সূরা আলে ইমরান শরিফে,আল্লাহ বলেন,
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
এই আয়াতের সর্বশ্রেষ্ঠ তরজুমা করেছেন হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত মুফতি আহমদ রিযা আলি খান মুহাদ্দিসে বেরেলভি قدس الله سره এভাবে—
❝এবং কাফিররা ষড়যন্ত্র(মাক্কার) করেছে এবং আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করার গোপন সমাধান (খুফিয়া তাদবির) বলে দিয়েছেন।এবং আল্লাহই সর্বাপেক্ষা উত্তম গোপন সমাধান প্রদানকারী!❞
সদরুল আফাজিল আল্লামা সৈয়্যদ নঈমউদ্দিন গনযে মুরাদাবাদি قدس سره ‘হাশিয়ায়ে কানযুল ঈমান’ এ লিখেন,❝’মাকার’ শব্দটা আরবী অভিধানে গোপনীয়তার অর্থে ব্যবহৃত হয়।এ জন্য গোপন তদবীরকে/বা সমাধানকেও ‘মাকার’ বলা হয়।আর সেই তদবীর যদি সদুদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তবে তা প্রশংসনীয় এবং কোন মন্দ উদ্দেশ্যে হলে নিন্দনীয় হয়।কিন্তু উর্দু ভাষায় এ শব্দটা فريب বা, ‘ধোঁকা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।এ কারণে কোনো অবস্থাতেই এটা আল্লাহর শানে বলা যাবে না। এবং এখন যেহেতু আরবী ভাষায়ও এটা خدع বা প্রতারণা অর্থে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে সেহেতু আরবীতেও আল্লাহর শানে এটার ব্যবহার জায়েয নেই।আয়াতে যেখানেই (আল্লাহর ব্যাপারে) এটার ব্যবহার এসেছে সেখানেই সেটার অর্থ হবে ‘গোপন কৌশল অবলম্বন করা’।❞
এখানে এসে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন অনেক তরজমাকারি।যেমন
☞’তফসিরে উসমানি’ তে দেওবন্দিদের শায়খুল হিন্দ মুফতি মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি সাহেব লিখেন—❝আর ষড়যন্ত্র করেছে (মাক্কার) এই কাফিরেরা,আর ষড়যন্ত্র করেছেন(মাক্কার) আল্লাহ!❞
☞মৌলভি আশরাফ আলি থানভি সাহেব আবার কাফেরদেরকে সম্মানের শব্দ দিয়ে তরজুমা করেছেন।উনি লিখেন—
❝আর এই লোকগুলো গোপন কৌশল(খুফিয়া তদবির) করেছে,আল্লাহও গোপন কৌশল(খুফিয়া তদবির) করেছে।❞
➤এখন কথা হলো আল্লাহ ﷻ কাউকে ‘ঠকান’ বা ‘ঠকাতে পারেন কি না’ — এসম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ কি বলে?
তরজমা যে যেমনই করুক না কেনো,সবাই এব্যাপারে একমত যে আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাক্কার’ বা ‘ষড়যন্ত্রকারি’ শব্দগুলো প্রযোজ্য নয়।ঠকানো মানে বলতে বুঝায় ‘প্রতারণা’, ‘যেমন কথা ছিল তদানুযায়ি কাজ না হওয়া’,’ওয়াদা খেলাফ করা’!যা মোটেও আল্লাহর শানে প্রযোজ্য নয়।
এক্ষেত্রে অকাট্য নস হল,একই সূরার ৯নং আয়াত
اِنَّ اللّٰہَ لَا یُخۡلِفُ الۡمِیۡعَادَ
—❝নিশ্চয়ই আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করেন না!❞
আবার আল্লাহ আরো বলেন,সূরা হাজ্জ আয়াত ৪৭
وَ لَنۡ یُّخۡلِفَ اللّٰهُ وَعۡدَهٗ ؕ
—❝অথচ আল্লাহ কখনো তার ওয়াদা খেলাফ করেন না।❞
কেউ যদি কাউকে ঠকায় সে গুনাহ করলো!গুনাহকারি তার কর্মফল ভোগ করবে কিয়ামতের মাঠে,সে যত আমলই করুক না কেন,বান্দার হক্ব নষ্ট করার প্রতারণার গুনাহ আল্লাহ তো ক্ষমা করবেন না।
মহাবিখ্যাত তফসিরে কবিরে (৮ম খন্ড ৭৩পৃ.,দারুল ফিকর,বৈরুত) ইমামুল মুফাসসিরীন ফখরুল মিল্লাতে ওয়াদ্দীন মুজাদ্দিদ ফখরুদ্দিন রাযি কুদ্দিসাস সিররুহ বলেন,
المكر عبارة عن الإحتيال في إيصال الشر، والاحتيال على الله تعالى محال فصار لفظ المكر في حقه من المتشابهات
—এই আয়াতাংশে ‘মাকার’ বা ষড়যন্ত্র দ্বারা প্রতারণা বুঝায়,যা মূলত একটা খারাপ গুণেরই প্রকাশক।আর আল্লাহর ﷻ বেলায় ‘প্রতারণা’ হল ‘মুহাল’ বা Absolutely Impossible,এবং এই আয়াতাংশে ‘মাকার’ শব্দ মূলতঃ মুতাশাবিহাত নির্দেশক!
তফসিরে কবিরে আরো আছে (৩/১৫৩,প্রাগুক্ত),
(فلن يخلف الله عهده)
يدل على أنه سبحانه وتعالى منزه عن الكذب وعده ووعيده.قال أصحابنا: لأن الكذب صفة نقص والنقص على الله محال
—❝’আল্লাহ ওয়াদা খিলাফ করেন না’— এ আয়াতটা এই বক্তব্যের পক্ষে দলিল যে,আল্লাহ ﷻ স্বীয় ওয়াদাসমূহ এবং শাস্তির প্রতিশ্রুতিসমূহে মিথ্যা হতে পবিত্র।কেননা,’মিথ্যা’ হল একটা ‘নক্বস’ বা ত্রুটি।আর আল্লাহর ‘যাত’ ও ‘সিফাত’ এ ‘ত্রুটি’ থাকাটা ‘মুহাল’ বা Absolutely Impossible
আমাদের আক্বিদার ইমাম শায়খুল ইসলাম আবুল মনসুর আল-মাতুরিদি বলেন,
حرفُ المكر مذموم عند الخلق فلا يجوز ان يسمىّ الله به الا في موضعِ الجزاء على ما ذكره
—’মাকার’ বা ষড়যন্ত্রকারি শব্দটা সৃষ্টির মধ্যে পাওয়া যায় এমন নিন্দনীয় কার্যকলাপের সাথে সম্পৃক্ত!একে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা নাজায়েয,কেবল ঐসব ক্ষেত্রেই একে উল্লেখ করতে হবে যেখানে উনি উল্লেখ করেছেন (যেমন এ আয়াতের তিলাওয়াতকালে)!
[সূরা আলে ইমরানের তফসির]
ধোঁকাবাজ/প্রতারক সম্পর্কে অনেক কড়া কথা বলা হয়েছে।যেমন একটা মশহুর হাদিস হল
مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
— যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
(মুসলিম শরিফ,কিতাবুল ঈমান)
সেখানে,’আপনি যদি ধোকা দেন,আল্লাহও আপনাকে ধোকা দিবে’— টাইপের স্টেটমেন্ট দ্বারা আল্লাহর জন্য ধোঁকা কে ‘মুমকিন’/’সম্ভব’ হবার Concept দাঁড় করানো যায় যা সম্পূর্ণ ভাবে অসম্ভব এবং কোরআন বিরোধী।