আহলে সুন্নাহর দৃষ্টিতে মিলাদুন্নাবি (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ঃ
[কুরআন ও হাদীসের আলোকে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন দিবস) উদযাপনের বৈধতা ও এতদসংক্রান্ত ইসলামী বিধান]
এটি সত্য যে ঈদে মীলাদুন্নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর সময় শয়তান ও তার সহযোগীরা ছাড়া সবাই দিনটিকে উদযাপন করেন; কেননা, শয়তান চার বার উচ্চস্বরে কেঁদেছিল – প্রথমবার যখন আল্লাহতা’লা তাকে অভিশপ্ত আখ্যা দেন; দ্বিতীয়বার যখন তাকে বেহেশ্ত থেকে বের করে দেয়া হয়; তৃতীয়বার যখন মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন হয়; এবং চতুর্থবার যখন সূরা ফাতেহা নাযেল তথা অবতীর্ণ হয় [ইবনে কাসীর কৃত আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ২য় খণ্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠা]।
নোট: ওপরের বর্ণনা একটি ছোট-খাটো ভূমিকামাত্র। পাঠ করা জরুরি কাতে’য়ী তথা প্রামাণিক ও সুস্পষ্ট দলিল-আদিল্লা নিচে পেশ করা হবে, ইনশা’আল্লাহ।
মুসলমান সর্বসাধারণ মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদত দিবস খুশি মনে উদযাপন করেন এই কারণে যে আল্লাহ পাক তাঁর ‘ফযল (অনুগ্রহ) ও রহমত (করুণা)’ প্রাপ্তিতে আমাদেরকে আদেশ করেছেন খুশি হতে। নিচের লেখনীর ভিত্তি হবে
(ক) কুরআন মজীদ ও এর তাফসীর (ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ);
(খ) হাদীস শাস্ত্র;
(গ) প্রসিদ্ধ আলেম-উলেমা ও ফেকাহবিদদের বক্তব্য; এবং
(ঘ) মীলাদুন্নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তির খণ্ডন।
ক. আল-কুরআন ওয়াল ফুরকান ও এর তাফসীরের মাধ্যমে উপলব্ধি
আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে বলেন,
”(হে রাসূল) আপনি বলুন: আল্লাহর ফযল (অনুগ্রহ) ও তাঁরই রহমত (দয়া/করুণা), তাতে তাদের (মো’মেন মুসলমানদের) খুশি প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলতের চেয়েও শ্রেয়।” (সূরা ইউনুস, ৫৮ আয়াত)
কেউ কেউ হয়তো কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে ভাবতে পারেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর ধরণীর বুকে শুভাগমন কোনো খোদায়ী করুণা নয়; আরও কেউ কেউ মিথ্যেভাবে আল্লাহর রহমতের ভাণ্ডারকে সীমাবদ্ধ করতে চান এই বলে যে, আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত ‘রহমত’ দ্বারা হুযূর পূর নূর (দ:)-কে উদ্দেশ্য করা হয় নি, আর তাই আমাদের খুশি/আনন্দ উদযাপন করা উচিত নয়। এমতাবস্থায় এই সমস্ত লোকদের জন্যে সেরা জবাব হবে কুরআনের আয়াত দ্বারা আয়াতের তাফসীর করা।
আল-কুরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,
”(হে রাসূল), আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি জগতসমূহের জন্যে আমার রহমত (করুণা) করে।” (সূরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত)
অতএব, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো যে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর ধরণীর বুকে শুভাগমন কেবল আমাদের জন্যেই রহমত নয়, বরং আল্লাহ পাকের সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্যেও তা রহমত। তাই কুরআনের (১০:৫৮) নির্দেশ মোতাবেক আমাদের তা উদযাপন করতে হবে।
ইমাম ইবনুল জাওযী নিজ ‘তাফসীর’গ্রন্থে সূরা ইউনূসের উক্ত ৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আদ্ দাহাক হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: এই আয়াতে ‘ফযল’ বলতে জ্ঞান (অর্থাৎ, আল-কুরআন ও তাওহীদ)-কে বুঝিয়েছে; আর ‘রহমত’ বলতে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে বোঝানো হয়েছে।” [ইবনে জাওযী কৃত ‘যা’দ আল-মাসীর ফী এলম আত্ তাফসীর’, ৪:৪০]
ইমাম আবু হাইয়ান আন্দালুসী এ সম্পর্কে বলেন, “ফযল বলতে জ্ঞানকে, আর রহমত বলতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।” [তাফসীর আল-বাহর আল-মুহীত, ৫:১৭১]
ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:) বলেন, “আবু শায়খ হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহর ফযল বলতে জ্ঞানকে, আর রহমত বলতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন, (হে রাসূল) আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি জগতসমূহের জন্যে আমার রহমত (করুণা) করে (সূরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত)।” [আস্ সৈয়ুতী প্রণীত দুররে মনসূর, ৪:৩৩০]
আল্লামা আলূসী ব্যাখ্যা করেন যে এমন কি ‘ফযল’ (অনুগ্রহ) বলতেও হযূর পাক (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যেমনিভাবে বর্ণিত হয়েছে আল-খতীব ও ইবনে আসাকির থেকে যে আয়াতোক্ত ‘ফযল’ হলেন মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) । [আলূসী রচিত রূহুল মাআনী, ১১:১৪১]
কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে,
”এটি আল্লাহর অনুগ্রহ; যাকে চান দান করেন; এবং আল্লাহ বড় অনুগ্রহশীল।” (সূরা জুমু’আহ্, ৪ আয়াত)
আয়াতের শেষাংশে ‘আল্লাহ বড় (অশেষ) অনুগ্রহশীল’ বাক্যটিকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) ব্যাখ্যা করেন এভাবে:
আল্লাহর অনুগ্রহ অফুরন্ত, যেহেতু তিনি মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে ইসলাম ও নবুয়্যত দান করেছেন; এও বলা হয়েছে যে এর মানে ঈমানদারদের প্রতি তিনি ইসলামের নেয়ামত বর্ষণ করেছেন। আর এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ তাঁর সৃষ্টিজগতের প্রতি তিনি অনুগ্রহ করেছেন মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এবং কেতাব (কুরআন) প্রেরণ করে। [তানবির আল-মিকবাস মিন তাফসীর ইবনে আব্বাস]
হযরত এয়াহইয়া (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
”অতএব, শান্তি তাঁরই প্রতি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, যেদিন বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্ত হবেন এবং যেদিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন।” (সূরা মরঈয়ম, ১৫ আয়াত)
প্রমাণিত হলো যে আম্বিয়া (আলাইহিস সালাম)-বৃন্দের বেলাদত তথা ধরণীতে শুভাগমনের দিনগুলো আল্লাহর দৃষ্টিতে ‘শান্তিময়’।
আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে বলেন,
”আর নিশ্চয় আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাদি সহকারে প্রেরণ করেছি (এ কথা বলে) ‘আপন সম্প্রদায়কে অন্ধকার রাশি থেকে আলোতে নিয়ে আসো এবং তাদেরকে আল্লাহর দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দাও’! নিশ্চয় সেটির মধ্যে নিদর্শনাদি রয়েছে অত্যন্ত ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে।” (সূরা ইবরাহীম, ৫ আয়াত)
আয়াতোক্ত আল্লাহর ’আইয়াম’ (দিবস) মানে কী? ইমাম বায়হাকী নিজ ‘শুআব আল-ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আল্লাহর ’আইয়াম’ বা দিনগুলো হলো সে সব দিন যা’তে তাঁর ‘নেয়ামত ও নিদর্শনাদি’ প্রকাশ পেয়েছে। [তাফসীর-এ-রূহুল মা’আনী, সূরা ইব্রাহীম, ৫ আয়াত]
আহাদীস থেকে এস্তাদলাল
বই-০০৬, হাদীস নম্বর-২৬০৬ (সহীহ মুসলিম)
হযরত আবু কাতাদা আনসারী (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে সোমবার দিন তিনি কেন রোযা রাখেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়; এর জবাবে তিনি এরশাদ ফরমান: এই দিন আমার বেলাদত (ধরণীতে শুভাগমন) হয়েছিল এবং এই দিনে আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়।
এই হাদীসটি আরও বর্ণনা করেন ইমাম বায়হাকী তাঁর ‘সুনান আল-কুবরা’ (৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০০, হাদীস নং ৮১৮২, ৮২৫৯) গ্রন্থে, ইমাম নাসাঈ নিজ ‘সুনান’ বইয়ে এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল স্বরচিত ’মুসনাদ’ পুস্তকে।
এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) তাঁর বেলাদত দিবসের ব্যাপারে খুব খুশি ছিলেন এবং তাই তিনি (আল্লাহর কাছে) কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে রোযা রেখেছিলেন। রোযা রাখা এক ধরনের এবাদত; সুতরাং যে কোনো ধরনের এবাদত পালন করে এই দিনকে উদযাপন করা যায়। কেউ রোযা রাখতেও পারেন, আবার (মীলাদের) মাহফিল (সমাবেশ) করতেও পারেন; কেননা এগুলোর সবই এবাদত।
খণ্ড-৭, বই-৬২, হাদীস নম্বর-৩৮ (সহীহ বুখারী)
উরসা (রা:) বর্ণনা করেন: সোওয়াইবা (রা:) আবু লাহাবের মুক্ত করে দেয়া ক্রীতদাসী ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে বুকের দুধ খাইয়েছিলেন (তাঁর মায়ের ইন্তেকালের পরে)।
আবু লাহাব মারা যাবার পরে তার এক আত্মীয় স্বপ্নে তাকে খুব খারাপ অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কেমন আচরণ পেলে?” সে উত্তরে বল্লো,
“তোমাদের ত্যাগ করার পরে আমি কোনো নিষ্কৃতি পাই নি, তবে প্রতি সোমবার আমার এই আঙ্গুল থেকে খাবার জন্যে পানি প্রবাহিত হয়; আর এটি এই জন্যে যে আমি (তা দ্বারা) সোয়াইবিয়াকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম।”
সোয়াইবিয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বেলাদতের সুসংবাদ আবু লাহাবের কাছে নিয়ে এলে সে ওই আঙ্গুলের ইশারায় তাঁকে মুক্ত করে দেয়। সর্বনিকৃষ্ট কাফের ও ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রুকেও এই কারণে তার আযাব ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় সে সকল মো’মেন মুসলমানের উচ্চ মর্যাদার কথা চিন্তা করুন, যাঁরা খুশি মনে হুযূর পাক (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর মওলিদ উদযাপন করেছেন এবং করছেন। এই হাদীসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হবে উলামাবৃন্দের রায়-সম্বলিত শেষ অধ্যায়ে।
খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৪৭, হাদীস নম্বর-১১৩০ (সহীহ মুসলিম, দারুল কুতাব আল-ইলমিয়্যাহ)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) মদীনায় এসে দেখেন যে সেখানকার ইহুদীরা ১০ই মুহররম তারিখে রোযা রাখছেন। এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা উত্তরে বলেন, ‘এই দিনটিতেই মূসা (আলাইহিস সালাম) ও বনী ইসরাইল বংশ ফেরাউনের ওপর বিজয় লাভ করেন। তাই আমরা এর মহিমা সমুন্নত রাখতে রোযা পালন করে থাকি।’ অতঃপর মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) বলেন, ‘মূসা(আলাইহিস সালাম)-এর ওপর তোমাদের চেয়ে আমরা বেশি হক্কদার।’ এমতাবস্থায় তিনি মুসলমানদেরকে রোযা রাখার আদেশ করেন।
হযরত মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সম্মানার্থে যদি ইহুদীরা তাঁর স্মরণে দিবস পালন করতে পারেন, তাহলে আমরা মুসলমান সমাজ মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) যেদিন এ দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছিলেন সে দিনটিকে সম্মান করার ও তা পালন করার ক্ষেত্রে আরও বেশি অধিকার সংরক্ষণ করি। এটি ওপরের হাদীস থেকে উলামা-এ-কেরামের নেয়া সর্বজন স্বীকৃত সিদ্ধান্ত, যা তাঁরা দুটো বিষয়ের মধ্যে তুলনার ভিত্তিতে গ্রহণ করেছেন। এই বিষয়ে শেষ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে।
খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নম্বর-২৪১, হাদীস নম্বর-৪৪৮ (সুনান আন্ নাসাঈ)
হযরত আনাস বিন মালিক (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) তাঁর মে’রাজে গমন সম্পর্কে ব্যাখ্যাকালে বলেন, জিবরীল আমীন (আ:) বেথলেহেমে আমাকে বোরাক থেকে নেমে দোয়া করতে অনুরোধ করেন, যা করা হলে তিনি বলেন: ’এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি কোথায় দোয়া করেছেন তা জানেন কি? আপনি বেথলেহেমে দোয়া করেছেন, যেখানে ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্ম হয়েছিল।’
ইমাম বায়হাকী (রহ:) এই হাদীসটি অপর এক সাহাবী হযরত শাদ্দাদ বিন আওস (রা:) থেকে ভিন্ন এসনাদে বর্ণনা করেন। বর্ণনাশেষে তিনি বলেন, ‘এর এসনাদ (সনদ) সহীহ।’ [আল-বায়হাকী কৃত ’দালাইল আন্ নবুওয়াহ’, (২/৩৫৫-৩৫৬)]
অতএব, মওলিদ ও আম্বিয়া (আলাইহিস সালাম)-এর জন্মস্থানসমূহ আল্লাহর শআয়ের তথা সম্মানীয় স্মৃতিচিহ্নগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
হক্কপন্থী উলামা ও ফুকাহাবৃন্দের সমর্থনসূচক দলিল
১/ – ইবনে কাসীর, যাকে সালাফী/ওহাবীরা তাফসীর ও ইতিহাস শাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে থাকে, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামের মুজাহিদ সুলতান গাযী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ভগ্নিপতি শাহ মালিক আল-মুযাফফর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। অথচ সালাফীরাই ইবনে কাসীরের কথাকে বিকৃত করে এই মর্মে মিথ্যে ছড়িয়েছে যে মুযাফফর শাহ একজন ফাসেক, নিষ্ঠুর ও বেদআতী শাসক ছিলেন (নাউযু বিল্লাহ)।
প্রকৃতপক্ষে ইবনে কাসীর লিখেন:
”(মুযাফফর শাহ) ছিলেন একজন উদার/সহৃদয় ও প্রতাপশালী এবং মহিমান্বিত শাসক, যাঁর সকল কাজ ছিল অতি উত্তম। তিনি কাসিইউন-এর কাছে জামেয়া আল-মুযাফফরী নির্মাণ করেন…..(প্রতি) রবিউল আউয়াল মাসে তিনি জাঁকজমকের সাথে মীলাদ শরীফ (মীলাদুন্নবী) উদযাপন করতেন। উপরন্তু, তিনি ছিলেন দয়ালু, সাহসী, জ্ঞানী, বিদ্বান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক – রাহিমুহুল্লাহ ওয়া একরাম – শায়খ আবুল খাত্তাব (রহ:) সুলতানের জন্যে মওলিদুন্ নববী সম্পর্কে একখানি বই লিখেন এবং নাম দেন ‘আত্ তানভির ফী মওলিদ আল-বাশির আন্ নাযীর’।
এ কাজের পুরস্কারস্বরূপ সুলতান তাঁকে ১০০০ দিনার দান করেন। সালাহিয়া আমল পর্যন্ত তাঁর শাসন স্থায়ী হয় এবং তিনি ’আকা’ জয় করেন। তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র থেকে যান।
”আস্ সাবত্ এক ব্যক্তির কথা উদ্ধৃত করেন যিনি সুলতানের আয়োজিত মওলিদ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন; ওই ব্যক্তি বলেন: ‘অনুষ্ঠানে সুলতান ভালভাবে রান্নাকৃত ৫০০০ ছাগল, ১০,০০০ মোরগ, ১ লক্ষ বৌল-ভর্তি দুধ এবং ৩০,০০০ ট্রে মিষ্টির আয়োজন করতেন’।” [’তারিখে ইবনে কাসীর’, ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়া’ ১৩তম খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা]
২/ – ইমাম সেহাবউদ্দীন আবুল আব্বাস কসতলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন
যিনি ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ শীর্ষক সীরাতের বই রচনা করেন, তিনি বলেন:
”মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদত তথা এ ধরণীতে শুভাগমন রাতে হয়েছে বলা হলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে দুটো রাতের মধ্যে কোনটি বেশি মর্যাদাসম্পন্ন – কদরের রাত (যা’তে কুরআন অবতীর্ণ হয়), নাকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর ধরাধামে শুভাগমনের রাত?
হুযূর পূর নূর (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদতের রাত এ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতর ৩টি কারণে –
প্রথমতঃ নবী করীম (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এ বসুন্ধরায় আবির্ভূত হন মওলিদের রাতে, অথচ কদরের রাত (পরবর্তীকালে) তাঁকে মন্ঞ্জুর করা হয়। অতএব, মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর আবির্ভাব, তাঁকে যা মন্ঞ্জুর করা হয়েছে তার চেয়েও শ্রেয়তর। তাই মওলিদের রাত অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন।
দ্বিতীয়তঃ কদরের রাত যদি ফেরেশতাদের অবতীর্ণ হবার কারণে মর্যাদাসম্পন্ন হয়, তাহলে মওলিদের রাতে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এ ধরণীতে প্রেরিত হবার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ফেরেশতাদের চেয়েও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, আর তাই মওলিদের রাতও শ্রেষ্ঠতর।
তৃতীয়তঃ কদরের রাতের বদৌলতে উম্মতে মোহাম্মদীকে বিশিষ্টতা দেয়া হয়েছে; অথচ মওলিদের রাতের মাধ্যমে সকল সৃষ্টিকে ফযিলাহ দেয়া হয়েছে। কেননা, মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্যে রহমত করে পাঠানো হয়েছে (আল-কুরআন ২১:১০৭)।
অতএব, এই রহমত সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্যে সার্বিক।”
রেফারেন্স: ইমাম কসতলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’, ১ম খণ্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা। এ ছাড়াও ইমাম যুরকানী মালেকী স্বরচিত ‘শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া’, ১ম খণ্ড, ২৫৫-২৫৬ পৃষ্ঠা।
ইমাম কসতলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি আরও বলেন: ”যাদের অন্তর রোগ-ব্যাধি দ্বারা পূর্ণ, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর মীলাদের মাস, অর্থাৎ, রবিউল আউয়ালের প্রতিটি রাতকে যাঁরা উদযাপন করেন তাঁদের প্রতি আল্লাহতা’লা দয়াপরবশ হোন!” [আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া, ১ম খণ্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা]
৩/ – ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী রহমাতুল্লাহে আলাইহি যিনি হিজরী ৯ম শতকের মোজাদ্দেদ (ইসলাম পুনরুজ্জীবনকারী), তিনি লিখেন:
“মীলাদুন্নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) উদযাপন যা মূলতঃ মানুষদের সমবেত করা, কুরআনের অংশ-বিশেষ তেলাওয়াত, মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর ধরাধামে শুভাগমন (বেলাদত) সংক্রান্ত ঘটনা ও লক্ষ্মণগুলোর বর্ণনা পেশ, অতঃপর তবাররুক (খাবার) বিতরণ এবং সবশেষে সমাবেশ ত্যাগ, তা উত্তম বেদআত (উদ্ভাবন); আর যে ব্যক্তি এর অনুশীলন করেন তিনি সওয়াব অর্জন করেন, কেননা এতে জড়িত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর মহান মর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাঁর সম্মানিত বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।” [ইমাম সৈয়ুতী কৃত ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’, ১ম খণ্ড, ২৯২ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-আসরিয়া, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]
* [হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ ৪১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]
একই দিনে বেলাদত (শুভাগমন) ও বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত) হলেও কেন মহানবী (দ:)-এর মীলাদ অগ্রাধিকার পাবে তা ইমাম সৈয়ুতী রহমাতুল্লাহে আলাইহি ব্যাখ্যা করে বলেন:
“বিশ্বনবী(সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদত হলো (আল্লাহর) সর্ববৃহৎ নেয়ামত (আশীর্বাদ); আর তাঁর বেসাল মহা দুর্যোগ। ধর্মীয় বিধান আমাদের প্রতি তাকিদ দেয় যেন আমরা আল্লাহর নেয়ামতের শোকরগুজারি (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ) করি এবং দুর্যোগের মুহূর্তে ধৈর্য ধরি ও শান্ত থাকি। শরীয়তের আইনে আমাদের আদেশ দেয়া হয়েছে কোনো শিশুর জন্মে পশু কোরবানি দিতে (এবং ওর গোস্ত গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে)।
এটা ওই শিশুর জন্মোপলক্ষে কৃতজ্ঞতা ও খুশি প্রকাশের নিদর্শন। পক্ষান্তরে, মৃত্যুর সময় পশু কোরবানি দিতে শরীয়ত আমাদের আদেশ দেয় নি।
উপরন্তু, শোক প্রকাশ বা মাতম করতে শরীয়তে মানা করা হয়েছে। অতএব, মীলাদুন্নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর পুরো মাসব্যাপী খুশি প্রকাশ করার পক্ষে ইসলামী বিধানের রায় পরিদৃষ্ট হয়; আর তাঁর বেসাল উপলক্ষে শোক প্রকাশ না করার পক্ষে মত দেয়া হয়।” [হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ, ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠা]
* [দেখুন – ইমাম সৈয়ুতী প্রণীত ’আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’, ১ম খণ্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-আসরিয়া, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]
নোট: মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেসাল ১২ই রবিউল আউয়াল নয়, যেমন ধারণা করে থাকে কিছু মানুষ; তাদের এই ধারণার জন্ম ‘অমৃতের সীলমোহর’ জাতীয় বই-পুস্তক।
বিভিন্ন সহীহ বর্ণনায় বিবৃত সঠিক দিনটি হলো ২রা রবিউল আউয়াল।