ইকামতে কখন দাড়াঁনো সুন্নাত? : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على اشرف المرسلين سيدنا محمد وعلى آل بيته الطيبين الطاهرين وأصحابه المنتجبين.
মহান আল্লাহতালা পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ করেন,
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
অর্থাৎ, সমস্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও। (সূরা বাকারাঃ ২৩৮)
নামাযের যে সকল হুকুম আহকাম রয়েছে সেগুলো যথাসময় সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমেই নামাযের আদব বা বিনয় প্রকাশ পায়। তেমনি নামাযে ইকামত এবং কাতার সোজা করার ব্যপারেও কিছু আদব রয়েছে। আমরা এখানে যা সংক্ষেপে আলোচনা করব তা হল-
ক) নামাযের কাতার সোজা করা ওয়াজিব।
এই ওয়াজিব আদায়ের সুন্নাত পদ্ধতি কখন..?(!)
খ) ইকামতের কোন সময় দাড়াঁনো মুস্তাহাব (উত্তম)।
গ) ওয়াজিব ও মুস্তাহাব উভয় আমল রক্ষাকরা কি আমাদের জন্য সাংঘর্ষিক নাকি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
▪ বুখারী শরীফে হযরত আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিতঃ
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ أَبِي قَتَادَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : «إِذَا أُقِيمَتْ الصَّلاَةُ فَلاَ تَقُومُوا حَتَّى تَرَوْنِي.»
অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ “নামাযের ইকামত হলে আমাকে না দেখা পর্যন্ত তোমরা দাঁড়াবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)
▪ সুনানে বায়হাকীতে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত,
عن أنس بن مالك أنه : إذا قيل : «قد قامت الصلاة وثب فقام»
অর্থাৎ, যখন ‘ক্বাদক্বামাতিস সালাহ’ বলা হত, তখন তিনি লাফদিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। {সুনানে বায়হাকী, ইবন মুনজির; আল আওসাত)
▪ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে হযরত আতিয়্যা রহ. থেকে বর্ণিতঃ
عن عطية قال: كنا جلوسا عند ابن عمر فلما أخذ المؤذن في الإقامة قمنا، فقال ابن عمر: «اجلسوا فإذا قال: قد قامت الصلاة فقوموا»
অর্থাৎ, আমরা ইবনে উমর রা. এর কাছে বসা ছিলাম। যখন মুয়ায্যিন ইকামত শুরু করল আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন ইবনে উমর রা. বললেনঃ তোমরা বস। মুয়ায্যিন যখন قد قامت الصلاة বলবে তখন দাঁড়াবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
▪ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় ইবরাহীম নাখায়ী রহ. এর আমল বর্ণিত হয়েছেঃ
«كان إذا قال المؤذن حي على الصلاة قام، فإذا قال قد قامت الصلاة كبر»
অর্থাৎ, যখন মুয়াজ্জিন حي على الصلاة বলত তখন তিনি (ইবরাহীম নাখায়ী রহ.) দাঁড়াতেন। আর যখন قد قامت الصلاة বলত তখন তাকবীর দিতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)
এ সসম্পর্কে প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের অভিমত
================================
ক) মালেকীঃ
———-
১। ইকামতের শুরু থেকে সমাপ্তির যে কোন সময়।
২। ইকামত শেষ করার পর।
ﻭﻗﺎﻝ ﻣﺎﻟﻚ ﻓﻲ اﻟﻤﻮﻃﺄ «ﻟﻢ ﺃﺳﻤﻊ ﻓﻲ ﻗﻴﺎﻡ اﻟﻨﺎﺱ ﺣﻴﻦ ﺗﻘﺎﻡ اﻟﺼﻼﺓ ﺑﺤﺪ ﻣﺤﺪﻭﺩ»
অর্থাৎ, ইমাম মালেক (রহ.) বলেছেন, নামাযের ইকামতের কোন পর্যায়ে মুসল্লিদের দাড়াঁতে হবে এ সম্পর্কে আমি কোন চূড়ান্ত হাদীস এ পর্যন্ত শুনিনি। (আউনুল মা’বুদ শরহে আবু দাউদ, ফতহুল বারী)
ﻭﺫﻫﺐ اﻷﻛﺜﺮﻭﻥ ﺇﻟﻰ ﺃﻧﻬﻢ «ﺇﺫا ﻛﺎﻥ اﻹﻣﺎﻡ ﻣﻌﻬﻢ ﻓﻲ اﻟﻤﺴﺠﺪ ﻟﻢ ﻳﻘﻮﻣﻮا ﺣﺘﻰ ﺗﻔﺮﻍ اﻹﻗﺎﻣﺔ»
অর্থাৎ, অধিকাংশ আলেমগণ (মালেকী) অভিমত দিয়েছেন যে, ইকামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইমাম ও মুসল্লিগণ দাড়াঁবেন না।
(শরহু মুওয়াত্তা; যুরকানী)
খ) শাফেয়ীঃ
———-
১। ইকামত শেষ করার সাথে সাথে।
«يستحب للإمام و الماموم أن لا يقوم حتى يفرغ المؤذن من الإقامة ، فإذا فرغ قاما متصلا بفراغه»
অর্থাৎ, ইমাম ও মুক্তাদির জন্য মুস্তাহাব যে, তারা মুয়াজ্জিন ইকামত শেষ করার আগে দাঁড়াবেনা। বরং শেষ করার সাথে সাথে দাঁড়াবে।
(আল মাজমু শরহুল মুহায্যাব)
গ) হাম্বলীঃ
———-
১। “ক্বাদ ক্বামাতিছ ছালাহ” বলার সময়।
«و يستحب أن يقوم إلى الصلاة عند قول المؤذن قد قامت الصلاة»
অর্থাৎ, মুয়াজ্জিন “ক্বাদ ক্বামাতিছ ছালাহ” বলার সময় নামাজে দাঁড়ানো মুস্তাহাব। (আল মুগনী)
ঘ) হানাফীঃ
———-
১। “হাইয়্যা আলাছ ছালাহ” বলার সময়।
২। “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” বলার সময়।
তবে হানাফী মাযহাবের তাহকিক হল, “হাইয়্যা আলাছ ছালাহ” বলার সময় দাড়াঁনো উত্তম।
«ويقوم الإمام والقوم عند حى على الصلاة»
অর্থাৎ, ইমাম এবং মুক্তাদিরা ‘হাইয়্যা আলাছ ছালাহ’ বললে নামাযের জন্য দাড়াঁবে। (শরহে বেকায়া)
পর্যালোচনা
============
এই মাস’আলায় ইকামতের কোন শব্দ শুনার পর মুসল্লিদের দাড়াঁতে হবে? এই বিষটির চেয়ে নামাযের জন্য ইমামের দাড়াঁনো প্রতি লক্ষ্য রেখে মুসল্লিদের দাড়াঁনোর বেশি গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়।
ইমাম যখন মসজিদে অবস্থান করবেন এবং নামাযের জন্য অগ্রসর হবেন কিংবা নামাযের মুসাল্লায় দাড়িঁয়ে যাবেন তখন মুসল্লিদেরও দাড়াঁনো সুন্নাত। এতে ইমামের তাজিম ও ইকামতে আদব উভয়টি পালন করা সম্ভব। ফলে ইমাম যদি “হাইয়্যা আলাছ ছালাহ” বলার সময় দাড়াঁন তাহলে মুসল্লিদেরও ইমামের দাড়াঁনোর আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখে একটি সুন্নাত মানা হল। অপরদিকে ইকামতের মুস্তাহাব আদায় হল। তখন আর বিষটি কেবল মুস্তাহাব হিসেবেই সম্পন্ন হলো না বরং সুন্নাতে হিসেবে বিবেচিত হয়েগেল।
কাতার কখন সোজা করা সুন্নাত?
========================
ইকামত প্রদানের পূর্ব থেকে দাড়িঁয়ে কাতার সোজা করার ব্যাপারে কোন হাদীসে বা কোন মাযহাবের ইমামই বিশেষভাবে সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করেন নাই। (ইকামতে শুরু থেকে কথা আছে কিন্তু পূর্ব থেকে কাতার সোজা করা এমনটা নেই)।
তাই ইকামতের পূর্বে কাতার সোজা করার এই অজুহাত দেয়া উচিৎ নয় যে, “কাতার সোজা করা ওয়াজিব তাই আমরা ইকামতের মুস্তাহাব (সুন্নাত) ত্যাগ করে কাতার সোজা করার মত ওয়াজিব পালন করি” (!!!)
বরং কাতার সোজা করার ব্যাপারে দুটি পদ্ধতি রয়েছে,
একঃ রাসূলাল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে কাতার সোজা করতেন ইকামতের সময়। তাই
▪ ইমাম বুখারী রহ. তাঁর সহীহ বুখারীতে শিরোনাম এনেছেন,
بَاب مَتَى يَقُومُ النَّاسُ إِذَا رَأَوْا الْإِمَامَ عِنْدَ الْإِقَامَةِ
অর্থাৎ, ইকামতের সময় ইমামকে দেখলে লোকেরা কখন দাঁড়াবে?
باب تَسْوِيَةِ الصُّفُوفِ عِنْدَ الإِقَامَةِ وَبَعْدَهَا
অর্থাৎ, “ইকামতের সময় এবং এর পরে কাতার সোজা করা।”
▪ হযরত আবূ ক্বাতাদাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত,
«إِذَا أُقِيمَتْ الصَّلاَةُ فَلاَ تَقُومُوا حَتَّى تَرَوْنِيومُوا حَتَّى تَرَوْنِي»
অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ “নামাযের ইকামত হলে আমাকে না দেখা পর্যন্ত তোমরা দাঁড়াবে না।” (বুখারী শরীফ)
▪ এবং হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত,
قَالَ أُقِيمَتِ الصَّلاَةُ فَأَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِوَجْهِهِ فَقَالَ
«أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ وَتَرَاصُّوا، فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي»
তিনি বলেন, সালাত এর ইকামত হচ্ছে, এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে মুখ করে তাকালেন এবং বললেনঃ “তোমরা কাতার গুলো সোজা করে নাও আর মিলে দাড়াও। কেননা, আমি আমার পেছনের দিক থেকেও তোমাদের দেখতে পাই।” (বুখারী শরীফ)
তাহলে বুঝা যাচ্ছে ইকামতে কাতার সোজা করার কথা বলা হয়েছে আর এটাই সুন্নাত নিয়ম।
দুইঃ বর্তমানে প্রায় সকল মসজিদেই কাতার চিহ্ন দেয়া থাকে।
তাই কাতার সোজা করার ব্যাপারে মুসল্লিগন পূর্বথেকেই সতর্ক থাকেন আর না থাকলে মসজিদে বসার আদব সম্পর্কে ইমাম সাহেব মুসল্লিদের পূর্বে আলোচনা করে শুনাবেন।
মুসল্লিদের মধ্যে যদি কেউ অসতর্কতাবশত কাতার ভঙ্গ করে বসে থাকেন কিংবা যদি খোলা মাঠ বা বড় কোন মাহফিলে অধিক সংখক মুসল্লিদের সমাগম হয় যাতে কাতার সোজা করা ইকামতের সময় সীমার ভেতরে সম্ভব না হয় তাহলে ইকামতের পূর্বে কাতার সোজা করে মুসল্লিদের বসিয়ে তারপর ইকামত শুরু করলে কাতার সোজা করার ওয়াজিব আমল ও সাথে ইকামতে দাড়াঁনোর সুন্নাত উভয়টি আশাকরি অত্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করা সম্ভব হবে। অপর দিকে একটি বিলুপ্তপ্রায় সুন্নাত আমল প্রচলনের জন্য একশত শহীদের সাওয়াব লাভ হবে। (আল্লাহ অধিক ভাল জানেন)।
আল্লাহতালা আমাদের ফিতনা থেকে রক্ষা করে সুন্নাতের উপর আমল এবং বিদ’আত থেকে বেচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।