আরাফাহ দিবস : গুরুত্ব ও ফযীলত
যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাহ ময়দানে চিহ্নিত সীমানার মধ্যে অবস্থান করা হজ্জের প্রধান রুকন। এই দিনকেই আরাফার দিন বলা হয়। এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও মর্যাদাপূর্ণ। এ দিনের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে নিম্নে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হ’ল।-আরাফাহ দিবসের মর্যাদা :এ দিবসটি অনেক ফযীলত সম্পন্ন দিবসের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। যে সকল কারণে এ দিবসটির এত মর্যাদা তার কয়েকটিনিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-(১) এ দিন ইসলাম ধর্মের পূর্ণতা লাভ ও বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নে‘মতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন। হাদীছে এসেছে-عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَنَّ رَجُلاً مِنَ الْيَهُودِ قَالَ لَهُ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، آيَةٌ فِى كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا لَوْ عَلَيْنَا مَعْشَرَ الْيَهُودِ نَزَلَتْ لاَتَّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا. قَالَ أَىُّ آيَةٍ قَالَ (الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا). قَالَ عُمَرُ قَدْ عَرَفْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ وَالْمَكَانَ الَّذِى نَزَلَتْ فِيهِ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ قَائِمٌ بِعَرَفَةَ يَوْمَ جُمُعَةٍ.‘তারিক বিন শিহাব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, এক ইহুদী লোক ওমর (রাঃ)-কে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনাদের কিতাবে আপনারা এমন একটিআয়াত তেলাওয়াত করে থাকেন যদি সে আয়াতটি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হ’ত তাহ’লে আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসাবে উদযাপন করতাম। তিনি বললেন, সে আয়াত কোনটি? লোকটি বলল, আয়াতটি হ’ল-اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। ওমর (রাঃ) এ কথা শুনে বললেন, আমি অবশ্যই জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে ও কোথায় অবতীর্ণ হয়েছেএবং অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোথায় ছিলেন। সে দিনটি হ’ল জুম‘আর দিন। তিনি সে দিন আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন’।[1](২) এ দিন হ’ল ঈদের দিন সমূহের একটি দিন। আবু উমামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَوْمُ عَرَفَةَ وَيَوْمُ النَّحْرِ وَأَيَّامُ التَّشْرِيْقِ عِيْدُنَا أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَهِىَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ-‘আরাফাহ দিবস, কুরবানীর দিন ও আইয়ামে তাশরীক (কুরবানী পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন’।[2]ওমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, সূরা মায়েদার এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে দু’টো ঈদের দিনে। তা হ’ল জুম‘আর দিন ও আরাফাহর দিন।[3]আরাফাহ দিবসের ফযীলত : আরাফাহ দিবসের বিভিন্ন ফযীলত রয়েছে। যেমন-১. আরাফাহ দিবসের ছিয়াম দু’বছরের গোনাহের কাফফারা :আরাফার দিন ছিয়াম পালন করলে এক বছর পূর্বের এবং এক বছর পরের গুনাহ মাফ হয়। আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আরাফাহ দিবসের ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّى أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَهُ-‘আরাফার দিনের ছিয়াম, আমি মনে করি বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে’।[4] উল্লেখ্য যে, আরাফার দিনে ছিয়াম পালন করবেন তারাই যারা হজ্জব্রত পালন করেন না। অর্থাৎ আরাফাহ ময়দানের বাইরে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের মুসলিম এই ছিয়াম পালন করবেন।২. আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন :এ দিনে আল্লাহ স্বীয় বান্দাদেরমধ্য থেকে অধিক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দিয়ে জাহান্নাম থেকেমুক্তি দান করেন। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِى بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُوْلُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ‘আরাফার দিন আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দারা আমার কাছে কি চায়’?[5] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছটি আরাফাহ দিবসের ফযীলতের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।ইবনে আব্দুল বার্র (রহঃ) বলেন, এ দিনে মুমিন বান্দারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কেননা আল্লাহ রাববুল আলামীন গুনাহগারদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন না। তবে তওবা করার মাধ্যমে ক্ষমা-প্রাপ্তির পরই তা সম্ভব। হাদীছে এসেছে-আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا كَانَ يَوْمُ عَرَفَةَ، إِنَّ اللهَ يَنْزِلُ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيُبَاهِيْ بِهِمُ الْمَلائِكَةَ، فَيَقُوْلُ : انْظُرُوْا إِلَى عِبَادِيْ أَتَوْنِيْ شُعْثًا غُبْرًا- ‘যখন আরাফার দিন হয়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকটে গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, আমার এ সকল বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ। তারাএলোমেলো কেশ ও ধূলায় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে’।[6]৩. অধিক পরিমাণে যিকর ও দো‘আ করার উপযুক্ত সময় :নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّوْنَ مِنْ قَبْلِى لاَ إِلَهَإِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُوَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ-‘সবচেয়ে উত্তম দো‘আ হ’ল আরাফাহ দিবসের দো‘আ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন তা হ’ল-আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনিসকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান’।[7]এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্দুল বার্র (রহঃ) বলেন, এ হাদীছদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আরাফাহ দিবসের দো‘আ নিশ্চিতভাবে কবুল হবে। আর সর্বোত্তম যিকর হ’ল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[8]ইমাম খাত্ত্বাবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দো‘আ করার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও তাঁর মহত্বের ঘোষণা করা উচিত।[9] অতএব, আরাফাহ দিবসের গুরুত্ব ও ফযীলত অনুধাবনকরতঃ এ দিবসে ছিয়াম পালনে সবাইকে সচেষ্ট হ’তে হবে। তাছাড়া যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে ইবাদতের ফযীলতও অত্যধিক। সে ব্যাপারেও আমাদেরকে যত্নবান হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৪৫, ৪৬০৬।[2]. আবুদাঊদ হা/২৪১৯।[3]. ছহীহ জামি‘ তিরমিযী, হা/২৪৩৮।[4]. মুসলিম হা/১১৬৩।[5]. মুসলিম হা/১৩৪৮।[6]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/৮১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৬১; মিশকাত হা/২৬০১।[7]. তিরমিযী হা/২৮৩৭; মিশকাত হা/২৫৯৮, সনদ ছহীহ।[8]. ইবনে আব্দুল বার্র, আত-তামহীদ।[9]. ইমাম খাত্ত্বাবী, শান আদ-দো‘আ,পৃঃ ২০৬