাকথিত ইসলামী দলের আবির্ভাব। পক্ষান্তরে হক্কানী আউলিয়ায়ে কেরামের সান্যিধ্যধন্যদের গুমরাহ হওয়ার কোন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। যেহেতু তারাই হলেন মুমিনদের চৎধপঃরপধষ জীবনে ইখলাস জাগরনের উৎসমূল।

একটি প্রসিদ্ধ প্রবচন এই যে, النَّاسُ كُلُّهُمْ هلك إِلا الْعَالِمُونَ ، وَالْعَالِمُونَ كُلُّهُمْ هَلَكَ إِلا الْعَامِلُونَ ، وَالْعَامِلُونَ كُلُّهُمْ هلك إِلا الْمُخْلِصُونَ ، وَالْمُخْلِصُونَ عَلَى خَطَرٍ عَظِيمٍ – আলেমে দ্বীন ব্যতীত সাধারণ মানুষদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য। আলেমরাও ধ্বংস হবে আমলকারীরা বেঁেচ যাবে। আবার আমলকারীগণও ধ্বংস হয়ে যাবে তবে যারা ইখলাসের (খাঁটিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য) সাথে আমল করেছে তারা মুক্তি পাবে। অথচ খাঁটি আমলকারীরা আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকবেন।

ইমাম বুখারী তদীয় সহীহ গ্রন্থে ঈমান অধ্যায়ে উল্লেখ করেন- عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه ، قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : إنما الأعمال بالنيات وإنما لكل امرئ ما نوى ، فمن كانت هجرته إلى الله ورسوله ، فهجرته إلى الله ورسوله ، ومن كانت هجرته الى دنيا يصيبها أو امرأة ينكحها ، فهجرته إلى ما هاجر إليه  – আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) মিম্বরে আরোহন অবস্থায় বলেন, আমি আল্লাহর প্রিয় হাবিব (দ:) কে বলতে শুনেছি, আমল (সওয়াব) হবে নিয়্যত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়্যত করবে। অতএব, যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য বলে গন্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের আশায় কিংবা কোন নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়, তবে তার হিজরত যে উদ্দেশ্যে করে সে হিসেবে গণ্য হবে (প্রতিদান পাবে)।

ইমাম মারুফ কারখী (রহ:) বলেন,- من عمل للثواب فهومن التجار ومن عمل خوفا من النار طمعا فهو من العبد ومن عمل لله فهو من الاحرار وهى المرتبة العلياء- – যে ব্যক্তি নিছক সাওয়াবের উদ্দেশ্যে আমল করে সে তো ব্যবসায়ী। আর যে দোযখের ভয় কিংবা বেহেস্তের প্রত্যাশায় কোন নেকআমল করেন সে ক্রীতদাস। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যের আমল করেন সেই মূলত স্বাধীন। আর এটাই হলো একজন খাঁটি ইমানদারের জন্য সম্মানজনক মর্যাদা।

ইখলাসের গুরুত্বঃ ইখলাস হলো আন্তরিকতার সাথে কাজ করা, আর আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে এমন গোপন ব্যাপার যা কোন ফেরেশতা জানতে পারে না যে তিনি লিখবেন কোন শয়তানও নয় সে তা বিনষ্ট করবে কিংবা প্রবৃত্তি ও নয় যে তাকে অন্য কোন দিকে ধাবিত করবে।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার বাণী: وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين – ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্য বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্টভাবে তাঁর ইবাদত করতে’।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, الا لله الدين الخالص – ‘জেনে রেখ! অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য’।

রাসূলুল্লাহ (দ:) হযরত মুয়ায (রা.) কে বলেন, اخلص دينك يكفيك العمل القليل – ‘হে মুয়ায তুমি ইখলাসের সাথে আল্লাহর ইবাদত করবে, তাতে অল্প আমলই তোমার নাজাতে জন্য যথেষ্ট হবে’।

হাদীস শরীফে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمُ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ جَرِيءٌ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَـسُحِبَ عَـلَى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّار-

রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেছেন “সর্ব প্রথম বিচারের জন্য কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে, যে শহীদ হয়েছিল। সে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার যে সব নেয়ামত ভোগ করেছিল তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে এবং তা সে স্বীকার করবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে তুমি এসব নেয়ামতের বিনিময়ে কি আমল করেছ ? সে বলবে, হে আমার রব ! আমি তো তোমার দীনের জন্য জিহাদ করে শহীদ হয়েছি তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি তো জিহাদ করেছিলে বীর পুরুষ বলে অবিহিত হওয়ার জন্যে। তাতো তোমাকে বলা হয়েছে, তারপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ইলম শিখেছে এবং অপরকে শিখিয়েছে ও কুরআন পড়েছে, তাকে ও তার প্রদত্ত নিয়ামতের কথা স্বরণ করিতে দেওয়া হবে এবং সে তার স্বীকার করবে। সে বলবে, হে আমার রব আমি ইলম শিখেছি ও অপর কে শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করেছি আর আল্লাহ তায়ালা বলবেন তুমি মিথ্যা বলছো, বরং তোমার উদ্দেশ্য ছিল লোকেরা তোমাকে আলিম বলবে এবং কুরআন পড়েছ যাতে লোকেরা বলে যে একজন ক্বারী তা তো বলা হয়েছে, এরপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে আল্লাহর হুকুেম অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তি কে হাযির করা হবে যাকে আল্লাহ তা’য়ালা সর্ব প্রকার ধন-সম্পদ থেকে প্রচুর পরিমাণ দিয়েছেন তাকে ও তার নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। অত :পর আল্লাহ বলবেন, এ ব্যাপারে তুমি কি আমল করেছো ? সে বলবে হে আমার রব ! যেখানে দান করলে আপনি সন্তুষ্ট, আমি সে সব স্থানে দান-খয়রাত করেছি আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো, তুমি তো এই জন্য তা করেছো যাতে তোমাকে দাতা বলা হয়, তা তো বলা ও হয়েছে। আল্লাহর হুকুমে তাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

উপর্যুক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল ইখলাস ব্যতীত আল্লাহর রাস্তায় শাহাদত বা প্রাণ বিসর্জন, ইলমে দ্বীনের চর্চা ও দান খয়রাতের মত গুরুত্বপূর্ণ আমল কবুল করা হবে না বরং জাহান্নামে অধোমুখী করে প্রবেশ করানো হবে। আলোচ্য হাদীসে পাক হতে ইখলাসের অপরিসীম গুরুত্ব অনুমেয়।

অপর হাদীসে প্রিয় নবীজী (দ:) এরশাদ করেনঃ

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيمَا يَرْوِي عَنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ: قَالَ إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ ثُمَّ بَيَّنَ ذَلِكَ فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ عِنْدَهُ عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ إِلَى أَضْعَافٍ كَثِيرَةٍ وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি প্রিয় নবীজী (দ:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তার প্রতিপালক থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আল্লাহ ভাল এবং মন্দ লিখে রেখেছেন, তারপর তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন অতএব যে কেউ কোন সৎকাজের ইচ্ছা করে তা না করলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ণ আমলের সাওয়াব দান করেন। আর যদি সে সৎকাজের ইচ্ছা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে আল্লাহ তার জন্য দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত এমনকি এর চেয়েও অধিক সাওয়াব দান করেন। আর যে কেউ কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করার পর তা না করে, তবে আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে পূর্ণ নেক আমলের প্রতিদান দেন। আর যদি সে মন্দ কাজের ইচ্ছা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে ফেলে তাহলে আল্লাহ তার জন্য একটি মাত্র পাপ লিখেন।

আলোচ্য হাদীসে পাক থেকে প্রমাণিত হলো ইখলাস অনুযায়ী বান্দার ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র আমলের সাওয়াব অগণিত ও অপরিসীম হবে। পক্ষান্তরে করুনাময় আল্লাহ বান্দার গুনাহের বেলায় একটি মন্দ আমলের বিনিময়ে একটি গুণাহই মাত্র তার আমল নামায় যুক্ত করবেন।

ইখলাসের মর্যাদাঃ আমল ও ইবাদত বন্দেগী কবুল হওয়ার জন্য ইখলাসের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব ও মর্যাদা। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, আমি প্রিয় নবীজী (দ 🙂 কে বলতে শুনেছি, পূর্বেকার যুগে তিনজন ব্যক্তি কোন গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হল। পথিমধ্যে বৃষ্টি এসে পড়ল। তারা একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল অতঃপর একটি পাথর খন্ড গড়িয়ে এসে গুহার মুখ বন্ধ করে দিলে তারা পারস্পর বলতে লাগল তাদের নেক (খাটি) আমল কে ওয়াসিলা বানিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা ছাড়া এই কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

তাদের একজন দোয়া করল, হে আল্লাহ ! আমার পিতা- মাতা অত্যন্ত বৃদ্ধ, আমি আমার পরিবার পরিজনের আগেই তাদেরকে দুধ পান করতাম। একদিন আমাকে জ্বালানী কাঠের সন্ধানে অনেক দূরে যেতে হল; আর আমি যখন রাতে বাড়ি ফিরে এলাম, তখন দেখি আমার পিতা-মাতা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লেন, আমি দুধ নিয়ে যথারীতি তাদের নিকট গিয়ে দেখি তারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাদের ঘুম থেকে জাগানো আমি সমীচীন মনে করলাম না। আবার তাদের পান করানোর পূর্বে পরিবারের লোকদের দুধ পান করানো ও অনুচিত মনে হল। আমি পেয়ালা হাতে নিয়ে রাতভর পিতা-মাতার নিকট দাড়িয়ে রইলাম। তাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা ও সঙ্গত মনে করলাম না। এদিকে বাচ্চারা আমার পায়ের কাছে এসে ক্ষুধায় কাঁদছিল। এ অবস্থায় সকাল হয়ে গেল আর তারা ঘুম থেকে জেগে উঠলেন আমি তাদের দুধ পান করালাম হে আল্লাহ, আমি যদি এ কাজটি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে আমার ওপর থেকে পাথরের এই বিপদ দূর করে দাও। এতে পাথর খন্ড কিছুটা দূরে সরে গেল কিন্তু তারা গুহা থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারল না।

অপর ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল, আমার কাছে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুন্দরী বলে মনে হত (এক বর্ণনা মতে) তার সাথে আমার অসামান্য ভালবাসা ছিল্ পুরুষ, নারীকে যতটা ভালবাসতে পারে, আমি তাকে ততটুকু ভালবাসতাম। আমি তার সাথে কামনা চরিতার্থ করার আকাংখা করলাম। কিন্তু সে এতে সম্মত হলনা। অবশেষে এক দূর্ভিক্ষের বছরে অভাব মোচনের তাড়নায় সে আমার নিকট এল। আমি তাকে আমার সাথে নির্জনে মিলনের শর্তে একশত বিশটি স্বর্ণমুদ্রা দিলাম আমার প্রস্তাবে সে সম্মত হল। আমি তখন তাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে নিলাম। অন্য বর্ণনা মতে, আমি যখন তার দুই হাটুর মাঝখানে বসলাম, তখন সে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ওহে তুমি আল্লাহকে ভয় কর। অবৈধভাবে আমার সতিত্ব নষ্ট করো না। আমি তৎক্ষণাৎ মেয়েটিকে ছেড়ে চলে গেলাম। অথচ আমি মেয়েটিকে অত্যন্ত ভালবাসতাম। আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম তাও তার কাছে রেখে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজটি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে এই বিপদ থেকে আমাদেরকে মুক্তি দান কর। ফলে পাথর খন্ডটি আরো কিছুটা সরে গেল। কিন্তু এতেও তারা বের হতে সক্ষম হলো না।

তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ আমি কয়েকজন শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে ছিলাম। আমি তাদেরকে যথারীতি পারিশ্রমিক পরিশোধ করলাম। কিন্তু তাদের একজন পারিশ্রমিক কম মনে করে তা রেখে চলে গেল। আমি তার পারিশ্রমিককে ব্যবসায় বিনিয়োগ করলাম। এতে তার পারিশ্রমিকের অংক অনেক বেড়ে গেল। কিছুদিন পরে লোকটি পুনরায় আসল এবং আমাকে সম্বোধন করে বললো, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে আমার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। আমি তাকে বললাম, সামনে যত উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও চাকর-বাকর দেখছ, সবই তোমার পারিশ্রমিক। সে আমাকে বলল, হে আল্লাহর বান্দা আমার সাথে ঠাট্টা করো না। আমি তাকে বললাম আমি তোমার সাথে মোটেই ঠাট্টা করছি না। অত:পর সে সব মালামাল নিয়ে চলে গেলে এবং কিছুই অবশিষ্ট রেখে গেলনা। হে আল্লাহ, আমি যদি এই কাজটি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে আমাদের থেকে এ বিপদটা দূর করে দাও। অত:পর গুহার মুখ থেকে পাথরটি সরে গেল এবং তারা সকলেই বেরিয়ে আপন লক্ষ্যস্থলের দিকে চলে গেল।

উক্ত হাদীসে আলোচ্য তিন ব্যক্তির ইখলাসপূর্ণ নেক আমল গুলোর ওয়াসিলাই ছিল তাদের দুনিয়ার বিপদ হতে নাজাতের কারণ। তেমনিভাবে পরকালের মহা বিপদ হতে নাজাত পেতে হলে দরকার ইখলাস পূর্ণ আমল। যা বান্দাকে সর্বক্ষেত্রে সফলতা এনে দেয়। পক্ষান্তরে ইখলাস বিহীন আমলের বাহার বা স্লোগানের ফুলঝুরি যতই বেশি হোক না কেন তাতে সাময়িক ভাবে নিজেকে লাভবান মনে হলেও স্থায়ীত্বের বিবেচনায় তাকে দুনিয়াবী লাঞ্ছনা ও আযাবে ইলাহীর অপেক্ষায় থাকতে হবে। যার নজির ও উপমা ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। তাই প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ তিনি যেন আমাদেরকে লৌকিকতাপূর্ণ আমল (শিরক এ খফী) পরিহার করে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (দ:) এর সন্তুষ্টি অর্জন করার মত ইখলাসপূর্ণ আমলের তাওফীক দান করেন। আমিন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment