একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ মিম্বরে উঠে বললেন, আমি তোমাদের জন্য অগ্রগামী ব্যক্তি, আমি তোমাদের হয়ে আল্লাহ’র নিকটে সাক্ষ্য দিব। আল্লাহ’র কসম, আমি এখানে বসে থেকেই আমার হাউযে কাওসার দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর ধন-ভান্ডারের চাবি (অন্য বর্ণনায় রয়েছে পৃথিবীর চাবিগুচ্ছ) আমার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ’র কসম! আমার ওফাতের পর তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে এ আশঙ্কা আমি করি না। তবে আমি তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, দুনিয়ার ধন-সম্পদের মোহে তোমরা আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়বে। (সহীহ বুখারী ৩৫৯৬, ১৩৪৪, ৪০৪২, ৪০৮৫, ৬৪২৬, ৬৫৯০)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমি ‘জাওয়ামিউল কালিম (ব্যাপক অর্থবহ সংক্ষিপ্ত কথা) সহ প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে (ঐশী) প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। একবার আমি ঘুমের অবস্থায় দেখলাম, পৃথিবীর ভান্ডারগুলোর চাবি আমাকে দেয়া হয়েছে এবং তা আমার হাতে রেখে দেয়া হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ ওফাত বরণ করে (পর্দা করে) গেছেন। আর তোমরা তা ব্যবহার (ভোগ) করছ কিংবা বলেছিলেন তোমরা তা থেকে উপকার লাভ করছ কিংবা তিনি এরকমই কোন কথা বলেছিলেন। (অন্য বর্ণনায়, আর তোমরা ঐ ভান্ডারগুলো সংগ্রহ করে চলেছ) (সহীহ বুখারী ৭২৭৩, ২৯৭৭, সুনানে আন-নাসায়ী ৩০৮৭)
তাই-ই হয়তো হযরত আবূ বকর রাঃ বলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি ও আমার ধন-সম্পদ আপনারই।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আবূ বকরের ধন-সম্পদ আমার যতটুকু উপকারে এসেছে অন্য কারো ধন-সম্পদ আমার তত উপকারে আসেনি। রাবী বলেন, এ কথায় আবূ বকর রাঃ কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি ও আমার ধন-সম্পদ আপনারই। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৯৪)
হুমায়দ ইবনু ‘আবদুর রহমান (র.) বলেনঃ আমি মু‘আবিয়া (রা.)-কে খুৎবায় বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ -কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ্ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের ‘ইলম দান করেন। আল্লাহ্ দান করেন (দাতা) আর আমি বন্টন করি (বন্টনকারী)। এ উম্মত সর্বদা তাদের প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী থাকবে, আল্লাহর আদেশ (কিয়ামত) আসা পর্যন্ত আর তারা থাকবে বিজয়ী।’ (সহীহ বুখারী ৩১১৬)
আনাস (রা.) বলেন, আমার মা উম্মু আনাস (রা.) আমাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর নিকট নিয়ে গেলেন। তখন তিনি তার ওড়নার অর্ধাংশ দিয়ে আমার ইযার (পায়জামা) এবং বাকী অর্ধাংশ দ্বারা আমার চাদর তৈরি করেছিলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ! এ আমার বালক পুত্র উনায়স (ছোট আনাস), আমি তাকে আপনার নিকট নিয়ে এসেছি, সে আপনার সেবায় থাকবে। তার জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করুন। তখন তিনি দুআ করলেন, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ “হে আল্লাহ! তাঁর ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করে দিন।” আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমার ধন-মাল অনেক আর সে যুগে আমার সন্তান ও সন্তানের নাতী-নাতনীর সংখ্যা ছিল একশ’র মতো। (সুবহান আল্লাহ) (সহীহ মুসলিম ৬২৭০)
রবী‘আহ্ ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, আমি রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর সাথে থাকতাম। উযূর পানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন মিসওয়াক, জায়নামায ইত্যাদি এগিয়ে দিতাম। একদিন তিনি ﷺ আমাকে বললেন, (তুমি আমার নিকট কিছু) চেয়ে নাও। আমি নিবেদন করলাম, আমার তো শুধু জান্নাতে আপনার সাহচর্য লাভই একমাত্র কাম্য। তিনি (ﷺ) বললেন, এছাড়া আর কিছু চাও? আমি বললাম, এটাই আমার একমাত্র আবেদন। তিনি ﷺ বললেন, তুমি বেশি বেশি সাজদাহ্ করে (এ মর্যাদা লাভের জন্য) আমাকে সাহায্য কর। [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৮৯৬, সহিহ মুসলিম ৯৮১, আবূ দাঊদ ১৩২০, নাসায়ী ১১৪১]
মদিনাবাসীগন একবার হযরত উমার (রা.) এঁর খেলাফতকালে অনাবৃষ্টির কারনে দূর্ভিক্ষে পতিত হন। হযরত বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) নামক জনৈক সাহাবী নবী করিম ﷺ-এঁর রওজা মােবারকে গিয়ে আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ﷺ! আপনার উম্মতেরা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। আপনি তাঁদের জন্য বৃষ্টির দোয়া করুন। অতঃপর রাত্রে স্বপ্নে এসে নবী করিম ﷺ বেলাল (রা.) কে বললেনঃ তুমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) এঁ নিকট গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে বলো- তাঁরা বৃষ্টি পাবে। স্বপ্ন দেখে বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) হযরত ওমর (রা.) কে এ শুভ সংবাদ দিলেন। হযরত ওমর (রা.) এ সংবাদ শুনে কেঁদে ফেললেন। মদিনাবাসীগন রহমতের বৃষ্টি লাভ করলেন।” (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহ হা/৩২৬৬৫/৩২০০২, ইমাম বায়হাক্বীঃ দালায়েলুন নবুয়াত, হা/ ৩০৩০/২৯৭৪, ফতহুল বারী শরহে বুখারী, ১০১০ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)
আবু জাওযাআ আওস ইবনু আব্দুল্লাহ (র.) বলেন, একবার মদীনাবাসী ভীষণ অনাবৃষ্টির কবলে পড়েছিল। লোকজন আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার নিকট অভিযোগ করলে তিনি বলেন, নবী ﷺ এঁর রওজার দিকে দেখ, আর তাতে আসমানের দিকে একটি ফুটো করে দাও, যেন আসমান ও তাঁর মাঝে কোনো আচ্ছাদন না থাকে। তিনি বলেন, তখন তারা তা-ই করলো। ফলে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হল। সেই বৃষ্টিতে এত বেশি ঘাস জন্মেছিল যে, উটগুলো তা খেয়ে বেশ মোটাতাজা হয়ে গিয়েছিল। তাদের পেট চর্বিতে ফুলে গিয়েছিল। ফলে সেই বছরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘উর্বরতার বছর’। (সুনান আদ-দারেমী ৯৩)
উসমান ইবনে আবূল আস সাকাফী (রাঃ) বলেন, নবী ﷺ তাকে বলেন, তুমি তোমার গোত্রের ইমামতি করবে। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি এই ব্যাপারে ভয় পাই। তিনি ﷺ বললেন, আমার কাছে আস, (অতঃপর) আমাকে তাঁর সামনে বসালেন। অতঃপর তাঁর হাত আমার বুকের মাঝে রাখলেন। এরপর বললেন, ঘুরে বসো। এবার আমার পিঠে দুই কাঁধের মাঝে তাঁর হাত রাখলেন। অতঃপর বললেন, নিজ গোত্রের ইমামতি কর (সুবহান আল্লাহ)। আর যে কেউ তার গোত্রের ইমামতি করবে, সে যেন তার নামাজ সংক্ষিপ্ত করে। কেননা, তাদের মধ্যে বৃদ্ধ, রুগ্ন, দুর্বল এবং এমন লোকও রয়েছে যার কোন প্রয়োজন আছে। অবশ্য যখন একাকী নামাজ আদায় করবে তখন সে যেরুপ ইচ্ছা করতে পারে। (সহীহ মুসলিম ৯৩৭)
রঈসুল মুফাসসিরিন বা সাইয়্যিদুল মুফাসসিরিন বা আল কুরআনের শ্রেষ্ঠ তাফসীরকারক হিসেবে যিনি স্বীকৃত তিনি হলে নবীজির চাচা আব্বাস রাঃ এঁর পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ)। কিভাবে তিনি এটা অর্জন করলেন..!
ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী ﷺ আমাকে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ্, তাকে হিকমত শিক্ষা দিন। আবদুল ওয়ারিস (র.) বলেন,
[নবী ﷺ] এ কথাটিও বলেছিলেন, হে আল্লাহ্! তাকে কিতাবের জ্ঞান দান করুন। ইমাম বুখারী (র.) বলেন الْحِكْمَةُ অর্থ নবুওয়াতের বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা। (সহীহ বুখারী ৩৭৫৬, ৭৫, ৭২৭০)
কিভাবে হযরত আবূ হুরাইরা রাঃ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (৫৩৭৪ টি) হাদিস বর্ণনাকারী হলেন..!
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি আমি আপনার কাছ থেকে বহু হাদীস শুনি কিন্তু ভুলে যাই। তিনি বলবেন তোমার চাঁদর খুলে ধর। আমি খুলে ধরলাম। তিনি ﷺ দু’হাত অঞ্জলী করে তাতে কিছু ঢেলে দেওয়ার মত করে বললেনঃ এটা তোমার বুকের সাথে লাগিয়ে ধর। আমি তা বুকের সাথে লাগালাম। এরপর আমি আর কিছুই ভুলিনি। ইবনু আবূ ফুদায়ক (রহঃ) সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন এবং তাতে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর হাত দিয়ে সেই চাঁদরের মধ্য (কিছু) দিলেন। (সহিহ বুখারী ১১৯)
আবূ হুরাইরাহ (রা.) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে দু’পাত্র ‘ইলম আয়ত্ত করে রেখেছিলাম। তার একটি পাত্র আমি বিতরণ করে দিয়েছি। আর অপরটি এমন যে, প্রকাশ করলে আমার কণ্ঠনালী কেটে দেয়া হবে। (সহিহ বুখারী ১২০)
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা বলতে পারো, সর্বাপেক্ষা বড় দানশীল (দাতা) কে? সাহাবীগণ উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সবচেয়ে বেশী জানেন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলছিলেন সবচেয়ে বড় দাতা হলেন আল্লাহ তা‘আলা। আর বনী আদমের মধ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ ই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। আর উনার পর বড় দাতা হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে ইলম শিক্ষা করবে এবং তা বিস্তার করতে থাকবে। ক্বিয়ামতের দিন সে একাই একজন ‘আমীর’ অথবা বলেছেন, একজন ‘উম্মত’ হয়ে উঠবে (অধিক মর্যাদাসম্পন্ন)। (মিশকাতুল মাসাবীহ ২৫৯, বায়হাক্বী ১৭৬৭)
ইমাম আবু হানীফা রহঃ ‘কাসিদায়ে নু’মান’ এ হুযুর (ﷺ) কে উদ্দেশ্য করে লিখেন,
‘ওহে জ্বীন ও মানবজাতির সর্বাধিক সম্মানিত ও দয়াবান সত্ত্বা, ওহে খোদার নেয়ামত সমূহের ভান্ডার, আল্লাহ আপনাকে যে নিয়ামতের বিশাল ভান্ডার দান করেছেন, সেখান থেকে দয়া করে আমাকেও কিছু দিন। আল্লাহ তা’আলা আপনাকে সন্তুষ্ট করেছেন। আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করুন। আপনার দান ও করুণার প্রত্যাশী হয়েছি। এ আবূ হানীফার জন্য (আল্লাহ’র) সৃষ্টি জগতে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। (ইমাম আবু হানিফাঃ কাসীদায়ে নুমানঃ পৃ.২২)