আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

 ভূমিকা

সকল প্রশংসা রাব্বুল আলামীনের জন্য। শুভ পরিণতি মুত্তাকীদেন জন্য। আর শাস্তি হচ্ছে যালিমদের জন্য। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই। তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সুস্পষ্ট মালিকে হক [প্রকৃত অধিপতি] আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী। মুত্তাকি [আল্লাহভীরু] লোকদের ইমাম [নেতা]। আল্লাহ অনুগ্রহ করুন তাঁর প্রতি। তাঁর বংশের প্রতি। তাঁর সাহাবীগণের প্রতি এবং নিষ্ঠার সাথে যারা কেয়ামত পর্যন্ত তাঁদের অনুসরণ করে যাবেন তাদের প্রতি।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁরই রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহ পাঠিয়েছেন। তাঁকে পাঠিয়েছেন গোটা সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত ও শান্তির দূত হিসেবে। আমলকারীদের মহান আদর্শ হিসেবে এবং সকল বান্দাহর জন্য প্রমাণ স্থাপনকারী হিসেবে।

আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর উপর যে কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে এমন সব বিষয় বর্ণনা করে দিয়েছেন যাতে নিহিত রয়েছে বান্দাহর অপরিসীম কল্যাণ। রয়েছে সহীহ আকীদা, নির্ভেজাল কর্ম, উন্নত চরিত্র এবং মহৎ শিষ্টাচার তথা দ্বীন ও দুনিয়ার সর্ববিষয়ে দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা লাভের অমূল্য পাথেয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এমন এক স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন আদর্শের উপর রেখে গেছেন যা দিবালোকের মত সুস্পষ্ট। যার জীবনে ধ্বংস অনিবার্য সে ছাড়া এ পথ থেকে অন্য কেউ বিচ্যুত হয় না।

সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীন এর মত সৃষ্টির উত্তম ব্যক্তিগণই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দেয়ার মাধ্যমে উক্ত পথ অবলম্বন করেছেন। তাঁরা এবং তাঁদেরকে যারা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন। তাঁরা তাঁর শরী‘আতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আকীদা, ইবাদত, চরিত্র ও শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁর সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরেছেন। এর ফলে তাঁরা এমন দলে পরিগণিত হয়েছেন যারা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। কোন অপমানকারীর অপমান কিংবা কোন বিরোধিতাকারী তাদের ক্ষতি করতে পারে না। এভাবে তাঁরা সত্যের পথে অবিচল থাকেন যতক্ষণ না আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে চুড়ান্ত নির্দেশ আসে।

আল্লাহ তা‘আলার অপরিসীম প্রশংসা এ জন্য যে, আমরা তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছি। তাঁদের কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত সীরাতের মাধ্যমে আমরা সঠিক পথ-নির্দেশনা লাভ করছি। আল্লাহর আপরিসীম নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপনের লক্ষ্যে এবং প্রতিটি মুমিনের জন্য যে পথ অবলম্বন করা অপরিহার্য তা বর্ণনা করার উদ্দেশ্যেই আমাদের এ নিবেদন।

আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে এ প্রার্থনাই করছি, তিনি যেন আমাদেরকে এবং আমাদের মুসলিম ভাইদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে দুনিয়া এবং আখেরাতের জিন্দিগীতে দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা দান করেন। আমাদেরকে যেন তাঁর অবারিত রহমত দান করেন। মূলত: তিনিই হচ্ছেন অবারিত রহমত দানকারী।

বিষয়টির গুরুত্ব এবং মানুষের মধ্যে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত-পার্থক্যের কারণে সংক্ষেপে আমাদের আক্বীদা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদার উপর দু’কলম লিখতে মনস্থ করেছি। আমাদের আক্বীদা হচ্ছে: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ফিরিশ্‌তা, আসমানী কিতাব, নবী-রাসূল, আখেরাত এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনা।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে এ প্রার্থনাই করছি তিনি যেন আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসকে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য গ্রহণ করেন। আর মানুষের জন্য করেন কল্যাণকর এবং উপকারী।

 আমাদের আক্বীদা

 আল্লাহর প্রতি ঈমান:

আমাদের আক্বীদা হচ্ছে: আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর সকল ফিরিশ্‌তা, আসমানী কিতাব, নবী-রাসূল, আখেরাত এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা।

 আল্লাহর রুবুবিয়্যাত

আমরা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাতে ঈমান আনি। এর অর্থ হচ্ছে, তিনিই হচ্ছেন রব; খালিক [সৃষ্টিকর্তা] বাদশাহ, সকল কাজেরই মহানিয়ন্ত্রক।

 আল্লাহর উলুহিয়্যাত

আমরা আল্লাহর তা‘আলার উলুহিয়্যাতে ঈমান আনি। যার অর্থ হচেছ, তিনিই হচ্ছেন সত্য ইলাহ। তিনি ব্যতীত সব মা‘বুদই বাতিল ও অসত্য।

 আল্লাহর নাম ও সিফাত

আমরা আল্লাহ তা‘আলার সব পবিত্র নাম ও সিফাত ঈমান আনি। অর্থাৎ তাঁর বহু পবিত্র নাম ও উন্নত সিফাতে কামেলা অর্থাৎ পরিপূর্ণ গুণাবলী রয়েছে।

 আল্লাহর ওয়াহদানিয়্যাত

আর এতে করে আমরা ঈমান আনি আল্লাহ তা‘আলার ওয়াহদানিয়্যাতে বা একত্ববাদে। এর অর্থ হচ্ছে তাঁর রুবুবিয়্যাত, উলুহিয়্যাত এবং যত পবিত্র নাম ও সিফাত রয়েছে তাতে কোন শরীক বা অংশীদার নেই।

 আল্লাহ তা‘আলাই এরশাদ করেছেন:

﴿رَّبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَا فَٱعۡبُدۡهُ وَٱصۡطَبِرۡ لِعِبَٰدَتِهِۦۚ هَلۡ تَعۡلَمُ لَهُۥ سَمِيّٗا ٦٥﴾ [مريم:65]

[আল্লাহ] “আসমান ও যমীন এবং এ দু’টির মাঝখানে যা আছে সব কিছুরই তিনি রব। অতএব তুমি তাঁরই ইবাদত করো এবং ইবাদতের পথে ধৈর্যের মাধ্যমে অবিচল থাকো। তাঁর সমতুল্য কোন সত্তার কথা তুমি জান কি?” [সূরা মারইয়াম: ৬৫]।

আল্লাহর জ্ঞান, সাম্রাজ্য ও ক্ষমতা

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَيُّ ٱلۡقَيُّومُۚ لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ وَلَا نَوۡمٞۚ لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ يَعۡلَمُ مَا بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَمَا خَلۡفَهُمۡۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيۡءٖ مِّنۡ عِلۡمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَۚ وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۖ وَلَا يَ‍ُٔودُهُۥ حِفۡظُهُمَاۚ وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ ٢٥٥﴾ [البقرة:255]

“আল্লাহ সেই চিরঞ্জীব শাশ্বত সত্তা, যিনি সমস্ত বিশ্বচরাচরকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তন্দ্রা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি নিদ্রাও যান না। আসমান ও যমিনে যা কিছু আছে সবই তাঁর মালিকানাধীন। এমন কে আছে যে তাঁর দরবারে তাঁরই অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করতে পারে? সামনে পিছনে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন। তাঁর জানা বিষয়সমূহের কোন জিনিসই তাদের জ্ঞানসীমার আয়ত্বাধীন হতে পারে না। অবশ্য কোন বিষয়ের জ্ঞান যদি তিনি নিজেই কাউকে জানাতে চান (তবে তা অন্য কথা)। তাঁর কুরসী সমগ্র আসমান ও যমীনকে ঘিরে আছে। আসমান ও যমীনের রক্ষণ-বেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত করে দিতে পারে না। বস্তুত: তিনিই হচ্ছেন এক সর্বোচ্চ মহান শ্রেষ্ঠতম সত্তা”। [সূরা আল-বাকারাহ: ২৫৫]

 আমরা ঈমান আনি­—

﴿هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِي لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ عَٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِۖ هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ٢٢ هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِي لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡمَلِكُ ٱلۡقُدُّوسُ ٱلسَّلَٰمُ ٱلۡمُؤۡمِنُ ٱلۡمُهَيۡمِنُ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡجَبَّارُ ٱلۡمُتَكَبِّرُۚ سُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٢٣ هُوَ ٱللَّهُ ٱلۡخَٰلِقُ ٱلۡبَارِئُ ٱلۡمُصَوِّرُۖ لَهُ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ يُسَبِّحُ لَهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٢٤﴾ [الحشر : 22-24]

“তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই। গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছুই তিনি জানেন। তিনিই রহমান ও রহীম। তিনিই আল্লাহ যিনি ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই। তিনি বাদশাহ। অতীব মহান ও পবিত্র। শান্তির ধারক। নিরাপত্তার আঁধার। রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি পরাক্রমশালী, সর্বজয়ী, মহাশক্তিধর এবং নিজ বড়ত্ব গ্রহণকারী। লোকেরা যেসব শিরক করছে, তা থেকে আল্লাহ সম্পূর্ণ পবিত্র। তিনিই আল্লাহ যিনি সৃষ্টিকর্তা, পরিকল্পনাকারী, আকার আকৃতি রচনাকারী। তাঁর অনেক সুন্দর-সুন্দর নাম রয়েছে। আসমান ও যমিনে যা কিছু আছে সব কিছুই তাঁর প্রশংসা করে। তিনি অতীব পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [হাশর : ২২-২৪]

আমরা ঈমান আনি যে, আসমান ও যমীনের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর।

﴿يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُۚ يَهَبُ لِمَن يَشَآءُ إِنَٰثٗا وَيَهَبُ لِمَن يَشَآءُ ٱلذُّكُورَ ٤٩ أَوۡ يُزَوِّجُهُمۡ ذُكۡرَانٗا وَإِنَٰثٗاۖ وَيَجۡعَلُ مَن يَشَآءُ عَقِيمًاۚ إِنَّهُۥ عَلِيمٞ قَدِيرٞ ٥٠﴾ [الشورى: 49-50]

“তিনি যাই চান, সৃষ্টি করেন। যাকে চান কন্যা-সন্তান দান করেন, যাকে চান পুত্র-সন্তান দান করেন। আবার যাকে চান পুত্র-কন্যা উভয় রকমের সন্তানই দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সব কিছুই জানেন এবং সব বিষয়েই ক্ষমতাবান।” [শূরা : ৪৯-৫০]

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ لَهُۥ مَقَالِيدُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ يَبۡسُطُ ٱلرِّزۡقَ لِمَن يَشَآءُ وَيَقۡدِرُۚ إِنَّهُۥ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ١٢ ﴾ [الشورى: 11-12]

“কোন জিনিসই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব কিছুই শুনেন ও দেখেন। আকাশমণ্ডল ও যমীনের সকল ধনভাণ্ডারের চাবি তাঁরই কাছে। যাকে তিনি চান প্রচুর রিজিক দান করেন, আর যাকে চান পরিমিত দান করেন। তিনি সব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।” [শূরা : ১১-১২]

 আল্লাহ রিযিকদাতা

আমরা আরও ঈমান আনি যে,

﴿وَمَا مِن دَآبَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِ رِزۡقُهَا وَيَعۡلَمُ مُسۡتَقَرَّهَا وَمُسۡتَوۡدَعَهَاۚ كُلّٞ فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٦ ﴾ [هود: 6]

“যমীনে বিচরণশীল এমন কোন জীব নেই, যার রিজিকের ব্যবস্থা আল্লাহর উপর নয় এবং যার স্থায়ী অস্থায়ী অবস্থান সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। এসব কিছুই এক সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।” [হুদ : ৬]

 আল্লাহ আলিমুল গায়েব

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚ وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعۡلَمُهَا وَلَا حَبَّةٖ فِي ظُلُمَٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡبٖ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٥٩ ﴾ [الأنعام:59]

“গায়েবের সব চাবিকাঠি তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। স্থল ও জল ভাগে যা কিছু আছে তার সবই তিনি জানেন। বৃক্ষচ্যুত একটি পাতাও এমন নেই যার সম্পর্কে আল্লাহ জানেন না। যমীনের অন্ধকারে কোন শস্য, কোন আর্দ্র, কোন শুষ্ক জিনিস সবই এক সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।” [আন‘আম : ৫৯]

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥ عِلۡمُ ٱلسَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ ٱلۡغَيۡثَ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡأَرۡحَامِۖ وَمَا تَدۡرِي نَفۡسٞ مَّاذَا تَكۡسِبُ غَدٗاۖ وَمَا تَدۡرِي نَفۡسُۢ بِأَيِّ أَرۡضٖ تَمُوتُۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرُۢ ٣٤ ﴾ [لقمان: 34]

“কেয়ামতের সময়ের জ্ঞান আল্লাহরই কাছে রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন গর্ভে কী আছে। কেউ জানে না আগামী কাল সে কী কামাই করবে। না কেউ জানে তার মৃত্যু হবে কোন যমীনে। আল্লাহই সব কিছু জানেন এবং সব বিষয়েই তিনি ওয়াকিফহাল।” [লোকমান : ৩৪]

 আল্লাহ কথা বলেন

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন যা বলেতে চান, যখন চান এবং যেভাবে চান।

﴿ وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِيمٗا ١٦٤﴾ [النساء: 164]

“আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন, যেভাবে কথা বলা হয়ে থাকে।” [নিসা : ১৬৪]

﴿وَلَمَّا جَآءَ مُوسَىٰ لِمِيقَٰتِنَا وَكَلَّمَهُۥ رَبُّهُۥ﴾ [الأعراف: 143]

“যখন মূসা আমার নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌছলো এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন”। [আ‘রাফ : ১৪৩]

﴿وَنَٰدَيۡنَٰهُ مِن جَانِبِ ٱلطُّورِ ٱلۡأَيۡمَنِ وَقَرَّبۡنَٰهُ نَجِيّٗا ٥٢﴾ [مريم: 52]

“আমি মূসাকে তুর [পাহাড়] এর ডান দিক থেকে ডাকলাম এবং গোপন কথা বার্তার দ্বারা তাকে নৈকট্য দান করলাম।” [মারইয়াম: ৫২]

আমরা একথা ঈমান রাখি যে,

﴿قُل لَّوۡ كَانَ ٱلۡبَحۡرُ مِدَادٗا لِّكَلِمَٰتِ رَبِّي لَنَفِدَ ٱلۡبَحۡرُ قَبۡلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَٰتُ رَبِّي﴾ [الكهف: 109]

“সমুদ্রগুলো যদি আমার রবের কথাসমূহ লেখার জন্য কালি হয়ে যেতো তাহলে আমার রবের কথা শেষ হওয়ার আগেই কালি শেষ হয়ে যেতো।” [কাহ্‌ফ : ১০৯]

﴿وَلَوۡ أَنَّمَا فِي ٱلۡأَرۡضِ مِن شَجَرَةٍ أَقۡلَٰمٞ وَٱلۡبَحۡرُ يَمُدُّهُۥ مِنۢ بَعۡدِهِۦ سَبۡعَةُ أَبۡحُرٖ مَّا نَفِدَتۡ كَلِمَٰتُ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٢٧﴾ [لقمان: 27]

“যমীনে যত গাছ আছে, তা সবই যদি কলম হয়ে যেতো, আর সমুদ্র্ আরও সাতটি সমুদ্র্ একে কালি সরবরাহ করতো, তাহলেও আল্লাহর কথাগুলো শেষ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [লোকমান: ২৭]

আমরা ঈমান আনি যে, সিদ্ধান্ত ও কোন খবর দানের ব্যাপারে আল্লাহর কালামই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সত্য ও সঠিক এবং পূর্ণতার দাবিদার। হুকুম আহকামের ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে বেশি ন্যায়ভিত্তিক ও ইনসাফপূর্ণ। বর্ণনার দিক থেকে তা সবচেয়ে বেশি সুন্দর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَتَمَّتۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدۡقٗا وَعَدۡلٗاۚ﴾ [الأنعام: 115]

“তোমরা রবের কথা সত্যতা ও ইনসাফের দিক থেকে পূর্ণতা লাভ করেছে।” [আন‘আম : ১১৫]

﴿وَمَنۡ أَصۡدَقُ مِنَ ٱللَّهِ حَدِيثٗا ٨٧﴾ [النساء: 87]

“বস্তুত আল্লাহর কথা অপেক্ষা অধিক সত্য কথা আর কার হতে পারে?” [নিসা : ৮৭]

 কুরআন আল্লাহর কালাম

আমরা ঈমান আনি যে, কুরআনে কারীম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র কালাম। এর মাধ্যমে তিনি হক কথা বলেছেন এবং জিবরাইল [আলাইহিস সালাম] এর কাছে তা অর্পণ করেছেন। এরপর জিবরাইল [আলাইহিস সালাম] সেই অর্পিত কথাগুলো নাযিল করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তরে।

﴿ قُلۡ نَزَّلَهُۥ رُوحُ ٱلۡقُدُسِ مِن رَّبِّكَ بِٱلۡحَقِّ ﴾ [النحل: 102]

“হে মুহাম্মাদ! এদেরকে বল, এ কুরআনকে ‘রুহুল কুদুস’ [জিবরীল] যথাযথভাবে তোমার রবের কাছ থেকে ক্রমাগতভাবে নাযিল করেছেন।” [নাহল : ১০২]

﴿وَإِنَّهُۥ لَتَنزِيلُ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٩٢ نَزَلَ بِهِ ٱلرُّوحُ ٱلۡأَمِينُ ١٩٣ عَلَىٰ قَلۡبِكَ لِتَكُونَ مِنَ ٱلۡمُنذِرِينَ ١٩٤ بِلِسَانٍ عَرَبِيّٖ مُّبِينٖ ١٩٥﴾ [الشعراء: 192-195]

“এটা [কুরআন] আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বাণী। এটা নিয়ে আমানতদার ‘রুহ’ তোমার দিলে অবতরণ করেছে। যেন তুমি সতর্ককারীগণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারো।” [শু‘আরা : ১৯২-১৯৫]

আল্লাহ সবকিছুর উপরে আছেন

আমরা আরও ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় “যাত ও সিফাত” [সত্তা ও গুণাবলী] দ্বারা সমগ্র সৃষ্টির উপরে আছেন।

এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার এরশাদ হচ্ছে:

﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ ٢٥٥﴾ [البقرة: 255]

“আর তিনিই সর্বোচ্চ ও মহান সত্তা।” [বাকারা ; ২৫৫]

﴿ وَهُوَ ٱلۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهِۦۚ وَهُوَ ٱلۡحَكِيمُ ٱلۡخَبِيرُ ١٨ ﴾ [الأنعام: 18]

“তিনি তাঁর বান্দাহদের উপর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। তিনি জ্ঞানী এবং সব বিষয়ে ওয়াকিফহাল।” [আন‘আম: ১৮]

 সব কিছুই আল্লাহর সৃষ্টি

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۖ﴾ [يونس: 3]

“তিনি আসমান ও যমীন ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর উঠেছেন। তিনি যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করেন।” [ইউনুছ: ৩]

আল্লাহ তা‘আলার আরশের উপর উঠার অর্থ হচ্ছে তাঁর সত্তা স্বীয় বিরাটত্ব ও বড়ত্বের জন্য যেমনটি শোভনীয় ঠিক তেমনভাবে আরশের উপর উঠা। এর অবস্থা ও রূপরেখা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির সাথে রয়েছেন। (সাথে থাকার অর্থ এ নয় যে, তিনি তাদের সাথে লেগে বা মিশে আছেন বরং তিনি আরশের উপরেই রয়েছেন।) আরশের উপর থেকে তিনি সৃষ্টির সব অবস্থা সম্পর্কেই জ্ঞাত আছেন। তিনি তাদের কথা শুনেন। তাদের কার্যকলাপ দেখতে পান। তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ফকীরকে রিযিক দান করেন। নি:স্ব ও অভাবী ব্যক্তির অভাব পূরণ করেন। যাকে ইচ্ছা রজত্ব দান করেন। যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন। যাকে ইচ্ছা অপমাণিত করেন। তাঁর হাতেই সমস্ত কল্যাণ নিহিত। সব কিছুর উপরই তিনি ক্ষমতাবান। যার এত বড় শান তিনি প্রকৃত অর্থেই তাঁর সৃষ্টির সাথে রয়েছেন। যদিও তিনি প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির উর্ধালোকে আরশের উপর রয়েছেন।

﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١﴾ [الشورى: 11]

“বিশ্বের কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সব কিছুই শুনেন এবং দেখেন।” [শূরা : ১১]

হুলুলিয়া[1] এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত আমরা এ কথা বলিনা যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টি জগত বা মাখলুকের সাথে এই যমীনে বিরাজ করছেন।

আমরা মনে করি যারা এধরনের কথা বলে তারা কাফের অথবা পথভ্রষ্ট। কারণ আল্লাহর শানে যা অশোভনীয় এবং অবমাননাকর তারা তাই বলছে।

 আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে খবর বা তথ্য জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাতেই এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। তারপর [দুনিয়াবাসীকে উদ্দেশ্য করে] বলতে থাকেন:

«من يدعوني فأستجيب له من يسألنى فأعطيه من يستغفرنى فأغفر له»

কে আমাকে ডাকবে যে আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আমার কাছে চাইবে যে আমি তাকে দান করব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে যে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? [মুয়াত্তা ১/২১৪, বুখারী ৯/২৫,২৬, মুসলিম ১/৫২১]

আল্লাহ বিচার-ফায়সালা করবেন

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা নির্ধারিত দিন অর্থাৎ শেষ বিচারের দিন বান্দাহদের মাঝে বিচার-ফায়সালা করার জন্য আগমন করবেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿كَلَّآۖ إِذَا دُكَّتِ ٱلۡأَرۡضُ دَكّٗا دَكّٗا ٢١ وَجَآءَ رَبُّكَ وَٱلۡمَلَكُ صَفّٗا صَفّٗا ٢٢ وَجِاْيٓءَ يَوۡمَئِذِۢ بِجَهَنَّمَۚ يَوۡمَئِذٖ يَتَذَكَّرُ ٱلۡإِنسَٰنُ وَأَنَّىٰ لَهُ ٱلذِّكۡرَىٰ ٢٣﴾ [الفجر: 21-23]

“কখনো নয়, যমীনকে যখন চুর্ণ-বিচুর্ণ করে বালুকাময় বানিয়ে দেয়া হবে এবং তোমার রব আগমন করবেন, আর ফিরিশ্‌তারা সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় থাকবে, জাহান্নামকে সেদিন সবার সামনে উপস্থিত করা হবে। সেদিন মানুষ স্মরণ করবে। কিন্তু তখন তার বোধশক্তি ফিরে পাওয়ায় কি লাভ হবে।” [ফজর : ২১ -২৩]

আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা

﴿ فَعَّالٞ لِّمَا يُرِيدُ ١٦﴾ [البروج: 16]

“[আল্লাহ] যা ইচ্ছা করেন তা সম্পন্ন করেই ছাড়েন।” [বুরুজ: ১৬]

আল্লাহর ইচ্ছা দু’রকমের

আমরা আরও ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা দু’রকমের: ১। কাউনিয়্যাহ ২। শারইয়্যাহ

১। কাউনিয়্যাহ : এ ধরনের ইচ্ছা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাকৃত জিনিসটি সম্পন্ন হয়। তবে জিনিসটি আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হওয়ার ব্যাপারটি জরূরী নয়। আর এটা দ্বারাই আল্লাহর ‘মাশিয়াত’ বা ইচ্ছা বুঝানো হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلُواْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ ٢٥٣﴾ [البقرة: 253]

“আল্লাহ চাইলে তারা পরস্পরে লড়াই করতে পারতো না-কিন্তু আল্লাহ যা চান তাই করেন।” [বাকারা : ২৫৩]

﴿ إِن كَانَ ٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يُغۡوِيَكُمۡۚ هُوَ رَبُّكُمۡ﴾ [هود: 34]

“যদি আল্লাহই তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চান (তাহলে কোন নসিহতই কাজে আসবে না)। তিনিই হচ্ছেন তোমাদের রব।” [হূদ : ৩৪]

২। শরইয়্যাহ : এ ধরনের ইচ্ছা দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাকৃত জিনিসটি সম্পন্ন হওয়া অপরিহার্য নয়। তবে এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত জিনিস বা বিষয়টি তাঁর পছন্দনীয় হতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿وَٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيۡكُمۡ﴾ [النساء: 27]

“আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিতে চান।” [নিসা : ২৭]

আমরা আরও ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার কাউনী এবং শর‘য়ী উভয় ইচ্ছাই তাঁর হিকমতের অধীন। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কাউনী ইচ্ছানুযায়ী যা ফয়সালা করেন অথবা শর‘য়ী ইচ্ছানুযায়ী বান্দাহ [মাখলুক] যে ইবাদত করে উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর হিকমত নিহিত রয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহর হিকমতের কিছু আমরা বুঝতে সক্ষম হই বা না হই অথবা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি এ ক্ষেত্রে অক্ষম হলেও কিছু যায় আসে না। [সর্বাবস্থাতেই তিনি সবচেয়ে বড় হাকীম]

﴿أَلَيۡسَ ٱللَّهُ بِأَحۡكَمِ ٱلۡحَٰكِمِينَ ٨﴾ [التين: 8]

“আল্লাহ কি সবচেয়ে বড় হাকীম নন?” [তীন: ৮]

﴿ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكۡمٗا لِّقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ٥٠﴾ [المائدة: 50]

“যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ী তাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুমের অধীকারী আর কে হতে পারে?” [মায়েদা: ৫০]

আল্লাহর ভালবাসা

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অলিগণকে ভালবাসেন। তাঁরাও আল্লাহকে ভালবাসেন।

﴿ قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ﴾ [آل عمران: 31]

“হে নবী! লোকদের বলে দাও, তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালবাস বলে দাবী করো, তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন।” [আল ইমরান : ৩১]

﴿ فَسَوۡفَ يَأۡتِي ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ يُحِبُّهُمۡ وَيُحِبُّونَهُۥٓ﴾ [المائدة: 54]

(তোমাদের কেউ যদি নিজের দ্বীন থেকে ফিরে যায়, তবে যাক না) আল্লাহ আরো এমন জাতির উত্থান ঘটাবেন যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসবেন আর তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবেন। [মায়েদা: ৫৪]

﴿وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٤٦﴾ [آل عمران: 146]

“আল্লাহ ধৈর্যশীল লোকদেরকে ভালবাসেন।” [আল ইমরান: ১৪৬]

﴿ وَأَقۡسِطُوٓاْۖ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٩﴾ [الحجرات: 9]

“তোমরা ইনসাফ করো। আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন” [হুজুরাত : ৯]

﴿ وَأَحۡسِنُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٩٥﴾ [البقرة: 195]

“তোমরা ইহসান করো। আল্লাহ মুহসিন বান্দাগণকে ভালবাসেন।” [বাকারা : ১৯৫]

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা সেসব কাজ ও কথার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি সেগুলোকে পছন্দ করেন; আর সেসব জিনিস তিনি নিষেধ করেছেন সেগুলোকে তিনি অপছন্দ করেন ।

﴿إِن تَكۡفُرُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنكُمۡۖ وَلَا يَرۡضَىٰ لِعِبَادِهِ ٱلۡكُفۡرَۖ وَإِن تَشۡكُرُواْ يَرۡضَهُ لَكُمۡۗ ﴾ [الزمر: 7]

“তোমরা যদি কুফরী করো তাহলে [মনে রেখো] আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তাঁর বান্দাহদের জন্য কুফরী পছন্দ করেন না। আ তোমরা শোকর করলে তিনি তোমাদের জন্য তা পছন্দ করেন।” [যুমার : ৭]

﴿ وَلَٰكِن كَرِهَ ٱللَّهُ ٱنۢبِعَاثَهُمۡ فَثَبَّطَهُمۡ وَقِيلَ ٱقۡعُدُواْ مَعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ ٤٦﴾ [التوبة: 46]

“তাদের বের হয়ে যাবার যদি ইচ্ছা সত্যিই থাকতো তবে তারা সে জন্য কিছু প্রস্তুতি অবশ্যই গ্রহণ করতো। কিন্তু তাদের সংকল্পবদ্ধ হওয়াটাই আল্লাহর পছন্দ ছিলো না। তাই আল্লাহ তাদেরকে অবসাদগ্রস্ত করে দিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন, ‘বসে থাকো বসে থাকা অন্যান্য লোকদের সাথে।” [তাওবা: ৪৬]

 আল্লাহর সন্তুষ্টি

আমরা ঈমান আনি যে, যারা ঈমানদার এবং নেক আমল করে আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট।

﴿ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ ذَٰلِكَ لِمَنۡ خَشِيَ رَبَّهُۥ ٨﴾ [البينة: 8]

“তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এ সন্তুষ্টি তার জন্যই যে ব্যক্তি স্বীয় রবকে ভয় করে।” [বাইয়িনাহ : ৮]

 আল্লাহর গযব

আমরা আরও ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা কাফের এবং অন্যান্য এমন লোকদের উপরই গযব নাযিল করেন যারা গযবের উপযুক্ত।

﴿ٱلظَّآنِّينَ بِٱللَّهِ ظَنَّ ٱلسَّوۡءِۚ عَلَيۡهِمۡ دَآئِرَةُ ٱلسَّوۡءِۖ وَغَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡ﴾ [الفتح: 6]

“যারা আল্লাহ সম্পর্কে কারাপ ধারণা পোষণ করে, দোষ-ত্রুটি ও খারাপের আবর্তে তারা নিজেরাই নিমজ্জিত। তাদের উপরই আল্লাহর গযব পড়েছে।” [ফাতহ: ৬]

﴿وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦﴾ [النحل: 106]

“কিন্তু যারা মনের সন্তোষ সহকারে কুফরী গ্রহণ করে নিয়েছে তাদের উপরই আল্লাহর গযব। এসব লোকদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি” [নাহল : ১০৬]

 আল্লাহর চেহারা

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার চেহারা রয়েছে যা “জালাল ও ইকরাম” অর্থাৎ মহিয়ান এবং গরিয়ান গুণ বিশিষ্ট।

﴿وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ ٢٧﴾ [الرحمن: 27]

“এবং কেবলমাত্র তোমরা রবের মহিয়ান ও গরিয়ান চেহারাই অবশিষ্ট থাকবে।” [রাহমান : ২৭]

আল্লাহর হাত

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার উদার এবং উম্মুক্ত দুটি হাত রয়েছে।

﴿بَلۡ يَدَاهُ مَبۡسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيۡفَ يَشَآءُۚ﴾ [المائدة: 64]

“আল্লাহর হাত তো উদার ও উন্মুক্ত। তিনি যেভাবেই ইচ্ছা খরচ করেন।” [মায়েদা : ৬৪]

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: 67]

“এসব লোকেরা তো আল্লাহর কদর যতটুকু করা উচিৎ তা করলো না, অথচ কেয়ামতের দিন গোটা যমীন তাঁর মুষ্ঠির মধ্যে থাকবে। আসমানসমূহ থাকবে তার ডান হাতের মধ্যে পেচানো অবস্থায়। এসব লোকেরা যে শিরক করে তা হতে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।” [যুমার: ৬৭]

 আল্লাহর চক্ষু

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার দুটি হাকীকী (প্রকৃত) চক্ষু আছে। এর প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত বাণী:

﴿وَٱصۡنَعِ ٱلۡفُلۡكَ بِأَعۡيُنِنَا وَوَحۡيِنَا﴾ [هود 37]

“আমার চোখের সামনে এবং অহী মোতাবেক তুমি নৌকা তৈরী করো।” [হূদ : ৩৭]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

«حجابه النور لو كشفه لأحرقت سبحات وجهه ما انتهى اليه بصره من خلقه»

নূর হলো আল্লাহর পর্দা। যদি তিনি তা উন্মুক্ত করেন তাহলে তাঁর নুরের তাজাল্লী সৃষ্টি জগতের যতদূর পর্যন্ত চোখের দৃষ্টি পৌঁছবে, জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। [মুসলিম, ইবন মাজা]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এ ব্যাপারে একমত যে আল্লাহ তা‘আলার দুটি চক্ষু রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাজ্জাল সম্পর্কিত হাদীসটি এর সমর্থন করছে। এ হাদীসটিতে তিনি বলেছেন:

إنه أعور وإن ربكم ليس بأعور

সে [দাজ্জাল] হলো কানা [এক চোখে দেখে] আর আমাদের রব কানা নন। [বুখারী ও মুসলিম]

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿ لَّا تُدۡرِكُهُ ٱلۡأَبۡصَٰرُ وَهُوَ يُدۡرِكُ ٱلۡأَبۡصَٰرَۖ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ ١٠٣﴾ [الأنعام: 103]

“আমরা তা‘আলাকে দুনিয়ার কোন চোখ প্রত্যক্ষ করতে পারে না বরং তিনিই সমস্ত চোখকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। তিনি অতিশয় সুক্ষ্নদর্শী এবং সর্ববিষয়ে ওয়াকিফহাল।” [আন‘আম: ১০৩]

মুমিন লোকেরা আল্লাহকে দেখতে পাবে

আমরা একথা ঈমান আনি যে, মুমিন ব্যক্তিগন কেয়ামতের দিন তাঁকে [রবকে] দেখতে পাবে।

﴿وُجُوهٞ يَوۡمَئِذٖ نَّاضِرَةٌ ٢٢ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٞ ٢٣﴾ [القيامة: 22-23]

“সেদিন [কেয়ামতের দিন] কিছু সংখ্যক চেহারা হাস্যোজ্জল হবে। নিজেদের রবের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখবে।” [কিয়ামাহ : ২২-২৩]

কোন কিছুই আল্লাহর মত নয়

আমরা আরও ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার কোন দৃষ্টান্ত নেই, তাঁর সিফাতে কামাল বা পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীর কারণে।

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١﴾ [الشورى: 11]

“কোন কিছুই তার মত নয়। তিনি সব কিছুই শুনেন এবং দেখেন।” [শূরা : ১১]

 আল্লাহর তন্দ্রা ও ঘুম নেই

আমরা আরও ঈমান আনি যে,

﴿لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ وَلَا نَوۡمٞۚ ﴾ [البقرة: 255]

“না তন্দ্রা, না নিদ্রা তাঁকে [আল্লাহকে] স্পর্শ করতে পারে।” [বাকারা : ২৫৫]

আল্লাহ পূর্ণ ইনসাফগার

আমরা আরও ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর “কামালে আদল” [পূর্ণ ইনসাফ] এর গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে কারো প্রতি জুলুম করেন না।

অনুরূপভাবে, তিনি তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও আয়ত্তের গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে বান্দাহদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে গাফেল ও উদাসীন নন।

 আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতা অসীম

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলার অসীম জ্ঞান ও ক্ষমতার কারণে আকাশ ও যমীনের কোন জিনিসই তাঁকে অক্ষম অপারগ বানাতে পারে না।

﴿إِنَّمَآ أَمۡرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيۡ‍ًٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٨٢﴾ [يس: 82]

“অর্থাৎ আল্লাহ যখন কোন জিনিসের ইচ্ছা পোষণ করেন তখন তিনি [কাঙ্খিত] জিনিসটিকে শুধু বলেন: “হয়ে যাও”। অমনি তা হয়ে যায়।” [ইয়াসীন: ৮২]

অনুরূপ, পূর্ণ শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হবার ফলে তিনি কখনো ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন না।

﴿وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ وَمَا مَسَّنَا مِن لُّغُوبٖ ٣٨﴾ [ق: 38]

“আমি যমীন ও আসমানসমূহ এবং এ দু’য়ের মধ্যে অবস্থিত সব জিনিসকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি। এতে কোন ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি।” [ক্বাফ: ৩৮]

 আল্লাহর নাম ও সিফাত

যেসব নাম ও গুণাবলী আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজের জন্য ঘোষণা করেছেন অথবা তাঁর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাব্যস্ত করেছেন বা স্বীকৃতি দিয়েছেন, সেসব নাম ও গুণাবলীর প্রতি আমরা ঈমান রাখি। কিন্তু কঠিনভাবে নিষিদ্ধ দু’টি জিনিসকে আমরা অস্বীকার করি। আর তা হচ্ছে: ১. তামছীল; ২. তাকয়ীফ।

১. তামছীল: অর্থাৎ অন্তরে কিংবা মূখে এ কথা বলা, “আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী মাখলুকের গুণাবলীর মত।

২. তাকয়ীফ: অর্থাৎ অন্তরে কিংবা মুখে একথা বলা, “আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীর অবস্থা, আকৃতি বা সূরত এ রকমের।

অনুরূপভাবে, যেসব বিষয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ব্যাপারে অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ব্যাপারে নেতিবাচক ঘোষণা করেছেন সেসব বিষয় নেতিবাচক হিসেবেই আমরা ঈমান আনি। এ সব নফী বা নেতিবাচক বিষয়গুলো, এর বিপরীতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কামালিয়াত তথা পূর্ণতাসম্পন্ন গুণ সাব্যস্ত করে। আর যেসব বিষয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুই বলেননি সেসব বিষয়ে আমরা চুপ থাকি।

আকীদা ও তাওহীদের এ পথে চলা ফরয

আমরা মনে করি যে, এ আক্বীদা ও তাওহীদের উপরে বর্ণিত পথে চলা ফরয ও অপরিহার্য। কারণ যেসব বিষয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক বলে ঘোষণা করেছেন সে সব বিষয়গুলো এমন সংবাদ ও তথ্য যা তিনি আপন সত্তা সম্পর্কে পরিবেশন করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জ্ঞান রাখেন। তিনি সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সবচেয়ে সুন্দর বচনের অধিকারী। বান্দারা নিজের জ্ঞান দ্বারা তাঁকে আয়ত্ত করতে পারে না।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে যে সব বিষয় ইতিবাচক বা নেতিবাচক বলে ঘোষণা করেছেন সেগুলো হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবেশিত খবর বা তথ্য। তিনি হচ্ছেন এমন এক মহান ব্যক্তি যিনি ‘আপন রব’ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী। সবচেয়ে উত্তম নসীহতকারী। সবচেয়ে বেশী সত্যবাদী এবং সুন্দর ভাষার অধিকারী। অতএব আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হচ্ছে জ্ঞান, সত্যবাদিতা এবং পরিপূর্ণ বর্ণনায় সমৃদ্ধ। তাই তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার সংশয় অথবা প্রত্যাখ্যান করার ব্যপারে কোন ওজর আপত্তি চলতে পারে না।

 অধ্যায়

 আল্লাহর উপর ঈমান

আল্লাহ তা‘আলার উপর যে সব ইতিবাচক বা নেতিবাচক সিফাত ও গুণাবলীর কথা বিস্তারিতভাবে কিংবা সংক্ষেপে পেশ করেছি সেগুলোর ব্যাপারে আমরা সবচেয়ে বেশী নির্ভর করছি কুরআন ও সুন্নাহর উপর। আমরা সবচেয়ে বেশী আস্থাশীল সে পথ ও নীতির উপর যা অবলম্বন করেছেন এ উম্মাতেরই সালাফে সালেহীন এবং হেদায়াতের পথিকৃত ইমামগণ।

আমরা মনে করি আল্লাহর নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর উক্তিগুলোর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করা অপরিহার্য। এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলার শানের সাথে সামঞ্জস্যশীল ও শোভনীয় “হাকীকত” এর উপর এগুলোর বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক।

আমরা কুরআন ও সুন্নাহর এসব উক্তিকে যারা পরিবর্তন করেছে এবং আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলো যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন, সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে যারাই তা পরিবর্তন করেছে তাদের পথকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি।

তাদের পথকেও আমরা পরিত্যাগ করি যারা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতগুলোকে বিকৃত করে এবং এসব উক্তির দ্বারা আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা উদ্দেশ্য নিয়েছেন তা গ্রহণ না করে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেয়।

অনুরূপভাবে, আমরা তাদের পথও পরিত্যাগ করি, যারা আল্লাহর সিফাতসংক্রান্ত এ বাণীগুলোকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের  উদ্দেশ্যকৃত অর্থ নিষিদ্ধ করে সেগুলোকে তা‘তীল বা অর্থহীন করে নেয়।

তদ্রূপ, আমরা সে পথও পরিত্যাগ করি, যারা “মুগালীন” অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতগুলোর ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে এবং বাড়াবাড়ি করে এগুলোকে কোন সুনির্দিষ্ট আকার আকৃতির উপর প্রয়োগ দেখায় অথবা এগুলোর উদ্দেশ্যকে বুঝানোর জন্য নিজেরাই অবয়ব বানিয়ে নেয়।  

আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে কুরআন ও সুন্নায় যা এসেছে তার সবই হক এবং সত্য। একটা অপরটার বিরোধী কিংবা বিপরীত নয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন:

﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢﴾ [النساء: 82]

“এরা কি কুরআন নিয়ে গভীর মনোনিবশের সাথে চিন্তা-ভাবনা করে না? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আসতো তাহলে এতে অনেক স্ববিরোধিতা পাওয়া যেতো।” [নিসা : ৮২]

কারণ, খবরাদি যদি পরস্পর বিরোধী হয় তাহলে একটি অপরটির মিথ্যা হওয়াকে অবধারিত করে তোলে। আল্লাহ ও রাসূলের পরিবেশিত খবরের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়া একেবারেই অসম্ভব।

যে ব্যক্তি এই দাবী করে যে, আল্লাহ তআলার কিতাবে কিংবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নায় অথবা উভয়টিতেই পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে, তাহলে এ দাবী হবে তার অসৎ উদ্দেশ্য বা তার অন্তরে বিদ্যমান বক্রতার কারণে। এ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক দাবীর জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার তাওবা করা এবং সাথে সাথে তার এ ভ্রান্তি ও গোমরাহী পরিত্যাগ করা উচিৎ।

আল্লাহর কিতাব কিংবা নবীর সুন্নায় অথবা উভয়টাতেই পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে যদি কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ দেখা দেয়, তাহলে মনে করতে হবে, তার মধ্যে জ্ঞানের স্বল্পতা অথবা বুঝতে অক্ষমতা অথবা তার চিন্তা শক্তিতে রয়েছে যথেষ্ট অপরিপক্বতা ও অপরিচ্ছন্নতা। এমতাবস্থায় তার উচিৎ আরো জ্ঞান-সাধনা করা। চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে আরো অধ্যাবসায়ী হওয়া। যাতে করে তার কাছে সত্য আরো উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। আর যদি কোন বিষয় তার কাছে সুস্পষ্ট না হয়, তাহলে বিষয়টি কোন আলেমের উপর ন্যাস্ত করা উচিৎ। সংশয়ের পথ পরিত্যাগ করা উচিৎ। জ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ যা বলে থাকেন এমতাবস্থায় তারও তাই বলা উচিৎ।

﴿ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ﴾ [آل عمران: 7]

“এর প্রতি আমরা ঈমান এনেছি। এর সবই আমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে”। [আল ইমরান : ৭] তার জেনে রাখা উচিৎ যে, কুরআন ও সুন্নায় কোন পারস্পরিক বিরোধিতা নেই। এ দু’য়ের মধ্যে কোন বৈপরিত্য ও বিরোধিতা নেই।

 অধ্যায়

ফিরিশ্‌তাদের প্রতি ঈমান

আমরা আল্লাহ তা‘আলার ফিরিশ্‌তাদের প্রতি ঈমান আনি। আরও ঈমান রাখি যে,  

﴿عِبَادٞ مُّكۡرَمُونَ ٢٦ لَا يَسۡبِقُونَهُۥ بِٱلۡقَوۡلِ وَهُم بِأَمۡرِهِۦ يَعۡمَلُونَ ٢٧﴾ [الأنبياء: 26-27]

“তারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দাহ। তারা তাঁর দরবারে আগে বেড়ে কথা বলে না। শুধু তাঁরই হুকুমে তারা কাজ করে।” [আম্বিয়া: ২৬, ২৭]

তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন। তারা তাঁরই ইবাদতে মগ্ন এবং তাঁরই আনুগত্যে নিয়োজিত।

﴿لَا يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِهِۦ وَلَا يَسۡتَحۡسِرُونَ ١٩ يُسَبِّحُونَ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ لَا يَفۡتُرُونَ ٢٠﴾ [الأنبياء: 19- 20]

“তারা আল্লাহর ইবাদত করতে অহংকার করে না। অলসতাও করে না। রাত দিন তাঁরই তাসবীহ পাঠে ব্যস্ত থাকে, একবিন্দুও থামে না।” [আম্বিয়া: ১৯-২০]

আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আমাদের থেকে আড়াল করে রেখেছেন ফলে আমরা তাদের দেখতে পাই না। কোন কোন সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কতিপয় বান্দাহর জন্য তাদের পর্দাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন (ফলে তারা দেখতে পেয়েছেন)। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামকে তাঁর আসল রূপে দেখতে পেয়েছেন, তাঁর ছিল ছয়শত ডানা যা দিগন্তকে ঢেকে ফেলেছিল [বুখারী]। অনুরূপভাবে জিবরাইল আলাইহিস সালাম মরিয়ম আলাইহাস সালামের নিকট পূর্ণাঙ্গ মানুষের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তখন মারইয়াম তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন আর তিনিও মারইয়ামের সাথে কথা বলেছিলেন। আর একবার একজন অপরিচিত মানুষের ছুরতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পাশেই তখন অবস্থান করছিলেন। জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) এমনভাবে রাসূলের কাছে আসলেন যে, তাঁর মাঝে সফরের কোন আলামত দেখা যায়নি। কাপড় ছিল ধব-ধবে সাদা। চুলগুলো খুবই কাল বর্ণের। জিবরাইল নিজ হাটু তাঁর হাটুর কাছাকাছি নিয়ে বসলেন। তাঁর হাত দুখানা দু’রানের উপর রেখে রাসূলের মুখোমুখি বসলেন। তারপর একে অপরকে লক্ষ্য করে কথাবার্তা বললেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জানালেন যে, তিনি [আগত ব্যক্তি] হচ্ছেনা জিবরাঈল [আলাইহিস সালাম] [বুখারী]।

আমরা ঈমান আনি যে, ফিরিশ্‌তাদেরকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন জিবরাইল [আলাইহিস সালাম] এর দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী নবী ও রাসূলগণের প্রতি অহী নাযিল করা।

মীকাঈল [আলাইহিস সালাম] এর দায়িত্ব হচ্ছে, বৃষ্টি বর্ষণ, তৃণ-লতা ও শাকশবজী উৎপাদনের কাজ আনজাম দেয়া।

ইসরাফীল [আলাইহিস সালাম] এর দায়িত্ব হচ্ছে, কিয়ামত ও পুনরুত্থানের সময় সিংগায় ফুঁক দেয়া।

মালাকুল মাওত [আলাইহিস সালাম] এর দায়িত্ব হচ্ছে, মৃত্যূর সময় “রুহ” কবয করা। এমনিভাবে পাহাড় সংক্রান্ত ব্যাপারে ফিরিশ্‌তা নিয়োজিত রয়েছে। আবার জাহান্নামের রক্ষক হিসেবেও নিয়োজিত রয়েছে একজন ফিরিশ্‌তা।

কিছু সংখ্যক ফিরিশ্‌তা মাতৃগর্ভস্থ সন্তানের দায়িত্বে নিয়োজিত। আর কিছু সংখ্যক ফিরিশ্‌তা এমন আছে যারা আদম সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করে। ফিরিশ্‌তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক এমনও রয়েছে যারা মানুষের আমলনামা লেখার কাজে নিয়োজিত। একাজে প্রতিটি মানুষের জন্যই দু’জন ফিরিশ্‌তা নিয়োজিত রয়েছে।

﴿عَنِ ٱلۡيَمِينِ وَعَنِ ٱلشِّمَالِ قَعِيدٞ ١٧ مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ ١٨﴾ [ق: 17-18]

“ডান ও বাম দিকে বসে তারা প্রতিটি কাজ লিপিবদ্ধ করে। এমন কোন শব্দ বান্দার মুখে উচ্চারিত হয় না যা সংরক্ষণের জন্য স্থায়ী পর্যবেক্ষণকারী নেই।” [ক্বাফ : ১৭-১৮]

আরো এমন কিছু সংখ্যক ফিরিশ্‌তা রয়েছে যারা মৃত ব্যক্তিকে তার গন্তব্যস্থান অর্থাৎ কবরে রাখার পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। কবরে দু’জন ফিরিশ্‌তা আসে। তারা মৃত ব্যক্তিকে তাঁর রব, দ্বীন এবং নবী সম্পর্কে প্রশ্ন করে।

﴿يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱلۡقَوۡلِ ٱلثَّابِتِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِۖ وَيُضِلُّ ٱللَّهُ ٱلظَّٰلِمِينَۚ وَيَفۡعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ ٢٧﴾ [إبراهيم: 17]

“তখন ঈমানদারগণকে আল্লাহ এক প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত কথার ভিত্তিতে দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় স্থানে প্রতিষ্ঠা দান করেন। আর জালেম লোকদেরকে আল্লাহ বিভ্রান্ত করে দেন। আল্লাহ যা চান তাই করেন।” [ইবরাহীম: ২৭]

জান্নাতবাসীদের জন্যও কিছু সংখ্যক ফিরিশ্‌তা নিয়োজিত রয়েছে।

﴿يَدۡخُلُونَ عَلَيۡهِم مِّن كُلِّ بَابٖ ٢٣ سَلَٰمٌ عَلَيۡكُم بِمَا صَبَرۡتُمۡۚ فَنِعۡمَ عُقۡبَى ٱلدَّارِ ٢٤﴾ [الرعد: 23-24]

“তারা জান্নাতবাসীদের সাদর সম্ভাষণের জন্য চার দিক থেকে আসবে আর বলতে থাকবে, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা দুনিয়াতে যেভাবে ধৈর্য অবলম্বন করেছো তার বিনিময়ে আজ তোমরা এ পুরস্কারের অধিকারী হয়েছো।” [রা‘দ: ২৩-২৪]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, উর্ধাকাশে অবস্থিত “আল-বাইতুল মামুর” এ প্রতিদিন সত্তর হাজার ফিরিশ্‌তা প্রবেশ করে অথবা নামাজ পড়ে। তাদের সংখ্যা এতই অধিক যে, এরপর তারা আর কোন দিন দ্বিতীয়বার এতে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে না। [বুখারী- মুসলিম]

 অধ্যায়

 আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী-রাসূলগণের উপর কিতাব নাযিল করেছেন। এসব কিতাব নাযিল করেছেন সমগ্র সৃষ্টিকুলের বিপক্ষে প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং নেক আমলকারীদের পক্ষে দলীল প্রমাণ হিসেবে। এসব কিতাবের মাধ্যমে নবী রাসূলগণ মানুষকে হিকমত শিক্ষা দেন এবং তাদের আত্মশুদ্ধি করেন।

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাসূলের উপরই কিতাব নাযিল করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَنزَلۡنَا مَعَهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡمِيزَانَ لِيَقُومَ ٱلنَّاسُ بِٱلۡقِسۡطِۖ﴾ [الحديد: 25]

“আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ পাঠিয়েছি। তাদের সাথে নাযিল করেছি কিতাব এবং মীযান। যাতে করে মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের উপর কায়েম থাকতে পারে।” [হাদীদ : ২৫]

আমরা আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে নিম্নোক্ত কিতাবগুলোর কথা জানি:

১. তাওরাত: এ কিতাব আল্লাহ তা‘আলা মূসা [আলাইহিস সালাম] এর উপর নাযিল করেছেন। বনী ইসরাইলের জন্য এটা সর্বশ্র্রেষ্ঠ কিতাব।

﴿فِيهَا هُدٗى وَنُورٞۚ يَحۡكُمُ بِهَا ٱلنَّبِيُّونَ ٱلَّذِينَ أَسۡلَمُواْ لِلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلرَّبَّٰنِيُّونَ وَٱلۡأَحۡبَارُ بِمَا ٱسۡتُحۡفِظُواْ مِن كِتَٰبِ ٱللَّهِ وَكَانُواْ عَلَيۡهِ شُهَدَآءَۚ ﴾ [المائدة: 44]

“এতে রয়েছে হেদায়াত এবং আলোকবর্তিকা। এর দ্বারা নিবেদিত প্রাণ নবীগণ ইয়াহূদীদের যাবতীয় বিচার-ফয়সালা করতেন, অনুরূপভাবে আলেম ও ফকীহগণও। কারণ তাঁদেরকে আল্লাহর কিতাবের হিফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। আর তারা ছিলো এ কিতাবের সাক্ষী।” [মায়েদা : ৪৪]

২. ইঞ্জীল: ঈসা [আলাইহিস সালাম] এর উপর আল্লাহ তা‘আলা ইঞ্জীল কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবটি তাওরাতের সমর্থক ও পরিপূরক।

﴿وَءَاتَيۡنَٰهُ ٱلۡإِنجِيلَ فِيهِ هُدٗى وَنُورٞ وَمُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَهُدٗى وَمَوۡعِظَةٗ لِّلۡمُتَّقِينَ ٤٦﴾ [المائدة: 46]

“আমি ঈসাকে ইঞ্জীল দান করেছি। এতে রয়েছে হিদায়াত ও [গোমরাহী থেকে বেচে থাকার] আলো। তাওরাতের [হুকুম আহকাম থেকে] যা কিছু এর সামনে ছিলো এ কিতাব তারই সমর্থক এবং সত্যতা প্রমাণকারী। এতে রয়েছে মুত্তাকী লোকদের জন্য হিদায়াত ও নসীহত।” [মায়েদা : ৪৬]

﴿وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعۡضَ ٱلَّذِي حُرِّمَ عَلَيۡكُمۡۚ﴾ [آل عمران: 50]

“ইঞ্জীল কিতাব নাযিলের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, তোমাদের উপর যা হারাম ছিলো এমন কতিপয় জিনিস আমি তোমাদের জন্য হালাল করে দেবো।” [আল-ইমরান :৫০]

৩. যাবূর: আল্লাহ তা‘আলা যাবূর কিতাবটি দাউদ [আলাইহিস সালাম] এর উপর নাযিল করেছেন।

৪. ইবরাহীম এবং মূসা [আলাইহিস সালাম] এর উপর ছহীফা [ছোট কিতাব] নাযিল হয়েছে।

৫. সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীম নাযিল করেছেন।

﴿هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ﴾ [البقرة: 185]

“গোটা মানব জাতির জন্য হিদায়েত স্বরূপ এ কুতাব এমন সুস্পষ্ট নির্দশনাবলী দ্বারা পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শন করে। হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য পরিস্কার ভাবে তুলে ধরে।” [বাকারা : ১৮৫]

﴿مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمُهَيۡمِنًا عَلَيۡهِۖ﴾ [المائدة: 48]

“পূর্বে নাযিলকৃত কিতাবের মধ্য থেকে সত্যরূপে যা এ কিতাবের সামনে রয়েছে এটি তার সত্যতা প্রমাণকারী এবং হিফাযত ও সংরক্ষণকারী।” [মায়েদা : ৪৮]

এ কিতাব নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের যাবতীয় কিতাবের হুকুম রহিত করে দিয়েছেন। তিনি এ কিতাবকে সব ধরনের সংশয়কারী এবং পরিবর্তন সাধনকারীর দুষ্কর্ম থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩﴾ [الحجر: 9]

“কুরআন আমিই নাযিল করেছি এবং নিজেই এর হিফাযতকারী।” [হিজর : ৯] কারণ এ কিতাব কিয়ামত পর্যন্ত গোটা সৃষ্টির জন্য দলীল হিসেবে অবশিষ্ট থাকবে।

পূর্ববর্তী কিতাবগুলো ছিলো অস্থায়ী/সাময়িক। এগুলোর জন্য একটা সময় নির্ধারিত ছিলো। রহিতকারী কিতাব (কুরআন) নাযিলের মাধ্যমে পূর্বেকার কিতাবগুলোর নিজস্ব কার্যকারিতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে কি কি রদ-বদল ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তারও বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এজন্যই এ কিতাবগুলো (পরবর্তী সময়ের জন্য) ত্রুটিমুক্ত ছিল না বরং সেগুলোতে অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে।

﴿ٱلَّذِينَ هَادُواْ يُحَرِّفُونَ ٱلۡكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِۦ﴾ [النساء: 46]

“ইয়াহূদীদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা কিতাবের বাক্যগুলোকে তাদের মূল অর্থ হতে সরিয়ে দেয়।” (অর্থাৎ বিকৃতি ঘটায়) [নিসা : ৪৬]

﴿فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩﴾ [البقرة: 79]

“সে সব লোকের জন্য ধ্বংস অনিবার্য যারা নিজেদের হাতে শরী‘আতের বিধান রচনা করে। তারপর লোকদেরকে বলে যে, এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। এ রকম করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এর বিনিময়ে তারা সামান্য স্বার্থ উদ্ধার করবে। তাই তারা নিজ হাতে যা রচনা করেছে এবং অন্যায়ভাবে যা কামাই করেছে তার জন্য রয়েছে ধ্বংস ও শাস্তি।” [বাকারা: ৭৯]

﴿قُلۡ مَنۡ أَنزَلَ ٱلۡكِتَٰبَ ٱلَّذِي جَآءَ بِهِۦ مُوسَىٰ نُورٗا وَهُدٗى لِّلنَّاسِۖ تَجۡعَلُونَهُۥ قَرَاطِيسَ تُبۡدُونَهَا وَتُخۡفُونَ كَثِيرٗا﴾ [الأنعام: 91]

“হে মুহাম্মাদ! বল, মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা এবং পথ নির্দেশনা হিসেবে মূসা যে কিতাব নিয়ে এসেছিল যা তোমরা টুকরা-টুকরা করে রেখে দিচ্ছ, যার কিছু অংশ দেখাও আর বহুলাংশই লুকিয়ে রাখ- সে কিতাব কে নাযিল করেছিল?” [আন‘আম: ৯১]

﴿وَإِنَّ مِنۡهُمۡ لَفَرِيقٗا يَلۡوُۥنَ أَلۡسِنَتَهُم بِٱلۡكِتَٰبِ لِتَحۡسَبُوهُ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمَا هُوَ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ وَمَا هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٨ مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤۡتِيَهُ ٱللَّهُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحُكۡمَ وَٱلنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُواْ عِبَادٗا لِّي مِن دُونِ ٱللَّهِ﴾ [آل عمران: 78-79]

“আর তাদের মধ্যে কিছু লোক এমনও রয়েছে যারা কিতাব পাঠ করার সময় জিহবা এমন ভাবে উলট-পালট করে যাতে তোমরা মনে করো যে তারা যা পাঠ করছে তা কিতাবেরই কথা। অথচ প্রকৃতপক্ষে তা কিতাবের কথা নয়। তারা বলে এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে অথচ আল্লাহর পক্ষ থেকে তা আসে নি। আসলে তারা জেনে শুনেই আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছে। কোন মানুষের পক্ষেই এটা শোভনীয় নয় যে, আল্লাহ  তাকে কিতাব, ক্ষমতা আর নবুয়াত দান করবে আর সে এগুলো পেয়ে মানুষকে বলবে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা আমার বান্দাহ হয়ে যাও।” [আল ইমরান : ৭৮-৭৯]

﴿يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ قَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ كَثِيرٗا مِّمَّا كُنتُمۡ تُخۡفُونَ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَيَعۡفُواْ عَن كَثِيرٖۚ قَدۡ جَآءَكُم مِّنَ ٱللَّهِ نُورٞ وَكِتَٰبٞ مُّبِينٞ ١٥ يَهۡدِي بِهِ ٱللَّهُ مَنِ ٱتَّبَعَ رِضۡوَٰنَهُۥ سُبُلَ ٱلسَّلَٰمِ وَيُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِهِۦ وَيَهۡدِيهِمۡ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ١٦ لَّقَدۡ كَفَرَ ٱلَّذِينَ قَالُوٓاْ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡمَسِيحُ ٱبۡنُ مَرۡيَمَۚ﴾ [المائدة: 15-17]

“হে আহলে কিতাব আমার রাসূল তোমাদের কাছে এসেছে। তিনি তোমাদেরকে এমন অনেক কিছুই কিতাব থেকে বলে দেন যা তোমরা গোপন করে রাখছিলে।”[মায়েদা : ১৫-১৭]

 অধ্যায়

 রাসূলদের উপর ঈমান

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছেন—

﴿مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا﴾ [النساء: 165]

“সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে। যেন রাসূল পাঠাবার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে লোকদের কোন যুক্তিই না থাকে। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” [নিসা: ১৬৫]

আমরা ঈমান আনি, সর্বপ্রথম রাসূল হচ্ছেন নূহ [আলাইহিস সালাম] আর সর্বশেষ হচ্ছেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

﴿إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ﴾ [النساء: 163]

“আমি তোমার প্রতি অহী পাঠিয়েছি যেমনভাবে আমি নূহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের প্রতি অহী পাঠিয়েছি।” [নিসা : ১৬৩]

﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ﴾ [الأحزاب: 40]

“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী ।” [আহযাব : ৪০]

নবীগণের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হচ্ছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর পর্যায়ক্রমে ইবরাহীম, মূসা, নূহ এবং ঈসা ইবন মারইয়াম। তাঁরা বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِيثَٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٖ وَإِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّيثَٰقًا غَلِيظٗا ٧﴾ [الأحزاب: 7]

“হে নবী স্মরণ করো, সে ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির কথা যা আমরা সব নবীর কাছ থেকে গ্রহণ করেছি এবং তোমার কাছ থেকেও এ প্রতিশ্রুতি নিয়েছি। তাদের সবার কাছ থেকেই আমরা খুব পাকাপোক্ত ওয়াদা গ্রহণ করেছি।” [আহযাব : ৭]

আমরা দৃঢ়তার সাথে এ বিশ্বাস পোষণ করি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরী‘আত এসব বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত নবীদের শরী‘আতের মর্যাদাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর বাণী হচ্ছে:

﴿۞شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ﴾ [الشورى: 13]

“তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই নিয়ম বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যান উপদেশ তিনি নূহ [আলাইহিস সালাম] কে দিয়েছিলেন। আর আমি তোমার প্রতি অহীর মাধ্যমে যা পাঠিয়েছি, যার নির্দেশ আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকেও দিয়েছিলাম। তা হচ্ছে, তোমরা দ্বীন কায়েম করো এবং এতে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” [শূরা: ১৩]

আমরা ঈমান আনি যে, সব রাসূলই মানুষ ছিলেন। মাখলুক ছিলেন। রুবুবিয়াতের কোন গুণ বা বৈশিষ্ট্য তাঁদের মধ্যে ছিলো না। সর্বপ্রথম রাসূল নূহ [আলাইহিস সালাম] সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন :

﴿وَلَآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ وَلَآ أَقُولُ إِنِّي مَلَكٞ﴾ [هود: 31]

“আমি তোমাদের বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার রয়েছে। আমি গায়েব জানি একথাও বলি না। আমি একথাও বলি না, ‘আমি একজন ফিরিশ্‌তা।” [হূদ: ৩১]

শেষ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ তা‘আলা একথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন:

﴿لَّآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ وَلَآ أَقُولُ لَكُمۡ إِنِّي مَلَكٌۖ﴾ [الأنعام: 50]

“আমি তোমাদেরকে একথা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার আছে। আমি গায়েব জানি একথা ও আমি বলি না। আমি একজন ফিরিশ্‌তা এটাও তোমাদেরকে আমি বলি না।” [আন‘আম : ৫০]

একথা বলার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন:

﴿لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ﴾ [الأعراف: 188]

“আল্লাহ যা চান তাছাড়া নিজের কোন লাভ বা ক্ষতি করার ক্ষমতা আমার নেই।” [আ‘রাফ : ১৮৮]

আল্লাহ তা‘আলা নবীকে একথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন:

﴿قُلۡ إِنِّي لَآ أَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا رَشَدٗا ٢١ قُلۡ إِنِّي لَن يُجِيرَنِي مِنَ ٱللَّهِ أَحَدٞ وَلَنۡ أَجِدَ مِن دُونِهِۦ مُلۡتَحَدًا ٢٢﴾ [الجن: 21-22]

“বলুন, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করার ক্ষমতাও রাখিনা, কোন কল্যাণ করারও ক্ষমতা রাখি না। বল: আমাকে আল্লাহর পাকড়াও হতে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। তাঁর আশ্রয় ছাড়া আমার আর কোন আশ্রয়স্থল দেখি না।” [জিন : ২১-২২]

আমরা ঈমান আনি, নবীগণ সবাই আল্লাহর বান্দাহ। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে রিসালাতের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। তাঁদের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও প্রশংসা বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে দাসত্বের গুণে গুণান্বিত করেছেন। প্রথম রাসূল নূহ [আলাইহিস সালাম] সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ذُرِّيَّةَ مَنۡ حَمَلۡنَا مَعَ نُوحٍۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَبۡدٗا شَكُورٗا ٣﴾ [الإسراء: 3]

“তোমরা তো তাদেরই সন্তান যাদেরকে আমরা নূহ [আলাইহিস সালাম] এর সাথে [নৌকায়] বহন করেছিলাম। আর নূহ [আলাইহিস সালাম] ছিল আল্লাহর একজন শোকরগুজার বান্দাহ।” [ইসরা : ৩]

সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন:

﴿تَبَارَكَ ٱلَّذِي نَزَّلَ ٱلۡفُرۡقَانَ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦ لِيَكُونَ لِلۡعَٰلَمِينَ نَذِيرًا ١﴾ [الفرقان: 1]

“অতীব বরকতপূর্ণ সেই সত্তা যিনি এ ফুরকান স্বীয় বান্দাহর উপর নাযিল করেছেন; যেন সে সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারে।” [ফুরকান: ১]

অন্যান্য নবীগণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন:

﴿وَٱذۡكُرۡ عِبَٰدَنَآ إِبۡرَٰهِيمَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ أُوْلِي ٱلۡأَيۡدِي وَٱلۡأَبۡصَٰرِ ٤٥﴾ [ص: 45]

“আমার বান্দাহ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের কথা স্বরণ করো। তারা বড় কর্মক্ষমতা সম্পন্ন এবং দৃষ্টিমান লোক ছিলো।” [ছোয়াদ : ৪৫]

﴿ وَٱذۡكُرۡ عَبۡدَنَا دَاوُۥدَ ذَا ٱلۡأَيۡدِۖ إِنَّهُۥٓ أَوَّابٌ ١٧﴾ [ص: 17]

“আমার বান্দাহ দাউদের কথা বর্ণনা করো, সে বড় শক্তি সামর্থের অধিকারী ছিলো। সব ব্যাপারেই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী ছিলো।” [ছোয়াদ :১৭]

﴿وَوَهَبۡنَا لِدَاوُۥدَ سُلَيۡمَٰنَۚ نِعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ إِنَّهُۥٓ أَوَّابٌ ٣٠﴾ [ص: 30]

“আর দাঊদকে আমরা সুলাইমান [এর মত বিচক্ষণ পুত্র] দান করেছি। সে কতইনা উত্তম বান্দাহ। সে [বার বার আল্লাহর দিকে] প্রত্যাবর্তনকারী।” [সোয়াদ: ৩০]

ঈসা আলাইহিস সালাম এর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন:

﴿إِنۡ هُوَ إِلَّا عَبۡدٌ أَنۡعَمۡنَا عَلَيۡهِ وَجَعَلۡنَٰهُ مَثَلٗا لِّبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٥٩﴾ [الزخرف: 59]

“সে [ঈসা] আল্লাহর বান্দাহ ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাঁর প্রতি আমরা নিয়ামত দান করেছি এবং তাকে বনী ইসরাইলের জন্য এক বিশেষ দৃষ্টান্ত বানিয়েছি।” [যুখরুফ :৫৯]

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে “রিসালত” সমাপ্ত করেছেন। তাঁকে গোটা মানব জাতির কাছে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ٱلَّذِي لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۖ فَ‍َٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ ٱلنَّبِيِّ ٱلۡأُمِّيِّ ٱلَّذِي يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَكَلِمَٰتِهِۦ وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٥٨﴾ [الأعراف: 158]

“হে মুহাম্মদ! বলো হে লোকসকল, আমি তোমাদের সবার প্রতি নবী হিসেবে সেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি, যিনি আসমান ও যমীনের একচ্ছত্র মালিক। তিনি ছাড়া আর কোন হক ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন। তিনিই মৃত্যু দেন। অতএব তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং তাঁরই প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি ঈমান আনো যিনি আল্লাহ এবং তাঁর কথাকে মেনে চলেন তোমরা তাঁর আনুগত্য করো; যাতে করে তোমরা হিদায়াত লাভ করতে পারো।” [আ‘রাফ : ১৫৮]

আমরা ঈমান আনি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরী‘আত হচ্ছে “দ্বীন ইসলাম”, যে দ্বীনকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাহদের জন্য পছন্দ করেছেন। একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুই কারও কাছ থেকে তিনি দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ﴾ [آل عمران: 19]

“আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দ্বীন।” [আলে-ইমরান :১৯]

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائدة: 3]

“আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম। আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হলাম।” [মায়েদা : ৩]

আরও ইরশাদ করেন:

﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥﴾ [آل عمران: 85]

“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করতে চায়; তার কাছ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর আখেরাতে সে হবে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত।” [আলে-ইমরান: ৮৫]

আমরা মনে করি বর্তমানে যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য মতাদর্শ যেমন ইয়াহূদীবাদ, খৃষ্টবাদ ইত্যাদিকে দ্বীন হিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবে সে কাফের। একাজ থেকে যাদি সে তাওবা করে তার তাওবা গ্রহণ করা হবে। অন্যথায় মুরতাদ হিসেবে তাকে হত্যা করতে হবে। কারণ সে কুরআনে মিথ্যারোপ করল।

আমরা মনে করি, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোটা মানব জাতির রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে সে মূলত: দুনিয়ার সব নবীকেই অস্বীকার করে। এমনকি সে নিজে যাকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করে এবং অনুসরণ করে, প্রকারান্তরে তাকেও সে অস্বীকার করে। এর প্রমাণ হচ্ছে:

﴿كَذَّبَتۡ قَوۡمُ نُوحٍ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ١٠٥﴾ [الشعراء: 105]

“নূহের কওম রাসূলগণের উপর মিথ্যারোপ করেছে”। [শু‘আরা : ১০৫]

এ আয়াতে নূহ [আলাইহিস সালাম] এর জাতিকে সমস্ত রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ নূহ [আলাইহিস সালাম] এর পূর্বে কোন রাসূলই আসেননি। এর অর্থ হলো, একজন নবীকে অস্বীকার করা, গোটা নবীকুলকে অস্বীকার করার শামিল।

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُواْ بَيۡنَ ٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيَقُولُونَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٖ وَنَكۡفُرُ بِبَعۡضٖ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُواْ بَيۡنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا ١٥٠ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ حَقّٗاۚ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا ١٥١﴾ [النساء: 150-151]

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং তাঁদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায়, আর বলে, আমরা কাউকে মানবো আর কাউকে মানবো না এবং ঈমান ও কুফরের মাঝখানে কোন পথ বের করার ইচ্ছা পোষণ করে তার নিঃসন্দেহে কাফের। কাফেরদের জন্য আমি অপমানকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি।” [নিসা: ১৫০-১৫১]

আমরা ঈমান আনি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে আর কোন নবী আসবে না। তাঁর পরে যে কেউ নবুয়তের দাবী করবে অথবা নবুয়তের মিথ্যা দাবীদারকে সত্য বলবে সেও কাফের। কারণ সে আল্লাহ তা‘আলা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলিমদের ‘ইজমা’ অর্থাৎ মুসলিম উম্মার সর্বসম্মত রায় ও সিদ্ধান্তকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।

আমরা ঈমান আনি যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য রেখে গিয়েছেন, খোলাফায়ে রাশেদীনকে। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে উম্মতের মধ্যে জ্ঞান ইসলামের প্রচার, প্রসার এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাঁরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মর্যাদাবান এবং খেলাফতের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন আবূ বকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] তারপর ওমর [রাদিয়াল্লাহু আনহু], তারপর হযারত ওসমান [রাদিয়াল্লাহু আনহু] অত:পর আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহু]।

মর্যাদার দিক থেকে তাঁদের অবস্থান যেমন ছিলো, খিলাফতের দিক থেকেও ছিলো তাদের তেমনই অবস্থান।

মহান হাকীম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য এটা কোনক্রমেই শোভনীয় নয় যে, সর্বোত্তম যুগেও তিনি এমন লোককে খিলাফতের দায়িত্ব দিবেন যার চেয়ে উত্তম এবং খিলাফতের অধিক যোগ্য ব্যক্তি উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।

আমরা আরও ঈমান আনি যে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে থেকে (মাফদুল) ব্যক্তি কোন কোন ক্ষেত্রে (আফদল) ব্যক্তির চেয়েও অধিক গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু (আফদাল) ব্যক্তিকে নিরঙ্কুশভাবে (মাফদুল) ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলা ঠিক নয়। কেননা মর্যাদার কারণ ও বিষয়বস্তু অনেক এবং বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এ প্রসংগে বলা যেতে পারে আবূ বকর “তাকওয়া” ওমর শাসন, ওসমান লজ্জা ও বিনয় এবং আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহুম] সাহসিকতা ও বীরত্বের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন।

শ্রেষ্ঠ উম্মত

আমরা ঈমান আনি যে, উম্মতে মুহাম্মদী হচ্ছে সর্বোত্তম উম্মত।

﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ﴾ [آل عمران: 110]

“তোমরা সর্বোত্তম উম্মত। মানুষের জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে। অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।” [আলে ইমরান : ১১০]

আমরা ঈমান আনি যে, উম্মতে মুসলিমার মধ্যে সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম [রাদিয়াল্লাহ আনহুম] তারপর তাবেয়ীন তারপরে তাবে-তাবেয়ীন।

আমরা আরও ঈমান আনি যে, কেয়ামত পর্যন্ত এ উম্মতের মধ্য থেকে এমন একটি দল হকের উপর অবিচল থাকবে যাদেরকে কোন অপমানকারী কিংবা বিরোধিতাকারী কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাদেরকে হকের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।

আমরা ঈমান আনি যে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যেসব ফিতনা অর্থাৎ ভুল বুঝা-বুঝির কারণে মতানৈক্য, সংঘাত ও সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে তা তাঁদের ব্যাখ্যা ও ইজতিহাদের কারণে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাঁদের জন্য দু’টি পরস্কার। যারা ভুল করেছেন তাদের জন্য রয়েছে একটি পুরষ্কার। আর ভুল-ত্রুটিগুলো আল্লাহ তা‘আলা মাফ করে দিয়েছেন।

আমরা মনে করি তাঁদের প্রতি কোন অন্যায় আচরণ থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিৎ। এমনিভাবে তাঁরা যে মর্যাদা ও প্রশংসার অধিকারী, তা ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা করা আমাদের অনুচিৎ। তাঁদের কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও ঈর্ষা পোষণ করা থেকে আমাদের অন্তরকে পবিত্র রাখা উচিৎ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ﴾ [الحديد: 10]

“তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পরে দান করেছে এবং জিহাদ করেছে তারা কখনো তাদের সমান হতে পারে না যারা মক্কা বিজয়ের আগে দান করেছে এবং জিহাদ করেছে। বস্তুত: তাদের মর্যাদা পরে দানকারী ও জিহাদকারীদের তুলনায় অনেক বেশী। আল্লাহ উভয়ের জন্যই উত্তম ওয়াদা করেছেন।” [আল হাদীদ : ১০]

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সম্পর্কে বলেন:

﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: 10]

“যারা এই অগ্রবর্তী লোকদের পরে এসেছে তারা বলে: হে আমাদের রব, আমাদেরকে এবং আমাদের সেসব ভাইদেরকে ক্ষমা করে দাও যারা আমাদের ঈমানদার লোকদের প্রতি কোন হিংসা ও শত্রুতার ভাব রেখো না। হে আমাদের রব, তুমি বড়ই অনুগ্রহকারী করুণাময়।”[হাশর: ১০]

 আখেরাত

আমরা শেষ দিবসে ঈমান আনি। আর শেষ দিন হচ্ছে কেয়ামতের দিন। এরপর আর কোন দিন নেই।

সেদিন মানুষ পুন:জীবন লাভ করবে। সে জীবন হবে হয় দারুন্নাইম, অর্থাৎ নিয়ামাতপূর্ণ ও শান্তিময় গৃহে নতুবা কঠিন শাস্তির গৃহে অনন্তকাল থাকার জন্য।

 শিঙ্গায় ফুঁক

আমরা ঈমান আনি যে, ইসরাফীলের দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুঁক দেয়ার পর মৃতকে জীবিত করার মাধ্যমে পুনরুত্থান সংঘটিত হবে।

﴿وَنُفِخَ فِي ٱلصُّورِ فَصَعِقَ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَن فِي ٱلۡأَرۡضِ إِلَّا مَن شَآءَ ٱللَّهُۖ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخۡرَىٰ فَإِذَا هُمۡ قِيَامٞ يَنظُرُونَ ٦٨﴾ [الزمر: 68]

“সেদিন সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। তখন আসমান ও যমীনের সকল প্রাণী মরে পড়ে থাকবে। অবশ্য আল্লাহ যাদেরকে জীবন্ত রাখবেন তারা ছাড়া। অতঃপর শিংগায় আরেকবার ফুঁক দেয়া হবে। তখন সবাই উঠে দাঁড়াবে এবং তাকিয়ে থাকবে।” [যুমার : ৬৮]

এরপর সব মানুষ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যে কবর থেকে উঠবে। তাদের অবস্থা হবে পাদুকা বিহীন নগ্ন এবং বস্ত্র বিহীন উলঙ্গ।

﴿كَمَا بَدَأۡنَآ أَوَّلَ خَلۡقٖ نُّعِيدُهُۥۚ وَعۡدًا عَلَيۡنَآۚ إِنَّا كُنَّا فَٰعِلِينَ ١٠٤﴾ [الأنبياء:104]

“যেভাবে সর্বপ্রথম আমরা সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম ঠিক সেভাবে আমরা তার পুনরাবৃত্তি করবো। এটা একটা ওয়াদা, যা পুরণ করার দায়িত্ব আমাদের। একাজ অবশ্যই আমরা করবো।” [আম্বিয়া : ১০৪]

 আমল নামা

আমরা আমল নামার উপর ঈমান আনি। এ আমল নামা হয় ডান হাতে দেয়া হবে নতুবা পিছন দিক থেকে বাম হাতে দেয়া হবে।

﴿فَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ بِيَمِينِهِۦ ٧ فَسَوۡفَ يُحَاسَبُ حِسَابٗا يَسِيرٗا ٨ وَيَنقَلِبُ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦ مَسۡرُورٗا ٩ وَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ وَرَآءَ ظَهۡرِهِۦ ١٠ فَسَوۡفَ يَدۡعُواْ ثُبُورٗا ١١ وَيَصۡلَىٰ سَعِيرًا ١٢﴾ [الإنشقاق: 7-12]

“অতঃপর যারা আমল নামা তার ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব সহজভাবে নেয়া হবে। আর সে আপনজনদের কাছে হাসি-খুশী ও আনন্দচিত্তে ফিরে যাবে। আর যে ব্যক্তির আমল নামা পিছন দিক হতে দেয়া হবে, সে ভয়ে মৃত্যুকে ডাকবে। সে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবে।” [ইনশিকাক : ৭-১২]

﴿وَكُلَّ إِنسَٰنٍ أَلۡزَمۡنَٰهُ طَٰٓئِرَهُۥ فِي عُنُقِهِۦۖ وَنُخۡرِجُ لَهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ كِتَٰبٗا يَلۡقَىٰهُ مَنشُورًا ١٣ ٱقۡرَأۡ كِتَٰبَكَ كَفَىٰ بِنَفۡسِكَ ٱلۡيَوۡمَ عَلَيۡكَ حَسِيبٗا ١٤﴾ [الإسراء: 13-14]

“আর প্রত্যেক ব্যক্তির ভাগ্যই আমরা তার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি। আর কেয়ামতের দিন আমরা তার জন্য একটি কিতাব প্রকাশ করবো। সে কিতাবটিকে উন্মুক্ত গ্রন্থ হিসেবে দেখতে পাবে। নিজের আমল নামা পড়ে দেখো। তাহলে আজ তোমার নিজের হিসাব দেখার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।” [ইসরা : ১৩-১৪]

মিজান

আমরা ঈমান আনি, কেয়ামতের দিন “মিজান” বা ভাল-মন্দ ওজন করার ব্যবস্থা থাকবে। কোন ব্যক্তির প্রতি জুলুম করা হবে না।

﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨﴾ [الزلزلة: 7-8]

“যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণ নেক আমল করবে সে তা দেখতে পাবে এবং যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমান বদ-আমল করবে, তাও সে দেখতে পাবে।” [যিল-যাল: ৭-৮]

﴿فَمَن ثَقُلَتۡ مَوَٰزِينُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٢ وَمَنۡ خَفَّتۡ مَوَٰزِينُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ خَسِرُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ فِي جَهَنَّمَ خَٰلِدُونَ ١٠٣ تَلۡفَحُ وُجُوهَهُمُ ٱلنَّارُ وَهُمۡ فِيهَا كَٰلِحُونَ ١٠٤﴾ [المؤمنون: 102-104]

“যাদের (নেক আমলের) পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। আগুন তাদের মুখমণ্ডলের চামড়া চেটে-চেটে খাবে। এর ফলে তাদের জিহবা বের হয়ে আসবে।” [মুমিনুন : ১০২-১০৪]

﴿مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ عَشۡرُ أَمۡثَالِهَاۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ ١٦٠﴾ [الأنعام: 160]

“বস্তুত: যে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য দশগুন বেশী পুরষ্কার রয়েছে। আর যে ব্যক্তি পাপ কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে, তাকে তার পাপের সমপরিমাণ প্রতিফল দেয়া হবে। কারো প্রতি কোন জুলুম করা হবে না।” [আন‘আম : ১৬০]

শাফা‘আত

আমরা ঈমান আনি যে, রাসূলুল্লাহ্ [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর জন্য ‘শাফাআতে উযমা’ (বা মহান শাফাআত) বিশেষভাবে নির্দিষ্ট রয়েছে। বান্দাহদের মধ্যে বিচার ফায়সালা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাঁরই অনুমতিক্রমে এ শাফা‘আত এমন এক সময়ে করবেন যখন মানুষ হাশরের মাঠে সীমাহীন দুশ্চিন্তা আর সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। লোকেরা প্রথমত আদম [আলাইহিস সালাম] এর নিকট যাবে। তারপর নূহ [আলাইহিস সালাম] তারপর ইবরাহীম, মূসা, ঈসা [আলাইহিস সালাম] এবং সর্বশেষ রাসূলুল্লাহ্ [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কাছে যাবে।

আমরা ঈমান আনি যে, মুমিনদের মধ্যে যারা জাহান্নামে যাবে তাদেরকে সেখান থেকে বের করার ব্যাপারে শাফা‘আতের সুযোগ রয়েছে। এ শাফা‘আত রাসূলুল্লাহ্ [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সহ অন্যান্য নবী, নেককার বান্দাহ এবং এবং ফিরিশ্‌তাদের জন্য নির্দিষ্ট।

আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রহমত ও ফজলে শাফা‘আত ছাড়াই জাহান্নামীদের মধ্য হতে একদল লাককে বের করে আনবেন।

হাওযে রাসূল

আমরা ঈমান আনি যে, রাসূলুল্লাহ্ [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর জন্য এমন একটি হাওয নির্দিষ্ট রয়েছে যার পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়ে মিষ্টি এবং মিশকের চেয়ে সুঘ্রাণ বিশিষ্ট। এর দৈর্ঘ একমাসের পথ এবং প্রস্থও একমাসের পথ। এর পাত্রগুলো সৌন্দর্যের দিক থেকে যেন আকাশের নক্ষত্র। নবী [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর উম্মতের মধ্যে মুমিনগণ এই হাওয থেকে পানি তুলবে। যে ব্যক্তি এ হাওয থেকে পানি পান করবে তার কখনো পিপাসা লাগবে না।

পুলসিরাত

আমরা ঈমান আনি যে, জাহান্নামের উপর পুলসিরাত স্থাপিত রয়েছে। মানুষ তাদের আমল অর্থাৎ কার্য-কলাপের ভিত্তিতে এ পুলসিরাত অতিক্রম করবে। প্রথম ব্যক্তি বিদ্যুতের গতিতে এটি অতিক্রম করবে। এর পরের ব্যক্তি অতিক্রম করবে বাতাসের গতিতে। তার পরের ব্যক্তি পাখির গতিতে। পুলসিরাত পার হওয়া শুরু হলে রাসূলুল্লাহ্ [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সেখানে দাড়িয়ে বলতে থাকবেন, হে আমার রব [বিপদ থেকে] রক্ষা করো, রক্ষা করো। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন হবে যে, বান্দাহদের নেক আমল এতই কম হবে যে তারা হামাগুড়ি দিবে। আর পুলসিরাতের দু’পাশে থাকবে কাটা বা হুলযুক্ত লোহার শলাকা লটকানো। আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ মোতাবেক হুলযুক্ত শলাকার আঘাত খেয়ে যে ব্যক্তি পার হতে পারবে সে নাজাত পাবে আর যে ব্যক্তি শলাকায় আটকা পড়ে যাবে সে জাহান্নামে যাবে।

আর আমরা কেয়ামতের দিন এবং সে দিনের ভয়ঙ্কর অবস্থা সংক্রান্ত যাবতীয় খবর যা কুরআন ও সুন্নায় এসেছে সে সবের উপরই ঈমান আনি। আল্লাহ সে কঠিন সময় আমাদের সাহায্য করুন।

বিশেষ শাফা‘আত

আমরা ঈমান আনি যে, জান্নাতের অধিকারী ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আল্লাহর কাছে বিশেষ সুপারিশ [খাস শাফা‘আত] করবেন। এ শাফা‘আত তাঁর জন্যই খাস।

 জান্নাত ও জাহান্নাম

আমরা জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্বে ঈমান আনি। জান্নাত পরম সুখ ও শান্তির স্থান। আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকী মুমিনদের জন্য জান্নাত তৈরী করেছেন। জান্নাতে এমন সুখ-শান্তির উপকরণ রয়েছে যা কোন চোখ দেখে নি। কোন কান যা শুনে নি। কোন অন্তর যা কখনো কল্পনা করেনি।

﴿فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٞ مَّآ أُخۡفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعۡيُنٖ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٧﴾ [السجدة: 17]

“তাদের কর্মের প্রতিফল হিসেবে চক্ষু শীতলকারী যে সুখ-সামগ্রী তাদের জন্য গোপন রাখা হয়েছে কোন প্রাণীই তা জানে না।” [সাজদাহ : ১৭]

আর জাহান্নাম হচ্ছে শাস্তির স্থান। জালিম, কাফেরদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম তৈরী করেছেন। এতে এমন দুঃখ-কষ্ট এবং শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে যা কোন হৃদয় কল্পনা করতে পারে না।

﴿إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلظَّٰلِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمۡ سُرَادِقُهَاۚ وَإِن يَسۡتَغِيثُواْ يُغَاثُواْ بِمَآءٖ كَٱلۡمُهۡلِ يَشۡوِي ٱلۡوُجُوهَۚ بِئۡسَ ٱلشَّرَابُ وَسَآءَتۡ مُرۡتَفَقًا ٢٩﴾ [الكهف: 29]

“আমরা জালিমদের জন্য আগুনের [জাহান্নামের] ব্যবস্থা করে রেখেছি। এ আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে পরিবেষ্টিত করে রাখবে। সেখানে তারা পানি চাইলে এমন পানি সরবরাহ করা হবে যা গলিত পদার্থের মত হবে। এর ফলে তাদের মুখমণ্ডল বিদগ্ধ হয়ে যাবে। এটা কতই না নিকৃষ্ট পানীয়। কতই না খারাপ আশ্রয়স্থল।” [কাহাফ : ২৯]

জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব বর্তমান রয়েছে। অনন্তকাল ধরে থাকবে। কোন দিন তা ধ্বংস হবে না।

﴿وَمَن يُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ وَيَعۡمَلۡ صَٰلِحٗا يُدۡخِلۡهُ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۖ قَدۡ أَحۡسَنَ ٱللَّهُ لَهُۥ رِزۡقًا ١١﴾ [الطلاق: 11]

 “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং নেক আমল করবে, আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে দাখিল করাবেন যার তলদেশ হতে ঝর্ণাধারা সদা প্রবাহমান থাকবে। এসব লোকেরা সেখানে অনন্তকাল বসবাস করবে। নেককার লোকদের জন্য আল্লাহ সেখানে উত্তম রিযিকের ব্যবস্থা রেখেছেন।” [তালাক: ১১]

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَعَنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمۡ سَعِيرًا ٦٤ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۖ لَّا يَجِدُونَ وَلِيّٗا وَلَا نَصِيرٗا ٦٥ يَوۡمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمۡ فِي ٱلنَّارِ يَقُولُونَ يَٰلَيۡتَنَآ أَطَعۡنَا ٱللَّهَ وَأَطَعۡنَا ٱلرَّسُولَا۠ ٦٦﴾ [الأحزاب: 64-66]

“আল্লাহ কাফেরদের উপর লা‘নত করেছেন এবং তাদের জন্য জ্বলন্ত আগুন তৈরী করে রেখেছেন। তারা সেখানে অনন্তকাল ধরে থাকবে। সেখানে কোন সাহায্যকারী বন্ধু তারা পাবে না। যেদিন তাদের চেহারা আগুনের উপর উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে: হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতাম।” [আহযাব : ৬৪-৬৬]

কুরআন ও হাদীস যাদের জান্নাতের যাবার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে ও মানগত দিক উল্লেখ করে ঘোষণা দিয়েছে, আমরা তার উপর ঈমান আনি এবং স্বীকার করি। নির্দিষ্ট করে জান্নাতে যাবার ব্যাপারে যাদের ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহুম] এর মত ব্যক্তিবর্গ। রাসূল [সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এদের নাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আর মানগত ও গুনগত দিক বিচার করে যাদের ব্যাপারে জান্নাতে যাবার ঘোষণা রয়েছে তারা হলেন, প্রত্যেক মুমিন ও মুত্তাকী লোক।

জাহান্নামে যাবার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীস যাদের নাম নির্দিষ্ট করে ও মানগত দিক বর্ণনা করে ঘোষণা দিয়েছে আমরা তাতেও ঈমান আনি। নির্দিষ্ট করে জাহান্নামের যাবার ঘোষণা রয়েছে আবু লাহাব, আমর বিন লোহাই আল খুযা‘য়ী সহ আরো কতিপয় ব্যক্তি সম্পর্কে। আর গুণগত ও মানগত দিক দিয়ে জাহান্নামে যাবার ঘোষণার মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক বড় ধরনের শিরককারী মুশরিক এবং মুনাফিক।

কবরে মৃত ব্যক্তির পরীক্ষা

আমরা ঈমান আনি যে, কবরে মৃত ব্যক্তির পরীক্ষা হবে। সে পরীক্ষাটি হচ্ছে, কবরে মৃত ব্যক্তিকে ফিরিশ্‌তারা তাঁর রব, দ্বীন এবং নবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তখন

﴿يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱلۡقَوۡلِ ٱلثَّابِتِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِۖ﴾ [إبراهيم: 27]

“শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসীগণকে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে এবং আখেরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন।” [ইবরাহীম : ২৭]

এসব প্রশ্নের জবাবে মুমিন ব্যক্তি বলবে, ‘আল্লাহ আমার রব’ ‘ইসলাম আমার দ্বীন’ মুহাম্মদ আমার নবী’ ।

পক্ষান্তরে কাফের এবং মুনাফিক ব্যক্তি বলবে, আমি কিছুই জানি না। দুনিয়ার লোকদেরকে যা বলতে শুনেছি আমিও তাই বলেছি।

কবরের শান্তি

কবরে মুমিনদের জন্য সুখ-শান্তি আছে একথা আমরা ঈমান আনি।

﴿ٱلَّذِينَ تَتَوَفَّىٰهُمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِيٓ أَنفُسِهِمۡۖ فَأَلۡقَوُاْ ٱلسَّلَمَ مَا كُنَّا نَعۡمَلُ مِن سُوٓءِۢۚ بَلَىٰٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمُۢ بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ٢٨﴾ [النحل: 28]

“পবিত্র থাকা অবস্থায় ফিরিশ্‌তারা যাদের রূহ কবয করে, তাদেরকে তারা বলে, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা তোমাদের আমলের বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করো।” [নাহল : ২৮]

কবরের আযাব

আমরা এতেও  ঈমান আনি যে, জালিম, কাফেরদের জন্য কবরে আযাবের ব্যবস্থা রয়েছে।

﴿وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلظَّٰلِمُونَ فِي غَمَرَٰتِ ٱلۡمَوۡتِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ بَاسِطُوٓاْ أَيۡدِيهِمۡ أَخۡرِجُوٓاْ أَنفُسَكُمُۖ ٱلۡيَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ ٱلۡهُونِ بِمَا كُنتُمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ غَيۡرَ ٱلۡحَقِّ وَكُنتُمۡ عَنۡ ءَايَٰتِهِۦ تَسۡتَكۡبِرُونَ ٩٣﴾ [الأنعام: 93]

“হায় তুমি যদি জালিমদেরকে সে অবস্থায় দেখতে পেতে যখন তারা মৃত্যুর যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। ফিরিশ্‌তারা তখন হাত বাড়িয়ে বলতে থাকে, দাও, বের করে দাও তোমাদের প্রাণ। আজ তোমাদের সেসব অপরাধের শাস্তি হিসাবে লাঞ্ছনার আযাব দেয়া হবে যে অপরাধ আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা ও অন্যায় বলার মাধ্যমে এবং তাঁর আয়াতসমুহের মোকাবেলায় অহংকার ও বিদ্রোহের মাধ্যমে তোমরা করেছো।” [আন‘আম: ৯৩]

এ প্রসংগে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কুরআন ও সুন্নায় যেসব গায়েবী খবর ও তথ্য এসেছে সেগুলো বিশ্বাস করা প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির উপর কর্তব্য। দুনিয়ার চোখে দেখা কোন জিনিসের উপর আন্দাজ অনুমান করে এসব বিষয়ের বিরোধিতা করা ঠিক নয়। কেন না নশ্বর দুনিয়া ও অবিনশ্বর আখিরাত, এ দু’টি জগতের মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান। একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন সাহায্যের আধার।

 অধ্যায়

তাকদীরের প্রতি ঈমান

আমরা ‘তাকদীর’ এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনি। তাকদীর হচ্ছে, সবজান্তা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার পূর্ব জ্ঞান ও হিকমতের দাবী অনুযায়ী সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য সবকিছু নির্ধারণ।

তাকদীরের স্তর

তাকদীরের চারটি স্তর রয়েছে:

 প্রথম স্তর হচ্ছে : জ্ঞান বা ইলম

আমরা ঈমান আনি যে, আল্লাহ তা‘আলা হচ্ছেন সর্বজ্ঞানী ও সর্বজান্তা। কি ছিল, কি হবে, কিভাবে হবে এসব তিনি তাঁর ‘ইলমে আযালী ও আবাদী’ অথাৎ স্থায়ী এবং চিরন্তন অপরিসীম জ্ঞান শক্তির মাধ্যমেই জানেন। তাই অজানার পর নতুন করে জানা এবং জানার পর ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটি আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

 দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে : লিপিবদ্ধকরণ

আমরা ঈমান আনি যে, কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সংঘটিত হবে তার সব কিছুই আল্লাহ তা‘আলা লৌহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

﴿أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٧٠﴾ [الحج: 70]

“তুমি কি জান না যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, তার সব কথাই আল্লাহ তা‘আলা জানেন। সব কিছুই একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাহর পক্ষে এসব কাজ খুবই সহজ।” [হজ্ব: ৭০]

তৃতীয় স্তর : ইচ্ছা

আমরা ঈমান আনি যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই হয় না। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। যা ইচ্ছা করেন না তা হয় না।

 চতুর্থ স্তর : সৃষ্টি

আমরা ঈমান আনি যে,

﴿ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ وَكِيلٞ ٦٢ لَّهُۥ مَقَالِيدُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۗ﴾ [الزمر: 62-63]

“আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা। তিনি সব কিছুরই অভিভাবক। আসমান ও যমীনের ধন-ভাণ্ডারের চাবি তাঁরই কাছে সংরক্ষিত”। [যুমার : ৬২-৬৩]

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এবং তাঁর বান্দাহর পক্ষ থেকে যা কিছু সংঘটিত হবে, তা চাই কথা হোক, কাজ হোক অথবা অমান্য করাই হোক না কেন এর সব কিছুই উক্ত চারটি স্তরের অন্তর্ভুক্ত। এর সবই তাঁর জানা এবং তাঁর কাছে লিখা রয়েছে। এর সবকিছুই তাঁর ইচ্ছা ও সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত।

 ﴿لِمَن شَآءَ مِنكُمۡ أَن يَسۡتَقِيمَ ٢٨ وَمَا تَشَآءُونَ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢٩﴾ [التكوير: 28-29]

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সোজা-সরল পথে চলতে চায় [তার জন্য এ কিতাব উপদেশস্বরূপ] আর যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা না চান ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না।” [তাকওয়ীর : ২৮-২৯]

﴿وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا فَعَلُوهُۖ فَذَرۡهُمۡ وَمَا يَفۡتَرُونَ ١٣٧﴾ [الأنعام: 137]

“আল্লাহ চাইলে তারা এ রকম করতো না। কাজেই তাদেরকে ছেড়ে দাও। নিজেদের মিথ্যা রচনায় তারা নিমগ্ন থাকুক”। [আন‘আম: ১৩৭]

﴿وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلُواْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ ٢٥٣﴾ [البقرة: 253]

“আল্লাহ চাইলে তারা কখনো লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ যা চান তাই করেন”। [বাকারাহ : ২৫৩]

﴿وَٱللَّهُ خَلَقَكُمۡ وَمَا تَعۡمَلُونَ ٩٦﴾ [الصافات: 96]

“আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা করো তাও সৃষ্টি করেছেন”। [সাফফাত: ৯৬]

এরপরও আমরা ঈমান আনি, যে কোন কাজ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাহকে এখতিয়ার এবং কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। বান্দাহর কাজ যে তার এখতিয়ার এবং ক্ষমতায় সংঘটিত হয়ে থাকে তার কিছু প্রমাণ:

১. আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

﴿فَأۡتُواْ حَرۡثَكُمۡ أَنَّىٰ شِئۡتُمۡۖ﴾ [البقرة: 223]

“তোমাদের ইচ্ছা মাফিক তোমাদের ক্ষেত্র [স্ত্রীদের কাছে] গমন করো”। [বাকারাহ : ২২৩]

﴿وَلَوۡ أَرَادُواْ ٱلۡخُرُوجَ لَأَعَدُّواْ لَهُۥ عُدَّةٗ﴾ [التوبة: 46]

“তারা যদি বের হওয়ার ইচ্ছা সত্যিই পোষণ করতো, তাহলে তারা অবশ্যই সে জন্য কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করতো”। [তাওবা : ৪৬]

উক্ত আয়াত দু’টিতে বান্দাহর ইচ্ছা পোষণ করা এবং ইচ্ছানুযায়ী প্রত্তুতি গ্রহণ করার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়েছে।

২. যদি বান্দাহর কাজ করার কোন এখতিয়ার ও ক্ষমতাই না থাকে তাহলে বিধি-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে যে নির্দেশ ও উপদেশ বান্দাহকে দেয়া হয়েছে তার অর্থ দাঁড়ায়, বান্দাহকে এমন কাজের প্রতি নির্দেশ দেয়া যা করার কোন ক্ষমতাই তার নেই। অথচ এমনটি হওয়া সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর করুণা, হিকমত ও কৌশলের পরিপন্থী। সাথে সাথে আল্লাহর এ ঘোষণার সম্পূর্ণ বিপরীত:

﴿لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ﴾ [البقرة: 286]

“আল্লাহ কারোর উপরই তার শক্তি-সামর্থের অধিক বোঝা চাপিয়ে দেন না”। [বাকারা : ২৮৬]

৩. মুহসীন ব্যক্তির ইহসানের প্রশংসা এবং খারাপ ব্যক্তির খারাপ কাজের নিন্দা করা আর উভয়কেই তার কৃতকর্মের প্রাপ্য পুরষ্কার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে একটি দলীল।

যদি বান্দাহর কর্ম, তার ইচ্ছা ও এখতিয়ার অনুযায়ী কোন কাজ সংঘটিত না-ই হতো তাহলে মুহসিন ব্যক্তির ইহসানের প্রশংসা করার কোন অর্থই হয় না। আর অন্যায়কারীর অন্যায়ের জন্য শাস্তি প্রদান যুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ আল্লাহ তা‘আলা কোন অর্থহীন কাজ করা এবং যুলুম করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।

৪. আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন

﴿مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا ١٦٥﴾ [النساء: 165]

“সু-সংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শণকারী হিসেবে। যেন তাঁদেরকে পাঠাবার পর আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে লোকদের কোন যুক্তি না থাকে। আল্লাহ তো সর্বাবস্থায় মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [নিসা : ১৬৫]

কাজ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে যদি বান্দাহর ইচ্ছা ও শক্তি কাজে লাগানোর কোন এখতিয়ারই না থাকে তাহলে রাসূল পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহর বিরুদ্ধে বান্দাহর হুজ্জত (যুক্তি) বাতিল বলে গণ্য হতো না।

৫. কার্য সম্পাদনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই কাজ করার সময় কোন রকম জবর-দস্তির অনুভূতি ও ধারণা পোষণ করা ছাড়াই কাজ করে। সে দাড়ায়, বসে, প্রবেশ করে, বের হয়, সফর করে আবার মুকীম হয় সম্পূর্ণ তার নিজ ইচ্ছানুযায়ী। সে এ কথা মনে করে না যে, কেউ তাকে এসব করার জন্য বাধ্য করছে কিংবা জবর-দস্তি করছে।

বরং বান্দাহ নিজেই স্বতঃষ্ফুর্ত কাজ আর জবর-দস্তিমূলক কাজের মধ্যে বাস্তব পার্থক্য বের করে। এমনি ভাবে শরী‘আত ও এ দু’ধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য করে থাকে। ফলে জবর-দস্তির শিকার হয়ে যদি বান্দাহ আল্লাহর হকের ব্যাপারে কোন কাজ করে ফেলে তাহলে এর জন্য কোন শাস্তি হবে না।

আমরা মনে করি পাপী ব্যক্তির জন্য তার পাপ কাজের পক্ষে ‘তাকদীর’ দ্বারা যুক্তি পেশ করার কোন সুযোগ নেই। কারণ পাপী তার নিজ এখতিয়ার ও শক্তির বলে পাপ কাজ করে অথচ সে জানে না যে পাপ কর্মটি তার ‘তাকদীরে’ আল্লাহ তা‘আলা লিখেছেন কি না। যে কোন কাজ নিজ এখতিয়ার ও ক্ষমতা বলে সমাপ্ত করার পূর্ব পর্যন্ত কেউ জানতে পারে না যে সংশ্লিষ্ট কাজটি আল্লাহ তা‘আলা তার ‘তাকদীরে’ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন কি না।

﴿وَمَا تَدۡرِي نَفۡسٞ مَّاذَا تَكۡسِبُ غَدٗاۖ﴾ [لقمان: 34]

“কেউ জানে না আগামী কাল সে কি কামাই করবে।” [লোকমান : ৩৪] তাহলে কোন কাজ করা বা না করার ক্ষেত্রে অপারগতা অথবা অক্ষমতার যুক্তি [অর্থাৎ আল্লাহ চাইলে করতাম, না চাইলে করতাম না] দেখানো কিভাবে সঠিক হতে পারে? তাই আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের যুক্তি দেখানোর বিষয়টি বাতিল ঘোষণা করেছেন:

﴿سَيَقُولُ ٱلَّذِينَ أَشۡرَكُواْ لَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَآ أَشۡرَكۡنَا وَلَآ ءَابَآؤُنَا وَلَا حَرَّمۡنَا مِن شَيۡءٖۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ حَتَّىٰ ذَاقُواْ بَأۡسَنَاۗ قُلۡ هَلۡ عِندَكُم مِّنۡ عِلۡمٖ فَتُخۡرِجُوهُ لَنَآۖ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَإِنۡ أَنتُمۡ إِلَّا تَخۡرُصُونَ ١٤٨﴾ [الأنعام:148]

“মুশরিক লোকেরা অচিরেই একথা বলবে, যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে আমরা শিরক করতাম না। আমাদের বাপ দাদারাও শিরক করতো না। আর আমরা কোন জিনিসকে হারাম করতাম না। বস্তুত: এধরনের কথা বলে তাদের পূর্ববর্তী লোকেরা সত্যে মিথ্যারোপ করেছিলো। এদেরকে বলো, তোমাদের কাছে এমন কোন জ্ঞান আছে কি যা আমাদের সামনে পেশ করার মতো? তোমরা তো কেবল ধারণা আর অনুমানের উপর চলো। আর ভিত্তিহীন ধারণার জন্ম দিয়ে চলছো।” [আন‘আম : ১৪৮]

যে পাপী ব্যক্তি তাকদীরের দোহাই দেয়, তাকে আমরা বলতে চাই, আনুগত্য বা নেক কাজ করাকে তুমি তোমার তাকদীরের লিখন বলছো না কেন। আল্লাহ তা‘আলা তো নেক কাজই তোমার তাকদীরে লিখে রেখেছেন। তোমার দ্বারা কোন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে পাপ-পূণ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ তাকদীরের লিখন তো তোমার অজানা। অর্থাৎ পাপ করে তুমি যেভাবে তাকদীরের লিখন বলে চালিয়ে দিচ্ছো, পূণ্য কাজ করেও তাকদীরের লিখন বলে চালিয়ে দিতে পারো। এ জন্যই সাহাবায়ে কিরামকে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিলেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই জান্নাত কিংবা জাহান্নামের স্ব-স্ব স্থান লিপিবদ্ধ রয়েছে তখন তাঁরা বললেন, আমরা কি তাহলে তাকদীরের উপর ভরসা করে আমল বাদ দিয়ে দিবো? তিনি উত্তরে বললেন, বরং তোমরা আমল করতে থাকো। যার জন্য যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য সে কাজ সহজ।

তাকদীরের দোহাই দিয়ে যে ব্যক্তি পাপ কাজ করে তাকে আমরা বলতে চাই, তুমি যদি মক্কা শরীফ সফর করতে চাও, আর সেখানে যাওয়ার জন্য যদি দু’টি পথ থাকে, আর একজন সত্যবাদী সংবাদ দাতা তোমাকে জানালো যে, মক্কার একটি পথ খুবই বিপদজনক ও দুর্গম, আর একটি পথ সোজা এবং নিরাপদ, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই দ্বিতীয় পথটি অবলম্বন করবে। প্রথম পথটি অবলম্বন করা তোমার জন্য আদৌ ঠিক নয়। কিন্তু প্রথম পথটি অবলম্বন করে যদি তুমি এ কথা বলো, আমার তাকদীরে এটাই লিখা ছিল। তাহলে অবশ্যই লোকেরা তোমাকে পাগল বলে গণ্য করবে।

তাকে আরো বলতে চাই, তোমার কাছে যদি এমন দু’টি চাকুরীর প্রস্তাব পেশ করা হয় যার একটি হচ্ছে অধিক বেতনের [অপরটি স্বল্প বেতনের] তাহলে তুমি বেশী বেতনের চাকুরিটাই গ্রহণ করবে। তাহলে আখেরাতের আমলের ক্ষেত্রে তুমি কিভাবে নিম্ন মানের কাজ করাকে বেছে নিবে? তারপর বলবে এটাই তাকদীরের লিখন?

তাকে আরো বলতে চাই, “আমরা দেখতে পাই তোমার যখন কোন শারীরিক রোগ দেখা দেয়, তখন চিকিৎসার জন্য তুমি সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ডাক্তারের দরজায় ধর্ণা দাও। তারপর অপারেশনের যত ব্যথা তা সহ্য করো। ঔষধ খাওয়ার যাবতীয় ঝামেলাকে বরদাস্ত করো। তাহলে অসংখ্য গুণাহর দ্বারা তোমার অন্তরে যে রোগের উৎপত্তি হয়েছে তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য কেন তুমি সে রকমটি করো না।

আমরা ঈমান আনি যে, বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অপরিসীম রহমত ও পূর্ণ হিকমতের কারণে কোন খারাপ কাজকেই আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যায় না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

«والشر ليس إليك»

“খারাপ তোমার দিকে বর্তাবে না”

আল্লাহর ফায়সালা নিজে কখনো খারাপ হতে পারে না। কেন না ফায়সালাটির পিছনে কোন না কোন কল্যাণ ও হিকমত নিহিত আছে। অনিষ্টতা বা ত্রুটি মূলত আল্লাহর ফায়সালার নয় বরং ফায়সালাকৃত জিনিস বা বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ত। এর প্রমাণ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :

«وقني شرّ ما قضيت»

“হে আল্লাহ! তোমার ফায়সালাকৃত জিনিসের অনিষ্টতা হতে আমাকে বাঁচাও”। [আবু দাউদ]। এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান [রাদিয়াল্লাহু আনহু] কে দু‘আয়ে কুনুতের অংশ হিসেবে শিখিয়েছেন।

এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনিষ্ট কথাটি আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালাকৃত জিনিসের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তাই অনিষ্টতা বা দোষ মূলত ফায়সালাকৃত বিষয়ের। তবে নিছক অনিষ্টতাই এর মুল কথা নয়। এক দিক থেকে খারাপ হলেও আবার অপর দিক থেকে এর মধ্যে কোন না কোন কল্যাণ নিহিত আছে।

দুনিয়ার বিপর্যয় যেমন: দুর্ভিক্ষ, রোগ-ব্যধি, অভাব-অনটন, ভয়-ভীতি ও আতংক ইত্যাদি খারাপ বটে কিন্তু অন্য দিক থেকে বিচার করলে এগুলোর মধ্যেও কল্যাণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন:

﴿ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِي ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِي عَمِلُواْ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٤١﴾ [الروم: 41]

“লোকদের নিজেদের কৃতকর্মের দরুণ স্থলে ও জলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। যেন তাদেরকে নিজেদের কৃতকর্মের স্বাদ ভোগ করাতে পারেন। এর ফলে হয়তো তারা [আল্লাহর পথে] ফিরে আসবে।” [রূম : ৪১]

চোরের হাত কাটা, ব্যাভিচারীর রজম অর্থাৎ পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেয়া, চোর এবং ব্যভিচারীর নিজের জন্য অনিষ্টকর হতে পারে। কেননা চোর তার হাত হারাচ্ছে আর ব্যভিচারী তার জীবন হারাচ্ছে। কিন্তু অন্য দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে দেখা যাবে এর মধ্যেও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে, তাদের উভয়ের পাপের কাফফারা হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তি একত্রিত করা হবে না। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে এর আরো একটি কল্যাণময় দিক রয়েছে। তা হচ্ছে, এ বিধান প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত, এবং বংশ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।

 অধ্যায়

 আক্বীদার শিক্ষা

উপরোক্ত মৌলিক নীতি বিশিষ্ট পবিত্র আক্বীদা পোষণ করার অনেক সুমহান শিক্ষা ও ফলাফল রয়েছে।

আল্লাহর প্রতি ঈমানের ফল

আল্লাহ তা‘আলার প্রতি এবং তাঁর পবিত্র নাম ও সিফাতের প্রতি ঈমান পোষণ করার ফল হচ্ছে এই যে, এ দ্বারা আল্লাহর প্রতি বান্দার যথার্থ ভালবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়। এর বদৌলতেই বান্দাহ আল্লাহ তা‘আলার হুকুম পালনে মনোনিবেশ করে। তাঁরই নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকে।

আল্লাহ তা‘আলার বিধি-নিষেধের প্রতি বান্দাহর এ আনুগত্য ব্যক্তি ও সমাজের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতের পরম শান্তি এনে দেয়।

﴿مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧﴾ [النحل: 97]

“যে ব্যক্তি নেক আমল করবে, সে পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক যদি সে মুমিন হয়, তাকে দুনিয়াতে পবিত্র জীবন দান করবো, আর আখেরাতে এ ধরনের লোকদেরকে তাদের উত্তম আমল অনুযায়ী পুরস্কার দান করবো”। [নাহল : ৯৭]

 ফিরিশ্‌তাদের প্রতি ঈমান আনার ফলাফল

ফিরিশ্‌তাদের উপর ঈমান আনার একাধিক উপকারিতা আছে। যেমন:

প্রথম : ফিরিশ্‌তাদের স্বীয় মহান স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার মহানুভবতা, মহত্ব, শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।

দ্বিতীয় : বান্দাহর হেফাজত বা রক্ষণাবেক্ষনের জন্য আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া জ্ঞাপন। কেননা তিনি এসব ফিরিশ্‌তাদের মধ্য থেকে কাউকে বান্দাহদের হেফাজতের জন্য, কাউকে তাদের আমল নামা লেখা ও অন্যান্য স্বার্থ রক্ষার জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন।

তৃতীয় : পূর্ণাঙ্গরূপে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার জন্য এবং মুমিনদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত করার কারণে ফিরিশতাদের প্রতি মুহাব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়।

 আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমানের ফলাফল

আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনারও বেশ উপকারিতা আছে।

প্রথম: সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অপরিসীম রহমত ও দয়া সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। কেননা তিনি দুনিয়ার প্রতিটি জাতির হিদায়াতের জন্যই আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন।

দ্বিতীয়: আল্লাহর হিকমতের বহিঃপ্রকাশ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এসব আসমানী কিতাবের মাধ্যমে প্রতিটি জাতির উপযোগী ও প্রয়োজনীয় বিধান পাঠিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ কিতাব হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। কিয়ামত পর্যন্ত এ কিতাব স্থান-কাল-পাত্র ভেদে গোটা সৃষ্টি জগতের হিদায়াতের জন্য উপযোগী এবং কার্যকর।

তৃতীয়: উপরোক্ত মেহেরবাণীর জন্য আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া জ্ঞাপন, ইত্যাদি।

নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমানের ফলাফল

নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমান পোষণ করার মধ্যেও অনেক কল্যাণ আছে।

এক: আল্লাহ তা‘আলার অপরিসীম রহমত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ এবং সৃষ্টি জগতের হিদায়াতের উদ্দেশ্যে নবী-রাসূল পাঠানোর মাধ্যমে সৃষ্টির প্রতি যে করুণ করেছেন তা জানা।

দুই: আল্লাহ তা‘আলার উপরোক্ত মহান নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন।

তিন: নবী-রাসূলগণের প্রতি মহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাঁদের যথাযোগ্য প্রশংসা জ্ঞাপন করা। কেননা তাঁরা হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, এবং তাঁরই একনিষ্ঠ বান্দাহ। তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার রিসালাত এবং উপদেশ মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন। মানুষের পক্ষ থেকে সব যুলুম নিপীড়ন ও নির্যাতন তাঁরা সহ্য করেছেন।

আখেরাতের প্রতি ঈমানের ফলাফল

আখিরাতের উপর ঈমান পোষণ করার মাঝেও মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে :

এক: আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা, শেষ দিবসে সওয়াব ও পুরষ্কার লাভের ক্ষেত্রে এবং আখেরাতের আযাবের ভয়ে পাপ ও অন্যায় থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা লাভ।

দুই: আখেরাতের পরম শান্তি ও সওয়াবের প্রত্যাশায় দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং উপভোগ্য বিলাস সামগ্রীর বঞ্চনায় মুমিন ব্যক্তির শান্তনা লাভ।

তকদীরের প্রতি ঈমানের ফলাফল

তকদীরের উপর ঈমান পোষণ করার মধ্যেও নিহিত আছে অনেক কল্যাণ।

এক: কোন কাজের কারণ সম্পন্ন করার সময় আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা। কেননা কাজ এবং কাজের কারণ সবই আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদীরের লিখন।

দুই: মনের সুখ ও অন্তরের প্রশান্তি লাভ। কেননা নিজ দায়িত্ব হিসেবে কার্যকারণ সম্পন্ন করার পর অন্তর যখন একথা জানতে পারবে যে, সবই আল্লাহর ফয়সালা তাই অনাকাংখিত যা ঘটার তা ঘটবেই তখন মন নিশ্চিন্ত থাকবে। অন্তর লাভ করবে প্রশান্তি। আল্লাহর ফয়াসালায় থাকবে সন্তুষ্টি। এমতাবস্থায় তাকদীরে বিশ্বাসী একজন লোকের চেয়ে অন্য কেউ এতটুকু সুন্দর জীবন, শক্তিশালী মন ও প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী হতে পারে না।

তিন: উদ্দেশ্য হাসিল হলে আত্মগর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করা। কেননা উদ্দেশ্য হাসিল হওয়া আল্লাহরই নেয়ামত এবং কল্যাণ ও নাজাত লাভের কারণ। তাই নেক বান্দাহ আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে আত্মগর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করে।

চার: উদ্দেশ্য হাসিল না হলে কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে গেলে অন্তরের অশান্তি ও অস্থিরতা দূর করা। কেন না বান্দাহর ভাগ্যে যা ঘটে তা আল্লাহ তা‘আলারই ফয়সালা। যিনি যমীন ও আসমানের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তাঁর যা ফয়সালা তা হবেই। এতে একমাত্র নেককার লোকেরাই ধৈর্য ধারণ করে এবং আখেরাতে এর পুরষ্কার কামনা করে। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِيٓ أَنفُسِكُمۡ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مِّن قَبۡلِ أَن نَّبۡرَأَهَآۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٢٢ لِّكَيۡلَا تَأۡسَوۡاْ عَلَىٰ مَا فَاتَكُمۡ وَلَا تَفۡرَحُواْ بِمَآ ءَاتَىٰكُمۡۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٍ ٢٣﴾ [الحديد: 22-23]

“যমীনে কিংবা তোমাদের উপর আপতিত প্রত্যেকটি বিপদই সৃষ্টি করার পূর্বে তা একটি কিতাবে রয়েছে। এরূপ করা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ ব্যাপার। এটা এ জন্য যে, তোমরা কোন কিছু থেকে বঞ্চিত হলে, তার জন্য কোন দুঃখ করবে না। আর কিছু পেয়ে গেলে তার জন্য আত্মগর্ব হবে না। আল্লাহ তা‘আলা কোন গর্বকারী ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না”। [হাদীদ: ২২-২৩]

আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ কামনাই করি, তিনি যেন আমাদেরকে এ পবিত্র আক্বীদার উপর দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা দান করেন, আমাদেরকে এর সুফল দান করেন, আমাদের জন্য তাঁর করুণা বৃদ্ধি করেন, হিদায়াত লাভের পর অন্তরে বক্রতা সৃষ্টি না করেন, আমাদের উপর তাঁর অপরিসীম রহমত বর্ষণ করেন। বস্তুত তিনিই হচ্ছেন মহা অনুগ্রহ দানকারী।

ওয়াল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment