প্রশ্ন : ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর ব্যাখ্যা কি?
উত্তর : أهل السنة শব্দটি مركب বা যৌগিক শব্দ। যার একটি أهل (আহল), অপরটি السنة (আস-সুন্নাহ)।أهل শব্দের আভিধানিক অর্থ হ’ল صاحب বা মালিক, অধিকারী, ওয়ালা ইত্যাদি। আর السنة শব্দটি একবচন, বহুবচনে سنن ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ রীতি-নীতি বা অভ্যাস। সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত অর্থ সুন্নাতের অনুসারী দল।
পারিভাষিক অর্থ : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কে মনীষীগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকজনের উক্তি উল্লেখ করা হ’ল।-
১. সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা (রহঃ) বলেন,وأهل السنة هم الذين اتبعوا سنة الرسول صلى الله عليه وسلم كل حين ومكان- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’ল তারা, যারা প্রতিটি ক্ষেত্রে ও সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে অনুসরণ করে’।[1]
২. ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহঃ) বলেন,
وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَمَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَكُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جِيْلًا فَجِيْلًا إِلى يَوْمِنَا هَذَا وَمَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِّ فِىْ شَرْقِ الْأَرْضِ وَغَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ-
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হকপন্থী ও তাদের বিরোধীদের বাতিলপন্থী বলি, তাঁরা হ’লেন, (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন’।[2]
৩. ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,أهل السنة والجماعة القوم الصادقون هم الذين اتبعوا القرآن والسنة لرسول وسنة صحبه أجمعين- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’ল এমন হকপন্থী দল, যারা কুরআন, রাসূলের সুন্নাত এবং ছাহাবীগণের রীতি-নীতি অনুসরণ করে’।[3] তিনি আরো বলেন,
وَمِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ مَذْهَبٌ قَدِيْمٌ مَعْرُوْفٌ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ اللهُ أَبَا حَنِيْفَةَ وَمَالِكًا وَالشَّافِعِىَّ وَأَحْمَدَ فَإِنَّهُ مَذْهَبُ الصَّحَابَةِ الَّذِيْنَ تَلَقَّوْهُ عَنْ نَبِيِّهِمْ-
‘আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ ও আহমাদের জন্মের বহু পূর্ব হ’তে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের একটি প্রাচীন মাযহাব সুপরিচিত ছিল। সেটি হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের মাযহাব, যাঁরা তাঁদের নবীর কাছ থেকে সরাসরি ইলম হাছিল করেছিলেন’।[4]
৪. শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তারাই, যারা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরে ও তার উপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং অন্য কোন দিকে দৃষ্টি দেয় না। এ কারণেই তাদেরকে ‘আহলে সুন্নাত’ রূপে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তাঁরা সুন্নাহর ধারক ও বাহক। তাদেরকে ‘আহলে জামা‘আত’ও বলা হয়। কারণ তাঁরা সুন্নাহর উপর জামা‘আতবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ। আপনি যদি বিদ‘আতীদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তাহ’লে দেখতে পাবেন যে, তারা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলে বিভক্ত। তাদের এ অবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে, তারা যে পরিমাণ বিদ‘আত তৈরী করে সেই পরিমাণ সুন্নাত থেকে দূরে সরে গিয়েছে’।[5]
৫. শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) বলেন,أما الفرقة الناجية فهي أهل السنة والجماعة، وأهل السنة لا اسم لهم إلا اسم واحد وهو أصحاب الحديث. ‘অতঃপর ফিরক্বা নাজিয়া হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’।[6]
৬. ইমাম ছাবূনী (রহঃ) বলেন,ولا يلحق أهل السنة إلا اسم واحد وهو أهل الحديث- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের একটি নাম ব্যতীত অন্য কোন নাম নেই। আর তাহ’ল ‘আহলেহাদীছ’।[7]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হ’ল যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অপর নাম ‘আহলেহাদীছ’। মোদ্দাকথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হচ্ছেন ছাহাবায়ে কেরাম, তাঁদের উত্তম অনুসারী এবং প্রত্যেক ঐসকল মুসলিম, যারা তাঁদের মানহাজ বা পদ্ধতি ও পথ-পন্থার অনুগামী এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁদের রীতি-নীতির ধারক। আর মূলতঃ তারাই আহলেহাদীছ।
প্রশ্ন : مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى বর্ণনাটি কি বিশুদ্ধ?
উত্তর : শায়খ আলবানী (রহঃ) বর্ণনাটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। ইমাম তিরমিযীও বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে একে ‘হাসান’ বলেছেন। হাকেম নিসাপুরী বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন,هذه أسانيد تقام بها الحجة في تصحيح هذا الحديث ‘এই সকল সনদ দ্বারা হাদীছটি ছহীহ হওয়ার দলীল সাব্যস্ত হয়’।[8] ছাহেবে মির‘আত উক্ত মর্মের ১০টি হাদীছ উল্লেখ করেছেন ‘শাওয়াহেদ’ হিসাবে। অতঃপর তিনি বলেন, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছ সমূহের কোনটি ‘ছহীহ’ কোনটি ‘হাসান’ ও কোনটি ‘যঈফ’। অতএব افةراق الأمة -এর হাদীছ নিঃসন্দেহে ‘ছহীহ’ (صحيح من غير شك)।[9]
প্রশ্ন- ০৬ : فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ ‘আহলে যিকির’ দ্বারা কি উদ্দেশ্য?
উত্তর : উল্লিখিত আয়াতাংশের মনগড়া ব্যাখ্যা করে মাযহাবীগণ নির্দিষ্ট একটি মাযহাব মানা ‘ফরয’ করেছে।[10] সুতরাং এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে। কোন আয়াতের খন্ডিতাংশ দ্বারা তার সঠিক মর্মার্থ জানা যায় না, যদি না তার পূর্বাপর উল্লেখ করা হয়। সেই সাথে আয়াত বা বিধানটি অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটও জানতে হয়। তাই প্রথমে আমরা পুরো আয়াতের অর্থ ও আয়াতটি অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট জেনে নিব।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلاَّ رِجَالاَ نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘আর তোমার পূর্বে আমরা লোকদের নিকটে অহীসহ যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম, তারা মানুষই ছিল। অতএব তোমরা জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জানো’ (আম্বিয়া ২১/৭)।
শানে নুযূল : আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করলেন, তখন আরবের লোকেরা বলতে লাগল, আল্লাহ তা‘আলা একজন মানুষকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করবেন, এমন হ’তে পারে না। তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়’।[11]
‘আহলে যিকির’ দ্বারা উদ্দেশ্য :
ক্বাতাদাহ (রহঃ) فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ-এর ব্যাখ্যায় বলেন, فاسألوا أهل التوراة والإنجيل ‘তোমরা তাওরাত ও ইঞ্জীলের অনুসারীদেরকে জিজ্ঞেস কর’।[12]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,يُرِيْدُ أَهْلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ‘আহলে যিকির’ দ্বারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের ঐ সকল অনুসারী উদ্দেশ্য, যারা নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল’।[13]
আল্লামা ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘আহলে যিকির’ দ্বারা أهل الكتب الماضية ‘অতীতকালের আহলে কিতাবগণ উদ্দেশ্য’।[14]
আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী (রহঃ) বলেন,فاسألوا أهل الكتب من التوراة والإنجيل ما كانوا يخبروكم عنهم. ‘তোমরা আহলে কিতাবদের মধ্যে তাওরাত ও ইঞ্জীলের অনুসারীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যারা তোমাদেরকে তাদের (পূর্ববর্তী নবীদের) সম্পর্কে অবহিত করে’।[15]
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), মুজাহিদ (রহঃ), আ‘মাশ প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মুফাসসিরগণ বলেন,أن المراد بأهل الذكر: أهل الكتاب ‘আহলে যিকির’ দ্বারা ‘আহলে কিতাব’ উদ্দেশ্য।[16]
মুফতী মুহাম্মাদ শফী হানাফী বলেন, فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ এখানে أَهْلَ الذِّكْرِ (যাদের স্মরণ আছে) বলে তাওরাত ও ইঞ্জীলের যেসব আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণ মানুষ ছিলেন, না ফেরেশতা ছিলেন, একথা যদি তোমাদের জানা না থাকে, তবে তাওরাত ও ইঞ্জীলের আলেমদের কাছ থেকে জেনে নাও। কেননা তারা সবাই জানে যে, পূর্ববর্তী সকল পয়গম্বর মানুষই ছিলেন। তাই এখানে أَهْلُ الذِّكْرِ দ্বারা সাধারণ কিতাবধারী ইহুদী ও খ্রিষ্টান অর্থ নিলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ তারা সবাই এ ব্যাপারে সাক্ষ্যদাতা। তাফসীরের সার-সংক্ষেপে এই অর্থ ধরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[17]
সুফিয়ান বলেন, يعني مؤمني أهل الكتاب ‘অর্থাৎ আহলে কিতাব মুমিনদেরকে জিজ্ঞেস কর’।[18]
উল্লিখিত তাফসীরগুলো নির্ভরযোগ্য, আয়াতের মর্মার্থ ও শানে নুযূলের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়াও বিভিন্ন মুফাসসির ‘আহলে যিকির’-এর তাফসীরে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। যেমন-
ইবনু যায়েদ বলেন,أهل القرآن، والذكر: القرآن. وقرأ (إِنَّا نَحْنُ نزلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ). (আহলে যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য) কুরআনের অনুসারী, যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য ‘কুরআন’। তিনি কুরআন থেকে পাঠ করলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা এ যিকির তথা কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি এবং নিশ্চয়ই আমরা এর হেফাযতকারী’।[19] তিনি আরো বলেন,أراد بالذكر القرآن؛ أي فاسألوا المؤمنين العالمين من أهل القرآن ‘যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য ‘কুরআন। অর্থাৎ কুরআনের অনুসারী বিশ্বের মুমিনদেরকে জিজ্ঞেস কর’।[20]
হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الذِّكْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, أهل القرآن والحديث ‘কুরআন ও হাদীছের অনুসারী’।[21]
ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, তারা হ’লেন أهل السنة ‘সুন্নাতের অনুসারী’। যেমন أهل الوحي অর্থাৎ ‘অহি-র অনুসারী’।[22]
জাবির আল-জু‘ফী বলেন,لما نزلت هذه الآية قال علي رضي الله عنه نحن أهل الذكر ‘যখন কুরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হ’ল তখন আলী (রাঃ) বললেন, আমরা আহলে যিকির’।[23]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আয়াতটি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হ’লেও ব্যাপকতার হুকুম রাখে। উক্ত আয়াতে মাযহাব ফরয হওয়ার স্বপক্ষে প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ তো নেই, পরোক্ষ কোন ইঙ্গিতও নেই। অথচ মাযহাবীগণ এ আয়াতাংশকে মাযহাব ফরয হওয়ার দলীল হিসাবে গ্রহণ করে সীমাহীন বাড়াবাড়ি করে চলেছে। শুধু তাই নয়, তারা দিবালোকে চক্ষু বন্ধ করে প্রকৃত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে আহলেহাদীছদের প্রতি লক্ষ লক্ষ টাকার ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেও লজ্জাবোধ করে না।
তাদের ওপেন চ্যালেঞ্জে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নির্দিষ্ট একটি মাযহাব মানাকে ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বলা হয়। তাক্বলীদে শাখছী পবিত্র কুরআনের এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত- فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ ‘তোমরা যদি না জান, তবে যারা জানে তাদের থেকে জিজ্ঞাসা কর’ (নাহল ১৬/৪৩)।
অত্র আয়াতে আহলে যিকর বলতে মুজতাহিদ আলেমদেরকে বুঝানো হয়েছে। দেহের চিকিৎসার জন্য অনেক চিকিৎসকের মধ্য হ’তে আস্থার ভিত্তিতে যেমন একজনকে নির্বাচন করা হয়, তেমনি রূহের চিকিৎসার জন্য অনেক আলেমের মধ্য হ’তে আস্থার ভিত্তিতে একজনকে নির্বাচন করতে হয়। এটাই যুক্তির কথা। আল্লাহর কালামের তাৎপর্যও তাই। একাধিক চিকিৎসকের দ্বারা একই সময়ে চিকিৎসা করালে রুগীর অবস্থা করুণ হ’তে বাধ্য। ঠিক তদ্রূপ একাধিক মাযহাব মানলে সাধারণ মানুষ দুনিয়ার লোভ ও মোহে পড়ে আল্লাহর দ্বীন ছেড়ে নিজের নফসের তাবেদারী বা অনুসারী হয়ে পড়বে। এ জন্যই নির্দিষ্ট একটি মাযহাব মানতে হবে। দেখুন, সাহাবায়ে কেরামও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইন্তেকালের পর ইজতিহাদী মাসআলার ক্ষেত্রে এক খলীফার তাকলীদ করেছেন। মাদীনাবাসী আনছারগণও এক হযরত যায়দ বিন সাবিত (রাঃ)-এর তাকলীদ করেছেন। এতে সাধারণ মানুষ নফসের অনুকরণ করার সুযোগ পায় না। ফলে দ্বীনের শৃঙ্খলা রক্ষা পায়।
একাধিক মাযহাব মানলে বা মানার অনুমতি দিলে মানুষের ধর্ম পালন একটা খেলনার বস্ত্ততে পরিণত হতে বাধ্য। এদিকে ইঙ্গিত দিয়ে হযরত হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) (মৃ. ১৯৪৩ ঈসায়ী, দেওবন্দ, ভারত) বলেন, এধরনের ক্রিয়াকর্মকে প্রশ্রয় দেয়া হলে ধর্মকে তামাশার বস্ত্ততে পরিণত করার বিস্তর সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যাবে। প্রতিটি ব্যাপারেই কোন না কোন মাযহাবে আত্মতুষ্টিমূলক বিধান তো পাওয়া যাবেই। তাই বলে, নিজের সুবিধামত মাযহাবের অনুসরণ কি প্রবৃত্তি পূজার সমর্থক হবে না?[24]
প্রিয় পাঠক! মাযহাবীদের ওপেন চ্যালেঞ্জের নমুনা অবলোকন করুন, তাদের উপত্থাপিত চ্যালেঞ্জ পত্রে কুরআনের সঠিক মর্মার্থের পরিবর্তে রয়েছে মনগড়া অপব্যাখ্যা। অতঃপর অবাঞ্ছিত খোঁড়া যুক্তি, অতঃপর ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি চরম মিথ্যাচার। মাযহাবীগণ তাদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কুরআন ও সুন্নাহর একনিষ্ঠ অনুসারী ছাহাবীগণকেও মাযহাবী ও মুক্বাল্লিদ বানিয়েছে। ছাহাবীদের সেই মাযহাবের অনুসরণীয় ইমামের নাম হিসাবে আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।[25] এক্ষণে মাযহাবী ভাইদের প্রতি সবিনয় জিজ্ঞাসা, আপনাদের উপরোক্ত কথামালা যদি সত্যিই হয় তাহ’লে উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর মাযহাব না মেনে আপনারা ইমাম আবু হানীফা (রাঃ)-এর মাযহাব মানছেন কেন? তাহ’লে কি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ইমাম; শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ?
মাযহাবীদের অভিমত অনুযায়ী ‘আহলে যিকির’ দ্বারা যদি শুধু নির্দিষ্ট এক ইমাম বা ইমাম চতুষ্টয় উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহ’লে তো আলোচিত আয়াতের বিধান ১৬১ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কেননা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর জীবনকাল ৮০-১৫০ হিঃ, ইমাম মালেক হানীফা (রহঃ)-এর জীবনকাল ৯৩-১৭৯ হিঃ, ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর জীবনকাল ১৫০-২০৪ হিঃ, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) জীবনকাল ১৬৪-২৪১ হিঃ। অর্থাৎ ইমাম চতুষ্টয়ের জীবনকাল মোট (৮০-২৪১ হিঃ)=১৬১ বছর। সেমতে فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ এ আয়াতের বিধান ৮০ হিজরীর পূর্বে এবং ২৪১ হিজরীর পরে অকার্যকর হয়ে পড়ে (নাঊযুবিল্লাহ)।
‘আহলে যিকির’ দ্বারা যদি শুধু নির্দিষ্ট কোন এক ইমাম বা ইমাম চতুষ্টয় উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহ’লে প্রশ্ন থেকে যায় যে, নিত্য নতুন সমস্যায় পড়ে তাঁদেরকে আমরা জিজ্ঞেস করব কিভাবে? তাঁরা তো মারা গেছেন।
এ প্রশ্নের জবাবে মাযহাবী ভাইগণ হয়ত বলবেন, তাঁদের রচিত কিতাব থেকে ফৎওয়া গ্রহণ করবেন। এক্ষণে প্রশ্ন এসে যায় যে, তারা তো প্রায় এক হাযার দু’শ’ বছর পূর্বে গত হয়ে গেছেন। এরপর সময়ের প্রেক্ষাপটে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে এবং হবে মহাপ্রলয়ের পূর্ব পর্যন্ত। তাহ’লে সে সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য কাদেরকে জিজ্ঞেস করব?
সারকথা :
আলোচিত আয়াতটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হ’লেও কুরআন সার্বজনীন মহাগ্রন্থ। বিধায় এর বিধান ব্যাপকতার দাবী রাখে। আর তা নির্দিষ্ট সীমানা পেরিয়ে সর্বকালের হক্বপন্থী মুজতাহিদ ও আলেমগণ আহলে যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। মুজতাহিদের জন্য ইজতিহাদের দুয়ার ক্বিয়ামত অবধি খোলা থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ ‘কোন বিচারক বিচার করেন ও ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হ’লে তার জন্য রয়েছে দু’টি নেকী। আর বিচারক বিচার করে ইজতিহাদে ভুল করলে তার জন্যও রয়েছে একটি নেকী’।[26]
উক্ত হাদীছ কোন বিশেষ গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং নিত্য নতুন সমস্যার সমাধান কল্পে প্রত্যেক যুগের মুজতাহিদগণ ইজতিহাদ করতে পারবেন।
[1]. আল-আকাইদুল ইসলামিয়্যাহ (ঢাকা : ইসলামিয়া কুতুবখানা, তাবি), পৃঃ ২২৫।
[2]. আলী ইবনু হাযম আন্দালুসী, কিতাবুল ফিছাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল (বৈরূত : মাকতাবা খাইয়াত্ব, ১৩২১/১৯০৩ ইং) শাহরাস্তানীর ‘মিলাল’ সহ ২/১১৩।
[3]. আল-আক্বাইদুল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ২২৫।
[4]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩২২ হিঃ) ১/২৫৬ পৃঃ।
[5]. শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ফৎওয়া নং ৪।
[6]. আব্দুল কাদের জিলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর : ১৩৪৬ হিঃ), ১/৯০ পৃঃ।
[7]. ইমাম আবু ওছমান আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ তাহক্বীক্ব : বদর আল-বদর (কুয়েত : দারুস সালাফিইয়্যাহ, ১ম সংস্করণ ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ ইং), পৃঃ ১০৬।
[8]. হাকেম ১/১২৮।
[9]. মির‘আত ১/২৭৬-৭৭।
[10]. রুহুল্লাহ নোমানী (সংকলিত) আহলেহাদীছের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ (ঢাকা : তাওফিকিয়্যাহ লাইব্রেরী, জুন/২০১২), পৃঃ ২০১২।
[11]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৪/৩৬২ পৃঃ।
[12]. তাফসীর তাবারী ১৭/৭ পৃঃ।
[13]. তাফসীর কুরতুবী ৬/২৪৭ পৃঃ।
[14]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/৩৬২ পৃঃ।
[15]. তাফসীর তাবারী ১৭/৭ পৃঃ।
[16]. তাফসীর ইবনে কাছীর…।
[17]. তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন, পৃঃ ৮৭২।
[18]. দুররে মানছূর ৪/১১৮ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী ৫/৪৬০ পৃঃ।
[19]. তাফসীর ত্ববারী ১৭/৭ পৃঃ।
[20]. তাফসীর কুরতুবী ৬/২৪৭ পৃঃ।
[21]. হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামূল মুওয়াক্কি‘ঈন ২/১৬৪ পৃঃ।
[22]. ইমাম ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম, পৃঃ ৮৩৮।
[23]. তাফসীর ত্বাবারী ১৭/৭ পৃঃ; তাফসীর আল-মারূদী ৩/৩৮ পৃঃ; তাফসীর আর-রাযী ২২/১৪৪ পৃঃ; বাহরুল মুহীত্ব ৬/২৯৮ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী ৬/২৪৭।
[24]. আহলে হাদীছের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ, ১৫২-১৫৩ পৃঃ।
[25]. ঐ, পৃঃ ১৫০।
[26]. বুখারী হা/৭৩৫২, ‘কুরআন ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অধ্যায় ‘বিচারক ইজতিহাদে সঠিক করুক বা ভুল করুক তার প্রতিদান পাবে’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম হা/১৭১৬।