ভূমিকা-
মূল কিতাব পাঠ-পর্যালোচনার পূর্বে নিম্নলিখিত নীতিমালা অতি উত্তমরূপে পাঠ-পর্যালোচনা করে মুখস্থ করে নিন। এ নিয়ম-নীতিগুলো অতি উপকারী।
নিয়ম নং-১
‘ইসনাদ’ অনুসারে হাদীসের বহু প্রকার রয়েছে; কিন্তু আমি শুধু তিনটি প্রকারের আলোচনা করবো: ক. হাদীস-ই সহীহ্, খ. হাদীস-ই হাসান এবং গ. হাদীস-ই দ্ব‘ঈফ।
প্রত্যেকটার সংজ্ঞা নিন্মরূপ
সহীহ্ ওই হাদীসকে বলা হয়, যা’তে চারটি বৈশিষ্ট্য আছে-
১. সেটার সনদ ‘মুত্তাসিল’ হয়; অর্থাৎ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে আরম্ভ করে কিতাব প্রণয়নকারী পর্যন্ত কোন বর্ণনাকারী কোথাও বাদ পড়েনি।*
২. সেটার সমস্ত বর্ণনাকারী প্রথম পর্যায়ের মুত্তাক্বী-পরহেযগার হন, কেউ ফাসিক্ব (পাপাচারী) কিংবা এমন না হন, যাঁর অবস্থাদি অস্পষ্ট ও গোপন।
৩. সমস্ত বর্ণনাকারী অত্যন্ত প্রখর স্মরণশক্তিসম্পন্ন হন; কারো স্মরণশক্তি অসুস্থতা কিংবা বার্দ্ধক্যের কারণে দুর্বল হবে না এবং
৪. ওই হাদীস ‘শায’ অর্থাৎ ‘মাশহুর’ হাদীসগুলোর বিপরীত হবে না।
হাসান ওই হাদীসকে বলা হয়, যার কোন বর্ণনাকারীর মধ্যে এ গুণাবলী সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেই; অর্থাৎ কারো তাক্বওয়া (খোদাভীরুতা) অথবা স্মরণশক্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ের নয়।
দ্ব‘ঈফ (দুর্বল) হচ্ছে ওই হাদীস, যার কোন একজন বর্ণনাকারীও মুত্তাক্বী ও প্রখর স্মরণশক্তি বিশিষ্ট নন। অর্থাৎ যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য ‘সহীহ্ হাদীস’-এর মধ্যে বিবেচিত ছিলো, ওইগুলো থেকে কোন একটি গুণ থাকে না।
নিয়ম নং- ২
প্রথম দু’ প্রকার, অর্থাৎ ‘সহীহ্’ ও ‘হাসান’ ‘আহকাম’ (বিধানাবলী) ও ‘ফযা-ইল’ (ফযীলতসমূহ) উভয়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য; কিন্তু হাদীস-ই দ্ব‘ঈফ (দুর্বল হাদীস) শুধু ফযীলতসমূহের মধ্যে গ্রহণযোগ্য; ‘আহকাম’ (বিধানাবলী)-এ গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ তা দ্বারা হালাল কিংবা হারাম প্রমাণিত হবে না। অবশ্য, আমলসমূহ অথবা কারো মহত্ব ও ফযীলত প্রমাণিত হতে পারে।
ফলশ্রুতি
‘দ্ব‘ঈফ’ বা দুর্বল হাদীস মিথ্যা, ভুল ও বানোয়াট হাদীসকে বলা হয় না, যেমনটি গায়র মুক্বাল্লিদ (লা-মাযহাবী)গণ সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল করে দিয়েছে; ফলে লোকেরাও সেটাকে গলধকরণ করে রেখেছে, বুঝে বসেছে; বরং মুহাদ্দিসগণ নিছক সতর্কতার ভিত্তিতে এ হাদীসের মর্যাদাকে প্রথম দু’ প্রকারের হাদীস থেকে কিছুটা কম রেখেছেন।
নিয়ম নং-৩
যদি ‘দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল) হাদীস কোন কারণে ‘হাসান’ পর্যায়ের হয়ে যায়, তবে সেটাও নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। তখন তা দ্বারা ‘আহকাম’ ও ‘ফযাইল’ সবই প্রমাণিত হতে পারে।
নিয়ম নং-৪
নি¤œলিখিত ব¯ুÍগুলোর মাধ্যমে ‘দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল) হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ের হয়ে যায়:
১. দুই কিংবা ততোধিক সনদে বর্ণিত হওয়া; যদিও ওই সনদগুলোও দুর্বল (দ্ব‘ঈফ) হয়। অর্থাৎ যদি একটি হাদীস কয়েকটা দুর্বল সনদেও বর্ণিত হয়ে যায়, তবে তখন সেটা আর দ্ব‘ঈফ বা দুর্বল থাকে না; ‘হাসান’ পর্যায়ের হয়ে যায়।
[সূত্র. মিরক্বাত, মওদ্বূ‘আত-ই কবীর; শামী, মুক্বাদ্দামা-ই মিশকাত শরীফ, কৃত. মাওলানা আবদুল হক্ব, রিসালাহ্-ই উসূল-ই হাদীস, কৃত, আল্লামা জুরজানী, তিরমিযী শরীফ প্রথম খন্ড ইত্যাদি] ২. কামিল আলিমদের আমল দ্বারা দ্ব‘ঈফ হাদীস ‘হাসান’ হয়ে যায়। অর্থাৎ যদি দ্ব‘ঈফ হাদীস অনুসারে ওলামা-ই দ্বীন আমল করতে আরম্ভ করেন, তবে তা ‘দ্ব‘ঈফ’ থাকেনা, ‘হাসান’ হয়ে যায়। এজন্য ইমাম তিরমিযী বলেছেন-
هذَا الْحَدِيْثُ غَرِيْبٌ ضَعِيْفٌ وَالْعَمَلُ عَلَيْهِ عِنْدَ اَهْلِ الْعِلْمِ
অর্থাৎ এ হাদীস তো ‘গরীব’ অথবা ‘দ্ব‘ঈফ’; কিন্তু বিজ্ঞ আলিমদের এটা অনুসারে আমল রয়েছে।
ইমাম তিরমিযীর এ কথার মর্মার্থ এ নয় যে, ‘এ হাদীস ‘দ্ব‘ঈফ, আমলযোগ্য নয়; কিন্তু উম্মতের বিজ্ঞ আলিমগণ বোকামী করে তদনুসারে আমল করে ফেলেছেন এবং সবাই পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেন’ বরং মর্মার্থ এ যে, হাদীসটি ‘সনদ’ অনুসারে দুর্বল ছিলো; কিন্তু উম্মতের বিজ্ঞ আলিমদের আমল দ্বারা শক্তিশালী হয়ে গেছে।
৩. আলিমদের অভিজ্ঞতা ও ওলীগণের কাশ্ফ দ্বারা ‘দ্ব‘ঈফ হাদীস’ শক্তিশালী হয়ে যায়। শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী একটি হাদীস শুনেছিলেন- ‘যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার কলেমা তাইয়্যেবাহ্ পাঠ করবে তার মাগফিরাত হয়ে যাবে।’ একবার এক যুবক বললো, ‘‘আমি আমার মারহুম মাকে দোযখে দেখতে পাচ্ছি।’’ শায়খ সত্তর হাজার বার কলেমা তৈয়্যবাহ্ পড়ে রেখেছিলেন। তিনি মনে মনে ওই কলেমাগুলো তার মাকে দান করে দিলেন। তিনি দেখলেন যুবকটি তখনই হেসে উঠলো আর বললো, ‘‘আমি আমার মাকে জান্নাতে দেখতে পাচ্ছি।’’ হযরত শায়খ বলেছেন, ‘‘আমি এ হাদীসের ‘সহীহ্ হওয়া’ এ ওলীর কাশ্ফ থেকে জানতে পেরেছি।’’ (সহীহুল বিহারী) মাওলানা মুহাম্মদ ক্বাসেম নানূতবী তার লিখিত কিতাব ‘তাহযীরুন্নাস’-এ এ ঘটনা হযরত জুনায়দ রাহমাতুল্লাহির বলে উল্লেখ করেছেন।
নিয়ম নং-৫
সনদ ‘দুর্বল’ হলে হাদীসের মতন (বচনগুলো) দুর্বল হওয়া অপরিহার্য হয় না। সুতরাং এমনটিও যে, এক হাদীস এক সনদে ‘দুর্বল’ হলেও অন্য সনদে ‘হাসান’ হতে পারে আর তৃতীয় সনদে ‘সহীহ্’ও হতে পারে। এ কারণে ইমাম তিরমিযী এক হাদীস সম্পর্কে বলেছেন- هذَا الْحَدِيْثُ حَسَنٌ صَحِيْحٌ غَرِيْبٌ (অর্থাৎ এ হাদীস হাসান, সহীহ্, গরীব)। ইমাম তিরমিযীর এ কথার মর্মার্থ হচ্ছে- এ হাদীস কয়েকটা সনদে বর্ণিত। এক সনদে ‘হাসান’, দ্বিতীয় সনদে ‘সহীহ্’ এবং তৃতীয় সনদে ‘গরীব’।
নিয়ম নং-৬
পরবর্তী বর্ণনাকারীর দুর্বলতা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস কিংবা মুজতাহিদদের জন্য ক্ষতিকারক নয়। সুতরাং যদি এক হাদীস ইমাম বোখারী কিংবা তিরমিযী ‘দ্ব‘ঈফ’ হিসেবে পেয়েছেন, কেননা, তাতে এক বর্ণনাকারী ‘দ্ব‘ঈফ’ অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তখন হতে পারে ওই হাদীসকে ইমাম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সহীহ্ সনদে পেয়েছেন। তাঁর যুগ পর্যন্ত ওই দুর্বল বর্ণনাকারী সেটার সনদে অন্তর্ভুক্ত হননি। সুতরাং কোন ওহাবীর পক্ষে একথা প্রমাণ করা সহজ নয় যে, ইমাম আ’যমও এ হাদীসকে ‘দুর্বল’ হিসেবে পেয়েছেন।
মজার কথা
একদা এক ওহাবী গায়র মুক্বাল্লিদের সাথে ‘ইমামের পেছনে ক্বিরআত পড়া’ বিষয়ে আমার মা’মুলী বিতর্ক হলো। আমি নি¤œলিখিত হাদীস পেশ করলাম-قِرَأَةُ الْاِمَامِ لَه قِرَأَةٌ (ইমামের ক্বিরাআত মুক্বতাদীর ক্বিরাআত)। ওহাবীটা বললো, ‘‘এ হাদীস ‘দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল)। সেটার সনদে ‘জাবির জুহানী’ আছে; যিনি দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল)।’’ আমি বললাম, ‘‘জাবির জুহানী কখন জন্মগ্রহণ করেছেন, যার কারণে এ হাদীস দুর্বল হলো?’’ সে লাফিয়ে ওঠে বললো, ‘‘৩৩৫হিজরীতে।’’ আমি বললাম, ‘‘যখন ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এ হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করেছিলেন, তখন জাবির তার পিতার পৃষ্ঠদেশেও আসেননি। কেননা, ইমামে আ’যমের জন্ম হয়েছে ৮০ হিজরিতে আর ওফাত হয়েছে ১৫০ হিজরিতে। সুতরাং তখন এ হাদীস শরীফ একেবারে সহীহ্ ছিলো। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ সেটাকে দ্ব‘ঈফ (দুর্বল) হিসেবে পেয়েছেন।’’ ওহাবীটা এর কোন জবাব দিতে পারে নি। জবাব না দিয়েই মারা গেছে।
সুতরাং হানাফী আলিমদের একথা মনে রাখা দরকার যে, তাঁরা যেন ওহাবীদেরকে ‘দ্ব‘ঈফ’ ‘দ্ব‘ঈফ’ বলা থেকে রুখে দেন, দুর্বলতার কারণ জিজ্ঞাসা করেন, তারপর এর উপর গবেষণা করেন যে, দুর্বলতা ইমাম আ’যমের পূর্বেকার, না পরবর্তীর? ইনশা-আল্লাহ্, ওহাবীজ্বী পানি চেয়ে বসবে এবং ‘দ্ব‘ঈফ, ‘দ্ব‘ঈফ’ বলার সবক ভুলে যাবে। কেননা, ইমামে আ’যমের যুগ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর যুগের একেবার কাছে। ওই সময় হাদীস খুব কম ‘দ্ব‘ঈফ’ ছিলো। ইমামে আ’যম হলেন তাবে‘ঈ।
নিয়ম নং-৭
‘জরহে মুবহাম’ (অনির্দিষ্ট ত্রুটিনির্ণয়) গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ হাদীসের কোন সমালোচক, বিশেষতঃ ইবনে জূযী প্রমুখের একথা বলে ফেলা যে, ‘অমুখ হাদীস অথবা বর্ণনাকারী দুর্বল, অনির্ভরযোগ্য’ যতক্ষণ পর্যন্ত একথা বলেন না কেন দুর্বল? এবং ওই বর্ণনাকারীর কি দুর্বলতা আছে? কেননা, দুর্বলতার কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ইমামগণের মতবিরোধ থাকে। একটা বিষয়কে কোন মুহাদ্দিস দোষ মনে করেন, অন্যজন তা দোষ মনে করেন না। দেখুন ‘তাদলীস’, ‘ইরসাল’, ঘোড়া দৌঁড়ানো, ঠাট্টা-মযাক করা, অল্প বয়স্ক হওয়া ও ফিক্বহ্ নিয়ে মগ্ন থাকাকে কোন কোন মুহাদ্দিস বর্ণনাকারীর দোষ হিসেবে বিবেচনা করেন; কিন্তু হানাফী ইমামগণের মতে ওইগুলোর মধ্যে কোনটাই দোষ নয়।[নূরুল আন্ওয়ার: হাদীসের সমালোচনা শীর্ষক আলোচনা]
নিয়ম নং-৮.
যদি জরহ্ ও তা’দীল (যথাক্রমে, পরস্পর বিরোধ নির্ণয় ও উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান)-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়, তবে তা’দীল-ই গ্রহণযোগ্য, ‘পরস্পর বিরোধ’ নয়। অর্থাৎ এক বর্ণনাকারীকে কোন মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন, অন্য কেউ শক্তিশালী বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন; কোন ইতিহাস দ্বারা তাঁর পাপাচারিতা প্রমাণিত হলো, আর অন্য কেউ বললেন, তিনি মুত্তাক্বী, সৎকর্মপরায়ণ ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁকে মুত্তাক্বী (খোদাভীরু) বলে বিবেচনা করা হবে এবং তাঁর বর্ণনা দুর্বল হবে না। কেননা, মু’মিনের মধ্যে তাক্বওয়া থাকাই আসল বা মূল কথা।
নিয়ম নং-৯
কোন হাদীস সহীহ্ না হলে, সেটা দুর্বল হওয়া অনিবার্য হয় না। সুতরাং যদি কোন মুহাদ্দিস কোন হাদীস সম্পর্কে একথা বলে ফেলেন, ‘‘এটা সহীহ্ নয়’’ সেটার অর্থ এ নয় যে, সেটা দুর্বল। হতে পারে যে, ওই হাদীস ‘হাসান’। ‘সহীহ্’ ও ‘দ্ব‘ঈফ’-এর মধ্যবর্তীতে অনেক স্তর রয়েছে।
নিয়ম নং-১০
সহীহ্ হাদীসের ভিত্তি মুসলিম, বোখারী কিংবা সিহাহ্ সিত্তার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সিহাহ্ সিত্তাহকে সহীহ্ বলার মর্মার্থ-এ নয় যে, সেগুলোর সমস্ত হাদীসই সহীহ্, ওইগুলো ব্যতীত অন্যান্য কিতাবের সমস্ত হাদীস ‘দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল); বরং মর্মার্থ শুধু এটাই যে, ওইগুলোর মধ্যে সহীহ্ হাদীস বেশী। আমাদের ঈমান হুযূর মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর রয়েছে; নিছক বোখারী, মুসলিম ইত্যাদির উপর নয়; হুযূর-ই আক্রামের হাদীস যেখান থেকেই পাওয়া যাক, তা আমাদের মাথা ও চোখের উপর; তা বোখারীতে থাকুক, কিংবা না-ই থাকুক।
আশ্চর্যবোধ হয় গায়র মুক্বাল্লিদ (লা-মাযহাবী)-দের উপর! তারা ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর তাক্বলীদ করাকে শির্ক সাব্যস্ত করে; কিন্তু মুসলিম ও বোখারীর উপর এমনভাবে ঈমান রাখে এবং তাঁদের এমন অন্ধ তাক্বলীদ বা অনুসরণ করে যে, আল্লাহরই পানাহ্!
নিয়ম নং-১১.
কোন বিজ্ঞ আলিম ফক্বীহ্ মুহাদ্দিসের কোন হাদীসকে কোনরূপ আপত্তি ছাড়া গ্রহণ করে নেওয়া ওই হাদীস শক্তিশালী হবার প্রমাণ। যদি কোন ফক্বীহ্ আলিম মুজতাহিদ কোন দ্ব‘ঈফ হাদীসকে কবূল করে নেন, তবে তা দ্বারা ওই দুর্বল হাদীস শক্তিশালী হয়ে যায়। ওয়ালী উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ খতীব তারবীযী, মিশকাত শরীফের প্রণেতা মহোদয় মিশকাত শরীফের ভূমিকায় লিখেছেন-
وَاِنِّىْ اِذَا اَسْنَدْتُّ الْحَدِيْثَ اِلَيْهِمْ كَأَنِّىْ اَسْنَدْتُّ اِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
অর্থ: আমি যখন হাদীসকে ওইসব মুহাদ্দিসের দিকে সম্পৃক্ত করেছি, তখন যেন সেটাকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে সম্পৃক্ত করেছি।
এসব নিয়ম থেকে আপনারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে, ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যেসব হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন, সেগুলোর কোনটা দুর্বল হতে পারে না। কারণ, সেগুলো অনুসারে উম্মতের আমল রয়েছে। সেগুলোকে বিজ্ঞ আলিম ও ফক্বীহ্গণ গ্রহণ করে নিয়েছেন। ওইগুলোর প্রতিটি হাদীস অনেক সনদে বর্ণিত হয়েছে। আমি অধম, আল্লাহর মুখাপেক্ষী, ইনশা-আল্লাহ্, প্রত্যেক মাসআলার পক্ষে অনেক হাদীস পেশ করবো, যেগুলো থেকে কোন হাদীসকে দুর্বল (দ্ব‘ঈফ) বলা যেতে পারে না, কেননা, সনদগুলোর আধিক্য ‘দ্ব‘ঈফ’কেও ‘হাসান’ করে দেয়।
নিয়ম নং-১২
যদি হাদীস ও ক্বোরআনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দৃষ্টিগোচর হয়, তবে হাদীসের অর্থ এভাবে করা চাই যেন উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়, দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। অনুরূপ যদি হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী বলে মনে হয়, তবে সেগুলোর এমন অর্থ করা দরকার, যেন বিরোধ না থাকে এবং সবকটি অনুসারে আমল করা যায়। এর উদাহরণ হচ্ছে এ-ই, মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন- فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ তরজমা: যে পরিমাণ ক্বোরআন মজীদ সহজ হয় ততটুকু নামাযে পড়ে নাও। কিন্তু হাদীস শরীফে শরীফে আছে- لاَ صَلٰوةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ
অর্থ: যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়েনি, তার নামায হয়নি।
এ হাদীসকে ওই আয়াতের বিরোধী বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং হাদীসের অর্থ এভাবে করো- ‘সূরা ফাাতিহা ব্যতীত নামায পূর্ণাঙ্গ হয় না।’ যে কোন ক্বিরাআত (مطلقا) নামাযে ফরয। আর সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব। সুতরাং পারস্পরিক বিরোধ দূর হয়ে গেলো। আর ক্বোরআন ও হাদীস উভয়টি অনুসারে আমলও হয়ে গেলো। অনুরূপ, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন-وَاِذَا قُرِءَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا لَه وَاَنْصِتُوْا তরজমা: যখন ক্বোরআন পাঠ করা হয়, তখন তা কান লাগিয়ে শোনো এবং নিশ্চুপ থাকো। কিন্তু হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- لاَ صَلوٰةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ অর্থ: যে সূরা ফাতিহা পড়ে না, তার নামায হয় না।
এ হাদীসকে ও-ই আয়াতের বিপরীত বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ক্বোরআন নিঃশর্তভাবে (সম্পূর্ণ) নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দিচ্ছে। আর হাদীস শরীফ মুক্বতাদীকে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। সুতরাং এটা মেনে নাও যে, ‘ক্বোরআনের হুকুম শর্তহীন (مطلق) আর হাদীস শরীফের হুকুম একাকী নামায সম্পন্নকারী অথবা ইমামের জন্য প্রযোজ্য।’ মুক্বতাদীদের জন্য ইমামের ক্বিরাআত যথেষ্ট; অর্থাৎ এটা তার জন্য ক্বিরাআত বলে বিবেচ্য হবে। মোটকথা, এ নিয়ম অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি কোন হাদীসকে ক্বোরআনের আয়াতের অথবা এর পূর্বে উল্লিখিত হাদীসের এমন বিরোধী হিসেবে পাওয়া যায় যে, কোনভাবেই সামঞ্জস্য হতে পারছে না, তখন ক্বোরআন-ই করীম অথবা ইতোপূর্বে উল্লিখিত হাদীসকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর এ হাদীস অনুসারে আমল করা যাবে না; এ হাদীসকে ‘মানসূখ’ (রহিত) বলে ধরে নিতে হবে। অথবা সেটাকে হুযূর-ই আক্রামের বিশেষত্বের মধ্যে গণ্য করতে হবে। এর বহু উদাহরণও রয়েছে।
নিয়ম নং ১৩.
হাদীস শরীফ দুর্বল হয়ে যাওয়া গায়র মুক্বাল্লিদদের জন্য ক্বিয়ামত তুল্য। কেননা, তাদের মাযহাবের ভিত্তি ওই বর্ণনাগুলোর উপরই প্রতিষ্ঠিত। বর্ণনা (হাদীস) দুর্বল হলে তো তাদের মাসআলাও বিলীন হয়ে গেলো; কিন্তু তা হানাফীদের জন্য কোন মতে ক্ষতিকর নয়; কেননা, হানাফীদের দলীল এ বর্ণনাগুলো নয়; তাঁদের দলীল হচ্ছে শুধু ইমামেরই অভিমত। ইমামের অভিমতের সমর্থক হচ্ছে- এ বর্ণনাগুলো। অবশ্য ইমামের দলীল হচ্ছে ক্বোরআন ও হাদীস। কিন্তু ইমাম সাহেব যখন হাদীসগুলো পেয়েছেন, তখন তো সেগুলো সহীহ্ ছিলো; কারণ, সেগুলোর সনদ এগুলো ছিলোনা, যেগুলো ইমাম বোখারী ও মুসলিমেরই রয়েছে। যদি পুলিশ অপরাধীকে জেলে পুরে দেয়, তবে পুলিশের দলীল হয় হাকিমের রায়; পাক-বাংলা-ভারতের দন্ডবিধির ধারাগুলো নয়। অবশ্য হাকিমের দলীল কিন্তু এ ধারাগুলো। এ কথা স্মরণ রাখো। ‘তাক্বলীদ’ হচ্ছে আল্লাহ্র রহমত। আর গায়র মুক্বাল্লিদ হওয়া মহান রবের আযাবই। [মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আলায়হির রাহমাহ্]