আহমাদ রিদা খান ব্রেলভীর বিরুদ্ধে উলামায়ে দেওবন্দের অপপ্রচার (১ম পর্ব)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইতোপূর্বে আমি এক আলোচনায় দেখিয়েছিলাম যে বিপরীত মত তথা ব্রেলভী ধারার আলিমদের সমালোচনা করতে গিয়ে কীভাবে দেওবন্দী আলিমদের মান্যবর আলিম ডক্টর খালিদ মাহমুদ বিভিন্ন রকম ইলমী খিয়ানত করেছেন। ইসলামে বিভিন্ন মতামত থাকা, পক্ষ – বিপক্ষ থাকা দোষণীয় নয়। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নিজের মত ও পক্ষকে শক্তিশালী করার জন্য বিপরীত মতের উপর জুলুম করা, খিয়ানত করা কিংবা মিথ্যাচার করা কোনভাবেই অনুমোদিত নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন,

وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَىٰ أَلَّا تَعْدِلُوا ۚ اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۖ

কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী।

অর্থাৎ আমার দৃষ্টিতে প্রতিপক্ষ যেই হোক, যে স্তরেরই হোক তাকে ঘায়েল করার জন্য তার নামে মিথ্যাচার করা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালানোর কোন সুযোগ নেই।

এজাতীয় ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়াতে উপকারের চেয়ে বরং ক্ষতি বেশি হয়। প্রতিপক্ষের সমালোচনায় যখন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়, তখন প্রতিপক্ষের কাছে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, এই সমালোচনা ইলমী – ইনসাফের সমালোচনা নয়। বরং এটা মিথ্যার উপর নির্ভর করে নিজেদের জিঘাংসা মেটানোর চেষ্টা মাত্র। এতে করে প্রতিপক্ষ তাদের মতের উপর আরও শক্তিশালী হয়ে যায়। এমনকি যাদের সামনে এজাতীয় মিথ্যার বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যায়, তারাও নিজেদের পক্ষের কথার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাচার করে যেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাওয়া হয়েছিল, দিন শেষে সেটি সব দিক থেকেই ব্যর্থ হয়।

যে কোন আলিমের ভুল-ত্রুটি বা বিচ্যূতি হলে সেটা সঠিক পন্থায় খন্ডন হওয়া জ্বরুরি। এর মাধ্যমে সবারই উপকার হয়। সঠিক ইলমী পদ্ধতিতে যদি ব্রেলভীদের খন্ডন হয়, এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কাজ। কিন্তু খন্ডনের নামে যদি মিথ্যাচার করা হয়, বিভিন্ন রকম মিথ্যা বিষয় চাপিয়ে দেয়া হয়, এগুলো তো কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

আজকের আলোচনায় আমরা দেখব, দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে কীভাবে নানা রকম অবাস্তব, মিথ্যা দাবী করে ব্রেলভীদের খন্ডন করা হয়েছে। এবং এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার হয়ে আসছে। দেওবন্দী ঘরানার পক্ষ থেকে এর সংশোধন বা এগুলোর প্রতিকার নিয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এর চেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, পরবর্তী প্রজন্ম এজাতীয় ভুলকে দলিল বানিয়ে সেগুলোকে প্রচারও করছে। কোন একটা ভুল বা মিথ্যা এভাবে গোষ্ঠীগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া অবশ্যই অন্যায়। বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের জিম্মাদারি যেখানে ছিলো, সঠিক পন্থায় ইনসাফের সাথে খন্ডন করা, এর বিপরীতে মিথ্যার উপর নির্ভর করে অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়া কখনও উলামায়ে কেরামের শান হতে পারে না।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্রেলভী মাসলাক বিশেষ করে আহমাদ রিদ্বা খানের বক্তব্য সঠিকভাবে তুলে এনে এর খন্ডনের পক্ষে। আমি নিজেও চাই, উলামায়ে দেওবন্দের পক্ষ থেকে সঠিক পন্থায় শক্ত ইলমী খন্ডন হোক। বিষয়গুলো এতো মজবুতভাবে খন্ডন হোক, যাতে এই খন্ডনের উপর অন্যরা হাত না দিতে পারে।

সম্প্রতি মাওলানা মিজান হারুন উলামায়ে দেওবন্দের মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন অবাস্তব ধারণার উপর ভিত্তি করে ব্রেলভীদের সমালোচনার পুনরাবৃত্তি শুরু করেছেন। উনার অধিকাংশ লেখা এজাতীয় মিথ্যাচারমূলক অপপ্রচারের চর্বিত চর্বণ। যা পূর্ব থেকেই উলামায়ে দেওবন্দের মাঝে প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে অনেকে এই প্রশ্ন বা আপত্তি তুলেছেন যে, কওমীর সন্তান হয়েও কেন আহমাদ রিদ্বা খানের পক্ষে আমি লিখছি? এর সহজ উত্তর হলো, দুনিয়াতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তির নামেও মিথ্যাচারের অনুমতি শরীয়াত দেয় না। এমনকি ফিরআউনের নামেও মিথ্যা কথা বলে তার বিরোধিতা করা অবৈধ। এক্ষেত্রে আমার সামনে যেহেতু এজাতীয় বিষয়ের বাস্তবতা স্পষ্ট, এজন্য নিজের দল বা পরিচয়ের বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ও ইলমের আমানত হিসেবে এই জাতীয় মিথ্যাচারের বাস্তবতা স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। ইলমী দালিলিক খন্ডন হলে আমি নিজেও এতে অংশগ্রহণ করব এবং সেটি প্রচারও করব। কিন্তু খন্ডনের নামে মিথ্যাচারকে সমর্থন করার কোন সুযোগ নেই।

চলুন, মিজান হারুনের সাম্প্রতিক একটি পোস্ট নিয়ে আলোচনা শুরু যাক। মিজান হারুন মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া লিখিত কওমী মাদ্রাসার মেশকাত জামাতের (দাওরা হদীসের নিচের জামায়াত) এর নেসাবভুক্ত দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান নামক কিতাব একটি অংশ স্ক্রিনশট দিয়ে লিখেছেন,

“ মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া (র.) লিখিত ‘দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান’। এমন মূল্যবান বই আমাদের মাদরাসাগুলোর পাঠ্যতালিকায় থাকলেও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয় না। আমাদের সময় দেখেছি, নামকাওয়াস্তে অতিরিক্ত বিষয় হিসেব পড়ানো হতো। ছেলেরা না বুঝেই কেবল পরীক্ষায় উতরানোর জন্য মুখস্থ করতো। অথচ এই বইয়ে নিজেদের ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের যে সবক রয়েছে, সেটা অধিকাংশ ছাত্রই অনুভব করতো না। ফলাফল সামনে।”

মিজান হারুনের পুরো পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন,

এখানে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াইহয়া সাহেব লিখেছেন,

সাইয়্যিদ আহমাদ বেরলভী রাহ: যখন হজ্ব থেকে ফিরে এসে তার জিহাদী তৎপরতা শুরু করলেন এবং দেশীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলোকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে একত্রিত করতে লাগলেন, তখন ধূর্ত ইংরেজরা সাইয়্যিদ আহমাদ রাহ: এবং তার সাথী-সঙ্গী শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে ওয়াহাবী মতালম্বী এবং এবং আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ফলে সাধারণ জনগণ তাদের ব্যাপারে বিভ্রান্তির শিকার হয়। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বুঝতে না পেরে একদল লোক তাদের ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করে। কারণ হলো, (মুহাম্মাদ বিন) আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারীরা ইসলামের কতিপয় বিষয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে এদেশীয় মুসলমানদের নিকট তারা আগে থেকেই সমালোচিত ছিলো। যখন প্রচার করা হলো এই সব আলিম উলামা ওয়াহাবী, তখন মানুষ তাদের প্রতি বিরুপভাবাপন্ন হয়ে ওঠল। আর একাজের জন্য তারা আহমাদ রেজা খান বেরলভী ও তার দলকে ক্রয় করে নেয়। বেরেলভী সম্প্রদায় মূলত: মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছাই করা স্বার্থান্বেষী এবং তোষামোদী লোকের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেরকা, যার নেতা ছিল মৌ: আহমাদ রেজা খান বেরলভী। এরা নিজেকে একমাত্র রাসূল প্রেমিক বলে দাবী করত এবং স্বদেশী আলিমদের বিরুদ্ধে ছিলো অত্যন্ত তৎপর। উলামায়ে কেরাম যখন শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন এরা তাদের মুকাবিলায় মেতে ওঠেছিল। এরাই ইংরেজদের প্ররোচণায় হক্বপন্থী উলামায়ে কেরামকে ওয়াহাবী বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। মৌলভী আহমাদ রেজা খান তো হিন্দুস্তানকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ফতওয়াও দিয়েছিল।”

আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব তার দেওবন্দ আন্দোলন বইয়ের ১৫২ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলি লিখেছেন। পূর্ণ আলোচনার স্ক্রিনশট:

এখানে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব সংক্ষেপে আহমাদ রিদ্বা খান বেরেলভীর বিরুদ্ধে বললেও একই ধরণের সমালোচনা তিনি একই বইয়ের আরেক জায়গায় আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একই বইয়ের ২৮২ পৃষ্ঠা থেকে বিদয়াতীদের ফেতনা প্রতিরোধে উলামায়ে দেওবন্দের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। ২৮৫ পৃষ্ঠায় তিনি একটি শিরোনাম দিয়েছেন, আহমদ রেজাখানের তৎপরতা নামে। সেখানে তিনি লিখেছেন,

“উলামায়ে হক্কানী যখন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন সংগ্রামে রত, তখন সাম্রাজ্যবাদীরা এই বিদয়াতী শ্রেণিকে তাদের স্বপক্ষে টেনে নেয়। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে উলামায়ে হক্কানীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য এদেশীয় ব্যক্তিবর্গের মাঝে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর পর বিদয়াতীদের বিশিষ্ট নেতা মাও: আহমদ রেজাখান ছিল অন্যতম।

বহু বিদয়াতের উদ্ভাবনকারী এই লোকটি রায়বেরলীতে জন্মগ্রহণ করে। এদেশের গণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ইংরেজ বিরোধী জিহাদী চেতনাকে অবদমিত করার জন্য ইংরেজরা যেসব ব্যক্তিবর্গকে জিহাদের বিধান রহিত বলে অপপ্রচার চালানোর জন্য ভাড়াটে হিসেবে নিয়োগ করেছিল, আহমদ রেজা খান ছিল তাদের অন্যতম। তবে সে গোলাম আহমদের মত জিহাদের বিধান রহিত করার জন্য নিজেকে নবী হিসেবে দাবী না করে অন্যপন্থা অবলম্বন করেছিল। প্রথম দিকে সে একজন আশেকে রাসূল এবং আধ্যাত্মিক রাহবার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে এবং আশেকে রাসূল হিসাবে নিজেকে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার জন্য মিলাদ ও কিয়ামের বিশেষ প্রথার প্রচলন করে। নবী প্রেমের কিছু কবিতা ও না’ত সে রচনা করে সাধারণ্যে প্রচার করতে থাকে। ইংরেজরা তাদের স্বার্থেই এ ভন্ড লোকটিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে। ফলে সেই নিমক হালালীর জন্য ইংরেজদের জন্য সহায়ক এমন কোন অপকর্ম নেই যা সে আঞ্জাম দেয়নি।”

এরপর তিনি ধারাবাহিকভাবে আহমাদ রেজাখানের দারুল হারব ও দারুল ইসলাম ফতোয়া নিয়ে সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ২৮৭ পৃষ্ঠায় তিনি ‘ওয়াহাবী অপবাদের নেপথ্য কাহিনী’ শিরোনামে আলোচনা শুরু করেন। এই আলোচনায় তিনি শুরুতে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীকে সংগ্রামী সংস্কারক হিসেবে উল্লেখ করে নজদীদের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। ওয়াহাবীদের ইতিহাস আলোচনা করার পর তিনি আবার আহমাদ রেজা খানের আলোচনায় ফিরে এসেছেন ২৮৯ পৃষ্ঠায়। এখানে তিনি লিখেছেন,

“ ভারতে যখন হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে তখন এ আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইংরেজরা যে সব চাল চালে তার মাঝে এ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওয়াহাবী বলে আখ্যায়িত করার চালটি অন্যতম। ১৮২২ সালে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ হজ্জ থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্যে জিহাদী তৎপরতা শুরু করলে ইংরেজরা তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে তাকে ওয়াহাবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। যেহেতু এদেশের মানুষ আগে থেকেই ওয়াহাবীদের প্রতি বিরুপ ভাবাপন্ন ছিল সুতরাং তাদের এই প্রচারণায় যথেষ্ট সুফল ফলে। এমনকি ইংরেজ ঐতিহাসিক মি: হান্টারতো এই উভয় আন্দোলনকে এক ও অভিন্ন বলেই মন্তব্য করেছেন এবং প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, হজ্জ করতে গিয়ে সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের শিষ্যত্ব বরণ করে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ভারতবর্ষে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূচনা করেন। এর পেছনে যুক্তি হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন যে, হজ্জে যাওয়ার আগে সে একজন পীর ছিল মাত্র, হজ্জ থেকে ফিরেই সে ওয়াহাবীদের অনুকরণে জিহাদী তৎপরতা শুরু করে। ওয়াহাবীরাও কবর ও মাযার পূজার বিরোধিতা করে সাইয়্যিদ আহমদও তাই করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর এই মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে প্রচার করার জন্য ইংরেজরা আহমদ রেজা খানকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে নেয়। সে তার দল বল নিয়ে আল্লাহর রাহে নিবেদিত স্বাধীনতা কামী মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে সাধারণ মানুষের মাঝে জোড় প্রচারণা চালাতে থাকে, এবং এদেরকে কাফের ও রাসূল বিদ্বেষী বলে ফতওয়া দিয়ে বেড়াতে থাকে। সাধারণ মানুষের মাঝে যারা এ আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ব থেকে ওয়াকিফহাল ছিলেন তারা তো ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্র সহজেই ধরে ফেলতে পারলেন, কিন্তু যারা এ আন্দোলনের সাথে পূর্ব থেকে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বা মুজাহিদদের তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন না তারাই এ প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হলেন বেশী। সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ জানেনা বিধায় তারা একথা তলিয়ে দেখেনি যে, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ১৭৮৭ সালে মারা গেলেন সুতরাং সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: ১৮২২ সালে হজ্জ করতে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করবেন কী রুপে?

এই কিতাবের ২৮৭ পৃষ্ঠায় আহমদ রিদ্বা খান ও তার অনুসারীদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,

“ কিন্তু আহমদ রেজা খান এই ফতওয়া নিয়ে ভারতবর্ষে এসে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে সংগ্রামী উলামায়ে কেরামের প্রভাব ক্ষুন্ন করত: স্বাধীনতা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে। তার অনুসারীরা এতটাই বেড়ে যায় যে, তাদের কুসংস্কারের সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া অন্য সব আলিম-উলামা ও তাদের অনুসারীদেরকে ঢালাওভাবে কাফের ও রাসূল বিদ্বেষী বলে অপপ্রচার করতে সামান্য কুন্ঠাবোধ করে না। মিলাদ কিয়াম ইত্যাদির মাধ্যমে নবী প্রেমের সস্তা বুলি আওড়িয়ে সাধারণ মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করে চলেছে। এদলটি বর্তমানে বহু জঘন্য বিশ্বাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরা রাসূল গায়েব জানেন এবং আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজ করেন রাসূলও তেমনি সর্বত্র বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করে। তাছাড়া এরা রাসূলকে মানুষ বলে মনে করে না বরং নূরানী এক সত্ত্বা বলে বিশ্বাস করে, এবং সে নূর আল্লাহর খন্ডিত নূর বলে দাবী করে। এদের কেউ কেউ আল্লাহ ও রাসূলকে এক ও অভিন্ন সত্ত্বা বলেও বিশ্বাস করে।”

আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেবের এ বইটি ১৯৯৮ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এবং দীর্ঘ সময় ধরে এটি কওমী মাদ্রাসার মেশকাত জামায়াতের পাঠ্য-তালিকায় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের মান্যবর আলিম মাওলানা কাজী মু’তাজিম বিল্লাহ সাহেব। এছাড়া বেফাকের প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল জব্বার সাহেবেরও একটি প্রশংসাবাণী রয়েছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই মাওলানা মিজান হারুন এই বইয়ের উপর কওমীর বর্তমান প্রজন্মকে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে আহমাদ রেজা খান ব্রেলভীর খন্ডনে এই বইয়ের আলোচনাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এর একটি অংশের স্ক্রিনশটও দিয়েছেন। যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি।

আমরা উপরে আহমাদ রেজা খান ব্রেলভী সম্পর্কে এ বইয়ের আলোচনার কিছু কিছু অংশ উল্লেখ করেছি। এই আলোচনাগুলোর সত্য-মিথ্যা বা বাস্তবতা নিয়ে পর্যালোচনার পূর্বে একটি জ্বরুরি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। কোন একটা বিষয় স্পষ্টভাবে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেটার উত্তর হিসেবে অনেকে তা’বীলের পথ অবলম্বন করেন। আমাদের সম্মানিত উস্তায মুফতী নুরুল আমীন সাহেব দা: বা: ক্লাসে প্রায়-ই বলতেন, বা’বুত তা’বীলি মাফতুহুন। অর্থাৎ তা’বীলের রাস্তা খোলা রয়েছে। ভুল-ভাল তা’বীল করে যে কোন বাস্তবতাকে উল্টিয়ে দেয়া সম্ভব। এজন্য কোন একটা ভুল-ভ্রান্তি সুস্পষ্ট হওয়ার পর দেখা যায়, নিজেদের মাসলাক বা চিন্তাধারাকে বাঁচানোর জন্য নানা রকম অপব্যাখ্যার রাস্তা তৈরি করা হয়। আমরা এখানে যেই পর্যালোচনা উল্লেখ করব, এগুলোর উপর এজাতীয় অপব্যাখ্যা এক ধরণের দায়সারা জওয়াব দেয়ার চেষ্টা হতে পারে। কারণ পূর্বেও এধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এজন্য নানা অপব্যাখ্যা করে এগুলোর ভুল-ভাল জওয়াব দেয়ার চেষ্টার কথা মাথায় রেখেই নিচের পর্যালোচনাগুলো পড়তে হবে।

সর্বপ্রথম বলে নেয়া প্রয়োজন যে, আহমদ রেজা খান ব্রেলভী বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট যেসকল কথা মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব লিখেছেন এর অধিকাংশই ঐতিহাসিক ও বাস্তবতার বিচারে মিথ্যা ও অপপ্রচার। প্রায় প্রত্যেকটা লাইন ধরে ধরে এর অসারতা তুলে ধরা সম্ভব। এটা করতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমি এখানে মোটাদাগের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। অন্যান্য বিষয়ের পর্যালোচনা আমার অন্য কোন লেখাতে পরবর্তীতে আনার চেষ্টা থাকবে ইনশা আল্লাহ।

উপরের আলোচনায় কিছু অবাস্তব ও মিথ্যা দাবী:

১। প্রথম দিকে সে একজন আশেকে রাসূল এবং আধ্যাত্মিক রাহবার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে এবং আশেকে রাসূল হিসাবে নিজেকে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার জন্য মিলাদ ও কিয়ামের বিশেষ প্রথার প্রচলন করে। নবী প্রেমের কিছু কবিতা ও না’ত সে রচনা করে সাধারণ্যে প্রচার করতে থাকে। (দেওবন্দ আন্দোলন-২৮৫ পৃষ্ঠা)

আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেবের এই বক্তব্যটি শুধু অবাস্তব বা মিথ্যাই নয় বরং এটি একটি চরম হাস্যকরও বটে। আহমদ রেজা খান বেরলভী নিজেকে আশেকে রাসূল হিসেবে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার মিলাদ ও কিয়ামের বিশেষ প্রথার প্রচলন করেছেন, এরকম হাস্যকর দাবী একজন আলিম কীভাবে করতে পারেন? মিলাদ – কিয়ামের প্রথার প্রচলন কি আহমাদ রেজা খান ব্রেলভীর হাত ধরে শুরু হয়েছে? প্রায় হাজার বছর আগের মিলাদ-কিয়ামের প্রথা আহমদ রেজা খানের হাত ধরে কীভাবে শুরু হতে পারে? নাকি যিনি এটি লিখেছেন তিনি জানেনই না যে মিলাদ – কিয়াম কীভাবে শুরু হয়েছে? এখানে এই বক্তব্যের তা’বীল উলামায়ে দেওবন্দের পক্ষ থেকে এরকম হতে পারে যে, মিলাদ – ক্বিয়ামের প্রথার প্রচলন দ্বারা আসলে হিন্দুস্তানের নতুন পদ্ধতির মিলাদ-কিয়াম উদ্দেশ্য। এই তা’বীলের উপর তখন প্রশ্ন আসবে, আহমদ রেজা খান পূর্ব থেকে চলে আসা মিলাদ-ক্বিয়ামের পদ্ধতিতে কী কী পরিবর্তন এনেছেন যে, তিনি মিলাদ – কিয়ামের প্রথা চালু করেছেন নিজেকে আশেকে রাসূল প্রমাণের জন্য এই দাবী করা সঠিক হতে পারে?

মোটকথা এরকম একটা নিরেট ভুল কথা কীভাবে এধরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাবে স্থান পেতে পারে সেটি আশ্চর্য্য হওয়ার মতো।

২। মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব আহমাদ রেজা খান বেরলভী ও তার অনুসারীদের বিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছেন,

“আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজ করেন রাসূলও তেমনি সর্বত্র বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করে।”

এটিও আহমাদ রেজা খান বেরলভী ও তার অনুসারীদের উপর একটি চরম পর্যায়ের মিথ্যাচার। এর চেয়ে বড় ধরণের মিথ্যা দাবী আর হতে পারে না। এই কথা বলা যে, আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজ করেন রাসূলও তেমনি সর্বত্র বিরাজ করেন, এটি বেরলভীদের বিশ্বাস, এটি বাস্তবেই বেরলভীদের আকিদা সম্পর্কে না জেনে তাদের উপর মিথ্যাচার।

ক: প্রথমত: আহমাদ রেজা খান বেরলভী বা তার অনুসারীরা আল্লাহ তায়ালাকে সর্বত্র বিরাজমানই বিশ্বাস করে না। বরং তারা আহলে সুন্নতের মৌলিক আকিদা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিক থেকে মুক্ত বিশ্বাস করে।

খ: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর মতো সর্বত্র বিরাজমান এটাও তাদের আকিদা নয় বরং এটি তাদের আকিদা বিরোধী একটি বাতিল কথা। তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রুহানী হুজুর বা উপস্থিতির কথা বলেন সম্ভাবনা হিসেবে। অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রুহ মোবারক যে কোন জায়গায় উপস্থিত হতে পারেন। এই কথাটি আহমাদ রিদ্বা খানের নিজের বক্তব্য বা মতামত নয়। বরং এটি তিনি ইবনুল কাইয়্যিমের কিতাবুর রুহের আলোচনা থেকে নিয়েছেন। কিতাবুর রুহে রুহকে মূহুর্তে যে কোন জায়গায় উপস্থিত হওয়ার উদারহণ হিসেবে একে সূর্য্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সূর্য্যের আলো যেমন সব-জায়গায় ছড়িয়ে থাকে রুহও তেমনি আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকার পরও এটি বিভিন্ন জায়গায় একই সাথে থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ইবনুল কাইয়্যিম দলিল দিয়েছেন, হযরত মুসা আ: এর রুহ কবরে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছে আবার তার সাথেই আসমানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হয়েছে।

গ: যদি ধরেও নেয়া হয়, তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব জায়গায় বিরাজমান বিশ্বাস করে, এরপরও তারা আল্লাহর মতো নবীজীকে সর্বত্র বিরাজমান বিশ্বাস করে এটা কীভাবে সাব্যস্ত হতে পারে? এই যে আল্লাহর সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাদৃশ্য দেয়া হচ্ছে, এটা তাদের নামে কীভাবে চালান হলো? তারা কি এটা কোথাও বলেছে? বা আহমদ রেজা খান কি এধরণের কোন কথা লিখেছে?

আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিকে বিশ্বাসের আকিদার বিরুদ্ধে খোদ আহমাদ রেজা খান যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, এর বিপরীতে তার উপরই এমন মিথ্যাচার করা যে নবীজীকে নাউজুবিল্লাহ আল্লাহর মতো সর্বত্র বিরাজমান বিশ্বাস করে, এর চেয়ে মিথ্যা দুনিয়াতে আর কী হতে পারে?

চলুন আল্লাহর স্থান ও দিক থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে আহমাদ রিদ্বা খানের কিছু বক্তব্য দেখে নেয়া যাক। আহমদ রেজা খান বেরলভীর একটি বিখ্যাত কিতাবের নাম হলো, “কাওয়ারিউল কাহহার ফির রদ্দি আলা মুজাসসিমাতিল ফুজ্জার”। এই কিতাবটি তিনি লিখেছেন, এজাতীয় বাতিল আকিদা খন্ডনের জন্য। এই কিতাবে তিনি লিখেছেন,

“ সাদৃশ্যবাদীরা আল্লাহর সিফাত অস্বীকারকারীদের বিপরীত। তারা এক্ষেত্রে ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়েছে। এদেরকে হাশাবিয়া বা মুজাসসিমাও (দেহবাদী) বলা হয়। এই খবীসরা প্রকাশ্যভাবে এই আকিদা গ্রহণ করেছে যে, আল্লাহর স্থান, দিক ও দেহ রয়েছে। আল্লাহর যেহেতু স্থান, দিক ও দেহ রয়েছে, এজন্য তার বসা-দাঁড়ান, ওঠা-নামা, চলন ও স্থির হওয়া সবই আছে। এরা হলো সেই প্রত্যাখ্যাত দল যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে। তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও ফেতনাকারী আখ্যা দেয়া হয়েছে।

প্রিয় ভাই, জেনে রেখো যে, নাপাক ওয়াহাবীরা পূর্ববর্তী বিভিন্ন বাতিল ফেরকার পরিত্যক্ত ভ্রান্তিগুলোকে জমা করে সেগুলো নিজেদের জন্য গ্রহণ করেছে। তারা আস্তে আস্তে বিভিন্ন বাতিল ফেরকার ভ্রান্তির পথে হেঁটেছে। অন্যান্য ভ্রান্তির পাশাপাশি তাদের অভ্যাস অনুযায়ী দেহবাদ ও সাদৃশ্যবাদের ক্ষেত্রেও বাতিল মতাদর্শের অনুসারী হয়েছে। ওহাবীদের নেতা ইসমাইল দেহলভী তার সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে তার জাহেল পীরের জন্য আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ ও হাতে – হাত রেখে মোসাফাহার কথা যখন লিখেছে, তার পরবর্তী প্রজন্ম নিরেট দেহবাদী বাতিল আকিদা গ্রহণ করেছে। এই মাজহাবের বুনিয়াদ রেখেছে তাদের মতাদর্শের নেতা ইসমাইল দেহলভী তার ‘ইদাহুল হক্কিস সরীহ কিতাবে’। সেখানে সে বলেছে, আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিক থেকে মুক্ত বিশ্বাস করা বিদয়াত ও ভ্রষ্টতা। তার খন্ডনে আমি ‘আল-কাউকাবাতুশ শিহাবিয়্যাহ’ নামক কিতাব রচনা করেছি। আমি সেখানে শাহ আব্দুল আজীজের তুহফায়ে ইসনা আশারিয়্যাহ কিতাব থেকে উদ্ধৃতি এনে দেখিয়েছি যে, তিনি বলেছেন, আহলে সুন্নতের মতে আল্লাহর জন্য কোন স্থানের প্রয়োজন নেই, আল্লাহর জন্য স্থান, দিক, উপর-নিচ সাব্যস্ত হতে পারে না।

বাহরুর রায়েক ও ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে থেকে বক্তব্য এনে দেখিয়েছি যে, এধরণের বক্তব্যের কারণে কুফুরী হয়। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করা হয়। আর আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করা কুফুরী। ফতোয়ায়ে কাজী খান থেকে উদ্ধৃত করেছি যে, কেউ যদি একথা বলে যে, আল্লাহ আসমানের উপর থেকে জানেন যে, আমার কাছে কিছুই নেই। এধরণের বক্তব্য কুফুরী হবে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত। খোলাসাতুল ফতোয়া থেকে উদ্ধৃত করেছি যে, কেউ যদি বলে যে, তীর-ধনুক নিয়ে আসমানে যাও এবং আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করো, তাহলে এটি কুফুরী হবে। কারণ সে আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করেছে।

[কাওয়ারিউল কাহহার, পৃ: ১৩১-১৩৪ ]

মোটকথা, যেই আকিদা-বিশ্বাস খোদ আহমাদ রেজা খান বেরলভীর কাছে বাতিল ও কুফুরী, সেই আকিদা তার উরপ চাপিয়ে দিয়ে এই দাবী করা যে, আহমাদ রেজা খান নবীজী সাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজমান ওই রকম সর্বত্র বিরাজমান মনে করে, এর চেয়ে চরম পর্যায়ের মিথ্যাচার আর কী হতে পারে?

৪। তাছাড়া এরা রাসূলকে মানুষ বলে মনে করে না বরং নূরানী এক সত্ত্বা বলে বিশ্বাস করে, এবং সে নূর আল্লাহর খন্ডিত নূর বলে দাবী করে।

এটাও আহমদ রেজা খান বা তার প্রকৃত অনুসারীদের উপর মিথ্যাচার। এ বিষয়ে মাওলানা মিজান হারুন তো আরও এক ধাপ এগিয়ে আহমদ রেজা খান খ্রিষ্টান বা হিন্দুদের মতো অবতারের আকিদায় বিশ্বাস করে এধরণের একটি অপবাদমূলক লম্বা আলোচনা করেছে। এখানে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য,

ক: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়াত বা মানুষ হওয়াকে অস্বীকার করা কুফুরী।

খ: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর খন্ডিত নূর মনে করাও কুফুরী।

এ দু’টি বিষয় খোদ আহমদ রেজা খান তার কিতাবে স্পষ্টভাবে লিখে গিয়েছেন। আমরা পরের পর্বে মিজান হারুনের অবতার বিষয়ক অপবাদ ও মিথ্যাচারের আলোচনায় খোদ আহমদ রেজা খানের কিতাব থেকে তার বক্তব্য দেখাব ইনশা আল্লাহ।

৫। এদেশের গণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ইংরেজ বিরোধী জিহাদী চেতনাকে অবদমিত করার জন্য ইংরেজরা যেসব ব্যক্তিবর্গকে জিহাদের বিধান রহিত বলে অপপ্রচার চালানোর জন্য ভাড়াটে হিসেবে নিয়োগ করেছিল, আহমদ রেজা খান ছিল তাদের অন্যতম। তবে সে গোলাম আহমদের মত জিহাদের বিধান রহিত করার জন্য নিজেকে নবী হিসেবে দাবী না করে অন্যপন্থা অবলম্বন করেছিল।

এটাও আহমাদ রেজা খানের উপর মিথ্যাচার। জি-হা-দের বিধান রহিত এজাতীয় কথা আহমাদ রেজা খান কোথায় বলেছেন? আর ইংরেজরা যে আহমাদ রেজাকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করেছে বা ভাড়াটে হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে এই কথারই বা দলিল কী? নাকি কোন ধরণের প্রমাণ ছাড়া লাগামহীনভাবে যে কোন কথা বলে দেয়া যায়?

৬। পুরো আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে মজার একটি বিষয় হলো এ বইয়ের ২৮৯ পৃষ্ঠায় আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়াহ সাহেব লিখেছেন,

“ ভারতে যখন হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে তখন এ আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইংরেজরা যে সব চাল চালে তার মাঝে এ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওয়াহাবী বলে আখ্যায়িত করার চালটি অন্যতম। ১৮২২ সালে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ হজ্জ থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্যে জিহাদী তৎপরতা শুরু করলে ইংরেজরা তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে তাকে ওয়াহাবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। যেহেতু এদেশের মানুষ আগে থেকেই ওয়াহাবীদের প্রতি বিরুপ ভাবাপন্ন ছিল সুতরাং তাদের এই প্রচারণায় যথেষ্ট সুফল ফলে। এমনকি ইংরেজ ঐতিহাসিক মি: হান্টারতো এই উভয় আন্দোলনকে এক ও অভিন্ন বলেই মন্তব্য করেছেন এবং প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, হজ্জ করতে গিয়ে সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের শিষ্যত্ব বরণ করে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ভারতবর্ষে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূচনা করেন। এর পেছনে যুক্তি হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন যে, হজ্জে যাওয়ার আগে সে একজন পীর ছিল মাত্র, হজ্জ থেকে ফিরেই সে ওয়াহাবীদের অনুকরণে জিহাদী তৎপরতা শুরু করে। ওয়াহাবীরাও কবর ও মাযার পূজার বিরোধিতা করে সাইয়্যিদ আহমদও তাই করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর এই মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে প্রচার করার জন্য ইংরেজরা আহমদ রেজা খানকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে নেয়। সে তার দল বল নিয়ে আল্লাহর রাহে নিবেদিত স্বাধীনতা কামী মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে সাধারণ মানুষের মাঝে জোড় প্রচারণা চালাতে থাকে, এবং এদেরকে কাফের ও রাসূল বিদ্বেষী বলে ফতওয়া দিয়ে বেড়াতে থাকে। সাধারণ মানুষের মাঝে যারা এ আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ব থেকে ওয়াকিফহাল ছিলেন তারা তো ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্র সহজেই ধরে ফেলতে পারলেন, কিন্তু যারা এ আন্দোলনের সাথে পূর্ব থেকে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বা মুজাহিদদের তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন না তারাই এ প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হলেন বেশী। সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ জানেনা বিধায় তারা একথা তলিয়ে দেখেনি যে, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ১৭৮৭ সালে মারা গেলেন সুতরাং সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: ১৮২২ সালে হজ্জ করতে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করবেন কী রুপে?

মজার বিষয় হলো, একই ধরণের বক্তব্য তিনি বইয়ের ১৫২ পৃষ্ঠাতেও এনেছেন। সেখানে তিনি সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর হজ্ব থেকে ফিরে আসার পরে তাদের দলের মুজাহিদিনকে ওয়াহাবী বলার জন্য আহমাদ রেজা খানকে দায়ী করেছেন। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, উক্ত লেখাটি মাওলানা মিজান হারুন স্ক্রিনশট নিয়ে প্রচারও করেছেন। অথচ এই দুই জায়গায় একটি আজীব দাবী পেশ করা হয়েছে। লেখক যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, এটিকে বাস্তব ধরে নিলে এটিকে পৃথিবীর সেরা কারামত বলতে হবে। আব্দুল কাদের জিলানীর নামে বিভিন্ন আজগুবী কারামত থাকলেও এই ধরণের কারামত বর্ণিত আছে কি না সন্দেহ।

মূল বিষয় হলো, আহমদ রেজা খানের জন্মই হয়েছে ১৮৫৬ সালে। অথচ লেখক তার বইয়ের দু’জায়গায় সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভীদের হজ্ব থেকে ফিরে আসার পরে তাদেরকে ওয়াহাবী বলার ষড়যন্ত্রের জন্য দায় চাপাচ্ছেন আহমাদ রেজা খানের উপর। এবং লেখক নিজেও উল্লেখ করেছেন, সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর হজ্ব থেকে ফিরে আসার ঘটনাটি ঘটেছে ১৮২২-২৩ সালে। অর্থাৎ লেখকের কথা আমলে নিলে আহমদ রেজা খান বেরলভী তার জন্মের প্রায় ৩৩ বছর আগে সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর অনুসারী মুজাহিদ বাহিনীকে ওয়াহাবী অপবাদ দিয়েছে। কোন ব্যক্তি যে তার জন্মের ৩৩ বছর আগে এভাবে একটা ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে সেটা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? যদি বলি যে, এটি বাস্তবেই এমন হয়েছে, তাহলে এটা হবে পৃথিবীর সেরা একটি কারামত। এমন কারামত যা খোদ বেরলভীরাও কোন দিন হয়ত কল্পনা করেনি। আর যদি বলা হয় এটা বাস্তব না, তাহলে সাইয়্যিদ আহমাদ বেরলভীর হজ্ব থেকে ফেরত আসার পরে তাদেরকে ওয়াহাবী বলার জন্য আহমদ রেজা খান কীভাবে দায়ী হোন? যা তার জন্মের প্রায় ৩৩ বছর আগের ঘটনা? নতুবা লেখকের বক্তব্য আজীব কোন তা’বীল বের করতে হবে। আমি নিজেও একটা দু’টো তা’বীল লিখতে পারতাম, তবে এটি তা’বীল বের করতে সিদ্ধহস্তদের জন্য ছেড়ে দিলাম। তারা এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিবে যে, জন্মের ৩৩ বছর আগের বিষয়ের জন্য একজন ব্যক্তি কীভাবে দায়ী হতে পারে?

এভাবে মিথ্যার বাজার বসিয়ে বেরলভীদের খন্ডনের চেষ্টা হচ্ছে। অন্য দিকে মিজান হারুন সাহেব আফসোস করছেন, এজাতীয় মিথ্যার বেসাতির উপর অন্যরা কেন বিশ্বাস করছে না বা এই কিতাবকে আরও গুরুত্ব কেন দেয়া হচ্ছে না? আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব যেভাবে লাইনে লাইনে অবাস্তব কথা লিখেছেন, এর বিস্তারিত খন্ডন করতে গেলে স্বতন্ত্র বই হয়ে যাবে। সংক্ষিপ্তভাবে মোটাদাগের কিছু বিষয় এখানে লিখেছি। পরবর্তী পর্বে ইনশা আল্লাহ নবীজীর নূর ও বাশার নিয়ে আহমদ রেজা খানের উপর মাওলানা মিজান হারুনের মিথ্যাচারের বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment