আযানের দু’আ প্রসঙ্গ
যুগের অবস্থা এতই করুণ যে সামান্য মুস্তাহাব নিয়ে মানুষ অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্বে পড়ে আছে। একদল আছে মুস্তাহাব নিয়ে বাড়াবাড়িতে,তো অন্যদল তাদেরকে বিদআতপন্থী দাবির মিছিল নিয়ে।যাই হোক,যারা এই ব্লগ পড়ছেন,তারা আগামীতে কোনো কিছুকে বিদআত বা ভিত্তিহীন বলার আগে একবার এই তিন উসুল দ্বারা মিলিয়ে নিবেন।
➤উসুল ১:—
‘হাদীসে দ্বইফ‘ এর উপর ফাযায়েলে আমল করা যায়।
কেননা,ইমাম নববী র. বলেন,
قد اتفق العلماء على جواز العمل بالحديث الضعيف فى فضائل الاعمال:مقدمة المؤلف
-‘‘উলামায়ে কিরাম এই বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন দুর্বল হাদিস ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য।’’[ইমাম নববী : আরবাঈন : ১/২০ পৃ. এবং ইমাম ইবনে দাকিকুল ঈদ, শরহে আরবাঈনুন নববিয়্যাহ, ১/২০ পৃ.]
➤উসুল ২:—
“হাদীসে দ্বইফ” এর একাধিক সূত্রের বর্ণনা এবং বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা একে শক্তি যোগায়।দলিলের উপযোগী করে দেয়।
ইমাম আব্দুল ওয়াহহাব শা’রানী বলেন:
قد احتج جمهور المحدثين بالحديث الضعيف اذا كثرت طرقه وألحقوه بالصحيح تارة وبالحسن
—‘‘নি:সন্দেহে জমহুর মুহাদ্দিসীনগণ দুর্বল হাদিসকে অধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে দলীল হওয়ার যোগ্যতা রূপে মেনে নিয়েছেন এবং সেটিকে কোন সময় সহীহ আবার কোন সময় ‘হাসান’ এর সাথে মিলিয়েছেন।
[ইমাম আবদুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মিযানুল কোবরা, ১/৬৮ পৃ.]
উসুল ৩:—
নতুন শরীয়তসম্মত সৃষ্ট সকল কিছুই বিদআত নয়,তথা হারাম হবে না।এটা খুবই জোরালো একটা উসুল।
ইমাম আসকালানী র. বলেন—
الفعل يدل على الجواز وعدم الفعل لا يدل على المنع
— কোনো কাজ করাটা জায়েজ হবার দলিল,কিন্তু না করাটা নিষিদ্ধ হবার দলিল নয়।
[ফতহুল বারী,১০/৫৫,ইমাম আসকালানী]
এরমধ্যে ৩য় উসুল টি আমাদের আজকের পোস্টে প্রয়োজন নেই।কেননা আমরা ইনশা আল্লাহ আযানের দোয়া “শাফায়াত শব্দযোগে পড়া” —টা হাদীস দ্বারা প্রমাণ করবো।
➤➤হাদীস নং-১:
মু’জামুল আওসাতে বর্ণিত আছে,হযরত আবু দারদা রাঃ হতে দূর্বল সনদে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে তিনি আযানের দোয়ায় উল্লেখ করেন
….صل على عبدك ورسولك واجعلنا في شفاعته يوم القيامة…..
—(এখানে) ওয়াজা’আলনা ফি শাফা’আতিহী ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ [বা,এবং ক্বিয়ামতের দিন আমাদেরকে তাঁর(ﷺ) শাফায়াতের অন্তর্ভুক্ত করুন।(বাক্যের উল্লেখ আছে)
হাদীস টি বর্ণিত আছে:—
★মু’জামুল আওসাত,৪/৭৮-৭৮পৃষ্ঠা,ইমাম তাবারানি
★মাজমাউল বাহারাইন,৬৩৭নং, ইমাম হায়সামী
★কিতাবুদ দু’আ,৩য় খন্ড,ইমাম তাবারানি
★আল বুদুরুস সাফিরাহ,১১২২ নং হাদীস,ইমাম সূয়ুতি।
★শাওকানী, তুহফাতুল-যাকীরীন,১/১৫৩ পৃ.
এই হাদীসের ‘শাওয়াহেদ’ বা সাক্ষ্য হিসেবে আবু দারদা হতেই আরেকটি হাদীসকে উপস্থাপন করেন ইমাম সূয়ুতি।সেখানে উল্লেখ:
….صل على محمد وأعطه سؤله يوم القيامة…..
—বা তাঁকে(ﷺ) কিয়ামতের দিন সুপারিশ করার অধিকার দান করুন (এবং আমাদেরকে তার অন্তর্ভুক্ত করুন)।
[আল বুদুরুস সাফিরাহ,১১২১ নং হাদীস,ইমাম সূয়ুতি]
তাহলে,উসুল ১ অনুসারে ‘শাফায়াত’ শব্দ প্রয়োগ মুস্তাহাব এবং উসুল ২ অনুসারে ‘হাসান’ পর্যায়ে উন্নীত হয়।
➤➤হাদীস নং ২:
এটা হলো সেই বিখ্যাত হাদীস যা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত এবং শাফাআতের দোয়া হিসেবে দলিল নেয়ার জন্য বিখ্যাত।
….. واجعلنا في شفاعته يوم القيامة…..
—ওয়াজা’আলনা ফি শাফা’আতিহী ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ।
হাদীসটি যেসকল গ্রন্থে উল্লেখ আছে:—
★মু’জামুল কাবীর,১২/৮৫,হাদীস নং ১২৫৫৪,ইমাম তাবারানী
★কানযুল উম্মাল,২১০১৭ নং হাদীস।ইমাম আলাউদ্দিন আলী মুত্তাকি আল হিন্দি হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন,এটি ইমাম আবু শায়খ ইস্পাহানী র. এর ‘আযান’ নামক গ্রন্থে বর্ণিত আছে।
★মাজমাউয যাওয়ায়েদ,১/৩৩৩,ইমাম হায়সামী
★ইত্বহাফুল খাইরাত,১/৪৯০,আল্লামা শিহাবুদ্দীন বুসিরী
✪রাবী পর্যালোচনা:
☞ইমাম হায়সামী উল্লেখ করেন,রাবী ইসহাক বিন আবদুল্লাহ কে ইমাম হাকেম কিছুটা নরম প্রকৃতির (لين) বলেছেন।এবং বাকী বর্ণনাকারীরা সকলেই সিকাহ বা বিশ্বস্ত।
[মিযানুল ইতেদাল,ক্রম ৭৭০,ইমাম যাহাবী]
☞ইমাম আবি হাতেম ‘জরহে ওয়াত-তাদীল’ গ্রন্থে ইসহাক বিন আবদুল্লাহকে দূর্বল বলেছেন।
[কিতাবু জারহে ওয়াত তাদীল,৫/১৪৩]
☞ইমাম ইবনে হিব্বান তাকে ‘সিকাহ’ বা বিশ্বস্তদের অন্তর্গত করেছেন।
[কিতাবুস সিকাহ,৮/৩৩,ইমাম ইবনে হিব্বান এবং
লিসানুল মিযান,২/৬৩,ক্রম ১০৪১,ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী]
☞ উক্ত রাবীর হাদীস ইমাম বুখারীর ‘আদাবুল মুফরাদ’ এবং সুনানু আবি দাউদে সংকলিত হয়েছে।
[তাহযিবুল কামাল,১৫/৪৮১,ক্রম ৩৫০৮,ইমাম জামালুদ্দিন মিযযি]
✪এবং যে সকল ইমামরা এটা হতে দলিল নিয়েছেন:—
➤আল্লামা আবু শায়খ এর বরাত দিয়ে,বিখ্যাত ‘উমদাতুল ক্বারী শরহে সহীহ বোখারী” তে ইমাম বদরুদ্দীন আইনী হানাফী র. ইবনে আব্বাস এর হাদীসটি দোআর দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
[উমদাতুল ক্বারী,৫/১৮১,ইমাম আইনী(দারুল কুতুব ইলমিয়াহ,বৈরুত)]
➤’মিরক্বাতুল মাফাতিহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ” কিতাবে ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী হানাফি র. ৬৭৩নং হাদীসের ব্যাখ্যায় উক্ত হাদীস কে আযানের দোয়ার দলিল উল্লেখ করেছেন।
[মিরক্বাত, ২/৩৪৪,মোল্লা আলী ক্বারী(দারুল কুতুব)]
➤হানাফি মাযহাবের অন্যতম কর্ণধার ইমাম কামালুদ্দীন ইবনে হুমাম র. উনার বিশ্বনন্দিত ‘ফতহুল ক্বদীর শরহে হিদায়া’র ১ম খন্ডের ২৫০ নং পৃষ্ঠায় এই হাদীসকে আযানের দোয়ার দলিল হিসেবে নিয়েছেন।[মাক্তাবায়ে শামেলা ওয়েবসাইট]
➤ইমাম ইবনে হাজার মক্কী শাফেয়ী র. ”ফতোয়ায়ে ফিকহিয়াতিল কুবরা’’ গ্রন্থে ১/১৩১।[মাক্তাবায়ে শামেলা ওয়েবসাইট]
জেনে রাখা দরকার, ‘নরম প্রকৃতি’ বা لين দ্বারা ‘হাসান’ পর্যায়ের রাবীদেরকে বুঝানো হয়ে থাকে।
[ফতহুল মুগীস,১/১৯৯,ইমাম সাখাভী]
আর এক্ষেত্রে ইমাম যাহাবী ‘মিযানে’ কেবলমাত্র ‘নরম প্রকৃতির’ বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন।যা রাবীর দূর্বলতা বুঝায় না বরং গ্রহণযোগ্যতা বুঝায়।
সুতরাঙ এই হাদীসগুলো থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে,ঐ রাবীর শিথিলতা হাদীসকে দূর্বল করে না বরঙ ‘শাওয়াহেদ’ বা সাক্ষ্যের প্রভাবে বড় বড় ইমামগণের কাছেও দলিলের যোগ্যতা প্রমাণ করে।অতএব,এটা নিঃসন্দেহে জায়েয।
এমনকি ‘ফতোয়ায়ে ফিকহিয়াতিল কুবরা’ এর এক স্থানে ‘শাফায়াত’ এর শব্দযোগ করে দোয়ার প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে হাজার হায়তামী মক্কি কয়েকটা হাদীস এনে প্রমাণ করে দিয়েছেন।যেমন:
(١)…….صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِك وَرَسُولِك، وَأَعْطِهِ الْوَسِيلَةَ وَالشَّفَاعَةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؛ حَلَّتْ لَهُ شَفَاعَتِي
—(হে আল্লাহ!আপনি) নবী ﷺ এর উপর অগণিত সালাত বর্ষণ করুন!তাকে ক্বিয়ামতের দিনে ওসীলা এবং শাফাআতের মর্যাদা দান করুন।নবীজী বলেন,এভাবে যে বলবে তারজন্য আমি শাফায়াত করবো।
আবার ইবনে আসেম এর বরাতে বর্ণনা করেন—
وَخَبَرُ ابْنِ أَبِي عَاصِمٍ «…… صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَآتِهِ سُؤْلَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ”»
—ঐ
তাছাড়া,অনেকে বলে থাকেন ‘ওয়াজাআলনা’ শব্দ হাদীসে এলেও ‘ওয়ারযুক্না’ নেই,তাই বিদআত।তাদের উদ্দেশ্যে,وَارْزُقْنَا আর وَاجْعَلْنَا হল সমার্থক শব্দ وَارْزُقْنَا শব্দের অর্থ হল নসীব করুন আর وَاجْعَلْنَا শব্দের অর্থ হল বানিয়ে দিন।আলফাজ বা শব্দের ব্যবধানে মূল অর্থ অক্ষত রেখে হাদিস বর্ণনা এবং গ্রহণ করা জায়েজ।
তথাপি,এমন ফুকাহায়ে কেরামগণ ‘ওয়ারযুকনা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন যাদের ইজতিহাদ উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য দলিলস্বরূপ।যেমনঃ
হানাফি মাযহাবের বড় মকামের ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম আল হালবী আল হানাফি এর মশহুর ফতোয়ার কিতাব “ছগীরীর” ১৯৮ পৃষ্ঠায় আযান অধ্যায়ে উল্লেখ আছে—
اللهم رب هذه الدعوة التامة و الصلوة القائمة ات سيدنا محمدن الوسيلة والفضيلة والدرجة الرفيعة و ابعثه مقاما محمودن الذى وعدته و ارزقنا شفاعته يوم القيامة انك لا تخلف الميعاد
— আল্লাহুম্মা রব্বাহাযিহিদ দা’ওয়াতিত তাম্মাহ।ওয়াসসালাতিল ক্ব-ইমাহ।আ-তি সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদানিল ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদ্বিলাতা ওয়াদ দারাজাতার রফীয়া’।ওয়াবাআছহু মাক্বোমাম মাহমুদানিল্লাযি ওয়াদতাহ।ওয়ারযুক্না শাফাআতাহু ‘য়াওমাল ক্বিয়ামাহ।ইন্নাকা লা তুখলিফুল মি’আদ।