মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম পরিচালক: গাউসুল আজম রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম। অমূল্য পসরা নিয়ে জ্ঞানের বহর এক ঘাট ছেড়ে চলে আরেক শহর প্রহর কেটেছে কতো কোথা পোতাশ্রয় ! সম্মুখে দ্বিগন্ত ছোঁয়া কেবলি নহর। বিশ্ব বরণ্য লেখক ও দার্শনিক আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর জন্ম এমনই এক ক্রান্তিকালে, যখন দুর্দান্ত প্রতাপশালী বৃটিশরা ভারত উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল এবং দীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান সাম্রাজ্যকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছিল। বৃটিশরা ধর্মীয় অঙ্গনে বিভ্রান্তি ছড়াবার জন্য কিছু ভারতীয় নামধারি আলেমকে ভাড়া করে তাদের দিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করিয়ে কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যা দিচ্ছিল এবং মুসলমানদের ঈমান আক্বীদা কলুষিত করছিল। বিশেষ করে প্রিয়নবী রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মান-মর্যাদা খাটো করে এই সব ভাড়াটে মৌলভীরা যখন ফতোয়াবাজি করছিল, ঠিক সেই মুহুর্তে শাহ আহমদ রেজা খাঁন (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে কলমী যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং মুসলমানরূপী শত্রুকে সমূলে উৎখাত করেন। ১২৭২ হিজরীর ১০ শাওয়াল মোতাবেক ১০ জুন ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরলভী শহরে সওদাগরা নামক মহল্লায় স্বনামধন্য খান পরিবারে ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জন্ম সাল সুরা মুজাদিলার ২২ নং আয়াতে করিমা থেকে বের করেছেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ কাবুলের কান্দাহার প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। হযরত মাওলানা সাঈদ উল্লাহ্ খান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন কান্দাহারের এক যুগশ্রেষ্ঠ আলিম ও বুযুর্গ ব্যক্তি। তিনি তথাকার এক সভ্রান্ত পাঠান গোত্রের বংশধর। মোঘল আমলে তিনি সুলতান মুহাম্মদ শাহ্ এবং নাসির শাহ্ এর সঙ্গে লাহোর আগমন করেন। সেখানে তিনি পরপর কয়েকটি সরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। লাহোরের শীষমহল তাঁরই জায়গীর ছিল। পরবর্তীতে তিনি লাহোর হতে দিল্লিতে চলে এলে সেখানেও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছেলে সা‘আদত ইয়ার খান মোঘল সম্রাজ্যের এক দিগি¦জয়ী সেনাপতি ছিলেন। তাঁরই এক ছেলে আযম খান ভারতের উত্তর প্রদেশ বেরেলিতে চলে আসেন। কিছুদিন সরকারি দায়িত্ব পালনের পর তিনি দুনিয়া বিমুখ হয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়ে পড়েন এবং বেরেলিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিন্ধান্ত নেন। তাঁর পুত্র হাফেয কাযেম আলী খান ছিলেন একজন বিশিষ্ট জমিদার। আটটি পরগণার জায়গীর তাঁরই হাতে ছিল। তাঁরই পুত্র রেযা আলী খান যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। যিনি জেনারেল বখত খানের সাথে ১২৫০ হিজরিতে (১৮৩৪ খ্রী.) ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। জেনারেল হার্টসন মাওলানা রেযা আলী খানের শিরোচ্ছেদের বিনিময়ে তৎকালীন পাঁচশ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেন। এ বুযুর্গ মুজাহিদ রেযা আলী খানের পুত্র হলেন আল্লামা নক্বী আলী খান। যিনি সে যুগের একজন স্বনামধন্য পন্ডিত, দার্শনিক, ফক্বীহ ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আর ইমাম আহমদ রেযা খান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন তাঁরই সন্তান। এভাবে তার পূর্ব পুরুষদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব যুগে জ্ঞান ও আমলের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)’র জন্মের পর তাঁর নাম ‘মুহাম্মদ’রাখা হয়। কিন্তু তাঁর সম্মানিত পিতামহ মাওলানা রেযা আলী খান ‘আহমদ রেযা’ নামে তাঁর নাম নির্বাচিত করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই স্বীয় নামের পূর্বে ‘আবদুল মুস্তাফা’ সংযোজন করলেন। তিনি ৪ বছর বয়সে মাত্র ৩০ দিনে পবিত্র কুরআন দেখে পঠন সমাপ্ত করেন। মকতবে প্রথম পাঠের দিনের ঘটনা থেকেই তাঁর এ অসাধারণ মেধাশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। ঘটনাটা হল-মক্তবে শিক্ষক তাঁকে আরবি বর্ণমালা পাঠদান করছিলেন। তিনিও শিক্ষকের মুখে মুখে আলিফ, বা, তা, সা, পড়ছিলেন; কিন্তু যুক্তাক্ষর ‘লাম-আলিফ’ পর্যন্ত এসে থেমে যান। শিক্ষক বললেন, পড়ছোনা কেন? ছোট্ট শিশÍ আহমদ রেযা উত্তরে বললেন, হুজূর! ইতিপূর্বে ‘আলিফ’ও পড়েছি ‘লাম’ও পড়েছি আবার পড়বো কেন? পাশে উপস্থিত পিতামহ তাঁকে শিক্ষকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেয়ে তিনি বিচলিত হলেন। পিতামহেরও বুঝতে দেরি হয়নি যে, তাঁর মনে যুক্তাক্ষরের রহস্য জানতে ভারী কৌতুহল জেগেছে। মাত্র তিন/চার বছরের শিশÍর মুখে এ অস্বাভাবিক ধরনের প্রশ্ন! ওস্তাদজি সেদিনই ধারণা করতে পেরেছিলেন যে, এ শিশুটি একদিন দেশ বরণ্যে আলেম হবে। শিক্ষক বললেন, প্রিয় বৎস! তোমার প্রশ্ন যথার্থ। তুমি প্রথমে যে আলিফ পড়েছিলে প্রকৃতপক্ষে তা ছিল ‘হামযা’। আর এটাই হল প্রকৃত ‘আলিফ’। ‘আলিফ’ যেহেতু সর্বদা সাকিন থাকে এবং তা দ্বারা কোন পদ বা শব্দ আরম্ভ করা যায়না, সেহেতু এখানে ‘লামে’র সাথে ‘আলিফ’কে সংযুক্ত করে উচ্চারণ দেখানো হয়েছে। তখন আ‘লা হযরত শিক্ষক মহোদয়কে আবার প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আলিফ’কে উচ্চারণ করার জন্য যদি অন্য অক্ষরের সাহায্য নিতে হয়, তবে এ‘লাম’ অক্ষরটির বৈশিষ্ট্যই বা কি? এ প্রশ্ন শুনে শিক্ষক তাকে স্নেহভরে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং প্রশ্নের জবাবে বললেন-বৎস! ‘লাম’ এবং ‘আলিফ’র মধ্যে বাহ্যিক সাদৃশ্য তো রয়েছে। তদুপরি উচ্চারণগত সর্ম্পক হলো ‘লাম’ শব্দের মধ্যবর্তী অক্ষর হল ‘আলিফ’ আর আলিফ উচ্চারণে মধ্যবর্তী অক্ষর পড়ে ‘লাম’। তাই ‘আলিফ এবং ‘লাম’এর মধ্যে এ নিবিড় সর্ম্পকের কারণে ‘লাম’ এর সাথে ‘আলিফ’কে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ অসাধারণ মেধা ও বিস্ময়কর স্মরণশক্তির কারণে অতি অল্প বয়সে অর্থাৎ মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শেষ বর্ষের সনদ অর্জন করেন। তিনি ১২৯৪ হিজরীতে আল্লামা আলে রাসুল মারহারাভী এর হাতে কাদেরীয়া ত্বরিকায় বায়াতে রাসুল গ্রহণ করেন এবং স্বল্প সময়ে আধ্যাত্মিক জগতের সুউচ্চ মাকামে আশিন হন। সেই সাথে ১৪ বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করতে আরম্ভ করেন। ১৩৩০ হিজরীতে কুরআনুল করিমের উর্দু অনুবাদ কানযুল ঈমান ফি তরজমা-ই কুরআন প্রকাশ করেন। ১৩১৮ হিজরীতে উলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে শতাব্দীর মুজাদ্দিদ উপাধিতে ভুষিত হন। আলা হযরত (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ৬৮ বছরের জিন্দেগীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ৫৫টি শাখা প্রশাখার উপর প্রায় দেড় হাজার কিতাব রচনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর আদর্শে উজ্জীবিত করেছিলেন। নবী প্রেমে বিভোর ইমাম আলা হযরত সত্য, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কারো সাথে কখনো আপোষ করেননি। তাই বাতিল পন্থীরা তাকে বিভিন্ন অপবাদ দিযে দূর্বল করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর অসাধারণ মেধা ও রাসূল প্রেমের মাধ্যমে ভ্রান্ত মতবাদীদের সকল যুক্তি-তর্ক লিখনীর মাধ্যমে খন্ডন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুন্নীয়তের প্রকৃত দর্শন বাস্তবায়নে ইমাম আলা হযরতের ক্ষুরধার লিখনী বিশ্ববাসীকে আলোকিত করেছে। অবশেষে এই মহৎ প্রাণ ক্ষণজন্ম পুরুষ এই ধুলায় ধরনীতে ৬টি বসন্ত অতিক্রম করে ১৩৩৪ হিজরী সনের ২৫ সফর শুক্রবার বাদ জুমা ২টা ৩৮ মিনিটে চিরস্থায়ী জগতে পাড়ি জমান। কবির ভাষায়- তেরশ চল্লিশ হিজরী পঁচিশ সফর – কাটে না কিছুতে আর দু:খের প্রহর শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আলা হযরত – শেষ করে গেলেন চলে জীবন সফর। ইমাম আহমদ রেজা খানঁ ফাজেলে বেরেলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কখনোই বৃটিশের দালাল ও পেট পূজারী ছিলেন না । এ ব্যাপারে ইতিহাসে যথেষ্ট প্রমাণাদি বিদ্যামান। যেমন: ক) মুহাম্মদ আলী বলেন-“ বৃটিশরা কখনোই ইমাম আহমদ রেযা খাঁনকে দাওয়াত করেননি। যেমনিভাবে তারা দাওয়াত করেছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ বেরেলভীকে”। খ) হোসাইন আহমদ মাদানী বলেন- “বৃটিশরা কখনোই ইমাম আহমদ রেযা খাঁনকে সাহায্য করেননি। যেমনিভাবে তারা সাহায্য করেছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ বেরেলভীকে”। গ) মুহাম্মদ ইকরাম ও সোলায়মান নদভী বলেন- “নদওয়াতুল ওলামার মতো ইমাম আহমদ রেযা খান কোন বৃটিশ কর্তা ব্যক্তি দ্বারা তাঁর মাদরাসা দারুল উলুম মানযারে ইসলামের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করান নি”। ঘ) ইমাম আহমদ রেযা খানের জনৈক সমসামিয়ক ব্যক্তিত্ব এবং ঘটনা প্রবাহের একজন প্রত্যক্ষ দর্শী সৈয়দ আলতাফ আলী বেরেলভী, যিনি পাকিস্তান এভুকশনাল কনফারেন্স করাচী এর সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন; তিনি বলেন- “রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খান বাস্তবিকই একজন স্বাধীনতা প্রেমিক ছিলেন। তাঁর হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে তিনি বৃটিশ ও তাদের শাসনকে ঘৃণা করতেন। তিনি কিংবা তাঁর দুই পুত্র মাওলানা হামদ রেযা খাঁন ও মোস্তফা রেযা খাঁন কখনোই শামসুল উলামা (উলামাদের সুর্য) জাতীয় খেতাব অর্জনের চিন্তাও করেননি। ভারতের শাসকবর্গ, সরকারী কর্মকর্তা কিংবা প্রাদেশিক কর্মকর্তার সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক ছিলনা”। ঙ) বৃটিশ সরকার ছাড়াও ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বৃটিশ রাজা বাদশাহদের প্রছন্দ করতেন না। সৈয়দ আলতাফ আলী বেরেলভী এ সম্পর্কে লিখেন-“সৈয়দ আলহাজ্ব আইয়ুব আলী রেযভীর ভাষ্যানুযায়ী ইমাম আহমদ রেযা খাঁন এমনভাবে চিঠির খামে ডাক টিকেট সংযুক্ত করতেন যার দরুণ রাণী ভিক্টোরিয়া, এডওয়ার্ড-৮ এবং জর্জ-৫ এর মাথা নিচের দিকে থাকতো”। একদিকে তিনি বৃটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হেফাজত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান, অন্যদিকে তথাকথিত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ষড়যন্ত্রকেও ছিন্ন করেন। সর্বপ্রথম তিনিই মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভুমি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র রচনা করেন। যা পরবর্তীতে দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে। আ’লা হযরতের জ্ঞানের গভীরতা দেখে শত্রু মিত্র প্রত্যেকই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাসউদ আহমদ “ইমাম আহমদ রেযা” শীর্ষক গ্রন্থে এবং ইয়াছিন আখতার মিছবাহী ‘দেবুস্থানে রেযা’ গ্রন্থে যে সকল মনীষী আ’লা হযরতের জ্ঞান-গরিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেছেন, তা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। যেমন- ১.বিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেন- হিন্দুস্তানে শেষ যুগে আলা হযরতের মত দক্ষ, মেধাবী ফক্বীহ জন্ম গ্রহন করেন নি। জ্ঞানের দিক দিয়ে তিনি এ যুগের ইমাম আবু হানিফা। ইমাম আহমদ রেজা খাঁন কীরূপ উচ্চ পর্যায়ের ইজতেহাদী যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন এবং যুগশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ পন্ডিত ছিলেন, তার ফতোয়া সমুহ অধ্যায়ন করলে তৎসম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায়। ২. আল্লামা হেদায়াতুল্লাহ সিন্দী মোহাজির মাদানী বলেন-ু তিনি (আ’লা হযরত) একজন প্রতিভাধর, নেতৃত্ব দানকারী আলেম, তাঁর সময়কার প্রখ্যাত আইনবিদ এবং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর দৃঢ় হেফাজতকারী, বর্তমান শতাব্দীর পুণরুজ্জীবন দানকারী, যিনি “দ্বীনে ইসলাম” এর জন্য সর্বশক্তি দ্বারা আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যাতে শরীয়তের হেফাজত করা যায়। তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণকারীদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের প্রতি তিনি তোয়াক্কা করেননি। তিনি দুনিয়াবী জীবনের মোহ সমূহের পিছু ধাওয়া করেননি বরং রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসাসুচক বাক্য রচনা করতেই বেশি পছন্দ করেছিলেন। হুজুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেমের ভাবোন্নাত্বতায় তিনি সর্বদা মশগুল ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। সাহিত্যিক সৌন্দর্যমন্ডিত ও প্রেম ভক্তিতে ভরপুর তাঁর “নাতিয়া পদ্যের” মূল্য যাচাই করা একেবারেই অসম্ভব। দুনিয়া এবং আখেরাতে তাঁর প্রাপ্ত-পুরষ্কারও ধারণার অতীত। ৩. জিয়াউল মাশায়েখ আল্লামা মোহাম্মদ ইব্রাহীম ফারুকী মোজাদ্দেদী বলেন-“নিঃসন্দেহে মুফতী আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী ছিলেন একজন মহাপন্ডিত। মুসলমানদের আচার-আচরণের নীতিমালা ও তরীকতের স্তরগুলো সম্পর্কে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। ইসলামী চিন্তা-চেতনার ব্যাখ্যা করেন, জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি-ভঙ্গি উচ্চসিত প্রশংসার দাবীদার। পরিশেষে, একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা বিশ্বাসের মানুষের জন্য তাঁর গবেষণাকর্ম আলোকবর্তিকা হয়ে খেদমত আঞ্জাম দেবে”। ৪. আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আলাউয়ী বলেন-“একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে যে, বিদ্যা, প্রতিভা ও কাব্যগুণ কোন ব্যক্তির মাঝে একসাথে সমন্বিত হয় না। কিন্তু আহমদ রেযা খাঁন ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তাঁর কীর্তি এ রীতিকে ভুল প্রমাণিত করে। তিনি কেবল একজন স্বীকৃত জ্ঞান বিশারদই ছিলেন না বরং একজন খ্যাতমানা কবিও ছিলেন”। ৫. ইবনে সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়খ আবদুল ফাততাহ আবু গাদ্দা বলেন- “একটি ভ্রমনে আমার সাথে এক বন্ধু ছিলেন। যিনি ফতোয়ায়ে রেযভীয়া (ইমাম সাহেবের ফতোয়া) গ্রন্থখানা বহন করছিলেন। ঘটনাচক্রে আমি দু-একটি ফতোয়া পাঠ করতে সক্ষম হই। এর ভাষার প্রাচুর্য, যুক্তি এবং সুন্নাহ ও প্রাচীন উৎস থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিসমূহ দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমি একটি ফতোয়ার দিকে এক নজর চোখ বুলিয়েই নিশ্চিত যে- এই ব্যক্তিটি বিচার বিভাগীয় অন্তর্দৃষ্টি সমৃদ্ধ একজন মহাজ্ঞানী আলেম”। ৬. মওলভী আশরাফ আলী থানবী বলেন-“(ইমাম) আহমদ রেযা খাঁনের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে- যদিও তিনি আমাকে কাফের (অবিশ্বাসী) ডেকেছেন। কেননা, আমি পূর্ণ অবগত যে, এটা আর অন্য কোন কারণে নয়- বরং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিত্বের প্রতি তাঁর সুগভীর ও ব্যাপক ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত”। তিনি আমাদের কাফির বলেন ইশকে রাসূলের ভিত্তিতে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। তিনি অন্যত্র বলেন-আমার যদি সুযোগ হতো, তাহলে আমি মৌলভী আহমদ রেযা খান বেরেলভী পেছনে নামাজ পড়ে নিতাম। ৭. জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ’লা মওদুদী মন্তব্য করেন- “ মাওলানা আহমাদ রেজা খাঁন মরহুম মগফুর আমার দৃষ্টিতে একজন অসাধারণ জ্ঞানী ও দূরদর্শীতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি মুসলিম মিল্লাতের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। যদিও তাঁর সাথে আমার কতিপয় বিষয়ে বিরোধ রয়েছে তবুও আমি তাঁর প্রভূতঃ দ্বীনি খেদমতকে স্বীকার করি। ৮. ড.তাহির আল কাদেরী বলেন, “ইসলাম ধর্মের প্রতি ইমাম সাহেবের নানাবিধ খেদমতের দিকে তাকানো এক সুখকর চমক। দৃশ্যতঃ তিনি একজন সংস্কারক (মোজাদ্দেদ), ব্যাখ্যাকারী (ভাষ্যকার), এবং এর পাশাপাশি উদ্ভাবক। ধর্মীয় বিশ্বাস ও মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কর্মের মূল্যায়ন করলে তাঁকে মনে হবে একজন উদ্ভাবক ও ব্যাখ্যাকারী (ভাষ্যকার)। ফেকাহ বা শরয়ী বিধি-বিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি একজন সৃজনশীল ফকীহ। সর্বোপরি, তরীকাপন্থী হিসেবে তিনি এক মহা-সংস্কারক।” ৯. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্্েরর বার্র্কলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. বার্বারা, ডি, ম্যাটকাফ অভিমত পেশ করেন- “ইমাম আহমদ রেযা খাঁন তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির একটি ঐশীদান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ড. জিয়াউদ্দিনের একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন- অথচ এর সমাধানের জন্য ড. জিয়াউদ্দিন জার্মান সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন”। ১০. হল্যান্ডের লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. জে, এম, এস, বাজন ড. মাসউদ আহমদের নিকট লিখিত তাঁর বক্তব্যে বলেন- “ইমাম সাহেব একজন বড় মাপের আলেম। তাঁর ফতোয়াগুলো পাঠের সময় এই বিষয়টি আমাকে পুলকিত করেছে যে- তাঁর যুক্তিগুলো তাঁরই ব্যাপক গবেষণার ইুিঙ্গত বহন করছে। সর্বোপরি- তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। আপনি (ড. মাসউদ আহমদ) সম্পূর্ণ সঠিক। পাশ্চাত্যে তাঁকে আরো অধিক জানা ও মুল্যায়িত করা উচিত- যা বর্তমানে হচ্ছে”। ইমাম আহমদ রেজা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর সংস্কারমুলক সফল পদক্ষেপের ফলে ভারতের অগণিত মুরতাদ এবং হিন্দু ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ধন্য করেছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, তাঁর সংস্কারের প্রভাবে সাড়ে চার লক্ষ মুরতাদ ও দেড় লক্ষ হিন্দু কালেমা পড়ে মুসলমান হয়েছে। এ মহান সংস্কারক ও কলম স¤্রাটের জীবন কর্ম বর্তমানে গবেষণার উপজীব্য বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে গবেষণা। বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হচ্ছে তার গ্রন্থাবলী। তার প্রতিটি লেখায় গভীরতা ও মননশীলতার ছাপ সুস্পষ্ট। তার রচনাশৈলীর উপমা উৎপ্রেক্ষায় রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ছোঁয়া। কেবল ধর্মীয় বিষয়াবলী নয়, গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছিল তার প্রগাড় জ্ঞান। বিশ্বের নিম্নলিখিত বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর জীবন ও কর্মের উপর বিভিন্ন গবেষক গবেষণায় রত আছেন। যেমন- * বার্কলী ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। * কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। * লিডেন ইউনিভার্সিটি, লিডেন, হল্যান্ড। * ডারবান ইউনিভার্সিটি, ডারবান, দক্ষিণ আফ্রিকা।* পাটনা ইউনিভার্সিটি, আলীগড়, ভারত। * মুসলিম ইউনিভার্সিটি, আলীগড়, ভারত। * উসমানিয়া ইউনিভার্সিটি, হায়দারাবাদ, ভারত। * সিন্ধু ইউনিভার্সিটি, জামসোরো, পাকিস্তন। * করাচী ইউনিভার্সিটি, পাকিস্তান। * পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, লাহোর, পাকিস্তান। * বাহাউদ্দীন ইউনিভার্সিটি, মূলতান, পাকিস্তান।* ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ ইন্সটিটিউট,করাচি, পাকিস্তান। * মদীনাতুল হিকাম্ত হামদর্দ ফাউন্ডেশন, করাচি, পাকিস্তান। * ওয়ার্ল্ড ইসলামিক মিশন সেন্টার করাচি, পাকিস্তান। * আল্লামা ইকবাল ওপেন ইউনিভার্সিটি, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান। * জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি, নয়া দিল্লি, ভারত। *হামদর্দ ইউনিভার্সিটি নয়া দিল্লি, ভারত। *বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য। * নিউ কাসেল্ ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য। * ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, কলকাতা, ভারত। * আল্-আযহার ইউনিভার্সিটি, কায়রো, মিশর। * ইবনে সাউদ ইউনিভার্সিটি, রিয়াদ, সৌদ আরব। * ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, বাংলাদেশ ইত্যাদি। তথ্যসূত্র: ১- স্মরণিকা-আন্তর্জাতিক সুন্নী সম্মেলন’১১, পৃ: ৩৪। ২- আল মুখতার, আলা হযরত কনফারেন্স’০৬ স্মারক,পৃ:২২। ৩- মখযানে আহমদী, মুফীদেআম, আগ্রা কর্তৃক প্রকাশিত, পৃঃ নং- ৬৭। ৪- নখশে হায়াত, দিল্লী ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত পৃঃ নং- ১২ – ১৩ ৫- শিবলী নামা, পৃঃ নং- ২৪৫, হায়াতে শিবলী পৃঃ নং- ৪৮২ ৬- দৈনিক জংগ , দৈনিক করাচী ২৫শে জানুয়ারী ১৯৭৯,পৃষ্ঠা-৬, কলাম ৪ এবং ৫ ৭- দৈনিক জংগ, করাচী, তাং ২৫/১/১৯৭৯ইং, পৃষ্ঠা-৬,কলম-৫ ৮- ঞযব ঘবমষবপঃবফ এবহরঁং ড়ভ ঃযব ঊধংঃ, নু উৎ. গধংঁফ ধযসবফ. ৯- মাকালঅতে ইয়াওমে রেজা, কৃত: আল্লামা আব্দুন্নবী কাওছার, খন্ড-৩, পৃ: ৮। ১০- ইসলামী বিশ্বকোষ,খন্ড- ২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ১১- মা’আরিফে রেযা করাচী, ১৯৮৬ খ্রিঃ পৃষ্ঠা নং-১০২। ১২- পায়গামাতে ইয়াওমে রেযা, কৃত:: মকবুল আহমদ চিশতি, লাহোর, পৃঃ -১৮। ১৩- সাওতুশ শারক, কায়রো, ফেব্রুয়ারী ১৯৭০, পৃঃ ১৬-১৭্। ১৪- ইমাম আহমদ রেযা আরবার ইত্যাদি, পৃঃ-১৯৪। ১৫- আশরাফুস সাওয়ানিহ,খন্ড-১, পৃ: ১২৯; সাপ্তাহিক চাতান, লাহোর, ২৩শে এপ্রিল ১৯৬২। ১৬- আলা হযরত কা ফিকহী মকাম এর বরাতে, কৃত মাওলানা আখতার শাহজাহান পূরী, লাহোওে মুদ্রিত১৯৭১ই্।ং ১৭- উসওয়া-ই আকাবিরঃ পৃষ্ঠা নং-১৮। ১৮- আল মিযান, পৃঃ ১৬, সন- ১৯৭৬ মুম্বাই ; মাকালাতে ইয়াওমে রেজা, ২য় খন্ড, পৃঃ ৫৪০ । ১৯- ‘হযরত মওলানা আহমদ রেযা খান বেরেলভী কা ইলমী নাযম’, কৃত: ড. তাহির আল কাদেরী লাহোর, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৫। ২০- মা’আরিফে রেযা , করাচী, ১৯৯১ইং, পৃ:-১৮। ২১- ড. মাসউদ আহমদকে প্রেরিত পত্র, তাং-২১-১১-৮৬। ২২- তাহরীক- ই আযাদী, সাওয়াদ- ই আযম,পৃ: ১২৭-১২৮।
আলা হযরত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।