আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর গুণাবলী

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর গুণাবলী

মূল: সা’আদ ইবনে দায়দা’ন আস্-সুবাঈ

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Sa’ad ibn Dhaydaan al-Subayi’s online book “In Defense of Mu’awiyah (Ra:).” Translator: Kazi Saifuddin Hossain]

বঙ্গানুবাদকের আরজ

الحمد لله الذي بالهدى أرسل رسوله والصلاة والسلام على نبيه الذي أوضح سبله وعلى آله وأصحابه الذين أعد لهم نزله وعلى أوليائه الذين جاهدوا في سبيله فأصابوا فضله. أما بعد.

সূচিপত্র

ভূমিকা – আবদুল্লাহ ইবনে আবদ আল-রহমান আল-সা’আদ

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর গুণাবলী:

১/ তাঁর ধার্মিকতা (ইসলামী জিন্দেগী)

২/ তাঁর সাহাবী হওয়া

৩/ প্রিয়নবী (দ:)-এর কাতেব/ওহী লেখক

৪/ সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)-বৃন্দের দ্বারা তাঁর প্রশংসা 

হযরত আলী (ক:) ও জ্যেষ্ঠ সাহাবামণ্ডলীর (রা:) প্রশংসা

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর প্রতি সর্ব-ইমাম হাসান (রা:), হুসাইন (রা:), তাঁদের পরিবার-পরিজন ও বাকি সাহাবাবৃন্দের (রা:) আনুগত্যের শপথ:

হযরত মু’আবিয়া (রা:) হতে আহলে বায়ত (রা:) কর্তৃক রওয়ায়াত/বর্ণনাসমূহ গ্রহণ

তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা 

“বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে” মর্মে সহীহ হাদীস ও অন্যান্য লিপির সাথে এর সম্পর্কযুক্তকরণ

আবূ বাকরাহ’র বর্ণিত “বাস্তবিকই আমার এই পুত্র একজন সৈয়্যদ” হাদীসটির রেফারেন্স:

প্রথম সনদ

দ্বিতীয় সনদ

তৃতীয় সনদ

চতুর্থ সনদ

পঞ্চম সনদ

ষষ্ঠ সনদ

সপ্তম সনদ

অষ্টম সনদ

নবম সনদ

হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণনা

হযরত উম্মে সালামাহ হতে বর্ণনা

মুরসাল বর্ণনা

এই হাদীসটির বিশ্লেষণ

ইমাম হাসান (রা:)-এর আবূ বাকরাহ (রা:) হতে এটা শোনার প্রমাণ:

প্রথম বর্ণনা

দ্বিতীয় বর্ণনা

তৃতীয় বর্ণনা

চতুর্থ বর্ণনা

এই হাদীস সহীহ হওয়ার পক্ষে মন্তব্য

সমর্থনসূচক বর্ণনাগুলো

এই হাদীসকে সুনির্দিষ্টভাবে সমর্থন করে এমন বর্ণনাসমূহ:

হযরত জাবের (রা:)-এর বর্ণনা

হযরত আনাস (রা:)-এর বর্ণনা

এই রওয়ায়াতকে সহীহ বলেছেন যে উলামাবৃন্দ

লেখকের মুখবন্ধ

প্রথম অধ্যায়

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর সমালোচনায় উদ্ধৃত আহাদীসের বিশ্লেষণ

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর সমালোচনায় উদ্ধৃত অনির্ভরযোগ্য ও বানোয়াট বর্ণনাসমূহ

প্রথম বর্ণনা: মু’আবিয়াকে আমার মিম্বরে দেখলে তাকে হত্যা কোরো!

প্রথম সনদ

দ্বিতীয় সনদ

তৃতীয় সনদ

চতুর্থ সনদ

পঞ্চম সনদ

ষষ্ঠ সনদ

সপ্তম সনদ

দ্বিতীয় বর্ণনা: আল্লাহতা’লা সওয়ারীকে ও নেতাকে এবং চালককে অভিসম্পাত দিন।

হযরত সাফীনাহ’র বর্ণনা

ইমাম হাসান (রা:)-এর বর্ণনা

হযরত বারা’আ ইবনে ’আযিব (রা:)-এর বর্ণনা

হযরত ’আসিম আল-লায়সী’র বর্ণনা

হযরত ইবনে ‘উমর (রা:)-এর বর্ণনা

হযরত মুহা’জির ইবনে ক্বুনফুয (রা:)-এর বর্ণনা

তৃতীয় বর্ণনা: এই গিরিপথ দিয়ে তোমাদের কাছে আসবে এক লোক, যে আমার ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে।

আরেকটি সনদ দ্বারা এই বর্ণনার সমর্থন

চতুর্থ বর্ণনা: আমার সুন্নাতকে প্রথম পরিবর্তন করবে বনূ উমাইয়াহ গোত্রভুক্ত এক লোক

এই বর্ণনার দুটি ত্রুটি

পঞ্চম বর্ণনা: অবাধ্য, অন্যায়কারী ও ধর্মত্যাগীদের হত্যা করতে আমাকে আদেশ করা হয়েছে।

প্রথম সনদ

দ্বিতীয় সনদ

তৃতীয় সনদ

চতুর্থ সনদ

পঞ্চম সনদ

ষষ্ঠ সনদ

সপ্তম সনদ

অষ্টম সনদ

নবম সনদ

দশম সনদ

একাদশতম সনদ

দ্বাদশতম সনদ

ত্রয়োদশতম সনদ

চতুর্দশতম সনদ

পঞ্চদশতম সনদ

ষষ্ঠদশতম সনদ

ষষ্ঠ বর্ণনা: নিশ্চয় আম্মারের হত্যাকারী ও আক্রমণকারী জাহান্নামের আগুনে।

প্রথমতঃ এই বর্ণনাটি সঠিকভাবে সাবেত/প্রমাণিত নয়

দ্বিতীয়তঃ এটা আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-কে দোষী সাব্যস্ত করে না

যেসব আহাদীস সহীহ, কিন্তু আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-কে উদ্দেশ্য করে না

প্রথম বর্ণনা: আমার উম্মতের ধ্বংস ক্বুরাইশ বংশীয় তরুণদের হাতে হবে।

দ্বিতীয় বর্ণনা: হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর বাণী, “আমি বাচ্চাদের সাথে খেলছিলাম যখন রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদেরকে অতিক্রম করেন…”

তৃতীয় বর্ণনা: খেলাফত টিকবে ত্রিশ বছর, অতঃপর নিষ্ঠুর রাজতন্ত্র তদস্থলে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

চতুর্থ বর্ণনা: ওয়াইহ ‘আম্মারকে বিদ্রোহীদল হত্যা করবে, সে তাদেরকে বেহেশতের দিকে ডাকবে, আর তারা তাকে ডাকবে জাহান্নামের দিকে। 

পঞ্চম বর্ণনা: আমার পরে তোমাদের বিষয়াদির দায়িত্বভার নেবে এমন লোকেরা, যারা এমন বিষয়ের প্রচলন করবে যা তোমরা অপছন্দ করো….

এই বর্ণনার প্রথম ত্রুটি

দ্বিতীয় ত্রুটি

তৃতীয় ত্রুটি

ষষ্ঠ বর্ণনা: আমার সাথে উম্মী নবী (দ:)-এর এমর্মে অঙ্গীকার হয়েছে যে, একজন ঈমানদার ছাড়া কেউই আমাকে ভালোবাসবে না এবং একজন মোনাফেক্ব (কপট) ছাড়া কেউই আমাকে ঘৃণা করবে না।

দ্বিতীয় অধ্যায় 

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর উন্নত বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত করে এমন দুর্বল ঘোষিত রওয়ায়াতগুলোর বিশ্লেষণ

প্রথম বর্ণনা: হে আল্লাহ, তাকে পথপ্রদর্শক, সঠিক নির্দেশনাপ্রাপ্ত বানিয়ে দিন এবং তারই মাধ্যমে (অন্যদের) পথপ্রদর্শন করুন।

দোষারোপকৃত প্রথম ত্রুটি

দোষারোপকৃত দ্বিতীয় ত্রুটি

দোষারোপকৃত তৃতীয় ত্রুটি

দোষারোপকৃত চতুর্থ ত্রুটি

দোষারোপকৃত পঞ্চম ত্রুটি

দোষারোপকৃত ষষ্ঠ ত্রুটি

দোষারোপকৃত সপ্তম ত্রুটি

দোষারোপকৃত অষ্টম ত্রুটি

দোষারোপকৃত নবম ত্রুটি

দ্বিতীয় বর্ণনা: নৌ অভিযান সম্পর্কে উম্মে হারাম (রা:)-এর বর্ণনা

দোষারোপকৃত প্রথম ত্রুটি

দোষারোপকৃত দ্বিতীয় ত্রুটি

বেদআতী লোকদের থেকে বর্ণনা নেয়ার ব্যাপারে উলামামণ্ডলীর দৃষ্টিভঙ্গি

প্রথম অভিমত

দ্বিতীয় অভিমত

তৃতীয় অভিমত

দোষারোপকৃত তৃতীয় ত্রুটি

তৃতীয় বর্ণনা: নিশ্চয় আমার এই পুত্রটি একজন সাইয়্যেদ

দোষারোপকৃত প্রথম ত্রুটি

দোষারোপকৃত দ্বিতীয় ত্রুটি

দোষারোপকৃত তৃতীয় ত্রুটি

দোষারোপকৃত চতুর্থ ত্রুটি

তৃতীয় অধ্যায়

আমীরে মু’আবিয়া (রা:) সম্পর্কে বানোয়াট কাহিনীগুলোর বিশ্লেষণ

প্রথম অভিয়োগ: তিনি মদের ব্যবসা করতেন

দ্বিতীয় অভিযোগ: তিনি সুদের কারবার করতেন

তৃতীয় অভিযোগ: তিনি ভারতবাসীদের কাছে মূর্তি বিক্রি করতেন

চতুর্থ অভিযোগ: তিনি মিথ্যে শপথ করতেন এবং মহানবী (দ:) তাঁর মিথ্যে প্রকাশ করে দেন

পঞ্চম অভিযোগ: তিনি সিফফীনের যুদ্ধে ২০ জন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবা (রা:)-কে হত্যা করেন

ষষ্ঠ অভিয়োগ: তিনি ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা:)-কে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন

সপ্তম অভিযোগ: তিনি আবদুর রহমান ইবনে খালেদ বিন ওয়ালীদকে হত্যা করেন

অষ্টম অভিযোগ: তিনি হুজর ইবনে ‘আদীকে হত্যা করেন

নবম অভিযোগ: তিনি আশতার মালেক ইবনে হারিস আল-নাখাঈকে হত্যা করেন

দশম অভিযোগ: ইমামে আলী (ক:)-এর প্রতি লা’নত দানের প্রথা চালু করেন

একাদশতম অভিযোগ: তাঁর প্রতি আবূ বাকরাহ, হাসান বসরী ও আসওয়াদ ইবনে এয়াযীদের সমালোচনা

চতুর্থ অধ্যায়

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর গুণাবলী/ উন্নত বৈশিষ্ট্য

সাধারণ বর্ণনালিপি

সুনির্দিষ্ট বর্ণনালিপি

মহানবী (দ:)-এর কাতেব/ওহী-লেখক হওয়াটা তাঁর গুণগুলোর একটি

ঈমানদারদের মামা হওয়াটা তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য

রাজকীয়তায় শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর একটি গুণ

প্রাথমিক (যুগের) মুসলমানদের কৃত তাঁর প্রতি প্রশংসা 

যারা তাঁকে গালমন্দ করে, তাদের ব্যাপারে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের বক্তব্য-বিবৃতি

পঞ্চম অধ্যায়

সাহাবা কেরাম (রা:)-এর মাঝে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে নিরবতা পালনের ব্যাপারে সুন্নী উলামাবৃন্দের ঐকমত্য

ভূমিকা – শায়খ ও মুহাদ্দীস আবদুল্লাহ ইবনে আবদ আল-রহমান আল-সা’আদ

সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি; তাঁরই (ঐশী) সাহায্য কামনা ও তাঁর কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করি; আর আমরা আমাদের অন্তরের বক্রতা ও কর্মের মন্দ ফলাফল হতে আল্লাহরই মাঝে আশ্রয় নেই। তিনি যাঁকে সৎ পথপ্রদর্শন করেছেন, তাঁকে কেউই পথহারা করতে পারে না; আর তিনি যাকে গোমরাহ/বিচ্যুত করেছেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক থাকে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ/উপাস্য নেই এবং তাঁর কোনো শরীক-ও নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁরই হাবীব ও (প্রেরিত) রাসূল।

অতঃপর এখানে যা বিবৃত হবে, তার ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, নিশ্চয় আল্লাহতা’লা আমাদের ধর্মকে পূর্ণতা দিয়েছেন এবং আমাদের প্রতি তাঁর নেআমত পরিপূর্ণ করেছেন, যেমনটি তিনি এরশাদ করেন:

 ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً 

অর্থ: “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম; আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে মনোনীত করলাম” [সূরা মা-ইদাহ্, ৩ নং আয়াত, তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]। অতএব, আমাদের ধর্মীয় ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, সব কিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আল্লাহর এই কেতাব ও রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাতের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আল্লাহতা’লা আরো ফরমান:

 وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ ٱلْكِتَابَ تِبْيَاناً لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ 

 অর্থ: “(হে হাবীব), আমি আপনার প্রতি এ ক্বুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বিবরণ, হিদায়াত, দয়া ও সুসংবাদ মুসলমানদের জন্যে” [সূরা নাহল, ৮৯ আয়াত, প্রাগুক্ত তাফসীর বাংলা সংস্করণ]। 

 ইমাম আল-বুখারী (রহ:)’র কাতেব/লিপিকার মুহাম্মদ ইবনে আবী হাতেম বলেন: আমি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারী (রহ:)’কে বলতে শুনেছি, “আমি এমন কোনো বিষয় সম্পর্কে জানি না, যা আল্লাহর কিতাবে ও রাসূল (দ:)-এর সুন্নাতে নেই।” এমতাবস্থায় আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এগুলোর সমস্তটুকু জানাটা কি সম্ভব? তিনি উত্তর দেন, “হ্যাঁ।” [সিয়্যার আল-আলম আল-নুবালা’ ১২:৪১২; এবং ইমাম বুখারী (রহ:)-এর লিপিকার মুহাম্মদ ইবনে আবী হাতেম রচিত ‘শামায়েল আল-বুখারী’, যেটাকে ইমাম যাহাবী একটি বড় সংকলন বলে অভিহিত করেন। ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) নিজ ‘তাগলিক্ব আল-তা’লিক্ব’ পুস্তকে (৫:৩৮৬) এই নির্দিষ্ট বইয়ের বিবরণের সনদ উদ্ধৃত করেন]। 

আল-শাতিবী প্রণীত ‘আল-এ’তেসাম’ পুস্তকে (১:৬৪) তিনি বলেন: বাস্তবিকই শরীয়ত পূর্ণতাপ্রাপ্ত; এতে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের সুযোগ নেই; কেননা আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম; আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে মনোনীত করলাম” [সূরা মা-ইদাহ্, ৩ নং আয়াত, তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]। 

অধিকন্তু, হযরত এরবাদ ইবনে সারিয়াহ (রা:)-এর বর্ণনায় এসেছে: রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদেরকে এমন এক উপদেশ দেন যার দরুন আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত এবং অন্তর (ভয়ে) কম্পমান হয়, আর আমরা আরয করি, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! এই উপদেশ মনে হচ্ছে যেনো বিদায়ের, এমতাবস্থায় আপনি আমাদের জন্যে কী পরামর্শ দেন?” তিনি বলেন:

تركتكم على البيضاء؛ ليلها كنهارها. ولا يزيغ عنها بعدي إلا هالك ومن يعش منكم؛ فسيرى اختلافاً كثيراً. فعليكم ما عرفتم من سنتي وسنة الخلفاء الراشدين من بعدي

অর্থ: “আমি তোমাদেরকে স্পষ্ট (সোজা-সরল) পথের ওপর ছেড়ে দিয়েছি; এর রাত এর দিনেরই মতো (উজ্জ্বল); আমার পরে কেউ-ই এ পথ থেকে বিচ্যুত হবে না, একমাত্র ধ্বংসের ভাগ্য যার সে ছাড়া। আমার পরে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতভেদ/মতপার্থক্য দেখতে পাবে; অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ সম্পর্কে যা জানো তা-ই আঁকড়ে ধরবে এবং আমার পরে সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফা (রা:)-দের সুন্নাহকেও আঁকড়ে ধরবে…”

এটা প্রতিষ্ঠিত যে মহানবী (দ:) দ্বীনী ও দুনিয়াদারির বিষয়াদি ব্যাখ্যা না করে বেসালপ্রাপ্ত হননি; আহলে সুন্নাহ উলামাবৃন্দের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে মুবতাদী’ তথা বেদআতী ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক এর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, (তাদের মতে) শরীয়ত অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে এবং তাতে কিছু বিষয়ের পুনর্বিবেচনা করা দরকার; অথবা এতে হারানো বিষয়াদি সংযোজনের অবকাশ রয়েছে। বেদআতী যদি সব দিক দিয়ে শরীয়তকে পরিপূর্ণ ও নিখুঁত জানতো, তাহলে তার জন্যে বেদআত প্রচলনের প্রয়োজন পড়তো না, নিজের ধারণা অনুযায়ী হারানো বিষয়াদির সংযোজন বা বিয়োজনেরও প্রয়োজন পড়তো না। আর যে ব্যক্তি দাবি করে যে শরীয়তের উন্নয়ন সাধনের অবকাশ আছে, সে সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে।

অতএব, যে ব্যক্তি কোনো বিষয় বা সিদ্ধান্ত জানতে চান, তাঁর জন্যে কিতাবুল্লাহ (ক্বুরআন মজীদ) ও সুন্নাহ’র সহায়তা নেয়া বাধ্যতামূলক; এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হযরত আমীরে মু’আবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (রা:) ও তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সেসব সংশ্লিষ্ট বিষয়ও। সত্যি এটা একটা বড় ব্যাপার এবং জটিলও বটে। কিছু লোক এতে জড়িয়েছে এবং ‘নসব’ তথা হযরত আলী (ক:)-বিরোধী ভ্রান্ত মতবাদে দীক্ষা নিয়েছে; পক্ষান্তরে, অপর কিছু লোক এতে জড়িয়ে ‘তাশাইয়্যু’ ও রাফেযী (সাহাবা-বিরোধী) হয়েছে। এই দুটো সমস্যা থেকে বাঁচার পথ হলো সমস্ত কিছু সুন্নাহ’তে হাওয়ালা তথা সমর্পণ করে দেয়া; কেননা সত্য ও পরিত্রাণ যাঁরা অন্বেষণ করেন, তাঁদের জন্যে এতেই নিহিত রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও তথ্য-উপাত্ত।

আবূ মূসা ও ইসরাঈল ইমাম হাসান (রা:) হতে, তিনি আবূ বাকরাহ (রা:) হতে বর্ণনা করেন (আল-বুখারী: ২৭০৪ নং হাদীস) প্রিয়নবী (দ:)-এর কথা, যিনি বলেন:

إن ابني هذا سيد، ولعل الله أن يصلح به بين فئتين من المسلمين.

অর্থ: “আমার এই পুত্র একজন সাইয়্যেদ (সর্দার) এবং আমি আশা করি যে তার মাধ্যমেই আল্লাহতা’লা দুটি মুসলমান বাহিনীকে একতাবদ্ধ করবেন।” – এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক যে কেউ ইমাম বুখারী (রহ:)-এর উদ্ধৃত আলোচ্য হাদীসটির শরণাপন্ন হলে এটা-ই যথেষ্ট হবে। আল্লাহর মর্জিতে এ হাদীস হতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এই লেখাটিতে আলোকপাত করা হবে নিচে।

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর (উচ্চ)-মক্বাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (দ:) বিস্তারিত বলেছেন সেই সময়কাল হতে, যখন তিনি ছিলেন যুবক (ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরপর); অতঃপর পরিণত বয়সী এবং হায়াতে জিন্দেগী ত্যাগের আগে বৃদ্ধ বয়সীও; এসব বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেয়া হবে, ইনশা’আল্লাহ। 

আমি আমাদের পুত্র শায়খ সা’আদ ইবনে দায়দান আল-সুবাঈ কর্তৃক আমীরে মু’আবিয়া (রা:) সম্পর্কে ও তাঁরই পক্ষ সমর্থনে যা এখানে লেখা হয়েছে, তা মনোযোগের সাথে পাঠ করেছি। আমার বিবেচনায় সে তার লেখায় উৎকর্ষ সাধন করেছে এবং তা হতে ফায়দাও পেয়েছে। আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর উচ্চমর্যাদা প্রতীয়মানকারী দলিলাদি সে উল্লেখ করেছে, এর পাশাপাশি তাঁর (পক্ষ) সমর্থনে পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখনীরও উদ্ধৃতি দিয়েছে। অতএব, আমি দোয়া করি যেনো আল্লাহ পাক তাকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করেন এবং তাকে আশীর্বাদধন্যও করেন, আমীন।

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর গুণাবলী

এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ভিত্তিতে:

১/ তাঁর ধার্মিকতা (ইসলামী জিন্দেগী)

হযরতে আমীরে মু’আবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (রা:)-এর ইসলামী জিন্দেগী সম্পর্কে উলামাবৃন্দের মাঝে কোনো মতপার্থক্য নেই। যে বিষয়ে তাঁদের মতভেদ আছে, তা হলো তাঁর ইসলাম গ্রহণের সময়কাল-সম্পর্কিত, যেমনটি কেউ কেউ বলেছেন সেটা হুদায়বিয়াহ’র বছর (৬ষ্ঠ হিজরী), আবার কেউ কেউ বলেছেন তৎপরবর্তী বছর; কেউ কেউ আবার মক্কা বিজয়ের সময় বলে একে উল্লেখ করেছেন; ওই সময় তিনি ছিলেন ১৮ বছরের তরুণ [আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর জীবনী পাওয়া যাবে ইবনে আসাকিরের রচিত ‘তারীখ’ (ইতিহাস) পুস্তকে, যেখানে বিভিন্ন আলেমের এতদসংক্রান্ত মতামত তিনি তালিকাবদ্ধ করেছেন]। 

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান আস্ সা’আদ) বলি, এটা সমস্ত উন্নত গুণের ভিত্তিমূল; আর যেহেতু এটা সুপরিচিত/প্রসিদ্ধ, সেহেতু সকল মানুষের দ্বারা এর মানদণ্ডেই একে মাপা উচিত। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা বলেন:

إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلإِسْلاَمُ.

অর্থ: “নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র (মনোনীত) ধর্ম…”[সূরা আলে ইমরান, ১৯]। অন্যত্র এরশাদ ফরমান:

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ ٱلإِسْلاَمِ دِيناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ

অর্থ: “আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতিরেকে অন্য কোনো ধর্ম চাইবে, তা তার পক্ষ থেকে কখনো গ্রহণ করা হবে না…” [সূরা আলে ইমরান, ৮৫]। আল্লাহতা’লা আরো ফরমান:

قُلْ بِفَضْلِ ٱللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ

অর্থ: “আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া, সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়” [সূরা ইঊনুস, ৫৮]। 

যদি বলা হয় যে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর ইসলামী জিন্দেগী অসিদ্ধ এবং তিনি স্রেফ কপটতা (মোনাফেকী)-স্বরূপ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাহলে আমি এর জবাব তিনটি দিক হতে প্রদান করবো।

প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ (দ:) হতে বিভিন্ন হাদীসে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর ইসলামী জিন্দেগী সম্পর্কে বিবৃত হয়েছে। এসব হাদীস দুটি শ্রেণিভুক্ত: 

(ক) সুনির্দিষ্ট লিপি

(খ) সাধারণ লিপি

সুনির্দিষ্ট হাদীসগুলোর মধ্যে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন (হাদীস নং ১৪৮০) মালেক ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে এয়াযীদ হতে, যিনি আল-আসওয়াদ ইবনে সুফিয়ানের মৌলা তথা মুক্ত করে দেয়া গোলাম, তিনি আবূ সালামাহ ইবনে আব্দিল রাহমান হতে, তিনি ফাতেমাহ বিনতে ক্বায়স (রা:) হতে; হযরত ফাতেমা (রা:) বলেন:

আমার যখন বিয়ের বৈধ বয়স হলো, তখন আমি মহানবী (দ:)-কে জানাই যে মু’আবিয়াহ ইবনে আবী সুফিয়ান (রা:) ও আবূ জাহম (রা:) উভয়েই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তিনি বলেন:

أما أبو جهم فلا يضع عصاه عن عاتقه. وأما معاوية فصعلوك لا مال له، انكحي أسامة بن زيد

অর্থ: আবূ জাহম তার লাঠি নিজের কাঁধ থেকে নামায় না, আর মু’আবিয়াহ গরিব এবং তার তেমন সম্পদ নেই। তুমি (বরঞ্চ) উসামাহ ইবনে যায়দকে বিয়ে করো…।”

এই বর্ণনায় আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর গুণগত উৎকর্ষের উল্লেখ রয়েছে এবং যারা তাঁর বিরুদ্ধে কপটতার অভিযোগ উত্থাপন করে, তাদেরও খণ্ডন এতে রয়েছে। কেননা হযরত ফাতেমা বিনতে ক্বায়স (রা:)-এর সাথে হুযূর পাকের (দ:) আলাপের মধ্যে ফুটে ওঠেছে যে তিনি সম্পদশালী নন; কিন্তু তাঁর ইসলামী জিন্দেগী সম্পর্কে যদি কোনো সংশয় থাকতো, তাহলে সেদিকে হযরত ফাতেমাহ (রা:)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো এবং মহানবী (দ:) এ কথা লুকোতেন না। অতএব, এ বর্ণনায় হযরতে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর উচ্চসিত প্রশংসা বিদ্যমান, আর এটা ঘটেছিলো তাঁর জীবনের প্রথম দিকে, তাঁরই ইসলামী জিন্দেগীর প্রাথমিক পর্যায়ে।

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেসাল শরীফের পরে আমীরে মু’আবিয়া (রা:) সৈনিক ও যোদ্ধা হিসেবে শা’ম (বৃহত্তর সিরিয়া) অঞ্চলে গমন করেন। এটা ছিলো খলীফা আবূ বকর (রা:)-এর খেলাফত আমলে। খলীফা (রা:) তাঁকে অতিরিক্ত সেনাদলের প্রধান করে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। 

অতঃপর খলীফা উমর ফারূক্ব (রা:)-এর শাসনামলে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-কে শা’ম অঞ্চলের কিছু অংশের শাসনভার দেয়া হয়; আর এটা ঘটেছিলো তাঁরই আপন ভাই এয়াযীদ ইবনে আবী সুফিয়ানের ইন্তেক্বালের পরে, যা পরবর্তী পর্যায়ে বর্ণনা করা হবে। আমীরে মু’আবিয়া (রা:) ওই পদে কর্মরত ছিলেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না হযরত উসমান (রা:) খলীফা হন; এরপর তাঁকে পুরো শা’ম অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করা হয়। এগুলোর সবই যুবক বয়সে তাঁর উন্নত গুণাবলীর স্পষ্ট নিদর্শন। 

পরিণত বয়সে তাঁর হালত-অবস্থা প্রসঙ্গে আল-বুখারী (রহ:)-এর বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর একখানা হাদীস (নং ২৭০৪) উদ্ধৃত করা সমীচীন হবে। এটা হযরত হাসান আল-বসরী (রহ:) হতে নেয়া, যিনি বলেন তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রহ:)-কে বলতে শুনেছেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁর নাতি ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা:)-কে পাশে নিয়ে এরশাদ ফরমান:

إن ابني هذا سيد، ولعل الله أن يصلح به بين فئتين من المسلمين

“আমার এই পুত্র একজন সাইয়্যেদ (সর্দার) এবং আমি আশা করি যে তার মাধ্যমেই আল্লাহতা’লা দুটি বিবদমান মুসলমান বাহিনীকে একতাবদ্ধ করবেন।” 

আল-বুখারী (রহ:) এই রওয়ায়াত/বর্ণনাটি তাঁর সংকলনগ্রন্থে বারংবার উল্লেখ করেছেন (হাদীস নং ৩৬২৯, ৩৭৪৭, ৭১০৯)।

এই হাদীসে ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা:)-এর উন্নত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এ মর্মে যে তিনি একজন সাইয়্যেদ, আর ওই গুণের চিহ্ন হচ্ছে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর বরাবরে তাঁর খেলাফতের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর। এতে আরো বর্ণিত হয়েছে যে ইমাম হাসান (রা:) ও আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর দুটি সেনাবাহিনী-ই মুসলমান; অধিকন্তু, এতে আমীরে মু’আবিয়া (র:)-এর গুণগত যোগ্যতা ও উচ্চসিত প্রশংসাও বিদ্যমান; কেননা প্রিয়নবী (দ:) ইমাম হাসান (রা:) কর্তৃক আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর বরাবরে খেলাফতের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশংসা দ্বারা আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর প্রশংসা করেছেন। তিনি নেতৃত্বের যোগ্য না হলে মহানবী (দ:) ইমাম হাসান (রা:)-এর কৃত এই সমঝোতা ও আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর পক্ষে খেলাফতের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশংসা করতেন না।

হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) বলেন:

قال سفيان بن عيينة: قوله: ((فئتين من المسلمين)) يعجبنا جداً

”দুটি মুসলিম সেনাবাহিনী” শীর্ষক হাদীসের বাণী আমাদেরকে অতিশয় প্রভাবিত করে। [এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান তাঁর প্রণীত ‘তারীখ’গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেন এবং সাঈদ ইবনে মানসূর হতে বর্ণনা করেন ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) নিজ ‘ফাতহুল বারী’ পুস্তকে (১৩:৬৬)]

ইমাম আবূ বকর আল-বায়হাক্বী (রহ:) বলেন:

وإنما أعجبهم لأن النبي (صلى الله عليه وسلم) سماهما جميعاً مسلمين. وهذا خبر من رسول الله (صلى الله عليه وسلم) بما كان من الحسن بن علي بعد وفاة علي في تسليمه الأمر إلى معاوية بن أبي سفيان

অর্থ: প্রভাবিত হওয়ার কারণ হলো, প্রিয়নবী (দ:) উভয় বাহিনীকেই ‘মুসলিম’ বলেছেন। আর এই বর্ণনা খলীফা হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু’র বেসাল শরীফের পরে ইমাম হাসান (রা:)-এর জীবনে যে ঘটনা ঘটবে এবং আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর বরাবরে তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তরের যে উপাখ্যান রচিত হবে, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর একটি (স্পষ্ট) ভবিষ্যদ্বাণীও।

ইমাম হাসান ইবনে আলী ইবনে আবী তালেব (রা:) তাঁর খুতবায় বলেন: 

أيها الناس، إن الله هداكم بأولنا، وحقن دماءكم بآخرنا، وإن هذا الأمر الذي اختلفت فيه أنا ومعاوية هو حق لامرئ كان أحق به مني، أو حق لي تركته لمعاوية إرادة إصلاح المسلمين وحقن دمائهم، وإن أدري لعله فتنة لكم ومتاع إلى حين  ا.هــ.

ওহে মানব সকল, নিশ্চয় আল্লাহ পাক তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছেন আমাদের প্রথম জনের দ্বারা, আর তিনি তোমাদের রক্ত (ঝরানো) হতে (তোমাদেরকে) বাঁচিয়েছেন আমাদের শেষ জনের দ্বারা; এই যে বিষয়টি যার ব্যাপারে আমীরে মু’আবিয়া (রা:) ও আমার মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে, তা হয় আমার চেয়ে অধিকতর যোগ্য কোনো ব্যক্তিত্বের অধিকারসংক্রান্ত, না হয় আমারই অধিকার যা আমি আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর বরাবরে ছেড়ে দিয়েছি এই উদ্দেশ্যে যে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা ফিরিয়ে আনা যাবে এবং তাদের রক্তও ঝরানো বন্ধ করা যাবে। আমি জানি না এটা কি তোমাদের জন্যে কোনো পরীক্ষা, নাকি কিছু সময়কালের জন্যে আনন্দ উদযাপন। [ইমাম বায়হাক্বী: আল-এ’তেক্বাদ]

আবূ সোলায়মান আল-খাত্তাবী নিজ ‘মা’আলিম আল-সুনান’ (৭:৩৭) পুস্তকে এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন:

تحت شرحه لهذا الحديث ـ : وقد خرج مصداق هذا القول فيه بما كان من إصلاحه بين أهل العراق وأهل الشام وتخليه عن الأمر؛ خوفا من الفتنة؛ وكراهية لإراقة الدم؛ ويسمى ذلك العام سنة الجماعة؛ وفي الخبر دليل على أن واحدا من الفريقين لم يخرج بما كان منه في تلك الفتنة من قول أو فعل عن ملة الإسلام؛ إذا قد جعلهم النبي صلى الله عليه وسلم مسلمين؛ وهكذا سبيل كل متأول فيما تعاطاه من رأي ومذهب دعا إليه؛ إذ كان قد تأوله بشبهة وإن كان مخطئا في ذلك؛ ومعلوم أن إحدى الفئتين كانت مصيبة والأخرى مخطئة  ا.هــ. 

(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ‘সাইয়েদ’-বিষয়ক) এই ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন হয়েছিলো ইরাক্ব ও শাম রাজ্য দুটোর জনগণের মধ্যকার ঐক্য/সমঝোতা দ্বারা; আর বাস্তবে পরিণত হয়েছিলো মুসলমানদের রক্ত ঝরবার আশঙ্কায় ইমাম হাসান (রা:)-এর নেতৃত্ব ত্যাগের বিষয়টিও; সেই সালটিকে ‘ঐক্যের বছর’ বলা হয়েছিলো। অধিকন্তু, এই বর্ণনায় প্রমাণ হয় যে উভয় দল-ই নিজেদের মধ্যকার মৌখিক অথবা কর্মতৎপরতাগত মতভেদের কারণে ইসলাম ধর্ম হতে খারিজ/বিচ্যুত হননি, কেননা মহানবী (দ:) তাঁদের উভয় দলকেই মুসলমান অভিহিত করেছিলেন। এটাই হচ্ছে এমন ব্যক্তির সাথে (ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র গৃহীত) আলোচনায় প্রবৃত্ত হবার (সঠিক) পন্থা, যিনি কোনো মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তা’বিল (ইসলামী পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) করেন – যদিও তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয় অস্পষ্ট ও সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা, এমন কী ভুলও। এটা জ্ঞাত যে একটি দল সঠিক ও অপরটি ভুল করেছিলেন (এজতেহাদে)। [আল-বাগাভী-ও অনুরূপ বক্তব্য লিখেছেন তাঁর ‘শরহে আল-সুন্নাহ’ গ্রন্থে (১৪:১৩৬)]

ইবনে তাইমিয়া নিজের ফাতাওয়া পুস্তকে (৩৫:৭০) লেখেন:

وأثنى النبي صلى الله عليه وسلم على الحسن بهذا الصلح الذي كان على يديه، وسماه سيداً بذلك، لأجل أن ما فعله الحسن يحبه الله ورسوله، ويرضاه الله ورسوله، ولو كان الاقتتال الذي حصل بين المسلمين هو الذي أمر الله به ورسوله لم يكن الأمر كذلك، بل يكون الحسن قد ترك الواجب، أو الأحب إلى الله، وهذا النص الصحيح الصريح يبين أن ما فعله الحسن محمود، مرضي لله ورسوله ا.هــ

অর্থ: “নবী করীম (দ:) ইমাম হাসান (রা:)-এর প্রশংসা করেছিলেন এই সমঝোতার জন্যে, যা তাঁর হাতে সুসম্পন্ন হয়, আর এর খাতিরেই তাঁকে ‘সাইয়্যেদ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা (বাস্তবায়িত হয়) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর প্রিয় ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা:)-এর ওই কাজটি দ্বারা, আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) তাঁর এই কাজে রাজি আছেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) যদি মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সংঘটিত হওয়াকে আদিষ্ট করতেন, তাহলে (ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র কাজের) এই (প্রশংসার) ব্যাপারটি হতো না। ওই অবস্থায় ইমাম হাসান (রা:) প্রকৃতপক্ষে (যুদ্ধ করার) একটি অত্যাবশ্যক গুরুদায়িত্বকে বাদ দিযে যেতেন; অথবা, সেটা হতো এমন এক দায়িত্ব যা আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। তবে এই রওয়ায়াত/বিবরণটি সহীহ ও স্পষ্ট/দ্ব্যর্থহীন এই মর্মে যে ইমাম হাসান (রা:) যা করেছিলেন তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর কাছে প্রশংসনীয় ও পছন্দনীয় ছিলো।”

এই হাদীস থেকে আরো যা বোঝা যায় তা হলো, এ ফিতনা (বিবাদ)-সম্পর্কিত আলোচনা ও আমীরে মু’আবিয়া (রা:) ও তাঁর দলের সমালোচনা পরিহার করতে হবে। কেননা মহানবী (দ:) এই সমঝোতার প্রশংসা করেছিলেন এবং যাঁর দ্বারা এটা বাস্তবায়িত হয়েছিলো, সেই ইমাম হাসান (রা:)-এরও ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। অতএব, যখন কেউ আমীরে মু’আবিয়া (রা:) ও তাঁর পক্ষের মুসলমানদের প্রতি অপবাদ দেয়, তখন তার এই কাজটি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর (ভবিষ্যদ্বাণীতে) প্রশংসিত সমঝোতার ভিত্তিকেই দুর্বল করে দেয়। উপরন্তু, এই সমঝোতার ফলাফল যাতে অস্তিত্বশীল ও জারি থাকে, সে জন্যে প্রয়োজন প্রথমাবস্থায় উদ্ভূত অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণগুলোকে পুনরায় জাগ্রত না করা; এগুলোর মধ্যে রয়েছে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর প্রতি অপবাদ এবং (তা এড়িয়ে) নিজেকে স্রেফ স্পষ্ট প্রামাণ্য দলিলে উল্লেখিত বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, যাতে এই সমঝোতার প্রভাব জারি রাখা সম্ভব হয়। মুহাদ্দীস ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) তাঁর কৃত ‘সুনান’ গ্রন্থে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন ‘ফিতনা-সংক্রান্ত বক্তব্য পরিহার’ শীর্ষক অধ্যায়ে (৫:২১১); আর এটা যেনো তিনি ইঙ্গিত করেছেন সে বিষয়েই, যা সম্পর্কে ওপরে আমরা আলোচনা করেছি। আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। নিঃসন্দেহে এটা ইমাম আবূ দাউদের (রহ:) গভীর অনর্দৃষ্টি (কাশফ) হতেই নিঃসৃত, আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি আপন করুণা বর্ষণ করুন, আমীন।

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর বৃদ্ধ বয়স প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (দ:) বিস্তারিত বলেছিলেন, যা আল-বুখারী ( হাদীস নং ৭২২২, ৭২২৩) ও মুসলিম (হাদীস নং ১৮২১) হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ (রা:) হতে আবদ আল-মালেক ইবনে উমাইরের সূত্রে বর্ণনা করেন; হযরত জাবের (রা:) তাতে বলেন:

سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقول: (( لا يزال أمر الناس ماضياً ما وليهم اثنا عشر رجلاً )) ثم تكلم بكلمة خفيت علي، فسألت أبي: ماذا قال رسول الله  صلى الله عليه وسلم؟ فقال: (( كلهم من قريش )) وهذا لفظ مسلم.

আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে শুনেছি এ কথা বলতে: “মানুষের বিষয়াদি (উন্নত হতে) থাকবে বারো জনের নেতৃত্বে…।” এরপর তিনি এমন কথা বলেন যা আমি (কানে) শুনতে পাইনি। তাই আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করি মহানবী (দ:) কী বলেছিলেন। তিনি উত্তরে বলেন, “তাঁরা (শাসকবৃন্দ) সবাই ক্বুরাইশ গোত্রভুক্ত।” 

ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে (৮২১) হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রা:) হতে ইমাম হুসাইন (রা:)-এর সূত্রে আলাদা শব্দচয়নে বর্ণনা করেন:

(( إن هذا الأمر لا ينقضي حتى يمضي فيهم اثنا عشر خليفة ))

“বস্তুতঃ এই বিষয়টি রহিত হবে না, যতোক্ষণ না বারো জন খুলাফা (খলীফামণ্ডলী) তাদের ওপরে শাসন করবে।”

হযরত জাবের (রা:) হতে সিমাকের সূত্রেও ভিন্ন শব্দচয়নে বর্ণিত হয়:

(( لا يزال الإسلام عزيزاً إلى اثني عشر خليفة )) ثم قال كلمة لم أفهمها، فقلت لأبي: ما قال؟ فقال: (( كلهم من قريش )).

“ইসলাম বারো জন খলীফার শাসনকাল পর্যন্ত শক্তিশালী হতে থাকবে।” এরপর মহানবী (দ:) কিছু একটা বলেন যা আমি বুঝতে পারিনি। তাই আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করি রাসূলুল্লাহ (দ:) কী বলেছিলেন। তিনি জবাবে বলেন, “তাঁরা (শাসকবৃন্দ) সবাই ক্বুরাইশ গোত্রীয় হবেন।”

হযরত জাবের (রা:) হতে আল-শাবী’র সূত্রে অন্যভাবে বর্ণিত:

(( لا يزال هذا الأمر عزيزاً منيعاً إلى اثني عشر خليفة )).

 “বারো জন খলীফার মাধ্যমে (শাসনের) এই বিষয়টি শক্তিশালী থাকবে।”

ইমাম মুসলিম (রহ:) তাঁর পুস্তকে (১৮২২) আমির ইবনে সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রহ:)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন যে হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ (রা:) তাঁর গোলাম নাফী’র মাধ্যমে লেখা পত্র দ্বারা তাঁকে জানিয়েছেন যে তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে বলতে শুনেছেন:

(( لا يزال الدين قائماً حتى تقوم الساعة، أو يكون عليكم اثنا عشرة خليفة كلهم من قريش )).

ইসলাম ধর্ম প্রাধান্য বজায় রাখবে প্রলয় দিবস অবধি; কিংবা বারো জন খলীফা তোমাদেরকে শাসন করা পর্যন্ত। তারা সবাই ক্বুরাইশ গোত্রভুক্ত হবে।

অতএব, এসব রওয়ায়াতের স্পষ্ট অর্থের ভিত্তিতে হযরতে আমীরে মু’আবিয়া (রা:) এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, কেননা তিনি ক্বুরাইশ গোত্রভুক্ত ছিলেন এবং তিনি শাসন করেছিলেন, আর তাঁর শাসনকালে ইসলাম ধর্ম শক্তিশালী ছিলো এবং আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। এই বিবরণ স্পষ্টভাবে তাঁর প্রতি প্রযোজ্য হয়, বিশেষ করে আল-শাবী ও সিমাকের বর্ণনাগুলো, যা ইসলামকে শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হিসেবে প্রতীয়মান করে; আর এই রওয়ায়াত স্পষ্ট ইঙ্গিত করে যে এই শক্তি ও ক্ষমতার সূচনা হয়েছিলো রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেসাল শরীফের পরে প্রথম খণীফা তথা হযরত আবূ বকর (রা:)-এর দ্বারা। অতঃপর ১২তম খলীফা পর্যন্ত এভাবে চলবে বলে ঘোষিত হয়েছিলো। আমীরে মু’আবিয়া (রা:) তাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, বিশেষ করে এই কারণে যে সকল মুসলমান তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন এবং ওই সালটিকে ঐক্যের বছর বলে অভিহিত করা হয়েছিলো।

ওপরে প্রদর্শিত প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে বোঝা যায়, হযরতে আমীরে মু’আবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (রা:) বৈধ খলীফা ছিলেন এবং তাঁর শাসনামলে ইসলাম ধর্ম শক্তিশালী ও আধিপত্যশীল ছিলো, আর এটা হয়েছিলো তাঁর শরীয়ত অনুসারে শাসন ও সুন্নাহ’র বাস্তবায়নের দরুন। নতুবা ইসলাম ধর্ম শক্তিশালী ও প্রভাবপূর্ণ হতো না। আল্লাহ-ই সর্বজ্ঞ।

আবূ যুর’আহ (রহ:) বলেন:

قال أبو زرعة: حدثني عبد الرحمن بن إبراهيم نا الوليد عن الأوزاعي قال: أدركتْ خلافة معاوية عدة من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم منهم: سعد وأسامة وجابر وابن عمر وزيد بن ثابت ومسلمة بن مخلد وأبو سعيد ورافع بن خديج  وأبو أمامة وأنس بن مالك، ورجال أكثر ممن سمينا بأضعاف مضاعفة، كانوا مصابيح الهدى، وأوعية العلم، حضروا من الكتاب تنزيله، وأخذوا عن رسول الله صلى الله عليه وسلم تأويله. 

আবদুর রহমান ইবনে ইবরাহীম আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; তিনি আল-ওয়ালীদ হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন, আল-আওযাঈ (রা:) বলেছেন: ‍মু’আবিয়া (রা:)’র শাসনামলের প্রতি সমর্থন ছিলো হুযূরে পাকের (দ:) বহু সাহাবী (রা:)’র, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্ব-হযরত সা’আদ (রা:), উসামাহ (রা:), জাবের (রা:), ইবনে উমর (রা:), যায়দ বিন সাবেত (রা:), মালামাহ ইবনে মাখলাদ (রা:), আবূ সাঈদ (রা:), রাফি’ ইবনে খাদীজ (রা:), আবূ উমামাহ (রা:), আনাস বিন মালেক (রা:) প্রমুখসহ আরো অসংখ্য সাহাবী যাঁদের নাম মোবারক আমরা অনেকবার উল্লেখ করেছি। তাঁরা ছিলেন হেদায়াতের প্রদীপ এবং জ্ঞানের আধার। তাঁরা ক্বুরআন অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনার সাক্ষী এবং এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও তাঁরা (সরাসরি) রাসূলুল্লাহ (দ:) হতে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আল্লাহতা’লার ইচ্ছায় তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম যাঁরা তাঁদেরকে পরম সাফল্যের সাথে অনুসরণ করেছিলেন, সেই উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রয়েছেন: সর্ব-হযরত আল-মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ (রহ:), আবদুর রাহমান ইবনে আল-আসওয়াদ ইবনে আবদ্ এয়াগুস্ (রহ:), সাঈদ ইবনে আল-মুসাইয়াব (রহ:), উরওয়াহ ইবনে আল-যুবাইর (রহ:), আবদুল্লাহ ইবনে মুহায়রিয (রহ:) এবং তাঁদের মতো পুণ্যাত্মাবৃন্দ যাঁরা উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে (মোটেও) বিচ্যুত হননি।  [‘তারীখে আবূ যুর’আহ’, ৪২-৪৩ পৃষ্ঠা]

আল-যাহাবী নিজ ‘সিয়্যার’ পুস্তকে (৩:১৩২) বলেন:

“তোমাদের জন্যে এতোটুকুই যথেষ্ট যে এই ব্যক্তিত্বকে একটি প্রদেশ শাসনের জন্যে (প্রথমে) খলীফা উমর (রা:) ও পরবর্তীকালে খলীফা উসমান (রা:) নিযুক্ত করেছিলেন; আর এটা ছিলো সীমান্ত প্রদেশ, যেখানে তিনি তাঁর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যে চরম উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন এবং তাঁর (এলাকার) জনগণ তাঁরই মহত্ত্ব/উদারতা ও ধৈর্যের ব্যাপারে খুশি/রাজি ছিলেন; যদিও কেউ কেউ হয়তো কোনো কোনো সময়ে তাঁর শাসনে কিছু অসুবিধার অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকতে পারেন। একইভাবে, তিনি শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, যদিও সাহাবাবৃন্দের (রা:) মাঝে অনেকেই গুণে-মানে ও ধার্মিকতায় তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এই ব্যক্তিত্ব-ই শাসন করেছিলেন এবং দুনিয়াকে পরিচালিত করেছিলেন নিজের গভীর বিচক্ষণতা, অনতিক্রম্য ধৈর্য, আশীর্বাদপূর্ণ মহত্ত্ব, সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও কৌশলপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্বারা। তাঁর ওই সব বিষয়ও আছে যার জন্যে তাঁকে আল্লাহর কাছে হিসেব দিতে হতে পারে [ইমাম যাহাবী’র এ বক্তব্য সুন্নী উলামাদের ঐকমত্যের খেলাফ – বঙ্গানুবাদক]। তাঁকে তাঁর জনগণ অত্যন্ত ভালোবাসতেন; তিনি শা’ম রাজ্যে বিশ বছর প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন, এরপর বিশ বছর তিনি খলীফা পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই শাসনকালে কেউই তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুঃসাহস দেখায়নি। পক্ষান্তরে, সকল জাতিগোষ্ঠী-ই তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন এবং তিনি আরব ও অনারব সবার ওপর শাসন করেছিলেন। তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো আরব, মিসর, শাম (বৃহত্তর সিরিয়া) ইরাক্ব, খুরাসান (মধ্য এশিয়া), পারস্য, আল-জাযিরাহ (মূল আরব), ইয়েমেন ও আল-মাগরেব (আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, মরোক্কো ইত্যাদি রাজ্য) এবং আরো অন্যান্য এলাকা।”

সাধারণ লিপিগুলো নিম্নতালিকা অনুযায়ী হবে:

আল-বুখারী (৩৬০৮) বর্ণনা করেন আল-হাকাম ইবনে নাফী’ (রহ:) হতে, তিনি শু’আয়ব (রহ:) হতে, তিনি আল-যুহরী (রহ:) হতে, তিনি আবূ সালামাহ ইবনে আবদির রাহমান (রা:) হতে, তিনি হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা:) হতে, যিনি বলেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

(( لا تقوم الساعة حتى يقتتل فئتان دعواهما واحدة )).  

”প্রলয় দিবস আসবে না, যতোক্ষণ না দুইটি (মুসলমান) দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; তাদের আহ্বান একই হবে (মানে একই আদর্শের জন্যে লড়বে)।”

মুসলিম (১০৬৫) বর্ণনা করেন ক্বাসিম ইবনে ফযল (রহ:) হতে, তিনি আবূ নাদরাহ (রহ:) হতে, তিনি আবূ সাঈদ (রা:) হতে, যিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: 

(( تمرق مارقة عند فرقة من المسلمين يقتلها أولى الطائفتين بالحق )). 

“মুসলমান সমাজ যখন দ্বিধা বিভক্ত হবে, তখন একটি দলের (কিছু) অংশ বিদ্রোহ করবে; আর দুটি দলের মধ্যে যে দলটি সত্যের কাছাকাছি অবস্থানে থাকবে, তারা ওই (বিদ্রোহী) অংশের সাথে লড়বে।”

অতএব, হযরত আলী (ক:) ও আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র মাঝে যা ঘটেছিলো, সে সম্পর্কে হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা:)’র বিবরণে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়; আর নিঃসন্দেহে হযরত আলী (ক:)-ই অন্য যে কারো চেয়ে সত্যের কাছাকাছি ছিলেন এবং তিনি-ই আবার খারেজী বিদ্রোহী/ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এই রওয়ায়াত/বর্ণনায় আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর ইসলামী জিন্দেগী সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কেননা নবী করীম (দ:) এরশাদ করেন, “…তাদের আহ্বান একই হবে,” এবং ”দুটি দলের মধ্যে যে দলটি সত্যের কাছাকাছি অবস্থানে থাকবে,” তারা ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে লড়বে।

ইমাম নববী (রহ:) তাঁর রচিত ’শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে (৭:১৬৮) বলেন:

( وفيه التصريح بأن الطائفتين مؤمنون، لا يخرجون بالقتال عن الإيمان، ولا يفسقون، وهذا مذهبنا ) 

“….এই বর্ণনায় রয়েছে এক দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা এ মর্মে যে দুটো দল-ই মুসলমান; আর তারা নিজেদের (মধ্যকার) এ যুদ্ধের কারণে ঈমান-ইসলাম থেকে খারিজ হননি, তাঁদেরকে ফাসিক্ব/পাপী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়নি। আর এটাই আমাদের (আহলে সুন্নাতের) দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান।” 

ইবনে কাসীর নিজের লিখিত ‘বেদায়াহ’ (১০:৫১৩) গ্রন্থে বলেন:

আর এতে (এ বিবরণে) রয়েছে শা’ম (সিরিয়া)-বাসী ও ইরাক্ববাসীদের উভয় দলেরই জন্যে ইসলামের একটি বিধান; রাফেযী শিয়া গোষ্ঠী যারা অজ্ঞ ও পথভ্রষ্ট এবং যারা শা’মবাসীদের প্রতি ধর্মত্যাগের অপবাদ দেয়, তারা যেমনটি দাবি করে থাকে তেমনটি নয়।

২/ তাঁর সাহাবী হওয়া                       

আল-বোখারী (রহ:) তাঁর সহীহ পুস্তকে (৩৭৪৬) হযরত হাসান ইবনে বিশর (রহ:) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন আল-মু’আফা আমাদের কাছে বর্ণনা করেন উসমান ইবনে আল-আসওয়াদ হতে, তিনি ইবনে আবী মুলাইকাহ হতে, যিনি বলেন:

আমীরে মু’আবিয়া (রা:) রাতে বেতরের নামায এক রাকআতে পড়তেন, আর তাঁর সাথে ছিলেন হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর এক মওলা (মুক্ত করে দেয়া গোলাম); তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর কাছে গিয়ে (আমীরে মু’আবিয়া সম্পর্কে) বলেন। অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন:

دعه فإنه قد صحب رسول الله صلى الله عليه وسلم.

 “তাঁকে ছেড়ে দাও! কেননা নিশ্চয় তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর একজন সাহাবী।”

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, আমীরে মু’আবিয়া (রা:) রাসূলুল্লাহ (দ:)’র সাহাবী হওয়ার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত, যেমনটি ওপরের এই বিবরণ ও অন্যান্য বর্ণনায় ওঠে এসেছে; আর সাহাবীবৃন্দের (রা:) উচ্চমর্যাদা ও গুণাবলী ক্বুরআন ও সুন্নাহ হতে জানা যায়। আল-ক্বুরআনে বর্ণিত স্পষ্ট প্রমাণ হলো:

لاَ يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ ٱلْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُوْلَـٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِن بَعْدُ وَقَاتَلُواْ وَكُلاًّ وَعَدَ ٱللهُ ٱلْحُسْنَىٰ وَٱللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

অর্থ: তোমাদের মধ্যে সমান নয় ওই সব লোক, যারা মক্কা বিজয়ের আগে ব্যয় ও জ্বেহাদ করেছে; তারা মর্যাদায় ওই সব লোক অপেক্ষা বড়, যারা বিজয়ের পর ব্যয় ও জ্বেহাদ করেছে এবং তাদের সবার সাথে আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন এবং আল্লাহ তোমাদের কৃত কর্মগুলো সম্পর্কে অবহিত। [সূরা হাদীদ, ১০ আয়াত]

এই আয়াতটি সমস্ত সাহাবা (রা:)’কে উদ্দেশ্য করেছে; যাঁরা মক্কা বিজয়ের আগে (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় ও জ্বেহাদ করেছিলেন এবং যাঁরা ওই বিজয়ের পরে ব্যয় ও জ্বেহাদ করেছিলেন তাঁদের সবাইকেই আল্লাহতা’লা ‘সর্বোত্তম’ পুরস্কার তথা জান্নাত প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর যেমনটি ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আমীরে মু’আবিয়া (রা:) কর্তৃক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ মক্কা বিজয়ের আগে হোক বা পরে, তিনি তবুও এই আয়াতে করীমার উদ্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব।  

৩/ প্রিয়নবী (দ:)-এর কাতেব/ওহী লেখক

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) নিজ ‘মুসনাদ’ (১:২৯১) পুস্তকে আফফান হতে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: আবূ আওয়ানাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: আবূ হামযাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)’কে বলতে শুনেছেন:

كنت غلاماً أسعى مع الصبيان قال: فالتفت فإذا نبي الله خلفي مقبلاً، فقلت: ما جاء نبي الله إلا إليَّ. قال: فسعيت حتى أختبئ وراء باب دار. قال: فلم أشعر حتى تناولني، قال: فأخذ بقفاي فحطأني حطأة. وقال: (( اذهب فادع لي معاوية )) وكان كاتبه، فسعيت، فقلت: أجب رسول الله فإنه على حاجة.  

আমি কিশোর থাকাকালে (একবার) অন্যান্য শিশুদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম; এমনি সময়ে হঠাৎ রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদের পেছন দিক থেকে এসে উপস্থিত হন। আমি ধারণা করি যে তিনি আমার খোঁজেই এসেছিলেন, তাই আমি দৌড়ে একটি ঘরের দরজার আড়ালে গিয়ে লুকোই; আর আমি বুঝতে পারিনি যতোক্ষণ না তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং আমার দুই কাঁধের মাঝখানে পিঠ চাপড়ে দেন। অতঃপর তিনি বলেন, “যাও এবং মু’আবিয়াকে গিয়ে বলো আমি ডেকেছি।” আর মু’আবিয়া (রা:) ছিলেন রাসূল (দ:)-এর কাতেব/ওহী লেখক। তাই আমি দৌড়ে গিয়ে (তাঁকে) বলি: “রাসূলুল্লাহ (দ:)’র আহ্বানে সাড়া দিন, কেননা আপনাকে তাঁর প্রয়োজন।”

আবূ দাউদ আল-তায়্যালিসী (রহ:)-ও তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে আবূ হামযাহ আল-ক্বাসসাব হয়ে হিশাম ও আবূ আওয়ানাহ’র সূত্রে অনুরূপ একটি বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। 

এই বিবরণের মৌলিক অংশটি একই শব্দচয়নে আবূ হামযাহ হতে শু’বাহ’র সূত্রে মুসলিমে (২৬০৪) বর্ণিত হয়েছে, স্রেফ এই বাক্যটি ছাড়া “…তিনি ছিলেন রাসূল (দ:)-এর কাতেব।” যদিও মুসলিমের বিবরণ আরো বেশি পূর্ণাঙ্গ। [সহীহ মুসলিমে (১৫০১) ইবনে আব্বাস (রা:)-এর বিখ্যাত বর্ণনাটি আরো উল্লেখ করে যে মহানবী (দ:) আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’কে কাতেব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং ওই বিবরণ সম্পর্কে আলোচনা সর্বজনবিদিত।]  

আবূ হামযাহ’কে ইমরান আল-ক্বাসসাব নামে ডাকা হয়; আর তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাধান্য লাভ করেছে যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে ব্যক্ত হয়েছে যে তাঁর বর্ণনাগুলোর মাঝে কোনো ক্ষতি নিহিত নেই, যেমনটি ইমাম আহমদ (রহ:) তাঁর সম্পর্কে বলেন, “(তিনি) হাদীসশাস্ত্রে ‘সালেহ’ তথা ন্যায়বান,” আর শু’বাহ হতে তাঁর বিবরণ তাঁকে শক্তিশালী করেছে। হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:)-ও তাঁর সম্পর্কে বলেন, “তিনি ছিলেন ইবনে আব্বাস (রা:)-এর সাথীদের মধ্য হতে।” আর এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা সুবিদিত হওয়ার বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে। অধিকন্তু, এই বিবরণে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন যে তিনি এ বাণী হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে শুনেছিলেন।

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, আমীরে মু’আবিয়া (রা:) মহানবী (দ:)’র কাতেব হওয়ার বাস্তবতা আলেম-উলামাদের মাঝে সুপ্রসিদ্ধ; আর প্রিয়নবী (দ:) তাঁকে ওহী লিপিবদ্ধ করার জন্যে নিজের কাতেব হিসেবে গ্রহণ করার বাস্তবতা আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র মহা এক গুণ ও সম্মান বলে সাব্যস্ত হয়।

আমীরে মু’আবিয়া (রা:) খলীফা হযরত আবূ বকর (রা:)-এরও কাতেব ছিলেন। এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান তাঁর লিখিত ‘আল-মারিফাহ ওয়াল-তা’রীখ’ (৩:৩৭৩) গ্রন্থে বলেন:

সুলাইমান আমাদের কাছে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: উমর ইবনে আলী আমাদের কাছে বর্ণনা করেন হিশাম ইবনে উরওয়াহ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, যিনি বলেন: আমি মু’আবিয়া (রা:)’র কাছে উপস্থিত হলে তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেন, ‘আল-মাসলূল (একটি দলিলের নাম) কোথায়?’ আমি তাঁকে জানাই সেটা আমার সাথেই আছে। অতঃপর তিনি বলেন, “ওয়াল্লাহ! আমি তা নিজ হাতে লিখেছিলাম। হযরত আবূ বকর (রা:) আল-যুবায়র (রা:)-এর জন্যে একটি জমি বরাদ্দ দিচ্ছিলেন এবং আমি তা রেকর্ড করছিলাম। এমতাবস্থায় হযরত উমর (রা:) সেখানে উপস্থিত হবার উপক্রম হলে হযরত আবূ বকর (রা:) দলিলটি নিয়ে ম্যাট্রেস তথা ফরাশের ভাঁজে রেখে দেন। হযরত উমর (রা:) সেখানে প্রবেশ করে বলেন, ‘মনে হচ্ছে আপনারা এখানে ব্যক্তিগত আলাপে রত, তাই নয় কি?’ হযরত আবূ বকর (রা:) ইতিবাচক উত্তর দিলে হযরত উমর (রা:) স্থানত্যাগ করেন। অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা:) দলিলটি আবার বের করেন এবং আমি তা লেখা সম্পন্ন করি।”

৪/ সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)-বৃন্দের দ্বারা তাঁর প্রশংসা

আল-বুখারী (৩৭৬৫) ইবনে আবী মুলায়কাহ’র সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে ইতিপূর্বে উদ্ধৃত আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র বেতরের নামায আদায় সংক্রান্ত প্রশ্নটির যে সমস্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন, তার একটিতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর উত্তরের ভাষ্য নিম্নরূপ: إنه فقيه মানে “নিশ্চয় তিনি একজন ফেক্বাহ-শাস্ত্রবিদ।” 

আল-খাল্লাল তাঁর ‘আল-সুন্নাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন হুশায়ম হতে, তিনি আল-আওয়াম ইবনে হাওশাব হতে, তিনি জাবালাহ ইবনে সুহায়ম হতে, যিনি বলেন:

আমি হযরত ইবনে উমর (রা:)’কে এ কথা বলতে শুনেছি, “রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পরে নেতৃত্ব দেয়ার বেলায় আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র মতো এমন কৌশলী আর কাউকেই আমি দেখিনি।” তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, “(তাহলে) আপনার পিতার (মানে হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র) ব্যাপারটি?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহ আমার পিতার প্রতি রহম করুন; তিনি আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র চেয়ে উত্তম/শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তবে আমীরে মু’আবিয়া (রা:) তাঁর চেয়েও (নেতৃত্বের ক্ষেত্রে) বেশি কৌশলী/বিচক্ষণ ছিলেন।” 

মা’মার নিজ ‘জামে’ পুস্তকে (২০৯৮৫, ইমাম আবদুর রাযযাক্ব প্রণীত ‘মুসান্নাফ’ সংস্করণ হতে সংগৃহীত) হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ হতে বর্ণনা করেন, যিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)’কে বলতে শোনেন:

আমি আর এমন কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি, যাঁকে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র মতো রাজ্য শাসকের ভূমিকা পালনের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁর কাছে দূরদূরান্ত হতে সর্বসাধারণ আগমন করতেন। তিনি কখনোই কৃপণ-কঞ্জুস, রূঢ় বা বদমেজাজি ছিলেন না।

আল-যাহাবী স্বরচিত ‘তা’রীখ আল-ইসলাম’ (২:৫৪৪) গ্রন্থে বিবৃত করেন:

বুসর ইবনে সাঈদ বর্ণনা করেন হযরত সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:) হতে, যিনি বলেন, “খলীফা হযরত উসমান (রা:)-এর পরে আমি আর কাউকেই দেখিনি যিনি এই দরজার সাথী (মানে আমীরে মু’আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র মতো এমন ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন করেছেন।”

আবূ যুরা’হ আল-দামেশকী তাঁর ‘তারীখ’ পুস্তকে (১:৫৭২) আবদুর রাহমান ইবনে ইবরাহীম হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: কা’আব ইবনে খুদায়জ আবূ হা’রিসাহ আমার কাছে বর্ণনা করেন – আবূ যুরা’হ বলেন:

আমি আবূ হা’রিসাহ’কে দেখেছি এবং তাঁর সান্নিধ্যে বসেছি; তিনি ছিলেন একজন পুণ্যবান শায়খ (হাদীসশাস্ত্র বিশারদ), যিনি বলেছেন যে আবদুল্লাহ ইবনে মুস’আব ইবনে সা’বেত আমাদের কাছে বর্ণনা করেন হিশাম ইবনে উরওয়াহ হতে, যিনি বলেন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আল-যুবায়র (রা:)’কে বলতে শুনেছিলেন এ কথা: “আমি আল্লাহর কসম করছি, তিনি (আমীরে মু’আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন ঠিক যেমনটি ইবনে রাক্বীক্বাহ (তাঁর সম্পর্কে) বলেছিলেন, আমি কি তাঁর ব্যাপারে কাঁদবো না? আমি কি তাঁর ব্যাপারে কাঁদবো না? (কেননা) তাঁর সাথে তো রয়েছে উভয় (জগৎ বা ধরনের) সম্পদ।” 

আল-খাল্লাল (৪৩৮ পৃষ্ঠা)-ও বর্ণনা করেন আল-আ’মাশ হতে, তিনি মুজাহিদ (রা:) হতে, যিনি বলেন:

তোমরা যদি আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’কে দেখতে, তাহলে তোমরা বলতে, “তিনি-ই মাহদী।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) নিজের ‘মুসনাদ’ (৪:৯৩) গ্রন্থে বর্ণনা করেন ওয়াকী’ হতে, যিনি বলেন, আবূ আল-মু’তামির আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইবনে সীরীন হতে, তিনি আমীরে মু’আবিয়া (রা:) হতে, যিনি বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) ঘোষণা করেন: “রেশমের ও চিতা বাঘের চামড়ার (তৈরি জিনে) সওয়ারি হবে না।” আর আমীরে মু’আবিয়া (রা:) এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন না যাঁকে মহানবী (দ:) হতে তিনি যা কিছু বর্ণনা করেছিলেন, তার জন্যে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো।

আল-আ’জুর্রী নিজ ‘আল-শরীআ’ পুস্তকে (৫:২৪৬৬; নং – ১৯৫৫) বর্ণনা করেন যে মারওয়া হতে (আগত) এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ:)’কে জিজ্ঞেস করেন আমীরে মু’আবিয়া (রা:) শ্রেষ্ঠ, না উমর বিন আবদিল আযীয? এমতাবস্থায় ইবনে আল-মুবারক (রহ:) উত্তর দেন:

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সান্নিধ্যে যে ধুলো আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র নাকে প্রবেশ করেছে, তাও উমর বিন আবদিল আযীযের চেয়ে শ্রেষ্ঠ/উত্তম।

আল-খতীব আল-বাগদাদী (রহ:) নিজ ‘তারীখ’ পুস্তকে (১:২০৯) রাবা’হ ইবনে আল-জার্রাহ আল-মওসিলী’র বর্ণনা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: আমি এক ব্যক্তিকে আল-মু’আফা’ ইবনে ইমরান’র প্রতি প্রশ্ন করতে শুনি এ মর্মে যে, উমর ইবনে আবদিল আযীয কীভাবে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র সাথে তুলনীয় হতে পারেন? এতে আল-মু’আফা’ অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং বলেন:  

রাসূলুল্লাহ (দ:)’র সাহাবা-এ-কেরামের (রা:) সাথে কারোরই তুলনা চলে না; আমীরে মু’আবিয়া (রা:) (একাধারে) তাঁর সাহাবী, সম্মুন্দি, কাতেব এবং আল্লাহর ওহী সংরক্ষণের আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব। 

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে খলীফা উমর ফারূক্ব (রা:) তাঁকে তাঁর ভাই এয়াযীদের ইন্তেক্বালের পরিপ্রেক্ষিতে শা’ম (সিরিয়া) দেশের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন; আর একইভাবে খলীফা উসমান যিন্নূরাইন (রা:)-ও তা করেছিলেন। এটাই যথেষ্ট প্রমাণ যে খলীফাবৃন্দের দৃষ্টিতে আমীরে মু’আবিয়া (রা:) সুযোগ্য ছিলেন। আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি সাহাবা (রা:)-বৃন্দের আর কী প্রশংসা যোগ করা যায় এই বাস্তবতা ছাড়া যে তাঁদের কেউ কেউ এবং মহান উত্তরসূরীদের অনেকে তাঁর কাছ থেকে হাদীস সংকলন করেছিলেন, যা পরবর্তী কোনো অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করা হবে। 

হযরত আলী (ক:) ও জ্যেষ্ঠ সাহাবামণ্ডলীর (রা:) প্রশংসা

মুহাম্মদ ইবনে নাসর আল-মারওয়াযী বর্ণনা করেন ‘তা’যীম ক্বদর আল-সালাহ’ পুস্তকে (২:১৩৪):

খলীফা আলী (ক:) যেসব মানুষ বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁদের সম্পর্কে প্রিয়নবী (দ:) হতে বর্ণনা করেছেন যা কিছু তিনি বর্ণনা করেছেন, আর তিনি তাঁদেরকে ঈমানদার বলেছেন এবং ঈমানদারদের বিধান মোতাবেক হুকুম তথা শাসন জারি করেছেন; আর একইভাবে হযরত আম্মার ইবনে এয়াসের (রা:)-ও (তা-ই করেছেন)।

’তা’যীম ক্বদর আল-সালাহ’ পুস্তকে (৩৬১) মুহাম্মদ ইবনে নাসর আল-মারওয়াযী বর্ণনা করেন ক্বায়স ইবনে মুসলিম হতে, তিনি তা’রিক্ব ইবনে শিহা’ব হতে, যিনি বলেন:

كنت عند علي حين فرغ من قتال أهل النهروان، فقيل له: أمشركون هم؟! قال: مِنَ الشرك فرُّوْا، فقيل: منافقون؟ قال: المنافقون لا يذكرون الله إلاّ قليلاً، قيل: فماهم؟ قال: قوم بغوا علينا، فقاتلناهم.

আমি হযরত আলী (ক:)’র সাথে ছিলাম যখন নাহরাওয়া’নের যুদ্ধ শেষ হয় এবং তাঁকে (ওই সময়) জিজ্ঞেস করা হয়, “এঁরা কি মুশরিক?” তিনি জবাবে বলেন, “শির্ক হতে তাঁরা ছিলেন পলায়মান।” অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, “(তাহলে কি) মুনাফেক্ব?” তিনি উত্তর দেন, “মুনাফেক্ব-বর্গ আল্লাহকে স্মরণ করে না, সামান্যটুকু ছাড়া।” এমতাবস্থায় তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তাঁরা তাহলে কী? আর তিনি উত্তর দেন, ”আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী এক দল মানুষ এবং আমরা তাঁদের সাথে লড়েছি।”

ওই বর্ণনাকারী অনুরূপ একটি বিবরণ উদ্ধৃত করেন এসহাক্ব হতে, তিনি ওয়াকী’ হতে, তিনি মিস’আর হতে, তিনি আমির ইবনে শাক্বীক্ব হতে, তিনি আবূ ওয়া’ঈল হতে, যিনি বলেন:

এক ব্যক্তি বলেন, “মুশরিকদের সাথে যেদিন লড়াই করা হয়, সেদিন কে ধূসর বর্ণের খচ্চরকে আহ্বান করেছিলেন?” এমতাবস্থায় হয়রত আলী (ক:) বলেন, “তাঁরা শির্ক হতে ছিলেন পলায়মান।” তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, “(তাহলে কি) মুনাফেক্ব?” তিনি জবাব দেন, “মুনাফেক্ব-বর্গ আল্লাহকে স্মরণ করে না, সামান্যটুকু ছাড়া।” অতঃপর প্রশ্ন করা হয় তাঁরা কী? আর তিনি উত্তর দেন, “আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী এক দল মানুষ এবং আমরা তাঁদের সাথে লড়ে তাঁদের ওপর বিজয়ী হয়েছি।”

‘তা’যীম ক্বদর আল-সালাহ’ পুস্তকে ওই বর্ণনাকারী আরো বর্ণনা করেন এসহাক্ব হতে, তিনি আবূ নু’আইম হতে, তিনি সুফিয়ান হতে, তিনি জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর বাবা হতে, যিনি বলেন:

জামাল বা সিফফীনের যুদ্ধে হযরত আলী (ক:) এক ব্যক্তিকে সীমা লঙ্ঘন করে (বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে) বলতে শোনেন। তাই তিনি বলেন, “ভালো ছাড়া অন্য কিছু বোলো না। তাঁরা হচ্ছেন এমন এক দল মানুষ যাঁরা দাবি করছেন আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি; আর আমরা বলছি তাঁরা আমাদেরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন এবং এ বিষয়ের ওপরই আমরা তাঁদের সাথে লড়াই করেছি।”

মুহাম্মদ ইবনে নাসর অাল-মারওয়াযী উক্ত ‘তা’যীম ক্বদর আল-সালাহ’ পুস্তকে আরো বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে এয়াহইয়া হতে, যিনি বলেন: আহমদ ইবনে খালেদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; যিনি বলেন মুহাম্মদ ইবনে রা’শিদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন মাকহূল হতে এই মর্মে যে, হযরত আলী (ক:)’র সাথীবৃন্দ তাঁকে মু’আবিয়া (রা:)’র সাথীবৃন্দ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন (যে তাঁদের ব্যাপারে ফায়সালা কী হবে)? তিনি উত্তর দেন, “তাঁরা ঈমানদার।”       

আল-মারওয়াযী ‘তা’যীম ক্বদর আল-সালাহ’ পুস্তকে আরো বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে এয়াহইয়া হতে, তিনি আহমদ ইবনে খালেদ হতে, তিনি আবদুল আযীয ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে আবী সালামাহ হতে, তিনি আবদুল ওয়া’হিদ ইবনে (আবী) আওন হতে, যিনি বলেন: 

হযরত আলী (ক:) সিফফীনের যুদ্ধে শহীদানকে অতিক্রম করার কালে আল-আশতারের পাশে ঝুঁকেন, আর তিনি সেখানে হা’বিস আল-এয়ামা’নীকে শহীদ অবস্থায় দেখতে পান। এমতাবস্থায় আল-আশতার দাবি করেন, ‘আমরা আল্লাহরই মালিকানাধীন এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাবো; হা’বিস আল-এয়ামা’নী তাঁদের সাথেই আছেন, এয়া (হে) আমীর আল-মো’মিনীন। তাঁর রয়েছে মু’আবিয়া (রা:)’র চিহ্ন। আল্লাহর শপথ, আমি সব সময়ই তাঁকে ঈমানদার বলে জানতাম।’ হযরত ইমামে আলী (ক:) জবাবে বলেন, “আর তিনি এখনো ঈমানদার। হা’বিস সেই ইয়েমেনবাসীর মধ্য হতে আগত ছিলেন, যাঁরা ধার্মিকতা ও ধর্মের অনুশীলনে কঠিন সাধনারত।” [বইটির সম্পাদক বলেন: আবদুল আযীয হচ্ছেন ইবনে আল-মা’জিশূন; তাঁর নামের ব্যাপারে অতিরিক্ত তথ্য নেয়া হয়েছে ‘আল-তাহযীব’ পুস্তক হতে; আর তাঁর শিক্ষকদের নামের ব্যাপারে দ্বিতীয় অতিরিক্ত ব্যাখ্যা এসেছে ‘আল-মিনহাজ’ ও ‘আল-তাহযীব’ বইগুলো হতে] 

মুহাম্মদ ইবনে নাসর বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে এয়াহইয়া হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে উবায়দ হতে, তিনি আল-মুখতার ইবনে না’ফি’ হতে, তিনি আবূ মাতার হতে, যিনি বলেন:

হযরত আলী (ক:) বলেন, “এদের মধ্যে সবচেয়ে বাজে লোকটি কবে সহিংসভাবে গজিয়ে উঠবে?” তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, “কে সবচয়ে বাজে লোক?” তিনি উত্তর দেন, “যে ব্যক্তি আমাকে শহীদ করবে।” অতঃপর ইবনে মুলজিম তাঁকে নিজের তরবারি দ্বারা আঘাত করে এবং ওই আঘাত হযরত আলী (ক:)’র শির মোবারকে এসে লাগে; এমতাবস্থায় মুসলমানবৃন্দ ইবনে মুলজিমকে হত্যা করতে চান। কিন্তু হযরত আলী (ক:) তাঁদেরকে বাধা দিয়ে বলেন, “এই লোকটিকে মেরো না; কেননা আমি যদি সেরে উঠি তাহলে তা হবে (আমার) ক্ষতগুলোর জন্যে প্রতিবিধান; আর যদি আমি শহীদ হই তাহলে তাকে হত্যা কোরো।” ইবনে মুলজিম তখন বলে, “আপনি (তাহলে) মৃত।” হযরত আলী (ক:) উত্তর দেন, “তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে?” এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, “আমার তরবারিতে বিষ মাখানো ছিলো।”

মুহাম্মদ ইবনে নাসর নিজস্ব সনদে বর্ণনা করেন আম্মার ইবনে এয়াসের (রা:) হতে এই মর্মে যে জনৈক ব্যক্তি এসে বলে, শা’ম রাজ্যের মানুষ কুফর/অবিশ্বাস সংঘটন করেছেন। এমতাবস্থায় হযরত আম্মার (রা:) উত্তর দেন:

এ কথা বোলো না; আমাদের ক্বিবলাহ একই, রাসূল (দ:)-ও একই। তবে তাঁরা এমন এক জনগোষ্ঠী যাঁরা ফিতনায় ক্ষতিগ্রস্ত; আর তাই এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য তাঁদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে তাঁদের সাথে লড়াই করা।

ওই রাবী/বর্ণনাকারী আলাদা আরেকটি সনদে হযরত আম্মার ইবনে এয়াসের (রা:) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন:

আমাদের ক্বিবলাহ একই, আমার রাসূল (দ:)-ও একই; আমাদের আহ্বানও একই। তবে তাঁরা এমন একটি দল যাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, আর এই কারণেই তাঁদের সাথে আমাদেরকে লড়তে হয়েছে।

বর্ণনাকারী আলাদা আরেকটি সনদে বর্ণনা করেন রাএয়াহ ইবনে আর-হা’রিস হতে, তিনি হযরত আম্মার ইবনে এয়াসের (রা:) হতে, যিনি বলেন:

এমন কথা বোলো না যে শা’ম রাজ্যের মানুষ অবিশ্বাস/কুফরি করেছেন; বরঞ্চ বলো তাঁরা ফিসক্ব/পাপ কিংবা জুলুম সংঘটন করেছেন। 

মুহাম্মদ ইবনে নাসর বর্ণনা করেন হারূন ইবনে আব্দিল্লাহ হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে উবায়দ হতে, তিনি মি’সার হতে, তিনি সাবেত ইবনে আবী হুদায়ল হতে এই মর্মে যে তিনি আবূ জা’ফরকে জঙ্গে জামাল (উটের যুদ্ধ)-এর মানুষদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন (এদের ব্যাপারে ফায়সালা কী হবে)। আর তিনি উত্তর দেন – “মু’মেনীন” (বিশ্বাসীবৃন্দ) কিংবা “অবিশ্বাসী নন।”

ওই বর্ণনাকারী পৃথক পৃথক আরো দুটি সনদেও আবূ জা’ফর হতে ওপরে উদ্ধৃত বিবরণের বক্তব্যগুলো বর্ণনা করেন। 

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর প্রতি সর্ব-ইমাম হাসান (রা:), হুসাইন (রা:), তাঁদের পরিবার-পরিজন ও বাকি সাহাবাবৃন্দের (রা:) আনুগত্যের শপথ:

এই অংশে কিছু বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হবে, যা পাঠকমণ্ডলী নিচে দেখতে পাবেন।

প্রথমতঃ ইমাম হাসান (রা:) স্বেচ্ছায় এবং কোনো প্রকার চাপ ছাড়াই আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি আনুগত্যের শপথ ব্যক্ত করেছিলেন। এর প্রমাণ হলো এই বাস্তবতা যে, ইমাম হাসান (রা:)’এর অধীনে গোটা ইরাক্বী সেনাবাহিনী ছিলো; আর তারা তাঁর পিতা হযরত আলী (ক:)’র বেসালপ্রাপ্তির পরে তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো; এমতাবস্থায় যে কোনো ধরনের প্রয়োজনীয় সাহায্য তারা তাঁকে প্রদান করতে প্রস্তুত ছিলো। সমাজের একমাত্র অভদ্র ও গুণ্ডা-বদমাইশ প্রকৃতির লোকেরাই তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছিলো; আর এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা যে মানুষেরা বিরোধী পক্ষের প্রতি আনুগত্য বদল করে থাকে। তবে এটা ইঙ্গিত করে যে ইমাম হাসান (রা:) নিজস্ব স্বাধীন মতানুযায়ী আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁকে তা করতে কোনো রকম ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বাধ্য করা হয়নি। এ কাজটি তিনি করেছিলেন নিরীহ মুসলমানদের রক্ত ঝরানো ও অভ্যন্তরীণ বিভেদের প্রতি অসন্তুষ্টিস্বরূপ। নতুবা তিনি ইচ্ছা করলে লড়াই চালিয়ে যেতে পারতেন, কিংবা অন্ততঃপক্ষে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ এড়াতে আত্মগোপন করতে পারতেন (বঙ্গানুবাদকের নোট: এটা একেবারেই অসম্ভব; কেননা ইমাম হাসান (রা:) ও ইমাম হুসাইন (রা:) অসীম সাহসী বীর ছিলেন; তাঁরা কাউকেই ভয় পাবার মতো ছিলেন না)। ইমাম হাসান (রা:) জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওই শপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

এই বিষয়টিকে আরো যে জিনিসটি সমর্থন করে তা হচ্ছে এ বাস্তবতা যে, ইমাম হাসান (রা:)’এর পক্ষে তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন (রা:) ও বাকি পরিবারসদস্যদের মতো যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। এ কথা কি বলা যাবে যে তাঁদের সবাইকেই ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এতে বাধ্য করা হয়েছিলো? হ্যাঁ, ইমাম হাসান (রা:) যে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন, এ বিষয়টিকে অনেকে অপছন্দ করেছিলো। কিন্তু তারা যখন এ ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জেনেছিলো, তখন তাঁকে অনুসরণ করেছিলো এবং আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি অনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো। এমতাবস্থায় এই বছরটিকে ‘জামাআহ’র (ঐক্যের) সাল হিসেবে অভিহিত করা হয়; কেননা সবাই আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হন।

অধিকন্তু, এই ব্যাখ্যার সমর্থন দিয়েছে এ বাস্তবতাও যে, ইমাম হুসাইন (রা:) শপথটির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র বেসাল শরীফ অবধি; আর আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিলো বিশ বছর। ইমাম হুসাইন (রা:) বিদ্রোহ করেন এয়াযীদের শাসনকালে, যেহেতু তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে তিনি অস্বীকার করেন। ওই ঘটনা হযরতে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র শাসনকালের শেষে ঘটেছিলো, যখন তিনি তাঁর পরে এয়াযীদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে মানুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইমাম হুসাইন (রা:)-সহ অনেক সাহাবী (রা:) শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। ইমাম হুসাইন (রা:) তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর অটল ছিলেন – যতোক্ষণ না তিনি নিজ মহৎ পরিবারসদস্যদের একটি ছোট দলসহ বিদ্রোহ করেন; আর এটা তখনই ঘটেছিলো যখন তাঁর কুফাবাসী শীয়া’হ গোষ্ঠী তাঁকে ধোকা দিয়েছিলো আনুগত্য ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দ্বারা; এভাবেই ইমাম হুসাইন (রা:)’এর দুর্ভাগ্যজনক পরিসমাপ্তি ঘটে, নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। এক্ষণে লক্ষ্য করুন, আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি ইমাম হাসান (রা:)’এর আনুগত্যের শপথ হতে এই ঘটনা কতোখানি আলাদা ধরনের। তাঁর সময়কালে তাঁরই হুকুমের অধীন একটি গোটা বাহিনী ছিলো, যারা তাঁর নির্দেশে লড়াই করতে এবং তাঁকে রক্ষা করতে ছিলো প্রস্তুত। এই কারণেই ইমাম হাসান (রা:) তাঁর পরিবারভুক্ত বা বাইরের অন্য কাউকেই এ কথা বলেননি যে তাঁর শপথটি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে আদায় করা হয়েছিলো; আর এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় তাঁদের কাছে, যাঁরা এসব ঘটনার ইতিহাস পাঠ করেছেন। 

দ্বিতীয়তঃ আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’কে সমালোচনা করে কাফের/অবিশ্বাসী ঘোষণা করতেও যারা কুণ্ঠিত হয় না, তাদের জন্যে ওপরে যা আলোচনা করা হয়েছে তা একটা স্পষ্ট খণ্ডনমূলক জবাব। এটা কি ধারণা করা যায় যে সর্ব-ইমাম হাসান (রা:) ও হুসাইন (রা:) এবং তাঁদের পক্ষাবলম্বনকারী ব্যক্তিবৃন্দ সবাই একজন কাফেরের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন? না, এটা কোনোভাবেই ধারণাযোগ্য হতে পারে না!

তৃতীয়তঃ হযরতে আমীরে মু’আবিয়া (রা:) যখন শাসনভার গ্রহণ করেন এবং সমগ্র উম্মত তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন, তখন তিনি ধর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মধ্যে কোনো রকম পরিবর্তন সাধন করেননি। ফলে ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো (যথারীতি) প্রতিফলিত হতে থাকে এবং দ্বীনী বিষয়াদিরও বিকাশ সাধিত হয়। নামাযের আযান যথারীতি বহাল থাকে এবং নামাযও আদায় হয়, যাকাত-ও সংগৃহীত হয়, মানুষেরা রোযাও রাখে এবং হজ্জ্ব-ও পালিত হয়। আমীরে মু’আবিয়া (রা:) নিজে (কোনো বছর) হজ্জ্বব্রত পালন করতে না পারলে তাঁর পক্ষে প্রতিনিধি পাঠাতেন। বস্তুতঃ রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জ্বেহাদ তখনো চলছিলো। কতিপয় সাহাবা (রা:) কনস্টানটিনোপল (কুসতুনতুনিয়া/আধুনিক ইস্তাম্বুল) জয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর অভিযানে যোগ দেন; (বাইজেন্টাইনীয়) রোমানদের বিরুদ্ধে ওই অভিযান এমনই এক পর্যায়ের ছিলো যে সাহাবী হযরত আবূ আইয়ূব আল-আনসারী (রা:)‘কে তাঁর নিজের অনুরোধে সেখানেই দাফন করা হয়েছিলো। আর তা হযরতে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি যারা অভিযোগ উত্থাপন করে, তাদের প্রতি এক সুস্পষ্ট খণ্ডন। কেননা এই লোকেরা যা দাবি করে ঘটনা যদি তা-ই হতো, তাহলে তিনি জোরে আযান দেয়া বন্ধ করে দিতেন; নামায-রোযা পালনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হতো, যাকাতের স্থলে করারোপ করা হতো, আর হজ্জ্বব্রত পালন পরিত্যক্ত হতো এবং জ্বেহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্যেও কোনো সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হতো না।

চতুর্থতঃ আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র শাসনামলে এবং হযরত ইমামে আলী (ক:)’র সাথে তাঁর যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি কখনোই রোমানদের কাছ থেকে সাহায্য চাননি; হযরত আলী (ক:)’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের (রোমানদের) সাথে হাত মেলাতেও তিনি চাননি। এ কাজ করা হতে যে বিষয়টি তাঁকে বাদ সেধেছিলো, তা হচ্ছে তাঁরই ইসলাম ও ঈমানদারি। কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে তিনি কীভাবে অ-মুসলমানদের সাহায্য চাইতে পারতেন? নতুবা তাঁর ইচ্ছা পূরণে কিংবা খামখেয়ালিপূর্ণ সাধ থেকে থাকলে তা মেটাতে তাঁর সামনে কোনো বাধা-ই ছিলো না।

পঞ্চমতঃ আমীরে মু’আবিয়া (রা:) ছিলেন শিক্ষিত সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)’এর মধ্য হতে একজন এবং এই উম্মতের কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিত্ব; অধিকন্তু তিনি আল-ক্বুরআনের তাফসীরকারক-ও বটেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) তাঁকে بأنه فقيه كما سبق ‘ফক্বীহ ও ধর্মীয় বিষয়াবলীতে গভীর জ্ঞানী’ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন, যা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।

আল-খাল্লাল নিজ ‘আল-সুন্নাহ’ পুস্তকে (৪৩৮ পৃষ্ঠায়) মুহাম্মদ ইবনে হাতীন হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন মুহাম্মদ ইবনে যুনবূর বলেছেন: 

قال الفضيل: أوثق عملي في نفسي ـ حب أبي بكر و عمر و أبي عبيدة بن الجراح و حبي أصحاب محمد عليهم السلام جميعاً . و كان يترحم على معاوية، و يقول : كان من العلماء من أصحاب محمد عليه السلام .         

অর্থ: আল-ফুযায়ল (রহ:) বলেন, “আমার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আমল/কর্ম হলো সর্ব-হযরত আবূ বকর (রা:), উমর (রা:), আবূ উবায়দাহ ইবনে আল-জার্রাহ (রা:)’র প্রতি আমারই মহব্বত; এবং প্রিয়নবী (দ:)’র সকল সাহাবা (রা:)’বৃন্দের প্রতি আমার ভালোবাসাও।” আর তিনি আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র প্রতি খোদার রহমত কামনা করতেন (দুআয়)। তিনি বলতেন, “আমীরে মু’আবিয়া (রা:) রাসূলে পাক (দ:)’এর সাহাবা-মণ্ডলীর (রা:) মাঝে জ্ঞানী-গুণীজন ছিলেন।”

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি: হযরত ফুদায়ল হচ্ছেন ইবনে আইয়াদ, আর তিনি ছিলেন তাঁর যুগের মানুষের কাছে অন্যতম সেরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর ‘যুহদ’ (কৃচ্ছ্বব্রত) ও এবাদত-বন্দেগীর জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং (সাহাবাবৃন্দের) পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরসূরীদের (তাবে’ তাবেঈনের) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র শরঈ সিদ্ধান্ত ও ফিক্বহী বিষয়াদির জ্ঞান ও সমঝদারি সম্পর্কে সমস্ত (ওপরে) বর্ণনা করা হয়েছে, যা তাঁর থেকে জানা যায় এবং উলামাবৃন্দের বইপত্রে বিদ্যমান। ইনশা’আল্লাহ এগুলোর কিছু কিছু পরবর্তী সময়ে উল্লেখ করা হবে; আর ইবনে হাযম তাঁকে শরঈ ফতোয়া প্রদানকারী সাহাবাবৃন্দের (রা:) মধ্যে মধ্যম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলে চিহ্নিত করেন। 

অধিকন্তু, তিনি ছিলেন রওয়ায়াত/হাদীস বর্ণনাকারী এবং মহানবী (দ:)’র সাহাবাবৃন্দ (রা:) তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করতেন।

আবূ নু’য়াইম আল-এসফাহানী নিজ ‘মা’রেফাত আল-সাহা’বাহ’ পুস্তকে (৫:২৪৯৭) সে সকল সাহাবা (রা:) ও তাবেঈনের (রহ:) নাম উল্লেখ করেছেন, যাঁরা আমীরে মু’আবিয়া (রা:) হতে হাদীস বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেন: 

সাহাবা (রা:)’মণ্ডলীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:), আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:), আবূ দার্দা (রা:), জারীর (রা:), আল-নু’মান (রা:), ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনে আল-’আস (রা:), ওয়া’ইল ইবনে হুজর (রা:) ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রা:) [নোট: সর্ব-হযরত আবূ সাঈদ (রা:) ও জারীর (রা:) উভয়েরই বর্ণনাগুলো মুসলিম শরীফে বিদ্যমান; হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)’এর বিবরণ রয়েছে বুখারী ও মুসলিম শরীফে; অার কম বয়সী সাহাবীদের মধ্যে আল-সা’য়েব ইবনে এয়াযীদ (রা:)’এর বর্ণনা মুসলিম শরীফে পাওয়া যায়]। তাবেঈনদের মধ্যে বর্ণনাকারীবৃন্দ হলেন সর্ব-হযরত সাঈদ ইবনে মূসা’ইয়্যেব (রহ:), আল-ক্বামাহ ইবনে ওয়াক্বক্বা’স (রহ:), উরওয়াহ ইবনে আল-যুবায়র (রহ:), মুহাম্মদ ইবনে আল-হানাফিয়্যাহ (রহ:), ঈসা’ ইবনে তালহাহ (রহ:), হুমায়দ ইবনে ‘আবদ আল-রাহমান (রহ:), আবূ সালামাহ ইবনে আবদ আল-রাহমান (রহ:), সা’লিম ইবনে আবদ-আল্লাহ (রহ:), ক্বা’সিম ইবনে মুহাম্মদ (রহ:) প্রমুখ।     

ইবনে হাযম নিজ প্রসিদ্ধ ‘আসমা’ আল-সাহা’বাহ আল-রুওয়া’ত’ পুস্তিকার ২৭৭ পৃষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বর্ণিত ১৬৩টি আহাদীসের কথা উল্লেখ করেন।

ইবনে আল-ওয়াযীর আল-এয়ামানী তাঁর ‘আল-আওয়া’সিম মিনাল-ক্বাওয়া’সিম’ পুস্তকে আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র রওয়ায়াত/বিবরণগুলোর উল্লেখ করেন এবং সেগুলোর ওপর নিজস্ব বিশেষজ্ঞ মতামতও বিস্তারিতভাবে প্রদান করেন। তিনি নিজ ‘আল-রওদ আল-বা’সিম’ কিতাবে ওর সংক্ষিপ্ত-সার উল্লেখ করেন, যাঁর মন্তব্যসমূহ পরবর্তী সময়ে উদ্ধৃত হবে, আল্লাহরই অনুমতিক্রমে।

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র জ্ঞান-গভীরতা ইঙ্গিত করে এমন প্রমাণসমূহের কিছু অংশ এগুলো – যে জ্ঞান তাঁরই ফতোয়া (শরীয়তের বিধানজ্ঞাপক রায়) ও তাঁরই দ্বারা আল্লাহর দিকে (মানুষকে) আহ্বান ও মন্দ হতে (তাদেরকে) বারণের দায়িত্ব পালনসম্পর্কিত নক্বলী দলিল (প্রামাণিক তথ্য) হতে এসেছে। এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

১/ ما أخرجه البخاري من طريق محمد بن جعفر قال: حدثنا شعبة عن أبي التياح قال سمعت حمران بن أبان يحدث عن معاوية رضي الله عنه قال: إنكم لتصلون صلاة لقد صحبنا رسول الله (صلى الله عليه وسلم) فما رأيناه يصليها، ولقد نهى عنها. يعني الركعتين بعد العصر  

আল-বুখারী (৫৮৭) বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে জা’ফর হতে, যিনি বলেন: শু’বাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবূ তাইয়াহ হতে, যিনি বলেছেন: আমি হুমরা’ন ইবনে আবা’নকে বর্ণনা করতে শুনেছি আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কথা: “নিশ্চয় তোমরা এমন কোনো সালাত/নামায আদায় করো; আর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সোহবত/সান্নিধ্যে ছিলাম, অথচ তাঁকে তা আদায় করতে দেখিনি। (বরঞ্চ) তিনি তা নিষেধ করতেন; মানে আসরের নামাযের পরে দুই রাকআত।”

২/ আল-বুখারী (৫৯৩২) বর্ণনা করেন ইসমাঈল হতে, তিনি মালিক হতে, তিনি ইবনে শিহাব হতে, তিনি হুমায়দ ইবনে আবদ আল-রাহমান ইবনে আউফ হতে, যিনি বলেন যে তিনি আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলতে শুনেছেন এই মর্মে যে তিনি ওই বছর হজ্জ্ব পালন করেন; আর মিম্বরে থাকা অবস্থাতেই তিনি এক প্রহরীর কাছ থেকে এক গুচ্ছ নকল চুল নিয়ে বলেন:

أين علماؤكم سمعت رسول الله (صلى الله عليه و سلم) ينهى عن مثل هذا ويقول: إنما هلكت بنو إسرائيل حين اتخذ هذا نساؤهم

অর্থাৎ, তোমাদের আলেম-উলামা কোথায়? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে এ জাতীয় বস্তুর প্রতি নিষেধসূচক আজ্ঞা প্রদান করতে শুনেছি; তিনি বলেছেন, “বনী ইসরাঈল জাতির বিনাশ সাধন তখনই হয়েছে, যখন তাদের নারীকুল এটা গ্রহণ করেছিলো।” [এছাড়া সহীহ মুসলিম, ২১২৭]

৩/ ইমাম আহমদ (৪:৯৬) বর্ণনা করেন ইবনে জুরায়জ হতে, যিনি বলেন: আমর ইবনে আতা ইবনে আবী আল-খুওয়ার বর্ণনা করেছেন তাঁর কাছে এই মর্মে যে নাফি’ ইবনে জুবায়র তাঁকে (আমরকে) আল-সায়েব ইবনে এয়াযীদের কাছে প্রেরণ করেন এমন একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে, যা তিনি আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’কে নামাযে থাকাকালীন অবস্থায় করতে দেখেছিলেন। অতঃপর আল-সায়েব উত্তর দেন:

فقال: نعم صليت معه الجمعة في المقصورة، فلما سلم قمت في مقامي و صليت. فلما دخل أرسل إلي، فقال: لا تعد لما فعلت إذا صليت الجمعة فلا تصلها بصلاة حتى تتكلم أو تخرج فإن نبي الله (صلى الله عليه وسلم) أمر بذلك. لا توصل بصلاة حتى تخرج أو تتكلم

অর্থ: হ্যাঁ, আমি ‘মাক্বসূরাহ’তে তাঁর সাথে জুমুআর নামায আদায় করেছিলাম। (ফরয) নামাযশেষে আমি দাঁড়িয়ে (সুন্নাহ) নামায পড়ি। তিনি (আমীরে মু’আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু অানহু) প্রবেশ করে আমাকে ডাকেন এবং বলেন, “আর কখনো এ রকম কোরো না। তোমার জুমুআ’র নামায পড়া সম্পন্ন হলে (অতিরিক্ত) নামায পড়ো না, যতোক্ষণ না তুমি কথা বলেছো কিংবা তোমার জায়গা হতে সরেছো; কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এটা করতে আদেশ দিয়েছিলেন। (ফরয ও সুন্নাহ) নামাযগুলো (একের অব্যবহিত পরে অপরটি) সংযুক্ত কোরো না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তুমি তোমার স্থান ত্যাগ করেছো বা কথা বলেছো।” এই রওয়ায়াত ইমাম মুসলিমও বর্ণনা করেছেন ইবনে জুরায়জ হতে, যিনি বলেন: আমর ইবনে আতা আমাদের কাছে বর্ণনা করেন (একই এসনাদ-সহ)।

৪/ ইমাম আহমদ (মুসনাদ, ৪:১০০) বর্ণনা করেন মারওয়ান ইবনে মুআবিয়া আল-ফাযারী হতে; তিনি বলেন, হাবীব ইবনে আল-শাহীদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আবূ জিলায হতে, যিনি বলেন আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) একবার (দরবারস্থল) ত্যাগ করেন এবং সবাই তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যান, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন:

فقال: سمعت رسول الله (صلى الله عليه وسلم) يقول: من سره أن يتمثل له الرجال قياماً فليتبوأ مقعده من النار-

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: “যে ব্যক্তি তার জন্যে মানুষের উঠে দাঁড়ানোর কারণে খুশি হয়, সে যেনো জাহান্নামে নিজের আবাসস্থলের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে।”

ইমাম তিরমিযী (২৭৫৫)-ও এটা বর্ণনা করেন ক্বাবীসাহ’র সূত্রে, তিনি সুফিয়ান হতে, তিনি হাবীব হতে ওপরের (একই) এসনাদ-সহ; আর ইমাম তিরমিযী (রহ:) এটাকে হাসান শ্রেণিভুক্ত করেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মুসনাদ, ৪:৯৪)-ও বর্ণনা করেন ইসমাঈলের সূত্রে, তিনি হাবীব ইবনে আল-শাহীদ হতে, তিনি আবূ মিজলায হতে এই মর্মে যে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ঘরে প্রবেশ করেন, যেখানে ইবনে আমির ও ইবনে আল-যুবায়র দু জনই উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই ইবনে আমির উঠে দাঁড়ান এবং ইবনে আল-যুবায়র বসে থাকেন। এমতাবস্থায় আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: 

اجلس؛ فإني سمعت رسول الله (صلى الله عليه وسلم) يقول: من سره أن يمثل له العباد قياما؛ فليتبوأ بيتا في النار – 

অর্থ: উপবিষ্ট থাকো! কেননা আমি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে বলতে শুনেছি: “কেউ যদি খুশি হয় এ মর্মে যে আল্লাহর বান্দাবৃন্দ তার জন্যে দণ্ডায়মান হবেন, তাহলে সে যেনো জাহান্নামে নিজের আবাসস্থলের জন্যে প্রস্তুতি নেয়।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ (৪:৯১) পুস্তকের আরেক জায়গায় এটা বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে জা’ফরের সূত্রে, তিনি শু’বাহ হতে, একই অর্থজ্ঞাপক এই বিবরণটি সহ। [বঙ্গানুবাদকের নোট: মহানবী (দ:)’র এই নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু মীলাদ শরীফে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ানো সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিষয়। তালগোল পাকানো উচিৎ নয়] 

৫/ আবূ দাউদ নিজ ‘সুনান’ পুস্তকে (২০৭৪) বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে এয়াহইয়া ইবনে ফারিস হতে, যিনি বলেন: এয়াক্বূব ইবনে ইবরাহীম আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন: আমার পিতা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইবনে এসহাক্ব হতে, যিনি বলেন যে আবদুর রহমান ইবনে হুরমুয আল-আ’রাজ তাঁর কাছে বর্ণনা করেন যে আব্বাস ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে আব্বাস নিজ কন্যাকে আবদুর রহমান ইবনে আল-হাকামের কাছে বিয়ে দেন, আর তিনি পাল্টা তাঁর কন্যাকে আব্বাসের কাছে বিয়ে দেন; আর এটাই দেনমোহর হিসেবে ধার্য হয়। এমতাবস্থায় আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাদের বিচ্ছেদের নির্দেশনা দিয়ে মারওয়ানের কাছে পত্র লেখেন; তাতে তিনি লেখেন:

هذا الشغار الذي نهى عنه رسول الله (صلى الله عليه وسلم) –

অর্থ: এটাই ’শিগার’ (কারো নারী আত্মীয়কে অন্যের সাথে বিয়ে দেয়া এই শর্তে যে ওই ব্যক্তিও নিজের কোনো নারী আত্মীয়কে তার সাথে পাল্টাপাল্টি বিয়ে দেবে এবং এটাই মোহরানা হবে), যা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করেছিলেন।” ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও এটা বর্ণনা করেন (মুসনাদ, ৪:৯৪) ইবরাহীম ইবনে সাআদের সূত্রে; এই একই এসনাদ-সহ।

৬/ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (৪:৯৩) বর্ণনা করেন হাশিম ইবনে আল-ক্বাসিম হতে, যিনি বলেন: হারিয আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আবদুর রহমান ইবনে আবী আউফ আল-জুরাশী (রা:) হতে, তিনি হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন:

 قال: رأيت رسول الله (صلى الله عليه وسلم) يمص لسانه ـ أو قال: شفته ـ يعني: الحسن بن علي صلوات الله عليه؛ وإنه لن يعذب لسان أو شفتان مصهما رسول الله (صلى الله عليه وسلم)

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে তাঁর (ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র) জিহ্বা বা ঠোঁট চুম্বন করতে দেখেছি; আর ওই জিহ্বা বা ঠোঁট যা’তে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চুম্বন করেছেন, তা কখনোই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে না।

৭/ ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ ‘মুসনাদ’ (৪:৯৪) পুস্তকে বর্ণনা করেন আলী ইবনে বাহর হতে, যিনি বলেন: আল-ওয়ালীদ ইবনে মুসলিম আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে আল-’আলা আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আবূল আযহার হতে, তিনি হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এই মর্মে যে আমীরে মুআবিয়া (রা:) তাঁদের কাছে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র অযূ’র কথা উল্লেখ করেছেন, যা’তে হুযূর পাক (দ:) নিজ শির মোবারক এক হাতভর্তি পানি দ্বারা মসেহ করতেন এমনিভাবে, যার দরুন পানি শির মোবারক হতে গড়িয়ে পড়তো বা প্রায় গড়িয়ে পড়তো। অতঃপর আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বাস্তবে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কীভাবে অযূ করতেন তা করে দেখান; আর যখন তিনি মাথা মসেহ করার পর্যায়ে আসেন, তখন তিনি তাঁর দু হাত নিজ পবিত্র শিরের সম্মুখভাগে স্থাপন করেন এবং পেছন দিকে ঘাড়ের ভিত্তি পর্যন্ত নিয়ে আবার আরম্ভের পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরিয়ে নেন। এর আরবী এবারত নিম্নরূপ:

وقال الإمام أحمد في مسنده: حدثنا علي بن بحر حدثنا الوليد بن مسلم قال: حدثنا عبد الله بن العلاء عن أبي الأزهر عن معاوية أنه ذكر لهم وضوء رسول الله (صلى الله عليه وسلم) وأنه مسح رأسه بغرفة من ماء حتى يقطر الماء من رأسه أو كاد يقطر؛ وإنه أراهم وضوء رسول الله (صلى الله عليه وسلم)؛ فلما بلغ مسح رأسه؛ وضع كفيه على مقدم رأسه؛ ثم مر بهما حتى بلغ القفا؛ ثم ردهما حتى بلغ المكان الذي بدأ منه 

আমীরে মুআবিয়া (রা:)’র সূত্রে আহলে বায়ত (রা:)’বৃন্দের রওয়ায়াত/বিবরণসমূহ             

আহলে বায়ত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কর্তৃক আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছ থেকে বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করার দৃষ্টান্ত তাঁদের দৃষ্টিতে তাঁর উন্নত গুণাবলী ও আস্থাভাজন হওয়ার বিষয়টি প্রতিফলন করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বিবরণগুলো ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে; আর তাঁর বর্ণিত অন্যান্য রওয়ায়াতের মধ্যে রয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে আহমদের কৃত ‘মুসনাদ’ (৪:৯৭) পুস্তকের ‘যাওয়াঈদ’-এ লিপিবদ্ধ বিবরণটি:

حدثني عمرو بن محمد الناقد حدثنا أبو أحمد الزبيري حدثنا سفيان عن جعفر بن محمد عن أبيه عن ابن عباس عن معاوية قال: قصرت عن رأس رسول الله (صلى الله عليه وسلم) عند المروة  

অর্থ: আমর ইবনে মুহাম্মদ আল-নাক্বিদ হতে বর্ণিত, তিনি আবূ আহমদ যুবাইরী হতে, তিনি সুফিয়ান হতে, তিনি জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে, তিনি আমীরে মুআবিয়া হতে, যিনি বলেন: “আমি মারওয়া এলাকায় মহানবী (দ:)’র শির মোবারক হতে (কয়েকটি) চুল কেটে রেখেছিলাম (মানে সংগ্রহ করেছিলাম)।” এর মূল বর্ণনা রয়েছে আল-বুখারী (১৭৩০) গ্রন্থে, যার সূত্র তা’ঊস, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; তিনি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

এছাড়াও এটা রওয়ায়াত করেন মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব, যিনি ইবনুল হানাফিয়্যাহ নামে সুপরিচিত; আর তাঁর বর্ণনাগুলোর মধ্য হতে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (৪:৯৭) বর্ণনা করেন আফফানের সূত্রে, তিনি হাম্মাদ ইবনে সালামাহ হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আক্বীল হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে আলী (ইবনুল হানাফিয়্যা) হতে, তিনি আমীরে মুআবিয়া (রা:) হতে, যিনি বলেন: 

سمعت رسول الله (صلى الله عليه وسلم) يقول: العمرى جائزة لأهلها

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে বলতে শুনেছি, ‘স্থায়ী বসবাস (স্রেফ) তাদের জন্যেই অনুমতিপ্রাপ্ত, যারা সেটার আহল তথা অধিকারী মানুষ।’

ষষ্ঠতঃ আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র জ্বিহাদ। কেননা তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পাশে থেকে অনেকগুলো বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইবনে সাআদ নিজ ‘তাবাক্বাত’ গ্রন্থে (৭:৪০৬) উল্লেখ করেন:

وشهد مع رسول الله (صلى الله عليه وسلم) حنيناً والطائف

অর্থ: আর তিনি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে সাক্ষী হন হুনাইন ও তাইফ (জ্বেহাদের)।       

উপরন্তু, খলীফা উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উভয়েরই শাসনামলে শা’ম তথা সিরিয়া রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এবং আমীরুল মো’মেনীন হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী সময়কালে পরিচালিত তাঁর সামরিক অভিযানগুলো নিম্নরূপ:

১/ – তিনি খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কাছে সাইপ্রাসে নৌ-অভিযান পরিচালনার অনুমতি চান এবং আল্লাহতা’লা তাঁর হাতেই সাইপ্রাস জয় মঞ্জুর করেন।

আর এই (নৌ) অভিযান সম্পর্কেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন:

أول جيش يغزو البحر قد أوجبوا

অর্থ: প্রথম সমুদ্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী (মুসলমান বাহিনী) বেহেশতী হবে।

ইমাম বুখারী (২৯২৪) হযরত উমাইর ইবনে আল-আসওয়াদ (রহ:)’এর সূত্রে বর্ণনা করেন, যিনি হযরত উবাদাহ ইবনে আল-সা’মিত (রা:)’এর কাছে আসেন; ওই সময় হযরত উবাদাহ (রা:) হিমস্ (পর্বত) হতে অবতরণ করছিলেন নিজস্ব বাহনে; আর তাঁর সাথে ছিলেন হযরত উম্মে হারা’ম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)। উমাইর (রহ:) বলেন: উম্মে হারা’ম (রা:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে বলতে শুনেছেন:

أول جيش من أمتي يغزون البحر قد أوجبوا  

অর্থ: প্রথম নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী (মুসলমান) বাহিনী বেহেশতী হবে।

এমতাবস্থায় হযরত উম্মে হারা’ম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রশ্ন করেন: 

يا رسول الله (صلى الله عليه وسلم) أنا منهم؟ 

অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল (দ:)! আমি কি তাঁদের মধ্য হতে (মানে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত)?

হুযূর পাক (দ:) উত্তরে বলেন: 

 قال: أنت منهم

অর্থ: (হ্যাঁ), তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত।

ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা বর্ণনা করেন আল-লাইস (রহ:) হতে, তিনি হযরত আনাস বিন মা’লেক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে, যিনি তাঁর খালা উম্মে হারা’ম বিনতে মালহা’ন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে রওয়ায়াতটি গ্রহণ করেন; আর বর্ণনাটির শেষে হযরত আনাস বিন মা’লেক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: 

أول ما ركب المسلمون البحر مع معاوية

অর্থ: মুসলমানবৃন্দের প্রথম নৌ অভিযান আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক পরিচালিত হয়।

ইমাম ইবনে হাজর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘ফাতহুল বা’রী’ (৬:৯০) পুস্তকে লেখেন: 

ومعاوية أول من ركب البحر من الغزاة وذلك في خلافة عثمان

অর্থ: এবং আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ই সর্বপ্রথম নৌ অভিযান পরিচালনা্ করেন; আর এটা ছিলো হযরত উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর খেলাফত আমলে। [দেখুন তা’রীখে ইবনে জারীর, ২:৬০১; ইবনে আসা’কির; এবং ইবনে কাসীর, ১০:২২৮]

২/ – কুসতুনতুনিয়া/কনস্টানটিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) নগরীর প্রথম অবরোধ সংঘটিত হয় আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র খেলাফত আমলে, ৪৯ হিজরী সালে। তাঁর প্রেরিত সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন: সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস, ইবনে আল-যুবায়র ও আবূ আইয়ূব আল-আনসা’রী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)। [দেখুন ‘তারীখে ইবনে জারীর, ৩:২০৬]

৩/ – কনস্টানটিনোপল নগরীতে দ্বিতীয় দফা অবরোধ দেয়া হয় ৫৪ হিজরী সালে; এর নেতৃত্বে ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ক্বায়স আল-হা’রিসী (রা:)। তাঁর বাহিনীকে শক্তিশালী করতে আরেকটি বাহিনীসহ আসেন হযরত ফাদা’লাহ ইবনে উবায়দ (রা:)। এই অবরোধ ৬ থেকে ৭ বছর স্থায়ী হয়। [প্রাগুক্ত তারীখে ইবনে জারীর দ্রষ্টব্য]

৪/ – উত্তর আফ্রিকা বিজয় শুরু হয় ৪১ হিজরী সালে। আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মিসরের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হযরত আমর ইবনে আল-আস্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বাইজেন্টাইন ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন; আর তিনি (মিসরের প্রাদেশিক শাসনকর্তা) হযরত উক্ববাহ ইবনে না’ফঈ আল-ফিহরী (রা:)’র নেতৃত্বে একটি সেনাদলকে প্রস্তুত করেন; এই সেনাপতি উত্তর আফ্রিকী অনেক রাজ্য জয় করেন।

৫/ – আমীরে মুআবিয়া (রা:)’র খেলাফত আমলে ক্বায়রোওয়া’ন নগরীর গোড়াপত্তন হয়, যেটা উত্তর আফ্রিকার আরো অনেক অঞ্চল বিজয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

৬/ – আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র শাসনামলে খোরাসান, সিজিস্তান ও কাবুলের মতো মধ্য এশিয়ার অনেক অঞ্চল বিজিত হয়। এসব অভিযান ৪২-৪৩ হিজরী সালের মাঝামাঝি সময়ে আরম্ভ হয়, যখন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমির ইবনে কুরায়য’কে নিয়োগ করেন এবং তিনি খলীফার প্রতিনিধি হন; এছাড়াও যখন আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ ইবনে হাবীব’কে ওই সব এলাকায় নিয়োগ করেন এবং সেখানে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব দেন। মারওয়া শহরটি ছিলো অভিযান পরিচালনার ঘাঁটি এবং সেখানকার প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন হযরত আল-হাকাম ইবনে আমর আল-গিফারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। 

সপ্তমতঃ আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন শরীয়তকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন এবং তিনি ক্বুরআন-সুন্নাহ’র পরিপন্থী সমস্ত কাজকেই নিষেধ করতেন। এটা তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনায় স্পষ্ট হয়, যেখানে তিনি তাঁর এই আচরণ প্রদর্শন করেন; আর এগুলোর কিছু কিছু দৃষ্টান্ত ওপরে আলোচিত হয়েছে, যেখানে তাঁর জ্ঞান ও বর্ণনাগুলো উল্লেখিত হয়েছে। 

অষ্টমতঃ তাঁর প্রদত্ত বর্ণনাগুলোতে রয়েছে সততা, সুনির্দিষ্ট/যথাযথ ও নির্ভুল (তথ্যের) স্বাক্ষর। তিনি তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং তাঁর বিবরণগুলোর ব্যাপারে (কখনোই) অভিযুক্ত হননি। আল-খাল্লাল বর্ণনা করেন ‘আল-সুন্নাহ’ (৪৪৭ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে জিজ্ঞেস করা হয়: জনৈক ব্যক্তি সর্ব-হযরত আমীরে মুআবিয়া ও আমর ইবনে আস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’কে নিয়ে বিদ্রূপ করে থাকে; তাকে রাফেযী (শিয়া) বলা যাবে কি? হযরত ইমাম জবাব দেন:

إنه لم يجترئ عليهما إلا وله خبيئة سوء. اهـ  

অর্থ: তাঁদের (দুই সাহাবীর) সম্পর্কে কিছু বলার সাহস কারোরই নেই; ব্যতিক্রম ওই ব্যক্তি, যে অন্তরে মন্দ অভিলাষ/বিদ্বেষ পোষণ করে।

আল-মিযযী ‘তাহযীব আল-কামা’ল’ পুস্তকে (১:৪৫) বলেন: 

আল-হা’কিম নিজস্ব সনদে আবূল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ আল-ক্বা’বিসী হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন, আমি আবূল হাসান ইবনে হেলালকে বলতে শুনেছি যে ইমাম আবূ আবদ আল-রহমান নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে সাহাবী হযরত আমীরে মুআবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। হযরত ইমাম উত্তরে বলেন:

إنما الإسلام كدار لها باب؛ فباب الإسلام الصحابة، فمن آذى الصحابة إنما أراد الإسلام كمن نقر الباب إنما يريد دخول الدار. قال: فمن أراد معاوية فإنما أراد الصحابة  

অর্থ: নিশ্চয় দ্বীন-ইসলাম একটি দরজাবিশিষ্ট গৃহের মতো। ওই দরজা হলেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)। যে ব্যক্তি তাঁদের ক্ষতি সাধন করে, সে প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্মেরই ক্ষতি সাধন করে, ঠিক যেমনটি কেউ ঘরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে দরজায় টোকা দেয়। (অতঃপর হযরত ইমাম বলেন), যে ব্যক্তি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে (আক্রমণের জন্যে) উদ্দেশ্য করেছে, সে প্রকৃতপক্ষে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’কেই উদ্দেশ্য করেছে।

ইবনে তাইমিয়াহ নিজ ফাতাওয়া (৩৫:৬৬) সংকলনে উল্লেখ করেন:

و قد علم أن معاوية وعمرو بن العاص وغيرهما كان بينهم من الفتن ما كان، ولم يتهمهم أحد من أوليائهم ولا محاربيهم بالكذب على النبي (صلى الله عليه وسلم)، بل جميع علماء الصحابة والتابعين بعدهم متفقين على أن هؤلاء صادقون على رسول الله (صلى الله عليه وسلم)، مأمونون عليه في الرواية عنه، والمنافق غير مأمون على النبي (صلى الله عليه وسلم)، بل هو كاذب عليه، مكذب له ا.هـ.

অর্থ: এটা জ্ঞাত যে কিছু বিষয়ে সর্ব-হযরত আমীরে মুআবিয়া ও আমর ইবনে আস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’এর সাথে অন্যান্যদের মতবিরোধ ছিলো। তবে কেউই তাঁদের দু জনকে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে মিথ্যে আরোপের অভিযোগে অভিযুক্ত করেননি – না তাঁদের সমর্থকবৃন্দ, না বিরোধী মত পোষণকারীবৃন্দ। বস্তুতঃ সকল সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও তাবেঈন (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)-ই এ ব্যাপারে সর্বসম্মত ছিলেন যে, তাঁরা দু জন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে যা রওয়ায়াত/বর্ণনা করেছেন তাতে তাঁরা বিশ্বস্ত/সত্যনিষ্ঠ ছিলেন; (কেননা) হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে কোনো মুনাফেক্ব যা বর্ণনা করে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি মিথ্যে আরোপকারী এবং তাঁর (বাণী প্রচারে) মিথ্যুক (হিসেবে ব্যর্থ) সাব্যস্ত। [ইবনে তাইমিয়াহ]

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে হাদীস বর্ণনা করার সময় হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) খুব সতর্ক ছিলেন এবং বাছ-বিচার করতেন। নিচে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো:

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ ‘মুসনাদ’ (৪:৯৯) গ্রন্থে বর্ণনা করেন ইবনে মাহদী হতে, তিনি মুআবিয়াহ ইবনে সালেহ হতে, তিনি রাবিআহ ইবনে এয়াযীদ হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমির আল-এয়াহসুবী হতে, যিনি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলতে শোনেন:

إياكم وأحاديث رسول الله (صلى الله عليه وسلم) إلا حديثا كان على عهد عمر، وإن عمر رضي الله عنه كان أخاف الناس في الله عز وجل، سمعت رسول الله يقول: من يرد الله به خيرا يفقه في الدين

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র হাদীস হিসেবে তোমরা যা বর্ণনা করো, সে সম্পর্কে সাবধান হও! ব্যতিক্রম ছিলো খলীফা উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাসনামল, যখন তিনি মানুষকে আল্লাহর ভয়ে ভীত করে রেখেছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে বলতে শুনেছি: “আল্লাহতা’লা যার ভালাই চান, তাকে তিনি দ্বীনের ফক্বীহ/সুপণ্ডিত আলেম বানিয়ে দেন।” [সহীহ মুসলিম শরীফ, ১০৩৭]

আল-বুখারী (আল-ফাতহ ১৩:৩৩৩) বর্ণনা করেন যে আবূল এয়ামানী বর্ণনা করেন শুয়াইব হতে, তিনি আল-যুহরী হতে, তিনি হুমায়দ ইবনে আবদির রহমান হতে, যিনি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে মদীনা মোনাওয়ারায় ক্বুরাইশদের একটি দলের মাঝে ভাষণ দিতে শোনেন; তাতে তিনি কা’আব আল-আহবারের কথা উল্লেখ করে বলেন:

إن كان من أصدق هؤلاء المحدثين الذين يحدثون عن أهل الكتاب، وإن كنا مع ذلك لنبلو عليه الكذب ا.هـ

অর্থ: সে আহলে কিতাব তথা ইহুদী জাতিগোষ্ঠী হতে (ঘটনা) বর্ণনাকারীদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যনিষ্ঠ; কিন্তু তবুও আমরা তার বর্ণনার ভ্রান্তির ব্যাপারে সতর্ক হবো।

আল-মারীসী’র প্রতি লেখা (رد على المريسي) রদসূচক পুস্তকের ৩৬৪ পৃষ্ঠায় ইমাম উসমান আল-দা’রিমী (রহ:) বলেন:

“বিরোধী পক্ষ আবূ সলত হতে শুনেছেন মর্মে এ কথা দাবি করেন যে, তিনি (আবূ সলত) বলেছিলেন আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’রও بيت الحكمة – ‘জ্ঞানের গৃহ’ নামে এমন একটি স্থান ছিলো, কারো কাছে (লিখিত) হাদীস থাকলে সেখানে তা সংরক্ষণ করা হতো এবং পরবর্তী সময়ে বর্ণনা করা হতো। তবে এই ঘটনা সম্পর্কে আমরা জানি না, অথবা রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলোতে এর কোনো রেফারেন্স-ও পাই না। অতএব, আমরা জানি না আবূ সলত কার কাছে থেকে তা বর্ণনা করেছেন; কেননা তিনি তা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে বর্ণনা করেননি। এটা এ কারণে যে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সীমিত সংখ্যক বর্ণনার জন্যেই পরিচিত ছিলেন, আর তিনি যদি চাইতেন তাহলে বিপুল সংখ্যক রওয়ায়াত পেশ করতে পারতেন। তবে তিনি তা এড়িয়ে গিয়েছেন। রাসূলে খোদা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে অধিক পরিমাণে হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে তিনি মানুষকে সতর্ক করতেন এই বলে: “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র হাদীস হিসেবে তোমরা যা বর্ণনা করো, সে সম্পর্কে সাবধান হও! ব্যতিক্রম ছিলো খলীফা উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাসনামল, যখন তিনি মানুষকে আল্লাহর ভয়ে ভীত করে রেখেছিলেন।” ইবনে সালিহ (এ কথা) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন মুআবিয়া ইবনে সালিহ হতে; আর তিনি তাঁর সনদ উল্লেখ করেছেন। বিরোধী পক্ষের এ দাবি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র প্রতি এক মহা অপবাদ এই মর্মে যে, তিনি সাবেত/যাচাই-বাছাই না করে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রতি হাদীস আরোপ করতেন। তিনি যদি এ পদ্ধতির অনুমতি দিতেন, তাহলে তিনি এটাকে নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি আরোপ করতেন। অথচ তিনি সাহাবা-এ-রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত রওয়ায়াত হলেই কেবল তা গ্রহণ করতেন এবং আহাদীস সম্পর্কে স্রেফ লোকের কথা গ্রহণ করতেন না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত সীমিত সংখ্যক হাদীস, যদিও তিনি তাঁর কাতেব/ওহী লেখক ছিলেন, এই বিষয়টি ইঙ্গিত করে যে আপনি আবূ সলত হতে যা বর্ণনা করেছেন তাতে অসত্যতা নিহিত ছিলো। আর আপনি যদি সৎ হন, তাহলে সেটার সনদ উল্লেখ করবেন। কেননা নিঃসন্দেহে আপনি তা কোনো যোগ্য বর্ণনাকারী হতে বর্ণনা করবেন না।” [ইমাম দারিমী]

ইমাম ইবনে আল-ওয়াযীর আল-সান’আনী হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেন এবং ব্যাখ্যা করেন যে তিনি এগুলো একা বর্ণনা করেননি। ইমাম আল-সান’আনী নিজ ‘আল-আওয়া’সিম মিনাল ক্বাওয়া’সিম (৩:১৬৩)’ পুস্তকে লেখেন:

وبعد هذه القواعد أذكر لك ما يصدقها من بيان أحاديث معاوية رضي الله عنه في الكتب السنة  لتعرف ثلاثة أشياء: عدم انفراده فيما روى، وقلة ذلك، وعدم نكارته 

অর্থ: এসব নিয়মের পরে আমি তোমার জন্যে উল্লেখ করবো ছয়টি (সহীহ হাদীসের) কিতাব হতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বর্ণিত আহাদীসের সত্যতা সম্পর্কে, যাতে তুমি তিনটি বিষয় উপলব্ধি করতে পারো: ১/ তাঁর বর্ণনা বর্ণনাসমূহে সমর্থিত; ২/ তাঁর বর্ণনা সীমিত সংখ্যক; এবং ৩/ তাঁর বর্ণনাগুলো ‘মুনকার’ নয়।

ইমাম সান‘আনী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) অতঃপর রওয়ায়াত/বিবরণগুলো উল্লেখ করেন এবং ব্যাখ্যা করেন কারা কারা যৌথভাবে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) হতে সেগুলো বর্ণনা করেছিলেন। তিনি তাঁর বইয়ে (৩:২০৭) আরো বলেন:

ثم قال: (فهذا جميع ما لمعاوية في الكتب السنة ومُسند أحمد حسب معرفتي وجملتها ستون حديثاً ما صح عنه وما لم يصح، المتفق على صحته عنه أربعة…) إلى أن قال: (وهو مُقلٌّ جدا بالنظر إلى طول مُدّته، وكثرة مخالطته، وليس فيما يصحُّ عنه بوفاق شيء يوجب الريبة والتهمة، ولا فيما رواه غيره من أصحابه فبان أن الأمر قريب، من قبل حديثهم، فلم يقبل منه حديثا منكراً…) إلى آخر ما قال رحمه الله    

অর্থ: এই হলো আমার জ্ঞানে ছয়টি (সহীহ) হাদীসগ্রন্থ ও ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর মুসনাদ পুস্তকে লিপিবদ্ধ আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বর্ণিত হাদীসের ব্যাপ্তি; যার সর্বমোট সংখ্যা ষাটটি সহীহ ও দুর্বল বিবরণ…তাঁর দীর্ঘ জীবন ও (প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সাথে) প্রচুর আলাপের তুলনায় তিনি খুব অল্প হাদীস-ই বর্ণনা করেছেন; আর (তাঁর বর্ণিত) সহীহ হাদীসগুলোতে উদ্বেগ সৃষ্টির মতো এমন কোনো কিছু নেই, কিংবা সেগুলো তাঁরই বর্ণনাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কোনো কারণ নয়….।

ইমাম সান’আনী (রহ:) ‘আল-রওদ আল-বা’সিম’ (২:৫২৩-৫৪৩) পুস্তকে বলেন:

الطائفة الثالثة: معاوية والمغيرة وعمرو بن العاص، ومن تقدم ذكره في الأوهام، فإن كثيراً من الشيعة ذكروا أنها ظهرت على هؤلاء الثلاثة قرائن تدلّ على التأويل، وقدحوا بتصحيح حديثهم في حديث الكتب الصّحاح كالبخاري ومسلم 

তৃতীয় দলটি আমীরে মু’আবিয়া, মুগীরাহ, আমর ইবনে আল-’আস্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও যাঁদেরকে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুতঃ অনেক শীয়াহ উল্লেখ করেছে যে এই তিনজনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক কারণ বিরাজমান, যেগুলো তা’উয়ীল ইঙ্গিত করে; আর তারা (শীয়াহ-বর্গ) বুখারী ও মুসলিম শরীফের মতো সহীহ হাদীসগ্রন্থগুলোতে ওই তিনজন সাহাবী (রা:)’র বিবরণগুলো সহীহ তথা নির্ভরযোগ্য (বিবেচিত) হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে।

আর আহলে হাদীস গোষ্ঠীর ব্যাপারে (বলতে হয়), তারা হলো তা’উয়ীল (ভিন্নতর ব্যাখ্যা) ও এজতেহা’দের (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী) লোকদের অন্তর্গত, যারা ব্যাখ্যাগুলোকে বোধগম্য পন্থায় প্রকাশ করার চেষ্টায় রত। কিন্তু অন্তর্নিহিত জ্ঞান সকলের কাছ থেকেই লুক্কায়িত; আর তাই এই বিষয়ে এ দুটি দলের মধ্যকার ব্যাপার (আমার) এই সংক্ষিপ্ত পুস্তকে তুলে ধরা যাবে না। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল সহজভাবে সহীহ হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতা পুনর্ব্যক্ত করা এবং সেগুলোকে সমর্থন যোগানো; এছাড়া আর কোনো কিছু নয়, যেমন দৃষ্টান্ত হলো ওই দুটো পক্ষের (মানে শীয়াহ ও আহলে হাদীস গোষ্ঠীর) পার্থক্য ব্যাখ্যা করা। আমি এই বইয়ে আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি সহীহ হাদীসগুলোকে এমন পদ্ধতিতে সমর্থন করার, যা সেগুলোর সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কিংবা সহীহ হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় সাধারণ নীতিমালার ব্যাপারে উভয় পক্ষের সর্বসম্মতিমূলক হয়, যেটা এই বইয়ের সযত্ন পর্যবেক্ষণকারী অবশ্যই লক্ষ্য করতে সক্ষম হবেন। এই পর্যায়ে আমি একটি ছাড়া অন্য কোনো নিকটতম ও সর্বসম্মত পন্থা খুঁজে পাচ্ছি না; আর তা হলো সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর মধ্যে যাঁদেরকে শীয়াহ গোষ্ঠী অভিযুক্ত করেনি, এসব হাদীসের প্রতিটির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে এক-এক করে তাঁদের সবার সত্য সাক্ষ্য গ্রহণ করা; বিশেষ করে সেসব রওয়ায়াত/বিবরণ সম্পর্কে আলোকপাত করা, যেগুলো হালাল ও হারাম বিষয়াদি নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

সর্ব-হযরত আবূ মূসা আল-আশ’আরী ও আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) এবং তাঁদের মতো অন্যান্য সাহাবাবৃন্দ যাঁদের বিরুদ্ধে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে যুদ্ধ করার বা তাঁকে অভিসম্পাত দেয়ার অভিযোগ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি, তাঁদের ব্যাপারে বিরোধীদের উত্থাপিত অভিযোগের জবাব ইতিপূর্বে (এ বইয়ে) দেয়া হয়েছে। ওই তিনজনের (মানে সর্ব-হযরত আমীরে মু’আবিয়া, মুগীরাহ ও আমর ইবনে আল-’আস্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈনের) প্রদত্ত বর্ণনাগুলো যে সহীহ, আমি তা-ই এখানে প্রমাণ করতে ইচ্ছুক। আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার খাতিরে আমি স্রেফ হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত বিবরণগুলোর প্রতি আলোকপাত করবো। খোদায়ী বিধিবিধান-সম্পর্কিত তাঁদের বর্ণনার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সাহাবাবৃন্দ (রা:) হতে বর্ণিত সেগুলোর পরিপূরক ও সমর্থনসূচক বিবরণ পেশের মাধ্যমে এ কাজটি সুসম্পন্ন হবে; আর আমি এই আলোচনার তাত্ত্বিক প্রকৃতিকে খর্ব না করে তা যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখার চেষ্টা করবো। এ লক্ষ্যে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আরম্ভ করছি:

হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত আহাদীস

الأول: حديث تحريم الوصل في شعور النساء

/ – মহিলাদের পরচুলা ব্যবহারে নিষেধসূচক হাদীস। আল-বুখারী, মুসলিম ও অন্যরা এটা (তাঁর কাছ থেকে) বর্ণনা করেন, আর সর্ব-হযরত আসমা’, আয়েশাহ ও জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর পরিপূরক বর্ণনাগুলো দ্বারা এটা সমর্থিত হয়েছে। হযরত আসমা’ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র বিবরণটি মুসলিম ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন; হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র বিবরণটি আল-বুখারী, মুসলিম ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন; আর হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বিবরণটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

/ – لا تزال طائفة من أمتي ظاهرين على الحق 

অর্থ: আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল (সর্বদা) সত্যের ওপর অটল-অবিচল থাকবে (হাদীস)। আল-বুখারী ও মুসলিম উভয়েই এটা আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছ থেকে বর্ণনা করেন। ইমাম মুসলিম (রহ:) এটা হযরত সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্বক্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও বর্ণনা করেন। উপরন্তু, সর্ব-ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) সবাই এটা হযরত সওবান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা হযরত মুআবিয়া ইবনে ক্বুর্রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন। আর ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত ‘ইমরা’ন ইবনে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

/ – حديث النهي عن الركعتين بعد العصر

আসর নামাযের পরে দুই রাক’আত নামায পড়া আল-বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) কর্তৃক তাঁর (আমীরে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর) কাছ থেকে বর্ণিত একটি হাদীস শরীফে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা মো’মেন মুসলমানবৃন্দের মা হযরত উম্মে সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতেও বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম আজমাঈন)। 

وروى مسلم عن عمر بن الخطاب (رضي الله عنه) أنه كان يضرب من يفعل ذلك، ولم ينكر ذلك من فعله فجرى الإجماع، وهو قول طوائف من أهل العلم       

অর্থ: ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন যে, খলীফা উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সেসব লোককে শাস্তি দিতেন, যারা আসরের নামায়ের পরে নামায পড়তো; আর কেউই তাঁকে এ কাজটির জন্যে ভর্ৎসনা করেননি। এটার ব্যাপারে এজমা’ (তথা উলামাবৃন্দের ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপরন্তু, অনেক ফক্বীহ আলেম/ইসলামী আইনশাস্ত্রজ্ঞ-ও একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন।

/ – حديث النهي عن الإلحاف في المسألة رواه عنه مسلم   

কোনো (আর্থিক) সাহায্য চাওয়ার সময় (তা) দাবি করাকে নিষেধকারী হাদীসটি তাঁর কাছ থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। এটা হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও সর্ব-ইমাম আল-বুখারী, মুসলিম ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) বর্ণনা করেন। হযরত সামুরাহ ইবনে জুনদুব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এটা বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)। আল-বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা বর্ণনা করেন হযরত যুবায়র ইবনে আল-আউয়াম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত আ’ঈদ ইবনে আ’মর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। সর্ব-ইমাম আল-বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) ও ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ ‘মুওয়াত্তা’ পুস্তকে এটা বর্ণনা করেন হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) দু জনই এটা লিপিবদ্ধ করেন হযরত সওবা’ন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তা করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) বর্ণনা করেন হযরত হাকীম ইবনে হিযা’ম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা বর্ণনা করেন হযরত ইবনে আল-ফা’রিসী হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)।

/ – إن هذا الأمر لا يزال في قريش ـ رواه عنه البخاري  

“নিশ্চয় এই বিধানটি ক্বুরাইশ গোত্রের সাথে অবশিষ্ট থাকবে” মর্মে হাদীস শরীফটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন ইমাম আল-বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) দু জনই এটা বর্ণনা করেন সর্ব-হযরত উমর ফারূক্ব ও আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে; আর ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

/ – حديث جلد شارب الخمر وقتله في الرابعة، رواه عنه أبو داود والترمذي        

মদ্যপায়ী ব্যক্তিকে বেত্রাঘাত ও চতুর্থ দফায় (অপরাধ সংঘটনের শাস্তিস্বরূপ) কতল-বিষয়ক হাদীসের বর্ণনাটি হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে উদ্ধৃত করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা)। আর বেত্রাঘাতের বিষয়টি ধর্মীয় জরুরাত তথা আবশ্যকতা হিসেবে সর্বজন জ্ঞাত এবং এর বিবরণসম্বলিত হাদীসের সংখ্যাও প্রচুর। তবে অপরাধীকে চতুর্থ দফায় অপরাধ সংঘটনের দায়ে হত্যার অতিরিক্ত শাস্তি-সংক্রান্ত বিবরণটি হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও উদ্ধৃত করেন সর্ব-ইমাম তিরমিযী ও আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা); ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা হযরত ক্বাবীসাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্যান্য সাহাবা (রা:) হতেও বর্ণনা করেন। সর্ব-ইমাম আল-হা’দী ও ইয়াহইয়া ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এই হাদীসটি ‘কিতা’ব আল-আহকা’ম’ পুস্তকে বর্ণনা করেন; কিন্তু অধিকাংশ উলামার মতানুসারে এই (শরঈ) বিধানটি রহিত হয়ে গিয়েছে – ولكن هذا الحكم منسوخ عند كثير من أهل العلم  

 ৭/ – حديث ”النهي عن لباس الحرير والذهب، وجلود السّباع” رواه عنه أبو داود والنسائي

অর্থ: “রেশম, সোনা ও শিকারী জন্তুর চামড়া পরিধান নিষেধ” মর্মে হাদীসটি তাঁর (আমীরে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর)  কাছ থেকে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা)। ইমাম নাসাঈ ও ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) ভিন্ন শব্দচয়নে এর অংশ বিশেষ বর্ণনা করেন। রেশম ও সোনা-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত পরিপূরক/সমর্থনসূচক হাদীসগুলো এতো প্রসিদ্ধ যে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। আর শিকারী বন্য জন্তু-জানোয়ারের চামড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে একটি হাদীস বিকল্প/আলাদা এক সনদে হযরত আবূ আল-মালীহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)। 

/ – حديث افتراق الأمة إلى نيّف وسبعين فرقة، رواه عنه أبو داود   

অর্থ: উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে মর্মে হাদীসটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা হযরত ইবনে আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন; যেমনটি তিনি ও ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও।

/ – النهي عن سبق الإمام بالركوع والسجود، رواه عنه أبو داود وابن ماجه

অর্থ: (নামাযের মধ্যে) রুকূ ও সেজদায় ইমামের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত বর্ণনাটি তাঁর কাছ থেকে উদ্ধৃত করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা)। এটা হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম আজমাঈন)। ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও এটা তাঁর ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন। সর্ব-ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও বর্ণনা করেন।

১০/ – النهي عن الشِّغار، رواه عنه أبو داود

অর্থ: ‘শীগার’ (বিয়ে অদল-বদল)‘কে নিষেধকারী বিবরণটি তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা বর্ণনা করেন হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর এটা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’এর মাঝে মশহুর তথা প্রসিদ্ধ বর্ণনার পর্যায়ভুক্ত, যার ফলশ্রুতিতে এই বাণীর অনুশীলন (তাঁদের) এজমা’ তথা ঐকমত্য সদৃশ।

১১/ – أنه توضأ كوضوء رسول الله صلّى الله عليه وسلّم

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মতো আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র অযূ করা সম্পর্কিত বিবরণটি ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) লিপিবদ্ধ করেন; আর এর কোনো সমর্থনের প্রয়োজন নেই। ব্যতিক্রম শুধু শির ও মুখমণ্ডলের ওপর পানির বিষয়টি, যা ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতেও বর্ণনা করেন।

১২/ – النهي عن النّوح

অর্থ: মাতম করে কান্নাকাটি করার নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত হাদীস তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন ইমাম ইবনে মাজাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে); আর উল্লেখ করার প্রশ্নে অন্যান্যদের বিবরণের চেয়ে এটা বেশি মশহুর/প্রসিদ্ধ।

১৩/ – النهي عن الرّضا بالقيام

অর্থ: অন্যদের দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নে খুশি হওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত হাদীসটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা)। এর সমর্থনসূচক একটি বর্ণনা এসেছে হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যা লিপিবদ্ধ করেন ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে); অপরটি এসেছে হযরত আবূ উমা’মাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যা লিপিবদ্ধ করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। দাঁড়ানোর বিশেষ অধিকারের ক্ষেত্রগুলোর ব্যাপারে লেখা ইমাম নববী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র কিতাবে তিনি পূর্ববর্তী দুটো হাদীস ও হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন। ইমাম নববী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদীসটিকে সহীহ বলে সমর্থন দেন।

১৪/ – النهي عن التمادح

অর্থ: মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসার প্রতি নিষেধসূচক হাদীসটি হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছ থেকে বর্ণনা করেন ইমাম ইবনে মাজাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। সর্ব-ইমাম আল-বুখারী, মুসলিম ও আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) এটা বর্ণনা করেন হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর সর্ব-ইমাম আল-বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) বর্ণনা করেন হযরত আবূ মূসা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। সর্ব-ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) এটা বর্ণনা করেন হযরত মিক্বদা’দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

১৫/ – تحريم كل مسكر    

অর্থ: সমস্ত নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি নিষেধাজ্ঞা; আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছ থেকে ইমাম ইবনে মাজাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা বর্ণনা করেন। বাকি সবাই বর্ণনা করেন হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। সর্ব-ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) বর্ণনাটি লিপিবদ্ধ করেন হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও; আর হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা)।

১৬/ – حكم من سها في الصلاة

অর্থ: কেউ নামাযে কোনো কিছু ভুলে যাওয়ার বিধান; এই বিবরণটি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এবং এর আরেকটি সমর্থনসূচক বর্ণনা এসেছে হযরত ইবনে সওবা’ন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যা লিপিবদ্ধ আছে ‘সুনানে আবী দাউদ’ পুস্তকে।

১৭/ النهي عن القران بين الحج والعمرة   

অর্থ: ক্বিরা’ন (তথা একই নিয়্যত বেঁধে হজ্জ্ব ও উমরাহ একত্রে একই সফরে পালন)‘এর প্রতি নিষেধাজ্ঞাসূচক বিবরণটি তাঁর কাছ থেকে লিপিবদ্ধ করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে); আর এটা এসেছে হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও, যা ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) লিপিবদ্ধ করেছেন। সর্ব-হযরত উমর ও উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত মওক্বূফ বিবরণ (যার সনদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত ফেরত যায়নি) লিপিবদ্ধ করেন ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে)।

১৮/ أنه قصر للنبي صلى الله عليه وسلم بمشقص بعد عمرته صلى الله عليه وسلم، وبعد حجّه، رواه عنه البخاري ومسلم وأبو داود والنسائي  

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) উমরাহ ও হজ্জ্বশেষে যে নিজের চুল কাঁচি (জাতীয় যন্ত্র) দ্বারা ছেঁটে নিতেন, তা হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)। অনুরূপ দুটো বিবরণ এসেছে সর্ব-হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে, যা লিপিবদ্ধ আছে মুসলিম শরীফে। হযরত সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে এটা উদ্ধৃত করেন এবং এর পাশাপাশি সর্ব-ইমাম নাসাঈ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) যাঁরা এ বিবরণকে সহীহ বলেন, তাঁরাও নিজ নিজ পুস্তকে বিবরণটি লিপিবদ্ধ করেন। ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন; আর ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা বর্ণনা করেন হযরত ‘ইমরা’ন ইবনে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর সর্ব-ইমাম তিরমিযী ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটার এমন এক সংস্করণ লিপিবদ্ধ করেন যেখানে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এটা বর্ণনা করেন এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মন্তব্য করেন যে এটা খোদ আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র দৃষ্টিভঙ্গিরই খেলাফ, কেননা তিনি তামাত্তু’কে বৈধ বিবেচনা করতেন না। [নোট: পৃথক পৃথক নিয়্যত বেঁধে একই তীর্থযাত্রায় হজ্জ্ব ও উমরাহ পালনকে তামাত্তু’ বলে]

১৯/ ما روى عن أخته أم المؤمنين أم حبيبة ـ رضي الله عنها ـ (( أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي في الثوب الذي يجامعها فيه، ما لم ير فيه أذى )) رواه أبو داود والنسائي، ويشهد لمعناه أحاديث كثيرة، منها: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم: (( كان يصلي في نعليه ما لم ير بهما أذى )) رواه البخاري ومسلم عن سعيد بن يزيد ورواه أبو داود عن أبي سعيد الخدري    

ويشهد لذلك حديث: (( فلا ينصرفنّ حتى يجد ريحاً أو يسمع صوتاً )) وهو متفق على صحته، إلى أشباه لذلك كثيرة تدل على جواز الاحتجاج بالاستصحاب للحكم المتقدّم، وعلى ذلك عمل العلماء في فطر يوم الشك من آخر شعبان،  وصوم يوم الشك من آخر رمضان 

অর্থ: হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর বোন ও ঈমানদারবৃন্দের মা (প্রিয়নবীর স্ত্রী) হযরত উম্মে হাবীবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সেই একই বস্ত্র পরে নামায পড়তেন, যেটা (পরে) তিনি তাঁর (উম্মে হাবীবার) সাথে মিলিত হতেন, যতোক্ষণ না ওই বস্ত্রটি ধূলিমিশ্রিত হতো। সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) দু জনই এটা আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন। এরকম অর্থের অনেক সমর্থনসূচক বিবরণ রয়েছে; যার মধ্যে একটি হলো প্রিয়নবী (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্যান্ডেল পরে নামায পড়তেন, যতোক্ষণ না ওই স্যান্ডেল জোড়া ধূলিমিশ্রিত হতো। হযরত সাঈদ ইবনে এয়াযীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা বর্ণনা করেন; আর ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা বর্ণনা করেন হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। এই বর্ণনাটি (অনুরূপ) আরো অনেক বিবরণ দ্বারা সমর্থিত, যার মধ্যে একটি হাদীসে যেমনটি বিবৃত হয় যে কারো দ্বিতীয় দফা অযূ করার প্রয়োজন নেই, যদি না তিনি শ্রবণ বা ঘ্রাণের মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে পায়ুপথে বায়ু নির্গত হয়েছে। এই সাধারণ নিয়মের পক্ষে সমর্থনসূচক প্রচুর বিবরণ বিদ্যমান; যদি এর পরিপন্থী কোনো প্রামাণিক দলিল না থাকে, তবে পূর্ববর্তী হুকুম তথা বিধান-ই বহাল থাকবে। এগুলোর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সন্দেহজনক দিবসে তথা শা’বান মাসের শেষ দিনে মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না গেলে পানাহার করা; একইভাবে চাঁদ দেখা না গেলে রমজান মাসের শেষ দিনে রোযা রাখা।    

২০/ نهى من أكل الثوم أو البصل عن دخول مسجد رسول الله صلى الله عليه وسلم

মসজিদে নববী (দ:)’তে প্রবেশের আগে পিঁয়াজ বা রসুন খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা-সম্বলিত বিবরণ। এটা আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁরই বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন এবং এর অনেকগুলো সমর্থনসূচক বিবরণ বিদ্যমান। ইমাম মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটা হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন, যেমনটি করেন সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা); এই দু জন ইমাম (রহ:) হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও এটা বর্ণনা করেন। সর্ব-ইমাম মুসলিম ও মালেক (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) হযরত আবূ হোরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতেও বর্ণনা করেন; অপর দিকে, ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন সর্ব-হযরত হুযায়ফা ও আল-মুগীরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে। সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম ও আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) এটা বর্ণনা করেন হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; পক্ষান্তরে, হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। সর্ব-ইমাম মুসলিম ও আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা বর্ণনা করেন হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। আর সার্বিকভাবে ওই দুটো গাছ থেকে খাওয়ার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে (সিদ্ধান্ত হলো), তা মসজিদে নববী (দ:)’তে প্রবেশের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা) এটা বর্ণনা করেন হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর হযরতে ইমামে আলী ইবনে আবী তালেব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা)।  

২১/ حديث: هذا يوم عاشوراء لم يكتب عليكم

আশূরা (পালন) নির্দেশকৃত নয় তথা আদিষ্ট নয় মর্মে বিবরণটি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম মালেক, বুখারী, মুসলিম ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)। এই (উদ্দিষ্ট) অর্থের সমর্থনসূচক একটি বিবরণ হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে উদ্ধৃত করেন সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহুমা); আর এটাই হলো বুঝে নেয়া অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বাণী হতে, যেখানে তিনি ইহুদীদের দ্বারা ওই দিনের রোযা পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর বলেন: 

فأنا أحق بموسى  

অর্থ: পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস সালাম)’র ওপর আমার হক্ব অধিকতর।

হুযূরে পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:

فنحن نصومه تعظيماً له

অর্থ: আমরা (ওই দিন) রোযা রাখি তাঁর (পয়গম্বর মূসা আলাইহিস্ সালামের) প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ।

২২/ لا تنقطع الهجرة

হিজরত শেষ না হবার বিবরণটি হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে); যদিও এটা তাঁর কাছ থেকে বিশুদ্ধ নয়। আল-খাত্তাবী (রহ:) বলেন: 

قال الخطابي: في إسناده مقال،   

অর্থাৎ, এর এসনাদে কিছু আপত্তি বিদ্যমান।

তবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সাআদী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণিত একটি অনুরূপ (সমর্থনসূচক) বিবরণও বিদ্যমান।

২৩/ حديث النهي عن لباس الذهب إلا مقطعاً 

বস্ত্রে স্বর্ণ পরিধানের প্রতি নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত হাদীস, যা আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। সাহাবাবৃন্দের (রা:) একটি দল হতে ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) কর্তৃক বর্ণিত একটি রওয়ায়াত/বিবরণে এটার প্রতি সমর্থন রয়েছে।  

২৪/ النهي عن المغلوطات

বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের প্রতি নিষেধাজ্ঞা। আল-খাত্তাবী (রহ:) বলেন:

قال الخطّابي: الأغلوطات. ولم يصح عنه، في إسناده مجهول،

তাঁর কাছ থেকে এই বর্ণনাটি বিশুদ্ধ নয়; কেননা এর এসনাদে অজ্ঞাত একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। তবে হযরত আবূ হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আবূ সাআদত ইবনে আল-আসীর (রহ:) উদ্ধৃত আরেকটি বর্ণনায় এটাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে।  

২৫/ حديث الفصل بين الجمعة والنافلة بعدها بالكلام أو الخروج

জুমুআ’ ও নফল নামাযের মধ্যে পার্থক্য করতে কথা (বলা) বা বেরিয়ে যাওয়া বিষয়ক হাদীসটি আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। হযরতে রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)‘এর আচরিত রীতি/সুন্নাহ সম্পর্কে হযরতে ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে অনুরূপ একটি বর্ণনা বুখারী ও মুসলিম শরীফে বিদ্যমান। ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) অনুরূপ একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন ইমাম আবূ মাসউদ আল-যুরাক্বী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হতে, যা’তে ওই ইমাম সাহেবের আচরিত রীতির কথা (উঠে) এসেছে।

২৬/ [السادس والعشرون ساقط من الأصل يراجع في الكتاب]

২৭/ حديث: كل ذنب عسى الله أن يغفره، إلا الشرك بالله وقتل المؤمن

আল্লাহতা’লার সাথে শির্ক তথা অংশীদার স্থাপন ও ঈমানদার মুসলমানকে হত্যা ছাড়া বাকি সমস্ত পাপ কাজ তিনি ক্ষমা করে দেবেন মর্মে হাদীসটি হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। এর সমর্থন এসেছে হযরত আবূ দারদা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর গৃহীত একটি রওয়ায়াত তথা বিবরণে; পাশাপাশি ক্বুরআন মজীদের একটি আয়াতে করীমায়ও এর পক্ষে সমর্থন বিদ্যমান।

২৮/ حديث: اشفعوا تؤجروا

কারো পক্ষে সুপারিশ করার সময় পুরস্কৃত হওয়ার হাদীসটি হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। এটা বুখারী ও মুসলিম হাদীসগ্রন্থ দুটোতে হযরত আবূ মূসা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সূত্রে বর্ণিত একটা সর্বজনজ্ঞাত হাদীস; আর ক্বুরআন মজীদও এর মর্মার্থকে সমর্থন দেয়।

২৯/ كراهة تتبع عورات الناس

মানুষের দোষত্রুটি তালাশের প্রতি নিষেধাজ্ঞা; এই বিবরণটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)। এর সমর্থনসূচক বর্ণনা এসেছে হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে তিরমিযী শরীফে; হযরত আবূ হোরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে মুসলিম শরীফে; আর সর্ব-হযরত আবূ বারযাহ আসলামী, উক্ববাহ ইবনে আমির ও যায়দ ইবনে ওয়াহব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) হতে স্বয়ং আবূ দাউদ শরীফে।

৩০/ حديث: من يرد الله به خيراً يفقهه في الدين

‘আল্লাহতা’লা কারো ভালাই চাইলে তাকে দ্বীনের ফক্বীহ তথা ধর্মতত্ত্ব/ঐশী বিধিবিধানের বিশারদ বানিয়ে দেন’ মর্মে হাদীসটি হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে); আর এটার দুটো সমর্থনসূচক বিবরণ বিদ্যমান। একটি এসেছে হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এবং অপরটি হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) দুটোই উল্লেখ করেন এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে সহীহ বলে ঘোষণা করেন। 

অতএব, এগুলোর সবই হচ্ছে হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত আহাদীস যা স্পষ্ট হুকুম-আহকাম (জারির) শ্রেণিতে প্রকাশিত; কিংবা যেগুলো হতে শরঈ ফতোয়া বের করা যেতে পারে। এসব বিবরণ শীয়া ও ফক্বীহদের মাযহাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; আর এসব রওয়ায়াতে এমন কোনো কিছু নেই যা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামাবৃন্দ কর্তৃক গৃহীত হয়নি, ব্যতিক্রম শুধু মনসূখ তথা রহিত হওয়া ওই বিবরণটি, যা’তে চারবার মদ্যপান করে (ঐশী) বিধান লঙ্ঘনের দায়ে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান বিধৃত হয়েছে। তবে আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যায়দী শীয়াদের শীর্ষস্থানীয় আলেম এটা বর্ণনা করেছেন। হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত সমস্ত আহাদীস-ই অন্যান্য বিশ্বস্ত/নির্ভরযোগ্য সাহাবা কেরাম (রা:)’এর বর্ণিত আহাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এমতাবস্থায় আমি সেসব ব্যক্তির প্রতি অবাক হই, যারা সিহাহ (সহীহ হাদীস) সংকলকবৃন্দকে এসব বিবরণ তাঁদের বইপত্রে লিপিবদ্ধ করে সেগুলোকে নিজেদের সংকলনে স্থান দেয়ার দায়ে দোষারোপ করে থাকে।  

এসব আহাদীস ছাড়াও হযরতে আমীরে মুআবিয়া (رَضِىَ اللهُ عَنْهُ)‘র বর্ণিত আরো কিছু প্রসিদ্ধ হাদীস ও সেগুলোর সমর্থনসূচক বিবরণ আমরা আলোচনা সংক্ষেপ করার খাতিরে উল্লেখ করিনি। আমরা এখানে সেগুলোকে শনাক্ত করার জন্যে সূক্ষ্মভাবে উদ্ধৃত করতে পারি। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে মুয়াযযিনের গুণাবলী, আযানের জবাব দেবার ফযীলত, জ্ঞান আহরণের মাহাত্ম্য, লায়লাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) ২৭ তারিখ (২৬ তারিখ দিবাগত রাত), আনসার সাহাবা (রা:)’দের প্রতি মহব্বত রাখার মহত্ত্ব, হযরত তালহা (رَضِىَ اللهُ عَنْهُ)’র গুণ ও মাহাত্ম্য, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বেসাল শরীফের তারিখ ও ৬৩ বছরে বয়সে তা ঘটেছিলো মর্মে বিবরণ। এ ছাড়াও রয়েছে নিম্নের দুআ-সহ হাদীসটি: اللهم لا مانع لما أعطيت ولا معطي لما منعت – অর্থাৎ, “হে আল্লাহ, আপনি যা দান করেন তা কেউই রহিত করতে পারে না….।” এটা ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সূত্রে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন। আরেকটি হাদীস: الخير عادة والشر لجاجة – অর্থাৎ, “খায়র তথা ভালো একটি স্বভাব…।” অন্য একটি হাদীস: لم يبق في الدنيا إلا بلاء وفتنة – অর্থাৎ, “এ দুনিয়াতে যা অবশিষ্ট আছে তা বালা (মুসীবত) ও বিবাদ-বিসংবাদ।” অপর একটি হাদীস: إنما الأعمال كالوعاء إذا طاب أسفله طاب أعلاه – অর্থাৎ, “নিশ্চয় কর্ম হচ্ছে একটি পাত্রের মতো; সেটার নিচের অংশ নির্মল থাকলে ওপরের অংশও পরিষ্কার থাকে।” এর পাশাপাশি রয়েছে সেসব লোকদের সম্পর্কে বিবরণ, যাদের প্রতি সোনা ও রুপা মজুতদারী সংক্রান্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিলো ( وَٱلَّذِينَ يَكْنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلْفِضَّةَ – সূরাহ তওবা, ৩৪ আয়াত)। এগুলোর সাথে যোগ করুন তাঁর দুটো মওক্বূফ বিবৃতি (কোনো সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র কথা যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত ফেরত যায়নি)। 

এগুলো হচ্ছে সিহাহ সিত্তাতে লিপিবদ্ধ হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সিংহ ভাগ বিবরণ; আমার কাছ থেকে কোনোটাই এড়িয়ে যায়নি, কেবল কিছু সংখ্যক ছাড়া, যেগুলো হয়তো আমি বে-খেয়ালে ছেড়ে আসতে পারি। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে কোনো মানুষ-ই মুক্ত নন। সমস্ত প্রতিষ্ঠিত বিবরণের পরিপন্থী বা সেগুলোর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছুই তাঁর বর্ণনাগুলোর মধ্যে নেই, যদিও এমন কিছু বর্ণনা রয়েছে, যেগুলোর সনদ তাঁর কাছে ফেরত পৌঁছুনোর ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য নয়, অথবা যেগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে মতপার্থক্য বিরাজমান। যেগুলোর ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে, সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের বেশির ভাগই হচ্ছে আহকাম/বিধিবিধান ও ফযীলতের শ্রেণিভুক্ত, যার সংখ্যা ১৩টি; সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله عليهما) চারটির ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন, ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) স্বতন্ত্রভাবে চারটি বর্ণনা করেন, আর ইমাম মুসলিম (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেন পাঁচটি। এ বিষয়টি ওই সময়কালে গৃহীত সততার নীতি ও মিথ্যেবাদিতার হীন পর্যায়ে নেমে আসা হতে বেঁচে থাকার প্রমাণবহ বটে। আল্লাহ মিথ্যেবাদীদের ত্যাগ করুন! আর যদি সেসব বিবরণের মধ্যে সততার ইঙ্গিত কোনোভাবেই পাওয়া না যায়, তবুও এই বাস্তবতা-ই যথেষ্ট যে হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কখনোই হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কোনো রকম সমালোচনামূলক রওয়ায়াত বর্ণনা করেন নি – না এমন কিছু যা তাঁর সাথে নিজের যুদ্ধবিগ্রহকে বৈধতা দেয়; না খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)‘এর ফযীলত বর্ণনা, অথবা তাঁকে শহীদ করায় অংশগ্রহণকারী খুনীদের সমালোচনা; যদিও (এ রকম করলে) তাঁর সেনাবাহিনি তাঁর কথায় বিশ্বাস করতেন এবং ওই ধরনের আবেগ সৃষ্টিতে তাঁর স্বার্থ-ও হাসিল হতো। তবে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ওই রকম কোনো কিছুই করেননি – না হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র (প্রকাশ্য) জীবদ্দশায়, না তাঁর বেসাল শরীফ-পরবর্তী সময়ে। এর সাথে আরো যোগ হবে এ বাস্তবতা যে, তিনি দ্বীন-ইসলামের শিক্ষাবিরোধী বা দ্বীনের মূলোৎপাটনকামী কোনো বর্ণনা প্রদান করেননি। এই কারণেই বিশিষ্ট সাহাবা (রা:) ও তাবেঈনের (রহ:) একাধিক জন তাঁর কাছ থেকে আহাদীস বর্ণনা করেছেন; এঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস, আবূ সাঈদ খুদরী, ইবনে যুবায়র, ইবনে মুসাইয়েব, আবূ সালিহ সাম্মান, আবূ ইদ্রিস খাওলানী, আবূ সালামাহ ইবনে আবদিল রহমান, উরওয়াহ ইবনে যুবায়র, সালিম ইবনে আব্দিল্লাহ, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখ। আর যাঁরা এঁদের থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁরাও অনুরূপ মেধা ও গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমি স্রেফ এটা উল্লেখ করছি এ কারণে যেনো আপনারা উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর বর্ণিত আহাদীস কেবল মুহাদ্দীস উলামা-ই বর্ণনার জন্যে বেছে নেননি; কেননা এ কথা জ্ঞাত যে মুহাদ্দেসীন উলামা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর পরম্পরা (এসনাদ) ছাড়া কোনো হাদীস গ্রহণ করবেন না। হযরতে আমীরে মুআবিয়া (রা:)’র বর্ণিত আহাদীস গ্রহণকারী প্রতিটি প্রজন্মের বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীবৃন্দ না হলে মুহাদ্দেসীন উলামা তা তাঁর বর্ণনা হিসেবে গ্রহণ করতেন না; আর তা যদি তাঁদের মানদণ্ডে না মিলতো এ মর্মে যে সেটা তাঁরই বর্ণিত হাদীস, তাহলে তাঁরা সেটাকে নিজেদের সহীহ সংকলনে স্থান দিতেন না। আমি শুধু এ কথা এখানে উল্লেখ করেছি এর সাথে পরিচিত হওয়ার ভিত্তিতেই, যদিও মুখ্য প্রমাণ ওপরে যা লেখা হয়েছে তাতেই নিহিত। আর আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভালো জানেন।

শীয়া ও মো’তাযেলা গোষ্ঠীগুলো হযরতে আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত আহাদীস গ্রহণের চেয়ে নিজেদের নীতিমালা অনুযায়ী যা বৃহত্তর ফলাফল তা-ই গ্রহণ করেছে: নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের ‘মুরসাল’ (বিঘ্নিত সনদ/পরম্পরার) বিবরণগুলো তাঁদের দ্বারা অবাধভাবে গৃহীত। এমতাবস্থায় তাঁরা হযরতে আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বর্ণিত হাদীসগুলো উপলব্ধি না করেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। বস্তুতঃ তাঁরা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের করা অনেক জাল বিবরণও গ্রহণ করেছেন, যে বর্ণনাকারীবৃন্দ পরিষ্কার অন্তর ও বিবেকসহ এমন কয়েকজনের কাছ থেকে তা বর্ণনা করেছিলেন, যারা ছিলেন অপরিচিত; এছাড়া সমালোচিত বর্ণনাকারীদের কাছ থেকেও তাঁরা বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করেছিলেন।

আর এটাই হয়ে থাকে সে সব লোকের ক্ষেত্রে, যাঁরা মুরসাল হাদীস গ্রহণ করে থাকেন; তা এতোখানি (ক্ষতিকর) যে, সেসব বিবরণ তাঁদের উপলব্ধি ছাড়াই কাঁধে চেপে বসে….অতএব, এরই ভিত্তিতে মুরসাল হাদীস গ্রহণ করা বৃহত্তর ক্ষতির কারণ হয় এবং তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি মিথ্যে আরোপের সুযোগ সহজতর করে দেয়। তাই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে তাঁর কাছের মানুষদের দোষত্রুটির দিকে লক্ষ্য রাখা অতীব প্রয়োজন, ঠিক যেমনিভাবে তিনি তাঁর বিরোধী ও দূরের মানুষদের দোষত্রুটির প্রতি নজর রাখেন। আমরা এ ব্যাপারে আল্লাহতা’লার সহায়তা যাচ্ঞা করি, আমীন।

আমীরে মুয়াবিয়া (রা:)’এর জীবনের কিছু ঘটনা 

হযরতে আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র জীবনের এসব ঘটনা ও বিবরণ বিশেষভাবে চয়ন করা হয়েছে, যেহেতু তাঁর সম্পর্কে উল্লেখিত বেশির ভাগ ঘটনা-ই সাধারণতঃ অন্তর্দ্বন্দ্বের সময়কালে সীমাবদ্ধ। অথচ তাঁর জীবনের অন্যান্য দিকগুলো অহরহ-ই অবহেলিত বা বিস্মৃত থেকে যায়।

১/ ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী নিজ ‘জামে’ কিতাবে (২৪১৪) বর্ণনা করেন সুওয়াঈদ ইবনে নাসর হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ:) হতে, তিনি আবদুল ওয়াহহাব ইবনে আল-ওয়ার্দ হতে, তিনি জনৈক মদীনাবাসী হতে, যিনি বলেন: 

كتب معاوية إلى عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها: أن اكتبي إلي كتابا توصيني فيه، ولا تكثري علي. فتكبت عائشة رضي الله عنها إلى معاوية: سلام عليك، أما بعد، فإني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: (( من التمس رضاء الله بسخط الناس كفاه الله مؤنة الناس، ومن التمس رضاء الناس بسخط الله وكله الله إلى الناس ))، والسلام علي.

অর্থ: আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে সালাম সহকারে একটি পত্রে এ কথা লেখেন: “আমাকে উপদেশ দিয়ে পত্র লেখবেন, তবে বেশি কিছু (দায়িত্ব) আমার ওপর দেবেন না।” প্রত্যুত্তরে মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) লেখেন: “আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর নিশ্চয় আমি শুনেছি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে; তিনি এরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি লোকের বিরূপ মনোভাবেও আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে, তবে লোকের (অনিষ্ট) হতে আল্লাহ-ই তার জন্যে যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টিতেও লোকের সন্তুষ্টি খুঁজে বেড়ায়, আল্লাহতা’লা তাকে লোকের বশীভূত করবেন।’ আপনার প্রতি সালাম।”  

ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) অনুরূপ একটি সনদে বর্ণনা করেন হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হতে, তিনি হিশাম ইবনে উরওয়াহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে), তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে….তবে এই সংস্করণটি মওক্বূফ। আমি (শায়খ সাআদ ইবনে দায়দা’ন আল-সুবাঈ) বলি, মওক্বূফ হাদীস অধিকতর সঠিক।

২/ হযরত মা’আমর (রহ:) নিজ ‘জামে’ পুস্তকে (মুসান্নাফে আবদির রাযযাক্ব – ২০৭১৭) বর্ণনা করেন আল-যুহরী হতে, তিনি হুমায়দ হতে, তিনি মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ হতে এই মর্মে যে, তিনি (মিসওয়ার) একবার হযরতে আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন:

قال: فلما دخلت عليه ــ حسبت أنه قال: سلمت عليه ــ ثم قال: ما فعل طعنك على الأئمة يا مسور؟ قال: قلت: ارفضنا من هذا، أو أحسن فيما قدمنا له. قال: لتكلمن بذات نفسك. قال: فلم أدع شيئا أعيبه به إلا أخبرته به. قال: لا أبرأ من الذنوب، فهل لك ذنوب تخاف أن تهلك إن لم يغفرها الله لك؟ قال: قلت: نعم. قال: فما يجعلك أحق بأن ترجو المغفرة مني؟! فوالله لما ألي من الإصلاح بين الناس؛ وإقامة الحدود؛ والجهاد في سبيل الله؛ والأمور العظام التي تحصيها؛ أكثر مما تلي، وإني لعلى دين يقبل الله فيه الحسنات، ويعفو فيه عن السيئات، والله مع ذلك ما كنت لأخير بين الله وغيره إلا اخترت الله على ما سواه. قال: ففكرت حين قال لي ما قال، فوجدته قد خصمني! فكان إذا ذكره بعد ذلك دعا له بخير  

অর্থ: আমি যখন আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর (ঘরে) প্রবেশ করি – বর্ণনাকারী তাঁকে সালাম দিয়েছিলেন বলে মনে করেন – অতঃপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “ওহে মিসওয়ার, ইমাম/নেতৃবৃন্দকে তোমার দোষারোপের কী হলো?” আমি বলি, “বিষয়টি আমরা (এক্ষণে) বাদ দেই; কিংবা (চলুন) আমি এখানে যে জন্যে এসেছি, তা-ই আলোচনা করি।” তিনি বলেন, “আলোচনা করো যা তোমার অন্তরে আছে।” মিসওয়ার বলেন, “আমি তাঁকে দোষারোপ করতে পারি এমন কোনো কিছুই ছাড়িনি, শুধু এতোটুকু যে আমি তাঁকে সে সম্পর্কে অবহিত করি।” এরপর তিনি বলেন, “আমি নিজেকে গুনাহ হতে মুক্ত বিবেচনা করি না। তোমার কি এমন পাপ আছে, যা দ্বারা তোমার বিনাশ তুমি আশঙ্কা করো, যদি আল্লাহতা’লা তোমাকে ক্ষমা না করেন?” আমি উত্তরে বলি, “হ্যাঁ।” তিনি বলেন, “আল্লাহতা’লার ক্ষমা পাবার বেলায় আমার চেয়ে তোমার বেশি আশাবাদী তথা যোগ্যতর হবার কারণ কী বলে তুমি মনে করো? আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, মানুষের বিবাদ মীমাংসা, অপরাধের শাস্তি বিধান, আল্লাহর রাস্তায় জ্বিহাদ পরিচালনা এবং তোমার গণনাতীত অন্যান্য (অনুরূপ) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি, যার দায়িত্ব আমি কাঁধে নিয়েছি, তা তোমার বহনকৃত দায়িত্ব হতে অনেক বেশি। আর আমি এমন এক ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে আল্লাহতা’লা উত্তম কাজগুলো গ্রহণ করেন এবং ভুলত্রুটি ক্ষমা করেন। আমি আল্লাহর নামে ক্বসম করছি এই মর্মে যে, আল্লাহ ও তিনি ছাড়া অন্যদের কাউকে বেছে নেয়ার পরিস্থিতিতে আমি সর্বদাই আল্লাহকে বেছে নিয়েছি!” মিসওয়ার বলেন, “আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যা বলেছিলেন, সে সম্পর্কে ভেবে আমি অনুধাবন করি যে এই আলোচনায় তিনি তাঁর মতকে সঠিক বলে সপ্রমাণ করেছিলেন।” আর এরপর মিসওয়ার যখনই তাঁর কথা স্মরণ করতেন, তাঁর জন্যে দুআ করতেন।

৩/ ইবনে আসাকির নিজ ‘তারীখ’ (৬২:৩৮৪) গ্রন্থে বর্ণনা করেন শু’বাহ হতে, তিনি সিমা’ক ইবনে হারব হতে, তিনি আলক্বামাহ ইবনে ওয়াইল হতে, তিনি তাঁর পিতা (ওয়াইল ইবনে হুজর) হতে, যিনি বলেন:

وروى ابن عساكر في تاريخه (384/62) من طريق أبي زرعة عن يحيى بن معين عن غندر عن شعبة عن سماك بن حرب عن علقمة بن وائل عن أبيه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم أقطعه أرضا، قال: فأرسل معي معاوية، فقال: أعطها إياه . أو قال: اعلمها إياه . قال: فقال لي معاوية: أردفني خلفك . فقلت: لا تكون من أرداف الملوك . قال: فأعطني نعلك . قلت: انتعل ظل الناقة . قال: فلما استخلف معاوية أتيته، فأقعدني معه على السرير، وذكرني الحديث . قال سماك: قال: فوددت أني كنت حملته بين يدي .  

অর্থ: রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) আমাকে একটি জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন এবং হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’কে আমার সাথে পাঠিয়েছিলেন সেটা চিহ্নিত করতে অথবা আমার বরাবর হস্তান্তর করতে। হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) আমাকে বলেন, “আমাকে আপনার সওয়ার/বাহনে আপনার সাথে চড়তে দিন।” আমি তাঁকে বলি, “আপনি রাজন্যবর্গের সাথে সওয়ারে চড়তে পারবেন না” [নোট: তিনি মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’কে নিজের সওয়ারের পেছনে বসাতে পছন্দ না করার প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন]। অতঃপর হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) বলেন, “আপনার স্যান্ডেল-জোড়া তাহলে পরতে দিন আমায়।” এর জবাবে আমি বলি, “উটের ছায়াকে ব্যবহার করুন” [নোট: এর মানে ওয়াইলের পরণে স্যান্ডেল ছিলো এবং হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ছিলেন খালি পা; যেহেতু ওয়াইল সওয়ারে চড়তে দেননি, অতএব তিনি অন্ততঃ চপ্পল জোড়া ধার দিতে পারতেন, যাতে উত্তপ্ত মরুভূমিতে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর পা পুড়ে না যায়। ওয়াইল কর্তৃক চপ্পলও ধার না দেয়ার ইচ্ছার কারণে তিনি তাঁকে উটের ছায়ায় হাঁটতে বলেন]। ওয়াইল বলেন, “হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যখন খলীফা হন, তখন আমি তাঁর কাছে আসি, আর তিনি আমাকে তাঁর ম্যাট্রেসে নিজের পাশে বসান এবং ওই ঘটনার কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন।” সিমাক বলেন যে ওয়াইল বলেছেন: “আমার তখন ইচ্ছা হচ্ছিলো, (আহা) আমি যদি তাঁকে আমার সওয়ারের ওপর আমারই সামনে বসতে দিতাম!”

৪/ হাফেয ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীরে (৫:১৯০) বর্ণনা করেন: 

4 ـــ وقال الحافظ ابن كثير في تفسيره (190/5) (1) : ( وقال ابن لهيعة : حدثني سالم بن غيلان عن سعيد بن أبي هلال أن معاوية بن أبي سفيان قال لكعب الأحبار: أنت تقول:  إن ذا القرنين كان يربط خيله باثريا؟ فقال له كعب: إن كنت قلت ذلك فإن الله قال: { وآتيناه من كل شيء سببا }.

وهذا الذي أنكره معاوية رضي الله عنه على كعب الأحبار هو الصواب، والحق مع معاوية في ذلك الإنكار؛ فإن معاوية كان يقول عن كعب: إن كنا لنبلو عليه الكذب. يعني: فيما ينقله، لا أنه كان يتعمد نقل ما ليس في صحفه، ولكن الشأن في صحفه أنها من الإسرائيليات التي غالبها مبدل مصحف محرف مختلق، ولا حاجة لنا مع خبر الله تعالى ورسول الله صلى الله عليه وسلم إلى شيء منها بالكلية، فإنه دخل منها على الناس شر كثير، وفساد عريض، وتأويل كعب قول الله : { وآتيناه من كل شيء سببا }، واستشهاده في ذلك على ما يجده في صحفه من أنه كان يربط خيله بالثريا غير صحيح ولا مطابق، فإنه لا سبيل للبشر ــ إلى شيء من ذلك، ولا إلى الترقي في أسباب السماوات، وقد قال الله في حق بلقيس : { وأوتيت من كل شيء } أي: مما يؤتى مثلها من الملوك، وهكذا ذو القرنين يسر الله له الأسباب، ـــ أي: الطرق والوسائل ـــ إلى فتح الأقاليم والرستيق والبلاد والأراضي، وكسر ـــ الأعداء وكبت ملوك الأرض، وإذلال أهل الشريك، قد أوتي من كل شيء مما يحتاج إليه مثله سببا، والله أعلم ) ا.هــ 

(1) وعزاه السيوطي في الدر المنثور (450/5) إلى تفسير ابن أبي حاتم.  

অর্থ: ইবনে লাহিয়াহ বর্ণনা করেন সালিম ইবনে গায়লান হতে, তিনি সাঈদ ইবনে আবী হেলাল হতে এই মর্মে যে, হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) হযরত কা’আব আল-আহবার (رضي الله عنه)’কে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি বলে থাকেন হযরত যুল-ক্বারনাইন তাঁর ঘোড়াকে আল-সুরায়্যা (তারকার) সাথে বেঁধে রাখতেন?” হযরত কা’আব (رضي الله عنه) উত্তর দেন, “আমি তা বলেছি, কেননা আল্লাহতা’লাও এরশাদ করেছেন: ‘নিশ্চয় আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছি এবং প্রত্যেক বস্তুর একটা উপায়-উপকরণ দান করেছি’ (১৮:৮৪)।” হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কর্তৃক হযরত কাআব (رضي الله عنه)’কে নিষেধ করাটা সঠিক; আর তিনি সঠিক ছিলেন, যেহেতু হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) হযরত কাআব (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলতেন: “এটা স্রেফ তাঁর মিথ্যেগুলো হতে আমাদের গৃহীত সতর্কতার সূত্রেই” – এ কথা দ্বারা তিনি হযরত কাআব (رضي الله عنه)’এর ধর্মশাস্ত্রলিপি তথা পূর্ববর্তী কিতাবের দিকে ইঙ্গিত করতেন এ মর্মে যে, সেগুলো রদবদল হয়ে গিয়েছিলো; তবে সেটা এ জন্যে (কোনোক্রমেই) নয় যে হযরত কা’অব (رضي الله عنه) তাঁর লিপিগুলোর ব্যাপারে মিথ্যাচার করছিলেন। উপরন্তু, তাঁর কাছে রক্ষিত ওই শাস্ত্রীয় লিপির প্রকৃতি ছিলো সেগেুলো ইসরাইলী বিবরণ হতে গৃহীত হয়েছিলো, যার বেশির ভাগই (তখন) বিকৃত বা রদবদল হয়ে গিয়েছিলো; এমন কী বানোয়াটও হয়ে গিয়েছিলো। আর আল্লাহতা’লা ও রাসূল (صلى الله عليه وسلم) আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, তারপরে সেগুলোর কোনো প্রয়োজনই আমাদের কাছে নেই। বস্তুতঃ এসব শাস্ত্রলিপি দ্বারা মানুষের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, মন্দেরও প্রসার ঘটেছে। অধিকন্তু, হযরত কা’আব (رضي الله عنه)’এর কৃত – ‘নিশ্চয় আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছি এবং প্রত্যেক বস্তুর একটা উপায়-উপকরণ দান করেছি’ (১৮:৮৪) – এই কালামুল্লাহ শরীফের ব্যাখ্যাটি এবং এর পক্ষে প্রমাণস্বরূপ হযরত যুল-ক্বারনাইনের ঘোড়া আল-সুরায়্যা তারকার সাথে বাঁধার ইহুদী শাস্ত্রীয় বিবরণটি সঠিক নয় এবং (বাস্তবতার সাথেও) সঙ্গতিপূর্ণ নয়; কেননা তা এবং তার পাশাপাশি আসমানে গমন মানুষের ক্ষমতার অতীত। আল্লাহতা’লা রানী বিলক্বীস সম্পর্কে ঘোষণা করেন: “আর তাকে (বিলক্বীসকে) সবকিছু থেকে দেয়া হয়েছে (২৭:২৩)।” এর মানে রাজা-বাদশাহদের যা মঞ্জুর করা হতে পারে, তা-ই তাঁকে দেয়া হয়েছিলো। অনুরূপভাবে, হযরত যুল-ক্বারনাইন’কেও এসব উপায়-উপকরণ মঞ্জুর করে আল্লাহতা’লা তাঁর জন্যে বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চল জয়, অত্যাচারীদের পতন সাধন ও মুশরিকদের হেয়করণ সহজতর করে দেন। এসব দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত উপায়-উপকরণ তাঁকে দান করা হয়। আর আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভালো জানেন। [ইবনে কাসীর কৃত তাফসীর, ৫:১৯০]

৫/ ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) আপন এসনাদ-সহ ‘আল-আদাব আল-মুফরাদ’ (৫৬৪) গ্রন্থে হযরত উরওয়াহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন:

كنت جالسا عند معاوية، فحدث نفسه ثم انتبه، فقال: لا حلم إلا بتجربة. يعيدها ثلاث.

অর্থ: একবার আমি হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর সাথে উপবিষ্ট ছিলাম এবং তিনি অন্যমনস্ক হয়ে আপনাআপনি কথা বলছিলেন; অতঃপর সচেতন হন। তিনি বলেন: ‘অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো ধৈর্য নেই।’ এ কথা তিনি তিন বার উচ্চারণ করেন।

হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ছিলেন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এমনই নিখুঁত দৃষ্টান্ত যে, ইমাম ইবনে আবীদ্ দুনইয়া (رحمة الله عليه) তাঁর ধৈর্য-সহ্য সম্পর্কে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন; ইমাম ইবনে আসিম (رحمة الله عليه)-ও অনুরূপ একটি গ্রন্থ সংকলন করেন।

৬/ আবূ বকর আল-দীনওয়ারী নিজস্ব এসনাদ-সহ তাঁর ‘মুজা’লাসাহ’ (২১৪০) পুস্তকে বর্ণনা করেন:

نظر معاوية إلى ابنه وهو يضرب غلاما له؛ فقال له: أتفسد أدبك بأدبه؟ فلم ير ضاربا غلاما له بعد ذلك.

অর্থ: একবার হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) তাঁর ছেলের দ্বারা জনৈক গোলামকে প্রহৃত হতে দেখেন। তাই তিনি তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, “তুমি কি তাকে আদবশীল করতে নিজের আদবশীলতাকে দূষণীয় করছো?” এরপর হতে তাকে আর কোনো গোলামের প্রহারে দেখা যায়নি। [বঙ্গানুবাদকের নোট: অনুবাদে এসনাদ বাদ দেয়া হয়েছে; মূল আরবীতে তা বিদ্যমান]

৭/ একই লেখক তাঁর ‘মুজা’লাসাহ’ (৮০১) কিতাবে হযরত আবূ সুফইয়ান ইবনে আল-আলা (رضي الله عنه)’এর এসনাদে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন:

إني لأرفع نفسي ــ أن يكون ذنب أو وزن من حلمي.

অর্থ: আমার সত্তাগত প্রকৃতি (এতো) অধিকতর উন্নত যে, তা কোনো পাপকর্মকে আমার ধৈর্যের চেয়ে ওজনবিশিষ্ট হতে দেয় না। 

ইমাম ইবনে আবীদ্ দুনইয়া (رحمة الله عليه) নিজস্ব ‘আল-হিলম’ (৩২) ও ‘আল-ইশরা’ফ’ (৩৩৭) পুস্তক দুটোতে এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন হযরত আল-আলা (রা:) হতে, যিনি হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর কথা উদ্ধৃত করেন: 

قال معاوية: ما يسرني بذل الكرم حمر النعم.

অর্থ: দয়া-দাক্ষিণ্যের চেয়ে লাল উটও আমাকে বেশি সন্তুষ্ট করতে পারে না।

এটা আল-মাদা’য়িনী হতে বর্ণিত হয়েছে আল-বালা‘যুরী কৃত ‘আনসা’ব আল-আশরা’ফ’ (৫:৩২) গ্রন্থেও। 

৮/ আবূ যুর’আহ আল-দিমাশক্বী নিজ ‘তারীখ’ (১:২৩১) পুস্তকে আবূ ইঊসুফ আল-হা’জিব হতে বর্ণনা করেন:

قدم أبو موسى الأشعري؛ فنزل بعض الدور بدمشق فكان معاوية يخرج ليلاً يستمع قراءته.

অর্থ: হযরত আবূ মূসা আল-আশআরী (رضي الله عنه) একবার দামেশক্বে আগমন করেন এবং কোনো গৃহে অবস্থান করছিলেন; এমতাবস্থায় হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সেখানে রাতে যেয়ে তাঁর ক্বুরআন তেলাওয়াত শুনতেন। 

৯/ একই গ্রন্থকার তাঁর ওই ইতিহাস বইয়ে (১:২২৩) নিজস্ব এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন:

 وقال أبو زرعة أيضا في تاريخه (223/1): حدثنا أبو مسهر قال حدثنا سعيد: أن فضالة بن عبيد توفي في خلافة معاوية. قال: فحمل معاوية سريره؛ وقال لابنه عبد الله: أعقبني أي بني؛ فإنك لن تحمل بعده مثله. 

অর্থ: হযরত ফাদালাহ ইবনে উবায়দ (রা:) হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর খেলাফত আমলে বেসালপ্রাপ্ত হন। অতঃপর খলীফা (রা:) তাঁর খাটিয়া বহন করেন এবং তাঁরই পুত্র আবদুল্লাহকে ওতে যোগ দিতে বলেন; কেননা এ রকম কারো মরদেহ সে আর কখনোই বহন করতে পারবে না।

১০/ আবূ যুর’আহ আল-দিমাশক্বী নিজস্ব এসনাদ-সহ তাঁর প্রণীত ‘তারীখ’ (১:৫৯৩) গ্রন্থে আরো বর্ণনা করেন ক্বাবীসাহ ইবনে জা’বির (রহ:) হতে, যিনি বলেন:

وقال أبو زرعة أيضا في تاريخ (593/1): وحدثني أحمد بن شبويه قال حدثنا سليمان بن صالح قال حدثني عبد الله بن المبارك عن جرير بن حازم عن عبد الملك بن عمير عن قبيصة بن جابر قال: قدمت على معاوية فرفعت إليه حوائجي فقضاها؛ قلت: لم تترك لي حاجة إلا قضيتها؛ إلا واحدة فأصْدِرها مصدرها. قال: وما هي؟ قلت: من ترى لهذا الأمر بعدك؟ قال: وفيم أنت من ذاك؟ قلت: ولم يا أمير المؤمنين؟ والله إني لقريب القرابة؛ وادُّ الصدر عظيم الشرف قال: فوالي بين أربعة من بني عبد مناف ثم قال: أما كرمة قريش: فسعيد بن العاص؛ وأما فتاها؛ حياءً وحلماً وسخاءً فابن عامر؛ وأما الحسن بن علي فسيد كريم وأما القارئ لكتاب الله الفقيه في دين الله الشديد في حدود الله مروان بن الحكم وأما عبد الله بن عمر فرجل نفسه؛ وأما الذي يرد ورود كذا؛ ويروغ رواغ الثعلب فعبد الله بن الزبير. 

অর্থ: আমি হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর কাছে গিয়ে তাঁর বরাবর আমার প্রয়োজনগুলো (আর্জি হিসেবে) পেশ করি; আর তিনি তা মেটাবার ব্যবস্থা করেন। আমি বলি: “আপনি তো আমার কোনো প্রয়োজনই পূরণের বাদ রাখেননি, স্রেফ একটি ছাড়া; সেটা কী আমি তা স্পষ্ট বলবো।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “সেটা কী?” আমি উত্তরে বলি: “আপনার পরে কে এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব নেবেন?” খলীফা (পাল্টা) প্রশ্ন করেন: “এতে আপনার এতো আগ্রহ কেন?” আমি উত্তরে বলি: “ওহে আমীরুল মো’মেনীন, কেন (আগ্রহ) নয়? আল্লাহর শপথ! আমি হলাম আপনার একজন অতি নিকটাত্মীয়, অত্যন্ত অনুগত ও অভিজাত।” তিনি বলেন, “বনী আবদে মানাফের চারজনের মধ্য হতে নেতা নিযুক্তি।” অতঃপর বলেন, “ক্বুরাইশের মহৎ ব্যক্তিস্বরূপ হচ্ছেন সাঈদ ইবনে আল-’আস (رضي الله عنه)। বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও উদার তরুণ হিসেবে আছেন ইবনে আমির (رضي الله عنه)। আর হযরত হাসান ইবনে আলী (رضي الله عنه) হচ্ছেন একজন সাইয়্যেদ, মহৎ (অভিজাত) ব্যক্তিত্ব। ক্বুরআন মজীদের তেলাওয়াতকারী ও ধর্মের ফেক্বাহবিদ/গবেষক এবং শাস্তির বিধান জারিকারক হচ্ছেন মারওয়ান ইবনে হাকাম। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হচ্ছেন আপনাতে হারানো ব্যক্তিত্ব। আর (অভীষ্ট্য লক্ষ্যে) পৌঁছুনোর মানুষ ও শেয়ালের মতো ধূর্ত হচ্ছেন আবদুল্লাহ ইবনে আল-যুবায়র (رضي الله عنه)।”

১১/ এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান নিজ ‘তারীখ’ (১:৩০৩) পুস্তকে তাঁর এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন ইয়্যাস ইবনে আবী রামলাহ আল-শা’মী হতে, যিনি বলেন:

وقال يعقوب بن سفيان في تاريخه (303/1): حدثني أبو يوسف حدثني عبيد الله بن موسى أخبرنا إسرائيل عن عثمان  عن إياس بن أبي رملة الشامي قال: سمعت معاوية سأل زيد بن أرقم: أشهدت مع رسول صلى الله عليه وسلم عيدين اجتمعا في يوم واحد؟ قال: نعم . [قال]: فكيف صنع؟ قال: صلى العيد ثم رخص في الجمعة فقال: من شاء أن يصلي فليصل . 

অর্থ: তিনি হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’কে শুনেছেন যায়দ ইবনে আরক্বাম (رضي الله عنه)’কে জিজ্ঞেস করতে এ কথা: “আপনি কি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সাথে একই দিনে দুইটি ঈদ প্রত্যক্ষ করেছেন?” তিনি উত্তর দেন: “হ্যাঁ।” হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) অতঃপর প্রশ্ন করেন: “রাসূল (صلى الله عليه وسلم) কী করেছিলেন?” হযরত যায়দ (رضي الله عنه) উত্তরে বলেন: “তিনি ঈদের নামায পড়েন এবং জুমুআ’র নামাযে ছাড় মঞ্জুর করেন; যারা তা পড়ার ইচ্ছা করে, তারা পড়তে পারবে।”

১৩/ উক্ত বর্ণনাকারী নিজ ‘তারীখ’ (১:৩৬৭-৮) গ্রন্থে আপন এসনাদ-সহ আরো বর্ণনা করেন হুমায়দ ইবনে আবদীল রহমান ইবনে আউফ (رضي الله عنه) হতে, যিনি বলেন তিনি শুনেছেন হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’কে মদীনায় খুতবা দানকালে এ কথা বলতে: 

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول هذا اليوم: هذا اليوم عاشوراء ولم يكتب الله صيامه عليكم وأنا صائم؛ فمن أحب أن يصوم فليصم ومن أحب أن يفطر فليفطر .

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’কে এই দিনে বলতে শুনেছি: “এই দিনটি হচ্ছে আশূরা’র দিন (১০ই মহর্রম) এবং আল্লাহ এতে তোমাদের প্রতি রোযা বিধান করেন নি; তবু আমি রোযা রেখেছি। তোমাদের মধ্যে যারা এ দিন রোযা রাখা পছন্দ করে, তারা তা রাখতে পারবে; আর যারা রোযা রাখতে চায় না, তারা খেতে পারবে।”

১৪/ উক্ত বর্ণনাকারী তাঁর ‘তারীখ’ (১:৪১৩) কিতাবে নিজস্ব এসনাদ-সহ আরো বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ ইবনে রাবা’হ আল-সুলামী (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে:

أنه صلى مع معاوية يوم طعن بايلياء ركعة وطعن معاوية حين قضاها فما زاد أن يرفع رأسه من سجوده فقال معاوية للناس: أتموا صلاتكم . فقام كل امرئ فأتم صلاته؛ لم يقدم أحداً ولم يقدمه الناس .

অর্থ: তিনি (সুলামী) হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর সাথে ওই দিনটিতে নামায আদায় করেছিলেন, যখন জেরুসালেমে প্রথম রাকআত নামায শেষ করার পর দ্বিতীয় রাকআতে ওঠার সময় তিনি ছুরিকাহত হন, আর তাঁর প্রতিক্রিয়া কিছুই ছিলো না সেজদাহ থেকে নিজ শির মোবারক তুলে মানুষকে ‘তোমাদের নামায সম্পন্ন করো’ – কথাটি বলা ব্যতিরেকে; ফলশ্রুতিতে সবাই বাকি নামায সুসম্পন্ন করেন। তিনি কাউকে (ইমামতির জন্যে) সামনে অগ্রসর হতে ডাকেন নি, কেউ অগ্রসরও হন নি।

১৫/ এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান তাঁর ‘তারীখ’ (১:৪৫৮) গ্রন্থে ক্বাবীসাহ ইবনে জা’বের (রা:)’এর এসনাদে একটি দীর্ঘ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, যেখানে ক্বাবীসাহ (রা:) বলেন:

حدثنا أبو بكر قال حدثنا سفيان قال حدثني طلحة بن يحيى قال حدثتني جدتي سعدى بنت عوف المُرية قالت: دخلت على طلحة بن عبيد الله يوماً وهو حائر فقلت له: مالي أراك حائراً أرابك شيء من أهلك فنعتبك؟ فقال: ما رابن يمنك ريب ولنعم حليلة المرء المسلم أنت؛ إلا أنه اجتمع في بيت المال مال كثير غمني. قالت: فقلت: وما يمنعك منه. أرسل إلى قومك واقسمه بينهم. قالت: فأرسل إلى قومه فقسمه بينهم. قال سعدى: فسألت الخازن: كم كان؟ قال: أربع مائة ألف. ثم رجع إلى حديث (( قبيصة بن جابر قال: وصحبت معاوية بن أبي سفيان فما رأيت رجلاً أنصع ـ أو قال: أبين ـ طرفاً ولا أحلم جليساً منه؛ وصحبت زياداً فما رأيت رجلاً أخصب رفيقاً ولا أكرم جليساً ولا أشبه سريرة بعلانية منه. وصحبت المغيرة بن شعبة فلو أن مدينة لها ثمانية أبواب لا يخرج من باب منها إلى بمكر لخرج من أبوابها كلها )).  

অর্থ: আমি মুয়াবিয়া বিন আবী সুফিয়ান (رضي الله عنه)‘এর সোহবতে (মানে সাহচর্যে) ছিলাম এবং আমি এমন কোনো ব্যক্তিকে দেখি নি, যাঁর এতোখানি স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা ছিলো (মানুষ ও পরিস্থিতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে); তাঁর মতো ধৈর্য-স্থৈর্যসম্পন্ন এমন কোনো সাহাবীকেও দেখিনি; আর আমি যিয়াদের সাহচর্যে ছিলাম, যাঁর চেয়ে উদার সাহাবী আমি দেখি নি এবং যাঁর সর্বসাধারণ্যে নির্বাহিত বাহ্যিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের সাযুজ্য তথা সঙ্গতির মতো কারো জীবনে এমন সঙ্গতিও দেখি নি। আর আমি মুগীরাহ ইবনে শু’বাহ’কে দেখেছি যিনি এমন এক ব্যক্তি, আট দরজাবিশিষ্ট শহরে অবস্থান করে কেউ আপন চিকন বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার দ্বারা তা হতে পালানোর সামর্থ্য রাখলে, কেবল তিনি-ই সেই সামর্থ্য রাখতেন।

১৬/ এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান নিজ ‘তারীখ’ (২:৩৮০-৩৮১) গ্রন্থে তাঁর এসনাদ-সহ সুলায়ম ইবনে আমর আল-খুবা’ইরী হতে আরো বর্ণনা করেন:

 حدثنا أبو اليمان قال حدثنا صفوان عن سليم بن عامر الخبائري: أن السماء قحطت فخرج معاوية بن أبي سفيان وأهل دمشق يستسقون؛ فلما قعد معاوية على المنبر قال: أين يزيد بن الأسود الجرشي؟ فناداه الناس؛ فأقبل يتخطى الناس فأمر معاوية فصعد المنبر فقعد عند رجليه؛ فقال معاوية: اللهم إنا نستشفع إليك اليوم بخيرنا وأفضلنا اللهم إنا نستشفع إليك بيزيد بن الأسود الجرشي. يا يزيد ارفع يديك إلى الله؛ فرفع يزيد يديه ورفع الناس أيديهم؛ فما كان أوشك أن فارت سحابه في الغرب كأنها ترس وهبت لها ريح فسقينا حتى كاد الناس ألا يبلغوا منازلهم. 

অর্থ: একবার খরা দেখা দিয়েছিলো এবং হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) দামেশ্কবাসীকে সাথে নিয়ে এসতেসক্বা’র নামাযের উদ্দেশ্যে তথা বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করতে বের হন। তিনি মিম্বরে বসে এয়াযীদ ইবনে আল-আসওয়াদ আল-জুরাশী (رضي الله عنه) কোথায় জিজ্ঞেস করেন। মানুষেরা তাঁকে ডেকে আনেন এবং তাঁর জন্যে রাস্তা ছেড়ে দেন যতোক্ষণ না তিনি মিম্বরের সামনে এসে পৌঁছেন। হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) তাঁকে মিম্বরে আরোহণ করতে বলেন আর তিনি নিজে তাঁর কদমে বসে থাকেন। অতঃপর হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) বলেন: “হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করছি আমাদের মাঝে সেরা ও সবচেয়ে পুণ্যবান ব্যক্তিত্বের খাতিরে; আমরা এয়ায়ীদ ইবনে আল-আসওয়াদ (رضي الله عنه)’এর ওয়াস্তে আপনার দরবারে প্রার্থনা করছি। হে এয়াযীদ, আপনি আল্লাহর দরবারে হাত তুলুন।” এমতাবস্থায় হযরত এয়াযীদ (رضي الله عنه) তাঁর দু হাত তুলে দুআ’ করেন এবং মানুষেরাও তাঁদের দু হাত তোলেন। সহসা পশ্চিম দিক থেকে একটি মেঘ আবির্ভূত হয়, বায়ুপ্রবাহ যেটাকে আপন শক্তি দ্বারা পরিচালিত করছিলো; আর অমনি বৃষ্টিপাত আরম্ভ হয়ে যায়, যার দরুন মানুষেরা মুষলধারায় বর্ষণের ফলে প্রায় নিজ নিজ গৃহে ফিরতে পারেন নি (মানে তাঁরা ভিজে গিয়েছিলেন)। 

১৭/ এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান নিজ ‘তারীখ’ পুস্তকে (২:৪১০) সাঈদ ইবনে আসাদের সূত্রে আলী ইবনে আবী হামলাহ হতে একটি এসনাদে আরো বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন:

أصاب الناس قحط بدمشق وعلى الناس الضحاكين قيس الفهري فخرج بالناس يستسقي فقال: أين يزيد بن الأسود الجرشي؟ فلم يجبه أحد ثم قال: أين يزيد بن الأسود الجرشي؟ فم يجبه أحد ثم قال: أين يزيد بن الأسود الجرشي؟ عزمت عليه إن كان يسمع كلامي إلا قام. فقام عليه برنس واستقبل الناس بوجهه ورفع جانبي برنسه على عاتقيه؛ ثم رفع يديه ثم قال: أي رب إن عبادك قد تقربوا بي إليك فاسقهم. قال: فانصر ـ الناس وهم يخوضون الماء. فقال: اللهم إنه قد شهرني فأرحني منه. قال: فما أتت عليه إلا جمعة حتى قتل الضحاك. 

অর্থ: একবার দামেশক্বের অধিবাসীরা খরা-পীড়িত হন। তাঁদেরকে নেতৃত্ব দেন আল-দাহহা’ক ইবনে ক্বায়স আল-ফিহরী, আর তিনি মানুষকে সাথে নিয়ে এসতেসক্বা’র নামাযে (বৃষ্টি প্রার্থনায়) বের হন। তিনি জিজ্ঞেস করেন এয়াযীদ ইবনে আল-আসওয়াদ জুরাশী (رضي الله عنه) কোথায়, কিন্তু কেউই জবাব দেননি; তিনি বারবার এয়াযীদ আল-আসওয়াদের (رضي الله عنه) নাম ধরে ডাকেন এবং তিনি উপস্থিত থাকলে সামনে আসতে বলেন। বুরনুস (শিরাবরণ-সহ আলখাল্লা) পরিহিত এক ব্যক্তি এগিয়ে আসেন এবং তিনি যখন মানুষের মুখোমুখি হন, তখন নিজের কাঁধে ওই শিরাবরণ নামিয়ে দু হাত তুলে দুআ’ করেন: “হে আমার প্রভু, মানুষেরা আমার দোহাই দিয়েছেন যেনো আপনি তাঁদেরকে বৃষ্টি মঞ্জুর করেন।” এমতাবস্থায় মানুষেরা বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরেন। অতঃপর এয়াযীদ আল-আসওয়াদ (رضي الله عنه) বলেন: “এয়া আল্লাহ, তিনি (দাহহা’ক) আমাকে পরিচিত করে দিয়েছেন; অতএব তাঁর থেকে আমাকে স্বস্তি মঞ্জুর করুন।” এই ঘটনার এক সপ্তাহও পার হয়নি, আল-দাহহা’ক নিহত হন। 

সাঈদ ইবনে আসাদ একই এসনাদে বর্ণনা করেন:

حدثنا سعيد أن معاوية قضى عن عائشة ثمانية عشر ألف دينار.

অর্থ: হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه) হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها)’এর পক্ষে ১৮০০০ স্বর্ণ মুদ্রা পরিশোধ করেন।

১৮/ এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান আপন ‘তারীখ’ (২:৪৭৯) গ্রন্থে আল-আওযাঈ হতে একটি এসনাদে বর্ণনা করেন:

كان معاوية بن أبي سفيان أول ما اعتذر إلى الناس في الجلوس في الخطبة الأولى في الجمعة؛ ولم يضع ذلك إلا لكبر سنه وضعفه..

অর্থ: হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه)-ই জুমুআ’র প্রথম খুতবাটি সর্বপ্রথমে বসে দেন; আর এ ব্যাপারে তাঁর প্রদর্শিত কারণ ছিলো তাঁর বেশি বয়স (মানে বার্ধক্য)।

১৯/ এয়াক্বূব ইবনে সুফিয়ান তাঁর লিখিত ‘আল-মারিফাহ ওয়াল-তা’রীখ’ (৩:৩৭৩) গ্রন্থে আরো বলেন:

وقال يعقوب بن سفيان في تاريخه (373/3): أخبرنا أبو الحسين بن الفضل القطان أبنا عبد الله بن جعفر ثنا يعقوب بن سفيان ثنا سليمان ثنا عمر بن علي بن مقدم عن هشام بن عروة عن أبيه قال: دخلت على معاوية فقال لي: ما فعل المسلول؟ قال قلت: هو عندي فقال: أنا والله خططتة بيدي أَقْطَعَ أبو بكر الزبير رضي الله عنه أرضاً فكنت أكتبها قال: فجاء عمر فأخذ أبو بكر يعني الكتاب فأدخله في ثني الفراش فدخل عمر رضي الله عنه فقال: كأنكم على حاجة؟ فقال أبو بكر رضي الله عنه: نعم فخرج فأخرج أبو بكر الكتاب فأتممته.   

অর্থ: সুলাইমান আমাদের কাছে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: উমর ইবনে আলী আমাদের কাছে বর্ণনা করেন হিশাম ইবনে উরওয়াহ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, যিনি বলেন: আমি মু’আবিয়া (রা:)’র কাছে উপস্থিত হলে তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেন, ‘আল-মাসলূল (একটি দলিলের নাম) কোথায়?’ আমি তাঁকে জানাই সেটা আমার সাথেই আছে। অতঃপর তিনি বলেন, “ওয়াল্লাহ! আমি তা নিজ হাতে লিখেছিলাম। হযরত আবূ বকর (রা:) আল-যুবায়র (রা:)-এর জন্যে একটি জমি বরাদ্দ দিচ্ছিলেন এবং আমি তা রেকর্ড করছিলাম। এমতাবস্থায় হযরত উমর (রা:) সেখানে উপস্থিত হলে হযরত আবূ বকর (রা:) দলিলটি নিয়ে ম্যাট্রেস তথা ফরাশের ভাঁজে রেখে দেন। হযরত উমর (রা:) সেখানে প্রবেশ করে বলেন, ‘মনে হচ্ছে আপনারা এখানে ব্যক্তিগত আলাপে রত, তাই নয় কি?’ হযরত আবূ বকর (রা:) ইতিবাচক উত্তর দিলে হযরত উমর (রা:) স্থানত্যাগ করেন। অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা:) দলিলটি আবার বের করেন এবং আমি তা লেখা সম্পন্ন করি।”

২০/ ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه) নিজ ‘সুনান’ গ্রন্থে আপন এসনাদ-সহ হিমইয়ার অঞ্চলের অধিবাসী সুলায়ম ইবনে আ’মির হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন:

كان بين معاوية وبين الروم عهد؛ وكان يسير نحو بلادهم؛ حتى إذا انقضى ـ العهد غزاهم؛ فجاء رجل على فرس أو برذون وهو يقول: الله أكبر؛ الله أكبر؛ وفاء لا غدر؛ فنظروا فإذا عمرو بن عبسة؛ فأرسل إليه معاوية فسأله؛ فقال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: (( من كان بين وبين قوم عهد فلا يشد عقدة ولا يحلها حتى ينقضي أمدها؛ أو ينبذ إليهم على سواء )). فرجع معاوية.

অর্থ: হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه) ও রোমানদের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি ছিলো, আর তিনি তাদের রাজ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অতঃপর যখন সন্ধির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়, তখন তিনি রোমানদেরকে আক্রমণ করেন। এক ব্যক্তি ঘোড়া বা মালবাহী ঘোড়ায় চড়ে আসেন এ কথা উচ্চারণ করতে করতে: আল্লাহ মহান; আল্লাহ মহান; ওয়াফাদারী (কথা রক্ষায় বিশ্বস্ততা) হোক, গাদ্দারী (বিশ্বাসঘাতকতা) না হোক। তাঁরা যখন তাকান, তখন দেখেন ওই ব্যক্তি হচ্ছেন আমর ইবনে আবাসাহ (رضي الله عنه)। হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه) তাঁকে ডেকে পাঠান এবং (এ ব্যাপারে) জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’কে বলতে শুনেছি, ‘যখন কেউ কোনো জাতির সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ থাকে, তখন তার উচিৎ নয় তা কষে ধরা বা মুক্ত করা, যতোক্ষণ না ওই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়, অথবা সে তাদের (বিরোধী জাতির) সাথে মিল রেখে সেটার পরিসমাপ্তি ঘটায় (যাতে উভয় পক্ষ সমান বা সমতায় থাকে)’।” এতদশ্রবণে হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه) ফেরত চলে আসেন।

ওপরের বিবরণটি সর্ব-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মুসনাদ ৪:১১১) এবং তিরমিযী (১৫৮০)-ও বর্ণনা করেন; আর ইমাম তিরমিযী (رحمة الله عليه) বলেন – وقال: حديث حسن صحيح ا.هــ – অর্থ: ‘হাদীসটি হাসান সহীহ।’ তবে আবূ হা’তিম তাঁর পুত্রের ‘মারাসীল’ (৩১০) পুস্তকে বলেন – سليم بن عامر لم يدرك عمرو بن عبسة – অর্থ: ‘সুলায়ম ইবনে আমির চিনতেন না আমর ইবনে আবাসাহ’কে।’ 

“বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে” মর্মে সহীহ হাদীস ও অন্যান্য লিপির সাথে এর সম্পর্কযুক্তকরণ

আল-বুখারী (رحمة الله عليه) তাঁর ‘সহীহ’ (২৬৫৭) পুস্তকে হযরত ‘ইকরিমা (رضي الله عنه) হতে নিজস্ব এসনাদে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন যে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁকে এবং আলী ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه)’কে নির্দেশ দেন হযরত আবূ সাঈদ (رضي الله عنه)’এর কাছে গিয়ে তাঁর রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলো শ্রবণ করতে; অতঃপর তাঁরা সেখানে যান এবং আবূ সাঈদ (رضي الله عنه) ও তাঁর ভাইকে তাঁদের মালিকানাধীন একটি বাগানে সেচ দিতে দেখেন। তাঁদের দু জনকে দেখতে পেয়ে হযরত আবূ সাঈদ (رضي الله عنه) তাঁদের কাছে আসেন এবং পা দুটো নিজ বস্ত্রে মোড়ানো অবস্থায় গুটিয়ে বসেন; তিনি বলেন:

كنا ننقل لبن المسجد لبنة لبنة، وكان عمار ينقل لبنتين لبنتين، فمر به النبي صلى الله عليه وسلم، ومسح عن رأسه الغبار، وقال: (( ويح عمار تقتله الفئة الباغية! عمار يدعوهم إلى الله، ويدعونه إلى النار! )) 

অর্থ: (মসজিদে নববী নির্মাণকালে) আমরা মসজিদের (জন্যে) ইটগুলোর মধ্য হতে একটি ইট একবার বহন করছিলাম; আর হযরত আম্মার (رضي الله عنه) একবারেই দুটো বহন করছিলেন। এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হযরত আম্মার (رضي الله عنه)‘কে অতিক্রম করছিলেন। তিনি তাঁর শির হতে ধূলি অপসারণ করেন এবং বলেন, “আল্লাহ যেনো আম্মারের প্রতি করুণা করেন। তাকে হত্যা করবে এক মারমুখো বিদ্রোহী দল। আম্মার তাদেরকে আল্লাহ’র দিকে আহ্বান করবে (আনুগত্যের উদ্দেশ্যে), আর তারা তাকে ডাকবে জাহান্নামের দিকে।”

ইমাম মুসলিম (২৯১৫)-ও হযরত আবূ নাদরাহ (رحمة الله عليه)’এর সূত্রে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন:

أخبرني من هو خير مني أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لعمَّار، وجعل يمسح رأسه ويقول: (( بؤس ابن سمية تقتلك فئة باغية )).

অর্থ: আমার চেয়ে শ্রেয়তর কেউ আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হযরত আম্মার (رضي الله عنه)’কে বলেন যখন তিনি তাঁর শির মুছে দিচ্ছিলেন: “ওহে সুমাইয়ার পুত্র, তুমি এক দল বিদ্রোহীর দ্বারা নিহত হবে।” 

ইমাম মুসলিম (رحمة الله عليه) হযরত উম্মে সালামাহ (رضي الله عنها) হতেও এটা বর্ণনা করেন (২৯১৬) এই মর্মে যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হযরত আম্মার (رضي الله عنه)’কে বলেন:

(( تقتلك الفئة الباغية )).

অর্থ: একটি বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে।

আমি (শায়খ সা’আদ ইবনে যায়দা’ন আল-সুবাঈ) বলি: এই হাদীস সহীহ, বরঞ্চ মোতাওয়াতের (ব্যাপকভাবে বর্ণিত ও শ্রুত), ঠিক যেমনটি কিছু উলামা উল্লেখ করেছেন [ইবনে আবদিল বার্র, ‘আল-ইস্তীয়াব’, ২:৪৮১; আল-যাহাবী, ‘সিয়্যারু আলা’মিল নুবালা’ ১:৪২১; এবং ইবনে হাজর, ‘আল-ইসা’বাহ’, ২:৫১২]। আর এই বিবরণের অর্থও স্পষ্ট; এর কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই এ মর্মে যে, হযরত আলী (رضي الله عنه) সত্যের সবচেয়ে কাছে ছিলেন এবং হযরত আম্মার (رضي الله عنه) বিদ্রোহী দলের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন, যেমনটি হাদীসটিতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এটা ছিলো বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর ভবিষ্যদ্বাণীর একটা, যা তাঁরই (প্রাপ্ত) এলমে গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান) ছিলো এবং যা ছিলো তাঁরই রেসালাতের একটা নিদর্শন বা চিহ্ন। তিনি যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেভা্বেই সব কিছু ঘটেছে, আর এ কথাটি সবাই জানেন। তবে এখানে বিদ্যমান লিপিগুলোর সাথে সেসব লিপিও যোগ করা অবশ্য কর্তব্য, যা’তে প্রতীয়মান হয় হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه)’এর ইসলাম ও এর পাশাপাশি তাঁরই গুণগত বৈশিষ্ট্যসহ তাঁর সাহাবী হওয়ার মর্যাদা; আর এগুলোর অনেকগুলোই এ বইয়ে ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُواْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا ـ

অর্থ: এবং যদি মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধ করে, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও। [আল-ক্বুরআন, ৪৯:৯]

ইমাম বুখারী (২৯২৪) হযরত উমাইর ইবনে আল-আসওয়াদ (রহ:)’এর সূত্রে বর্ণনা করেন, যিনি হযরত উবাদাহ ইবনে আল-সা’মিত (রা:)’এর কাছে আসেন; ওই সময় হযরত উবাদাহ (রা:) হিমস্ (পর্বত) হতে অবতরণ করছিলেন নিজস্ব বাহনে; আর তাঁর সাথে ছিলেন হযরত উম্মে হারা’ম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)। উমাইর (রহ:) বলেন: উম্মে হারা’ম (রা:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে বলতে শুনেছেন:

أول جيش من أمتي يغزون البحر قد أوجبوا  

অর্থ: প্রথম নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী (মুসলমান) বাহিনী বেহেশতী হবে।

এমতাবস্থায় হযরত উম্মে হারা’ম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রশ্ন করেন: 

يا رسول الله (صلى الله عليه وسلم) أنا منهم؟ 

অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল (দ:)! আমি কি তাঁদের মধ্য হতে (মানে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত)?

হুযূর পাক (দ:) উত্তরে বলেন: 

 قال: أنت منهم

অর্থ: (হ্যাঁ), তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত।

ইমাম বুখারী (২৭৯৯-২৮০০) এটা বর্ণনা করেন আল-লাইস (রহ:) হতে, তিনি হযরত আনাস বিন মা’লেক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে, যিনি তাঁর খালা উম্মে হারা’ম বিনতে মালহা’ন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে রওয়ায়াতটি গ্রহণ করেন; আর বর্ণনাটির শেষে হযরত আনাস বিন মা’লেক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: 

أول ما ركب المسلمون البحر مع معاوية

অর্থ: মুসলমানবৃন্দের প্রথম নৌ অভিযান আমীরে মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক পরিচালিত হয়।

ইমাম ইবনে হাজর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘ফাতহুল বা’রী’ (৬:১৮) পুস্তকে লেখেন: 

ومعاوية أول من ركب البحر للغزاة؛ وذلك في خلافة عثمان ا.هــ

অর্থ: এবং আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ই সর্বপ্রথম নৌ অভিযান পরিচালনা্ করেন; আর এটা ছিলো হযরত উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর খেলাফত আমলে। [এ ছাড়া দেখুন তা’রীখে ইবনে জারীর তাবারী, ২:৬০১; ইবনে আসা’কির; এবং ইবনে কাসীর, ১০:২২৮]

ইমাম আবদুর রাযযাক্ব (رحمة الله عليه) নিজ ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে (৯৬২৯) বর্ণনা করেন মা’মার হতে, তিনি যায়দ বিন আসলাম হতে, তিনি আতা’ ইবনে ইয়াসির হতে এই মর্মে যে হযরত হুযায়ফা (رضي الله عنه)’এর বিবি সাহেবা বলেন:

نام رسول الله صلى الله عليه وسلم ثم استيقظ وهو يضحك، فقلت: تضحك مني يا رسول الله؟! قال: (( لا، ولكن من قوم من أمتي يخرجون غزاة في البحر مثلهم كمثل الملوك على الأسرة )). ثم نام، ثم استيقظ أيضا فضحك، فقلت:  تضحك مني يا رسول الله؟! فقال: (( لا، ولكن من قوم يخرجون من أمتي غزاة في البحر، فيرجعون قليلة غنائمهم، مغفورا لهم )). قالت: ادع الله لي أن يجعلني منهم. قال: فدعا لها.

অর্থ: একবার প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ঘুমোচ্ছিলেন এবং এরপর জেগে উঠে হাসেন; অতঃপর হযরত হুযায়ফা (رضي الله عنه)’এর বিবি সাহেবা জিজ্ঞেস করেন: “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم), আপনি কি আমার প্রতি হেসেছেন?” তিনি উত্তর দেন, “না, তবে (হেসেছি) আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল নৌ অভিযানে সমুদ্র যাত্রা করবে এমনিভাবে যেনো তারা রাজার মতো সিংহাসনে বসে আছে।” অতঃপর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) আবারো ঘুমিয়ে পড়েন; আর তিনি যখন জাগ্রত হন, তখন আবারো হাসেন। আর আমিও পুনরায় জিজ্ঞেস করি তিনি আমাকে নিয়ে হেসেছিলেন কি না। অতঃপর তিনি উত্তরে বলেন, “না, তবে (হেসেছি) আমার উম্মতের মধ্যে ওই দলটির প্রতি, যারা নৌ অভিযানে যাবে; তারা সামান্য গনীমতের মাল নিয়ে ফিরবে; আর তাদেরকে ক্ষমা করা হবে (আল্লাহর পক্ষ হতে)।” হযরত হুযায়ফা (رضي الله عنه)’এর বিবি সাহেবা আরয করেন: “দুআ’ করুন আল্লাহ যেনো আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন।” এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁর জন্যে দুআ’ করেন।

হযরত আতা’ (رضي الله عنه) বলেন:

فرأيتها في غزاة غزاها المنذر بن الزبير إلى أرض الروم وهي معنا، فماتت بأرض الروم. 

অর্থ: আমি তাঁকে (ওই মহিলাকে) দেখেছি হযরত মুনযির ইবনে যুবায়র (رضي الله عنه)’এর নেতৃত্বে (বাইজেন্টাইনীয়) রোমান রাজ্যে পরিচালিত সেনা অভিযানে এবং তিনি আমাদের সাথেই ছিলেন; আর তিনি রোমান রাজ্যেই ইন্তেক্বাল করেন।

قلت: وهذا إسناد رجاله ثقات؛ ولا شك أن الذي في الصحيح أصح وإن كان بمعناه؛ وقد صحيحه ابن حجر على شرط الصحيح، ولكنه فرق بين القصتين وأطال في ذلك (ينظر: الفتح 6283)، والأقرب أنهما قصة واحدة.

আমি (শায়খ সা’আদ ইবনে যায়দান আল-সুবাঈ) বলি: এই বিবরণের এসনাদ/সনদ সহীহ। তবে সন্দেহ নেই সহীহ সংকলনগুলোতে বিদ্যমান বিবরণগুলো আরো বেশি নির্ভরযোগ্য, যদিও অর্থ একই। ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله عليه) এই বিবরণকে ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه)’এর মানদণ্ডের ভিত্তিতে সহীহ শ্রেণিভুক্ত করেছেন। তবে তিনি এগুলোকে দুটো আলাদা আলাদা ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (৬:৮৩)। তবে অধিকতর সম্ভাব্য ব্যাপার হতে পারে এই যে, এটা একটা একক ঘটনা ছিলো।

قلت: وبضم النصوص بعضها إلى البعض الآخر اتضحت هذه المسألة؛ وقد تكلم بعض أهل العلم على هذه القضية وذكروا بعض ما تقدم.

আমি (শায়খ সা’আদ ইবনে দায়দা’ন আল-সুবাঈ) আরো বলি: কেউ লিপিগুলোকে একত্রিত বা সমন্বয় করে সামগ্রিকভাবে দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন; আর কতিপয় উলামা এটা উল্লেখও করেছেন এবং কিছু কিছুর ব্যাখ্যাও করেছেন, যা (ইতিপূর্বে) ব্যাখ্যা করা হয়েছে। [আল-ক্বুরতুবী কৃত ‘আল-তাযকিরাহ’, ৩:১৮৯]

১/ এয়াক্বূব ইবনে শায়বাহ নিজ ‘মুসনাদ’ পুস্তকে ‘আম্মার (রা:)’এর মুসনাদ’ শিরোনামের অধীনে হযরত আম্মার (رضي الله عنه) হতে বর্ণনাসমূহ উল্লেখ করে বলেন: 

سمعت أحمد بن حنبل سئل عن حديث النبي ـ صلى الله عليه وسلم ـ في عمار: ((تقتلك الفئة الباغية)) فقال أحمد: قتلته الفئة الباغية كما قال النبي ـ صلى الله عليه وسلم. وقال: في هذا غير حديث صحيح عن النبي ـ صلى الله عليه وسلم؛ وكره أن يتكلم في هذا بأكثر من هذا ا.هــ من ((منهاج السنة النبوية)) (414/4).   

অর্থ: আমি শুনেছি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه)’কে হযরত আম্মার (رضي الله عنه)-সংক্রান্ত প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর (উচ্চারিত) ‘বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে’ মর্মে হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো; এমতাবস্থায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) বলেন, “বিদ্রোহী দলটি তাঁকে হত্যা করেছিলো, যেমনিভাবে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) উল্লেখ করেছিলেন।” ইমাম সাহেব (আরো) বলেন: “এই বিবরণ রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم ) হতে সহীহ (হিসেবে) বর্ণিত নয়।” আর তিনি (হযরত ইমাম) এ বিষয়ে এর চেয়ে অধিক কথা বলতে অপছন্দ করেছেন। [মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ৪:৪১৪]

ইমাম ইবনে হাযম (রহ:) নিজ ‘আল-ফিসাল’ (৪:১২৪) গ্রন্থে বলেন:

وأما أمر معاوية رضي الله عنه فبخلاف ذلك ولم يقاتله علي رضي الله عنه لا متناعة من بيعته؛ لأنه كان يسعه في ذلك ما وسع ابن عمر وغيره، لكن قاتله لا متناعه من إنفاذ أو امره في جميع أرض الشام، وهو الإمام الواجبة طاعته فعلي المصيب في هذا، ولم ينكر معاوية قط فضل علي واستحقاقه الخلافة، لكن اجتهاده أداه إلى أن رأى تقديم أخذ القود من قتلة عثمان رضي الله عنه على البيعة، ورأى نفسه أحق بطلب دم عثمان، والكلام فيه من ولد عثمان، وولد الحكم ابن أبي العاص لسنه ولقوته على الطلب بذلك، كما أمر رسول الله صلى الله عليه وسلم عبد الرحمن بن سهل أخا عبد الله بن سهل المقتول بخيبر بالسكوت، وهو أخو المقتول وقال له: كبر كبر، وروي: الكبر الكبر، فسكت عبد الرحمن وتكلم محيصة وحويصة ابني مسعود، وهما ابنا عم المقتول لأنهما كانا أسن من أخيه، فلم يطلب معاوية من ذلك إلا ما كان له من الحق أن يطلبه، وأضاف في ذلك الأثر الذي ذكرنا وإنما أخطأ في تقديم ذلك على البيعة فقط، فله أخر الاجتهاد في ذلك ولا إثم عليه فيما حرم من الإصابة كسائر المخطئين في اجتهادهم الذين أخبر رسول الله صلى الله عليه وسلم أن لهم أجرا واحدا وللمصيب أجرين.   

অর্থ: আর হযরতে আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه)’এর বিষয়ে (বলবো), এটা ওর পরিপন্থী এবং হযরত আলী (كرم الله وجهه) তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁর বাইয়া’ত গ্রহণ না করার কারণে নয়, যেহেতু তাতে তাঁর অবকাশ ছিলো, ঠিক যেমনটি ছিলো হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)’এরও। বরঞ্চ তিনি (মানে খলীফা) তাঁর (মানে আমীরের) সাথে যুদ্ধ করেছিলেন সমগ্র শা’ম/সিরিয়া অঞ্চলে তাঁর (খলীফার) নির্দেশ পালন না করার খাতিরে; আর তিনি ছিলেন ইমাম/খলীফা যাঁর আদেশ মান্য করা ওয়াজিব/অবশ্য কর্তব্য ছিলো। অতএব, খলীফা হযরত আলী (كرم الله وجهه) ছিলেন এই বিষয়ে হক্ব/সঠিক। পক্ষান্তরে, আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه) কখনোই খলীফা (كرم الله وجهه)’এর উন্নত গুণাবলী বা তাঁর খেলাফতের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করেন নি। তবে তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদ (তথা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) তাঁকে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে পরিচালিত করেছিলো যে, খলীফা (كرم الله وجهه)’এর প্রতি বাইয়া’ত/আনুগত্য প্রকাশের আগে (পূর্ববর্তী) খলীফা হযরত উসমান (رضي الله عنه)’এর হত্যাকাণ্ডের ক্বেসাস তথা বদলা নেয়া অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হবে। আর তিনি বদলা নেয়ার ক্ষেত্রে এবং পূর্ববর্তী খলীফা (رضي الله عنه)’এর পক্ষে কথা বলার ব্যাপারে নিজেকে অধিকতর শ্রেয় অবস্থানে বলে বিবেচনা করেন; সেটা তাঁরই বয়স ও বদলা নেবার যোগ্যতার বিচারে পূর্ববর্তী খলীফা (رضي الله عنه)’এর পুত্রদের এবং হাকাম ইবনে আবী আল-আস (রা:)’এর পুত্রদের আগে আসে (বলে তিনি মনে করেছিলেন)। উদাহরণস্বরূপ, রাসূলূল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হযরত আবদুর রহমান ইবনে সাহল (رضي الله عنه)’কে খায়বর এলাকায় তাঁর ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সাহল (رضي الله عنه)’এর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকতে বলেছিলেন, যদিও তিনি ছিলেন তাঁরই ভাই। বরঞ্চ রাসূলুল্লাহ ( صلى الله عليه وسلم) বলেন, “জ্যেষ্ঠরা, জ্যেষ্ঠরা।” এমতাবস্থায় হযরত আবদুর রহমান (رضي الله عنه) নিশ্চুপ থাকেন এবং মুহাইয়্যিসাহ ও হুওয়াইয়্যিসাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنهما) কথা বলেন, কেননা তাঁরা মরহূমের চাচাতো ভাই ছিলেন এবং মরহূমের আপন ভাইয়ের চেয়ে বয়সে ছিলেন বড়। অতএব, আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه)-ও সেই অগ্রাধিকার বিবেচনায় তাঁর এ দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বিশেষ করে, আমরা যে বিবরণ ওপরে উদ্ধৃত করেছি তারই আলোকে। তিনি যে ক্ষেত্রে (ইজতিহাদী) ভ্রান্তি সংঘটন করেছেন তা কেবলমাত্র বাইয়া’তের আগে বদলা নেবার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ক্ষেত্রেই। ব্যস, অতোটুকুই। অতএব, তিনি তাঁর ইজতিহাদ তথা ফিক্বহী গবেষণার জন্যে একটি সওয়াব/পুরস্কার পাবেন এবং সঠিক সিদ্ধান্তে না পৌঁছুনোর জন্যে গুনাহের ভাগীদার হবেন না, ঠিক যেমনটি অন্যান্য মুজতাহিদবৃন্দ ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করে পাপী হন না। কেননা তাঁদের সম্পর্কে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বলেছেন যে, তাঁরা (এর দরুন) একটি সওয়াব পাবেন এবং সঠিক ইজতিহাদ প্রয়োগকারী মুজতাহিদবৃন্দ পাবেন দুটি সওয়াব। [ইবনে হাযম]          

ولا عجب أعجب ممن يجيز الاجتهاد في الدماء وفي الفروج، والأبشار، والأموال، والشرائع التي يدان الله بما من تحريم وتحليل وإيجاب، ويَعْذِر المخطئين في ذلك، ويرى ذلك مباحا لليث، وأبي حنيفة، والثوري، ومالك والشافعي، وأحمد، وداود، وإسحاق، وأبي ثور، وغيرهم، كزفر، وأبي يوسف، ومحمد بن الحسن، والحسن بن زياد وإبن القاسم، وأشهب، وابن الماجشون، والمزني، وغيرهم. 

অর্থ: এর চেয়ে বেশি তাজ্জবের কোনো কিছু হতে পারে না যাঁরা ইজতিহাদ তথা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের অনুমতি দেন, যে ইজতিহাদের ফলশ্রুতিতে রক্ত ঝরে, অথবা বৈবাহিক সম্পর্ক জায়েয হয়; কিংবা সম্পদের বিষয়াবলী বা শরীয়তের অন্যান্য বিষয় কেউ নিষেধ করেন আর কেউ অনুমতি দেন, আর অন্যান্যরা ওয়াজিব তথা বাধ্যবাধকতা আরোপ করেন; অথচ এসব ক্ষেত্রে যাঁরা ইজতিহাদী ভ্রান্তিতে পড়েন, তাঁদেরকে তাঁরা (ওজর-স্বরূপ) দায়মুক্ত করে দেন। তাঁরা এই অনুমতি দেন সর্ব-ইমাম আল-লায়স্, আবূ হানীফা, আস্ সাওরী, মালিক, শাফেঈ, আহমদ (বিন হাম্বল), দাউদ, ইসহাক্ব, আবূ সাওর ও অন্যানদের ক্ষেত্রে, ঠিক যেমনটি (অনুমতি) দেন সর্ব-ইমাম যুফার, আবূ ইঊসুফ, মুহাম্মদ ইবনে হাসান, হাসান বিন যিয়াদ, ইবনে আল-ক্বাসিম, আশহাব, ইবনে আল-মাজিশূন, আল-মুযানী ও অন্যদের (رحمة الله عليهم أجمعين)।

অতএব, তাঁদের কেউ একজন কোনো ব্যক্তির রক্তের অনুমতি দেবেন, আবার অন্য কেউ (তাতে) নিষেধ করবেন; যেমন হলো ডাকাত বা সমকামী এবং এছাড়াও অন্যান্য বিষয়, যা সংখ্যায় অনেক। তাঁদের অনেকে কোনো বিশেষ নারীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ককে জায়েয (অনুমতি) দেবেন, আর অন্যরা তা নিষেধ করবেন; এর উদাহরণ হলো সেই কুমারী নারী যাকে তার সম্মতি ছাড়াই তার পিতা বিয়ে দিয়েছেন, অথচ সে মানসিকভাবে সুস্থ ও পরিণত। এর বাইরেও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনুরূপভাবে, শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ের বেলায়ও একই অবস্থা বিরাজমান।

মু’তাযেলা গোষ্ঠী তাদের ফক্বীহ-পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে এ রকমই করেছে; এঁদের মধ্যে রয়েছেন ওয়াসিল, আমর প্রমুখ ফেক্বাহবিদ ও উলামা; ঠিক যেমনটি করেছে খাওয়ারিজ-চক্র তাদের ফক্বীহ-উলামা ও মুফতীদের সাথে। অতঃপর তারা এই বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে সেই সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যাঁরা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সাহাবা হওয়ার পাশাপাশি গুণী ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং ইজতিহাদের মর্যাদাসম্পন্ন; যথা – সর্ব-হযরত মু’য়াবিয়া, আমর ইবনে আস প্রমুখ (رضي الله عنهم أجمعين)। এই বিদ্বানমণ্ডলী স্রেফ যা করেছেন, তা হলো এমন সব বিষয়ে ইজতিহাদ প্রয়োগ করেছেন যেগুলোর ফলশ্রুতিতে রক্ত ঝরেছে; ঠিক যেমনটি মুফতীদের ফতোয়ায় ঝরে থাকে। কিছু কিছু মুফতী জাদু-বান-টোনাকারীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া আবশ্যক বিবেচনা করেন, আবার অন্যরা এর সাথে একমত হন না; তাঁদের কেউ কেউ গোলাম হত্যার দায়ে স্বাধীন ব্যক্তির প্রতি মৃত্যুদণ্ড জারি করেন, আবার অন্যরা এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন; তাঁদের কেউ কেউ কোনো অবিশ্বাসী/অ-মুসলমান (হত্যার বেলায়) মুসলমান ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাকে বৈধ বিবেচনা করেন, আর অন্যান্যরা এর সাথে একমত হন না। – فأي فرقة بين هذه الاجتهادات واجتهاد معاوية وعمرو وغيرهما، لو لا الجهل والعمى والتخليط بغير علم؟ – তাহলে এসব (মুফতীদের) ইজতিহাদ ও সর্ব-হযরত মু’য়াবিয়া, আমর ও অন্যান্য সাহাবা (رضي الله عنهم أجمعين)’বৃন্দের ইজতিহাদের মধ্যে পার্থক্য কী হতে পারে, স্রেফ কারো কারো অন্ধ-অজ্ঞতা এবং নিজেদের অজানা বিষয়াদিতে বিভ্রান্তিতে জড়ানো ছাড়া?

আমরা সম্যক অবগত যে, কারো কোনো বাধ্যবাধকতা থাকলে এবং তিনি তা পূরণে বাধা দিলে, আর সেটার খাতিরে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকলে ইমামের (মানে খলীফার) দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে ওই ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা; যদিও ওই ব্যক্তির কাজটি তা’উয়ীল তথা ন্যায্য ব্যাখ্যাপূর্ণ হয়, আর তা ওই ব্যক্তির নৈতিক সততা ও সদগুণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না; ঠিক যেমনটি তা কবীরাহ গুনাহ তথা মহাপাপের সংঘটন সাব্যস্ত হওয়াকে অপরিহার্য করে তোলে না। বরঞ্চ তাঁর ইজতিহাদের জন্যে এবং তাঁর বিবেচনায় সেরা সমাধান অন্বেষণের নিয়্যত বা উদ্দেশ্যের কারণে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা নির্দ্বিধায় বলি, হক্ব/সত্য পথটি ছিলো ইমামে আলী (كرّم الله وجهه)’এর এবং তিনি সঠিক ছিলেন নিজ ইজতিহাদে (মানে গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তে); আমরা আরো স্বীকার করি তাঁর ইমামত/খেলাফত তথা নেতৃত্বের বৈধতাকে, আর তিনি (এর জন্যে) দুটি সওয়াব লাভ করবেন: একটি তাঁর ইজতিহাদের জন্যে এবং অপরটি সঠিক সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্যে। অনুরূপভাবে, আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস সহকারে বলি, আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه) ও তাঁর পক্ষ সমর্থনকারী মুসলমানবৃন্দ ইজতিহাদে ভুল করেছিলেন, আর তাঁরা তাই একটি সওয়াব লাভ করবেন।

অধিকন্তু, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সহীহ হাদীসটিতে তিনি এক দল বিদ্রোহীর বর্ণনা দিয়েছিলেন, যারা দুটি যুদ্ধরত মুসলিম বাহিনীর কোনো একটির ভেতর থেকে বিদ্রোহ করবে, আর ওই দুটি যুদ্ধরত বাহিনীর মধ্যে যাঁরা সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকবেন, তাঁরাই ওই বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করবেন। ওই বিদ্রোহীরা বাস্তবিকই আবির্ভূত হয়েছিলো এবং তারা খাওয়ারিজ/খারেজীচক্র নামে পরিচিত হয়; হযরতে ইমামে আলী (كرّم الله وجهه)‘এর পক্ষ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সহীহ হাদীসে এসেছে – (( تقتل عمارا الفئة الباغية )) – “বিদ্রোহী দল আম্মার (ইবনে এয়াসির)’কে হত্যা করবে।”

যে মুজতাহিদ ইজতিহাদে ভুল করেন, তিনি যদি তাঁর যুদ্ধের ভিত্তিকে সত্য/ন্যায়সঙ্গত বলে বিশ্বাস করেন, আন্তরিকভাবে আল্লাহর দয়া অন্বেষণ করেন, আর তিনি যে ইজতিহাদে ভুল করেছেন সে ব্যাপারে না জানেন, তাহলে তিনি বিদ্রোহী পক্ষ হবেন বটে, কিন্তু (তাঁর ইজতিহাদের জন্যে) তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ’হাদ্দ’ তথা শরঈ আইনি শাস্তি প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করা হবে না। আর যে ব্যক্তি নিজের ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জেনেও যুদ্ধ করে, সে একজন শত্রু যোদ্ধা, যার প্রতি হাদ্দ প্রযোজ্য হবে এবং সেই সাথে বদলাও। ওই ধরনের ব্যক্তি একজন পাপী ও ইমামের বিরুদ্ধাচরণকারী সাব্যস্ত হবে; সে – المجتهد المخطئ – তথা ইজতিহাদে ভুল সংঘটনকারী মুজতাহিদ নয়। এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নিম্নবর্ণিত আয়াতে করীমায়:

وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللهِ ۚ  

অর্থ: এবং যদি মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধ করে, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি করাও। অতঃপর যদি একে অপরের প্রতি সীমালঙ্ঘন করে, তবে ওই সীমালঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতোক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে [আল-ক্বুরআন, ৪৯:৯; নূরুল এরফান]। আল্লাহ আরো ফরমান:

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَيْنَ اَخَوَيْكُمْ

অর্থ: মুসলমান-মুসলমান পরস্পর ভাই। সুতরাং আপন দু ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দাও। [আল-ক্বুরআন, ৪৯:১০; প্রাগুক্ত]

আর এটাই আমাদের কথা যা আমরা বলছি, কোনো রকম অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে; আয়াতটির স্পষ্ট মানে হতে বিচ্যুত না হয়ে।

আল্লাহতা’লা (ওপরের আয়াতে) তাঁদেরকে বিদ্রোহী ঈমানদার বলে সম্বোধন করেছেন; তাঁরা পরস্পর পরস্পরের ভাই, এমন কী যখন তাঁরা পরস্পর যুদ্ধরত (তখনো তাঁরা একে অপরের ভাই)। অপর পক্ষটি সঠিক পথের ওপর বিচরণরত, ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত – যাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হয়েছে এবং যাঁদেরকে বিদ্রোহীদের সাথে নিজেদের বিরোধ মিটমাট করার ক্ষেত্রে (খোদায়ী) আদেশ দেয়া হয়েছে। আর আল্লাহ পাক যুদ্ধের কারণে তাঁদেরকে (বিদ্রোহীদেরকে) ফাসিক্ব/পাপী হিসেবে বর্ণনা করেননি; তাঁদেরকে ঈমানী ঘাটতিসম্পন্ন বলেও বর্ণনা করেননি। স্রেফ এতোটুকুই যে তাঁরা ভুল (ইজতিহাদ প্রয়োগ) করে বিদ্রোহ করেছেন, আর তাঁরা অপর পক্ষের রক্ত ঝরাতে চাননি। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (رضي الله عنه)’কে হত্যা করেছিলেন আবূল্ গাদিয়্যা আল-জুহানী, যিনি সাহাবী হিসেবে কথিত। অতএব, গাদিয়্যা তা’উয়ীল (ভিন্নতর ব্যাখ্যা) ও ইজতিহাদ প্রয়োগ করেছিলেন, যে কাজে তিনি ভুল করেছিলেন এবং বিদ্রোহ করেছিলেন; তবু তিনি তাঁর ইজতিহাদে একটি সওয়াব পাবেন। তিনি খলীফা উসমান (رضي الله عنه)’এর খুনীদের মতো নন, যেহেতু খলীফার হত্যাকাণ্ডে ইজতিহাদের কোনো অবকাশই ছিলো না; কেননা খলীফা কাউকে হত্যা করেননি, ওত পেতে কাউকে আচমকা আক্রমণও করেননি, লুণ্ঠনও করেননি, আত্মরক্ষাও করেননি, পরকীয়ায়ও জড়াননি, অথবা ঈমান পরিত্যাগ করে মুরতাদ্দ-ও হননি, যা হয়তো তা’উয়ীলের পক্ষে ভিত্তি হতে পারতো। বস্তুতঃ তাঁকে যারা হত্যা করেছিলো, তাদেরকে প্রকাশ্য গুনাহগার বলে বর্ণনা করা হয়েছে; তারা সশস্ত্র আক্রমণকারী; নিরপরাধ রক্ত ঝরিয়েছিলো তারা, আর এ কাজ ন্যায়সঙ্গত হওয়ার পক্ষে তাদের কোনো ন্যায্য কারণ বা শাস্ত্রীয় বিধানগত কোনো ব্যাখ্যাও ছিলো না। তারা আসলেই অভিযুক্ত পাপী।

অতএব, এ বিষয়টি যদি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় এবং হযরত আলী (كرّم الله وجهه) সঠিক ছিলেন বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে কেউ ঘরে অবস্থান করে যুদ্ধে না জড়ানোর রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলো নিঃসন্দেহে তাঁদেরই প্রতি প্রযোজ্য হবে, যাঁরা কোন্ পক্ষ সঠিক ছিলেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। আর এটাই আমাদের বক্তব্য। কেননা সত্য যখন স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, তখন ক্বুরআন মজীদের দলিলের ভিত্তিতে বিদ্রোহী পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত হয়। আর যদি উভয় পক্ষ বিদ্রোহী হন, তাহলে তাঁদের উভয়েরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জরুরি, কেননা আল্লাহর কালাম/বাণী তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়; কারণ উভয়ই মূলতঃ আল্লাহ হতে আগত। যথা – আল্লাহ এরশাদ ফরমান:

 وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ ـ إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ

অর্থ: এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তা তো ওহী, যা তাঁর প্রতি (নাযিল) করা হয়। [আল-ক্বুরআন, ৫৩:৩-৪; নূরুল এরফান]

আল্লাহ অন্যত্র ফরমান:

وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ ٱللهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخْتِلاَفاً كَثِيراً 

অর্থ: এবং যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে হতো, তবে অবশ্যই তাতে বহু বিরোধ দেখতে পেতো। [আল-ক্বুরআন, ৪:৮২; প্রাগুক্ত]

অতএব, আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস-সহ জানি, মহানবী (صلى الله عليه وسلم) যা কিছু বলেছেন তা আল্লাহ হতেই আগত; এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে আল্লাহতা’লা হতে এমন কিছু আগমন করতে পারে না, যা পরস্পরবিরোধী (বা স্ববিরোধী)। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতা’লারই প্রাপ্য। 

হযরত আলী (كرّم الله وجهه) কেন যুদ্ধ করেছিলেন সে সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তির জবাব দেয়াই অবশিষ্ট রইলো; তাই আমরা বলি, আল্লাহতা’লা তৌফীক্ব দিন: 

أما قولهم إن أخذ القود واجب من قتلة عثمان رضي الله عنه والمحاربين لله تعالى ورسوله صلى الله عليه وسلم الساعين في الأرض بالفساد، والهاتكين حرمة الإسلام، والحرم والإمامة والهجرة، والخلافة والصحبة والسابقة فنعم.

অর্থ: খলীফা উসমান (رضي الله عنه)’এর হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ বা বদলা নেয়ার পক্ষীয়দের কথা প্রসঙ্গে (বলতে হয়), তাঁর হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করা ওয়াজিব তথা অবশ্যকর্তব্য ছিলো; যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলো, দুনিয়ার বুকে মন্দ ও ফাসাদ বিস্তার করেছিলো এবং যারা ধর্ম অবমাননা ও মদীনা মোনাওয়ারার পবিত্রতা ক্ষুন্ন করেছিলো, আর ইমামতের চিহ্নকে হেয় করেছিলো, সাহাবা (রা:)’বৃন্দের পুতঃপবিত্রতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছিলো, হ্যাঁ, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা অবশ্যকর্তব্য ছিলো।

وما خالفهم قط علي في ذلك ولا في البراءة منهم، ولكنهم كانوا عددا ضخما جماً لا طاقة له عليهم، فقد سقط عن علي رضي الله عنه مالا يستطيع عليه، كما سقط عنه وعن كل مسلم ما عجز عنه من قيام بالصلاة والصوم والحخ ولا فرق، قال الله تعالى: (لاَ يُكَلِّفُ ٱللهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا)، وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (( إذا أمرتكم بشئ فأتوا منه ما استطعتم ))، ولو أن معاوية بايع عليا لقوى به على أخذ الحق من قتلة عثمان، فصح أن الاختلاف هو الذي أضعف يد علي عن إنفاذ الحق عليهم، ولو لا ذلك لأنفذ الحق عليهم كما أنفذوه على قتلة عبد الله بن خباب إذ قدر على مطالبة قتلته .

অর্থ: হযরত আলী (كرّم الله وجهه) কখনোই এই বিষয়ে তাঁদের (মানে বদলার পক্ষীয়দের) বিরোধিতা করেননি; এর পাশাপাশি তিনি (ওই অপরাধে) জড়িতদের থেকেও নিজেকে দূরত্বে রাখেননি। কেননা তাদের সংখ্যা ছিলো বিপুল এবং তাদের বিরুদ্ধে তাঁর কোনো উপায়ও ছিলো না। যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো অবস্থা তাঁর ছিলো না, সেহেতু তা করার বাধ্যবাধকতা তাঁর ওপর থেকে মওকূফ হয়ে গেছে, ঠিক যেমনটা ওই মুসলমান-ব্যক্তির ওপর থেকে মওক্বূফ হয়ে যায়, যাঁর নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি ধর্মীয় কর্তব্য পালনের সামর্থ্য নেই। (এ দুইয়ে) কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আল্লাহ কোনো আত্মার ওপর বোঝা অর্পণ করেন না, কিন্তু তার সাধ্য পরিমাণ” [২:২৮৬; নূরুল এরফান]। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ঘোষণা করেন: “আমি যখন তোমাদেরকে কোনো আদেশ দেই, তখন তোমরা তা তোমাদের সাধ্য পরিমাণ পালন করো।” আর আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه) যদি খলীফা আলী (كرّم الله وجهه)’এর প্রতি বাইয়াত তথা আনুগত্য প্রকাশ করতেন, তাহলে খলীফা আলী (كرّم الله وجهه) তাঁকে হযরত খলীফা উসমান (رضي الله عنه)’এর হত্যাকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতেন। অতএব, এ কথা বলা সঠিক যে খলীফা হযরত আলী (كرّم الله وجهه) কর্তৃক সুবিচার নিশ্চিতকরণে প্রধান বাধাগুলোর একটি ছিলো ওই বিভক্তি; তা না থাকলে তিনি খলীফা হযরত উসমান (رضي الله عنه)’এর হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করার মতো অবস্থানে থাকতেন, ঠিক যেমনটা তিনি সুদৃঢ় অবস্থানে থেকে শাস্তি বিধান করেছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে খাব্বাব (رضي الله عنه)’এর হত্যাকারীদের ক্ষেত্রে।

وأما تأسي معاوية في امتناعه من بيعة علي بتأخر علي عن بيعة أبي بكر فليس في الخطأ أسوة، وعلي قد استقال ورجع وبايع بعد يسير، فلو فعل معاوية مثل ذلك لأصاب، ولبايع حينئذ بلا شك كل من امتنع من الصحابة من البيعة من أجل الفرقة، وأما تقارب ما بين علي وطلحة والزبير وسعد فنعم، ولكن من سبقت بيعته وهو من أهل الاستحقاق للخلافة فهو الإمام الواجبة طاعته فيما أمر به من طاعة الله عز وجل، سواء كان هنالك من هو مثله أو أفضل منه أو لم يكن، كما سبقت بيعة عثمان قبله فوجبت طاعته وإمامته على علي وغيره .  

ولو بويع هنالك حينئذ وقت الشورى علي أو طلحة أو الزبير، أو عبد الرحمن أو سعد لكان الإمام، وولزمت عثمان طاعته، وكذلك إذ قتل عثمان رضي الله عنه، فلو بدر طلحة أو الزبير أو سعد أو ابن عمر فبويع لكان هو الإمام ولوجبت طاعته ولا فرق .

ومعاوية مخطئ مأجور مجتهد، وقد يخفى الصواب على الصاحب العالم فيما هو أبين وأوضح من هذا الأمر من أحكام الدين، فربما رجع إذا استبان له، وربما لم يستبين له حتى يموت عليه، وما توفيقنا إلا بالله عز وجل، وهو المسئول العصمة والهداية لا إله إلا هو.

فطلب علي حقه فقاتل عليه، وقد كان له تركه ليجمع كلمة المسلمين كما فعل الحسن ابنه رضي الله عنهما، فكان له بذلك فضل عظيم قد تقدم به إنذار رسول الله صلى الله عليه وسلم إذ قال: (( ابني هذا سيد ولعل الله أن يصلح به بين طائفتين عظيمتين من أمتي )) فغبطه رسول الله صلى الله عليه وسلم بذلك، ومن ترك حقه رغبة في حقن دماء المسلمين فقد أتى من الفضل بما لا وراء بعده ومن قاتل عليه ولو أنه فلس فحقه طلب، ولا لوم عليه، بل هو مصيب في ذلك، وبالله تعالى التوفيق ) اـ هــ . 

অর্থ: হযরত আলী (كرّم الله وجهه)’এর দৃষ্টান্ত, যা’তে তিনি হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’এর খেলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বিলম্ব করেছিলেন, তা আমীরে মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه) কর্তৃক (খলীফা আলী’র প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সময়) অনুসরণ করার ক্ষেত্রে (বলবো), এতে কোনো ভুল নজির নেই। আর হযরত আলী (كرّم الله وجهه) তো নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে অনতিবিলম্বে খলীফা আবূ বকর (رضي الله عنه)’এর প্রতি বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন। অতএব, আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি তাঁকে (এ ব্যাপারে) অনুসরণ করে থাকেন, তাহলে তিনি সঠিক এবং তখন সকল সাহাবা কেরাম (রা:)-ও নিঃসন্দেহে তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করতেন, যেহেতু বিভক্তির জন্যে তাঁদের অনেকেই বাইয়াত গ্রহণে বিরত ছিলেন। যদিও সর্ব-হযরত তালহা, যুবায়র, সা’আদ (রা:)’এর মতো অনেকেরই হযরত আলী (كرّم الله وجهه)’এর কাছাকাছি মর্যাদা ছিলো, তবুও তাঁরই প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হয়েছিলো এবং তাঁকেই বৈধ ইমাম হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিলো, ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ পালনে যে ইমামের আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক; আর অনুরূপ মর্যাদার অন্যদের উপস্থিতির বিষয়টি তখন গৌণ হয়ে যায়। কেননা বাইয়াত ইতিপূর্বে হযরত উসমান (رضي الله عنه)’এর প্রতি প্রদান করা হয়েছিলো এবং তাঁরা মর্যাদায় তাঁর কাছাকাছি হলেও হযরত উসমান (رضي الله عنه)-ই ছিলেন ইমাম, আর তাঁকে মান্য করা ছিলো বাধ্যতামূলক। ওই পরামর্শক সভা কালে যদি হযরত উসমান (رضي الله عنه) সর্ব-হযরত আলী বা তালহা বা যুবায়র বা আবদুর রহমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর মতো অপর কাউকে নির্বাচন করা হতো, তাহলে তিনি-ই হতেন ইমাম এবং তখন হযরত উসমান (رضي الله عنه)’এর জন্যে তাঁকে মান্য করাও বাধ্যতামূলক হতো। হযরত উসমান (رضي الله عنه)’এর আগে যদি ওই পদ্ধতি বহাল থাকে, তাহলে তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরও তা প্রযোজ্য হবে।

অতএব, খলীফা আলী (كرّم الله وجهه) তাঁর নিজের হক্ক/অধিকার চেয়েছিলেন এবং আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন; যদিও তাঁর হক্ব প্রয়োগ/বলবৎ না করার স্বাধীনতা তাঁর ছিলো, আর তিনি মুসলিম ঐক্য বজায় রাখার জন্যে তাঁদেরকে ছেড়ে দিতে পারতেন, ঠিক যেমনিভাবে তাঁরই পুত্র ইমাম হাসান (رضي الله عنه) করেছিলেন, যাঁর সম্পর্কে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বলেছিলেন: “আমার এই পৌত্র একজন সাইয়্যেদ (ইমাম); হয়তো আল্লাহতা’লা তার মাধ্যমে আমার উম্মতের মধ্যে যুদ্ধরত দুটো বড় দলকে একতাবদ্ধ করবেন।” রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এ ব্যাপারে তাঁর প্রতি খুশি ছিলেন। নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরানো পরিহার করতে যে ব্যক্তি নিজ অধিকার ছেড়ে দেন, তিনি নিশ্চয় সাধনার অতীত উন্নত গুণগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন। আর যিনি লড়াই বেছে নেন, তা তাঁরই অধিকার বটে এবং তাঁর প্রতি এ ব্যাপারে কোনো দোষারোপ চলবে না; তিনি তাঁর এরকম অবস্থানে সঠিক। আর আল্লাহতা’লার কাছেই নিহিত সমস্ত তৌফীক্ব।

৩/ – 

وقال ابن العربي في العواصم من القواصم (ج١/ص: ١٧١ــ١٧٤): (والذي تثلج به صدوركم أن النبي صلى الله عليه وسلم ذكر في الفتن وأشار وبين وأنذر الخوارج، وقال: (( تقتلهم أدنى الطائفتين إلى الحق ))، فبين أن كل طائفة منهما تتعلق بالحق، ولكن طائفة علي أدنى إليه، وقال تعالى: { وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُواْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَىٰ ٱلأُخْرَىٰ فَقَاتِلُواْ ٱلَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيۤءَ إِلَىٰ أَمْرِ ٱللهِ فَإِن فَآءَتْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا بِٱلْعَدْلِ وَأَقْسِطُوۤاْ إِنَّ ٱللهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ } [الحجرات: ٩] ، فلم يخرجهم عن الإيمان بالبغي بالتأويل، ولا سلبهم اسم الأخوة بقوله بعده: {  إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَٱتَّقُواْ ٱللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ } [الحجرات: ١٠] ، وقال صلى الله عليه وسلم في عمار: (( تقتله الفئة الباغية )) ، وقال صلى الله عليه وسلم في الحسن: (( ابني هذا سيد ولعل الله أن يصلح به بين فئتين عظيمتين من المسلمين )) ، فحسن له خلعه نفسه وإصلاحه ) ا.هـ    

(শায়খে আকবর) হযরত মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী (رحمة الله عليه) ‘আল-আওয়াসিমু মিনাল-ক্বাওয়াসিম’ (১:১৭১-১৭৪) গ্রন্থে বলেন: তোমাদের চিত্তগুলোতে যা শান্তভাব এনে দেবে তা হচ্ছে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) মুসলমানদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং খারেজী গোষ্ঠী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ও সতর্ক করেছিলেন যখনই তিনি বলেছিলেন, “(সর্ব-হযরত আলী ও মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার বিবদমান) দুটো দলের মধ্যে সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি দলটি (খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে)।” অতএব, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ব্যাখ্যা করেছিলেন যে এই দুটো দলের প্রতিটিরই সত্যের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকবে; তবে হযরতে ইমামে আলী (كرّم الله وجهه)’এর দলটি সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি হবেন। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং যদি মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধ করে, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি করাও। অতঃপর যদি একে অপরের প্রতি সীমালঙ্ঘন করে, তবে ওই সীমালঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতোক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। অতঃপর তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে সংশোধন করে দাও এবং সুবিচার করো [আল-ক্বুরআন, ৪৯:৯; নূরুল এরফান]। আর আল্লাহতা’লা বিদ্রোহী দলটিকে ঈমানদারি থেকে খারিজ তথা বের করে দেননি তাঁদেরই ভিন্নতর ব্যাখ্যাজনিত অবাধ্যতার কারণে; তিনি তাঁদেরকে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দেননি, কেননা এর পরপরই তিনি এরশাদ ফরমান: “মুসলমান-মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং আপন দু ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়” [আল-ক্বুরআন, ৪৯:১০; নূরুল এরফান]। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হযরত আম্মার বিন এয়াসির (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেন: “বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে।” আর তিনি ইমাম হাসান (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেন: “আমার এই পৌত্র একজন সাইয়্যেদ (ইমাম); হয়তো আল্লাহতা’লা তার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধরত দুটো বড় দলকে একতাবদ্ধ করবেন।” অতএব, এ সব ঘটনায় ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’এর ভূমিকা ছিলো তিনি নিজের (খেলাফতের) অধিকার ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং মিটমাট তথা সুষ্ঠু নিষ্পত্তি নিশ্চিত করেছিলেন। [শায়খ ইবনে আরবী: আল-আওয়াসিমু মিনাল-ক্বাওয়াসিম, ১:১৭১-১৭৪]

৪/ – ইবনে তাইমিয়াহ ‘মিনহাজুস্ সুন্নাহ’ (৪:৪৬৭-৪৬৮) পুস্তকে বিবৃত করেন:

…যদিও হযরত আম্মার (رضي الله عنه) সম্পর্কে হাদীসে আছে যে বিদ্রোহী দল তাঁকে হত্যা করবে, তবে তা (হয়তো) উদ্দেশ্য করে থাকতে পারে ওই সব ব্যক্তিকে যারা বাস্তবিকপক্ষে তাঁকে হত্যা করার জঘন্য কাজটি করেছিলো; তারা বিদ্রোহী, কেননা তারা তা হতে ভিন্ন এক কারণে যুদ্ধ করেছিলো; আর এটা সম্ভব হতে পারে যে তারা যুদ্ধের আগে বিদ্রোহী ছিলো না….আর সর্ব-হযরত ইমামে আলী (كرّم الله وجهه) ও আমীরে মু’য়াবিয়াহ (رضي الله عنه) রক্তপাত এড়ানোর ব্যাপারে সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষী ছিলেন; এমন কী তা যোদ্ধাদের নিজেদের চেয়েও বেশি। তবে বাস্তবে যা ঘটেছিলো, তা তাঁদেরকে পরাস্ত করে ফেলেছিলো এবং এ ধরনের ফিতনাহ যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন এমন কী সবচেয়ে বিচক্ষণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিও (ফিতনার) এ আগুন নেভাতে অক্ষম হয়ে যান। আর (ওই সময় বিবদমান) দুটো সেনা শিবিরেই আশতার আল-নাখাঈ, হাশিম ইবনে ‘উতবাহ আল-মিরক্বাল, আবদুর রহমান ইবনে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ, আবূল আ’ওয়ার আল-সুলামীর মতো লোকেরা ছিলো, যারা যুদ্ধের পক্ষে উস্কানি দিচ্ছিলো। এই লোকদেরই কেউ কেউ চরম উগ্রতার পর্যায়ে খলীফা উসমান (رضي الله عنه)’এর (বদলার) পক্ষ সমর্থন করছিলো, আবার অন্যরা তাঁকে ফেলে পালাচ্ছিলো; আর কেউ কেউ হযরত আলী (كرّم الله وجهه)’এর পক্ষ উগ্রভাবে সমর্থন করছিলো, আবার অন্যরা তাঁকে ফেলে পালাচ্ছিলো। 

অতঃপর হযরত আমীরে মু’য়াবিয়াহ (رضي الله عنه)’এর পক্ষে যারা যুদ্ধ করেছিলো, তারাও স্রেফ তাঁরই খাতিরে তা করেনি, বরং অন্য কারণে করেছিলো। আর এ ধরনের লড়াই যা জাহেলীয়া যুগের যুদ্ধের সদৃশ ছিলো, তাতে জড়িতদের পক্ষে নিজেদের বিশ্বাস ও লক্ষ-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করা ভীষণ কঠিন এক ব্যাপার ছিলো; ঠিক যেমনটি আল-যুহরী বলেছেন:

(وقعت الفتنة وأصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم متوافرون، فأجمعوا أن كل دم أو مال أو فرج أصيب بتأويل القرآن فإنه هدر أنزلوهم منزلة الجاهلية) ا.هــ.

অর্থ: ফিতনা ঘটেছিলো এবং রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) উপস্থিত ছিলেন; আর তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন যে ক্বুরআন মজীদের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা কোনো রক্ত ঝরলে, অথবা মালামাল বা (নারীর) সতিত্ব হরণের ঘটনা ঘটলে তা জাহেলীয়া যুগের ঘটনার মতো একই দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে (মানে তা ধর্মের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হবে না)।

ইবনে তাইমিয়া উক্ত ‘মিনহাজুস্ সুন্নাহ’ (৪:৪৯৮-৪৯৯) গ্রন্থে আরো ব্যক্ত করেন:

( وأيضاً فإن الله تعالى يقول في كتابه: [ وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُواْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا ] ، فقد جعلهم مؤمنين إخوة مع الاقتتال والبغي ، وأيضاً فقد ثبت في الصحيح عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : (( تمرق مارقة على حين فرقة من المسلمين تقتلهم أولى الطائفتين بالحق )) ، وقال صلى الله عليه وسلم : (( إن ابني هذا سيد وسيصلح الله به  بين فئتين عظيمتين من المسلمين )) ، وقال صلى الله عليه وسلم لعمار : (( تقتله الفئة الباغية )) لم يقل الكافرة ، وهذه الأحاديث صحيحة عند أهل العلم بالحديث وهي مروية بأسانيد متنوعة لم يأخذ بعضهم عن بعض ، وهذا مما يوجب العلم بمضمونها ، وقد أخبر النبي صلى الله عليه وسلم أن الطائفتين المفترقتين مسلمتان ، ومدح من أصلح الله به بينهما ،  وقد أخبر أنه تمرق مارقة وأنه تقتلها  أدنى الطائفتين إلى الحق ) ا.هــ     

অর্থ: আল্লাহতা’লা আপন কিতাবে আরো ফরমান: ““এবং যদি মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধ করে, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি করাও…”; অতএব, তিনি তাঁদেরকে ঈমানদার ও ভাই (হিসেবে গণ্য) করেছেন, যদিও যুদ্ধ ও বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। উপরন্তু, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত যে তিনি বলেছেন: “একটি দল বিদ্রোহ করবে এবং তাদের সথে যুদ্ধ করবে (বিবদমান) দুটো মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি যারা তারাই।” আর প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আরো ফরমান: “আমার এই পৌত্র একজন সাইয়্যেদ (ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); আল্লাহতা’লা তার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধরত দুটো বড় দলকে একতাবদ্ধ করবেন।” এবং তিনি হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলেন: “বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে।” লক্ষ্য করুন যে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) কাফের/অবিশ্বাসী বলে সম্বোধন করেননি। আর মুহাদ্দীস আলেম-উলামার মতানুসারে এসব বিবরণ সহীহ/বিশুদ্ধ; এবং এগুলো বিভিন্ন এসনাদ/বর্ণনাকারীদের পরম্পরায় বর্ণিত হয়েছে, যাঁদের কেউই একে অপরের কাছ থেকে তা গ্রহণ করেননি; আর এটাই এসব বিবরণের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করেছে। নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) দুটো বিভক্ত দলকেই মুসলমান বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর তিনি তাঁদের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দেয়ার জন্যে ইমাম (হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি আরো ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে একটি দল বিদ্রোহ করবে এবং বিবদমান দুটো মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি বাহিনীটি বিদ্রোহীদের সাথে লড়বেন।   

৫/ – ইমাম আল-যাহাবী তাঁর ‘আল-মুনতাক্বা’ (১:২৪৯-২৫২) গ্রন্থে বিবৃত করেন:

( قال ــ أي المخالف ــ : وقاتل عليا وعلي عندهم رابع الخلفاء إمام حق وكل من قاتل إمام حق فهو باغ ظالم. 

قلنا : نعم، والباغي قد يكون متأولا معتقدا أنه على حق، وقد يكون بغيه مركبا من تأويل وشهرة وشبهة وهو الغالب.

وعلى كل تقدير فهذا لا يرد، وإنا لا ننزه هذا الرجل ولا من هو أفضل منه عن الذنوب، والحكاية مشهورة عن المسور بن مخرمة أنه خلا بمعاوية فطلب منه معاوية أن يخبره بما ينقمه عليه، فذكر المسور أموراً ، فقال : يا مسور ، ألك سيئات؟ قال نعم ، قال: أترجو أن يغفرها الله؟ قال: نعم ، قال: فما جعلك أرجى لرحمة الله مني، وإني مع ذلك والله ما خيرت بين الله وبين سواه إلا اخترت الله على ما سواه ، ووالله لما أليه من الجهاد وإقامة الحدود والأمر بالمعروف والنهي عن المنكر أفضل من عملك، وأنا على دين يقبل الله من أهله الحسنات ، ويتجاوز لهم عن السيئات….  

فإن قيل: هؤلاء بغاة لأن النبي صلى اللّٰه عليه وسلم قال لعمار: (( تقتلك الفئة الباغية )). 

قلنا: الخبر الصحيح، وقد تكلم فيه بعضهم، وبعضهم تأوله على أن الباغي الطالب،  وهذا لا شئ.

وأما السلف كأبي حنيفة ومالك وأحمد وغيرهم فيقولون: لم يوجد شرط قتال الطائفة الباغية ، فإن اللّٰه يأمر بقتالها ابتداء ، بل أمر إذا اقتتلت طائفتان أن يصلح بينهما، ثم إن بغت إحداهما قوتلت .

ولهذا كان هذا القتال عند أحمد ومالك: قتال فتنة .

وأبو حنيفة يقول: لا يجوز قتال البغاة حتى يبدؤوا بقتال الإمام، وهؤلاء لم يبدؤوه.

ثم أهل السنة تقول: الإمام الحق ليس معصوما، ولا يجب على الإنسان أن يقاتل معه كل من خرج عن طاعته، ولا أن يطيعه الإنسان فيما يعلم أنه معصية وأن يتركه أولى.

وعلى هذا ترك  جماعة من الصحابة القتال مع علي لأهل الشام، والذين قاتلوه لا يخلو إما أن يكونوا عصاة، أو مجتهدين مخطئين أو مصيبين .

وعلى كل تقدير فهذا لا يقدح في إيمانهم  ولا يمنعهم الجنة بقوله تعالى { وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُواْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَىٰ ٱلأُخْرَىٰ فَقَاتِلُواْ ٱلَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيۤءَ إِلَىٰ أَمْرِ ٱللهِ فَإِن فَآءَتْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا بِٱلْعَدْلِ وَأَقْسِطُوۤاْ إِنَّ ٱللهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ }  { إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ } فسماهم إخوة ) ا.هـــ. 

অর্থ: আপত্তি উত্থাপনকারীরা বলে, “(আমীরে) মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) লড়াই করেছিলেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর বিরুদ্ধে, যিনি ছিলেন চতুর্থ খলীফা; আর যে ব্যক্তি ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি একজন বিদ্রোহী ও জালেম।” আমরা জবাবে বলি: হ্যাঁ, কিন্তু বিদ্রোহকারী হয়তো এমন ব্যক্তি হতে পারেন যিনি তা’বিল (ইজতিহাদ/গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ) করেছেন এ কথা বিশ্বাস করে যে, তিনি-ই সত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত আছেন। আর তাঁর বিদ্রোহ হতে পারে তা’বিল ও খ্যাতি অন্বেষণের এক সমন্বয়, পাশাপাশি এক ভুল বোঝাবুঝিও; আর এটা অত্যন্ত সার্বিক। আর প্রতিটি সম্ভাব্যতার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। আমরা তাঁকে বা তাঁর চেয়েও শ্রেষ্ঠদেরকে পাপ বা ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করি না। মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ (রা:)’এর সাথে তাঁর প্রসিদ্ধ ঘটনাটি এর পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে। মিসওয়ার (রা:) বলেন: “আমি তাঁর (আমীরে মু’য়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর) দোষত্রুটি তালাশে কোনো কিছু বাদ রাখিনি স্রেফ এতোটুকু যে, আমি তাঁকে সে সম্পর্কে জানিয়েছিলাম।” অতঃপর তিনি বলেন, “আমি নিজেকে পাপ/গুনাহ হতে মুক্ত বলে মনে করি না। (ওহে মিসওয়ার), তোমার কি এমন কোনো গুনাহ আছে যা আল্লাহ পাক ক্ষমা না করলে তুমি তোমার বিনাশ আশঙ্কা করো?” মিসওয়ার (রা:) উত্তর দেন, “হ্যাঁ।” অতঃপর আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আল্লাহতা’লার ক্ষমার আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে তুমি আমার চেয়ে কী কারণে বেশি যোগ্যতর মনে করো? আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি যে, মানুষের বিরোধ মীমাংসা, (শরঈ) শাস্তি বিধান, আল্লাহর রাস্তায় জ্বিহাদ পরিচালনা এবং তোমার গণনার অতীত বড় বড় বিষয়াদি, যার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করেছি, তা তোমার নেয়া দায়িত্ব থেকে অনেক অনেক বেশি। আর আমি এমন ধর্মের ওপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত যেখানে আল্লাহতা’লা সৎকর্মগুলো ক্ববূল (গ্রহণ) করেন এবং ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেন। আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি, আল্লাহ ও অন্যান্যদের মধ্যে বেছে নেবার পরিস্থিতি দেখা দিলে আমি সর্বদা অন্যান্যদের ওপরে আল্লাহকেই বেছে নেবো!” মিসওয়ার (রা:) বলেন, “আমি তাঁর কথা বিবেচনা করে অনুধাবন করতে পারি যে, তিনি ওই আলোচনায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে বোঝাতে পেরেছিলেন।” আর তাই যখনই মিসওয়ার (রা:) তাঁর কথা চিন্তা করতেন, তৎক্ষণাৎ তিনি আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু অনহু)’এর জন্যে দোয়া করতেন। 

যদি বলা হয় যে তাঁরা বিদ্রোহী, কেননা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হযরত আম্মার (رضي الله عنه)’কে বলেছিলেন যে বিদ্রোহী দল তাঁকে হত্যা করবে, তাহলে আমরা (জবাবে) বলবো: এই বিবরণ সহীহ তথা বিশুদ্ধ; যদিও কেউ কেউ এটা সম্পর্কে আপত্তি তুলেছেন এবং অন্যান্যরা বলেছেন এর শব্দচয়ন তা (মানে হত্যার) অন্বেষণকে উদ্দেশ্য করেছে – আর এই দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যহীন। সর্ব-ইমাম আবূ হানীফা, মালিক, আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) প্রমুখের মতো পূর্ববর্তী প্রজন্মের পুণ্যাত্মাবৃন্দ বলেন যে, বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে লড়াই করার পূর্বশর্ত এখানে অনুপস্থিত, কেননা আল্লাহতা’লা শুরুতেই যুদ্ধ করার আদেশ করেননি। বরঞ্চ তিনি আদেশ করেছেন তাদের মধ্যে যুদ্ধের ঘটনা ঘটলে যেনো বিবদমান উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করানো হয়। অতঃপর কোনো দল অপর দলের বিরুদ্ধে সীমা লঙ্ঘন করলেই সীমা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি হবে। এমতাবস্থায় সর্ব-ইমাম মালিক ও আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) এই যুদ্ধটিকে ফিতনা হিসেবে বিবেচনা করেন। আর ইমাম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলতেন যে সীমালঙ্ঘনকারী বাহিনীর সাথে লড়াই করা ততোক্ষণ জায়েয নয়, যতোক্ষণ না তারা ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করে, যেমনটি করেছিলো এরা।

অতঃপর আহলুস্ সুন্নাত (সুন্নী উলামাবৃন্দ) বলেন যে বৈধ ইমাম মা’সূম তথা (ইজতেহাদী) ভুলভ্রান্তি হতে মুক্ত নন, আর ইমামের বিরোধিতাকারী যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইমামের পক্ষ হয়ে লড়াই করা কারো জন্যে বাধ্যতামূলক নয়; উপরন্তু, ওই ব্যক্তি যা ভুল বলে জানেন এবং তা ছেড়ে দেয়াই উত্তম মনে করেন, সে বিষয়ে ইমামের আদেশ মান্য করাও তাঁর জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। এরই ভিত্তিতে সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর একটি দল হযরতে ইমামে আলী (كرّم الله وجهه)’এর পক্ষে সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পরিত্যাগ করেন। আর হযরত ইমাম (كرّم الله وجهه)’এর বিরুদ্ধে যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন নিম্ন শ্রেণিভুক্ত: তাঁরা হয় পাপী, নতুবা মুজতাহিদবৃন্দ যাঁরা নিজেদের ইজতিহাদে (তথা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তে) সঠিক বা ভুল করেছিলেন। প্রতিটি সম্ভাব্য ক্ষেত্রেই তাঁদের ঈমানের প্রতি কোনো রকমের অভিযোগ এতে ওঠে না। আর তাঁদের বেহেশ্ত হতে বঞ্চিত হবারও প্রশ্ন ওঠে না আল্লাহতা’লারই বাণীর ভিত্তিতে, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন: “এবং যদি মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধ করে, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করাও। অতঃপর যদি একে অপরের প্রতি সীমালঙ্ঘন করে, তবে ওই সীমালঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতোক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। অতঃপর তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে সংশোধন করে দাও এবং সুবিচার করো” [আল-ক্বুরআন, ৪৯:৯; নূরুল এরফান]। তিনি আরো ফরমান: “মুসলমান-মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং আপন দু ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করিয়ে দাও” [আল-ক্বুরআন, ৪৯:১০; নূরুল এরফান]। (লক্ষণীয় যে) আল্লাহ তাঁদের পরস্পরকে পরস্পরের ভাই নামে সম্বোধন করেছেন। [ইমাম যাহাবী, আল-মুনতাক্বা]       

৬/ – ইবনে কাসীর নিজ ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান-নেহায়াহ’ (৩:২১৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেন:

(ওপরে উদ্ধৃত) এই হাদীসটি নুবূওয়্যতের দলিল (নিদর্শন); কেননা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে হযরত আম্মার (رضي الله عنه) বিদ্রোহী দলের হাতে নিহত হবেন; আর তিনি সিফফীনের যুদ্ধে শাম (সিরিয়া) দেশের বাহিনীর হাতে নিহত হন; ওই সময় তিনি খলীফা হযরতে ইমামে আলী (كرّم الله وجهه)’এর পক্ষে ইরাকী বাহিনীতে যুদ্ধরত ছিলেন। আর হযরত আলী (كرّم الله وجهه) শাসন পরিচালনার বেলায় আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه) হতে বেশি হক্বদার ছিলেন। হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه)’এর দলকে ‘বাগী’ তথা (ফিতনা-সৃষ্টিকারী) বিদ্রোহী মর্মে এমন কোনো নামে সম্বোধন করা উচিৎ নয় যার দরুন তাঁরা কাফির/অবিশ্বাসী বলে সাব্যস্ত হন, ঠিক যেমনটি গণ্ডমূর্খ পথভ্রষ্ট শিয়া গোষ্ঠী ও (অনুরূপ) অন্যান্য চক্র সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস পেয়ে থাকেন {ولا يلزم من تسمية أصحاب معاوية بغاة تكفيرهم كما يحاوله جهلة الفرقة الضالة من الشيعة وغيرهم}। কেননা হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه) ও তাঁর সাথীবৃন্দ যদিও বিদ্রোহ করেছিলেন, তবুও তাঁরা ছিলেন এমন (মুজতাহিদ আলেম)-ব্যক্তিবৃন্দ যাঁরা একই সময়ে তা’উয়ীল (মানে গবেষণা) করেছিলেন। আর প্রত্যেক মুজতাহিদ অবধারিতভাবে (নিজ ইজতিহাদ প্রয়োগে) সঠিক নন; বস্তুতঃ যিনি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন তিনি দিগুণ সওয়াব/পুরস্কার লাভ করেন, পক্ষান্তরে যিনি (ইজতিহাদে) ভুল করেন তিনি পান একটি সওয়াব। অতঃপর যে লোকেরা হযরত আম্মার (رضي الله عنه) সম্পর্কে বর্ণিত – {تقتلك الفئة الباغية} – শীর্ষক হাদীসটিতে বাড়তি কথা যোগ করেছে এ মর্মে – لا أنالها الله شفاعتي يوم القيامة – “আল্লাহ যেনো ক্বিয়ামত দিবসে তাদেরকে (মানে আম্মারের হন্তাদেরকে) আমার সুপারিশ নসীব না করেন,” তবে নিশ্চয় তারা রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর হাদীসে একটি বানোয়াট মিথ্যে কথা যুক্ত করেছে; কেননা তিনি এ কথা বলেননি। আর এটা কোনো নির্ভরযোগ্য/বিশ্বস্ত সূত্র হতেও বর্ণিত হয়নি; এবং আল্লাহতা’লা-ই ভালো জানেন।

আর হাদীসে উল্লেখিত {يدعوهم إلى الجنة ويدعونه إلى النار} – “সে (আম্মার) তাদেরকে জান্নাতের দিকে আহ্বান করবে এবং তারা তাকে ডাকবে জাহান্নামের দিকে” মর্মে ভাষ্য সম্পর্কে (বলতে হয়), এটা এ কারণে যে হযরত আম্মার (رضي الله عنه) ও তাঁর সাথীবৃন্দ ঐক্যের দিকে ডাকছিলেন এবং শা’ম দেশের মানুষেরা বিষয়টিকে একচেটিয়া (বা এক তরফা) করে নিচ্ছিলেন, অথচ যাঁরা শাসন পরিচালনায় অধিকতর হক্বদার ছিলেন এবং এর পাশাপাশি প্রতিটি অঞ্চলেরই নেতৃত্ব দানে যাঁদের অধিকার ছিলো, তাঁরা তা করছিলেন না। এ বিষয়টি উম্মতকে আরো বিভক্ত ও মতভেদময় করেছিলো, যেমনটি তাঁদের (মানে সিরীয়দের) অবস্থান অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো, যদিও তাঁরা তা (মানে মতভেদ ও বিভক্তি) উদ্দেশ্য করেননি। আর আল্লাহ-ই ভালো জানেন। [ইবনে কাসীর কৃত ‘বেদায়া ওয়ান নেহায়া,’ ৩:২১৮]

ইমাম আবূ আবদিল্লাহ আল-যাহাবী (রহ:) তাঁর ‘সিয়্যার’ (৩:১২৮) গ্রন্থে কী সুন্দর বলেছেন:

(فنحمد الله على العافية الذي أوجدنا في زمان قد انمحص فيه الحق واتضح من الطرفين، وعرفنا  مآخذ كل واحد من الطائفتين، وتبصرنا فعذرنا واستغفرنا وأحببنا باقتصاد، وترحمنا على البغاة بتأويل سائغ في الجملة، أو بخطأ ــ إن شاء الله ــ مغفور؛ وقلنا كما علمنا الله: { رَبَّنَا ٱغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلإِيمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاًّ لِّلَّذِينَ آمَنُواْ } [الحشر:10] . 

وترضينا أيضا عمن اعتزل الفريقين كسعد بن أبي وقاص وابن عمر ومحمد بن مسلمة وسعيد بن زيد وخلق.

وتبرأنا من الخوارج المارقين الذين حاربوا عليا وكفروا الفريقين؛ فالخوارج كلاب النار؛ قد مرقوا من الذين؛ ومع هذا فلا نقطع لهم بخلود النار؛ كما نقطع به لعبدة الأصنام والصلبان).    

অর্থ: অতঃপর আমরা আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করি আমাদের প্রতি কল্যাণ নসীব করার জন্যে যে, তিনি আমাদেরকে এমন এক জমানায় পাঠিয়েছেন যখন সত্য পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন হয়েছে (বিবদমান) উভয় দিক থেকে। আমরা (এখন) জানি উভয় পক্ষ তাঁদের মত কোত্থেকে গ্রহণ করেছিলেন; আর আমরা অধিক অবহিত ও সচেতন হয়েছি এবং (অভিযোগ থেকে) অব্যাহতি দিয়েছি আর ধৈর্য সহকারে ক্ষমা ও ভালোবাসা চেয়েছি (তাঁদের পক্ষে)। আমরা বিদ্রোহী পক্ষের জন্যে সাধারণভাবে ব্যাপক ব্যাখ্যা দ্বারা, কিংবা ইজতিহাদী ভ্রান্তিহেতু রহমত/করুণা চেয়েছি (আল্লাহর দরবারে), যে ইজতিহাদী ভুলত্রুটি আল্লাহর অনুমতিক্রমে হয়তো মাফ হয়ে যেতে পারে। আর আমরা বলছি, ঠিক যেমনটি আল্লাহতা’লা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন বলতে: “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরকেও, যাঁরা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছেন আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারবৃন্দের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না” [সূরা হাশর, ১০ আয়াত]। 

আমরা আরো আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করি সেসব ব্যক্তিবৃন্দের পক্ষে, যাঁরা (বিবদমান) উভয় দলকে এড়িয়ে চলেছিলেন; যেমন সর্ব-হযরত সা’আদ বিন আবী ওয়াক্কাস ও ইবনে উমর ও মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ ও সাঈদ ইবনে যায়দ প্রমুখ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)।

অধিকন্তু, আমরা নিজেদের মুক্ত রাখছি বিরোধিতাকারী খারেজী গোষ্ঠী হতে, যারা হযরত আলী (كرّم الله وجهه)’এর সাথে যুদ্ধ করেছিলো এবং (বিবদমান) দুটো দলকে কাফির তথা অবিশ্বাসী ঘোষণা করেছিলো। অতঃপর খারেজীচক্র জাহান্নামের কুকুর; তারা ধর্মত্যাগী। আর এ দ্বারা আমরা বলি না যে তারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, যেমনটি আমরা বলি মূর্তি উপাসক ও (দুইটি আড়াআড়ি) ক্রুশের পূজারী তাতে চিরকাল অবস্থান করবে। [ইমাম যাহাবী, প্রাগুক্ত ‘আল-সিয়্যার’, ৩:১২৮]

আবূ বাকরাহ’র বর্ণিত “বাস্তবিকই আমার এই পুত্র একজন সৈয়্যদ” হাদীসটির রেফারেন্স:

আল-বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজের ‘সহীহ’ (২৭০৪) পুস্তকে বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (রহ:) হতে, যিনি বলেন: সুফিয়ান আমার কাছে বর্ণনা করেন আবূ মূসা (রহ:) হতে, যিনি হযরত হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’কে বলতে শোনেন:

আল্লাহর শপথ, ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লহু আনহু) আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বিরুদ্ধে পর্বতসম বিশালাকৃতির সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। হযরত ‘আমর ইবনে আ’স (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলেন, “নিশ্চয় আমি দেখতে পাচ্ছি বিশালাকৃতির সেনাদল যারা প্রতিপক্ষকে বিনাশ না করে ফিরে যাবে না।” আমীরে মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه) যিনি দু জনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তিনি তাঁকে বলেন:

أي عمرو، إن قتل هؤلاء هؤلاء، وهؤلاء هؤلاء، من لي بأمور الناس؟! من لي بنسائهم؟! من لي بضيعتهم؟!  

অর্থ: “ওহে আ’মর! যদি এরা ওদেরকে হত্যা করে এবং ওরা এদেরকে হত্যা করে, তাহলে আমার সাথে কে অবশিষ্ট থাকবে জনগণের কাজে? তাঁদের নারীদের (দেখাশুনা করার) কাজে আমার সাথে কে অবশিষ্ট থাকবে? তাঁদের সন্তানদের (যত্ন নেবার) কাজে আমার সাথে কে অবশিষ্ট থাকবে?”

অতঃপর আমীরে মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه) ক্বুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত আবদুশ্ শামস গোষ্ঠীর দু জন মানুষ আবদুর রহমান বিন সামুরাহ ও আবদুল্লাহ ইবনে আমির বিন কুরায়যকে ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’এর কাছে প্রেরণ করেন এ কথা বলে – اذهبا إلى هذا الرجل فاعرضا عليه، وقولا له، واطلبا إليه – “এই ব্যক্তির (মানে ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর) কাছে যাও এবং শান্তি আলোচনা করো; আর তাঁকে শান্তি প্রস্তাব গ্রহণের জন্যে আবেদন জানাও।” অতঃপর ওই দু জন (মধ্যস্থতাকারী) ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’এর কাছে যান এবং তাঁর সাথে আলোচনা করে শান্তির প্রস্তাব গ্রহণের আবেদন জানান। ইমাম হাসান (رضي الله عنه) বলেন: 

إنا بنو عبد المطلب قد أصبنا من هذا المال، وإن هذه الأمة قد عاثت في دمائها.

অর্থ: “আমরা আবদুল মুত্তালিবের বংশ (এক্ষণে) কপর্দকশূন্য এবং মানুষেরা হানাহানি ও দুর্নীতিতে লিপ্ত (আর স্রেফ অর্থকড়ি-ই তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারবে)।” মধ্যস্থতাকারী দু জন ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’কে বলেন:

فإنه يعرض عليك كذا وكذا، ويطلب إليك ويسألك.

অর্থ: “আমীরে মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه) আপনাকে এতো এতো দেবার প্রস্তাব করেছেন, আর তিনি আপনার প্রতি শান্তি স্থাপনের আবেদন জানিয়েছেন।” ইমাম হাসান (رضي الله عنه) তাঁদেরকে বলেন:

فمن لي بهذا؟!

অর্থ: “তোমরা যা এখানে (অঙ্গীকারস্বরূপ) বল্লে, তার দায়দায়িত্ব নেবে কে?”

এমতাবস্থায় তাঁরা দু জন উত্তরে বলেন: 

نحن لك به.

অর্থ: “আমরা আপনার পক্ষে এর দায়িত্ব নেবো।”

অতঃপর ইমাম হাসান (رضي الله عنه) যা-ই কিছু চেয়েছেন, তাঁরা দু জন (উত্তরে) বলেছেন – نحن لك به – “আমরা আপনার পক্ষে এর দায়িত্ব নেবো।” ফলে ইমাম হাসান (رضي الله عنه) শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন।

ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আমি আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলতে শুনেছি: “আমি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে মিম্বরের ওপরে দেখতে পাই আর হযরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) তাঁর পাশে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) মানুষের দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং তারপর ইমাম হাসান (رضي الله عنه)’এর দিকে তাকাচ্ছিলেন এ কথা বলে: 

(( إن ابني هذا سيد، ولعل الله أن يصلح به بين فئتين عظيمتين من المسلمين )).

অর্থ: ‘আমার এ পৌত্র একজন সাইয়্যেদ (ইমাম)। আল্লাহ হয়তো তার মাধ্যমে মুসলমানদের দুটো (বিবদমান) বড় দলকে একতাবদ্ধ করবেন’।”  

فصل

في تخريج حديث أبي بكرة: (( إن ابني هذا سيد ))

’আমার এ পৌত্র একজন সাইয়্যেদ’ মর্মে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদীসটির তাখরীজ-বিষয়ক অনুচ্ছেদ

ইমাম আল-বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ’সহীহ’ (২৭০৪) গ্রন্থে বলেন:

قال لي علي بن عبد الله: إنما ثبت لنا سماع الحسن من أبي بكرة بهذا الحديث.

অর্থ: আলী ইবনে আবদিল্লাহ (ইবনে আল-মাদীনী) আমাকে জানান: “একমাত্র এই হাদীস দ্বারাই আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে শায়খ হাসান (আল-বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে (তা) শুনেছিলেন।”

আমি (শায়খ দায়দা’ন আল-সুবাঈ) বলি: এই বর্ণনাটি শায়খ হাসান আল-বসরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁর থেকে এ বিবরণের মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। কেউ কেউ তাঁর কাছ থেকে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সূত্রে এটা বর্ণনা করেছেন; আর কেউ কেউ করেছেন তাঁর কাছ থেকে হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সূত্রে; আবার কেউ কেউ তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন হযরত উম্মে সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’এর সূত্রে; আবার কেউ কেউ তাঁর কাছ থেকে (সরাসরি) ‘মুরসাল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। 

হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সূত্রে তাঁর (মানে শায়খ হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহির) কাছ থেকে যাঁরা এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, (তাঁদের বেলায়) এতে রয়েছে বিভিন্ন তরীক্ব (طريق) তথা এসনাদ:

প্রথম এসনাদ

ইসরাঈল (রহ:) হতে বর্ণিত; তিনি আবূ মূসা (রহ:) হতে, তিনি শায়খ হাসান আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে এ মর্মে যে তিনি বলেন – سمعت أبو بكرة – “আমি আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে শুনেছি (বলতে)।” এটা এভাবেই বর্ণনা করেছেন ইবনে আল-মাদীনী (রহ:) আল-বুখারীতে (৭১০৯; আল-বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমাম ইবনে আল-মাদীনী রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে ‘আল-আওসাত’ ১:৬৩৭ গ্রন্থেও এটা বর্ণনা করেন); আর আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (রহ:)-ও এটা বর্ণনা করেন আল-বুখারীতে (২৭০৪); উপরন্তু, সাদাক্বাহ ইবনে আল-ফযল আল-মারওয়াযী (রহ:)-ও আল-বুখারীতে (৩৭৪৬) এটা বর্ণনা করেন; যেমনিভাবে বর্ণনা করেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘মুসনাদ’ (৫:৩৭-৩৮) ও ‘ফাযায়েলে সাহাবাহ’ (১৩৫৪) গ্রন্থ দুটোতে; আর মুহাম্মদ ইবনে মানসূর (রহ:) বর্ণনা করেন ‘আল-নাসাঈ আল-কুবরা’ (১৭১৮, ১০০৮১) ও ‘আল-সুগরা’ (৩:১০৭) পুস্তক দুটোতে; এছাড়া, মুহাম্মদ ইবনে আব্বাদ (রহ:) বর্ণনা করেন ‘সুনানে বায়হাক্বী’ (৬:১৬৫) কিতাবে; এবং আল-হুমাইদী (রহ:) বর্ণনা করেন নিজ ‘মুসনাদ’ (২:৩৪৮) পুস্তকে; আর সাঈদ ইবনে মানসূর (রহ:) বর্ণনা করেন ‘আল-বায়হাক্বী (৮:১৭৩) গ্রন্থে; এবং ইবরাহীম ইবনে বাশশার (রহ:) বর্ণনা করেন ইমাম তাবারানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর ‘আল-কবীর’ (৩:৩৩) বইয়ে – এঁদের সবাই তা বর্ণনা করেন হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়নাহ (রহমতুল্লহি আলাইহি)’এর সূত্রে; তিনি ইসরাঈল (আবূ মুসা) হতে, যিনি বলেন, “আমি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’কে শুনেছি এ কথা বলতে – سمعت أبا بكرة يقول وذكر الحديث – “আমি আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে শুনেছি (আলোচ্য হাদীসটি বর্ণনা করতে)।” [নোট: ইবনে হাজর (রহ:) ‘আল-ফাতহুল বারী’ (১৩:৬২) গ্রন্থে বলেন: ‘আল-ইসমাঈলী (রহ:) এটা সাত জনের কাছ থেকে সুফিয়ান ইবনে উবায়নাহ (রহ:)’এর সূত্রে বর্ণনা করেন এবং বিবরণগুলোর শব্দচয়নের বিভিন্নতাও তাতে উল্লেখ করেন।”]

এটা (ইমাম হাসান সংক্রান্ত হাদীসটি) আরো বর্ণিত হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদ (রহ:) হতে আল-নাসাঈ (রহ:)’এর ‘আল-কুবরা’ (৮১৫৬) গ্রন্থে; এবং খালাফ ইবনে খলীফা (রহ:) হতে আল-বাযযার (৯:১০৯) এবং আবূ খায়সামাহ (রহ:) হতে আল-বায়হাক্বী (৭:৬৩) পুস্তকে; সবগুলোই হযরত উবায়নাহ (রহ:)’এর সূত্র হতে, তিনি আবূ মূসা (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) হতে; তবে এতে হযরত হাসান বসরী (রহ:) কর্তৃক শ্রুত হওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ নেই।

আল-বাযযার (রহ:) তাঁর বর্ণনা শেষে বলেন:

حديث إسرائيل أبي موسى لا نعلم رواه إلا ابن عيينة عنه.

অর্থ: ইসরাঈল আবূ মূসা (রহ:)’এর বর্ণিত হাদীসটির অন্য কোনো বর্ণনাকারী সম্পর্কে আমরা জানি না, কেবল হযরত ইবনে উবায়নাহ (রহ:) ছাড়া।

হাফেয ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহ:) নিজ ‘ফাতহুল বারী’ (১৩:৬৩) পুস্তকে আল-বাযযার (রহ:)’এর উপরোক্ত কথা উল্লেখ করার পরে বলেন:

وتعقبه مغلطاي بأن البخاري أخرجه في علامات النبوة من طريق حسين بن علي الجعفي عن أبي موسى ــ وهو إسرائيل هذا ــ وهو تعقب جيد، ولكن لم أر فيه القصة وإنما أخرج فيه الحديث المرفوع فقط ا.هـــ. 

অর্থ: মুগলাতাই তাঁকে শুধরে দিয়েছিলেন ‘আলামত আল-নুবূওয়্যাহ’ অধ্যায়ে (লিপিবদ্ধ) বর্ণনাটির ভিত্তিতে, যা হুসাইন ইবনে আলী আল-জু’ফী (রহ:)’এর তরীক্ব তথা (এসনাদ) সূত্রে, তিনি আবূ মুসা (রহ:) হতে – যিনি হলেন এই ইসরাঈল – আর এটা একটা উত্তম সংশোধন বটে। তবে আমি পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করি নি এবং তিনি স্রেফ হাদীসটিকে মরফু’ (সরাসরি নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী) হিসেবে বর্ণনা করেন। [ফাতহুল বারী, ১৩:৬৩]

আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (রহ:)-ও এটা বর্ণনা করেন আল-বুখারী (৩৬২৯) গ্রন্থে, যা ইয়াহইয়া ইবনে আদম (রহ:)’এর সূত্রে; তিনি হুসাইন আল-জু’ফী হতে, তিনি আবূ মূসা (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) হতে; আর এতে হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) থেকে শ্রুত হওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ নেই।

ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ (রহ:) হাদীসটি বর্ণনা করেন হুসাইন আল-জু’ফী (রহ:) হতে, তিনি আবূ মূসা (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে – মুরসাল (হিসেবে)।

দ্বিতীয় এসনাদ

এটা বর্ণনা করেছেন মুবারক ইবনে ফাদালাহ (রহ:) ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হতে, তিনি বলেন:

أخبرني أبو بكرة.

“হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে জানিয়েছেন।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘মুসনাদ’ (৫:৪৪) পুস্তকে বর্ণনা করেন:

حدثنا هاشم ثنا المبارك ثنا الحسن ثنا أبو بكرة … وساق الحديث. 

“হাশিম (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; তিনি (হাশিম) বলেন, ‘আল-মুবারক (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন;’ তিনি (আল-মুবারক) বলেন, ‘হাসান (বসরী রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন;’ তিনি (হাসান বসরী) বলেন, ‘হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) আমার কাছে বর্ণনা করেন’।” 

এটা আল-বাযযার (রহ:)-ও (৯:১০৯) বর্ণনা করেন আহমদ ইবনে মানসূর আল-রামাদী (রহ:) হতে, তিনি ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) হতে, তিনি আবূ ফাদালাহ (রহ:) হতে – যাঁর নাম মুবারক ইবনে ফাদালাহ – তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হতে, যিনি বলেন:

حدثني أبو بكرة.

”হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমার কাছে বর্ণনা করেন…।”

আল-বাযযার (রহ:) এই বিবরণ শেষে বলেন:

هذا الحديث يروى عن جابر وعن أبي بكرة وحديث أبي بكرة أشهر وأحسن إسنادا؛ وحديث جابر أغرب؛ فذكرناه عن أبي بكرة. 

”এই হাদীস তথা বিবরণটি সর্ব-হযরত জাবির ও আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে; আর আবূ বাকরাহ (রা:)’এর বর্ণিত হাদীসটি অধিক প্রসিদ্ধ এবং সেটার এসনাদ-ও অধিকতর উত্তম/নির্ভরযোগ্য; পক্ষান্তরে, হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদীসটি গরিব বা বিরল। সুতরাং আমরা হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বর্ণিত সংস্করণটিকে উল্লেখ করেছি (এখানে)।” [লেখক শায়খ সা’আদ ইবনে দায়দা’ন আল-সুবাঈ’র নোট: হযরত জাবির (রা:)’এর এসনাদটি গরিব হওয়ার দলিলটি লিপিবদ্ধ করেছেন ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহ:) নিজ ‘ফাতহুল বারী’ (১৩:৬৬) কিতাবে, যা’তে তিনি সিদ্ধান্ত নেন – وحديث جابر غريب – ‘হযরত জাবির (রা:)’এর বর্ণিত হাদীসটি গরীব/বিরল।’]

অতঃপর তিনি (আল-বাযযার ৯:১১১) এটা আহমদ ইবনে মানসূর (রহ:) হতেও বর্ণনা করেন; আর ইবনে হিব্বান (৬৯৬৪) বর্ণনা করেন আবূ খলীফা (রহ:), আল-ফযল ইবনিল হাবীব (রহ:) হতে, তাঁরা দু জনই আবূল ওয়ালীদ আত্ তায়্যালিসী (রহ:) হতে, তবে তাতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেননি যে তিনি (নিজে) শুনেছেন। 

এরপর ইমাম বাযযার (রহ:) বলেন:

هذا الحديث قد روي عن أبي سعيد وعن أبي بكرة؛ ومبارك بن فضالة ليس بحديثه بأس؛ وقد روى عنه قوم كثير من أهل العلم ا. هــ.

অর্থ: এই হাদীস (আরো) বর্ণিত হয়েছে আবূ সাঈদ (রা:) ও আবূ বাকরাহ (রা:) হতে; আর মুবারক ইবনে ফাদালাহ (রহ:)‘এর কোনো দোষ নেই (হাদীস বর্ণনায়), কারণ নিশ্চয় তাঁর কাছ থেকে অনেক হাদীসবিদ উলামা রওয়ায়াত/বিবরণ গ্রহণ করেছেন। [নোট: আবূ সাঈদের এই বর্ণনাটি দেখতে ‘কাশফুল আসতা’র’ (২৬৩৮) পুস্তকও দেখুন]

তৃতীয় এসনাদ

এটা আশ’আস্ ইবনে আবদিল মালিক (রহ:) হতে বর্ণিত; তাঁর সূত্রে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে (বর্ণিত)। [নোট: আত্ তাবারানী (রহ:)’এর ‘আল-কবীর’ পুস্তকে বর্ণনাকারীকে আশ’আস্ ইবনে আবদিল মালিক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে] 

মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ আল-আনসারী (রহ:) এটা তাঁর (আবূ বাকরাহ’র) কাছ থেকে বর্ণনা করেন, যা লিপিবদ্ধ আছে আবূ দাউদ (৪৬২৯) ও আল-তিরমিযী (৩৭৭৩) এবং আত্ তাবারানী কৃত ‘আল-কবীর’ গ্রন্থগুলোতে; এ ছাড়াও রয়েছে আল-হাকিম (৩:১৭৪) কিতাবে।

ইমাম তিরমিযী (রহ:) বলেন:

هذا حديث حسن صحيح.

অর্থ: এই হাদীসটি হাসান সহীহ।

চতুর্থ এসনাদ

আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদ’আন (রহ:) বর্ণনা করেন তাঁর (হাসান বসরী রহমতুল্লাহে আলাইহে) থেকে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে। তাঁর কাছ থেকে মূসা’দ্দাদ (রহ:) বর্ণনা করেন আবূ দাউদ শরীফ গ্রন্থে (৪৬২৯); এবং মুসলিম ইবনে ইবরাহীম (রহ:) বর্ণনা করেন আবূ দাউদ শরীফে (৪৬২৯); আর ইমাম তাবারানী (রহ:) বর্ণনা করেন ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে (৩:৩৩); এবং আরিম (রহ:) বর্ণনা করেন ইমাম তাবারানী (রহ:)’এর ’আল-কবীর’ কিতাবে (৩:৩৩); আর ইয়াহইয়া ইবনে হাবীব ইবনে আরবী (রহ:) বর্ণনা করেন আল-বাযযারে (৯:১০৯); এবং আফফান ইবনে মুসলিম (রহ:) ও সুলাইমান ইবনে হরব বর্ণনা করেন আল-হাকিমে (৩:১৭৪) – সবাই হাম্মাদ ইবনে যায়দ (রহ:) হতে, তিনি আলী ইবনে যায়দ (রহ:) হতে…।

আল-বাযযার (রহ:) এরপর বলেন:

وقال البزار عقبه: حديث علي بن زيد عن الحسن عن أبي بكرة لا نعلم رواه عن علي إلا حماد بن زيد ا.هــ.

অর্থ: আলী ইবনে যায়দ (রহ:)’এর বিবরণটি ইমাম হাসান (বসরী রহ.) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে – আমরা এটার আলী (ইবনে যায়দ) হতে বর্ণিত হওয়া সম্পর্কে জানি না, কেবল হাম্মাদ ইবনে যায়দ (রহ:) ছাড়া। 

পঞ্চম এসনাদ

এটা বর্ণিত হয়েছে ইসমাঈল ইবনে মুসলিম (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। 

যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তাবারানী (রহ:) ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে (৩:৩৪) আবদুর রহমান ইবনে সালম (রহ:) হতে, তিনি সাহল ইবনে উসমান (রহ:) হতে, তিনি আবূ মু’য়াবিয়া (রহ:) হতে, তিনি ইসমাঈল হতে..।

وإسماعيل بن مسلم هو المكي وهو وإن كان من أهل العلم إلا أنه متروك.

অর্থ: এবং ইসমাঈল ইবনে মুসলিম (রহ:) মক্কাবাসী ও জ্ঞানীদের মধ্যে একজন হলেও তাঁকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে।

ষষ্ঠ এসনাদ

আবূল-আশহাব জা’ফর ইবনে হাইয়্যান (রহ:) বর্ণনা করেন ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

ইমাম তাবারানী (রহ:) এটা বর্ণনা করেন ‘আল-আওসাত’ (২:১৪৭) ও ‘আল-কবীর’ (৩:৩৪) গ্রন্থগুলোতে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাদাক্বাহ (রহ:) হতে, তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে ইঊসুফ আল-জুবাইরী (রহ:) হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ আল-আনসারী (রহ:) হতে, তিনি আবূল আশহাব (রহ:) হতে…।

সপ্তম এসনাদ

দাউদ ইবনে আবী হিন্দ (রহ:) বর্ণনা করেন ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

এটা বর্ণনা করেছেন ইমাম তাবারানী (রহ:) ‘আল-আওসাত’ (৩:২৪৫) গ্রন্থে আসলাম ইবনে সাহল আল-ওয়াসিতী (রহ:) হতে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আলী আল-শায়বানী (রহ:) হতে, তিনি আবদুল হাকাম ইবনে মনসূর (রহ:) থেকে, তিনি ওপরের এসনাদ-সহ দাউদ (রহ:) থেকে; আর ইমাম তাবারানী (রহ:) বলেন:

لم يرو هذا عن داود إلا عبد الحكم بن منصور.

অর্থ: এবং এটা দাউদ (রহ:) হতে কেউই বর্ণনা করেননি কেবল আবদুল হাকাম ইবনে মানসূর (রহ:) ছাড়া।

অষ্টম এসনাদ

ইঊনুস ইবনে উবায়দ (রহ:) ও মানসূর ইবনে যাযান (রহ:) বর্ণনা করেন ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

ইমাম তাবারানী (রহ:) এটা বর্ণনা করেন ‘আল-সগীর’ (৭৬৬) ও ‘আল-কবীর’ (৩:৩৪) গ্রন্থগুলোতে রাবী ইবনে সুলায়মান (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবদুর রহমান ইবনে শায়বাহ আল-জাদ্দী (রহ:) হতে, তিনি এ এসনাদ-সহ হুশায়ম (রহ:) হতে। আর ইমাম তাবারানী (রহ:) বলেন:

لم يروه عن يونس إلا هشيم ولا رواه عنه إلا ابن شيبة؛ تفرد به الربيع.

অর্থ: ইঊনুস (রহ:) থেকে কেউই এটা বর্ণনা করেননি কেবল হুশায়ম (রহ:) ছাড়া; আর হুশায়ম (রহ:) থেকে কেউই বর্ণনা করেননি ইবনে শায়বাহ (রহ:) ছাড়া; আর তিনি একক তথা বিচ্ছিন্নভাবে এটা বর্ণনা করেছেন।

আবদুর রহমান ইবনে শায়বাহ (রহ:) সম্পর্কে আবূ হাতিম (রহ:) বলেন:

لا أعرفه؛ وحديثه صالح. وذكره النباتي في (( ذيل الضعفاء )).

قلت: يبدو أن النباتي ذكره في كتابه بسبب عدم شهرته؛ والله أعلم. 

অর্থ: আমি তাঁকে চিনি না, তবে তাঁর (বর্ণিত) হাদীসগুলো উত্তম; এবং আল-নাবাতী (রহ:) তাঁকে ‘যায়ল আল-দু’আফা’ পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আমি বলি, (বইটিতে) তাঁর এ অন্তর্ভুক্তি হয়তো তাঁরই অপরিচিত হওয়ার কারণে; আর আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভালো জানেন।

নবম এসনাদ

মা’মার (রহ:) হতে বর্ণিত, যিনি বলেন: 

أخبرني من سمع الحسن يحدث عن أبي بكرة.

হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) হতে ইমাম হাসান বসরী (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত হতে শুনেছেন এমন কেউ একজন আমার কাছে বর্ণনা করেন।

এটা মা’মার (রহ:)’এর ‘জা’মে’ (১১:৪৫২) পুস্তকে বিদ্যমান, যা ইমাম আবদুর রাযযাক্ব (রহ:)’এর সূত্রে (ত্বরীক্ব); এবং তাঁর দ্বারাও (বর্ণিত)। আর তাঁর সূত্রে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) নিজ ‘মুসনাদ’ (৫:৪৭) কিতাবে বর্ণনা করেছেন।

এতদ্বারা হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) হতে ইমাম হাসান বসরী (রহ:) বর্ণিত এসনাদ নয়টিতে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দুটো এসনাদে সরাসরি শ্রবণের বিষয়টি পাওয়া যায়, এবং বাকিগুলোতে তা উল্লেখিত হয়নি (বরঞ্চ সেগুলো ‘আন’আনাহ’, মানে ‘হতে’ শব্দটি দ্বারা বর্ণিত)।

হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণনাসমূহ

ইমাম নাসাঈ (রহ:) ‘আল-কুবরা’ (৫:৪৯) গ্রন্থে বলেন:

أخبرنا إسماعيل بن مسعود أنا خالد بن الحارث عن أشعث عن الحسن عن بعض أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم ـ يعني أنسا ــ قال: لقد رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب؛ والحسن على فخذه فيتكلم ما بدا له؛ ثم يقبل عليه؛ فيقبله فيقول: (( اللهم إني أحبه فأحبه )) قال: ويقول: (( إني لأرجو أن يصلح به بين فئتين من أمتي )).

অর্থ: আমার কাছে বর্ণনা করেন ইসমাঈল ইবনে মাসউদ (রহ:), তিনি খালিদ ইবনে হারিস্ (রহ:) হতে, তিনি আশআস্ (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কতিপয় সাহাবা (রা:) তথা হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন: আমি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে খুতবা দিতে দেখি এবং (নাতি) ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর উরুতে (বসে) ছিলেন; নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলতে চেয়েছিলেন তা (খুতবায়) ব্যক্ত করেন; অতঃপর তিনি ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর দিকে ফিরে তাঁকে চুমু খান এবং বলেন: “এয়া আল্লাহ, আমি তাকে (হাসানকে) ভালোবাসি, অতএব আপনিও তাকে ভালোবাসুন।” তিনি এরপর ফরমান: “আমি আশা করি যে তার দ্বারা আমার উম্মতের মধ্যে বিবদমান দুটো দল ঐক্যবদ্ধ হবে।”

ইমাম নাসাঈ (রহ:) উক্ত কিতাবে (৫:৪৯) আরো বর্ণনা করেন আশ’আস্ (রহ:)’এর এসনাদে – ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে – তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কতিপয় সাহাবা (রা:) তথা হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন: আমি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দরবারে প্রবেশ করি এবং সর্ব-ইমাম হাসান ও হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁর মোবারক পেটের ওপরে হামাগুড়ি দিচ্ছিলেন। নবী পাক (صلى الله عليه وسلم) বলেন:

(( ريحانتي من هذه الأمة )). 

অর্থ: “আমার এ উম্মতের মধ্য হতে আমারই দুটো পুষ্প।”

এই হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রহ:) তাঁর ‘খাসায়েস-এ-আলী (ক:)’ পুস্তকেও (১৪৪) বর্ণনা করেন।

উপরন্তু, তিনি নিজ ‘আমল আল-এয়াউম ওয়াল-লায়লাত’ (২৫৩) গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেন আশআস (রহ:)’এর ইসনাদে – ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে – তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কতিপয় সাহাবা (রা:) তথা হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন:

رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب؛ والحسن بن علي على فخذه؛ ويقول: (( إني لأرجو أن يكون ابني هذا سيدا؛ وإني لأرجو أن يصلح به بين فئتين من أمتي )).

অর্থ: আমি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে খুতবা দিতে দেখি এবং (নাতি) হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর উরুর ওপরে (বসে) ছিলেন; অতঃপর তিনি বলেন: “আমি আশা করি আমার এই পৌত্র সাইয়্যেদ (তথা ইমাম) হবে; আর আমি আশা করি আল্লাহ পাক তার মধ্যস্থতায় আমারই উম্মতের মধ্যে বিবদমান দুটো দলকে ঐক্যবদ্ধ করবেন।”

আল-বাযযার (রহ:)-ও এটা বর্ণনা করেন নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে – যেমনটি বিবৃত হয়েছে ‘কাশফুল আসতার’ (২৬৩৪) পুস্তকে – আশআস্ (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, যিনি বলেন:

وأظنه عن أنس ـ رفعه …. وساق الحديث.

অর্থ: “আমার মনে হয় এই হাদীসটি হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে (বর্ণিত)।”

উম্মে সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণনা

আমি (শায়খ দায়দা’ন আল-সুবাঈ) এটা পাইনি একমাত্র আল-মিযযী (রহ:)’এর কৃত ‘আল-তোহফা’ (৯:৩৯) গ্রন্থে ছাড়া, যা’তে তিনি বলেন এ হাদীসটি হযরত উম্মে সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত হয়েছে ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর দ্বারা।

মুরসাল হাদীস

এটা বর্ণিত হয়েছে নুয়াইম ইবনে হাম্মাদ (রহ:)’এর ‘আল-ফিতান’ পুস্তকে (৪২৩) ও ইবনে আবী শায়বাহ (রহ:)’এর ‘মুসান্নাফ’ কিতাবে (৬:৩৭৬) – হুসাইন ইবনে আলী (রহ:) হতে, তিনি আবূ মূসা ইসরাঈল (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে – ‘মুরসাল’ (হিসেবে)। একইভাবে, ইসহাক্ব ইবনে রা’হুইয়াহ (৪:১৩১) বর্ণনা করেছেন ইবনে মাহদী (রহ:)’এর সূত্রে, তিনি সাহল ইবনে আবী সলত্ (রহ:) হতে, তিনি হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, ‘মুরসাল’ (হিসেবে)। ইমাম আবূ আবদির রহমান নাসাঈ (রহ:) হাদীসটি আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদা’ন (রহ:)’এর সূত্রে ও ইসরাঈল আবূ মূসা (রহ:)’এর সূত্রে এবং আশ’আস্ (রহ:)’এর সূত্রে উল্লেখ করার পরে বলেন:

أرسله عوف وداود وهشام.

অর্থ: “আউফ (রহ:), দাউদ (রহ:) ও হিশাম (রহ:) সবাই এটা মুরসাল (হিসেবে) বর্ণনা করেন।”

অতঃপর ইমাম নাসাঈ (রহ:) প্রতিটি মুরসাল বর্ণনার ইসনাদ লিপিবদ্ধ করেন।

এই হাদীসটির বিশ্লেষণ

ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) পর্যন্ত ইসনাদ তথা বর্ণনাকারীদের পরম্পরা ফেরত পৌঁছুনোর ক্ষেত্রে এই হাদীসটির বিশুদ্ধতা (সহীহ) প্রশ্নে কোনো সন্দেহ-ই নেই, কেননা তাঁর কাছ থেকে বিশাল সংখ্যক রওয়ায়াত/বর্ণনাকারী এটা বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর পূর্ববর্তীদের প্রশ্নে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, যেমনটি এ বিবরণের সূত্রবিষয়ক অংশে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। এটার বর্ণনা চারটি সূত্রে এসেছে:

১/ – ইমাম হাসান বসরী (রহ:) – হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) থেকে;

২/ – ইমাম হাসান বসরী (রহ:) – হযরত আনাস (রা:) থেকে;

৩/ – ইমাম হাসান বসরী (রহ:) – হযরত উম্মে সালামাহ (রা:) থেকে;

৪/ – ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে মুরসাল বর্ণনাগুলো।

দ্বিতীয় সূত্রটির বেলায় এটা ভুল বলে মনে হচ্ছে এবং খালিদ ইবনে হারিস (রহ:)-ই সে ব্যক্তি যিনি বলেছিলেন, ‘মানে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’ (يعني أنسا)। ইমাম হাসান (রহ:) হতে আশ’আস্ (রহ:)’এর বিবরণটিতেই কেবল ‘কতিপয় সাহাবা (রা:) হতে’ মর্মে কথাটি দৃশ্যমান হয়েছে; আর মনে হয়েছে যেনো খালিদ (রহ:)-ই সে ব্যক্তি যিনি বলেছিলেন, ‘মানে আনাস (রা:);’ এটা বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ আল-আনসারী (রহ:) আশ’আস (রহ:) থেকে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) থেকে, তিনি আবূ বাকরাহ (রা:) থেকে [নোট: এটাকে আরো সমর্থন যোগায় এই বিষয়টি যে, তাঁদের অধিকাংশই ইমাম হাসান বসরী (রহ:) থেকে ওই রকমভাবে বর্ণনা করেছেন]।

আরেকটি সম্ভাবনা হলো, এই বক্তব্যটি আশ’আস্ (রহ:) হতে এসেছে এবং ওই সাহাবী (রা:)’কে শনাক্তকরণে এটা তাঁর নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে গৃহীত ছিলো; আর তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে এটা ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে বর্ণিত ছিলো, যিনি তা বর্ণনা করেছিলেন হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠ হাদীসবেত্তা-ই এটাকে ওইভাবে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) ‘মুখতাসারে যওয়াঈদে মুসনাদে বাযযার’ (১৯৭৬) গ্রন্থে বিবৃত করেন:

أخطأ فيه أشعث وإنما هو عن الحسن عن أبي بكرة ا.هـ.

অর্থ: আশ’আস্ (রহ:) ভুল করেছেন; এটা অবশ্যই (বর্ণিত) ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) হতে।

তৃতীয় সূত্রটির ক্ষেত্রে আমি (শায়খ আল-সুবাঈ) এটার এসনাদ প্রাপ্ত হইনি; তবে এটা সম্ভাব্য যে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। কেননা ইতিপূর্বে প্রদত্ত উদ্ধৃতি অনুযায়ী ইবনে রা’হূইয়াহ (রহ:) এই হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং ’মুসনাদে উম্মে সালামাহ’তে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে তিনি এটা ইমাম হাসান বসরী (রহ:)’এর সূত্রে বর্ণনা করেন, মুরসাল (হিসেবে)। আর আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভালো জানেন।

বাকি রইলো প্রথম ও শেষ সূত্রের সম্ভাব্যতা। প্রাধ্যান্যপ্রাপ্ত মতটি হচ্ছে প্রথম সূত্রটি; তা দুটি কারণে:

প্রথম বিধান: হাদীসবেত্তাদের একটি বড় দল ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর তাঁরা হলেন:

১/ – ইসরাঈল ইবনে মূসা (রহ:); আবূ মূসা আল-বসরী (রহ:); এবং তিনি (আবূ মূসা) তাবেঈন-বৃন্দের মধ্যে সর্ব-ইমাম হাসান বসরী (রহ:), আবূ হা’যিম আল-আশজাঈ (রহ:) ও মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহ:)’এর মতো মহান আলেম-উলামার কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আরো কথিত আছে যে, তিনি ইমাম ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ:) হতেও বর্ণনা করেছেন, তবে এটা আল-আযদী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, আর তিনি (আল-আযদী) বলেছেন এটা ইমাম ইবনে মুনাব্বিহ (রহ:) ভিন্ন অন্য কেউ হবেন। আর যাঁরা তাঁর (ইসরাঈলের) কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁরাও নিজেদের জমানায় কীর্তিমান হাদীসবিদ ছিলেন; যেমন – সর্ব-ইমাম ইবনে উবায়নাহ (রহ:), আল-ক্বাত্তা’ন (রহ:); আর তিনি (ইসরাঈল) তেমন একটা বর্ণনা করেননি। তাঁকে সবচেয়ে নিখুঁত মতানুসারে বিশ্বস্ত বিবেচনা করা হয়েছে, যেহেতু ইবনে মাঈন (রহ:) তাঁকে সমর্থন করেছেন; ঠিক যেমনটি করেছেন ইমাম আবূ হা’তিম (রহ:), যিনি আরো যোগ করেন – لا بأس به – মানে ‘তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই’; ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ:)-ও ‘আল-সিক্বা’ত’ পুস্তকে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করেন। কেবল আল-আযদী-ই তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন – فيه لين – ‘তিনি (রাবী হিসেবে) দুর্বল।’

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, আল-আযদী যা বলেছেন সেদিকে মনোযোগ না দেয়াই উচিৎ; বিশেষ করে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুহাদ্দীস উলামা তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন – যেমনটি এক্ষেত্রে ঘটেছে – যা তাঁরই কড়া ও কঠিন মানদণ্ডের কারণে। আর আল-আযদী সম্পর্কেও অনেকে কথা বলেছেন।

ইসরাঈল (রহ:)’এর বিশ্বস্ততা/নির্ভরযোগ্যতার পক্ষে আরেকটি বাস্তবতা হলো এই যে, ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁকে রাবী/বর্ণনাকারী হিসেবে গ্রহণ করেছেন; আর আল-ক্বাত্তান (রহ:) তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

২/ – মুবারক ইবনে ফাদা’লাহ (রহ:) সম্পর্কে কিছু মতদ্বৈততা থাকলেও বিশুদ্ধতম মত হলো তাঁর মাঝে কোনো সমস্যা নেই।

৩/ – আশ‘আস্ ইবনে আবদিল মালিক আল-হুমরানী (রহ:) সম্পর্কেও মতপার্থক্য ছিলো। ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন (রহ:) বলেন:

خرج حفص بن غياث إلى عبادان؛ فاجتمع إليه البصريون؛ فقالوا له: لا تحدثنا عن ثلاثة: أشعث بن عبد الملك وعمرو بن عبيد وجعفر بن محمد؛ فقال: أما أشعث فهو لكم وأنا أتركه لكم.

অর্থ: হাফস্ ইবনে গিয়াস (রহ:) আবাদানের উদ্দেশ্যে গমন করেন; আর বসরাবাসী লোকেরা তাঁর কাছে সমবেত হন। অতঃপর তাঁরা তাঁকে বলেন, “আমাদের কাছে (নিম্নের) তিনজন হতে হাদীস বর্ণনা করবেন না: আশ’আস্ ইবনে আবদিল মালিক, ‘আমর ইবনে উবায়দ ও জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ।” এমতাবস্থায় তিনি উত্তর দেন: “আশ’আস (রহ:)’এর সাথে এটা আপনাদের ব্যাপার; আর আপনাদের কাছেই এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি ছেড়ে দিলাম।”

ইয়াহইয়া আল-ক্বাত্তা’ন (রহ:) বলেন:

هو عندي ثقة مأمون. 

অর্থ: আমার মতে তিনি বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন।

ইমাম আল-বুখারী (রহ:) বলেন:

كان يحيى بن سعيد وبشر بن المفضل يثبتون أشعث الحمراني.

অর্থ: ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রহ:) ও বিশর ইবনে আল-মুফাদ্দাল (রহ:) আশ’আস্ আল-হুমরানী (রহ:)’কে অনুসমর্থন করতেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বলতেন:

هو أحمد في الحديث من أشعث بن سوار؛ روى عنه شعبة؛ وما كان أرضى يحيى بن سعيد عنه؛ كان عالما بمسائل الحسن؛ ويقال: ما روى يونس؟ فقال: نثبت عن الحسن إنما أخذه عن أشعث بن عبد الملك.

অর্থ: তিনি আশ’আস্ ইবনে সাওওয়ার (রহ:) হতেও অধিক প্রশংসনীয়; শু’বাহ (রহ:) তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন; আর ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রহ:) তাঁর প্রতি কতোখানি সন্তুষ্ট ছিলেন! তিনি ইমাম হাসান (আল-বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর মাসায়েল/সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ছিলেন। প্রশ্ন করা হয়েছিলো এ মর্মে যে ইঊনুস (রহ:) কী বর্ণনা করে থাকেন? তখন উত্তরে বলা হয়: নিশ্চয় তিনি আশ’আস্ ইবনে আবদিল মালিক (রহ:) হতে (হাদীস) গ্রহণ করে থাকেন।

ইবনে মাঈন (রহ:) ও ইমাম নাসাঈ (রহ:) তাঁর সম্পর্কে বলেন – ثقة – ‘বিশ্বস্ত।’ আবূ যুর’আহ (রহ:) তাঁকে অভিহিত করেন – صالح – ‘সত্যনিষ্ঠ।’

আবূ হা’তিম (রহ:) বলেন:

لا بأس به؛ وهو أوثق من الحداني؛ وأصلح من ابن سوار.

অর্থ: তাঁর মাঝে কোনো সমস্যা নেই এবং তিনি আল-হাদ্দানী (রহ:) হতেও বেশি বিশ্বস্ত; আর ইবনে সাওওয়ার (রহ:) হতেও বেশি সঠিক।

ইবনে আদী (রহ:) বলেন:

أحاديثه عامتها مستقيمة؛ وهو ممن يكتب حديثه ويحتج به؛ وهو في جملة أهل الصدق؛ وهو خير من أشعث بن سوار بكثير.

অর্থ: তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো সাধারণতঃ স্পষ্ট/খাঁটি; আর তিনি তাঁদেরই একজন, যাঁদের বিবরণগুলো লিপিবদ্ধ করা যায় এবং যেগুলোর ওপরে নির্ভরও করা যায়; আর তিনি সেসব পুণ্যাত্মাদেরই একজন যাঁদেরকে সত্যনিষ্ঠ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে; আর তিনি আশ’আস ইবনে সাওওয়ার (রহ:) হতে অধিকতর শ্রেয়।

ইমাম আশ’আস্ ইবনে আবদিল মালিক আল-হুমরানী (রহ:)’কে যে বিষয়টি সমর্থন যোগায়, তা হলো সর্ব-ইমাম শু’বাহ (রহ:) ও ইবনে ক্বাত্তা’ন (রহ:) তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন; আর আমার (শায়খ সা’আদ ইবনে দায়দা’ন আল-সুবাঈ) কাছে তাঁকে বিশ্বস্ত হিসেবে বিবেচনা করার মানদণ্ড এটাই। পক্ষান্তরে, ইমাম ইবনে মাঈন (রহ:) হাফেয হাফস্ ইবনে গিয়াস (রহ:) হতে যা কর্ণনা করেছেন, তার জবাব তিনটি উপায়ে দেয়া যায়:

(ক) আমরা জানি না ওই বসরী লোকেরা কারা? তাঁরা কি বড় বড় হাফেয (হাদীস মুখস্থকারী), নাকি সাধারণ বর্ণনাকারী?

(খ) তাঁরা যা বলেছেন তা জ্যেষ্ঠ হাফিযবৃন্দের কথার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, বিশেষ করে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রহ:)’এর সাথে, যিনি নিজ সময়কার বসরী উলামাবৃন্দের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন।

(গ) ইমাম আশ’আস (রহ:)’এর প্রতি ওই বসরী বর্ণনাকারীদের অনাগ্রহ স্পষ্টতঃ তাঁর বিবরণগুলোর কারণে নয়। এটা সম্ভাব্য হতে পারে যে, অন্যান্য কারণ এতে নিহিত ছিলো; যেমন এ বাস্তবতা যে তিনি তাঁদেরই অঞ্চলের একজন এবং তাঁর বর্ণনাগুলো সুপ্রসিদ্ধ; আর তাঁরা এমন অন্যান্যদের বিবরণ/রওয়ায়াত তালাশ করছিলেন যাঁরা তাঁদের অঞ্চলের নন।

ইমাম আশ’আস্ (রহ:)’এর ব্যাপারটি হলো, তিনি সেসব জ্যেষ্ঠ হাফিযের অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম ইবনে সীরীন (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আল-ক্বাত্তা’ন (রহ:) বিবৃত করেন – لم ألق أحدا يحدث عن الحسن أثبت منه – অর্থাৎ, ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তাঁর (ইমাম আশ’আসের) মতো দক্ষ কাউকে তিনি পাননি। ইমাম ক্বাত্তা’ন (রহ:) আরো ব্যক্ত করেন বলে জানা যায় যে, তিনি আশ’আস (রহ:)’এর মতো ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে হাদীসের এমন নিখুঁত বর্ণনাকারী আর কাউকে পাননি; অধিকন্তু, ইমাম ইবনে আওন (রহ:)’এর পরে ইমাম ইবনে সীরীন (রহ:)’এর বিবরণগুলোর ব্যাপারে আশ’আস্ (রহ:)’এর মতো বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী আর কাউকেও তিনি পাননি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বলেন – كان عالما بمسائل الحسن – মানে ‘তিনি (আশ’আস্) ইমাম হাসান (আল-বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর মাসায়েল/সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ছিলেন।’ ইমাম আহমদ (রহ:) তাঁর সম্পর্কে আরো উল্লেখ করেন যে তিনি যখন ইমাম হাসান বসরী (রহ:)’এর কাছে যেতেন, তখন ইমাম হাসান বসরী (রহ:) তাঁকে বলতেন – يا أبا هانئ انشر بزك. أي هات مسائلك – অর্থ: ‘তোমার প্রশ্নগুলো করো।’

এ প্রসঙ্গে ইমাম আশ’আস্ (রহ:) বলতেন:

كل شيء حدثتكم عن الحسن قد سمعته منه إلا ثلاثة أحاديث: حديث زياد الأعلم عن الحسن عن أبي بكرة أنه ركع قبل أن يصل إلى الصف؛ وحديث عثمان البتي عن الحسن عن علي في الملاص؛ وحديث حمزة الضبي عن الحسن أن رجلا قال: يا رسول الله متى تحرم علينا الميتة؟ 

অর্থ: ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে সমস্ত (হাদীস) আমি যা বর্ণনা করেছি, তা তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি, ব্যতিক্রম (শুধু) তিনটি হাদীস। প্রথমটি যিয়াদ আল-আ’লম (রহ:)’এর বিবরণ ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে, তিনি সফ তথা নামাযের সারিতে যোগ দেবার আগে রুকূ’ করেছিলেন; দ্বিতীয়টি উসমান আল-বাত্তী (রহ:)’এর বিবরণ ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে ‘আল-মালা’স্’ সংক্রান্ত বিষয়ে; এবং তৃতীয়টি হামযাহ আল-দাব্বী (রহ:)’এর বিবরণ ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে এ মর্মে যে, জনৈক ব্যক্তি গলিত মাংসের ব্যাপারে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন (হারাম কি না)।

৪/ – আবূল আশহাব জা’ফর ইবনে হাইয়্যান (রহতুল্লাহি আলাইহি) একজন বিশ্বস্ত রাবী/বর্ণনাকারী এবং (মুহাদ্দেসীনবৃন্দের) জামাআত তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (এঁদের মধ্যে রয়েছেন) ইমাম তাবারানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাদাক্বাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর ত্বরীক্বে/সূত্রে, তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে ইঊসুফ আল-জুবায়রী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও আবদুল্লাহ ইবনে ইঊসুফ আল-জুবায়রী আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, (তাঁরা) হযরত জুবায়র ইবনে হাইয়্যাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর পুত্রদের কাছ থেকে। ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) আবূল আশহাব (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’কে আল-সিক্বা’ত তথা বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন:

حدثنا عنه ابنه أحمد.

অর্থ: তাঁর পুত্র আহমদ তাঁর সূত্রে আমাদের কাছে (হাদীস) বর্ণনা করেছেন। [وأبنه أحمد وثقه الدارقطني – ইমাম দারু ক্বুতনী (রহ:)’এর কাছে তাঁর পুত্র আহমদ বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী]

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, তাঁকে সমর্থন দান করছে এই বাস্তবতা যে হাফিজবৃন্দের একটি বড় দল তাঁর কাছ থেকে রওয়ায়াত/বর্ণনা গ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন সর্ব-ইমাম ইবনে মাজাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ইবনে খুযায়মাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ইবনে আবী দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), আবূ আরূবাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ইবনে সা’আদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), হারব ইবনে ইসমাঈল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও অন্যান্যরা। তাঁর কাছ থেকে এর (মানে বর্ণনার) প্রাচুর্য দৃশ্যমান হয় এ কারণে যে, তিনি (হাফিজদের) একটি বড় দল হতে বর্ণনা গ্রহণ করেছেন এবং একটি বড় দল তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা গ্রহণ করেছেন; আর এ কারণেই ইমাম ইবনে হাজর (আসক্বালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘আল-তাক্বরীব’ পুস্তকে তাঁর সম্পর্কে বলেন – صدوق – ‘আস্থাভাজন।’ আমি বলি, এটা দৃশ্যমান যে তিনি যদি ’বিশ্বস্ত’ (ثقة) হওয়ার উচ্চস্তরে না হন, তবে তিনি ‘আস্থাভাজন’ (صدوق) পর্যায়ের বটেন।

৫/ – আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদ’আন জ্ঞানী পণ্ডিতদের মধ্যে একজন, কিন্তু তিনি যয়ীফ/দুর্বল; যদিও তাঁর ইসনা’দ (বর্ণনাকারীদের পরম্পরা) সহীহ/বিশুদ্ধ।

৬/ – ইসমাঈল ইবনে মুসলিম পরিত্যক্ত (متروك)।

৭/ – এরপর রয়েছেন এমন বর্ণনাকারীবৃন্দ যাঁরা ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে এই বর্ণনাটি শুনেছিলেন কিন্তু যাঁদের নাম উল্লেখিত হয়নি; যেমনটি হযরত মা’আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বর্ণনাটির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

দ্বিতীয় বিধান: দ্বিতীয় কারণটি হলো এই যে এটা একটা (অতিরিক্ত/) সংযোজন; আর কোনো বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর কাছ থেকে সংযোজন গ্রহণযোগ্য, কেননা যিনি জানেন তিনি প্রামাণ্য দলিল হন সেই ব্যক্তির মুকাবিলায় যিনি জানেন না (لأن من علم حجة على من لم يعلم)। এই সংযোজন একটি বড় দল কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে, আর তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এমন অনেকে যাঁরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত, অনেকে যাঁরা আস্থাভাজন, অনেকে যাঁরা আবার স্রেফ সমস্যা নেই এমন (রাবী), আবার অনেকে যাঁরা দুর্বল।

ইমাম হাসান (রা:)-এর আবূ বাকরাহ (রা:) হতে হাদীসটি শোনার প্রমাণ

উলামাবৃন্দের মাঝে ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কর্তৃক হযরত আবূ বাকরাহ আস্ সাক্বাফী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে হাদীস শ্রবণের ব্যাপারে মতপার্থক্য বিদ্যমান; আর এই মতপার্থক্য দুটি দৃষ্টিভঙ্গিজনিত:

  • প্রথম মতটি হলো তিনি ওই সাহাবী (রা:) হতে হাদীস শোনেন নি; এটা সর্ব-ইমাম ইবনে মা’ঈন, আদ্ দারু ক্বুতনী ও অন্যান্যদের (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)। [লেখকের নোট: ইমাম দারু ক্বুতনী (রহ:) ‘সু’আলা’তুল হা’কিম’ গ্রন্থে (৩২০) বলেন: “ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হযরত আবূ বাকরাহ (রা:) থেকে হাদীস শোনেন নি।” আল-তাতাব্বু’ পুস্তকে (৩২৩) তিনি বলেন: “আল-বুখারী (রহ:) ইমাম হাসান বসরী (রহ:) থেকে হাদীসসমূহ বর্ণনা করেছেন, যিনি বর্ণনা করেছেন হযরত আবূ বাকরাহ (রা:)’এর সূত্রে। এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ‘কুসূফ’ তথা সূর্য/চন্দ্রগ্রহণ সংক্রান্ত বিবরণ; ‘আল্লাহ তোমার (উত্তম বস্তুর প্রতি) আগ্রহ বৃদ্ধি করুন, তবে তা (নামাযের কাতারে সামিল না হয়ে রকূ’র) পুনরাবৃত্তি কোরো না’ (زادك اللهُ حرصا ولا تعد); ‘যে জাতি আপন বিষয়াদির দায়িত্ব কোনো নারীর কাছে ন্যস্ত করে, তারা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে না’ (لا يفلح قوم ولوا أمرهم إمرأة); এবং ‘আমার এই নাতি একজন সাইয়্যেদ’ (ابني هذا سيد); আর ইমাম হাসান বসরী (রহ:) বর্ণনা করেননি কেবল আল-আহনাফ (রহ:) ছাড়া, যিনি বর্ণনা করেন হযরত আবূ বাকরাহ (রা:)’এর সূত্রে।” আমি (শায়খ আল-সুবাঈ) বলি: আমি তাঁর (ইমাম বসরীর) কাছ থেকে স্রেফ একটি বর্ণনা পেয়েছি আল-আহনাফ (রহ:)’এর সূত্রে; ’আত্-তোহফাতুল আশরাফ’ ও ‘ইতহা’ফ’ গ্রন্থ দুটোর ভিত্তিতে (বলা চলে), ইমাম হাসান বসরী (রহ:)’এর প্রচুর শিক্ষক থাকার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত এবং তা এমন পর্যায়ে যে তিনি তাঁর কতিপয় ছাত্রের কাছ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাই আল-আহনাফ (রহ:) থেকে তাঁর হাদীস শোনার ব্যাপারটি হযরত আবূ বাকরাহ (রা:)’এর কাছ থেকে শোনার বিষয়টিকে নাকচ করে না।]     
  • দ্বিতীয় মতটি ব্যক্ত করে যে তিনি অবশ্যই ওই সাহাবী (রা:) হতে হাদীস শ্রবণ করেছেন; আর এটা সর্ব-ইমাম বাহয ইবনে আসাদ আল-’আম্মী আল-বসরী, আলী ইবনে আল-মাদীনী, আল-বুখারী, আল-বাযযার (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) প্রমুখের। এটা ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এরও দৃষ্টিভঙ্গি বলে দৃশ্যমান হয়, কেননা তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে এ ধরনের দুটো বর্ণনা প্রমাণীকরণ 

করেছেন।

অতঃপর হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর হাদীস শ্রবণের বিষয়টি যাঁরা গ্রহণ করেন, তাঁরা আবার দুটি দলে বিভক্ত হয়েছেন:

১/ প্রথম দলটি এটাকে অবাধ সরাসরি/অপরোক্ষ বর্ণনা হিসেবে বিবেচনা করেন (القسم الأول: من أطلق السماع؛ فقال إنه سمع؛ ولم يقيده بشيء);

২/ দ্বিতীয় দলটি কিছু বর্ণনার ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রিত/সীমিত করেন, তবে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে গৃহীত তাঁর সকল বর্ণনাকে নিয়ন্ত্রিত করেন না (والقسم الثاني: من أثبت له السماع؛ ولكن قيده بقوله: سمع شيئا)।

বস্তুতঃ সঠিক মত পোষণ করেন দ্বিতীয় দলটি, যা নিম্নের কারণগুলোর আলোকে ব্যাখ্যা করা হলো:

প্রথমতঃ বেশ কয়েকটি হাদীসে ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যে তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে হাদীস শ্রবণ করেছেন, যেমনটি শুনেছেন ওই বর্ণনাটি যা এসেছে ইমাম ইসরাঈল ইবনে মূসা আল-বসরী (রহ:) হতে, যিনি একজন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী, আর এটা ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও অন্যান্য হাদীসবিদবৃন্দ লিপিবদ্ধ করেছেন, যার তাখরীজ তথা উৎস-বৃত্তান্ত ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে (ওপরে)।

দ্বিতীয়তঃ বিদ্যমান ইমাম যিয়া’দ ইবনে হাসসা’ন আল-আ’লম আল-বা’হিলী আল-বসরী (রহ:)’এর বর্ণনা; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর সম্পর্কে বলেন, “সিক্বাহ, সিক্বাহ তথা বিশ্বস্ত, বিশ্বস্ত” (ثقة ثقة); আর ইমাম আবূ হা’তিম (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন:

هو من قدماء أصحاب الحسن.

অর্থ: তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর জ্যেষ্ঠ সঙ্গীদের মধ্য হতে।

আর তাঁর (মানে ইমাম যিয়া’দের) বর্ণনা রয়েছে সুনানে আবী দাউদ শরীফে (৬৮৩), যা সর্ব-ইমাম ইবনে দা’সসাহ ও আর-রামলী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা)’এর সূত্রে বর্ণিত [আল-বায়হাক্বী (রহ:)-ও নিজ ‘সুনান’ পুস্তকে (৩:১০৬) ইবনে দা’সসাহ’র সূত্রে ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) হতে বর্ণনা করেছেন]; আর ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-ও এটা বর্ণনা করেছেন (২:১১৮) – তাঁদের দু জনই বর্ণনা করেছেন ইমাম হুমাইদ ইবনে মাস’আদাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর সূত্রে, তিনি ইয়াযীদ ইবনে যুরাঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) থেকে, তিনি ইমাম সাঈদ ইবনে আবী আরূবাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) থেকে, তিনি ইমাম যিয়া’দ আল-আ’লম (রহমতুল্লাহি আলাইহি) থেকে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর কাছ থেকে এ মর্মে যে, হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন (একবার) তিনি যখন মসজিদে নববীতে প্রবেশ করেন, তখন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযের রুকূ’তে রত ছিলেন; অতঃপর তিনিও রুকূ’তে যোগ দেন নামাযের কাতারে তথা সারিতে যোগ না দিয়েই। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন:

زادك اللهُ حرصا ولا تعد.

অর্থাৎ, ‘আল্লাহ তোমার (উত্তম বস্তুর প্রতি) আগ্রহ বৃদ্ধি করুন, তবে তা (মানে নামাযের কাতারে সামিল না হয়ে রকূ’র) পুনরাবৃত্তি কোরো না।’

এই হাদীসটি আল-বুখারী (৭৮৩)’তেও বর্ণিত হয়েছে ইমাম মূসা ইবনে ইসমাঈল (রহ:)’এর তরীক্ব তথা সূত্রে, তিনি হাম্মা’ম (রহ:) হতে, তিনি আল-আ’লম (রহ:)’এর সূত্রে অবশিষ্ট ইসনাদ-সহ; তবে এটা স্পষ্টভাবে বিবৃত করে না ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে হাদীসটি শুনেছিলেন।

ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বক্তব্য, যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে ইমাম বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর ‘আল-মা’রিফাহ’ পুস্তকে (২:৩৮১), তাতে তিনি বলেন:

سمعت من يروي بإسناد حسن أن أبا بكرة ذكر للنبي صلى الله عليه وسلم أنه ركع وراء الصف؛ فقال له النبي صلى الله عليه وسلم: (( زادك اللهُ حرصا ولا تعد )).  

অর্থ: আমি শুনেছি (সহীহ) সনদে যে, হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে জানান তিনি (নামাযের) কাতারে সামিল হবার আগেই রুকূ করেছিলেন। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “আল্লাহ তোমার (উত্তম বস্তুর প্রতি) আগ্রহ বৃদ্ধি করুন, তবে তা (মানে নামাযের কাতারে সামিল না হয়ে রকূ’র) পুনরাবৃত্তি কোরো না।”

তৃতীয়তঃ মুবারক ইবনে ফাদা’লাহ আল-বসরী (রহ:)’এর বর্ণনা [নোট: ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ:) যদিও তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “মুবারক ইবনে ফাদালাহ বহু হাদীসের (মান) উন্নীত করতেন; আর তিনি অনেক হাদীসের বেলাতেই বলতেন: ‘ইমাম হাসান (বসরী) হতে, তিনি ইমরা’ন হতে, তিনি ইবনে মুগাফফাল (রা:) হতে;’ অথচ ইমাম হাসান বসরী (রহ:)’এর অন্যান্য সাথীবৃন্দ এই একই কথা বলতেন না,” তবুও তাঁর (মানে মুবারকের) বর্ণনা অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত]; আল-বুখারী (১০৪৮) তাঁর বর্ণনা মু’য়াল্লাক্ব (معلق) তথা ইসনাদ-বিহীন রেখেছেন, যা বর্ণিত হয়েছে ক্বুতায়বাহ (রহ:)’এর সূত্রে, তিনি বলেন: হাম্মাদ ইবনে যায়দ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি (হাম্মাদ) বলেন: ইঊনুস (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এই মর্মে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:

(( إن الشمس والقمر آيتان من آيات الله؛ لا ينكسفان لموت أحد؛ ولكن الله تعالى يخوف بهما عباده )).

অর্থ: নিশ্চয় সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্য হতে দুটো নিদর্শন; (অতএব) সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ কারো মৃত্যুর কারণে সংঘটিত হয় না। কিন্তু আল্লাহ এ দুটোর দ্বারা তাঁর বান্দাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করেন। [আল-হাদীস]

আশ’আস্ (রহ:) মু্বারক (রহ:)’এর সূত্রে ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে বর্ণনা করেন, যেমনটি করেন মূসা (রহ:) মুবারক (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, যিনি বলেন:

أخبرني أبو بكرة أن النبي صلى اللّٰه عليه وسلم قال: (( إن اللّٰه تعالى يخوف بهما عباده )).

অর্থ: হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমার কাছে বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বান্দাদের অন্তরে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ উভয়ের দ্বারা ভীতির সঞ্চার করে থাকেন।” [আল-হাদীস]

(ওপরে) ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ইমাম মুবারক (রহ:) কর্তৃক ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে বর্ণিত হাদীসটিতে তিনি (মানে ইমাম বসরী) স্পষ্ট বলেছিলেন তিনি তা হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে শুনেছিলেন, যে আলোচ্য হাদীসে বিবৃত হয়েছিলো:

(( إن ابني هذا سيد )).

অর্থ: আমার এই নাতি একজন সাইয়্যেদ (আল-হাদীস)। [সর্ব-ইমাম অহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও বাযযার (রহ:)]

ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) আরো বর্ণনা (৫:৪১-৪২) করেন, আবূল নাদর ও ’আফফান দু জনই আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এই মর্মে: আল-মুবা’রাক (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে – যেটা সম্পর্কে আফফা’ন নিজ সংস্করণে বলেন: আল-মুবা’রাক (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এই মর্মে যে তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:)’কে বলতে শুনেছেন যে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন – প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন এক দল মানুষের কাছে আসেন যাঁরা কোষমুক্ত তরবারি পরস্পরের সাথে বিনিময় করছিলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:

(( لعن الله من فعل هذا؛ أو ليس قد نهيت عن هذا؟ ))

ثم قال: (( إذا سل أحدكم سيفه فنظر إليه؛ فأراد يناوله أخاه؛ فليغمده ثم يناوله إياه )).

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি এ কাজ করে, তার প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত! আমি কি এটা নিষেধ করিনি?’ অতঃপর তিনি (দ:) ফরমান: ‘তোমাদের কেউ নিজ তরবারি দেখার জন্যে কোষমুক্ত করলে এবং (এরপর) তার (দ্বীনী) ভাইকে তা হস্তান্তর করতে চাইলে সে যেনো তা কোষবদ্ধ করে আর এরপর হস্তান্তর করে।’

চতুর্থতঃ ওপরের এই বর্ণনার সাথে হিশাম ইবনে হাসান আল-বসরী (রহ:)’এর বর্ণনাটিও যোগ করুন। আবূ বকর ইবনে আবী খায়সামাহ বলেন – যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে ‘তাহযীবুল কামা’ল’ (৩০:৭) গ্রন্থে – হাওদাহ ইবনে খলীফাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এই মর্মে যে, হিশাম ইবনে হাসান (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন হযরত হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) থেকে, যিনি বলেন:

مر بي أنس بن مالك وقد بعثه زياد إلى أبي بكرة يعاتبه؛ فانطلقت معه؛ فدخلنا على الشيخ وهو مريض؛ فأبلغه عنه، فقال: إنه يقول: ألم أستعمل عبيد الله على فارس؟! ألم أستعمل روادا على دار الرزق؟! ألم أستعمل عبد الرحمن على الديوان وبيت المال؟! فقال أبو بكرة: فهل زاد على أن أدخلهم النار؟! فقال أنس: إني لا أعلمه إلا مجتهدا. فقال الشيخ: أقعدوني، إني لا أَعلمه إلا مجتهدا؛ و أهل حروراء قد اجتهدوا؛ فأصابوا أم أخطأوا؟ قال الحسن: فرجعنا مخصومين.      

অর্থ: হয়রত আনাস বিন মা’লিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যখন যিয়াদ তাঁকে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কাছে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে সতর্ক করতে; অতঃপর আমি (হাসান বসরী) তাঁর সাথে যাই এবং শায়খ (রা:)’এর ঘরে প্রবেশ করি। তিনি ছিলেন অসুস্থ। হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যিয়াদের পক্ষ থেকে তার বার্তা শায়খ (রা:)’কে পৌঁছে দেন এ মর্মে: “আমি কি উবায়দুল্লাহকে পারস্যের গভর্নর নিয়োগ করিনি? রাওয়া’দকে খাজাঞ্চির দায়িত্ব দেইনি? আবদুর রহমানকে বায়তুল মালের ভাতার দায়িত্বভার অর্পণ করিনি?” অতঃপর হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “সে এ কথা কি যোগ করেনি যে সে তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করিয়েছে?” এরপর হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমি তো তার সম্পর্কে জানি না স্রেফ এ ছাড়া যে সে একজন মুজতাহিদ (শরঈ গবেষণা ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি)।” তখন শায়খ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমাকে উঠে বসাও। নিশ্চয় আমিও তাকে মুজতাহিদ ছাড়া চিনি-জানি না। তাহলে হারূরা’র লোকদের কী ব্যাপার/ফায়সালা, তারাও তো ইজতিহাদ প্রয়োগ করেছিলো। তারা কি সঠিক ছিলো, না ভুল করেছিলো?” ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “আমরা (যুক্তিতর্কে) পরাজিত হয়ে (সেখান থেকে) প্রত্যাবর্তন করি।”

এই বিবরণটি সা’লিহ ইবনে আহমদও নিজ ‘মাসা’য়েল’ (১১০৭) পুস্তকে তাঁর পিতা হতে, তিনি হাওদাহ হতে বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয়তঃ এই দৃষ্টিভঙ্গি বসরাহ এলাকার হাফেজ (-এ-হাদীস) উলামাবৃন্দের একটি বড় দলের। তাঁরা ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর একই শহর হতে আগমনকারী ছিলেন, এবং তাই তাঁরা তাঁকে অন্যদের চেয়ে বেশি চিনতেন-জানতেন। আর হযরত আবূ বাকরাহ আল-সাক্বাফী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর ব্যাপার ছিলো তিনি অন্যত্র হতে বসরাহ শহরে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানেই বেসালপ্রাপ্ত হন। একই অবস্থা ছিলো ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বেলায়ও, যা আমরা পরে আলোচনা করবো, ইনশা’আল্লাহ। অতএব, তাঁদের রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলো বসরাহ নগরীর আলেম-উলামার কাছে সুপরিচিত ছিলো; আর হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বর্ণনাগুলো, তিনি (ইমাম হাসান) কী শুনেছিলেন এবং কী শুনেন নি সবই তাঁরা (মানে বসরী উলামা) সবচেয়ে ভালোভাবে জানতেন। তাই এই বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের মতামতের ওপরে প্রাধান্য পায় তাঁদেরই এলাকার কথা বিবেচনায় নিয়ে। হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম হাসান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হাদীস শুনেছিলেন মর্মে বিষয়টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এসব বসরী উলামার সাথে ইবনে আল-মাদীনী ও তাঁর সমসাময়িককাল হতে আরম্ভ করে এ যাবৎকাল পর্যন্ত বসরাবাসী কোনো আলেম ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে আমি (শায়খ আল-সুবাঈ) জানি না। যাঁরা তাঁদের সাথে মতভেদ করেছেন, তাঁরা বসরাহ হতে আগত নন।

তৃতীয়তঃ বাহয ইবনে আসাদ আল-বসরী (রহ:) ইমাম হাসান (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বেশ কয়েকজন সঙ্গি-সাথীর ছাত্র। অতএব, তিনি হযরত ইমাম (রহ:)’এর অনেক সাথীর কাছ থেকে রওয়ায়াত/বিবরণ পেশ করেছেন এবং এই মত ব্যক্ত করেছেন যে ইমাম হাসান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে কিছু রওয়ায়াত শুনেছিলেন। কাজেই তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্যগুলোর ওপরে প্রাধান্য পায় আপন অনন্য বৈশিষ্ট্যের খাতিরে, কেননা তিনি এরই কারণে তাঁর পরে আগত উত্তরসূরীদের তুলনায় ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর ব্যাপারে বেশি জানতেন। আর ইমাম হাসান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) যে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে হাদীস শুনেছিলেন, এটাই সে প্রাধান্য লাভকারী মতের অন্যতম উপাদান গঠন করেছে। 

বাহয ইবনে আসাদ (রহ:) বিশ্বস্ত রাবী/বর্ণনাকারীদের মধ্য হতে এমন একজন যাঁর সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন:

إليه المنتهى في التثبت.

অর্থ: তিনিই (হাদীসের) চূড়ান্ত প্রতিপাদনকারী।

চতুর্থতঃ ইমাম হাসান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সিফফীনের যুদ্ধের সময় বসরাহ নগরীতে বসতি স্থাপন করেন এবং বেসাল শরীফ অবধি সেখানেই থেকে যান। হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও বসরায় বসতি স্থাপন করেন এবং ৫১ অথবা ৫২ হিজরী সালে সেখানে বেসালপ্রাপ্ত হন; তার মানে তাঁরা দু জনই প্রায় ১৫ বছরব্যাপী এক সময়কাল যাবৎ একই শহরে বসবাস করেছিলেন। এটা সর্বজনবিদিত, সেই যুগে (উক্ত শহরে) স্রেফ একটি জুমুআ’র নামায (জামা’আতে) আদায় হতো এবং একটি ঈদের জামা’আত অনুষ্ঠিত হতো, যার দরুন ইতিপূর্বে যা উদ্ধৃত হয়েছে তার সাথে এই তথ্য হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর হাদীস শ্রবণের অভিমতকে সমর্থন যোগায়।                 

পঞ্চমতঃ ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে যেসব হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলোর ওপরই তাঁর নিজের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ভিত্তিশীল ছিলো; আর তাঁর দৃষ্টিতে তাঁরই দ্বারা দালিলিক প্রমাণ হিসেবে এগুলোর ব্যবহার হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতার ইঙ্গিতবহ। এগুলো থেকেই তাঁর দ্বারা গৃহীত আমাদের (বর্তমান) প্রতিপাদ্য হাদীসটি (নিম্নরূপ):

1ـ قال الإمام أحمد في مسنده (44/5): حدثنا هاشم ثنا المبارك ثنا الحسن ثنا أبو بكرة قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي بالناس؛ وكان الحسن بن علي رضي الله عنهما يثب على ظهره إذا سجد؛ ففعل ذلك غير مرة؛ فقالوا له: والله إنك لتفعل بهذا شيئا ما رأيناك تفعله بأحد؟! قال المبارك: فذكر شيئا؛ ثم قال: (( إن ابني هذا سيد؛ وسيصلح الله به بين فئتين من المسلمين )). فقال الحسن: فوالله والله بعد أن ولي لم يهرق في خلافته ملء محجمة من دم.      

অর্থ: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (৫:৪৪) বর্ণনা করেন হিশাম (রহ:) থেকে, তিনি মুবারক (রহ:) থেকে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) থেকে, যিনি বলেন, হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষদের সাথে জামা’আতে নামায আদায় করছিলেন এবং ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁর মোবারক পিঠে উঠছিলেন যখনই তিনি সেজদা করছিলেন; আর এটা অব্যাহত ছিলো। অতঃপর মানুষেরা তাঁকে বলেন, “আল্লাহর কসম, (হে ছোট জন), আমরা আপনাকে এ কাজ করতে দেখেছি, যা আর কারো সাথে আপনাকে করতে দেখিনি।” বর্ণনাকারী মুবারক (রহ:) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু একটা বলেন; অতঃপর তিনি (দ:) বলেন, “নিশ্চয় আমার এই নাতি একজন সাইয়্যেদ (ইমাম); আর আল্লাহ পাক তার মাধ্যমেই দুটো বিবদমান মুসলমান বাহিনির মাঝে সন্ধি/সমঝোতা স্থাপন করবেন।” ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর নামে আবারো শপথ করে বলছি, তাঁর (মানে ইমাম হাসান ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র) নেতৃত্ব গ্রহণের পরে কোনো রক্ত ঝরে নি, এমন কী শিঙ্গা অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত কাপের পরিমাণ রক্তও নয়।”

ইসহাক্ব ইবনে রা’হূইয়্যা (রহ:) নিজ ‘মুসনাদ’ (৪:১৩১) গ্রন্থে বলেন, আবদুর রহমান ইবনে মাহদী (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, সাহল ইবনে আবী আস্ সলত্ (রহ:) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন এ মর্মে যে তিনি ইমাম হাসান আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’কে বলতে শুনেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন:

(( إن ابني هذا سيد؛ يصلح الله به فئتين من المسلمين )) يعني الحسن بن علي؛

অর্থ: “আমার এই নাতি একজন সাইয়্যেদ (ইমাম); আল্লাহতায়ালা তারই মধ্যস্থতায় দুটো বিবদমান মুসলমান দলের মাঝে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করবেন।” মানে ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে এতে।

ইমাম হাসান আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই প্রসঙ্গে বলেন:

فقد والله أدركت ذلك؛ أصلح الله به فئتين من المسلمين.

অর্থ: “আল্লাহর কসম, আমি এর সাক্ষী। আল্লাহতায়ালা তাঁরই মাধ্যমে মুসলমানদের দুটো বিবদমান বাহিনির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করেন।” [বঙ্গানুবাদকের নোট: এই দুটো বিবদমান বাহিনি ইমাম হাসান বিন আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা এবং আমীরে মু’য়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র। ওপরে উদ্ধৃত বিশুদ্ধ হাদীসটিতে প্রমাণিত হয় যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়কেই মুসলমান বিবেচনা করেছিলেন। অথচ রাফেযীপন্থী শিয়া-চক্র আমীরে মু’য়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর অনুগত বাহিনিকে বাগ্বী/বিদ্রোহী বলে দোষারোপ করে থাকে। তাদের এ কাজটি ধর্মবিরোধী ও অন্তর্ঘাতমূলক]           

2 ــ ومن ذلك أيضا ما رواه أبو داود في سننه (1242) قال: حدثنا عبيدالله بن معاذ ثنا أبي عن الأشعث عن الحسن عن أبي بكرة قال: صلى النبي صلى الله عليه وسلم في خوف الظهر فصف بعضهم خلفه؛ وبعضهم بإزاء العدو؛ فصلى ركعتين ثم سلم؛ فانطلق الذين صلوا معه فوقفوا موقف أصحابهم؛ ثم جاء أولئك فصلوا خلفه؛ فصلى بهم ركعتين ثم سلم؛ فكانت لرسول الله صلى الله عليه وسلم أربعا؛ ولأصحابه ركعتين ركعتين.

অর্থ: আর তা থেকে ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-ও নিজ ‘সুনান’ গ্রন্থে (১২৪২) বর্ণনা করেন এ কথা বলে: উবায়দুল্লাহ ইবনে মু’আয আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এই বলে, আমার পিতা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আশআস্ (রহ:) হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহ:) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যোহরের নামায ‘শঙ্কার নামায’ হিসেবে পড়েন (صلى النبي صلى الله عليه وسلم في خوف الظهر)। তাই তাঁদের মধ্যে একটি দল তাঁর ইমামতিতে কাতারবদ্ধ তথা সারিবদ্ধ হন, আর অন্যরা শত্রুদের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। এমতাবস্থায় তিনি দু রাক’আত নামায পড়েন এবং সালাম ফেরান। অতঃপর যাঁরা নামায পড়েছিলেন, তাঁরা উঠে সাথীদের জায়গায় গিয়ে শত্রুদের দিকে মুখ করে (প্রহরায়) দাঁড়ান, আর যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা তাঁর ইমামতিতে নামায পড়তে আসেন; এরপর তিনি দু রাক’আত নামায তাঁদেরকে সাথে নিয়ে পড়েন এবং সালাম ফেরান। অতএব, তাঁর জন্যে এটা চার রাক’আত নামায ছিলো, আর সাহাবী (রা.)’বৃন্দের দুই দলের প্রতিটির জন্যে ছিলো দু রাক’আত করে। 

وبذلك كان يفتي الحسن.

অর্থ: আর এ ভাষ্যটি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর (নিজস্ব) অভিমত। [নোট: এ বাক্যটি মনে হয় আশ’আস্ (রহ.)’এর মন্তব্য, যা ইমাম বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বর্ণনায় পরিদৃষ্ট হবে (পরবর্তীতে)]

ষষ্ঠতঃ হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বর্ণনাটি মজবুত এবং এতে কোনো আপত্তিযোগ্য কিছু নেই। আর হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে তিনি যা বর্ণনা করেছেন, তাতে তাঁর (বর্ণনা) আংশিক নিশ্চিত করা হয়েছে।

ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর বর্ণনাগুলোর নির্দিষ্ট কয়েকটি সংস্করণে কিছু কথা হয়তো অসমর্থিত মনে হতে পারে, তবে তা ব্যাখ্যা দ্বারা সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:

প্রথম হাদীস 

الحديث الأول: قال الإمام أحمد (41/5): حدثنا يزيد أخبرنا حماد بن سلمة عن زياد الأعلم عن الحسن عن أبي بكرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم استفتح الصلاة؛ فكبر ثم أوما إليهم أن مكانكم؛ ثم دخل فخرج ورأسه يقطر؛ فصلى بهم؛ فلما قضى ـ الصلاة؛ قال: (( إنما أنا بشر وإني كنت جنبا )).

অর্থ: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (৫:৪১) বর্ণনা করেন এয়াযীদ হতে, যিনি বলেন: হাম্মাদ ইবনে সালামাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যিয়াদ আল-আলম হতে, তিনি হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায আরম্ভ করেন এবং তাকবীর পাঠ করেন; অতঃপর হাতের ইশারায় সাহাবা (রা.)’বৃন্দকে তাঁদের জায়গায় থাকতে নির্দেশ দেন, আর (নিজ) গৃহে প্রবেশ করেন এবং শির মোবাবরক হতে পানি (গড়িয়ে) পড়া অবস্থায় বের হয়ে আসেন। তিনি নামায পড়ান এবং এরপর বলেন: “আমি তো মানবীয় আবরণসম্পন্ন; আর আমি ছিলাম জুনু্ব (মানে স্ত্রী সহবাস দ্বারা নাপাক)।”

ورواه الإمام أحمد أيضا (41/5) قال: حدثنا أبو كامل حدثنا حماد عن زياد الأعلم عن الحسن عن أبي بكرة أن النبي صلى الله عليه وسلم دخل في صلاة الفجر؛ فأومأ إليهم..بنحوه. 

অর্থ: এটা ইমাম আহমদ (৫:৪১) আরো বর্ণনা করেন আবূ কামিল হতে একই ইসনাদে, যা হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) পর্যন্ত পৌঁছেছে; এতে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের নামায আরম্ভ করেন এবং এরপর তাঁর মোবারক হাতে তাঁদেরকে ইশারা করেন….।

ورواه أيضا (45/5) قال: حدثنا عفان حدثنا حماد بن سلمة حدثنا زياد الأعلم عن الحسن عن أبي بكرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم دخل في صلاة الفجر فأومأ إلى أصحابه .. بنحوه.  

অর্থ: ইমাম আহমদ (৫:৪৫) এটা আরো বর্ণনা করেন আফফানের সূত্রে একই ইসনাদে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে, নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের নামায পড়া আরম্ভ করেন এবং এরপর তাঁর মোবারক হাতে আপন সাহাবা (রা.)’বৃন্দের প্রতি ইশারা করেন….।

وهذا الحديث رواه أبو داود (236) من طريق موسى بن إسماعيل ويزيد؛ ورواه ابن خزيمة (1629) من طريق عفان ويحيى بن عباد ويزيد؛ كلهم عن حماد بن سلمة به.

অর্থ: ইমাম আবূ দাউদ (২৩৬) এই হাদীসটি বর্ণনা করেন মূসা বিন ইসমাঈল ও এয়াযীদের সূত্রে; একইভাবে ইবনে খুযায়মাহ (১৬২৯) বর্ণনা করেন আফফান, ইয়াহইয়া ইবনে আব্বাদ ও এয়াযীদের সূত্রে; এঁদের সবাই বর্ণনা করেন হাম্মাদ বিন সালামাহ হতে বাকি (পুরো) ইসনাদ-সহকারে।

هذا الحديث صحيح؛ ولكن يستغرب فيه قوله: (فكبر ثم أومأ) فهذه تخالف ما جاء في ((الصحيحين)) ( ) من حديث الزهري عن أبي سلمة عن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم خرج وقد أقيمت الصلاة وعدلت الصفوف حتى إذا قام في مصلاه انتظرنا أن يكبر انصرف قال: على مكانكم فمكثنا على هيئتنا حتى خرج إلينا ينطف رأسه ماء وقد اغتسل.

অর্থ: এই হাদীসটি সহীহ/বিশুদ্ধ, ব্যতিক্রম শুধু ‘তিনি তাকবীর দেন এরপর ইশারা করেন’ বাক্যটি; এটা সহীহাইন তথা বুখারী ও মুসলিম হাদীসগ্রন্থ দুটোতে আল-যুহরী প্রদত্ত বিবরণের খেলাফ, যা তিনি বর্ণনা করেছেন আবূ সালামাহ হতে, তিনি হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন ঘর থেকে বের হন এবং এক্বামত ঘোষণা করা হয় ও কাতার সোজা করা হয়, আর আমরা অপেক্ষায় ছিলাম তাঁর নিজ জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে তাকবীর পাঠের জন্যে; (কিন্তু) তিনি স্থান ত্যাগ করেন এ কথা বলে, “তোমাদের (নিজ নিজ) জায়গায় স্থিত থাকো;” আর আমরা সেভাবেই স্থিত ছিলাম যতোক্ষণ না তিনি আবার (মসজিদ থেকে) বের হয়ে গিয়েছিলেন; (ওই সময়)  তাঁর শির মোবারক থেকে পানি পড়ছিলো, কেননা তিনি গোসল করেছিলেন।

মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে:

فأتى رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى إذا قام في مصلاه قبل أن يكبر ذكر فانصرف؛ وقال لنا: ((مكانكم)).

অর্থ: অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করেন এবং যখন নিজ নামাযের স্থানে দাঁড়ান তাঁর তাকবীর দেবার আগে, তখন তিনি স্মরণ করতে পারেন আর চলে যান আমাদেরকে এ কথা বলে: “তোমাদের (নিজ নিজ) স্থানে স্থিত থাকো।”

এর জবাব দুটি উপায়ে দেয়া যায়। প্রথমটি হলো রওয়ায়াত তথা বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিত বা দৃষ্টিকোণ হতে (من حيث الرواية)। আর এটা এই যে, বিবরণগুলোতে বিভিন্নতা বিদ্যমান এবং অনেক হাদীস হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বর্ণিত হাদীসের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (১:৮৮) বর্ণনা করেন ইবনে লাহী’আহ (রহ.) হতে, তিনি বর্ণনা করেন হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) পর্যন্ত এসনাদ-সহ, যিনি বলেন:

بينما نحن مع رسول الله صلى الله عليه وسلم نصلي إذ انصرف ونحن قيام؛ ثم أقبل ورأسه يقطر فصلى لنا الصلاة… الحديث. 

অর্থ: আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে নামাযরত ছিলাম; ওই সময় আমাদেরকে নামাযে দণ্ডায়মান রেখে তিনি চলে যান এবং ফিরে আসেন শির মোবারক থেকে পানি পড়তে থাকা অবস্থায়; অতঃপর তিনি আমাদের নামায পড়ান…। (হাদীস)

ইমাম আহমদ (২:৪৪৮) বর্ণনা করেন ওয়াকীঈ (রহ.) হতে, তিনি হযরতে আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) পর্যন্ত এসনাদ-সহ, এই মর্মে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হন; আর তাকবীর পাঠ করে তিনি প্রস্থান করেন তাঁদেরকে আপন আপন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইশারা করে। তিনি গোসল করতে যান এবং যখন ফেরেন তখন তাঁর শির মোবারক থেকে পানি পড়ছিলো। অতঃপর তিনি নামাযে ইমামতি করেন। (হাদীস)  

এই হাদীসটি ইবনে মাজাহ শরীফেও (১২১০) বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম তাহাবী (রহ.) ‘মুশকিল আল-আ’সার’ (৩/৮৮) গ্রন্থে এবং আদ্ দা’রাক্বুতনী নিজ পুস্তকে (১/৩৬২) বর্ণনা করেন উবায়দুল্লাহ বিন মু’য়ায আল-আনবারী হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি সাঈদ হতে, তিনি ক্বাতা’দাহ (রা.) হতে, তিনি হযরত আনাস্ বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন:

دخل النبي صلى الله عليه وسلم في صلاة فكبر وكبرنا معه ثم أشار إلى القوم أن كما أنتم؛ فلم نزل قياما حتى أتانا وقد اغتسل؛ ورأسه يقطر ماء.  

অর্থ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযে দাখিল হন এবং তাকবীর দেন আর আমরাও তাঁর সাথে সাথে তাকবীর পাঠ করি; অতঃপর তিনি মানুষের প্রতি ইশারা করেন স্থিত থাকতে, আর আমরাও দাঁড়িয়ে থাকি যতোক্ষণ না তিনি গোসল করে ফিরে আসেন; (ওই সময়) তাঁর শির মোবারক থেকে পানি ঝরছিলো।

ইমাম দারু ক্বুতনী (রহ.) এরপর বলেন, “আবদুল ওয়াহহাব আল-খাফফাফ তাঁর (মানে ইমাম দারু ক্বুতনীর) সাথে মতভেদ করেছেন; অতঃপর ইমাম দারু ক্বুতনী হাদীসটি বর্ণনা করেন আবদুল ওয়াহহাব ইবনে আতা’ হতে, তিনি সাঈদ হতে, তিনি ক্বাতাদা হতে, তিনি বকর ইবনে আবদিল্লাহ মুযানী হতে – মুরসাল (হাদীস) হিসেবে। এরপর তিনি বলেন:

قال عبد الوهاب: وبه نأخذ.  

অর্থ: আবদুল ওয়াহহাব আল-খাফফাফ বলেন, “এবং (এবার) আমরা এটা গ্রহণ করলাম।”

ইমাম মালিক (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে (১/৪৮) বর্ণনা করেন ইসমাঈল ইবনে আবী হাকিম হতে এই মর্মে যে, আ’তা ইবনে ইয়াসার তাঁকে জানিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোনো এক নামাযে তাকবীর পাঠ করেছিলেন, অতঃপর তিনি নিজ হাত মোবারক দ্বারা তাঁদেরকে ইশারা করেন স্থির থাকতে এবং এরপর তিনি প্রস্থান করেন; আর তিনি ফিরে এলে তাঁর ত্বক মোবারকে পানির প্রভাব বিরাজ করছিলো (মানে পানি লেগেছিলো)।

ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ সুনান গ্রন্থে (১/২৬৩), আইয়ূব, ইবনে আওন ও হিশাম সবাই এ হাদীস বর্ণনা করেন হযরত মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এ মর্মে যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকবীর পাঠ করেন, অতঃপর তাঁদেরকে বসতে ইশারা করে গোসলে চলে যান। অনুরূপভাবে ইমাম মালিক (রহ.) বর্ণনা করেছেন ইসমাঈল ইবনে আবী হাকিম (রহ.) হতে, তিনি আ’তা ইবনে ইয়াসার (রা.) হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে। 

ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) আরো বলেন:

وكذلك حدثناه مسلم بن إبراهيم حدثنا أبان عن يحيى عن الربيع بن محمد عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه كبر.

অর্থ: একইভাবে, মুসলিম ইবনে ইবরাহীম আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবা’ন হতে, তিনি ইয়াহইয়া হতে, তিনি আল-রাবী’ ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এমর্মে যে তিনি তাকবীর পাঠ করেছিলেন।

(জবাব দেয়ার) দ্বিতীয় উপায়টি ব্যাখ্যামূলক এবং এতে দুটো পদ্ধতি বিদ্যমান:

(ক) প্রথম মসলক/পদ্ধতিটি হলো এটাকে একাধিক ঘটনা বলে বিবেচনা করা; সর্ব-ইমাম ইবনে হিব্বান ও নববী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।

(খ) দ্বিতীয় মসলক/পদ্ধতিটি হলো এই বাহ্যতঃ অসঙ্গতি একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দ্বারা সমাধান করা; আর তাতে  “নামাযে দাখিল হন” ও “তাকবীর পাঠ করেন”- বাক্যগুলোর উদ্দিষ্ট অর্থ বুঝতে হবে নামাযের সূচনালগ্নের খুব কাছাকাছি (من ذهب إلى أن المقصود بالدخول في الصلاة والتكبير قرب دخوله فيها)। এটা ইমাম ত্বাহা’বী (রহ.)’এর গৃহীত পন্থা।

অতএব, এই জবাব দ্বারা এ হাদীসের সমস্যাযুক্ত বাক্যটির সমাধান হয়ে যাচ্ছে, যদিও এতে বিদ্যমান থাকতে পারে সামান্য ‘খাতা’ বা ভ্রম; কেননা দুটো সহীহ হাদীস সংকলনে যা বিরাজমান তা অধিকতর সহীহ; এর বিধান (সঠিকের) অত্যন্ত কাছাকাছি।

দ্বিতীয় হাদীস

ইমাম নাসাঈ (রহ.) ‘আস্ সুগরা’ পুস্তকে (৩/১৫২) বর্ণনা করেন ‘আমর ইবনে আলী হতে, তিনি ইয়াযীদ ইবনে যুরাঈ হতে, তিনি ইঊনুস হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন:

كنا عند النبي صلى الله عليه وسلم؛ فانكسفت الشمس فقام إلى المسجد يجر رداءه من العجلة فقام إليه الناس فصلى ركعتين كما يصلون؛ فلما انجلت خطبنا فقال: ((إن الشمس والقمر آيتان…)) الحديث. 

অর্থ: আমরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে ছিলাম; এমনি সময়ে সূর্যগ্রহণ হয়, আর তিনি জুব্বা মোবারক টানতে টানতে মসজিদে (নববীতে) তাড়াতাড়ি গমন করেন। মানুষেরাও তাঁর সাথে (নামাযে) দণ্ডায়মান হন এবং তিনি তাঁদেরকে নিয়ে দুই রাক’আত নামায পড়েন। অতঃপর যখন সূর্য পুনরায় উদিত হয়, তখন তিনি খুতবা দেন এই বলে, “সূর্য ও চন্দ্র দুটো নিদর্শন…।” (আল-হাদীস)

এ হাদীস বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম আল-বাযযার (৩৬৬২), ইবনে খুযায়মাহ (১৩৭৪), আত্ তাহা’বী (১/৩৩০), আল-বাগাভী ‘আল-জা’আদীয়্যাত’ পুস্তকে (১৩৮৫), আল-বায়হাক্বী (৩/৩৩১) এবং অন্যান্যরা; তাঁদের সবাই ইয়াযীদ ইবনে যুরাঈয়ের সূত্রে (তরীক্বে), একই ইসনাদে (মানে সনদে)।

ইসমাঈল ইবনে উলাইয়্যাহ-ও এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) ‘সহীহ’ গ্রন্থে (২৮৩৫) বর্ণনা করেন আবূ ইয়া’লা (রহ.) হতে, তিনি আবূ খায়ছামা হতে, তিনি ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম হতে, তিনি ইঊনুস হতে, তিনি উবায়দ হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন: 

كنا عند النبي صلى الله عليه وسلم فكسفت الشمس؛ فقام صلى الله عليه وسلم عجلانا إلى المسجد فجر إزاره أو ثوبه؛ وثاب إليه ناس؛ فصلى بهم ركعتين نحو ما تصلون… الحديث.  

অর্থ: আমরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে ছিলাম, এমনি সময়ে সূর্যগ্রহণ হয়; তিনি উঠে দাঁড়ান এবং দ্রুত মসজিদে (নববীতে) গমন করেন পরনের কাপড়ের নিচের অংশ অথবা বস্ত্র মোবারক টানতে টানতে। আর মানুষেরাও তাঁকে অনুসরণ করেন। তিনি তাঁদেরকে সাথে নিয়ে দুই রাক’আত নামায আদায় করেন, যেমনটি তোমরা নামায পড়ে থাকো…। (আল-হাদীস)

আল-বাগাভী (রহ.)-ও ‘আল-জা’আদীয়্যাত’ পুস্তকে (১৩৮৫) ইসমাঈলের এই সংস্করণটি যৌথভাবে বর্ণনা করেন ইয়াযীদ ইবনে যুরাঈ’র রওয়ায়াত/বিবরণের সূত্রে।

আশ’আস্ ইবনে আব্দিল মালিক-ও এটা বর্ণনা করেন, যেমনটি উল্লেখ করেছেন ইমাম নাসাঈ (১৪৯২) ইসমাঈল ইবনে মাসউদের সূত্রে, তিনি খালিদ হতে, তাঁর কাছ থেকে; ইমাম ইবনে হিব্বান (২৮৩৭)-ও এটা বর্ণনা করেন ইসহাক্ব ইবনে ইবরাহীম আল-তা’জিরের সূত্রে, তিনি আবদুল করীম ইবনে আবদীল্লাহ হতে, তিনি আল-নাদর ইবনে শুমাইল হতে, তিনি আশ’আস্ হতে, একই ইসনাদে; আর এটা বর্ণনা করেছেন আল-হাকিম (১/৩৩৪) আহমদ ইবনে ইয়াকূবের সূত্রে, তিনি ইঊসুফ ইবনে ইয়াকূব হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে আবী বকর হতে, তিনি খা’লিদ ইবনে আল-হা’রিস্ হতে, তাঁর থেকে একই ইসনাদে। আল-বায়হাক্বী এটা বর্ণনা করেন আল-হাকিম হতে (৩/৩৩৭-৩৩৮)।

ورواه النسائي أيضا (1464) من طريق عمرو بن علي ومحمد بن عبد الأعلى قالا: حدثنا خالد ثنا أشعث به؛ وليس فيه هذه اللفظة. 

অর্খ: ইমাম নাসাঈ (১৪৬৪)-ও ‘আমর ইবনে ‘আলী এবং মুহাম্মদ ইবনে আল-আবদ্ আল-’আলার সূত্রে (তরীক্বে) এটা বর্ণনা করেন খালিদ হতে, তিনি আশ’আস্ হতে; তবে ‘আশ’আস’-এর সূত্রে খালিদ হতে’ মর্মে উচ্চারিত বাক্যটির উল্লেখ ব্যতিরেকে।

وقد علق البخاري رواية أشعث في صحيحيه (1048) ولكن لم يسق لفظها.

ইমাম বুখারী (রহ.) আশ’আসের বর্ণনাকে মু’আল্লাক্ব (১০৪৮) বলেছেন, কিন্তু (উচ্চারিত) কথাটিকে উল্লেখ করেননি। 

ইমাম বাগাভী (রহ.) ‘আল-জা’আদীয়্যাত’ (১৩৮৪) পুস্তকে বর্ণনা করেন যায়দ ইবনে আখযাম (রহ.) ও আলী ইবনে মুসলিম (রহ.) হতে; তাঁরা দু জন বলেন, ‘সাঈদ ইবনে ’আমির (রহ.) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, শু’বাহ (রহ.) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন ইঊনুস ইবনে উবায়দ হতে, তিনি হযরত হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন,

انكسفت الشمس على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فصلى ركعتين.

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সময়ে সূর্যগ্রহণ হয়েছিলো; অতঃপর তিনি দুই রাক’আত নামায পড়েন।’ এটা ’আলী ইবনে মুসলিম (রহ.) কর্তৃক বর্ণিত সংস্করণ।

যায়দ ইবনে আখযাম (রহ.)’এর সংস্করণে বিবৃত হয়:

صلى بنا النبي صلى الله عليه وسلم في الكسوف مثل صلاتنا. 

অর্থ: ‘প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্যগ্রহণকালে আমাদেরকে সাথে নিয়ে নামাযে ইমামতি করেন, যা আমাদের (নিয়মিত) সালাতের সদৃশ ছিলো।’ তবে এ রওয়ায়াত তথা বিবরণে দু রাক’আতের কোনো উল্লেখ নেই; আর এ হাদীসের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে এটা সাঈদ ইবনে ‘আমির (রহ.) ছাড়া আর কেউই বর্ণনা করেননি।

এই রওয়ায়াত/বিবরণের মধ্যে উল্লেখিত – فصلى بهم ركعتين نحو ما تصلون – “তিনি (দ.) তাঁদের সাথে দুই রাক’আত সালাত আদায় করেন, যেমনটি তোমরা সাধারণত নামায পড়ে থাকো” – মর্মে কথাটি এ অর্থ বোঝায় যে সূর্যগ্রহণকালীন নামাযের একটি মাত্র রুকূ’; আর এটা সর্যগ্রহণকালীন নামাযের সহীহ বর্ণনাগুলোর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।

এই আপত্তির জবাব দুটি উপায়ে দেয়া যেতে পারে:

প্রথম উপায়টি হলো বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে (من حيث الرواية); আর তা এই যে, ইবনে উলাইয়্যাহ (রহ.), ইয়াযীদ ইবনে যুরাঈ (রহ.) ও আশ’আস (রহ.) সবার সাথেই পার্থক্য (এতে) বিদ্যমান। এটা বর্ণনা করেছেন খালিদ আল-ওয়া’সিতী (রহ.), অবদুল ওয়া’রিস্ ইবনে সাঈদ (রহ.), আবদুল ‘আলা (রহ.), শু’বাহ (রহ.)। সাঈদ ইবনে আ’মির (রহ.) হতে বর্ণিত অপর সংস্করণটির রাবী হলেন হাম্মাদ ইবনে যায়দ (রহ.), হাম্মাদ ইবনে সালামাহ (রহ.), হুশায়ম ইবনে বশীর (রহ.), নূহ ইবনে ক্বায়স (রহ.) – এঁদের সবাই বর্ণনা করেছেন ইঊনুস ইবনে উবায়দ (রহ.) হতে, (ওপরে উদ্ধৃত) এই বাক্যটির উল্লেখ ব্যতিরেকে।

১/ – খা’লিদ আল-ওয়া’সিতী (রহ.)’এর বর্ণনা রয়েছে আল-বুখারীতে (১০৪০);

২/ – আবদুল ওয়া’রিস্ ইবনে সাঈদ (রহ.)’এর বর্ণনাও রয়েছে আল-বুখারীতে (১০৬৩);

৩/ – আবদুল্ ‘আলা আল-সা’মী (রহ.)’এর বর্ণনাও রয়েছে আল-বুখারীতে (৫৭৮৫);

৪/ – হাম্মাদ ইবনে যায়দ (রহ.)’এর বর্ণনা রয়েছে আল-বুখারী (১০৪৮) ও নাসাঈ (১৪৫৯) শরীফে;

৫/ – হুশায়ম (রহ.)’এর বর্ণনা রয়েছে নাসাঈ (১৪৬৩) ও তাহাবী (৩/৩৩০) গ্রন্থে;

৬/ – হাম্মাদ ইবনে সালামাহ (রহ.)’এর বর্ণনা রয়েছে আল-বায়হাক্বী (৩/৩৩৭) পুস্তকে;

৭/ – নূহ ইবনে ক্বায়স (রহ.)’এর বর্ণনা রয়েছে ইবনে হিব্বান (২৮৩৩, আল-ইহসান অনুসারে) কিতাবে;

৮/ – সাঈদ ইবনে আ’মির (রহ.)’এর বর্ণনা, শু’বাহ (রহ.) হতে আল-বুখারী (১০৬২) শরীফে, মাহমূদ ইবনে গায়লান-সূত্রে;

৯/ – ইয়াহইয়া ইবনে সাকান (রহ.)-ও বর্ণনা করেন সাঈদ ইবনে আ’মির হতে, শু’বাহ-সূত্রে – আল্ জা’দীয়্যাত (১৩৮৬), ‘আমর না’ক্বিদ-সূত্রে।

যায়দ ইবনে আখযাম (রহ.)’এর রওয়ায়াত, যা তিনি বর্ণনা করেছেন সাঈদ ইবনে আ’মির (রহ.) হতে, তিনি শু’বাহ (রহ.) হতে, তাতে যায়দ থেকে একটি ভ্রান্তি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় – যদি তাঁর বর্ণনা সঠিকও হয়ে থাকে [নোট: আল-বাযযার তাঁর মুসনাদ (৩৬৬০) পুস্তকে এটা যায়দ ইবনে আখযাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি সাঈদ ইবনে আ’মির থেকে, কিন্তু এতে এই বাক্যটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি; আর আল্লাহই ভালো জানেন]। এটা দুটি কারণে:

প্রথমতঃ আলী ইবনে মুসলিম (রহ.), মাহমূদ ইবনে গায়লান (রহ.) ও ইবনে মারযূক্ব (রহ.), যাঁদের বর্ণনাগুলো ইমাম তাহা’বী (রহ.)’এর ‘শরহু মা’আনী আল-আসার’ (১/৩৩০) ও ইমাম বায়হাক্বী (রহ.)’এর ‘আল-কুবরা’ (৩/৩৩১) গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে, তাঁরা সবাই যায়দের থেকে পৃথক হয়েছেন এবং এ বাক্যটি উল্লেখ করেননি।

দ্বিতীয়তঃ বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দীস-উলামা শু’বাহ (রহ.) হতে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন, আর তাঁরা এই বাক্যটি তাতে উল্লেখ করেননি।

দ্বিতীয় উপায় যা জবাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে তা হলো, জ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ (من حيث الدراية)। ইমাম ইবনে হিব্বান (আল-ইহসা’ন, ২৮৩৫ অনুসারে) বলেন,

قول أبي بكرة ((فصل بهم ركعتين نحو ما تصلون)) أراد به تصلون صلاة الكسوف ركعتين في أربع ركعات وأربع سجدات ا.هــ

অর্থ: হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর “তিনি (দ.) তাঁদের সাথে দুই রাক’আত সালাত আদায় করেন, যেমনটি তোমরা সাধারণত নামায পড়ে থাকো”- মর্মে বাণীটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সূর্যগ্রহণকালীন তোমরা সাধারণত যেভাবে কুসূফের নামায পড়ো; এর মানে দুই রাক’আত নামাযের মধ্যে চারটি রুকূ’ ও চারটি সেজদাহ।

আর এটা একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর। আল্লাহই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানেন।

তৃতীয় হাদীস

ইমাম আহমদ (৫/৪৬) বর্ণনা করেন ইমাম আবদুর রাজ্জাক্ব (রহ.) হতে, যিনি বলেন, মা’মার (রহ.) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইমাম ক্বাতা’দাহ (রহ.) ও অন্যান্য আরো অনেকের থেকে, (তাঁরা) ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন,

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: ((إن ريح الجنة لتوجد من مسيرة مائة عام؛ وما من عبد يقتل نفسا معاهدة إلا حرم الله عليه الجنة ورائحتها أن يجدها)) قال أبو بكرة: أصم الله أذني إن لم أكن سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقولها.

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শুনেছি এ কথা বলতে: “নিশ্চয় জান্নাতের সুগন্ধ এক শ বছরের (যাত্রার) দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে; আর (আল্লাহর) কোনো বান্দা-ই মঞ্জুরকৃত সুরক্ষাপ্রাপ্ত (এমন) কাউকে হত্যা করেন না, এর ব্যতিক্রম (স্রেফ) এই যে আল্লাহ তাকে জান্নাত ও সেটার সুগন্ধ হতে বঞ্চিত করবেন।” হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আল্লাহ আমার কানগুলো বধির করে দিন, যদি আমি রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ কথা বলতে না শুনে থাকি।”

ওপরের হাদীসটি এর স্পষ্ট অর্থের ভিত্তিতে আল-বুখারীতে (৩১৬৬) প্রাপ্ত বর্ণনার খেলাফ বা পরিপন্থী বলে দৃশ্যমান হয়, যা বর্ণিত হয়েছে মুজাহিদ (রা.) হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে এ মর্মে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“‏ مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا لَمْ يَرَحْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ رِيحَهَا تُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًا ‏”‏‏.‏

অর্থ: যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে সন্ধিচুক্তির আওতায় সুরক্ষাপ্রাপ্ত এমন কাউকে হত্যা করে, সে জান্নাতের সুগন্ধ পাবে না; অথচ জান্নাতের সুগন্ধ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়। [সহীহ বুখারী, ৩১৬৬, বই-৫৮, হাদীস-৮]

এরও দুটি উপায়ে জবাব বিদ্যমান:

প্রথম উপায় হলো, এ নির্দিষ্ট ইসনাদ/সনদ সম্পর্কে কতিপয় জ্যেষ্ঠ হাফিযে হাদীস এটাকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আল-বুখারী (রহ.) এ বর্ণনাটি  ‘তারীখুল কবীর’ (১/৪২৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেন সুফিয়ান হতে, তিনি ইঊনুস হতে, তিনি আল-হাকাম ইবনে আল-আ’রাজ হতে, তিনি আশ’আস্ হতে; এবং এরপর তিনি (আল-বুখারী) বলেন: 

وقال حماد عن يونس عن الحسن عن أبي بكرة؛ والأول أصح  ا.هــ.

অর্থ: হাম্মাদ ব্যক্ত করেন ইঊনুস হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। তবে প্রথমটি (মানে রওয়ায়াত/বিবরণটি) অধিকতর বিশুদ্ধ। 

ইমাম নাসাঈ (রহ.) ‘আল-কুবরা’ (৮৭৪৪) গ্রন্থে বর্ণনা করেন হা্ম্মাদ হতে, তিনি ইঊনুস হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; অতঃপর ইমাম নাসাঈ (রহ.) বলেন:

هذا خطأ والصواب حديث ابن علية؛ وابن علية أثبت من حماد بن سلمة؛ والله أعلم ا.هـ.

অর্থ: এটা একটা ভ্রান্তি এবং সঠিক হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে ইবনে উলাইয়াহ হতে; আর ইবনে উলাইয়াহ অধিকতর নির্ভরযোগ্য হাম্মাদ ইবনে সালামাহ হতে; আল্লাহই (এ বিষয়ে) ভালো জানেন। [আল-কুবরা, ৮৭৪৪]

ইবনে উলাইয়্যাহ’র রওয়ায়াত/বিবরণটি লিপিবদ্ধ আছে আন্ নাসাঈ (৪৭৪৮) ও আহমদ (৫/৩৮) গ্রন্থ দুটোতে, যা বর্ণিত হয়েছে ইঊনুস ইবনে উবায়দ হতে, তিনি আল-হাকাম ইবনে আল-’আরাজ হতে, তিনি আশআস্ ইবনে সারমালাহ হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান:

((من قتل نفسا معاهدة بغير حلها حرم الله عليه الجنة أن يشم ريحها)).

অর্থ: যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে সন্ধিচুক্তির আওতায় সুরক্ষাপ্রাপ্ত এমন কাউকে কোনো (শরীয়ত-সম্মত) ন্যায্য কারণ ছাড়া হত্যা করে, তাকে আল্লাহতায়ালা জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া থেকে নিষিদ্ধ করবেন। [আল-হাদীস]

দ্বিতীয় উপায়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তিশীল এবং তা হলো, রওয়ায়াত তথা বর্ণনাটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করা সত্ত্বেও বাহ্যত (দৃশ্যমান) অসঙ্গতির মধ্যে সঙ্গতি বিধান করা। কোনো স্বল্প পরিমাণের উল্লেখ অসংখ্য পরিমাণকে নাকচ করে দেয় না। সুন্নাহের মধ্যে এর অনেক উদাহরণ বিরাজমান।

ইবনে ক্বাইয়্যেম জওযিয়্যা ‘হা’দী আল-আরওয়া’হ’ (১১৯-১২০) পুস্তকে জান্নাতের সুঘ্রাণপ্রাপ্তির দূরত্ব বর্ণনাকারী রওয়ায়াতগুলোর মধ্যকার বিভিন্নতা ইঙ্গিত করে বলেন:

وهذه الألفاظ لا تعارض بينها بوجه؛ وقد أخرجا في الصحيحين من حديث أنس قال: لم يشهد عمي مع رسول الله صلى الله عليه وسلم بدرا. قال: فشق عليه. قال: أول مشهد شهده رسول الله صلى الله عليه وسلم غبت عنه! فإن أراني الله مشهدا فيما بعد مع رسول الله صلى الله عليه وسلم ليرين الله ما أصنع. قال: فهاب أن يقول غيرها. قال: فشهد مع رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم أحد؛ قال: فاستقبل سعد بن معاذ فقال له: أين؟ فقال: واها لريح الجنة أجده دون أحد. قال: فقاتلهم حتى قتل. قال: فوجد في جسده بضع وثمانون من بين ضربة وطعنة ورمية. فقالت أخته عمة الربيع بن النضر: فما عرفت أخي إلا ببنانه. ونزلت هذه الآية: {مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُواْ مَا عَاهَدُواْ ٱللَّهَ عَلَيْهِ} قال: فكانوا يرون أنها نزلت فيه وفي أصحابه.  

অর্থ: এসব কথার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি নেই। তাঁরা (বুখারী ও মুসলিম) উভয়েই হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “আমার চাচা বদরের জ্বিহাদে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে উপস্থিত ছিলেন না এবং তা তাঁকে (মানসিক) কষ্ট দিতো/পীড়িত করতো; আর তিনি বলতেন, ‘প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)‘এর প্রথম যুদ্ধ (এটা), অথচ আমি তাঁর সাথে ছিলাম না? আল্লাহ আমাকে ফুরসৎ দিলে আমি আল্লাহকে দেখাবো আমি কী করতে প্রস্তুত আছি।’ তিনি উহুদের জ্বিহাদের দিন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে উপস্থিত ছিলেন এবং হযরত সা’আদ ইবনে মু’য়ায (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। হযরত সা’আদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোথায়?’ অতঃপর তিনি উত্তর দেন, ‘কী চমৎকার জান্নাতের সুঘ্রাণ! আমি উহুদের (ময়দান) হতে তা পাচ্ছি।’ অতঃপর তিনি লড়াইয়ে যোগ দেন যতোক্ষণ না শহীদ হন, আর তাঁর দেহ মোবারকে আশিটি জখম হয়, যা লম্বা ও সরু ক্ষত এবং তরবারি/ছুরিকাঘাতের জখম। তাঁর বোন, যিনি আল-রাবী ইবনে আল-নাদরের ফুপু, তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাইকে শনাক্ত করতে পারিনি কেবল তাঁর আঙ্গুলের ডগা ছাড়া; আর এ উপলক্ষেই অবতীর্ণ হয়েছিলো আয়াতে করীমা – মুসলমােনদের মধ্যে কিছু এমন পুরুষ রয়েছে, যারা সত্য প্রমাণিত করেছে যে-ই অঙ্গীকার তারা আল্লাহর সাথে করেছিলো’ [আল-ক্বুর’আন, ৩৩/২৩; নূরুল ইরফান]।” তাঁরা এটাকে তাঁর (মানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) ও তাঁরই আসহাবমণ্ডলীর প্রতি অবতীর্ণ বলে বিবেচনা করতেন। (ইবনে কাইয়্যেম)

জান্নাতের সুঘ্রাণ দুই কিসিমের। একটির সুগন্ধ আল্লাহর কতিপয় বান্দার রূহ মোবারক তথা পুতঃআত্মা এ জগতেই পান, যা আন্যান্যরা জানতেও পারেন না। অপরটি হলো সেই সুগন্ধ যা দেহের ইন্দ্রিয়গুলো লাভ করতে পারে, যেমন – কেউ সুগন্ধি ফুলের সুবাস লাভ করেন। অতএব, এ ধরনের সুঘ্রাণ জান্নাতের অধিবাসীবৃন্দ পরলোকে লাভ করবেন, দূর হতে অথবা কাছ থেকে; আর এ জগতের ক্ষেত্রে কেবল নবী ও রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীর মধ্যে মনোনীত পুণ্যাত্মাবৃন্দই তা লাভ করবেন এবং হযরত আনাস ইবনে নাদর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্ভবত এ ধরনের সুঘ্রাণই লাভ করেছিলেন। আর আল্লাহই ভালো জানেন।

চতুর্থ হাদীস

ইবনে খুযায়মাহ (রহ.) তাঁর সহীহ গ্রন্থে (১৩৬৮) বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে মা’মার ইবনে রিবী আল-ক্বায়সী হতে, যিনি বলেন, ‘আমর ইবনে খলীফাহ আল-বাকরা’উয়ী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আশ’আস্ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে,

أن النبي صلى الله عليه وسلم صلى بالقوم صلاة المغرب ثلاث ركعات ثم انصرف، وجاء الآخرون فصلى بهم ثلاث ركعات، فكانت للنبي صلى الله عليه وسلم ست ركعات، وللقوم ثلاث ثلاث.

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযীদের জামা’আতের সাথে মাগরেবের তিন রাক’আত নামায আদায় করেন এবং প্রস্থান করেন। আরেকটি দল আগমন করেন, তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের সাথেও তিন রাক’আত নামায পড়েন। ফলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছয় রাক’আত নামায পড়েন, আর মানুষেরা (দু জামা’আতের প্রতিটি) তিন রাক’আত করে নামায আদায় করেন।

আল-হাকিম নিজ ‘আল-মুসতাদরাক’ (১/৩৩৭) পুস্তকে এটা মুহাম্মদ ইবনে মা’মার (রহ.)’এর তরীক্ব তথা সূত্রে একই ইসনাদ-সহকারে বর্ণনা করেন। (এর শেষে) উক্ববাহ বলেন:

سمعت أبا علي الحافظ يقول: هذا حديث غريب؛ أشعث الحمراني لم يكتبه إلا بهذا الإسناد ا.هـ

অর্থ: আমি আবূ আলী হাফিযকে শুনেছি এ কথা বলতে: এই হাদীসটি গরীব; আশ’আস্ হুমরানী এটা লিপিবদ্ধ করেননি কেবল এ ইসনাদ ছাড়া। 

বর্ণনাকারীদের একটি বড় দল এটা আশ’আস্ থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁরা যা বর্ণনা করেছেন তা ’আমর ইবনে খলীফার বর্ণনার খেলাফ; এঁদের মধ্যে রয়েছেন মু’য়ায ইবনে মু’য়ায, সাঈদ ইবনে আমির, আবূ আসিম ও আবূ হুর্রাহ।

ইমাম আবূ দাউদ (১২৪২) বর্ণনা করেন উবায়দুল্লাহ ইবনে মু’য়ায হতে, যিনি বলেন, আমার পিতা আমার কাছে বর্ণনা করেন আশ’আস্ হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন:

صلى النبي صلى الله عليه وسلم في خوف الظهر فصف بعضهم خلفه؛ وبعضهم بإزاء العدو؛ فصلى ركعتين ثم سلم؛ فانطلق الذين صلوا معه فوقفوا موقف أصحابهم؛ ثم جاء أولئك فصلوا خلفه؛ فصلى بهم ركعتين ثم سلم؛ فكانت لرسول الله صلى الله عليه وسلم أربعا؛ ولأصحابه ركعتين ركعتين. وبذلك كان يفتي الحسن. قال أبو داود: وكذلك في المغرب يكون للإمام ست ركعات؛ وللقوم ثلاثا ثلاثا. اهـ.

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার (জ্বিহাদকালে শত্রুর আক্রমণের) আশঙ্কা নিয়ে যোহরের নামায পড়েন; আর তাঁদের (সাহাবাদের) একটি দল তাঁর ইমামতিতে কাতারবদ্ধ হন, অপর দলটি শত্রুদের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। তিনি দুই রাক’আত নামায পড়ান, এবং এরপর সালাম ফেরান; যাঁরা তাঁর সাথে নামায পড়েছিলেন, তাঁরা সরে তাঁদের সাথীদের অবস্থানে গিয়ে দাঁড়ান এবং প্রহরারত সাহাবা (রা.)-মণ্ডলী তাঁর ইমামতিতে নামায পড়তে আসেন। তিনি আরো দুই রাকআত নামায তাঁদের সাথে পড়ান এবং এরপর সালাম ফেরান। অতএব, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোট চার রাক’আত নামায পড়েন এবং তাঁর সাহাবা (রা.)-মণ্ডলী দুইটি জামা’আতের প্রতিটিতে দুই রাক’আত করে নামায পড়েন। আর ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এরই ভিত্তিতে ফতোয়া/সিদ্ধান্ত দিতেন। ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) বলেন: “অনুরূপভাবে, মাগরিব নামাযে ইমাম পড়বেন ছয় রাক’আত এবং নামাযীরা পড়বেন প্রতি জামা’আতে তিন রাক’আত করে।”

ইমাম আল-বায়হাক্বী (রহ.) তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে (৩/২৫৯-২৬০) বর্ণনা করেন সাঈদ ইবনে আ’মির সূত্রে, তিনি আশ’আস্ হতে, তিনি ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, এবং এরপর ইমাম বায়হাক্বী (রহ.) বলেন যে রাসূলে খোদা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবা (রা.)-বৃ্ন্দের একটি দলের সাথে দুই রাক’আত নামায পড়ান, তারপর সালাম ফেরান; তাঁরা (প্রতিরক্ষাব্যূহে) ফিরে গেলে (প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত) অন্যান্য সাহাবা (রা.) নামাযে যোগ দেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুই রাক’আত নামায পড়ান আর সালাম ফেরান। অতএব, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর জন্য এটা ছিলো চার রাক’আত সালাতুল্ খওফ তথা শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কার নামায, আর সাহাবা (রা.)’মণ্ডলীর দুটো দলের প্রতিটির জন্য তা ছিলো দুই রাকা’আত করে। আল-বায়হাক্বী (রহ.) বলেন:

وكذلك رواه معاذ بن معاذ عن الأشعث، وقال: في الظهر، وزاد: قال: وبذلك كان يفتي الحسن، وكذلك في المغرب يكون للإمام ست ركعات وللقوم ثلاث ثلاث.

অর্থ: এটা এভাবেই বর্ণিত হয়েছে মু’য়ায ইবনে মু’য়ায (রহ.) হতে, তিনি আশ’আস হতে, আর তিনি বলেন, “যোহরের ওয়াক্তের নামাযে;” তিনি আরো যোগ করেন, “এবং এর ভিত্তিতেই ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ফতোয়া দিতেন। অনুরূপভাবে, মাগরিবের ওয়াক্তের নামাযে ইমাম সাহেব পড়াবেন ছয় রাক’আত আর নামাযীবৃন্দের দুই দলের প্রতিটি দল পড়বেন তিন রাক’আত করে।”

(ইমাম বায়হাক্বী আরো বলেন) আবূ আলী আল-রূযাবা’রী (রহ.) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবূ বকর ইবনে দাসসাহ হতে, যিনি বলেন, আবূ দাউদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন উবায়দউল্লাহ ইবনে মু’য়ায হতে, যিনি বলেন, আমার পিতা আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আশ’আস্ হতে; আর তিনি এই বর্ণনাটি এর অর্থসহ উল্লেখ করেছেন বটে, তবে ভিন্ন শব্দচয়নে, আর এই অতিরিক্ত সংযোজনের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। “অনুরূপভাবে মাগরিবের ওয়াক্তের নামাযে” (وكذلك في المغرب) কথাটা প্রসঙ্গে বলবো, আমি এটাকে হাদীসের সাথে সম্পর্কিত আমার পুস্তকে পেয়েছি ঠিক, কিন্তু এটা আশ’আসের বক্তব্য বলেই মনে হয়; আর এটা কিছু কপিতে দৃশ্যমান; আবূ দাউদ (রহ.) বলেন – وكذلك في المغرب – “অনুরূপভাবে মাগরিবের ওয়াক্তের নামাযে।” কিছু মানুষ এটা বর্ণনা করেছেন আশ’আস্ হতে, মারফূ’ হিসেবে। তবে আমি এক্ষেত্রে এটাকে মনোযোগের বিচ্যুতি ছাড়া অন্য কিছু বলে বিবেচনা করি না।

তিনি (ইমাম বায়হাক্বী) ‘আল-মা’রিফাহ’ গ্রন্থে (৩/১৭) বলেন:

وقد رواه عمرو بن خليفة البكراوي عن الحسن عن أبي بكرة عن النبي صلى الله عليه وسلم ي المغرب؛ وهو وهم؛ والصحيح هو الأول؛ والله أعلم ا.هــ.

অর্থ: ’আমর ইবনে খলীফাহ বর্ণনা করেন ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে মাগরিব প্রসঙ্গে, কিন্তু এটা একটা অনবধানতা। সঠিক সংস্করণটি হলো প্রথমটি (মানে যোহরের নামায প্রসঙ্গে), আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। [আল-মা’রিফাহ, ৩:১৭]

ইমাম তাহাভী (রহ.) ‘শরহু মা’আনী-ইল-আ’সার’ (১:৩১৫) গ্রন্থে বলেন:

حدثنا أبو بكرة وابن مرزوق قالا: ثنا أبو عاصم عن الأشعث عن الحسن عن أبي بكرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم صلى بهم صلاة الخوف فصلى بطائفة منهم ركعتين ثم انصرفوا؛ وجاء الآخرون فصلى بهم ركعتين؛ فصلى رسول الله صلى الله عليه وسلم أربعا؛ وصلى كل طائفة ركعتين. حدثنا أبو بكرة ثنا أبو داود ثنا أبو حرة عن الحسن عن أبو بكرة عن النبي صلى الله عليه وسلم مثله ا.هــ. 

অর্থ: আবূ বাকরাহ (রহ.) ও ইবনে মারযূক্ব (রহ.) উভয়ই আমাদের কাছে বর্ণনা করেন এই বলে, আবূ আসিম আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এই মর্মে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবা (রা.)-বৃন্দকে নিয়ে সালাতে খওফ (তথা শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কার নামায) পড়েন, আর তিনি তাঁদের একটি দলের সাথে দুই রাক’আত নামায পড়ান; অতঃপর তাঁরা সরে গেলে (প্রহরারত) অপর দলটি আসেন, এবং তিনি তাঁদেরকে সাথে নিয়ে দুই রাক’আত নামায পড়ান। অতএব, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়েন চার রাক’আত; আর প্রতিটি দল পড়েন দুই রাক’আত করে। আবূ বাকরাহ (রহ.) অনুরূপ একটি হাদীস আমাদের কাছে বর্ণনা করেন এই বলে, ’আবূ দাউদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এ কথা উল্লেখ করে’ – ‘আবূ হুর্রাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে।’

এই হাদীস সহীহ হওয়ার পক্ষে মন্তব্য

تقدم أن هذا الحديث لا شك في صحته عن الحسن البصري؛ وتقدم أيضا أن الراجح من الاختلاف الذي وقع هو رواية من رواه عنه عن أبي بكرة، وتقدم ترجيح سماع الحسن من أبي بكرة فالراجح صحته؛ وقد صححه كبار الأئمة كما سوف يأتي.

অর্থ: ইতিপূর্বে সাব্যস্ত হয়েছে যে ইমাম হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত (আলোচ্য ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক দুটো মুসলিম বাহিনির মাঝে সন্ধি স্থাপন মর্মে) এই হাদীসটির সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। আর এটাও ইতিপূর্বে সাব্যস্ত হয়েছে এ বিবরণের বিভিন্ন সংস্করণের আলোকে এ মর্মে যে, পছন্দকৃত সংস্করণ হচ্ছে সেটাই যা তাঁর (মানে ইমাম হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহির) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে (গ্রহণ করে)। অধিকন্তু, এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে সবচেয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাদীসটি শুনেছিলেন। অতএব, এ হাদীসটি সহীহ/বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি-ই গৃহীত; আর বুযূর্গ মুহাদ্দেসীন (মানে গুরুজন হাদীসবেত্তাবৃন্দ) এই হাদীসকে সহীহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, যা আমরা নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে দেখতে পাবো।

সমর্থনসূচক বিবরণগুলো

এই হাদীসটির আ’ম তথা সাধারণ ও খা’স তথা সুনির্দিষ্ট সমর্থনসূচক বিবরণ রয়েছে। খা’স-গুলো পরে উল্লেখ করা হবে; সার্বিকগুলো আগে উল্লেখ করা হলো।

প্রথমতঃ ক্বুর’আন মজীদ ও সুন্নাতে নববী (দ.)-এর দলিলগুলো ’আস্ সুলহু’ তথা সন্ধির পক্ষে ইঙ্গিত দেয় এবং তাতে উৎসাহিত করে। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন:

لاَّ خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِّن نَّجْوَاهُمْ إِلاَّ مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلاَحٍ بَيْنَ ٱلنَّاسِ

অর্থ: তাদের অধিকাংশ পরামর্শের মধ্যে কোনো মঙ্গল নেই, কিন্তু যে ব্যক্তি নির্দেশ দেয় দান-খয়রাত কিংবা ভালো কথা অথবা মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের…। [আল-ক্বুর’আন, ৪/১১৪; নূরুল ইরফান]

আল্লাহ আরো ফরমান:

وَٱلصُّلْحُ خَيْرٌ

অর্থ: …আর আপস-নিষ্পত্তি/সন্ধি উত্তম…। [আল-ক্বুর’আন, ৪/১২৮; নূরুল ইরফান]

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন:

فَٱتَّقُواْ ٱللهَ وَأَصْلِحُواْ ذَاتَ بِيْنِكُمْ

অর্থ: …সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব রাখো/সন্ধি স্থাপন করো…। [আল-ক্বুর’আন, ৮/১, নূরুল ইরফান]

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন:

وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُواْ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَهُمَا

অর্থ: এবং যদি মুসলমানদের দু’টি দল পরস্পর যুদ্ধ করে, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি করাও…। [আল-ক্বুর’আন, ৪৯/৯; নূরুল ইরফান]

আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আরো ফরমান:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُواْ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ

অর্থ: মুসলমান-মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং আপন দু’ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দাও…। [আল-ক্বুর’আন, ৪৯/১০; নূরুল ইরফান]

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:

((كُلُّ سُلاَمَى مِنَ النَّاسِ عَلَيْهِ صَدَقَةٌ كُلَّ يَوْمٍ تَطْلُعُ فِيهِ الشَّمْسُ؛ تَعْدِلُ بَيْنَ اثْنَيْنِ صَدَقَةٌ… الحديث )).

অর্থ: প্রাত্যহিক সূর্যোদয়ে মানুষের (শরীরের) প্রতিটি গ্রন্থির সাদক্বাহ দেয়া অবশ্যকর্তব্য। দু জন মানুষের মাঝে ইনসাফ করা হচ্ছে সাদক্বাহ। [বুখারী ২৯৮৯; মুসলিম ১০০৯; ইমাম নববীর ৪০ হাদীস, ২৬ নং হাদীস]

উক্ত দুটো বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থে আরো বর্ণিত হয়েছে উম্মে কুলসূম বিনতে উক্ববাহ (রা.) হতে, যিনি বলেন:

(( سمِعتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم  يَقُولُ لَيْسَ الكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ فَيَنْمِي خَيراً أَوْ يقُولُ خَيْراً )).

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, ওই ব্যক্তি মিথ্যেবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপনের জন্য (বানিয়ে) ভালো কথা পৌঁছে দেয়, অথবা ভালো কথা বলে। [বুখারী ২৬৯২; মুসলিম ৬৭৯৯]

দ্বিতীয়তঃ এই বর্ণনার প্রকৃত ঘটনাটি-ই হাদীসটি সহীহ হওয়ার পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে; আর এর প্রতি ইশারা করা হয়েছে ইমাম হাসান আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর কথা থেকে, যখন তিনি ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও আমীরে মু’য়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মধ্যে সন্ধি স্থাপনের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে এই হাদীসকেই উদ্ধৃত করেন।

তৃতীয়তঃ ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর প্রতি ইরাক্বী জনগণ আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন এবং ঈমানদারবৃন্দের একটি বিশাল দল তাঁরই পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন; এটা তিনি বেশ কিছু কারণে করেছিলেন, যার মধ্যে সম্ভবত এই হাদীসখানি অন্তর্ভুক্ত ছিলো (মানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে তিনি জানতেন এবং সেটার প্রতি সমর্পিত ছিলেন – বঙ্গানুবাদক)। আর আল্লাহই এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জানেন। [বঙ্গানুবাদকের অতিরিক্ত নোট: রাফেযী শিয়া-চক্র আহলে বাইত (রা.)’এর প্রতি মেকি প্রেম-ভক্তি দেখালেও ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর এই সন্ধি স্থাপনের কারণে তাঁর কোনো প্রশংসা মুখে আনে না; তারা তাঁর ব্যাপারে একদম চুপ! আসলে তাদের এ আহলে বাইত-প্রীতির দাবি একটি বড় ধরনের ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়!]

এই হাদীসকে সুনির্দিষ্টভাবে সমর্থন করে এমন বিবরণসমূহ:

হযরত জাবের (রা:)-এর বর্ণনা:

আল-খতীব আল-বাগদাদী (রহ.) নিজ ‘তা’রীখ’ গ্রন্থে (৮/২৬-২৭) আপন ইসনাদ-সহ ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-উমাউয়ী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আল-আ’মাশ হতে, তিনি আবূ সুফিয়ান হতে, তিনি হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন যে ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:

إن ابني هذا سيد يصلح الله به بين فئتين من المسلمين.

অর্থ: নিশ্চয় আমার পৌত্র একজন সাইয়্যেদ; আল্লাহতায়ালা তার মাধ্যমে বিবদমান দুটো মুসলমান বাহিনিকে একতাবদ্ধ করবেন। (আল-হাদীস)

এই হাদীসের বর্ণনাকারীবৃন্দ সবাই সিক্বা/বিশ্বস্ত ও মশহুর/প্রসিদ্ধ; আর মুহাদ্দীস-উলামা তাঁদের সবার কাছ থেকে (মাঈনের সূত্রে) এটা বর্ণনা করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-উমাউয়ী সম্পর্কে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত হলো তিনি বিশ্বস্ত, হাদীসশাস্ত্রে পারদর্শী। মুহাদ্দেসীন-উলামার সংখ্যাগরিষ্ঠই তাঁকে অনুসমর্থন করেন, ইবনে মাঈনের মতোই, তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত অধিকাংশ রওয়ায়াত/বর্ণনার ক্ষেত্রে, এবং ইবনে আম্মার, আদ্ দারাক্বূতনী ও ইবনে সা’আদ (হতেও)। ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন – ليس به بأس ثقة – ‘কোনো সমস্যা নেই, বিশ্বস্ত।’ তবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন – لم تكن له حركة في الحديث – ‘হাদীস-শাস্ত্রে তাঁর তেমন কোনো নড়াচড়া (মানে গবেষণা) নেই।’ আরেকটি বর্ণনায় তিনি (ইমাম আহমদ) বলেন:

ما كنت أظن عنده الحديث الكثير؛ فإذا هم يزعمون أن عنده عن الأعمش حديثا كثيرا وعن غيره؛ وقد كتبنا عنه؛ وكان له أخ له قدر وعلم يقال له: عبدالله. ولم يثبت أمر يحيى؛ كأنه يقول: كان يصدق وليس بصاحب حديث.

অর্থ: আমি মনে করি না তাঁর কাছে অসংখ্য হাদীস ছিলো; তবে তাঁরা দাবি করে থাকেন যে তাঁর কাছে আল-আ’মাশ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে (বর্ণিত) প্রচুর হাদীস রয়েছে; আর আমরা তাঁর থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি; তাঁর আবদুল্লাহ নামে একজন ভাই ছিলেন যাঁর মর্যাদা ও জ্ঞান ছিলো। তাঁর সম্পর্কে ইয়াহইয়ার মত স্পষ্ট নয়, কেননা তিনি বলেছেন, ‘তিনি সত্যবাদী ছিলেন, কিন্তু হাদীসবিদ ছিলেন না।’

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, এসব বক্তব্য ইঙ্গিত করে যে তিনি আল-আ’মাশ হতে বেশ কিছু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন; কিন্তু তিনি নিখূুঁত ও যথাযথ ছিলেন না। বরঞ্চ তিনি ওর (মানে স্তরের) চেয়ে সামান্য পিছিয়ে ছিলেন; আর এর দ্বারাই আল-দু’আফা গ্রন্থে আল-উক্বায়লীর উত্থাপিত আপত্তির জবাব কেউ দিতে পারেন। আল-বুখারী (রহ.) তাঁর থেকে চারটি হাদীসের বর্ণনা এনেছেন, যার মধ্যে দুটোর বিকল্প ইসনাদ আল-বুখারীতে লিপিবদ্ধ, (সেগুলোর) একটি আল-আ’মাশ হতে; আর অপর দুটোর বিকল্প ইসনাদ মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ। ইমাম ইবনে হাজর (রহ.) তাঁকে ‘আল-হাফিয’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম যাহাবী তাঁকে ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, তাঁর এই হাফিয তথা হাদীস মুখস্থ থাকার পক্ষীয় বিবরণটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) কর্তৃক তাঁর মাগাযী সম্পর্কে হাদীসসমূহে খ্যাতি বিষয়ে প্রদত্ত বক্তব্যেরই সম্পূরক। আর ইবনে সা’আদ তাঁকে যে বলেছেন হাদীসবিদ নন, তবে বিশ্বস্ত, তা ইতিপূর্বে উল্লেখিত সমস্ত কিছুর আলোকে সম্পূর্ণ সঠিক নয়। 

অধিকন্তু, আমি বলি, আয্-যাহাবী ‘আত্ তাযকিরাহ’ গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে বলেছেন:

روى عنه خلق كثير.

অর্থ: প্রচুর সংখ্যক হাদীসবিদ তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।       

এই ইসনাদের অবশিষ্ট বর্ণনাকারীবৃন্দ সবাই সুপ্রসিদ্ধ। আবূ সুফিয়ান (রহ.) সম্পর্কে ও হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে তাঁর হাদীস শ্রবণের ব্যাপারে বেশ অনেক কথা বলা হয়েছে, আর এর সারসংক্ষেপ হলো তিনি হাদীসগুলোর কিছু কিছু (নিজে) শুনেছেন এবং পাশাপাশি কিছু কিছু তিনি হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মোড়ানো পাতা (صحيفة) নামে সুখ্যাত লিপি থেকে সংগ্রহ করেছেন। তাঁর নিম্নোক্ত কথা থেকে তা সুপ্রতিষ্ঠিত:

جاورت جابرا بمكة ستة أشهر.

অর্থ: আমি মক্কা মোয়াযযমা নগরীতে হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সাথে ছয় মাস থেকেছি।

আবূ সুফিয়ান (রহ.)’এর বর্ণনাগুলো ‘সহীহাইন’ (বুখারী ও মুসলিম) বিশুদ্ধ দুটো হাদীসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে; তবে আল-বুখারী গ্রন্থে সংকলিত হাদীসগুলোর সবই ‘মুতা’বা’আত’ (متابعة) তথা সম্পূরক। [লেখকের নোট: আমি (শাইখ সুবাঈ) ‘শরহুত তিরমিযী (২৭৫)’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছি]

আল-আ’মাশ (রহ.) আবূ সুফিয়ান (রহ.)’এর কাছ থেকে যে বর্ণনাটি নিয়েছেন তা সুখ্যাত এমনই পর্যায়ে যে তাঁকে (অর্থাৎ আল-আ’মাশকে) তাঁর (মানে আবূ সুফিয়ানের) কাছ থেকে মূল বর্ণনাকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়; আর ইবনে ’আদী (রহ.) বলেন:

لا بأس به؛ روى عنه الأعمش أحاديث مستقيمة.

অর্থ: তাঁকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই; আল-আ’মাশ তাঁর কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য/বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ বর্ণনা করেছেন।

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, তাবেঈ হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সা’আদ (রহ.) সমর্থিত হয়েছেন আবদুর রহমান ইবনে মাগরা’ (রহ.)’এর বর্ণনা দ্বারা; ইমাম তবরানী (রহ.) ‘আল-কবীর’ (৩/৩৫) গ্রন্থে নিজ ইসনাদ-সহ বর্ণনা করেন আবদুর রহমান ইবনে মাগরা’ (রহ.) হতে, তিনি আল-আ’মাশ (রহ.) হতে, তিনি আবূ সুফিয়ান (রহ.) হতে, তিনি হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:

إن ابني ـ يعني الحسن ـ سيد؛ وليصلحن الله به بين فئتين من المسلمين.

অর্থ: নিশ্চয় আমার এ পৌত্র – মানে (ইমাম) হাসান ইবনে আলী – একজন সাইয়্যেদ; আর অবশ্যই আল্লাহতায়ালা তার মাধ্যমে বিবদমান দুটো মুসলিম বাহিনির মাঝে সন্ধি স্থাপন করাবেন।

ইমাম আল-বাযযার (রহ.)-ও ‘কাশফুল আসতার’ (২৬৩৫) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ ভাষ্যা্নুযায়ী এটা বর্ণনা করেন ইঊসুফ ইবনে মূসা (রহ.) হতে, তিনি এই ইসনাদ-সহ ইবনে মাগরা’ (রহ.) হতে। আল-বাযযার (রহ.) বলেন:

لا نعلمه يروى عن جابر إلا بهذا الإسناد.

অর্থ: আমরা এটা হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হওয়া সম্পর্কে জানি না কেবল এই ইসনাদ ছাড়া।

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, আবদুর রহমান ইবনে মাগরা’কে নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে; আর তাঁরা (মানে হাদীসবিদবৃন্দ) তাঁর আল-আ’মাশ হতে বর্ণনাগুলোকে খাস্ তথা সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করে নিয়েছেন। আলী ইবনে আল-মাদীনী বলেন:

ليس بشيء؛ كان يروي عن الأعمش ستمائة حديث تركناه؛ لم يكن بذاك. 

অর্থ: কিছুই না; তিনি আল-আ’মাশ থেকে ছয় শ হাদীস বর্ণনা করতেন যা আমরা তরক করেছি তথা বাদ দিয়েছি। তিনি এতো কিছু নন।

ইবনে আদী (রহ.) বলেন:

وهو كما قال علي؛ إنما أنكرت على أبي زهير هذا أحاديث يرويها عن الأعمش؛ لا يتابعه عليها الثقات.

অর্থ: আলী (ইবনে মাদীনী) যেমনটি বলেছেন (তাই সঠিক)। আমি আবূ যুহাইরকে স্রেফ আল-আ’মাশ হতে বর্ণিত এসব হাদীসের খাতিরেই সমালোচনা করেছি; এগুলো বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের দ্বারা সমর্থিত নয়। 

অতএব, ওপরে প্রদত্ত কারণে এই বর্ণনাটি ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের বর্ণনাকে শক্তিশালী করে না।

সংক্ষিপ্তসার হলো, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ হতে এই ইসনাদ ওপরে উল্লেখিত কারণে শক্তিশালী বটে, কিন্তু এটা গরীব (বিরল); আর আল-আ’মাশ হতে ইয়াহইয়ার একক বর্ণনাগুলো যথেষ্ট নয়; কিন্তু এগুলো সমর্থন দেয়ার বেলায় ভালো। অতএব, আমল তথা অনুশীলন করার জন্য (সঠিক) হযরত আবূ বাকরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হাদীসটি, আর হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হাদীসটি এর সমর্থনসূচক বর্ণনা মাত্র।

ইমাম বাযযার (রহ.) তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (৯/১১০-১১১) বলেন:

وهذا الحديث يروى عن جابر وعن أبي بكرة؛ وحديث أبي بكرة أشهر وأحسن إسنادا؛ وحديث جابر أغرب ا.هــ

অর্থ: এই বর্ণনাটি এসেছে সর্ব-হযরত জাবের ও আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সূত্রে। তবে হযরত আবূ বাকরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনাটি অধিকতর সুপ্রসিদ্ধ ও উত্তম ইসনাদ-বিশিষ্ট; পক্ষান্তরে, হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনাটি গরীব তথা বিরল।

ইমাম তবরানী (রহ.) ‘আল-আওসাত’ গ্রন্থে (১৮১০) বলেন:

لم يرو هذا الحديث عن الأعمش إلا عبد الرحمن ويحيى بن سعيد الأموي.

অর্থ: এই হাদীসটি আল-আ’মাশ হতে আবদুর রহমান ও ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ উমাউয়ী ছাড়া আর কেউই বর্ণনা করেননি।

হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বর্ণনা

আবূ ‘আমর আল-দা’নী (রহ.) ‘আল-ফিতান’ (১/২১৬-২১৭) গ্রন্থে বলেন:

আবদুর রহমান ইবনে আবদিল্লাহ আল-ফারায়েদীর সাথে আমাদের পাঠের সূত্রে তিনি আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, আবূ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে নুসাইর আমাদের কাছে বর্ণনা, যিনি বলেন, আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব ইবনে ইবরাহীম ইবনে ফার্রূক্ব আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আল-রা’ফিক্বাহ’তে এ কথা বলে, উমার ইবনে মুহাম্মদ (যিনি ইবনে তাল্লি নামে সমধিক প্রসিদ্ধ, তিনি) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন তাঁর পিতা হতে, যিনি বর্ণনা করেন মা’ক্বীল ইবনে আবা’ন হতে, তিনি হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এই মর্মে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে বলেছেন:

(( إن ابني هذا سيد؛ يصلح الله عز وجل على يديه بين فئتين من أمتي يحقن الله دماءهم به )).

অর্থ: আমার এ পৌত্র একজন সাইয়্যেদ; আল্লাহতায়ালা তার হাতে আমার উম্মতের দুটো বিবদমান দলকে ঐক্যবদ্ধ করবেন; সে এ (সন্ধি) দ্বারা তাদের রক্ত ঝরা হতে তাদেরকে নিষ্কৃতি দেবে।

আমি (শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান সা’আদ) বলি, এই ইসনাদের মধ্যে আছেন আবা’ন আর্-রাক্কা’শী। তিনি পুণ্যবান (সোয়ালিহীন)-দের একজন বটেন; তবে তিনি পরিত্যক্ত (متروك)। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে জাল হাদীস বর্ণনা করেছিলেন কি-না সে ব্যাপারে মতপার্থক্য বিরাজমান।

শু’বাহ তাঁর সম্পর্কে মিথ্যের দোষারোপ করেন; পক্ষান্তরে, অন্যান্য হাদীসবেত্তাবৃন্দ ভিন্নমত পোষণ করেন এই বলে যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ কাজ করেননি। বরঞ্চ তাঁরই অবহেলা ও দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে এটা ঘটেছিলো। আবূ হা’তিম বলেন:

متروك الحديث؛ وكان رجلا صالحا ولكنه بلي بسوء الحفظ.

অর্থ: (তিনি) হাদীস বিষয়ে পরিত্যক্ত; পুণ্যবান ব্যক্তি ছিলেন বটে, তবে দুর্বল স্মৃতিশক্তি (হেফয) দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন।

আবূ যুর’আহ (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়:

كان يتعمد الكذب؟

অর্থ: তিনি (আবা’ন) কি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে বলেছিলেন?

হযরত ইমাম উত্তর দেন:

لا؛ كان يسمع الحديث من أنس ومن شهر ومن الحسن فلا يميز بينهم.

অর্থ: না! তিনি সর্ব-হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), শাহর (রহ.) ও ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে হাদীস শুনতেন, কিন্তু তাঁদের (বর্ণনার) মধ্যে পৃথক করতে পারতেন না (দুর্বল স্মৃতিহেতু)।

এটা প্রতীয়মান হয় যে তাঁর মাঝে বেশ অসাবধানতা ছিলো। ইয়াযীদ ইবনে যুরাঈ বলেন:

حدثني عن أنس بحديث؛ فقلت له: عن النبي صلى الله عليه وسلم؟ فقال: وهل يروي أنس عن غير النبي صلى الله عليه وسلم؟! فتركته.  

অর্থ: তিনি আমার কাছে হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত একটি হাদীস বর্ণনা করেন; অতঃপর আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘এটা কি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এসেছে?’ তিনি উত্তর দেন, ‘হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন?’ তাই আমি তাঁকে বাদ দেই।

অতএব, এই ইসনাদটি যদিও ওপরের আলোচনা অনুযায়ী সামান্য মূল্য ধারণ করে, তথাপিও এতে এই বিবরণটির প্রসিদ্ধি প্রমাণিত হয়। এবং আল্লাহতায়ালাই সবচেয়ে ভালো জানেন।

এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন যে আইয়েম্মাহ/উলামাবৃন্দ

হাদীসশাস্ত্রজ্ঞ ইমামমণ্ডলীর একটি বড় দল আলোচ্য এ হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং এটাকে মজবুত (বর্ণনা) বলে বিবেচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন:

১/- ইমাম হাসান আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), যেমনটি ইতিপূর্বে প্রতীয়মান হয়েছে যে তিনি এই হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যা তাঁরই মতানুযায়ী এর শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিতবহ। 

২/ – ইমাম ইবনে উবায়নাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর সম্পর্কে এ মর্মে যে তিনি বলেছেন:

قوله: (( فئتين من المسلمين )) يعجبنا جداً. 

অর্থ: “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর উচ্চারিত ‘মুসলমানদের মধ্যে বিবদমান দুটি দল’ – এই কথাটি আমাদেরকে প্রভাবিত করে।” এটা ইমাম উবায়নাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর কাছে হাদীসটির শক্তি নির্দেশকারী হওয়ার প্রমাণ (وهذا يدل على قوة الحديث عنده)।

৩/ – ইমাম ইবনে আল-মাদীনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)

৪/ – ইমাম আল-বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)

৫/ – ইমাম আল-তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)

৬/ – ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহি আলাইহি)

৭/ – ইমাম আল-বাগাভী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ‘শারহুস্ সুন্নাহ’ (১৪/১৩৬) গ্রন্থে।

এছাড়াও অসংখ্য হাদীসবেত্তা যাঁরা এই হাদীসের সহীহ হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন।

আল্লাহর তরফ থেকেই আগত সমস্ত তৌফীক্ব। আল্লাহতায়ালার সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও তাবেঈন (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-বৃন্দের প্রতিও। [আমি আমার বৎস আবদুল মজীদ ইবনে ইবরাহীম আল-উহায়বী, আয়মান ইবনে আবদিল্লাহ আল-উলাইয়্যান এবং সা‘মী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জা’য়াদউল্লাহ’র প্রতি এই গবেষণায় একাডেমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে আমাকে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ তাদেরকে অফুরন্ত পুরস্কার দান করুন, আমীন]

স্বাক্ষর –

আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান আস্-সা’আদ  

লেখকের মুখবন্ধ

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَحِيْمِ.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য যিনি আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম)-মণ্ডলীর নুবূয়্যতের ক্রমধারাশেষে ইসলামী প্রতিটি যুগে এমন কিছু আলেম-উলামা প্রেরণ করেছেন, যাঁরা পথহারা লোকদেরকে হেদায়াতের পথের দিকে আহ্বান করেছেন এবং যাঁরা আঘাত ও ক্ষতির মুখে ধৈর্য ধরেছেন। তাঁরা আল্লাহর ঐশীগ্রন্থ আল-ক্বুর’আনের মাধ্যমে জরাব্যাধিগ্রস্তদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করেছেন, আর আল্লাহরই নূর তথা জ্যোতি দ্বারা অন্ধদের দর্শনক্ষমতা দান করেছেন। তাঁরা ইবলীস শয়তান কর্তৃক প্রাণনাশের শিকার কতোজনেরই না জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন! আর কতোজন পথভ্রষ্ট মানুষকেই না তাঁরা হেদায়াত দান করেছেন! তাই মানবজাতির ওপর তাঁদের প্রভাব কতো চমৎকার! আর তাঁদের ওপরে মানবজাতির প্রভাব কতো বিরক্তিকর! তাঁরা আল্লাহর কিতাব (আল-ক্বুর’আন) দ্বারা অপনোদন করেছেন গোমরাহ ধর্মসংস্কারকদের ধর্মবিকৃতি; বাতীল/মিথ্যেবাদীদের জোচ্চুরি; আর গণ্ডমূর্খদের অপব্যাখ্যা, যারা উড্ডীন করেছিলো বিদআতের পতাকা এবং ছড়িয়েছিলো ফিতনার বিষবাষ্প। কেননা অবশ্যঅবশ্য তারা কিতাবুল্লাহর সাথে মতবিরোধ করে থাকে। তারা আল্লাহ ও তাঁর কিতাব সম্পর্কে (গভীর) জ্ঞান ছাড়াই কথা বলে। তারা মোতাশাবেহ তথা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক কালাম সম্পর্কে মনগড়া মত প্রকাশ করে এবং সরলবিশ্বাসী, (ধর্মীয় জ্ঞানে) অশিক্ষিত মানুষকে ধোঁকা দেয় এবং ফলস্বরূপ বিভ্রান্ত করে। আমরা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী লোকদের এসব ক্লেশ থেকে মহান আল্লাহর দরবারে আশ্রয় চাই, আমীন। [নোট: এই খুতবা উদ্ধৃত হয়েছে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহির রচিত ফতোয়া – الرد على الزنادقة والجهمية – গ্রন্থ হতে; এর পক্ষে অনেক রেফারেন্স আরবী সংস্করণে বিধৃত]

আমি (লেখক: শাইখ আস্ সুবাঈ) সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং (এতে) তাঁর কোনো শরীকদারও নেই – না তাঁর মোবারক নামগুলোতে, না তাঁর ঐশী গুণাবলীতে। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও মনোনীত রাসূল এবং পছন্দকৃত নবী। তাঁর আ’ল তথা পরিবার-পরিজন ও আসহাব তথা সাথী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর প্রতি জানাই সালাত-সালাম। সেই সাথে কিয়ামত অবধি (আগমনকারী) তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারীদের প্রতিও জানাই সালাত-সালাম। (ثم أما بعد)

ইমাম আবূ আবদিল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসালপ্রাপ্তি: ২৪১ হিজরী/৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দ) কী সুন্দর বলেছেন সেসব লোক সম্পর্কে যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দকে অসম্মান বা হেয় করার অসৎ উদ্দেশ্যে আহাদীস/বাণী ও আখবর/বিবরণসমূহ সংগ্রহ করে থাকে। আবূ বকর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-খাল্লা’ল (বেসাল: ৩১১ হিজরী/৯২৩ খ্রীষ্টাব্দ) প্রণীত ‘কিতাবুস্ সুন্নাহ’ (৩/৫০১) গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত ইমাম (রহ.) বলেন:

(( لو كان هذا في أفناء الناس لأنكرته فكيف في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال أنا لم أكتب هذه الأحاديث. قال المروزي: قلت لأبي عبدالله فمن عرفته يكتب هذه الأحاديث الرديئة ويجمعها أيهجر؟ قال: نعم يستاهل صاحب هذه الأحاديث الرديئة الرجم )) وسنده صحيح. 

অর্থ: “এটা যদি এমন লোকদের সম্পর্কে বলা হতো যাদের বংশ অপরিচিত, তাহলেও আমি এটাকে নিন্দা করতাম; এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের ব্যাপারটি কেমন হবে? আমি তো এসব আহাদীস লিপিবদ্ধই করিনি!” আল-মার্রূযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “আমি আবূ আবদ-আল্লাহ (ইমাম আহমদ হাম্বল)-কে জিজ্ঞেস করলাম, “অতএব, আমি যদি এমন ব্যক্তিকে জানি, যে এসব অপবিত্র/অন্যায় বর্ণনা লিপিবদ্ধ ও সংগ্রহ করেছে, তাহলে কি তাকে নিন্দা জানাতে হবে?” হযরত ইমাম (রহ.) উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, এ ধরনের বর্ণনা লিপিবদ্ধকারী লোকদের পাথর মারতে হবে!” [সহীহ সনদ; আরো জানতে দেখুন – ইবনে বাত্তাহ প্রণীত ‘কিতাবুল ইবা’নাহ’ (২৯৪ পৃষ্ঠা) এবং ইমাম যাহাবী রচিত ‘সিয়্যারুল আলামিন্ নুবালা’, (১০/৯২)]

আপনি বিস্মিত ও তাজ্জব হয়ে যাবেন যখন দেখতে পাবেন একাডেমিক গভীর গবেষণা এবং ইসলামী ইতিহাসকে বিকৃতি ও জাল তথ্যের অনুপ্রবেশ হতে মুক্ত করার অভিপ্রায় পোষণকারীদের মাঝে (অবস্থানকারী) কতিপয় লেখককে, যারা স্পর্ধা প্রদর্শন করেছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আসহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানবৃন্দের কুৎসা রটনার; সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মানহানি ও বিদ্রূপ করার; সাহাবী হওয়ার মর্যাদাকে কেবল মুহাজিরীন ও আনসারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার; আর হুদায়বিয়াহর ঘটনা ও মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণকারী সহস্র সহস্র সাহাবী (রা.)-কে শরীয়ত-নির্দেশিত সংজ্ঞানুসারে সাহাবী হওয়ার মর্যাদা থেকে বাদ দেয়ার। এ উপায়ে তারা (কটাক্ষমূলকভাবে) ইঙ্গিত করেছে যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর প্রশংসায় যেসব দলিল এসেছে সেগুলো এই (পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণকারী) ব্যক্তিবৃন্দ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয় না; এর পাশাপাশি তাঁদের নৈতিক বিশুদ্ধতার প্রতি মানহানিকর কথা তো আছেই! এ যেনো তাঁরা কেবল সাহাবী শব্দটির পারিভাষিক অর্থেই সাহাবী!

এটা একটা নতুন (বিদ’আতী) কথা যা ধর্মের মধ্যে পরিবেশিত হয়েছে এবং যার কোনো পূর্ব-নজির নেই। এটা (১২ ইমামের অনুসারী) রাফেযী শিয়া কর্তৃক সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর প্রতি কাফির/অবিশ্বাসী ও রিদ্দাহ/ধর্মত্যাগী হওয়ার ফতোয়া প্রদানের পর্যায়ে পৌঁছেছে; ব্যতিক্রম শুধু তাঁদের মধ্যে কয়েকজন (যাঁরা রাফেযীদের মতে ঈমানদারি ত্যাগ করেননি); তবুও রাফেযীচক্র তাঁদের সাহাবী হওয়াকে অস্বীকার করে না [নোট: ইবনে তাইমিয়া নিজ ’আস্ সা’রিমুল মাসলূল’ ৩/১১১০ পুস্তকে বলেন – وأما من جاوز ذلك إلى أن زعم أنهم ارتدوا بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم إلا نفرا قليلا لا يبلغون بضعة عشر نفسا أو أنهم فسقوا عامتهم فهذا أيضا لا ريب في كفره فإنه مكذب لما نص القرآن في غير موضع من الرضى عنهم والثناء عليهم بل من يشك في كفر مثل هذا فإن كفره متعين – অর্থ: আর যারা সীমালঙ্ঘন করেছে এ দাবি নিয়ে যে, রাসূলুল্রাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম রিদ্দাহ/ধর্মত্যাগী হয়ে গিয়েছিলেন, ব্যতিক্রম স্রেফ কয়েকজন যাঁদের সংখ্যা বিশ জনের বেশি নয়, অথবা (এ দাবি নিয়েও যে) তাঁরা সামষ্টিকভাবে সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে গিয়েছিলেন – তাহলে এই ধরনের ব্যক্তির কুফরীর ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই; কেননা সে আল-কুর’আনের অসংখ্য স্থানে উল্লেখিত সাহাবা (রা.)-বৃন্দের প্রতি খোদার রেযামন্দি/সন্তুষ্টি ও তাঁদের প্রশংসাসূচক বাণীকে নাকচ করে দিয়েছে। বস্তুতঃ যে ব্যক্তি ওই লোকের কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ রাখবে, তারও কুফরী সাব্যস্ত হবে]। তবে আল্লাহরই প্রতি সমস্ত প্রশংসা (এ কারণে) যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের নেক আমল করার সময় শেষ হয়ে গেলেও আল্লাহর ইচ্ছায় সেগুলোর পুরস্কার বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এর পক্ষে ইমাম ইবনে আসাকির (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে বর্ণিত একটি রওয়ায়াত মূল আরবীগ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। আমরা বাংলা সংস্করণ প্রকাশের সময় তা উদ্ধৃত করবো, ইন-শা-আল্লাহ]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতকে গালিগালাজ করার কথা না বললেই নয়। এর পাশাপাশি বিদ’আতী ও নফসানী খায়েশসম্পন্ন লোকদের এবং তাদের উদ্ভাবিত অনুশীলনের প্রশংসা করাও। তদুপরি, প্রাথমিক প্রজন্মের বইপত্রকে নৃতাত্ত্বিকতার বই হিসেবে বর্ণনা করা এবং ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের বইগুলোর সমালোচনা করা। তাছাড়া, এই বিদ’আত এবং গোমরাহ অনুশীলনগুলোর মধ্য থেকে আরো কিছু দিক উল্লেখ করা হবে না, যেগুলো প্রথমে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি অথচ ধীরে ধীরে বিচ্যুতির দিকে যেগুলো ধাবিত হয়েছে।

এটা সর্বজনবিদিত যে, নাফসানী খায়েশসম্পন্ন ও বিদ’আতী লোকদের আলামত হলো তাদের দ্বারা প্রথম প্রজন্মের মুসলমানবৃন্দের এবং আহলে আছার তথা আইম্মায়ে আহাদীস ও বুযূর্গানে দ্বীনের প্রতি বদনাম করা; এবং এমন বর্ণনা দ্বারা আহলুস সুন্নাহর প্রতি উপাধি নির্ধারণ করা যা থেকে তাঁরা নির্দোষ; একটি বিখ্যাত প্রবাদ ব্যক্ত করে – رمتني بدائها وانسلت – পাতিল কেটলিকে কালো বলে অভিহিত করে! 

আবূ যুর’আহ উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদিল করীম আর্ রাযী (ইন্তিকাল: ২৬৪ হিজরী/৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দ) এবং আবূ হাতিম মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস্ আর্ রাযী (ইন্তিকাল: ২৭৭ হিজরী/৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ) উভয়ই বলেছেন:

وعلامة أهل البدع الوقيعة في أهل الأثر. 

“বিদ’আতী লোকদের চিহ্ন হলো আছার-সম্পন্ন মানুষদের অপমান করা।” [হাদীস; আবূল কা’সিম হিবাত-আল্লাহ ইবনে হাসান আল-লালাকাঈ (ইন্তিকাল: ৪১৮ হিজরী/১০২৭ খ্রীষ্টাব্দ) কৃত শরহে উসূলে ই’তিক্বাদে আহলে সুন্নাহ গ্রন্থ ১/১৭৯]

আবূ হাতিম আর্ রাযী (রহ.) বলেছেন: 

علامة أهل البدع : الوقيعة في أهل الأثر.

وعلامة الزنادقة : تسمية أهل الأثر حشوية، يريدون بذلك إبطال الآثار.

وعلامة القدرية : تسميتهم أهل السنة مجبرة.

وعلامة الجهمية : تسميتهم أهل السنة مشبهة…. 

অর্থ: “বিদ’আতীদের চিহ্ন হলো আছারের মানুষদের অপমান করা; যিনদিক/অন্তর্ঘাতী শত্রুদের নিদর্শন হলো আছার-সম্পন্ন পুণ্যাত্মাবৃন্দকে হাশবিয়্যাহ বলা যা দ্বারা তারা উনাদেরকে ভ্রান্ত প্রতীয়মান করতে পারে; কাদরিয়ার নিদর্শন হলো আছার-সম্পন্ন বুযূর্গবৃন্দকে মুজাব্বিরাহ হিসেবে উল্লেখ করা; এবং জাহমিয়ার নিদর্শন হলো আছার-সম্পন্ন ব্যক্তিবৃন্দকে মুশাব্বিহা বলে উল্লেখ করা। [দেখুন – শরহে সুন্নাহ, প্রণেতা: আল-বারবাহারী, ১০৯ পৃষ্ঠা]

ইমাম আবু উসমান ইসমাইল ইবনে আবদির রহমান আল-সা’বূনী (ইন্তিকাল: ৪৪৯ হিজরী/১০৫৮ খ্রীষ্টাব্দ) বলেন: 

(( قلت: وكل ذلك عصبية ولا يلحق أهل السنة إلا اسم واحد وهو أصحاب الحديث )).

অর্থ: আমি বলি, এসবই পক্ষপাতমূলক, এবং আহলে সুন্নাতের (মানুষেরা) আর কোনো কিছুর হক্বদার নন কেবল একটি নাম ছাড়া, এবং তা আসহাবে হাদীস তথা হাদীসের সাথীবৃন্দ। [আল-সা’বূনী কৃত ‘আকীদাতুস্ সালাফ ওয়া আসহাবুল হাদীস’ ৩০৫ পৃষ্ঠা]

ইমাম লালাকাঈ (রহ.) ‘শরহে উসূলে ই’তিকাদে আহলে সুন্নাহ’ কিতাবে বর্ণনা করেন মায়মূন ইবনে মিহরান (রহ.) হতে, যিনি বলেন:

قال لي ابن عباس يا ميمون لا تشتم السلف وأدخل الجنة بسلام.

অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমায় বলেন, “ওহে মায়মূন, সালাফ তথা প্রাথমিক যুগের মুসলমান পুণ্যাত্মাবৃন্দকে অভিশাপ দেবে না এবং শান্তিপূর্ণভাবে বেহেশতে প্রবেশ করবে।” [সর্ব-ইমাম ইবনে আসা’কির রচিত ‘তা’রীখুদ্ দিমাশক্ব’, ৬১/২৪৯, এবং আল-মিযযী প্রণীত ‘তাহযীবুল কামা’ল’, ২৯/২১৭]

এইসব সন্দেহ ও বানোয়াট কথার খণ্ডন করে অনেক বই লেখা হয়েছে; আর (ইসলামী) জ্ঞানবিশারদবৃন্দ এবং (ইসলামী) জ্ঞানের তালেব/ছাত্রবর্গ এইসব বানোয়াট কথা ও মিথ্যে অপপ্রচারের (মুখোশ) উন্মোচনের লক্ষ্যে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তাঁদের প্রতিদান দিন (আমীন)।

এই বইটি হবে – আল্লাহর ইচ্ছায় – হযরত মু’য়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে উল্লেখিত বিভ্রান্তি এবং বানোয়াট কথার প্রত্যুত্তর, যেহেতু হাজার হাজার পৃষ্ঠা (কালি দ্বারা) কালো করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানিকর মন্তব্য ও অপ্রমাণিত সমালোচনা-সহ, যেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

(১) আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মসজিদের মিম্বরে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে অভিসম্পাত দেয়ার কুপ্রথা চালু করেন;

(২) তিনি মদ ও মাদকের ব্যবসা করতেন;

(৩) তিনি সুদভিত্তিক লেনদেন করতেন;

(৪) তিনি ভারতীয়দের কাছে মূর্তি বিক্রি করতেন;

(৫) তিনি সিফফীন যুদ্ধের দিন ২৫ জন বদরী সাহাবা (রা.)-কে হত্যা করেছিলেন;

(৬) মু’য়াবিয়া (রা.) সর্বপ্রথম প্রিয়নবী (দ.)-এর সুন্নাহের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করেছিলেন;

(৭) তিনি হযরত আম্মার (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডে সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, আর তাঁর মরদেহ পুড়িয়েছিলেনও;

(৮) প্রিয়নবী (দ.) কর্তৃক মু’য়াবিয়া (রা.) অভিশপ্ত ছিলেন তা প্রমাণে সহীহ সনদে হাদীস প্রদর্শনের চেষ্টা;

(৯) বদর জ্বিহাদে অংশগ্রহণকারী উবাদাহ বিন সামীত (রা.)-এর মতো জ্যেষ্ঠদের অভিযোগ – তিনি মন্দ নেতাদের মধ্য হতে (আগত);

(১০) আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) কর্তৃক মু’য়াবিয়া (রা.)-এর ঈমানদারীর ব্যাপারে সন্দেহের অভিযোগ;

(১১) আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) কর্তৃক মু’য়াবিয়া (রা.)-এর প্রতি মুনাফিক্ব হওয়ার অভিযোগ, যিনি তাবূক অভিযানশেষে প্রিয়নবী (দ.)-এর গুপ্তহত্যার পরিকল্পনাকারী ছিলেন;

(১২) মু’য়াবিয়া (রা.) খলীফা উমর (রা.)-কে শা‘ম দেশ ভ্রমণকালে হত্যার পরিকল্পনা করেন;

(১৩) মু’য়াবিয়া (রা.) আশতার আন্ নাখাঈ, আবদুর রহমান ইবনে খালিদ বিন ওয়ালীদ ও অন্যান্যদের হত্যা পরিকল্পনা করেন;

(১৪) তিনি জালিম শাসকদের নেতা ছিলেন;

(১৫) মুহা’জিরূন, আনসার ও তাবেঈনদের অনেকেই তাঁর নিন্দা ও সমালোচনা করেন মর্মে প্রমাণের চেষ্টা;

(১৬) তিনি ও তাঁর পিতা (আবূ সুফিয়ান) মিথ্যে আনুগত্যের শপথ নিতেন; এবং

(১৭) প্রিয়নবী (দ.)-এর অনেক সুন্নাতকে তিনি বিলুপ্ত করেছিলেন।

মিথ্যেবাদী কুৎসা রটনাকারীদের বানোয়াট এ ধরনের নানা অপবাদ (হাসান ইবনে ফারহান মালিকী লিখিত আস্ সুহবাতুস্ সাহাবাহ বইটি দেখুন), এবং আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিন্দাকারী লোকদের দ্বারা সংঘটিত অন্যান্য বিকৃতি, যা দ্বারা অনির্ভরযোগ্য এবং বানোয়াট বর্ণনাসমূহ প্রমাণীকরণের হলিখেলায় তারা মেতেছে, আর এর পাশাপাশি তাঁর ফযীলত বর্ণনাকারী সহীহ হাদীসগুলোকে তারা অনির্ভরযোগ্য ঘোষণা করেছে। 

এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেলো ইমাম আবূ তৌবাহ আল-হালাবী আর্ রাবী ইবনে নাফেঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর বক্তব্য; তিনি বলেন:

معاوية بن أبي سفيان ستر أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم فإذا كشف الرجل الستر اجترأ على ما وراءه.

অর্থ: হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হলেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবাবৃন্দের (পর্দার) আবরণ; অতঃপর যে ব্যক্তি এই আবরণ ওঠাবে সে এটার আড়ালে থাকা লক্ষবস্তু (আক্রমণের) দুঃসাহস দেখাবে। [খতীব বাগদাদী কৃত ‘তারীখ’, ১/২০৯; এবং ইবনে আসাকির রচিত ‘তারীখু দিমাশক্ব’, ৫৯/২০৯; আরো দেখুন – ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ,’ ১১/৪৫০]

আরো (রয়েছে) ওয়াকীঈ ইবনে জার্রাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর বক্তব্য:

معاوية رضي الله عنه بمنزلة حلقة الباب، من حركة اتهمناه على من فوقه. 

অর্থ: হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হচ্ছেন দরজা (নাড়ার) কড়ার মতো; যে ব্যক্তি তা নাড়ে আমরা তাকে দোষারোপ করি তাঁরও (মানে ওই সাহাবীরও) ওপরে যাঁরা আছেন (মানে আসহাবমণ্ডলী) তাঁদের ব্যাপারে (বৈরী মনোভাব পোষণের অভিযোগে)। [ইমাম ইবনে আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, ৫৯/২১০]

অনুরূপভাবে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন:

معاوية عندنا محنة، فمن رأيناه ينظر إليه شزرا اتهمناه على القوم، أعني على أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم.   

অর্থ: হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের জন্য এক (অগ্নি)-পরীক্ষা; যে ব্যক্তি তাঁকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছে, আমরা তাকে মুসলিম জাতির প্রতি বৈরীভাবাপন্ন বলে অভিযুক্ত করেছি; আমি বোঝাতে চাচ্ছি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আসহাব (রাদ্বিযাল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর প্রতি শত্রু হিসেবে অভিযুক্ত করেছি। [ইমাম ইবনু আসা’কির (রহ.), তারীখু দিমাশক্ব, ৫৯/২১১]

وصدق الإمام البربهاري رحمه الله حين قال في شرح السنة (106): إذا رأيت الرجل يطعن على أحد من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فأعلم أنه صاحب قول سوء وهوى.

অর্থ: ইমাম বারবাহারী (রহ.) সত্য কথাটি বলেছেন যখন তিনি নিজ ‘শরহুস্ সুন্নাহ’ (১০৬) গ্রন্থে বলেন: “আপনি যদি কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একজন সাহাবী (রা.)-কে অপবাদ দিতে দেখতে পান, তাহলে জেনে রাখুন, সে মন্দ ভাষী (মানে গালিগালাজকারী) ও অহমিকা/আত্মম্ভরিতাসম্পন্ন ব্যক্তি (যে মনগড়া কথা বলে)।”

এর চেয়েও বড় মারাত্মক ও বিরক্তিকর হলো সর্ব-হযরত আবূ বকর, ‘উমর, আনাস বিন মালিক, সামুরাহ বিন জুনদুব, ‘আমর ইবনুল আস্ ও আবূ হুরাইরাহ-সহ অন্যান্য সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দকে অপবাদ দেয়া বা তাঁদের কুৎসা রটনা করা।

এই তে-পায়া কুলুঙ্গির তৃতীয় অংশ হলো আহলে সুন্নাতের উলামাদের সমালোচনা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইবনে কাসীর, আয-যাহাবী প্রমুখসহ তাঁদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী (প্রজন্মসমূহের) আলেম-উলামা।

আমি (আল-সুবাঈ) আন্তরিকভাবে কামনা করেছিলাম, যে ব্যক্তি এই ধরনের নৈতিক ত্রুটি সম্পর্কে লেখে, সে যেনো তার নিজের ত্রুটিগুলো দিয়ে শুরু করে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের প্রতি শত্রুতা পোষণ করা থেকে তার অন্তরকে রক্ষা করে এবং তার জিহ্বাকেও তাঁদের সম্পর্কে কটূক্তি করা থেকে রক্ষা করে।

وَٱلَّذِينَ جَآءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلإِيمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاًّ لِّلَّذِينَ آمَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ.

অর্থ: এবং ওই সব লোক, যারা তাদের পরে এসেছে তারা আরয করে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরকেও, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না! হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনিই অতি দয়ার্দ্র, দয়াময়। [আল-ক্বুর’আন, ৫৯/১০]

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহ) বলেন:

 ومن انتقص أحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم أو أبغضه لحدث كان، أو ذكر مساوية كان مبتدعا حتى يترحم عليهم جميعاً ويكون قلبه لهم سليما. 

অর্থ: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সাহাবী (রা.)-কে হেয় প্রতিপন্ন করে, বা ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার কারণে তাঁদের প্রতি কোনো খারাপ অনুভূতি লালন করে বা তাঁদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উল্লেখ করে, তাহলে সে ব্যক্তি দ্বীনের মধ্যে বিদআত সংঘটনকারী এবং সে এইভাবেই থাকবে যতোক্ষণ না তাঁদের সকলের প্রতি সুধারণা সে পোষণ করে এবং তাঁদের সকলের প্রতি শুদ্ধ/পরিষ্কার অন্তর বজায় রাখে। [দেখুন – মানা’ক্বিবে ইমামে আহমদ (২১০ পৃষ্ঠা); প্রণেতা: আবূল ফারাজ আবদুর রহমান ইবনে আবী হাসান ইবন জাওযী (ইন্তিকাল: ৫৯৭ হিজরী/১২০১ খ্রীষ্টাব্দ); আল-কিফায়াহ ফী ইলমির্ রিওয়া’ইয়াহ (৫১ পৃষ্ঠা); প্রণেতা: আল-খতীব আল-বাগদাদী আবূ বকর আহমদ ইবনে আলী (ইন্তিকাল: ৪৬৩ হিজরী/১০৭১ খ্রীষ্টাব্দ)]

ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘আল-ওয়া’সিতীয়াহ’ গ্রন্থে বলেন:

ومن أصول أهل السنة والجماعة سلامة قلوبهم وألسنتهم لأصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم كما وصفهم الله في قوله تعالى: ((وَٱلَّذِينَ جَآءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلإِيمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاًّ لِّلَّذِينَ آمَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ))، وطاعة النبي صلى الله عليه وسلم في قوله: ((لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ)). 

অর্থ: আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি হলো এই যে, তাঁদের অন্তর ও জিহ্বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-মণ্ডলীর বিরুদ্ধে কোনো কিছু থেকে (একদম) মুক্ত, যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁদের সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন: “এবং ওই সব লোক, যারা তাদের পরে এসেছে তারা আরয করে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরকেও, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না! হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনিই অতি দয়ার্দ্র, দয়াময়” [আল-ক্বুর’আন, ৫৯/১০]। আর নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি আনুগত্য (যেমনটি তিনি স্বয়ং) ঘোষণা করেছেন হাদীস শরীফে – “তোমরা আমার সাহাবীদের গালমন্দ কোরো না। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউ যদি উহূদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও দান-খয়রাত করে তবু তা তাদের (মানে সাহাবাদের) কারো এক মুদ্দ বা অর্ধ মুদ্দ দান-খয়রাত করার সমান মর্যাদাসম্পন্নও হবে না” [সুনান ইবনু মাজাহ, ১৬১]   

এ বইটিতে বেশ কিছু বিষয় আলোচিত হবে:

১/ – হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সমালোচনায় উদ্ধৃত সেসব বর্ণনা সম্পর্কে জবাব দেওয়ার জন্য বইয়ের একটি অধ্যায় নিবেদিত।

২/ – একটি অধ্যায় নিবেদিত হয়েছে সেসব হাদীসের ব্যাপারে যেগুলোকে (বিরোধীদের দ্বারা) ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা করা হয়েছে অথচ যেগুলোতে হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর গুণ ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে।

৩/ – হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার জন্য নিবেদিত একটি অধ্যায়।

৪/ – হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর গুণাবলী ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নিবেদিত একটি অধ্যায়।

৫/ – প্রাথমিক যুগের মুসলমান প্রজন্মগুলোর কৃত হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রশংসার প্রতি উৎসর্গিত একটি অধ্যায়।

৬/ – হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে যারা অভিশাপ/অভিসম্পাত দেয় তাদের সম্পর্কে প্রাথমিক যুগের মুসলমান প্রজন্মগুলোর মতামত পেশের জন্য নিবেদিত একটি অধ্যায়।

৭/ – সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মধ্যে যা ঘটেছিলো সে বিষয়ে নীরব থাকার ক্ষেত্রে মুসলমানদের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাতের ঐকমত্যের প্রতি নিবেদিত একটি অধ্যায়।

হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্নচক্র তাঁর প্রশংসাপূর্ণ গ্রন্থগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সমস্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে; আর এই গ্রন্থগুলোকে বিকৃত করে বা প্রত্যাখ্যান করে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে, কিন্তু তারা কীভাবে এর দায় এড়াতে পারবে বলে মনে করে? ইবনে তাইমিয়া তাঁর ‘ফাতাওয়া’ [সংকলন – ২০/১৬১] গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:

فلا تجد قط مبتدعاً إلا وهو يحب كتمان النصوص التي تخالفه ويبغضها ويبغض إظهارها وروايتها والتحدث بها ويبغض من يفعل ذلك.

অর্থ: আপনি কখনোই এমন কোনো বিদ’আতীকে খুঁজে পাবেন না, যে তার মতের বিরোধিতাকারী গ্রন্থগুলোকে ধামাচাপা দিতে পছন্দ করে না। সে এই গ্রন্থগুলোকে ঘৃণা করে, ঠিক যেমনটি সেগুলোকে প্রকাশ্যে আনতে অথবা বর্ণনা করতে কিংবা সেগুলো সম্পর্কে কথা বলতে সে ঘৃণা করে, আর ঠিক যেমনটি সে ঘৃণা করে তাঁদেরকে যাঁরা এই বইপত্রের উদ্ধৃতি দেন। [‘ফাতাওয়া,’ ২০/১৬১]

আল্লাহর সন্তুষ্টির ওয়াস্তে এবং এরপর ইতিহাসের খাতিরে বলছি, হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে এসব বানোয়াট কাহিনি ও অপপ্রচারের কোনো ভিত্তি নেই। যদি এই বানোয়াট কাহিনিগুলো কিছু পৃষ্ঠাকে কালো করার ঘটনা না ঘটতো এবং এই ধরনের বক্তব্যের লেখকবর্গ ইঙ্গিত না করতো যে এগুলো অনুসন্ধানমূলক একাডেমিক গবেষণা ও ইসলামী ইতিহাসের মুক্তির সোপান, তাহলে এই বানোয়াট কাহিনিগুলোর গভীরে ডুব দেওয়ার পরিবর্তে উপেক্ষা করাই শ্রেয় হতো। কেননা প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের মতামতকে নির্মূল করার জন্য এবং যারা এগুলো উচ্চারণ করে তাদের কণ্ঠস্বরকে ক্ষীণ করার জন্য আরো ভালো হতো এ ভিত্তিহীন মতামতগুলোকে স্রেফ উপেক্ষা করা; কেননা এগুলোর উল্লেখ গণ্ডমূর্খদেরকে এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে।

আমি এই বইটির শিরোনাম দিয়েছি – سل السنان في الذب عن معاوية بن أبي سفيان رضي الله عنه – হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র পক্ষে জবাব। 

أسأل الله أن ينفع به؛ ويجعله خالصا لوجهه الكريم؛ سبحان ربك رب العزة عما يصفون؛ وسلام على المرسلين؛ والحمد لله رب العالمين؛ وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.

অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেনো তিনি এ বইটিকে উপকারী করেন; আর এটা শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই করা হয়েছে; পবিত্রতা আপনার রবের/প্রভুর – যিনি সর্বশক্তিমান, মহাসম্মানিত – তাঁরা [তাঁকে] যেমনভাবে বর্ণনা করেন; আর সমস্ত রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের প্রতি বর্ষিত হোক (অনন্ত) শান্তি; সমস্ত প্রশংসা সমস্ত বিশ্বজগতের রব [একমাত্র] আল্লাহরই জন্য; আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সমস্ত পরিবারসদস্য এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করুন (আমীন)।

লেখক – সা’আদ ইবনে দ্বায়দা’ন আস্ সুবাঈ

১২/০৭/১৪২৭ হিজরী সাল।

প্রথম অধ্যায়

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর সমালোচনায় উদ্ধৃত আহাদীসের বিশ্লেষণ

আমীরে মু’আবিয়া (রা:)-এর সমালোচনায় উদ্ধৃত অনির্ভরযোগ্য ও বানোয়াট বর্ণনাসমূহ

প্রথম বর্ণনা

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন:

إذا رأيتم معاوية على منبري فاقتلوه.

অর্থ: “যখন তোমরা মু’য়াবিয়াকে আমার মিম্বরের ওপরে (উপবিষ্ট) দেখবে, তখন তাকে হত্যা কোরো!”

১/ – এটা বর্ণনা করেছেন ইবনে ‘আদী নিজ ‘আল-কামিল’ গ্রন্থে (২/১৪৬), ৫/২০০, ৫/৩১৪; এর পাশাপাশি ইবনুল জাওযী আপন ‘আল-মওদূ’আত’ পুস্তকে (২/২৬৫), যা’তে যুক্ত রয়েছে নিম্নের কথা – فارجموه – অর্থাৎ ‘তাকে পাথর নিক্ষেপ কোরো।’ এই হাদীস আরো বর্ণনা করেছেন ইবনে আসাকির তাঁর ‘তারীখু দিমাশক্ব’ কিতাবে (৫৯/১৫৫); এঁদের সবাই বর্ণনা করেছেন মুজালিদ ইবনে সাঈদ হতে, তিনি আবূল ওয়াদাক হতে, তিনি আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। [নোট: (ক) আল-কামিল ফী দু’য়াফা আর্ রিজাল গ্রন্থটির প্রণেতা আবূ আহমদ আবদুল্লাহ ইবনে আদী (ইন্তিকাল: ৩৬৫ হিজরী/৯৭৬ খ্রীষ্টাব্দ); এটা হাদীসের দুর্বল বর্ণনাকারী হিসেবে বিবেচিত রাবীদের জীবন-বৃত্তান্তের একটি সংকলন তাঁর; তিনি এই জীবনীমূলক গ্রন্থে ওই রাবীর কিছু সংখ্যক বর্ণনাকেও চিহ্নিত করেন, যার দরুন ওই বর্ণনায় ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। (খ) আবূল ফারাজ ইবনুল জাওযী রচিত ‘আল-মওদূ’য়াত মিনাল-আহাদীস্-ইল-মারফূ’আত পুস্তক; এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি আরোপিত বানোয়াট/জাল হাদীসের একটা সংকলন। (গ) আবূল ক্বাসিম আলী ইবনে আল-হাসান ইবনে আসাকির (ইন্তিকাল: ৫৭১ হিজরী/১১৭৫ খ্রীষ্টাব্দ); (ঘ) তারীখু দিমাশক্ব গ্রন্থটি দামেশক নগরীর ইতিহাসভিত্তিক একটি বিশ্বকোষ, যা ৭০ খণ্ডে প্রকাশিত; এটা ছিলো ওই সময়কার দামেশক্বে ভ্রমণকারী ও সেখানে বসবাসকারী প্রত্যেকটি ব্যক্তির জীবনী; শুধু হাদীসবেত্তা নন, বরং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও জীবনী; ইবনে আসাকির এঁদের সম্পর্কে লোকমুখে প্রচলিত নির্ভরযোগ্য-অনির্ভরযোগ্য নির্বিশেষে সমস্ত বিবরণই সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন; তাঁর লক্ষ্য ছিলো লিপিবদ্ধ সমস্ত বক্তব্যের জন্য একটি ইসনাদ/সনদ পেশ করা]

২/ – ইবনে আদী নিজ আল-কামিল শীর্ষক গ্রন্থের অন্যত্র এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন (৭/৮৩); আরো বর্ণনা করেছেন আল-বালাযুরী তাঁর ‘আনসাবুল আশরাফ’ পুস্তকে (৫/১৩৬); ইবনুল জাওযী আপন আল-মওদূআত কিতাবে (২/২৫৬); এবং ইবনে আসাকির নিজ তারীখ-এ-দিমাশক্ব কিতাবে (৫৯/৫৫); এঁদের সবাই এটা বর্ণনা করেছেন আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদা’ন হতে, তিনি হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। [নোট: (ক) আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-বালাযুরী (ইন্তিক্বাল: ২৭৯ হিজরী/৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দ); (খ) বালাযুরীর বইটি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অতি উচ্চ খান্দান/পরিবারসদস্যবৃন্দের জীবনীমূলক সংকলন]

৩/ – এটা ইবনে আদী বর্ণনা করেছেন নিজ ‘আল-কামিল’ পুস্তকে (২/২০৯); ইবনে হিব্বান তাঁর আল-মাজরূহীন গ্রন্থে (১/৩৫); ইবনুল জাওযী আপন ‘আল-মওদূ’আত’ কিতাবে (২/২৬৫); এঁদের সবাই বর্ণনা করেছেন আব্বাদ ইবনে ইয়াকূব আল-রাওয়াজিনী হতে, তিনি আল-হাকাম ইবনে যাহির হতে, তিনি আসিম হতে, তিনি যির্র হতে, তিনি ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ) হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে। [নোট: (ক) আবূ হাতিম মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান আল-বুস্তী (ইন্তিক্বাল: ৩৫৪ হিজরী/৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দ); (খ) কিতাবুল মাজরূহীন মিনাল-মুহাদ্দিসীন ওয়াদ-দু’আফা ওয়াল-মাতরূকীন শীর্ষক কিতাবটি ইবনে হিব্বানের একটি সংকলন, যা’তে তিনি হাদীসের দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের জীবনবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন; তাঁর ‘আল-সিক্বাত’ শিরোনামের একটি বইও আছে, যা’তে নির্ভরযোগ্য বলে তাঁরই বিবেচিত বর্ণনাকারীদের নাম তিনি সংগ্রহ করেছেন। তবে অনেক হাদীসবিদ তাঁর ‘সিক্বাত’ গ্রন্থে কোনো বর্ণনাকারীর প্রতি তাঁরই ‘সিক্বা’ হিসেবে অনুসমর্থনকে বিবেচনা করেন না, কেননা (তাঁদের মতে) এ বইতে তাঁর মানদণ্ড উদার ছিলো; (গ) শেষোক্ত ইসনাদের জন্য দেখুন ‘আনসাব আল-আশরাফ’ গ্রন্থ (৫/১৩৮)]

৪/ – ইবনে আদী নিজ ‘আল-কামিল’ (৭/১১২) গ্রন্থে বর্ণনা করেন এ কথা – আলী ইবনে সাঈদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আল-হুসাইন ইবনে ঈসা আর্ রাযী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, সালামাহ ইবনে আল-ফযল আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আত্ তায়মী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবূ উমামাহ ইবনে সাহল ইবনে হুনাইফ হতে, তিনি তাঁর পিতা (সাহল ইবনে হুনাইফ) হতে, তিনি রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে, যিনি ঘোষণা করেন:

إذا رأيتم فلاناً على المنبر فاقتلوه.

অর্থ: “যখন তোমরা অমুককে আমার মিম্বরে (উপবিষ্ট) দেখবে, তখন তাকে হত্যা কোরো!”               

৫/ – ইবনে আদী তাঁর ‘আল-কামিল’ (৭/১১২) গ্রন্থে আরো বর্ণনা করেন আহমদ ইবনে হুসাইন আল-সাদফীর সূত্রে (তরীকে), তিনি সুফিয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-ফাযারী হতে, তিনি মানসূর ইবনে সালামাহ হতে, তিনি সুলাইমান ইবনে বিলাল হতে, তিনি জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি মারফূ’ হাদীস হিসেবে রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে, যিনি ফরমান:

إذا رأيتم على منبري فاقتلوه يعني فلان…

অর্থ: “যখন তোমরা আমার মিম্বরে দেখতে পাবে, তখন তাকে হত্যা কোরো” – তিনি অমুককে বুঝিয়েছিলেন। [দেখুন – ইমাম যাহাবী কৃত ‘মিযানুল এ’তেদাল’, ২/১৭২]

৬/ – ইবনে আদী প্রণীত ‘আল-কামিল’ (৩/৪১৯) পুস্তকে তিনি বলেন: “ইবনে সাঈদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, যিনি বলেন, আবূ শায়বাহ ইবনে আবী বকর ইবনে আবী শায়বাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন খালিদ ইবনে মাখলাদ হতে, তিনি সুলাইমান ইবনে বিলাল হতে, তিনি জা’ফর হতে, তিনি বদর জিহাদে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের একটি দল হতে, তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে।”

৭/ – এটা আরো বর্ণিত হয়েছে ইবনে আদী রচিত ‘আল-কামিল’ (৫/১০১) গ্রন্থে, আবূ জা’ফর মুহাম্মদ ইবনে ’আমর আল-উক্বাইলী (ইন্তিকাল: ৩২২ হিজরী/৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দ) প্রণীত ‘আল-দু’আফা’ (৩/৯৯৭; দুর্বল বর্ণনাকারীদের জীবন-বৃত্তান্তমূলক) পুস্তকে, আল-খতীব লিখিত ‘তারীখ’ (১২/১৮১) কিতাবে, ইবনে জাওযী কৃত ‘আল-মওদূ’আত’ (২/২৬৬) বইয়ে, ইবনে আসাকির রচিত ‘তারীখ দিমাশক্ব’ (৫৯/১৫৭) গ্রন্থে; এগুলোর সবই সুলাইমান ইবনে হারবের বর্ণনাসূত্রে, তিনি হাম্মাদ ইবনে যায়দ হতে, যিনি বলেন, আইয়ূবকে বলা হয় – ‘আমর ইবনে উবায়দ বর্ণনা করেছেন ইমাম হাসান (রা.) হতে এ মর্মে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন – إذا رأيتم معاوية على منبري فاقتلوه –  “যখন তোমরা মু’য়াবিয়াকে আমার মিম্বরের ওপরে (উপবিষ্ট) দেখবে, তখন তাকে হত্যা কোরো!” অতঃপর আইয়ূব এর উত্তরে বলেন – كذب عمرو – “আমর মিথ্যে বলেছে!” [আরো দেখুন – ‘আনসাবুল আশরাফ’ (৫/১৩৬)]

প্রথম ইসনাদ 

এই বর্ণনার ইসনাদে রয়েছে মুজালিদ ইবনে সাঈদ আল-হামাদানী আল-কুফী।

(ক) ইমাম বুখারী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – كان يحيى القطان يضعفه وكان ابن مهدي لا يروي عنه – “ইয়াহইয়া আল-ক্বাত্তান তাকে দুর্বল (বর্ণনাকারী হিসেবে) পেয়েছেন এবং ইবনে মাহদী তার থেকে বর্ণনা করতেন না।”

(খ) আল-জূযাজানী বলেন – يضعف حديثه – “তার (বর্ণিত) হাদীসগুলো দুর্বল।” [আহওয়ালুর্ রিজাল (জীবনী নং ১২৬)]

(গ) ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন – ليس بشئ – “(একেবারে) মূল্যহীন!” [আরবী এ কথাটি সাধারণত অতি দুর্বল বর্ণনাকারীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ইবনে মাঈন কখনো কখনো হাদীসশাস্ত্রে স্বল্পজ্ঞানী বর্ণনাকারীর প্রতি এটা আরোপ করতেন]

(ঘ) হযরত ইমাম আহমদ (রহ.) আরো বলেন – كذا وكذا، وحرك يده ولكنه يزيد في الإسناد – “অমুক-অমুক, অতঃপর তার হাত সরায়; কিন্তু সে ইসনাদ বৃদ্ধি করে থাকে।” 

(ঙ) হযরত ইমাম আহমদ (রহ.) আরো বলেন – مجالد عن الشعبي وغيره ضعيف كم من أعجوبة لمجالد – “মুজালিদ (বর্ণনা করেছে) আল-শা’বী ও অন্যান্যদের কাছ থেকে; দুর্বল (বর্ণনা); কতোগুলো আজব বর্ণনা মুজালিদ হতে (এসেছে)!” 

(চ) ইয়াহইয়া তার সম্পর্কে বলেন – كان ضعيفا وقال لا أحتج بحديث – “সে দুর্বল (বর্ণনাকারী)।” তিনি আরো বলেন – “আমি তার (বর্ণিত) হাদীস গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করি না।” [লা আহতাজ্জু বিহী – শেষের এই কথাটি এমন বর্ণনাকারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যাদের দুর্বল স্মৃতিশক্তি ও নিখুঁত না হওয়ার কারণে প্রচুর ভুল হয়]  

(ছ) ইমাম নাসাঈ (রহ.) বলেন – كوفي ضعيف – “(এক) কুফাবাসী, দুর্বল (বর্ণনাকারী)।” [আদ্ দূ’আফা ওয়াল-মাতরূকীন, ৫৫২ নং জীবনী]

(জ) ইবনে আদী বলেন – وعامة ما يرويه غير محفوظ – “সে যা বর্ণনা করেছে তার অধিকাংশই অসমর্থিত।” [আল-কামিল, ৬/৪২৩; আত্ তাহযীব, ৪/২৪]

দ্বিতীয় ইসনাদ

এই ইসনাদে রয়েছে (বর্ণনাকারী) ‘আলী ইবনে যায়দ জুদ’আন।

(ক) ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ليس بشئ – “(একেবারে) মূল্যহীন!”

(খ) ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ليس بذاك القوي – “তেমন শক্তিশালী নয়” [তারীখে ইবনে মাঈন, ইমাম দারিমী (রহ.)-এর বর্ণনা (১৪১)]; অপর বর্ণনায় তিনি বলেন – ليس بذاك – “মোটেও নয় (নির্ভরযোগ্য);” আল-দূরী হতে আরেকটি বর্ণনায় তিনি বলেন – ليس بحجة – “প্রামাণিক (উৎস) নয়।” [তারীখে ইবনে মাঈন, আল-দূরী (রহ.)-এর বর্ণনা নং ৩৪১]

(গ) আল-জূযাজা’নী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – واهي الحديث ضعيف لا يحتج به – “তার বর্ণনায় সে অমনোযোগী, দুর্বল; নির্ভর করা যাবে না।” [আহওয়ালুর রিজা’ল, (জীবনী নং ১৮৫)]

(ঘ) আবূ হা’তিম (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ليس بالقوي؛ يكتب حديثه؛ ولا يحتج به؛ وكان يتشيع – “(কোনো মানদণ্ডেই) শক্তিশালী নয়; তার বর্ণনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হবে (বটে), তবে কোনো প্রামাণিক উত্স হিসেবে বিবেচিত হবে না; আর সে শিয়া মতবাদের পক্ষে ছিলো।” [আজ্-জারহু ওয়াত্-তা’দীল, ৬/১৮৬]    

(ঙ) ইবনে খুযায়মাহ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – لا أحتج به لسوء حفظه – “তার দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে আমি তাকে নির্ভরযোগ্য মনে করি না।”

(চ) ইবনু সা’আদ তার সম্পর্কে বলেন – كان كثير الحديث؛ وفيه ضعف؛ ولا يحتج به – “(বর্ণিত) হাদীসের সংখ্যা প্রচুর; তবে তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে; তাকে কোনো প্রামাণিক উত্স হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়।” [আত্-তাবাক্বাত, ৭/২৫২]

(ছ) আবূ যুরাহ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ليس بالقوي – “(কোনো মানদণ্ডেই) শক্তিশালী নয়।” 

(জ) ইমাম তিরমিযী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – صَدُوقٌ إِلاَّ أَنَّهُ رُبَّمَا يَرْفَعُ الشَّىْءَ الَّذِي يُوقِفُهُ غَيْرُهُ – “সত্যবাদী, তবে সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত হাদীসের ইসনাদ উন্নীত করে, যা অন্যান্য হাদীসবেত্তা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) পর্যন্ত গিয়ে সম্পন্ন করেন।” [তিরমিযী, ২৬৭৮]

(ঝ) ইমাম দা’রু কুতনী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – لا يزال عندي فيه لين –  “আমার মূল্যায়নে তার মধ্যে রয়েছে দুর্বলতা।” [আল-মুগনী ফীদ্-দু’আফা, (জীবনী নং ৪২৬৫)]

(ঞ) ইবনে আদী (রহ.) নিজ ‘আল-কামিল’ পুস্তকে বলেন – كان يغلي في التشييع ومع ضعفه يكتب حديثه – “সে শিয়া মতবাদের পক্ষে চরমপন্থী ছিলো; তবে দুর্বলতা সত্ত্বেও তার বর্ণিত হাদীস লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে।” [আল-কামিল, ৫/২০১]

(ট) হাম্মাদ ইবনে যায়দ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – يقلب الأحاديث – “সে হাদীসসমূহে পরিবর্তন সাধন করেছে।” [আদ্-দু’আফা, ৩/৯৫৮]

(ঠ) ইমাম নাসাঈ (রহ.) ও ইবনে উবায়নাহ (রহ.) তাকে দুর্বল ঘোষণা করেছেন। [আত্-তাহযীব,৩/১২৬]

(ড) ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – كان يخطئ وكثر ذلك فاستحق الترك – “সে ভুল করেছে; এটা প্রায়শই ঘটেছিলো, যার ফলস্বরূপ সে পরিত্যক্ত হওয়ার যোগ্য।” [আল-মাজরূহীন, ২/৭৮]

(ঢ) আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদ’আনের বর্ণিত হাদীস অন্যান্য বর্ণনাকারীর হাদীসকে সমর্থন দিয়েছে (নোট: মানে সে অন্যান্যদের সাথে যৌথভাবে এ হাদীস বর্ণনা করেছে, এককভাবে নয়); আবদুল মালিক ইবনে আবী নাদরাহ এটা যৌথভাবে আপন পিতা হতে বর্ণনা করেছেন ওই ইসনাদ-সহ, যা ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.)-এর ‘আল-মাজরূহীন (১/১৭৩) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে এই প্রতিপাদন/সমর্থন অকার্যকর, এর কারণ হলো ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) এই ইসনাদে যে বর্ণনাকারী থেকে বর্ণনা করেছেন, সেই আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে বিশর ইবনে ফাদালাহ তথা ফক্বীহ/ফেক্বাহবিদ আবূ বশর। ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন:

كان مما يضع المتون للآثار ويقلب الأسانيد للأخبار حتى غلب عليه أجبار الثقات، وروايته عن الأثبات بالطامات على مستقيم حديث فاستحق الترك.

অর্থ: “সে তাদের মধ্য থেকে ছিলো যারা হাদীসের বর্ণনার পাঠ জাল/বানোয়াট করতো, এবং সে বর্ণনার ইসনাদ-গুলোকে প্রতিস্থাপন করতো, যেনো মনে হয় সেগুলো নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে এসেছে; এবং সে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে আপত্তিকর (জাল) বর্ণনাসমূহ এনেছে, যার ফলস্বরূপ সে পরিত্যক্ত হওয়ার যোগ্য।” ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) নিজ ‘আল-মাজরূহীন’ (১/১৭১) গ্রন্থে তার (মানে ফক্বীহ আবূ বশরের) বর্ণিত কিছু সংখ্যক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে আলোচ্য এই হাদীসটিও অন্তর্ভুক্ত; অতঃপর হযরত ইমাম (রহ.) বলেছেন – 

وهذه الأحاديث التي ذكرناها أكثرها مقلوبة ومعمولة عملت يداه.

অর্থ: “এসব বর্ণনা যা আমরা উল্লেখ করেছি, এগুলোর অধিকাংশেরই ইসনাদ (মানে বর্ণনাকারীদের পরম্পরা) পরিবর্তন করা হয়েছে, আর এগুলো তারই হাতের কারসাজি বলে জ্ঞাত।” [ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) প্রণীত আল-মাজরূহীন, ১/১৭১]

তৃতীয় ইসনাদ

এই ইসনাদে রয়েছে (বর্ণনাকারী) আল-হাকাম ইবনে যাহীর আল-ফাযা’রী আল-কুফী।

(ক) ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) ‘আল-মাজরূহীন’ গ্রন্থে তার সম্পর্কে বলেন – (( روى عنه الكوفيون، كان يشتم أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم يروي الثقات الأشياء الموضوعات وهو الذي يروي عن عاصم عن زر…..)) فذكر الحديث – কুফাবাসী তার থেকে বর্ণনা করতো। সে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে মন্দ উক্তি করতো এবং সিক্বা তথা বিশ্বস্ত রাবী/বর্ণনাকারীদের নামে জাল/বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করতো; আর সে-ই বর্ণনা করেছে আসিম হতে, তিনি যির্র হতে…।” অতঃপর ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) হাদীসটি উল্লেখ করেন। [আল-মাজরূহীন, ১/৩০৪]

(খ) ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ليس بشئ – “(একেবারে) মূল্যহীন!” তিনি অন্যত্র বলেন – كذاب – “ডাহা মিথ্যুক!”

(গ) ইমাম আল-নাসাঈ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – متروك الحديث كوفي – “তার বর্ণিত হাদীসগুলো পরিত্যক্ত, জনৈক কুফাবাসী।” [আদ্ দু’আফা’ ওয়াল-মাতরূকীন, (জীবনী নং ১২৭)]

(ঘ) ইমাম বুখারী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – منكر الحديث – “তার বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যাত।” [আত্ তারীখুল্ কবীর, ২/৩৪৫]

(ঙ) আল-জূযাজানী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ساقط – “অধঃপতিত/ব্যর্থ।” [আহওয়ালুর রিজাল, ৩৩]

(চ) ইমাম ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ পুস্তকে তার সম্পর্কে বলেন – عامة أحاديثه غير محفوظة – “তার বর্ণিত বেশির ভাগ হাদীসই অসমর্থিত” [২/২১০]। শারীক ইবনে আবদিল্লাহ আল-ক্বাজী এটা আল-হাকাম ইবনে যাহিরের সাথে যৌথভাবে বর্ণনা করেছে, যেমনটি উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) ‘আল-মাজরূহীন’ পুস্তকে (২/১৬৩)। তবে শারীক ইবনে আবদিল্লাহ আল-ক্বাজী আল-কুফী ছিলো দুর্বল, বিশেষ করে কাজী/বিচারক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পরে যা কিছু সে নিজ স্মৃতি থেকে বর্ণনা করেছিলো (সেসব হাদীসের বেলায়)। 

(ছ) ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) ‘আস্ সিক্বাত’ গ্রন্থে (৬/৪৪৪) তার (শারীক ইবনে আবদিল্লাহ আল-ক্বাজী) সম্পর্কে বলেন – وكان في آخر أمره  يخطئ فيما روى تغير عليه حفظه. فسماع المتقدمين عنه الذين سمعوا بواسطة ليس فيه تخليط مثل يزيد بن هارون وإسحاق الأزرق، وسماع المتأخرين منه بالكوفة فيه أوهام كثيرة – “(জীবনের) শেষ দিকে সে নিয়মিত ভুল করেছিলো এবং তার স্মৃতিশক্তি হারিয়েছিলো। অতএব, ওয়া’সিতে তার প্রাথমিক সময়ে যাঁরা তার কাছ থেকে বর্ণনাসমূহ শুনেছিলেন, তাঁদের মনে কোনো বিভ্রান্তি নেই; যেমন – ইয়াযীদ ইবনে হারূন, ইসহাক্ব আল-আযরাক্ব প্রমুখ। তবে পরবর্তীকালে কুফায় যারা তার কাছ থেকে বর্ণনা শুনেছে তাদের বর্ণনায় অসংখ্য ভুল বিরাজমান।” 

(জ) ইমাম ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ গ্রন্থে বলেছেন – الغالب على حديثه الصحة والإستواء، والذي يقع في حديثه من النكرة إنما أتي به من سوء حفظه لا أنه يتعمد شيئًا مما يستحق أن ينسب فيه إلى شيء من الضعف – “তার বর্ণনাগুলো সাধারণত বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য; তবে তার বর্ণনায় আপত্তিকর যা ঘটেছে, তা স্মৃতির দুর্বলতাহেতু, আর দুর্বল ঘোষণার যোগ্য ইচ্ছাকৃত (ভুল) বর্ণনার কারণে তা নয়।” [৪/২২]

(ঝ) সালিহ জাযারাহ বলেন – صدوق ولما ولي القضاء اضطرب حفظه – “সে সত্যবাদী, কিন্তু যখন বিচারকের পদ গ্রহণ করেছিলো, তখন স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো।”

চতুর্থ ইসনাদ

ইমাম ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ গ্রন্থে (৬/১১২) দুর্বল রাবী তথা বর্ণনাকারীর অসমর্থিত ও অপরিচিত বর্ণনার কথা ইঙ্গিত করে বলেন – وهذا بهذا لم أكتبه إلا عن علي بن سعيد – “আর এই (শব্দচয়নে বর্ণনাটি) আমি লিপিবদ্ধ করিনি কেবল আলী ইবনে সাঈদের বর্ণনা ছাড়া।” 

তদুপরি, এই ইসনাদে আছে সালামাহ ইবনুল ফাদল আবী আবদিল্লাহ আল-আবরাশ, এবং সে দুর্বল। তার অনেক অসঙ্গতিপূর্ণ (مناكير) ও অপরিচিত/বিরল (غرايب) বর্ণনা রয়েছে। শুধু মাগা’যী (মানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জ্বিহাদসমূহ এবং এর পাশাপাশি সীরাতের সাধারণ বিষয়াবলী)  শ্রেণিভুক্ত যা কিছু সে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের কাছ থেকে বর্ণনা করেছে, কেবল তা-ই অন্যান্য রওয়ায়াত/বর্ণনা হতে শক্তিশালী, যদিও তার হাদীস/বর্ণনাগুলোর প্রতি সামগ্রিকভাবে দুর্বল মান আরোপ করা হয়েছে।

(ক) ইমাম বুখারী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – عنده مناكير، وهنه علي بن المديني، قال علي: ما خرجنا من الري حتى رمينا بحديثه – “তার রয়েছে অনেক অসমর্থিত অপরিচিত বর্ণনা। আলী ইবনে আল-মাদীনী তাকে দুর্বল বলেছেন (আত্ তাহযীব, ২/১৬৫)। আলী বলেন, আমরা রাঈ (শহর) ত্যাগ করিনি, যতোক্ষণ না আমরা তার বর্ণনাগুলো ছুঁড়ে ফেলেছি (যা আমরা লিপিবদ্ধ করেছিলাম)।” [আত্ তারীখুল কবীর, ৪/৮৪]

(খ) আবূ হা’তিম (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – محله الصدق وفي حديث إنكار يكتب حديثه ولا يحتج به – “সে সত্যবাদী শ্রেণিভুক্ত, তথাপিও তার বর্ণিত হাদীসগুলোতে অসঙ্গতি রয়েছে। তার হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করা যায়, কিন্তু দালিলিক প্রমাণ হিসেবে নির্ভর করা যায় না।” [আজ-জারহু ওয়াত্ তা’দীল, ৪/১৬৯]

(গ) সর্ব-ইমাম নাসাঈ ও ইসহাক্ব ইবনে রা’হূইয়াহ (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) উভয়েই তাকে দুর্বল ঘোষণা করেছেন। [আদ্ দু’আফা’ ওয়াল-মাতরূকীন (জীবনী নং ১৪৮৭)]

(ঘ) আল-হাকিম তার সম্পর্কে বলেন – ليس بالقوي عندهم – “হাদীসবিদ উলামাবৃন্দের কাছে সে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী নয়।” 

(ঙ) ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তাকে সিক্বা’ত গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করলেও তার সম্পর্কে বলেন – يخطئ ويخالف – “সে ভুল করে এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বর্ণনাও পেশ করে।” [আস্ সিক্বা’ত, ৮/২৭৮]

(চ) সর্ব-ইমাম ইবনে মাঈন, আবূ দাউদ ও ইবনে সা’আদ (রহ.) তাকে অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেছেন।

(ছ) ইমাম ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ পুস্তকে (৩/৩৪১) তার জীবনী-বৃত্তান্তে বলেন – وعنده سوى المغازي عن ابن إسحاق وغيره إفرادات وغرائب ولم أجد في حديثه حديثاً قد جاوز فيه الحد في الإنكار وأحاديثه مقاربة ومحتملة – “আর তার কাছে রয়েছে ইবনে ইসহাক্ব ও অন্যান্যদের কাছ থেকে তার বর্ণিত মাগা’যী-বিষয়ক হাদীস ছাড়াও অনেক একক, বিরল/অপরিচিত, অসমর্থিত বর্ণনা; আমি তার বর্ণিত হাদীসগুলোতে এমন বর্ণনা পাইনি যা অসঙ্গতির সীমালঙ্ঘন করেছে; (কিন্তু) তার বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল।” 

তবে এই বর্ণনায় আমরা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসারের ইসনাদে আনআনাহ’তে সমস্যা খুঁজে পাই; আর তাকে (হাদীসের তথ্য) গোপনকারী (মুদালিস) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন)। যখন সে ঊহ্য আকারে বর্ণনা করে তখন গোপন [মানে তাদলীস সংঘটন] করে, বিশেষ করে যদি সে মাগা’যী-বিষয়ক ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের হাদীস বর্ণনা করে। তাই যদি তার মধ্যে তাদলীসের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়, তবে বর্ণনা গ্রহণ করা হবে না; এবং এই বর্ণনার বিরল প্রকৃতি প্রমাণ করে সে সত্যি তাদলীস/গোপন করেছে।

পঞ্চম ইসনাদ

এই ইসনাদে আছে সুফিয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-ফাযা’রী আল-মাসীসী। তার সম্পর্কে ইবনে আদী (রহ.) নিজ ‘আল-কামিল (৩/৪১৯) গ্রন্থে বলেন – يسرق الحديث ويسوي الأسانيد – অর্থাৎ, “সে হাদীস চুরি করতো (জাল/বানোয়াট সমর্থনকারী হাদীস আরোপ করে), আর ইসনাদে হস্তক্ষেপ করতো (বর্ণনাকারী রদবদল করে অথবা বাদ দিয়ে – সাধারণত বিশ্বস্ত/সিকা বর্ণনাকারীদের মাঝে অবিশ্বস্ত বর্ণনাকারীকে বসিয়ে দিয়ে)।” অতঃপর ইমাম ইবনে আদী (রহ.) আল-ফাযা’রীর বর্ণিত এই নির্দিষ্ট হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন –

سواه سفيان الفزاري هذا فقال عن جعفر بن محمد عن أبيه عن جابر ورواه عن منصور بن سلمة عن سليمان بن بلال وسليمان ثقة ومنصور لا بأس به وإنما يروي جعفر بن محمد عن جماعة من أهل بدر عن النبي صلى الله عليه وسلم…. ولسفيان بن محمد غير ما ذكرت من الأحاديث ما لم يتابعه الثقات عليه وفي أحاديثه موضوعات وسرقات يسرقها من قوم ثقات وفي أسانيد ما يرويه تبديل قوم بدل قوم واتصال مراسيل وهو بين الضعف.  

অর্থ: “সুফিয়ান ফাযা’রী এই হাদীসে পরিবর্তন সাধন করেছে, যেহেতু সে বলেছে – ‘(এটা বর্ণিত) জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে;’ আর সে এটা বর্ণনা করেছে মানসূর ইবনে সালামাহ হতেও, তিনি সুলাইমান ইবনে বিলাল হতে – এবং সুলায়মান সিক্বা/বিশ্বস্ত ও মানসূর গ্রহণযোগ্য – অথচ এটা বর্ণিত হয়েছে কেবল জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ সূত্রে, বদর জিহাদে অংশগ্রহণকারী এক দল সাহাবা (রা.) হতে (নোট: এই ইসনাদের ধারাবাহিকতায় ছেদ নিশ্চিত – অনুবাদক), তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে।” আর সুফিয়ান ইবনে মুহাম্মদের রয়েছে উল্লেখিত হাদীসগুলো ছাড়াও অন্যান্য হাদীস, যেগুলোর পক্ষে তার কাছে বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীবৃন্দের তরফ থেকে নেই মোটেও কোনো সমর্থন, কেননা সে অনেক জাল হাদীস তৈরির পাশাপাশি বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের ইসনাদ হতে বিকল্প ইসনাদও বানিয়ে নিতো। অধিকন্তু, তার বর্ণনাগুলোতে এমন বর্ণনাকারীদের নামও আছে, যাঁদের নাম রদবদল করা হয়েছে, আর এর সাথে সাথে এমন ইসনাদও রয়েছে যেগুলোর ধারাবাহিকতা তাবেঈন (রহ.)-বৃন্দের পর্যায়ের ঊর্ধ্ব পর্যন্ত ক্ষুন্ন হয়েছে। তার দুর্বলতা স্পষ্ট দৃশ্যমান। [ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী রচিত ‘লিসা’নুল মীযা’ন’, ৩/৯৩]

ষষ্ঠ ইসনাদ

এই ইসনাদে আছে খা’লিদ ইবনে মাখলাদ আল-ক্বাতাওয়া’নী, যে ইমাম বুখারী (রহ.)-এর বর্ণনাকারীদের একজন হলেও হাদীসশাস্ত্রে দুর্বল।

(ক) ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – له مناكير – “তার রয়েছে অনেক বর্ণনা, যেগুলো সমর্থিত নয় (তার দুর্বলতা সত্ত্বেও)।” [আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল, ৩/৩৫৪]

(খ) ইবনে সা’আদ তার সম্পর্কে বলেন – منكر الحديث في التشيع مفرطًا – “ভীষণ দুর্বল, এর পাশাপাশি সে শিয়া মতবাদে চরমপন্থী।” [আত্ তাবাক্বাত, ৬/৪০৬]

(গ) আবূ হা’তিম (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – يكتب حديثه ولا يحتج به – “তার হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে, তবে (স্বতন্ত্র) দালিলিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।” [আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল, ৩/৩৫৪]

(ঘ) ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – صدوق لكنه يتشيع – “সে সত্যবাদী, কিন্তু (আকীদায়) শিয়া মতবাদী।” [সু’য়ালাতুল আজুর্রী লি আবী দাউদ, ১/১০৩]

(ঙ) সর্ব-ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (রহ.) ও ইবনে আদী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – لا  بأس به – “তার (বর্ণনার) মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।” [আত্ তাহযীব, ১/৫৩১; তারীখু ইবনু মাঈন, ইমাম দারিমী (রহ.)-এর বর্ণনা (১/১০৪); ইবনে আদী (রহ.)-এর আল-কামিল, ৩/৩৫]

(চ) সর্ব-ইমাম আল-ঈজলী ও ইবনে হিব্বান (রহ.) উভয় তাকে সিক্বা/বিশ্বস্ত বিবেচনা করেন। [আল-ঈজলী কৃত মা’রিফাতুস্ সিক্বা’ত, ১/৩২১; এবং ইবনে হিব্বান প্রণীত আস্ সিক্বা’ত, ৮/২২৪]

সপ্তম ইসনাদ

এতে বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে:

১/ এটা কর্মবাচ্যসূচক বর্ণনা (صيغة التمريض) – যা এর দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করে – যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে আদী ‘আল-কামিল’ গ্রন্থে (৫/১০১), আল-উক্বাইলী ‘আদ্ দু’আফা’ পুস্তকে (৩/৯৯৮), আল-খতীব তাঁর ‘তারীখ’ কিতাবে (১২/১৮১), ইবনুল জওযী ‘আল-মওদূ’আত’ বইয়ে (২/২৬৬) এবং ইবনে আসা’কির ‘তারীখ-এ-দিমাশক্ব’ গ্রন্থে (৫৯/১৫৭) এই মর্মে – قيل لأيوب أن عمرو بن عبيد يروي عن الحسن ولا يعرف من القائل – “আইয়ূবকে বলা হয়েছিলো, ‘নিশ্চয় আমর ইবনে উবায়দ (এটা) বর্ণনা করেছেন হাসান হতে,’ আর এ কথার বক্তা অপরিচিত।”

২/ আইয়ূব সাখতিয়্যানী বলেছেন যে এই হাদীসটি মিথ্যে/জাল, যেমনটি লিপিবদ্ধ করেছেন ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ গ্রন্থে (৫/১০১; ৫/১০৩)। [أيوب السختياني رحمه الله قال عن هذا الحديث كذب كما عند ابن عدي في الكامل…١٠١/٥ ـ ١٠٣/٥]

৩/ এই ইসনাদে রয়েছে আমর ইবনে উবায়দ; আবূ উসমান বসরী:

(ক) আইয়ূব ও ইঊনুস ইবনে উবায়দ দু জনই বলেছেন – كان عمرو بن عبيد يكذب في الحديث – “আমর ইবনে উবায়দ মিথ্যে/জাল হাদীস বর্ণনাকারী।”

(খ) আদ্ দা’রাক্বুতনী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – ضعيف – “দুর্বল (বর্ণনাকারী)।”

(গ) ইবনে মাঈন বলেন – ليس بشئ – “(একেবারে) মূল্যহীন।” [তারীখু ইবনু মাঈন গ্রন্থে উদ্ধৃত আদ্ দূরী বর্ণিত হাদীস; ৪/২৭৫]

(ঘ) আন্ নাসাঈ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – متروك الحديث – “(তার) বর্ণিত হাদীসগুলো পরিত্যক্ত।” [আদ্ দু’আফা ওয়াল-মাতরূকীন (জীবনী নং ৪৪৫)]

(ঙ) ইবনে হিব্বান (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন – كان داعية إلى الاعتزال ويشتم أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ويكذب مع ذلك في الحديث توهماً لا تعمداً – “সে একজন মু’তাযেলী মতবাদী প্রচারক এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর প্রতি অপমানজনক কথা উচ্চারণ করতো; আর এর সাথে সে অমনোযোগীভাবে জাল হাদীস বর্ণনা করতো, (যদিও) উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নয়।” [আল-মাজরূহীন, ২/৬৯]

(চ) ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কা’মিল’ গ্রন্থে (৫/১১০) বলেন – مذموم ضعيف الحديث جداً معلن بالبدع – “ঘৃণিত (ব্যক্তি), হাদীস বর্ণনায় মাত্রাতিরিক্ত দু্র্বল, প্রকাশ্যে বিদ’আতের ঘোষণাকারী।” [আল-কা’মিল, ৫/১১০]

অতএব, আমর ইবনে উবায়দ একজন ডাহা মিথ্যুক, বিশেষ করে হাসান হতে যা বর্ণনা করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে। হুমাইদ আত্ তাউয়ীল, আইয়ূব আস্ সাখতিয়্যানী ও ইবনে আউন সবাই এ কথা স্পষ্ট বলেছেন। তাই এ ইসনাদ সাবেত/প্রমাণিত নয়। আর এমন কী তা প্রমাণ করা গেলেও এটা হাসানের কাছ থেকে বর্ণিত মুরসাল হাদীসগুলোর একটা হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হবে। আর হাসান হতে বর্ণিত মুরসাল হাদীস বিবেচিত নয়।

‘আল-মুনতাখাবু মিনাল-’ঈলাল লিল-খাল্লা’ল’ গ্রন্থে (২২৯; সংকলনকারী – ইমাম মুওয়াফফাক আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে কুদামাহ মাকদিসী রহ. – বেসাল: ৬২০ হিজরী/১২২৩ খ্রীষ্টাব্দ) আল-খাল্লা’ল বলেন:

وأخبرنا عبدالله: حدثني أبي: حدثنا سليمان بن حرب: حدثنا حماد بن زيد، قال: قال رجل لأيوب: إن عمرو بن عبيد روى عن الحسن، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: إذا رأيتم ـ يعني ـ معاوية على المنبر.                       

অর্থ: আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবদুল্লাহ তাঁরই পিতা হতে, যিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন সুলাইমান ইবনে হরব, যিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ ইবনে যাইদ; তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আইয়ূবকে বলেন, নিশ্চয় আমর ইবনে উবায়দ বর্ণনা করেছেন হাসান (বসরী) হতে এ মর্মে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা যখন দেখতে পাবে, মানে মু’য়াবিয়াকে, মিম্বরের ওপরে (উপবিষ্ট)” – আইয়ূব (তৎক্ষণাৎ ওই ব্যক্তিকে জবাবে) বলেন:

فقال: كذب عمرو.

অর্থ: ‘আমর ডাহা মিথ্যাচার করেছে।

আবদুল্লাহ (আরো) বর্ণনা করেন:

قال: وسألت أبي أن يحدثني عمرو بن عبيد قلت: أعرفها. فأملى علي، عن سهل بن يوسف عن عمرو بن عبيد عن الحسن فقال: أتركه، كذب على الحسن. 

অর্থ: আমি আমার পিতার প্রতি ‘আমর বিন উবায়দের বর্ণনাগুলো আমার কাছে উদ্ধৃত করতে আরজ করলাম, (কেননা) আমি সেগুলো জানতাম। অতঃপর তিনি আমাকে বর্ণনা করলেন সেই রওয়ায়াতটি যা বর্ণিত হয়েছে সাহল ইবনে ইঊসুফ হতে, তিনি ’আমর ইবনে উবায়দ হতে, তিনি হাসান (বসরী) হতে; অতঃপর তিনি (আমায়) বল্লেন, ‘এটা তরক করো তথা বাদ দাও, কেননা সে (’আমর) ইমাম হাসান (বসরী)-এর প্রতি মিথ্যে আরোপ করেছে!’

এ সব থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে এই হাদীসটি ভিত্তিহীন, বর্ণনার ইসনাদ/পরম্পরার ক্ষেত্রে এবং মতন/পাঠের দিক থেকেও। অনেক আলেম-উলামা এই বর্ণনাটিকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন:

১/ ইমাম বুখারী (রহ.) ‘আত্ তারীখুল্ আওসাত’ (৭১) পুস্তকে বলেন:

وروى حماد بن سلمة عن علي بن زيد عن أبي نضرة أن معاوية لما خطب على المنبر فقام رجل فقال قال ورفعه إذا رأيتموه على المنبر فاقتلوه وقال آخر اكتبوا إلى عمر فكتبوا فإذا عمر قد قتل وهذا مرسل لم يشهد أبو نضرة تلك الأيام وقال عبد الرزاق عن بن عيينة عن علي بن زيد عن أبي سعيد رفعه وهذا مدخول لم يثبت ورواه مجالد عن أبي الوداك عن أبي سعيد رفعه وهذا واه قال أحمد أحاديث مجالد كلها حلم وقال يحيى بن سعيد لو شئت لجعلها كلها عن الشعبي عن مسروق عن عبدالله ويروى عن معمر عن بن طاوس عن أبيه عن رجل عن عبدالله بن عمرو رفعه في قصته وهذا منقطع لا يعتمد عليه وروى الأعمش عن سالم عن ثوبان رفعه في قصته وسالم لم يسمع من ثوبان والأعمش لا يدري سمع هذا من سالم أم لا؟! قال أبو بكر بن عياش عن الأعمش أنه قال: نستغفر الله من أشياء كنا نرويها على وجه التعجب اتخذوها ديناً وقد أدرك أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم معاوية أميراً في زمان عمر وبعد ذلك عشر سنين فلم يقم إليه أحد فيقتله قال البخاري: وهذا مما يدل على هذه الأحاديث أن ليس لها أصول ولا يثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم خبره على هذا النحو في أحد أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم إنما يقوله أهل الضعف بعضهم في بعض إلا ما يذكر أنهم ذكروا في الجاهلية ثم أسلموا فمحا الإسلام ما كان قبله. 

অর্থ: হাম্মাদ বর্ণনা করেন আলী ইবনে যায়দ হতে, তিনি আবূ নাদরাহ হতে এ মর্মে যে, “নিশ্চয় হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যখন মিম্বর হতে খুতবা দিচ্ছিলেন এমনি সময়ে এক লোক উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি আরোপ করে নিম্নের হাদীসটি – ‘যদি তোমরা তাকে (মু’য়াবিয়াকে) মিম্বরে দেখতে পাও, তবে হত্যা কোরো;’ আর অপর একজন বলে, ‘উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে (পত্র) লেখো।’ তারা তাই করে, কিন্তু খলীফা উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ইতোমধ্যে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।” তবে এটা একটা মুরসাল বর্ণনা এবং আবূ নাদরাহ (পূর্ববর্তী) সেসব দিনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। ইমাম আবদুর রাযযাক্ব (রহ.) বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে উবায়নাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর সূত্রে, তিনি আলী ইবনে যায়দ হতে, তিনি আবূ সাঈদ (খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে; আর এতে জাল করা রয়েছে এবং বর্ণনাটি প্রমাণিত নয়। মুজা’লিদ এটা বর্ণনা করেছেন আবূল ওয়াদা’ক হতে, তিনি আবূ সাঈদ (খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে; আর এটা অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনা। ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ.) বলেন যে মুজা’লিদের বর্ণনাগুলো যেনো স্বপ্নের মতো। ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ বলেন, কারো ইচ্ছা হলে সে এগুলোর সবই তৈরি করতে পারতো আল-শা’বী হতে, তিনি মাসরূক্ব হতে, তিনি আবদুল্লাহ হতে। এ ঘটনাটি আরো বর্ণিত হয়েছে মা’মার হতে, তিনি ইবনে তা’উস হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি জনৈক ব্যক্তি হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে, আর এই হাদীসের ইসনাদে ছেদ পড়েছে, তাই এটা নির্ভরযোগ্য নয়। আল-আ’মাশ এই ঘটনা সম্পর্কে বর্ণনা করেন সা’লিম হতে, তিনি সওবান হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে। তবে সা’লিম এটা সওবান থেকে শ্রবণ করেননি। আর আল-আ’মাশ এটা সা’লিম থেকে শুনেছেন কি না তা নিশ্চিত নয়। আবূ বকর ইবনে আল-আইয়্যাশ বর্ণনা করেন আল-আ’মাশ হতে এ মর্মে যে তিনি বলেন: “আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই সেসব বিষয় থেকে, যেগুলো আমরা বিস্ময়াবিভূত হওয়ার ভিত্তিতে বর্ণনা করেছি; আর তারা এগুলোকে ধর্মের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে।” প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আসহাব (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী উপস্থিত ছিলেন খলীফা উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফত আমলে, যখন হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে অধিষ্ঠিত হন এবং এরপর আরো দশ বছরের একটা সময়কাল যাবৎ ওই পদে যখন শাসন করেন; কিন্তু (তাঁদের) কেউই তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াননি। ইমাম আল-বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, এতে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে এসব বর্ণনার মোটেও কোনো ভিত্তি নেই এবং এ প্রকৃতির কোনো বর্ণনাই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে তাঁর কোনো সাহাবী (রা.)-এর সূত্রে প্রমাণিত হয়নি। এটা সম্পর্কে দুর্বল বর্ণনাকারীরাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে মাত্র; ব্যতিক্রম শুধু জা’হিলিয়্যা যুগে যা ঘটেছিলো তাই, আর এরপর তাঁরা ইসলামে প্রবেশ করেন, আর ইসলাম ধর্ম এর আগের সব কিছু মুছে ফেলে (তাঁদেরকে) পুতঃপবিত্র করেছে।

২/ আবূ জা’ফর উক্বায়লী (রহ.) ‘আদ্ দু’আফা’ গ্রন্থে (১/২৮০) কিছু সংখ্যক হাদীস, যেগুলোর মধ্যে (আলোচ্য) এই বর্ণনাও আছে, তা উল্লেখ করার পর বলেন: 

ولا يصح عن النبي عليه الصلاة والسلام في هذا المتون من وجه يثبت.

অর্থ: এবং এসব ‘মতন’ তথা মূললিপির কোনোটাই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে সাবেত বা প্রমাণিত হয়নি। [আল-মওদূ’আত, ২/২৬৬; তাহযীবুত্ তাহযীব, ৩/১৬৪]

৩/ ইবনে আদী (রহ.) কৃত ‘আল-কা’মিল’ পুস্তক (৩/৪১৯)।

৪/ ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) ‘আল-মাজরূহীন’ (১/১৭১) গ্রন্থে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে বিশর ইবনে ফাদালাহ (রহ.)-এর জীবনীর অধীনে তাঁর কাছ থেকে কিছু হাদীস, যার মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত, তা বর্ণনা করার পর বলেন:

وهذه الأحاديث التي ذكرناها أكثرها مقلوبة ومعمولة، عملت يداه.

অর্থ: এসব হাদীস যা আমরা উল্লেখ করেছি, তার বেশির ভাগই রদবদল হয়েছে এবং তাতে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে; এটা তাঁর হাতের কারসাজি। 

এই কারণে ইমাম হাফেয ইবনে হাজর (রহ.) ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে (৩/১৬৪) বলেন:

وقال غيره أنكر ما روى ما حدث به حماد بن سلمة عنه عن أبي نصرة عن أبي سعيد رفعه إذا رأيتم……..

অর্থ: তাঁর (মানে ইবনে হিব্বানের) পাশাপাশি অন্যরা (এটা) প্রত্যাখ্যান করেছেন, যা হাম্মাদ ইবনে সালামাহ বর্ণনা করেছেন তাঁর (মানে আহমদ ইবনে মুহাম্মদের) কাছ থেকে, তিনি আবূ নাদরাহ হতে, তিনি আবূ সাঈদ (রা.) হতে….।

৫/ আজ-জাওযাক্বা’নী (রহ.) ‘আল-আবা’তীল’ (১/২০০) পুস্তকে বলেন: “এই বর্ণনাটি বানোয়াট, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন; এটা বিদ’আতীদের প্রচলিত বিদ’আত ছাড়া কিছুই নয়, যারা জালিয়াত। আল্লাহ তাদেরকে উভয় জগতে পরিত্যাগ করুন! যে কেউ এতে বা এর মতো কোনো কিছুতে যদি বিশ্বাস করে, কিংবা এমন কী মনে করে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ধরনের কথা বলেছেন, তাহলে সে পথভ্রষ্ট, ধর্মচ্যুত।”

৬/ ইবনে জওযী তাঁর ‘আল-মওদূ’আত’ কিতাবে (২/২৬৬) বলেন – هذا الحديث لا يصح عن رسول الله صلى الله عليه وسلم – “এই বর্ণনা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে সহীহ (হাদীস) হিসেবে বর্ণিত নয়;” আর ‘আল-মওদূ’আত’ পুস্তকে (২/২৬৪) ইবনে জওযী সেসব লোকের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যে এই বর্ণনাটি বানিয়েছে। 

৭/ ইমাম ইবনে আসা’কির (রহ.) ‘তারীখ-এ-দিমাশক্ব’ গ্রন্থে (৫৯/১৫৭) বলেন:

وهذه الأسانيد كلها فيها مقال.

অর্থ: “এই সমস্ত বর্ণনা সন্দেহজনক।”

৮/ আবূল অব্বাস ইবনে তাইমিয়াহ তাঁর ‘মিনহাজুস্ সুন্নাতিন্ নববীয়্যাহ’ কিতাবে (৪/৩৮০) বলেন:

وهذا الحديث ليس في شيء من كتب الإسلام وهو عند الحفاظ كذب وذكره ابن الجوزي في الموضوعات. 

অর্থ: এসব বর্ণনা ইসলামী বইপত্রে পাওয়া যায় না। হাদীস-বিশারদমণ্ডলীর দৃষ্টিতে এগুলো ডাহা মিথ্যে, আর ইবনে জাওযী এ কথা ‘আল-মওদূ’আত’ গ্রন্থে বলেছেন।

৯/ আয্ যাহাবী নিজ ‘সিয়ারু আলামিন্ নুবালা’ পুস্তকে (৩/১৫০) বলেন:

هذا كذب، ويقال هو معاوية بن تابوه المنافق.

অর্থ: এটা একটা মিথ্যে। এ কথাও (ব্যাখ্যাস্বরূপ) বলা হয়েছে যে, এর (মানে বর্ণনাটির) উদ্দেশ্য মু’য়াবিয়াহ ইবনে তা’বূহ, যে একজন মুনাফিক্ব।

১০/ ইবনে কাসীর ‘আল্ বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ গ্রন্থে (১১/৪১৯) বলেন:

وهذا الحديث كذب بلا شك.

অর্থ: এই বর্ণনাটি সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যে।

১১/ ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী (রহ.) কৃত ‘তাতহীরুল জানা’ন’(৩৮)।

১২/ আশ্ শওকানী প্রণীত ‘আল-ফাওয়াঈদুল মজমূ’আহ’ (৪০৭)।

১৩/ ইমাম সৈয়ূতী (রহ.) রচিত আল-ফাওয়াঈদ মিনাল্ লায়লীল্ মাসনূ’আহ (১/৩৮৮)।

১৪/ ইবনে আর্রাক্ব আল-কিনা’নী লিখিত ‘তানহীযুশ্ শরী’আতিল মারফূ’আহ (২/৮)।

তদুপরি, এই বর্ণনাটি ভিত্তিহীন, যদি কেউ কেবল এর মতন/পাঠ বা লিপিকে  বিবেচনা করেন। তা (স্রেফ) দুটি কারণে:

১/ নিশ্চয় মিম্বরে আরোহণ করেছিলো এমন অনেকেই, যারা হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে (আমলের ক্ষেত্রে) মন্দতর ছিলো; কিন্তু প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতদসত্ত্বেও তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেননি।

২/ এটা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সমালোচনাও বটে, বিশেষ করে সে সকল সাহাবা (রা.), যাঁদের কাছে এই (কথিত) হাদীস পৌঁছেছে অথচ তাঁরা আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে হত্যার দ্রত ব্যবস্থা না নিয়ে এর ওপর আমল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। 

আবূল আব্বাস ইবনু তাইমিয়া নিজ ‘মিনহা’জুস সুন্নাতিন্ নবূবীয়াহ’ (২/২৯৫) গ্রন্থে এই (কথিত) হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:

هذا الحديث ليس في شيء من كتب الإسلام وهو عند الحفاظ كذب وذكره ابن الجوزي في الموضوعات ثم صعد المنبر من هو شر من معاوية وما أمر بقتله.

অর্থ: এই (কথিত) হাদীস ইসলামী বইপত্রে পাওয়া যায় না এবং এটা হাদীস-শাস্ত্রবিদবৃন্দের কাছে জাল/বানোয়াট; আর ইবনে জাওযী এটা সম্পর্কে তাঁর প্রণীত ‘আল-মওদূ’আত’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে (আমলের বেলায়) মন্দতর লোক মিম্বরে আরোহণ করেছিলো, কিন্তু তাকে হত্যার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি।

ইবনে তাইমিয়া ‘মিনহাজুস সুন্নাতিন্ নবূবীয়াহ’ পুস্তকে (৪/৩৮০) আরো বলেন:

ومما يبين كذبه أن منبر النبي صلى الله عليه وسلم قد صعد عليه بعد موت معاوية ممن كان معاوية خيرًا منه باتفاق المسلمين فإن كان يجب قتل من صعد عليه لمجرد الصعود على المنبر وجب قتل هؤلاء كلهم. ثم هذا خلاف المعلوم بالاضطرار من دين الإسلام أن مجرد صعود المنبر لا يبيح قتل مسلم وإن كان أمر بقتله لكونه تولى الأمر وهو لا يصلح فيجب قتل كل من تولى الأمر بعد معاوية أفضل منه. هذا خلاف ما تواترت به السنن عن النبي صلى الله عليه وسلم من نهيه عن قتل ولاة الأمور وقتالهم كما تقدم بيانه. ثم الأمة متفقة على خلاف هذا، فإنها لم تقتل كل من تولى أمرها ولا استحلت ذلك  ا.هـ

অর্থ: আরেকটি কারণ যা এই বর্ণনাটিকে ডাহা মিথ্যা বলে প্রমাণ করে তা হলো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মিম্বরে আরোহণ করা হয়েছিলো — হযরতে আমীরে মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বেসালের পর — এমন ব্যক্তিদের দ্বারা, যাদের থেকে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) শ্রেষ্ঠ ছিলেন, যে ব্যাপারটিতে মুসলমান সমাজ সর্বসম্মত। সুতরাং, শুধু মিম্বরে আরোহণের কারণে আরোহণ করেছে এমন লোকদেরকে হত্যা করা যদি ওয়াজিব হতো, তাহলে তাদের সবাইকে হত্যা করা ওয়াজিব ছিলো। তদুপরি, এটা ইসলাম ধর্মের জ্ঞাত প্রয়োজনের পরিপন্থী এ মর্মে যে, স্রেফ মিম্বরে আরোহণের কারণে কোনো মুসলমান ব্যক্তিকে হত্যা করতে হবে। আর যদি বলা হয়, এর দ্বারা বোঝায় মুসলমানদের বিষয়াদির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে হত্যা ওয়াজিব, তাহলে এটাও বলা যেতে পারে যে হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, তারা তো মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলো; কেন তাদের হত্যা করার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি? অধিকন্তু, এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেসব তাওয়াতুর হাদীসের পরিপন্থী, যেগুলো বারংবার তাকিদ দিয়েছে এ মর্মে যে মুসলমানদের নেতাবৃন্দের হত্যা বা তাঁদের সাথে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। এ ছাড়াও মুসলমানদের ঐকমত্য এর খেলাফ, কারণ যারা নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলো তাদেরকে হত্যা করার চেষ্টাও তাঁরা করেননি এবং এর অনুমতিও তাঁরা দেননি।

হাফেয ইবনে কাসীর আপন ‘আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ’ (১১/৪৩৪) গ্রন্থে বলেন:

وهذا الحديث كذب بلا شك ولو كان صحيحا لبادر الصحابة إلى فعل ذلك لأنهم لا بأخذهم في الله لومة لائم.

অর্থ: আর এই (কথিত) হাদীসটি নিঃসন্দেহে মিথ্যা। যদি তা সত্য হতো তাহলে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) তা বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করতেন না; কেননা আল্লাহর আদেশ পালনে কোনো প্রকার সমালোচনাই তাঁদের বাদ সাধতো না।

ইমাম ইবনু হাজর হায়তামী মক্কী (রহ.) তাঁর ‘তাতহীরুল জানা’ন’ (৩৮ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে যা লিখেছেন তাও দেখুন।

হাসান আল-মালিকীর প্রদত্ত (“যদি তোমরা আমার মিম্বরে মু’য়াবিয়াকে দেখতে পাও, তবে তাকে হত্যা কোরো!” – إذا رأيتم معاوية على منبري فاقتلوه) – এই বর্ণনাটিকে সত্যায়িত করার প্রচেষ্টার বিষয়ে নিম্নে কিছু একাডেমিক পর্যবেক্ষণ দেওয়া হলো:

১/ তাঁর দ্বারা মূল উৎসের প্রতি উল্লেখ না করে অপ্রধান/গৌণ উৎসের উল্লেখ এটাই ইঙ্গিত করে যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে খবর/বর্ণনাটি পাননি; যেমন –

(ক) বর্ণিত হয়েছে আল-হাকাম ইবনে যাহিরের সূত্রে, তিনি আসিম হতে, তিনি যির্র হতে, তিনি হযরত ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এ মর্মে যে তিনি (দ.) বলেন – “যখন তোমরা আমার মিম্বরের ওপরে মু’য়াবিয়াকে দেখতে পাবে…”- হাদীস – إذا رأيتم معاوية على … الحديث)। তিনি এটাকে ‘সিয়্যারু আলা’মিন্ নুবালা’ (৩/১৪৯) গ্রন্থের প্রতি আরোপ করেছেন, অথচ বর্ণনাটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ইবনে আদী (রহ.)-এর ‘আল-কামিল’ (২/২০৯) পুস্তকে এবং ইবনে হিব্বান (রহ.)-এর ‘আল-মাজরূহীন’ (১/৩৫) কিতাবে, আর ইবনুল জাওযী কৃত ‘আল-মওদূ’আত’ (২/২৬৫) গ্রন্থেও।

(খ) বর্ণিত হয়েছে সুফিয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-ফাযা’রীর সূত্রে, তিনি মানসূর ইবনে সালামাহ হতে, তিনি বিলাল ইবনে সুলাইমান হতে, তিনি জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে, যিনি বলেন: “যদি তোমরা দেখো আমার মিম্বরের ওপরে অমুককে…তবে তাকে হত্যা কোরো” – হাদীস – إذا رأيتم على منبري فاقتلوه يعني فلان)। তিনি এটাকে আরোপ করেন ‘মীযানুল এ’তেদা’ল’ (৩/২৪৮) পুস্তকের প্রতি, অথচ এটা বর্ণনা করেছেন ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ (৩/৪১৯) গ্রন্থে।

(গ) বর্ণিত হয়েছে খালিদ ইবনে মাখলাদ সূত্রে, তিনি সুলাইমান ইবনে বিলাল হতে, তিনি জা’ফর হতে, তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একটি দল হতে, তাঁরা নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে। তিনি এটাকে ‘মীযানুল এ’তেদাল’ (৩/২৪৮) কিতাবের প্রতি আরোপ করেছেন, অথচ এটা বর্ণনা করেছেন ইবনে আদী ‘আল-কামিল (৩/৪১৯) গ্রন্থে। 

২/ তাঁর দ্বারা সমর্থনকারী বর্ণনাগুলো উল্লেখ করার ক্ষেত্রে ধোঁকাবাজি (তাদলীস):

“যদি তোমরা মু’য়াবিয়াকে আমার মিম্বরের ওপরে দেখো, তবে হত্যা কোরো” (إذا رأيتم معاوية على منبري فاقتلوه) – এই হাদীসটির ক্ষেত্রে আল-মালিকী উল্লেখ করেছেন অপর একটি (সমর্থনকারী) ইসনাদ, যা বর্ণিত হয়েছে ইবনে আদী কর্তৃক ‘আল-কামিল (৩/৪১৯) পুস্তকে, আর যা বর্ণিত হয়েছে খালিদ ইবনে মাখলাদ সূত্রে, তিনি সুলাইমান ইবনে বিলাল হতে, তিনি জা’ফর হতে, তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একটি দল হতে, তাঁরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে। তিনি একটি সমর্থনসূচক ইসনাদ-ও উল্লেখ করেন, যেটা বর্ণনা করেছেন ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ (৩/৪১৯) গ্রন্থে সুফিয়ান আল-ফাযারী সূত্রে, তিনি মানসূর ইবনে সালামাহ হতে, তিনি সুলাইমান ইবনে বিলাল হতে, তিনি জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে মরফু’ হাদীসস্বরূপ – إذا رأيتم على منبري فاقتلوه يعني فلان – “যদি তোমরা দেখো আমার মিম্বরের ওপরে অমুককে…তবে তাকে হত্যা কোরো।” 

তবে দ্বিতীয় ইসনাদটি কেবল সুফিয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-ফাযারীর বানোয়াট একটি সংস্করণ, যেমনটি উল্লেখ করেছেন ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ (৩/৪১৯) কিতাবে।     

 ৩/ “যদি তোমরা মু’য়াবিয়াকে আমার মিম্বরের ওপরে দেখো, তবে হত্যা কোরো” – إذا رأيتم معاوية على منبري فاقتلوه –  এই বর্ণনাটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এটা আসিমের সূত্রে চারটি ইসনাদে বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি কেবল তিনটি ইসনাদ-ই উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি শারীকের সূত্রে আসিম হতে; দ্বিতীয়টি আল-হাকাম ইবনে যাহিরের সূত্রে আসিম হতে এবং তা ‘সিয়্যারুল আলামিন নুবালা’ গ্রন্থের প্রতি আরোপিত; আর তৃতীয়টিকে তিনি কারো প্রতি আরোপ করেননি, অথচ তা আল-বালাযিরীর ‘আনসাবুল আশরাফ’ (৫/১৩৭) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে সাল্লামা আবাল মুনযিরের সূত্রে, তিনি আসিম হতে, তিনি যির্র হতে, তিনি হযরত ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

দ্বিতীয় বর্ণনাটি

الحديث الثاني: (( لعن الله الراكب والقائد والسائق )).

অর্থ: আল্লাহ (উটের) সওয়ারী, পরিচালনাকারী ও চালকের প্রতি লা’নত দিন। 

হযরত সাফীনাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনা:

ইমাম বাযযার (রহ.) তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (৯/২৮৬) বর্ণনা করেন, আল-সাকান ইবনে সাঈদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আবদুস্ সামাদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আমার পিতা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, এবং হাম্মাদ ইবনে সালামাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন সাঈদ ইবনে জুমহা’ন হতে [নোট: এটা সঠিক নাম, যদিও মূল লিপিতে জুহমান দৃশ্যমান, যা বানানগত ত্রুটি – লেখক আস্ সুবাঈ], তিনি হযরত সাফীনাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে:

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان جالساً فمر رجل على بعير وبين يديه قائد وخلفه سائق فقال: لعن الله القائد والسائق والراكب.

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার বসেছিলেন যখন এক ব্যক্তি উটের পিঠে চড়ে অতিক্রম করছিলো; সামনে ছিলো এক ব্যক্তি, যে উটটি পরিচালনা করছিলো, আর পেছনে ছিলো এক ব্যক্তি, যে উটকে অগ্রসর হবার জন্যে চালনা করছিলো (মানে তাড়না দিচ্ছিলো)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আল্লাহ (উটের) সওয়ারী, পরিচালনাকারী ও চালকের প্রতি লা’নত দিন।” 

এর জবাব নিম্নরূপ:

(ক) এই বর্ণনাকে সহীহ ধরে নিলেও এতে হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর কোনো উল্লেখ নেই।

(খ) এই বর্ণনাটি অসমর্থিত (মুনকার) হওয়ার পাশাপাশি এর দুর্বলতাহেতু প্রত্যাখ্যাত। এ ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে আল-বালা’যুরী রচিত ‘আনসা’বুল আশরা’ফ’ গ্রন্থে (১২৯ পৃষ্ঠা), যা বর্ণিত হয়েছে আবদুল ওয়া’রিস ইবনে সাঈদ সূত্রে/তরীকে, তিনি সাঈদ ইবনে জুমহা’ন হতে, তিনি হযরত সাফীনাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে – “আল্লাহ (উটের) সওয়ারী, পরিচালনাকারী ও চালকের প্রতি লা’নত দিন” – لعن الله القائد والسائق والراكب – এখানে বাহনটি হচ্ছে একটি উট। নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো প্রাণিকে লা’নত দিতে পারেন বলে কি কখনো কল্পনা করা যায়? তিনি সহীহ মুসলিম শরীফ গ্রন্থে (২৫৯৮) ঘোষণা করেছেন – لاَ يَكُونُ اللَّعَّانُونَ شُفَعَاءَ وَلاَ شُهَدَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – “অভিসম্পাতকারীরা কিয়ামত দিবসে সুপারিশকারী কিংবা সাক্ষ্যদাতা হতে পারবে না।” এবং যেমনটি তিনি এরশাদ করেছেন সহীহ মুসলিম শরীফ গ্রন্থে (২৫৯৫) হযরত ইমরা’ন ইবনে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনায়, যিনি বলেন:

بَيْنَمَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ وَامْرَأَةٌ مِنَ الأَنْصَارِ عَلَى نَاقَةٍ فَضَجِرَتْ فَلَعَنَتْهَا فَسَمِعَ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏ “‏ خُذُوا مَا عَلَيْهَا وَدَعُوهَا فَإِنَّهَا مَلْعُونَةٌ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ عِمْرَانُ فَكَأَنِّي أَرَاهَا الآنَ تَمْشِي فِي النَّاسِ مَا يَعْرِضُ لَهَا أَحَدٌ ‏.‏      

অর্থ: একবার রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো এক সফরে ছিলেন। সে সময় এক আনসার মহিলা একটি উষ্ট্রির পিঠে আরোহী ছিলেন। তিনি (সেটার আচরণে) বিরক্ত হয়ে তার প্রতি অভিসম্পাত দান করলেন। তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা শুনে বললেন, “এর উপরে (মানে পিঠে) যা আছে তা (নামিয়ে) নিয়ে নাও এবং একে ছেড়ে দাও। কেননা সে তো অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছে।” হযরত ইমরা’ন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমি যেনো সে উষ্ট্রীটিকে এখনো দেখতে পাচ্ছি, যে মানুষের মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছে, অথচ কেউই তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছেন না।”

(গ) আল-বাযযার (রহ.)-এর শিক্ষক আল-সাকান ইবনে সাঈদ হলেন ‘অপরিচিত’ (مجهول), কেননা তাঁর কোনো জীবনীমূলক বিবরণ পাওয়া যায় না। ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী মক্কী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর ‘মজমাউয্ যওয়াঈদ’ গ্রন্থে (৭/৩৯৫) বলেন:

شيخ البزار السكن بن سعيد لم أعرفه.

অর্থ: “ইমাম বাযযার (রহ.)-এর শিক্ষক আল-সাকান ইবনে সাঈদকে আমি চিনি না/জানি না।” 

ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনা

ইমাম তবারানী (রহ.) নিজ ‘আল-মু’জামুল কবীর’ গ্রন্থে (৩/৭১, হাদীস নং ২৭০৯) বর্ণনা করেন:

حدثنا زكريا بن يحيى الساجي حدثنا محمد بن بشار بندار حدثنا عبد الملك بن الصباح المسمعي حدثنا عمران بن حدير أظنه عن أبي مجلز قال: قال عمرو بن العاص والمغيرة بن شعبة لمعاوية إن الحسن بن علي عيي وإن له كلاماً ورأياً وإنه قد علمنا  كلامه فيتكلم كلاماً فلا يجد كلاماً، فقال: لا تفعلوا فأبوا عليه فصعد عمرو المنبر فذكر عليا ووقع فيه ثم صعد المغيرة بن شعبة فحمد الله وأثنى عليه ثم وقع في علي رضي الله عنه؛ ثم قيل للحسن بن علي: أصعد، فقال: لا أصعد ولا أتكلم حتى تعطوني إن قلت حقاً أن تصدقوني وإن قلت باطلاً أن تكذبوني، فأعطوه فصعد المنبر فحمد الله وأثنى عليه فقال: بالله يا عمرو، وأنت يا مغيرة، تعلمان أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: (( لعن الله السائق والراكب )) أحدهما فلان، قالا: اللهم نعم بلى، قال: أنشدك الله يا معاوية ويا مغيرة أتعلمان أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لعن عمراً بكل قافية قالها لعنة، قالا: اللهم بلى، قال: أنشدك بالله يا عمرو وأنت يا معاوية ابن أبي سفيان أتعلمان أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لعن قوم هذا، قالا: بلى، قال الحسن: فإني أحمد الله الذي وقعتم فيمن تبرأ من هذا، 

অর্থ: আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যাকারিয়্যা ইবনে ইয়াহইয়া আস্ সা’জী; তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে বাশ্শা’র; তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন আবদুল মালিক ইবনে আস্ সাব্বাহ আল-মাসমাঈ; তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেন ইমরান ইবনে হুদায়র – আমার ধারণা – আবূ মিজলায হতে, যিনি বলেন: “হযরত আমর ইবনুল আ’স্ ও আল-মুগীরাহ ইবনে শু’বাহ হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু))-কে বলেন যে হযরতে হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) নিজেকে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে অক্ষম এবং তাঁর কিছু বলার আছে, আর তাঁর একটি অভিমত আছে প্রকাশ করার; আর আমরা জানি তিনি কী বলছেন এবং তাঁর বলার পরও কোনো রকম উত্তর পাচ্ছেন না। তাই আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদেরকে (মানে আমর ও মুগীরাহ’কে) কোনো কিছু না করার জন্যে বলেন, কিন্তু তাঁরা নমনীয় হন; আমর ইবনে আ’স্ (রা.) মিম্বরে আরোহণ করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন আর হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর নিন্দা করেন। এরপর মুগীরাহ মিম্বরে আরোহণ করেন, আর আল্লাহর প্রশংসা করে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর নিন্দা করেন। অতঃপর ইমাম হাসান বিন আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে মিম্বরে আরোহণ করতে বলা হয়, কিন্তু তিনি তা করতে অস্বীকার করেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না তাঁকে আশ্বস্ত করা হবে যে তিনি সত্য বল্লে তাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করবেন, আর মিথ্যে বল্লে তাঁরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন। তাঁকে এরপর আশ্বস্ত করা হয় এবং তিনি মিম্বরে আরোহণ করেন ও আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন: আল্লাহর শপথ, ওহে আমর, আর আপনি, ওহে মুগীরাহ, আপনারা দু জনই জানেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা (উটের) চালক ও সওয়ারীকে লা’নত/অভিসম্পাত দিয়েছেন;’ তাদের একজন হচ্ছেন অমুক।’ হযরত আমর ও মুগীরাহ উত্তর দেন, আল্লাহর শপথ, হ্যাঁ (তা) নিশ্চয়। অতঃপর হযরত ইমাম (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর নামে আপনাদের জিজ্ঞেস করছি, ওহে মু’য়াবিয়া (রা.) এবং ওহে মুগীরাহ, আপনারা দু জন কি অবগত নন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমর (রা.)-কে লা’নত দিয়েছেন, প্রতিটি বাক্যের শেষ করেছেন তাঁকে লা’নত দিয়ে? এ কথার উত্তরেও তাঁরা বলেন, আল্লাহর শপথ, হ্যাঁ (তা) নিশ্চয়। এরপর ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ওহে আমর (রা.) এবং ওহে মু’য়াবিয়্যা (রা.), আল্লাহর ওয়াস্তে আমি আপনাদের কাছে জিজ্ঞেস করছি, আপনারা কি অবগত নন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ব্যক্তির (মানে মুগীরাহর) কওম তথা জাতির প্রতি লা’নত দিয়েছেন? এতে তাঁরা উত্তর দেন, নিশ্চয়!….”

وذكر الحديث وهذا الحديث باطل سنداً ومتناً: من جهة الإسناد قال عمران بن حدير أظنه عن أبي مجلز ولا يعلم من الظان!! 

অর্থ: এই বর্ণনাটি বাতিল/ভিত্তিহীন, ইসনাদ তথা সনদ ও মতন তথা লিপি উভয় ক্ষেত্রেই। ইসনাদের দিক হতে ইমরান ইবনে হুদায়র বলেছেন, “আমি ধারণা করি এটা আবূ মিজলায হতে (বর্ণিত)।” কিন্তু ধারণাকারী প্রকৃতপক্ষে কে, তা নিশ্চিত নয়।

وأيا كان هذا الظان فإنه أيضاً لم يجزم أنه عن أبي مجلز لاحق بن حميد فقد يكون عنه وقد يكون عن غيره!!

অর্থ: ধারণাকারী যে-ই হোন না কেন, এটা কোনোক্রমেই নিশ্চিত নয় যে এটা আবূ মিজলায, লা’হিক ইবনে হুমাইদ হতে (বর্ণিত), কেননা এটা তাঁর থেকে হতে পারে আবার অন্য যে কারো কাছ থেকেই হতে পারে।

المالكي بتر الحديث ولم يذكر القصة كاملة! والقصة فيها نكارة وهي أن الحسن أخبر أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لعن عمرو بن العاص بكل قافية قالها!! فكيف يلعن الرسول عليه الصلاة والسلام عمرو بن العاص بكل قافية قالها ثم يأمره على جيش المسلمين في ذات السلاسل كما في ((صحيح البخاري)) (3462)!!

অর্থ: আল-মালিকী তাঁর বর্ণনাটি সংক্ষিপ্ত করেছেন এবং পূর্ণ বিবরণ উল্লেখ করেননি। এতে বর্ণিত খোদ ঘটনাটির ক্ষেত্রেই আপত্তি রয়েছে, কেননা তাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি খুতবায় প্রতিটি বাক্যের শেষে হযরত ‘আমর ইবনুল আ’স (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে লা’নত দিয়েছিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব যে তিনি একটি একক খুতবার মধ্যে প্রতিটি বাক্যে এমন একজন ব্যক্তিকে লা’নত তথা অভিশাপ দিয়েছিলেন, যাঁকে তিনিই ‘যাতুস্ সালা’সিল’ নামের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেছিলেন, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থে (৩৬৬২ – حَدَّثَنَا مُعَلَّى بْنُ أَسَدٍ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيْزِ بْنُ الْمُخْتَارِ قَالَ خَالِدٌ الْحَذَّاءُ حَدَّثَنَا عَنْ أَبِيْ عُثْمَانَ قَالَ حَدَّثَنِيْ عَمْرُوْ بْنُ الْعَاصِ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَهُ عَلَى جَيْشِ ذَاتِ السُّلَاسِلِ)। 

ثم أليس هذا يخالف ما رواه مسلم في ((صحيح)) (121) في قصة وفاة عمرو بن العاص رضي الله عنه عندما بكى فقال له ابنه: يا أبتي أما بشرك رسول الله صلى الله عليه وسلم بكذا!

অর্থ: উপরন্তু, এটা কি সেই বিশুদ্ধ বর্ণনার পরিপন্থী নয়, যা সহীহ মুসলিম শরীফ হাদীসগ্রন্থে (১২১) বর্ণিত হয়েছে এ মর্মে যে, হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বেসাল উপলক্ষে তিনি কাঁদতে আরম্ভ করেন, আর তাঁর পুত্র তাঁকে সান্ত্বনা দেন এই বলে: “হে আমার প্রিয় বাবা, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি আপনাকে অমুক-অমুক বিষয়ের সুখবর দেননি?”

أليس هذا يخالف ما جاء عنه عليه الصلاة والسلام بالشهادة لعمرو بن العاص بالإيمان روى أحمد في ((المسند)) (17843) والنسائي في ((الكبرى)) (8301) وابن حبان (7092) كلهم من طريق موسىٰ بن علي بن رباح عن أبيه عن عمرو بن العاص رضي الله عنه قال: كان بالمدينة فزع فتفرقوا فنظرت إلى سالم مولى أبي حذيفة قد أخذ سيفه محتبياً فلما رأيت ما صنع سالم دعوت بسيفي فاحتبيت به فخرج رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: ((أيها الناس ألا يكون فزعكم إلى الله عز وجل ورسوله، ما هذا! ألا فعلتم كما فعل الرجلان المؤمنان)). 

অর্থ: এই বর্ণনাটি কি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে যা উল্লেখিত হয়েছে তার পরিপন্থী নয়, যেখানে তিনি হযরতে ‘আমর ইবনুল আ’স (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঈমানদারির পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ.) নিজ ‘আল-মুসনাদ’ গ্রন্থে (১৭৮৪৩), ইমাম নাসাঈ (রহ.) আপন ‘আস্ সুনানুল কুবরা’ পুস্তকে (৮৩০১) এবং ইমাম ইবনু হিব্বান (৭০৯২) তাঁর কিতাবে – এঁদের সবাই মূসা ইবনু আলী ইবনু রাবাহ (রহ.)-এর ত্বরীক/সূত্রে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি হযরত আমর ইবনুল্ আ’স (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, যিনি বলেন:

মদীনায় (একবার) এক মহা আতঙ্ক দেখা দেয় এবং লোকেরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। আমি লক্ষ্য করি হযরত আবূ হুযায়ফাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম সালিম তাঁর তরবারি তুলে নিয়েছেন; তাঁকে এ রকম করতে দেখে আমিও আমার তরবারি তুলে নেই। এমন সময় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মাঝে বের হয়ে আসেন এবং বলেন, “ওহে লোক সকল, তোমাদের কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভয় থাকা উচিত নয়? এটা কী? এই দুইজন ঈমানদার যা করেছে, তোমরা কেন সে রকম করো নি?”

الجواب متروك لمن بتر الحديث؟!

অর্থ: এর (মানে এ প্রশ্নের) জবাব সেই ব্যক্তির প্রতি বর্তায়, যে হাদীস বিকৃত করে!

ওপরের আলোচনা দ্বারা এই বর্ণনার নিম্নের দুটি ইসনাদের প্রতি জবাবও প্রদত্ত হয়ে যায়, যেহেতু এগুলো একই ইসনাদে বর্ণিত – 

(ক) হযরত আমর ইবনুল আ’স (রা.)-এর হাদীস;

(খ) হযরত মুগীরাহ ইবনু শু’বাহ (রা.)-এর হাদীস।

হযরত বারা’আ ইবনু ’আযিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনা

ইমাম বুখারী (রহমতু্ল্লাহি আলাইহি) ‘আত্ তারীখুল কবীর’ গ্রন্থে (১/২৭৪), ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘আল-ঈলাল’ পুস্তকে (৩৮১), ইমাম ত্ববারানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘আল-আওসাত’ কিতাবে (৪/২০৮) বর্ণনা করেন সালামাহ ইবনুল্ ফযলের তরীক্ব/সূত্রে; তিনি মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক্ক হতে; তিনি সালামাহ ইবনে কুহাইল হতে; তিনি ইবরাহীম ইবনে বারা’আ ইবনে আযিব হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে। আবূ ঈসা তিরমিযী (রহ.) এই বর্ণনা সম্পর্কে বলেন, যা ‘আল-ঈলাল’ (৭১৪) পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে:

سألت محمداً عن هذا الحديث فقال: قد عرفته ولم أره يعرفه إلا من هذا الوجه. 

অর্থ: আমি মুহাম্মদকে এই বর্ণনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি এবং তিনি বলেন: “আমি এটা সম্পর্কে জানি, কিন্তু এই একটিমাত্র সূত্র ছাড়া তাঁর (মানে বর্ণনাকারীর) এ বর্ণনাটি জানার কোনো বিষয় আমার চোখে পড়েনি।” 

এটা ইমাম ইবনে আসাকির (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বর্ণনা করেছেন ‘তারীখু দিমাশক্ক’ (৫৯/২০৪) গ্রন্থে সালামাহ ইবনুল ফযলের সূত্রে; তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক হতে; তিনি ইবরাহীম ইবনুল বারা’আ ইবনু আযিব হতে; তিনি তাঁর পিতা হতে। এটা আরো বর্ণনা করেছেন আর্-রূয়্যানী নিজ ‘মুসনাদ’ (৩২৫) কিতাবে, আর এই বর্ণনাটির কিছু ত্রুটি বিদ্যমান:

১/ – এই ইসনাদে আছেন সালামাহ ইবনে ফযল আবূ আবদিল্লাহ আল-আবরাশ, যিনি দুর্বল রাবী/বর্ণনাকারী। তাঁর রয়েছে অনেক অসঙ্গতি ও অপরিচিত/বিরল বর্ণনা (وهو ضعيف الحديث له مناكير وغرائب)। আর তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক হতে কেবল ‘মাগাযী’ বিষয়ের অধীনে যা কিছু বর্ণনা করেছেন, স্রেফ তা-ই অন্যান্য বর্ণনা হতে শক্তিশালী, যদিও সার্বিকভাবে তাঁর বর্ণনাগুলো দুর্বল হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে (وإن كان حديثه ضعيف مطلقاً)।

২/ – আরবী পাঠ – في الإسناد عنعنة محمد بن إسحاق بن يسار المطلبي فقد وصف رحمه الله بالتدليس فإذا عنعن فإنه يتأنى في خيره لا سيما إذا كانت روايته في غير المغازي فإذا ثبت تدليسه رد خبره – মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক ইবনে ইয়াসারের  প্রত্যাখ্যাত ইসনাদ; উপরন্তু তাঁকে তাদলীস তথা হাদীস-সংক্রান্ত তথ্য গোপনকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে – আল্লাহ তাঁকে রহম করুন! তিনি যখন ‘আনআনা’ হিসেবে তা বর্ণনা করেন তখন তিনি তাদলীস সংঘটন করেন; বিশেষ করে মাগাযী বিষয়বহির্ভূত বর্ণনাগুলোতে। অতএব, তাঁর তাদলীস উপস্থিত থাকলে বর্ণনাগুলো প্রত্যাখ্যাত।

৩/ – এই ইসনাদে মিলের অযোগ্য অসংলগ্নতা, যেহেতু এটা এসেছে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক হতে, তিনি সালামাহ ইবনে কুহাইল হতে, তিনি ইবরাহীম ইবনে আল-বারা’আ হতে, তিনি আল-বারা’আ ইবনে আযিব হতে; এই বর্ণনা আরো এসেছে সালামাহ ইবনে কুহাইলের উল্লেখ ছাড়াই মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক হতে, তিনি ইবরাহীম ইবনে আল-বারা’আ হতে, তিনি তাঁর পিতা (আল-বারা’আ ইবনে আযিব) হতে। এই কারণেই ইমাম বুখারী ‘আত্ তারীখুল কবীর’ (১/২৭৪) গ্রন্থে বলেন:

يختلفون في إسناده.

অর্থ: এর ইসনাদ নিয়ে (মুহাদ্দেসীনের) মতপার্থক্য বিরাজমান। 

৪/ – ইবরাহীম ইবনে আল-বারা’আ ইবনে আ’যিব অপেক্ষাকৃত অপরিচিত বর্ণনাকারী; কেননা ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘আস্ সিক্বা’ত’ (৪/৬) গ্রন্থে ছাড়া অন্য কোনো মুহাদ্দীস-আলেমই তাঁকে সিক্বা/বিশ্বস্ত বলে প্রতিপাদন করেননি। ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘তারীখুল কবীর’ (১/২৭৪) ও ইমাম ইবনে আবী হা’তিম (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ’আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল’ (২/৮৯) কিতাবগুলোতে তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে চুপ থেকেছেন। আল-বুখারী ও ইবনে আবী হা’তিম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা)-এর নীরবতা কোনো কিছুকে গণনায় আনে না (যদিও)।

৫/ – এটা সালামাহ ইবনে কুহাইলের একক বর্ণনা ইবরাহীম ইবনে আল-বারা’আ হতে, আর শুধুমাত্র মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক-ই তাঁর কাছ থেকে এটা বর্ণনা করেছেন। ‘আতরাফুল গারাঈব ওয়াল্ আফরা’দ’ (২/২৮৫) পুস্তকে এটা লিপিবদ্ধ পাওয়া যায়:

حديث أن رسول الله جلس في قبة له الحديث تفرد به سلمة بن كهيل عنه وتفرد به عنه محمد بن إسحاق. وذكر للحديث متابعة عن البراء رواها نصر بن مزاحم في كتاب ((صفين)) (218) عن عبد الغفار بن القاسم عن عدي بن ثابت عن البراء بن عازب قال: أقبل أبو سفيان ومعه معاوية فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((اللهم ألعن التابع والمتبوع اللهم عليك بالأقيعس))، فقال ابن البراء لأبيه من: الأقيعس؟ قال: معاوية! وهذا لا يصح. نصر بن مزاحم متروك. 

অর্থ: ‘প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জন্যে (তৈরি) একটি তাঁবুতে বসেছিলেন’ মর্মে বর্ণনাটি কেবল সালামাহ ইবনে কুহায়ল বর্ণনা করেছেন, আর এটা তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন এককভাবে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ক। অপর একটি বর্ণনা এসেছে আল-বারা’আ হতে, যা বর্ণনা করেছেন নাসর ইবনে মুযা’হিম ‘সিফফীন’ শিরোনামের কিতাবে (২১৮) আবদুল গাফফার ইবনে আল-ক্কাসিম হতে, তিনি আদী ইবনে সা’বিত হতে, তিনি বারা’আ ইবনে আযিব (রা.) হতে, যিনি বলেন: আবূ সুফিয়ান আগমন করেন এবং তাঁর সাথে ছিলেন মু’য়াবিয়া; অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান: “হে আল্লাহ, অনুসরণকারীর প্রতি অভিসম্পাত দিন, আর যাকে অনুসরণ করা হচ্ছে তাকেও অভিসম্পাত দিন। হে আল্লাহ, সিনা উঁচুকারীর (বিরুদ্ধে) বিহিত (ব্যবস্থা) করুন!” এরপর ইবনে বারা’আ (রা.) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেন সিনা উঁচুকারী ব্যক্তিটি কে; আর তিনি উত্তর দেন, “মু’য়াবিয়া।” এই বর্ণনাটি সহীহ নয়, কেননা নাসর ইবনে মুযা’হিম হলেন মাতরূক/পরিত্যক্ত। 

(ক) আবূ হাতিম (রহ.) ‘আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল’ (৮/৪৬৮) গ্রন্থে বলেন – واهي الحديث، متروك الحديث لا يكتب حديثه – অতি দুর্বল; তাঁর বর্ণনাগুলো পরিত্যক্ত, লিপিবদ্ধ করা যাবে না।

(খ) আবূ জা’ফর উকায়লী ‘আদ্ দু’আফা’ (৪/৩০০) পুস্তকে বলেন – كان يذهب إلى التشيع وفي حديث اضطراب وخطأ كثير – তিনি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হন; তাঁর বর্ণনাগুলোতে অনেক ভুল-ভ্রান্তির পাশাপাশি রয়েছে অসংলগ্নতাও।”

(গ) আল-জুযাজানী ‘আশ্ শাজারাতু ফী আহওয়ালির্ রিজা’ল’ (জীবনী নং ১০৯) বইয়ে বলেন – كان زائغاً عن الحق مائلاً – তিনি সত্য থেকে বিচ্যুত হতেন এবং (শিয়া মতবাদের দিকে) ঝুঁকেছিলেন। 

(ঘ) আবূ খায়সামাহ বলেন – كان كذاباً – তিনি ডাহা মিথ্যুক। [দেখুন লিসানুল মীযান, ৩/২৬৭]

(ঙ) ইয়াহইয়া বলেন – ليس حديث بشيء – তাঁর বর্ণনাগুলো মূল্যহীন। [প্রাগুক্ত লিসানুল মীযান, ৩/২৬৭]

(চ) আদ্ দারু কুতনী বলেন – ضعيف – দুর্বল। [প্রাগুক্ত লিসানুল মীযান, ৩/২৬৭]

(ছ) সালিহ ইবনে মুহাম্মদ বলেন – روى عنه الضعفاء أحاديث مناكير – তিনি দুর্বল বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন; প্রত্যাখ্যাত বর্ণনাসমূহ (যা সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক)। [প্রাগুক্ত লিসানুল মীযান, ৩/২৬৭]

(জ) আবূল ফাতহ আল-আযদী বলেন – كان غالياً في مذهبه غير محمود في حديثه – তিনি নিজ মাযহাবে চরমপন্থী ছিলেন; বর্ণনার ক্ষেত্রে (মোটেও) প্রশংসনীয় নন। [প্রাগুক্ত লিসানুল মীযান, ৩/২৬৭]

(ঝ) আয্ যাহাবী ‘মীযানুল ই’তিদা’ল’ (৪/২৫৩) কিতাবে বলেন – (تركوه) – তাঁকে (মানে তাঁর বর্ণনাগুলোকে) বাদ দেওয়া হয়েছে। 

আল-মালিকী বলেছেন:

وثقه ابن حبان ووثقه ابن أبي حديد وترجم له الخطيب البغدادي أقول ثم ماذا؟!

অর্থ: তাঁকে (ইবনে ইসহাক্ককে) ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সিক্কাত তথা সত্যায়ন করেছেন এবং (এর পাশাপাশি) ইবনে আবী আল-হাদীদ ও আল-খতীবও তাঁর জীবনীমূলক বিবরণের উল্লেখ করেছেন। 

আমি (আস্ সুবাঈ) বলি: এরপরে কী? ইমাম ইবনে হিব্বান (নিজ ‘আস্ সিক্কাত’ ৯/২১৫ গ্রন্থে) ছাড়া অন্যান্য আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল (মানে হাদীস বর্ণনাকারীদের যাচাইকারী) উলামাবৃন্দ ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণা করেছেন যে তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো মাতরূক/পরিত্যক্ত। অধিকন্তু, ইমাম ইবনে হিব্বান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কখনো কখনো হাদীস বর্ণনাকারীদের সত্যতা প্রতিপাদনের প্রশ্নে নমনীয় হিসেবে জ্ঞাত। তাহলে অন্যান্য এ সকল মুহাদ্দিস ইমাম যখন তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তখন অবস্থা কী হতে পারে? [নোট: ইমাম ইবনে হিব্বানের এতদসংক্রান্ত নমনীয়তার ব্যাপারে জানতে দেখুন – ইবনে আবদুল হাদী কৃত ‘আস্ সা’রিমুল মানকী’, ১০৪ পৃষ্ঠা; মীযানুল ই’তিদা’ল’, ৩/১৭৫; ‘লিসা’নুল মীযান,’ ১/২০৮; এবং আবদুর রহমান মু’আল্লিমি রচিত ‘আত্ তানকীল’, ১/৪৩৭]

ইবনে আবী আল-হাদীদ প্রসঙ্গে (বলবো), তিনি হলেন ইযযুদ্দীন আবদুল হামীদ ইবনে আবী হুসাইন আল-মাদা’ইনী (মৃত্যু: ৬৫৫ হিজরী), যিনি ‘শরহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থের রচয়িতা এবং যিনি বিদ’আতী প্রবক্তাদের অন্যতম ছিলেন, আর ইসলাম ধর্মের বিনাশ সাধনের অন্বেষণকারীদেরও একজন ছিলেন। [নোট: আল-মু’আল্লিমি তাঁর সম্পর্কে কী লিখেছেন তা জানতে দেখুন – ‘আল-আনওয়ারুল কাশিফাহ,’ ১৫২ পৃষ্ঠা]

وترجمة الخطيب البغدادي له لا تغني شيئاً، وعبد الغفار بن القاسم أبو مريم الأنصاري رافضي وضاع.

অর্থ: ইমাম খতীব আল-বাগদাদী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) যে জীবনীমূলক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেছেন, তা বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততার (পক্ষে) কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না; আর (এই ইসনাদে বিরাজমান) আবদুল গাফফার ইবনুল ক্কাসিম আবূ মরিয়ম আল-আনসারী একজন রাফেযী শিয়া ও হাদীস জালকারী।

(১) আলী ইবনে আল-মাদীনী বলেন – كان يضع الحديث – “তিনি হাদীস জাল করতেন।”

(২) ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন – ليس بشيء – “কোনো মূল্য নেই।” [তারীখু ইবনু মাঈন, ৩/৩৬৬; আল-দূরী’র বর্ণনা]

(৩) ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন – عبد الغفار بن القاسم بن قيس بن فهد ليس بالقوي عندهم – “আবদুল গাফফার ইবনুল ক্কাসিম ইবনু ক্কায়স্ ইবনু ফাহদ হাদীসশাস্ত্রের উলামাবৃন্দের দ্বারা শক্তিশালী বলে বিবেচিত নন।” [আত্ তারীখুল কবীর, ৬/১২২]

(৪) ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন -سمعت شعبة سمعت سماكاً الحنفي يقول لأبي مريم في شيء ذكره كذبت والله، قال أبو داود: وأنا أشهد أن أبا مريم كذاب لأني قد لقيته وسمعت منه واسمه عبد الغفار بن القاسم. وعامة حديثه بواطيل قال أحمد كان أبو مريم يحدث ببلايا في عثمان – “আমি শুনেছি শু’বাহ হতে, যিনি বলেছেন, আমি শুনেছি সিমা’ক আল-হানাফীকে আবূ মরিয়মের প্রতি তারই কোনো কথা প্রসঙ্গে এ কথা বলতে, ‘আল্লাহর কসম, তুমি মিথ্যে বলেছো!’ আর আমি (ইমাম আবূ দাউদ) সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আবূ মরিয়ম নিশ্চয় এক ডাহা মিথ্যুক, কেননা আমি তার সাক্ষাৎ পেয়েছি এবং তার থেকে (বর্ণনা) শুনেছি। তার নাম আবদুল গাফফার ইবনুল ক্কাসিম। তার বেশির ভাগ বর্ণনাই ভিত্তিহীন। ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন যে আবূ মরিয়ম (সাধারণত) খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বালা/মসীবত সম্পর্কেই বর্ণনা করতো। [আদ্ দু’আফা আল-কবীর, ৩/১০১]

(৫) সর্ব-ইমাম আবূ হাতিম ও নাসাঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) এবং অন্যান্যরা বলেন – متروك  الحديث – “তিনি মাতরূক/পরিত্যক্ত।” [আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল, ৬/৫৩]

(৬) আল-আ’জুর্রী বলেন যে তিনি ইমাম আবূ দাউদ (রহ.)-কে তাঁর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন আর তিনি উত্তর দিয়েছেন – كان يضع الحديث – “সে হাদীস জাল করতো।” [লিসানুল মীযান, ২/২২৬]

(৭) আদ্ দারাকুতনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন – متروك – “পরিত্যক্ত।” 

(৮) আস্ সা’জী, আল-উক্কায়লী, ইবনুজ্ জা’রূদ ও ইবনু শা’হীন তাঁকে দুর্বল বর্ণনাকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এখন আল-মা’লিকীর একাডেমিক দেউলিয়াত্ব দেখুন যা তাঁর নিম্নলিখিত বিবৃতিতে পরিস্ফুট:

((فالصواب فيه والله أعلم هو القبول في المتابعات والشواهد فقط لثلاثة أسباب))!: 1 ـ توثيق بعضهم له وإن كانوا قلة.

অর্থ: “অতঃপর তাঁর ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি (আল্লাহই ভালো জানেন) এই যে, তিনি কেবল (অন্যদের) অনুসরণমূলক ও (অন্যদের প্রতি) সমর্থনসূচক (সাক্ষ্যসম্বলিত) বর্ণনাসমূহের ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য; আর তা তিনটি কারণে: (১) সংখ্যায় কম হলেও কিছু আলেম তাঁকে সিক্কা সাব্যস্ত তথা অনুমোদন করেছিলেন…।”

أقول لم يوثقه أحد إلا ابن عقد ومن ابن عقدة؟! وما مكانته في علم الجرح والتعديل!

আমি (আস্ সুবাঈ) বলি: ইবনে উকদাহ (আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সাঈদ ইবনে উকদাহ) ছাড়া তাঁদের কেউই তাকে সিক্কা সাব্যস্ত বা অনুমোদন করেননি। এই ইবনে উকদাহ কে এবং আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল তথা (হাদীস) বর্ণনাকারীদের যাচাইকারক বিদ্যাশাস্ত্রে তাঁর মর্যাদাই বা কী?

(ক) ইবনে আবদা’ন বলেন – ابن عقدة قد خرج عن معاني أصحاب الحديث فلا يذكر معهم – ইবনু উকদাহ হাদীসবিদমণ্ডলীর (সার্বিক) সংজ্ঞার বাইরে অবস্থানরত; এবং তাঁকে তাঁদের সাথে স্মরণ করা অনুচিত।

(খ) হামযাহ আস্ সাহমী বলেন – سألت أبا بكر بن عبدان عن ابن عقدة إذا نقل شيئاً في الجرح والتعديل هل يقبل قوله؟ قال: لا يقبل – আমি আবূ বকর ইবনে আবদা’নকে ইবনে উকদাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি এ মর্মে যে, যদি তাঁর কাছ থেকে আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল তথা (হাদীস) বর্ণনাকারীদের যাচাইমূলক কোনো কিছু বর্ণিত হয় তবে তা কি গৃহীত হবে। তিনি উত্তর দেন, “না, তা গৃহীত হবে না।” [তাযকিরাতুল হুফফায, ৩/৮২২]

(গ) আদ্ দারুকুতনী (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন – كان رجل سوء، وانظر ((الكامل في الضعفاء)) 327/5 – সে একজন মন্দ লোক ছিলো। [আরো দেখুন ‘আল-কামিল ফীদ্ দু’আফা’ (৫/৩২৭)]।

(ঘ) আল-বারকানী বলেন – سألت الدار قطني أيش أكثر ما في نفسك عن ابن عقدة قال: الإكثار بالمناكير – আমি আদ্ দারুকুতনীকে জিজ্ঞেস করি, আপনার (সত্তার) মাঝে ইবনে উকদাহর ব্যাপারে কী বেশি নিহিত আছে? তিনি উত্তর দেন, “অতিরিক্ত নিন্দা।”

(ঙ) ইবনে আবদিল হাদী ‘আত্ তানকীহ’ গ্রন্থে বলেন – كان مجمع الغرائب والمناكير – তিনি গরীব তথা একক/বিরল ও প্রত্যাখ্যাত (দুর্বল) বর্ণনাগুলোর সংকলনকারী ছিলেন।

(চ) ইমাম যাহাবী ‘সিয়্যারু আলামিন্ নুবালা’ (১৫/১৪২) গ্রন্থে বলেন – وكتب عمن دب ودرج من الكبار والصغار والمجاهيل وجمع الغث إلى السمين – “তিনি যুবক, বৃদ্ধ ও অপরিচিতদের কাছ থেকে বর্ণনাসমূহ লিপিবদ্ধ করতেন এবং চর্বিহীন ও চর্বিযুক্ত সংগ্রহ করতেন, মানে বিচার-বিবেচনা ছাড়া সব ধরনের বর্ণনাই গ্রহণ করতেন।” ইমাম যাহাবী ‘আল-মীযানুল ই’তিদাল’ (১/১২৮) পুস্তকে আরো বলেন – ابن عقدة وابن خراش فيهما رفض وبدعة – ইবনে উকদাহ ও ইবনে খার্রাশ হচ্ছে রাফেযী শিয়া এবং বিদ’আতী। [আরো দেখুন আত্ তানকীল, ১/১৭০] 

 2ـ أقول لتضعيف أهل الحديث له لأنه يضع الحديث وليس لأنه من أهل البدع كما ذكر المالكي عن الإمام أحمد وأبي حاتم الرازي.

দ্বিতীয়তঃ আমি (শাইখ সুবাঈ) বলি, মুহাদ্দেসীন উলামা কর্তৃক তাঁকে দুর্বল বিবেচনা করার কারণ তিনি হাদীস জাল করতেন; আর তা তাঁর বিদ’আতের কারণে নয়, যা আল-মালিকী দাবি করেছেন সর্ব-ইমাম আহমদ হাম্বল ও আবূ হাতিম আর্ রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা)-এর সূত্রে।

(ক) আলী ইবনুল মাদীনী বলেন – كان يضع الحديث – তিনি হাদীস জাল করতেন। [দেখুন – আল-কামিলু ফীদ্ দু’আফা-ই; ৫/৩২৭]

(খ) আল-আজুর্রী বলেন – سألت أبا داود عنه فقال كان يضع الحديث – আমি ইমাম আবূ দাউদ (রহ.)-কে তাঁর (ইবনে উকদাহ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবং তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তিনি হাদীস জাল করতেন।” [দেখুন – লিসা’নুল মীযা’ন, ২/২২৮]

3 ـ وهذا الحديث شاهد فقط فهو من الأحاديث الصالحة التي تحدث عنها ابن عدي.

তৃতীয়তঃ এই হাদীসটির কেবল একটি সমর্থনকারী বর্ণনা রয়েছে, আর সেটা ইবনে আদী কর্তৃক উদ্ধৃত গ্রহণযোগ্য হাদীসগুলোর মধ্যে একটি। 

আমি (শাইখ আস্ সুবাঈ) বলি, ইবনে আদী ‘আল-কামিলু ফীদ্ দু’আফা-ই’ (৫/৩২৮) গ্রন্থে বিবৃত করেন: 

((وفي أحاديثه ما لا يتابع عليه)). وهذا منها.

অর্থ: “তাঁর হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেক অসমর্থিত বর্ণনা।” আর এটা সেগুলোরই একটা।

4 ـ وقد روى عنه شعبة وقتادة وهما من الحفاظ، والجواب على هذا من ثلاثة أوجه: 

চতুর্থতঃ শু’বাহ ও কাতাদাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন; আর তাঁরা দু জন (প্রাথমিক যুগের) হাফিযবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত। এর জবাব তিন দিক থেকে দেয়া যায়:

(ক) শু’বাহ (রহ.) আবদুল গাফফার ইবনুল কাসিম আবূ মরিয়ম আনসারী হতে কোনো হাদীস বর্ণনা করেননি, কেবল দুটি ছাড়া। প্রথম হাদীসটি শু’বাহ (রহ.) বর্ণনা করেন তাঁর থেকে, তিনি ইমাম নাফিঈ (রহ.) হতে, তিনি হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে; আর দ্বিতীয় হাদীসটি আতা’ (রহ.) হতে, তিনি হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে। 

(খ) শু’বাহ (রহ.) স্রেফ তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছিলেন তাঁর অবস্থা প্রকাশ পাওয়ার আগে। যখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তিনি হাদীস জাল করছেন, তৎক্ষণাৎ শু’বাহ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা ত্যাগ করেন। আদ্ দারুকুতনী (রহ.) ‘লিসা’নুল মীযা’ন’ (২/২২৮) গ্রন্থে বলেন:

متروك الحديث وهو شيخ شعبة أثني عليه شعبة وخفي على شعبة أمره فبقى بعد شعبة فخلط وقال أبو داود: غلط في أمره شعبة.

অর্থ: হাদীসশাস্ত্রে তিনি পরিত্যক্ত/মাতরূক; এবং তিনি শু’বাহ (রহ.)-এর শিক্ষক ছিলেন। শু’বাহ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন, তবে তাঁর অবস্থা শু’বাহ হতে আড়াল ছিলো; তিনি শু’বাহ (রহ.)-এর পরেও ছিলেন আর বর্ণনাগুলোতে তালগোল পাকাতেন।” ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) বলেন, “শু’বাহ তাঁর ব্যাপারে ভুল করেছিলেন” [দেখুন – লিসানুল মীযান, ২/২২৮ ও সু’য়ালাতুল বারকানী, ৩১৬]। আবূ জা’ফর উকাইলী (রহ.) ‘আদ্ দু’আফা’ (৩/৮৫২) গ্রন্থে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে বর্ণনা করেন – شعبة عرفه قديماً كان يقول: إنما كان ما نزله به  بعد – “শু’বাহ তাঁকে অনেক আগে থেকেই চিনতেন, তবে তাঁর ক্ষেত্রে যা ঘটেছিলো (মানে হাদীস জাল) তা পরের ঘটনা।”

(গ) কাতাদাহ (রহ.) তাঁর থেকে বর্ণনা করার ব্যাপারে আমি (শাইখ সুবাঈ) বলি, বিপরীতটা-ই সত্য। তিনি বরং কাতাদাহ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন [আল-কামিল, ৫/৩২৮]। এর আরবী লিপি নিম্নরূপ:

وقد روى عنه قتادة! أقول العكس وهو الصحيح روى هو عن قتادة!!

আ’সিম আল-লায়সী হতে বর্ণিত হাদীস

ইমাম তবারানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর ‘আল-মু’জামুল কবীর’ (১৭/১৭৬) গ্রন্থে বর্ণনা করেন:

حدثنا العباس بن الفضل الأسفاطي ثنا موسى بن إسماعيل ح وحدثنا عبد الرحمن بن الحسين العابوري التستري ثنا عقبة بن سنان الدارع قالا ثنا غسان بن مضر عن سعيد بن يزيد أبي مسلمة عن نصر بن عاصم الليثي عن أبيه قال: دخلت مسجد المدينة فإذا الناس يقولون نعوذ بالله من غضب الله وغضب رسوله، قال قلت: ماذا، قالوا: كان رسول الله يخطب على منبره فقام رجل فأخذ بيد أبنه فأخرجه من المسجد، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم لعن الله القائد والمقود ويل لهذه الأمة من فلان ذي الاستاه. 

অর্থ: আল-আব্বাস ইবনুল ফযল আল-আসফাতী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, মূসা ইবনু ইসমাঈল আমাদের কাছে এবং আবদুর রহমান ইবনুল হুসাইন আল-আবূরী আত্ তুসতুরীর কাছে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, উক্ববাহ ইবনু সিনান আদ্ দারী – তাঁরা দু জনই বলেছেন, গাসসান ইবনু মুদার আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন নাসর ইবনু আসিম আল্ লায়সী হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, যিনি বলেন, “আমি মদীনার মসজিদে (নববীতে) প্রবেশ করলাম আর তখন অকস্মাৎ মানুষেরা বলতে লাগলেন, ‘আমরা আল্লাহতায়ালার ক্রোধ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্রোধ হতে পানাহ চাই।’ (অতঃপর) আমি বল্লাম, ‘এটা কী?’ তাঁরা বল্লেন, ‘রাসূলে খোদা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মিম্বরে খুতবাহ দিচ্ছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে তার ছেলের হাত ধরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বলেন, আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত পড়ুক তার ওপর, যে (বাহন) পরিচালনা করে এবং যে (বাহনে) পরিচালিত হয়; এই উম্মতের জন্যে দুঃখ অমুকের তরফ হতে, যার (বাহনের) পেছনটা দীর্ঘ (মানে অনুসারীবর্গ দলে ভারী)।”

ইবনু আবী আসিম এটা সংক্ষিপ্ত আকারে ‘আল-আহাদ ওয়াল-মাসানী’ (৯৩৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেন; আর ইবনু আবদুল্ বার্র অনুরূপ শব্দচয়নে বর্ণনা করেন ‘আল-ইস্তিয়াব’ (৫৭৫) পুস্তকে। তবে হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর কোনো রকম উল্লেখই এতে নেই (وليس لمعاوية فيه ذكر)। 

কিছু সংখ্যক আলেম-উলামার মতানুযায়ী, আবূ নাসর আসিম ইবনু আমর লায়সী কোনো সাহাবী নন। ইবনু আবদুল বার্র নিজ ‘আল-ইস্তিয়াব’ (৫৭৫) কিতাবে বলেন:

قال أحمد: لا أدري أسمع عاصم هذا عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أم لا؟!

অর্থ: ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ.) বলেছেন, আমি নিশ্চিত নই আসিম এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে (আদৌ) শুনেছিলেন কি-না!

আল-ইসাবাহ (৩/৫৭৪) গ্রন্থে ইমাম বাগাভী (রহ.) বলেন:

ولا أدري له صحبة أم لا؟

অর্থ: আমি নিশ্চিত নই তিনি (মানে আসিম) (আদৌ) সাহাবী কি-না?

অধিকন্তু, এই বর্ণনাটি আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে স্পষ্টভাবে লা’নত বা অভিসম্পাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে উদ্দেশ্য করে না। এর সাথে যোগ হয়েছে হাদীসের মতন বা লিপিটি মুনকার তথা প্রত্যাখ্যাত; আর এটা অসঙ্গতিপূর্ণ এ কারণে যে এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সকল মুসলমানের প্রতি দুর্বলতা আরোপ করে, যদি এ বর্ণনাটিকে সমর্থনকারী ব্যক্তির বোধশক্তি থেকে থাকে!

ইবনে তাইমিয়া ‘মিনহাজুস্ সুন্নাতিন্ নববীয়্যাহ’ (৪/৪৪৫) গ্রন্থে বলেন:

إن خطب النبي ﷺ لم تكن واحدة، بل كان يخطب في الجمع والأعياد والحج وغير ذلك، ومعاوية وأبواه يشهدان الخطب كما يشهدها المسلمون كلهم، أفتراهما في كل خطبة كانا يقومان ويمكنان من ذلك؟! هذا قدح في النبي ﷺ وفي سائر المسلمين إذ يمكنون اثنين دائما يقومان ولا يحضران الخطبة ولا الجمعة وإن كانا يشهدان كل خطبة فما بالهما يمتنعان عن سماع خطبة واحدة قبل أن يتكلم بها؟!   

অর্থ: “নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খুতবাহ একাধিক ছিলো। বরঞ্চ তিনি জুমু’আহ, ঈদ, হজ্জ্ব ইত্যাদি দিবসে খুতবাহ দিতেন। আমীরে মু’য়াবিয়া ও তাঁর পিতা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) অন্যান্য সকল মুসলমানের মতোই তাতে যোগ দিতেন। এই কথা কি ধারণা করা যায় যে তাঁরা এ রকম প্রতিটি ধর্মসভায় উঠে দাঁড়িয়ে স্থান ত্যাগ করতেন এবং ইচ্ছানুযায়ী তা করার বেলায় তাঁরা স্বাধীন ছিলেন? 

“এটা নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সকল মুসলমানের প্রতি মারাত্মক সন্দেহ আরোপ করে, যেহেতু ওই দু জনকে উঠে দাঁড়িয়ে খুতবাহ-স্থল ত্যাগ হতে তাঁরা ফেরাতে পারেননি। আর যদি ওই দু জন সত্যিসত্যি খুতবাহ শুনতে ধর্মসভায় যোগ দিতেন, তাহলে কোনো একটি বিশেষ খুতবাহ পেশের আগে তাঁরা তা কেনই বা শুনতে চাইবেন না?” [ইবনে তাইমিয়া, মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ৪/৪৪৫]

হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু))-এর বর্ণনা

এই বর্ণনাটি এসেছে নাসর ইবনে মুযা’হিম হতে ‘সিফফীন’ শীর্ষক পুস্তকে (২২০), যা তলীদ ইবনে সুলাইমানের তরীক বা সূত্রে, তিনি আল-আ’মাশ হতে, তিনি আলী ইবনুল আক্বমার হতে, যিনি বলেন:

وفدنا على معاوية وقضينا حوائجنا ثم قلنا لو مررنا برجل قد شهد رسول الله ﷺ وعاينه فأتينا عبد الله بن عمر فقلنا: … وفيه (فنظر رسول الله ﷺ إلى أبي سفيان ومعاوية وأخوه أحدهما قائد والآخر سائق قال: ((اللهم ألعن القائد والسائق والراكب)). قلنا: أنت سمعت رسول الله ﷺ؟ قال: نعم وإلا فصمتا أذناي كما عميت عيناي). 

অর্থ: আমরা এক প্রতিনিধিদল হিসেবে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাই; অতঃপর আমাদের কাজ সম্পন্ন করে আমরা বলি, চলুন, এমন কারো সাথে দেখা করি, যিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীর সময় উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁকে দেখেছিলেন। তাই আমরা হযরতে ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে দেখা করি…আর তাঁকে জিজ্ঞেস করি: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবূ সুফিয়ান, মু’য়াবিয়াহ ও তাঁর ভাইয়ের দিকে তাকান, (যখন) তাঁদের একজন উটকে (সামনে থেকে টেনে) পরিচালনা করছিলেন, আর অপরজন পেছন থেকে (কিছু একটার সাহায্যে) তাড়া দিচ্ছিলেন; প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘হে আল্লাহ, (উটের) পরিচালনাকারী, সওয়ারী ও তাড়া দাতাকে লা’নত দিন।’ আমরা তাঁকে (ইবনে উমরকে) জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি এ কথা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে শুনেছেন?’ তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, নতুবা আমার কান বধির হয়ে যাক, যেমনিভাবে আমার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে!’ 

এই বর্ণনায় (ইসনাদে) রয়েছে রাফেযী শিয়া নাসর ইবনে মুযা’হিম, যাকে মাতরূক আল-হাদীস তথা হাদীসশাস্ত্রে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং তার দুর্বলতা সম্পর্কে আজ্ জারহু ওয়াত্ তা‘দীল বা হাদীসশাস্ত্রজ্ঞবৃন্দের মতামত ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

তালীদ ইবনে সুলাইমান হচ্ছে আল-মুহা’রিবী আল-কুফী (মানে কুফাবাসী)।  

(ক) আবূ জা’ফর উকায়লী (রহ.) ‘আল-দু’আফা’ (১/১৫৫) গ্রন্থে বলেন – قال أحمد ويحيى: كان كذاباً – “সর্ব-ইমাম আহমদ হাম্বল ও ইয়াহইয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) দু জনই বলেছেন সে একজন মিথ্যুক!”

(খ) আরেকটি বর্ণনায় ইয়াহইয়া (রহ.) বলেন – ليس بشيء كان يشتم عثمان أو أحداً من الصحابة فهو دجال – “কোনো কিছুর যোগ্য নয়; সে খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কিংবা সাহাবা কেরাম (রা.)-এর মধ্যে কোনো একজনের প্রতি অপমানজনক কথা উচ্চারণ করতো; সে একজন দজ্জাল!” [তারীখু ইবনু মা’ঈন, ২/২৮৫; ৩/৫৪৬]

(গ) সর্ব-ইমাম নাসাঈ ও আদ্ দারু কুতনী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) দু জনই বলেছেন – ضعيف – “সে দুর্বল।”

(ঘ) ইবরাহীম (রহ.) বলেন – وهو عندي كان يكذب – “আমার মতে সে ছিলো একজন মিথ্যুক!” [আহওয়ালুর্ রিজা’ল, জীবনী নং ৯৩]

(ঙ) সালিহ জাযারাহ বলেন – كان أهل الحديث يسمونه بليدا لا يحتج بحديثه – “মুহাদ্দীসবৃন্দ তাকে তালীদের পরিবর্তে ‘বালীদ’ মানে বোকা/মূর্খ নামে ডাকতেন; তার বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।”

(চ) ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ (২/৮৬) গ্রন্থে বলেন – ((وبين على روايته أنه ضعيف)) – “তার রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলো হতে এটা স্পষ্ট সে (খুবই) দুর্বল।”

(ছ) আল-সাজী বলেন – كذاب – “ডাহা মিথ্যুক!”

(জ) ইমাম ইবনু হিব্বান (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘আল-মাজরূহীন’ (১/২০৪) পুস্তকে বলেন – وروى في فضائل أهل البيت عجائب – “আহলে বাইত (রা.)-বৃন্দের ফযায়েল তথা গুণাবলী সম্পর্কে সে আজব (মানে আজগুবি) সব বর্ণনা পেশ করেছে।” 

(ঝ) ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মানাকীব অধ্যায়ে তার একটি মাত্র বর্ণনা এনেছেন।

(ঞ) আল-মারওয়াযী (রহ.) ইমাম আহমদ হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হতে বর্ণনা করেন – كان يتشيع ولم ير به بأساً – “সে শিয়া মতবাদী ছিলো, আর তার মাঝে কোনো ক্ষতি দৃশ্যমান হয়নি।” ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) আরো বলেন – كتبت عنه حديثاً كثيراً عن أبي الجحاف – “আমি আবূজ্ জাহাফের সূত্রে তার অনেকগুলো হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি।”

أقول: ولعل الإمام أحمد ذكر هذا قبل أن يتبين له حاله. لأنه في رواية أخرى عنه قال: هو عندي كان يكذب.

অর্থ: আমি (শাইখ আস্ সুবাঈ) বলি, হয়তো ইমাম আহমদ (রহ.)-এর কাছে তার অবস্থা স্পষ্ট হওয়ার আগেই তিনি (ওপরের) মন্তব্য করেছিলেন; কেননা আরেকটি বর্ণনায় ইমাম আহমদ (রহ.)-এর দৃষ্টিতে সে মিথ্যুক সাব্যস্ত হয়েছে।

(ত) আল-ঈজলী বলেন – لا بأس به كان يتشيع ويدلس – “তার মধ্যে ক্ষতি নেই, যদিও সে শিয়া মতবাদী ছিলো এবং তাদলীস তথা বর্ণনাকারীদের তথ্য গোপন করতো।” তবে আল-ঈজলীকে সে সকল মুহাদ্দীসের একজন বিবেচনা করা হতো, যিনি বর্ণনাকারীদেরকে সিক্বা/বিশ্বস্ত সাব্যস্ত করার বেলায় অধিকতর উদার ছিলেন (و العجلي متساهل في التوثيق)।

(থ) আল-হাকিম আবূ সাঈদ নাক্কাশ বলেন – رديء المذهب منكر الحديث روى عن أبي الجحاف أحاديث موضوعه كما في  – ((تهذيب التهذيب)) 1/257 “বদ মাযহাবী, মুনকারে হাদীস, আবূজ্ জাহাফের সূত্রে সে অনেক জাল হাদীস বর্ণনা করেছে, যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে ‘তাহযীবুত্ তাহযীব’ (১/২৫৭) পুস্তকে।” 

এসব (প্রমাণ) থেকে স্পষ্ট হয় যে এই ব্যক্তি (তালীদ ইবনে সুলাইমান কুফী) একজন মিথ্যুক ও জাল হাদীস প্রস্তুতকারী; তার এ দুর্বলতা কেবল আপন বদ-মাযহাবের কারণে নয়, বরং নিজ মিথ্যেচারিতার কারণেই।

অতএব, এই বর্ণনা এক জালকারী হতে এসেছে, যে এমন একজন বর্ণনাকারীর বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করেছিলো যাকে ‘মাতরূক আল-হাদীস’ বা হাদীসশাস্ত্রে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলো!

অধিকন্তু, হযরতে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর সমালোচনা হতে সবচেয়ে দূরবর্তী ব্যক্তিত্ব; আর তিনি তাঁদের মানাক্বীব তথা গুণাবলীর প্রচুর প্রশংসা করতেন; আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর জন্যে তাঁর প্রশংসা ছিলো সর্বজনজ্ঞাত ও প্রমাণিত। তিনি বলেন:

ما رأيت بعد رسول الله ﷺ أسود من معاوية قيل له: ولا أبو بكر وعمر؟ فقال: كان أبو بكر وعمر خيرا منه وما رأيت بعد رسول الله ﷺ أسود من معاوية.   

অর্থ: ‘প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর চেয়ে অধিকতর দক্ষ শাসক আমি আর দেখি নি।’ তাঁকে (ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে) প্রশ্ন করা হয়: ‘সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তা নন কি?’ তিনি উত্তর দেন, ‘তাঁরা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিলেন, কিন্তু আমি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর চেয়ে অধিকতর দক্ষ শাসক আর দেখি নি।’ [দেখুন – মিনহাজুস্ সুন্নাতিন্ নববীয়্যাহ, ৪/৪৪৫]

এটা বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনু আসাকির ‘তারীখু দিমাশক্ব’ (৫৯/১৭৩) গ্রন্থে; আল-লা’লাকাঈ ‘শরহুস্ সুন্নাহ’ (২৭৮১) পুস্তকে; এবং আল-খাল্লাল ‘আস্ সুন্নাহ’ (১/৪৪৩) কিতাবে। ইমাম বুখারী (রহ.) কর্তৃক ‘তারীখুল কবীর’ (৭/৩২৭) ও (২/৪৪২) পুস্তকে, ইবনু আদী কর্তৃক ‘আল-কামিল’ (৬/১১০) গ্রন্থে, এবং ইমাম ইবনু আসাকির কর্তৃক ‘তারীখু দিমাশক্ব’ (৫৯/১৭৪) কিতাবে ইমাম নাফেঈ (রহ.)-এর তরীক্ব/সূত্রে হযরত ইবনু উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে গৃহীত অপর এক বর্ণনাও এটাকে সমর্থন দেয়। আরো দেখুন ‘সিয়্যারু আলামিন্ নুবালা’ শীর্ষক পুস্তক (৩/১৫৩)। অতএব, এ বর্ণনা হাসান (নির্ভরযোগ্য)।

হযরত মুহা’জির ইবনে ক্বুনফুয (রা:)-এর বর্ণনা

আল-মালিকী বলেন:

মুহাজির (রা.)-এর ‘মুসনাদ’ ইমাম তবরানী (রহ.)-এর ‘মু’জাম গ্রন্থের ওইসব অংশে ছিলো, যা হারিয়ে গিয়েছে। অতএব, আমি এই ইসনাদের ব্যাপারে কোনো হুকুম দিতে পারবো না। কিন্তু এই ইসনাদটি সম্পূরক যা মূল হাদীসকে শক্তিশালী করেছে, বিশেষ করে আল-হায়সামী (রহ.)-এর সিক্বা তথা সত্যতা প্রতিপাদনকে। [আস্ সুহবাতু ওয়াস্ সাহাবাহ, ২০২ পৃষ্ঠা]

আমি (শাইখ সুবাঈ) বলি: আল-মু’জামুল কবীর (২০/২৩০) গ্রন্থে ইমাম তবরানী (রহ.) বলেন –

حدثنا المقدام بن داود حدثنا أسد بن موسى حدثنا أبو معاوية محمد بن خازم عن إسماعيل بن مسلم عن الحسن عن المهاجر بن قنفذ قال: رأى رسول الله ﷺ ثلاثة على بعير فقال: الثالث ملعون. 

অর্থ: আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আল-মিক্বদাম ইবনে দাউদ; তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আসাদ ইবনু মূসা; তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবূ মু’য়াবিয়াহ মুহাম্মদ ইবনু কাযিম – হাসান হতে, তিনি মুহাজির ইবনু কুনফুয (রা.) হতে, যিনি বলেন যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিন ব্যক্তিকে উটের পিঠে চড়তে দেখতে পান এবং বলেন, “তৃতীয় জন লা’নতপ্রাপ্ত/অভিশপ্ত।”

মু’জামুস্ সাহাবাহ (৩/৬০) গ্রন্থে হাসান ইবনু আলী আল-আনযী বলেন যে আবূ কুরাইব আমাদের কাছে একই বর্ণনা পেশ করেছেন। এই ইসনাদের রয়েছে দুটো ত্রুটি:

(ক) – إسماعيل بن مسلم المكي متروك الحديث – ইসমাঈল ইবনু মুসলিম আল-মক্কী হাদীসশাস্ত্রে প্রত্যাখ্যাত।

(খ) – الحسن بن أبي الحسن البصري لم يسمع من المهاجر بن قنفذ وإنما يروي عنه بواسطة حضين بن المنذر القرشي – আল-হাসান ইবনুল হাসান আল-বসরী শুনতে পাননি মুহাজির ইবনু কুনফুয (রা.) হতে; বরঞ্চ তিনি হুদাইন ইবনুল মুনযির আল-কুরাশীর মাধ্যমে এটা বর্ণনা করেছেন। [দেখুন – তাহযীবুল কামাল, ২৮/৫৭৮]

ইবনু তাইমিয়াহ নিজ ‘মিনহাজুস্ সুন্নাহ’ (৪/৪৪৫) কিতাবে বলেন: 

أولاً: نحن نطالب بصحة هذا الحديث فإن الإحتجاج بالحديث لا يجوز إلا بعد ثبوته. ونحن نقول هذا في مقام المناظرة وإلا فنحن نعلم قطعًا أنه كذب. ثانيًا: هذا الحديث من الكذب الموضوع باتفاق أهل العلم بالحديث … 

অর্থ: প্রথমতঃ হাদীসটি দলিল হিসেবে ব্যবহারের আগে এটা সহীহ হওয়ার বিষয়টি আমরা সপ্রমাণ করার দাবি করি। আর আমরা কেবল এটার ব্যাপারে বিতর্ক করার অবস্থান থেকেই বলছি, নতুবা আমরা নিশ্চিত যে এটা একটা ডাহা মিথ্যে। দ্বিতীয়তঃ মুহাদ্দীস উলামার দৃষ্টিতে এই হাদীসটি জাল ও মিথ্যে।

إلى أن قال: (ثم من المعلوم من سيرة معاوية أنه كان من أحلم الناس وأصبرهم على من يؤذيه وأعظم الناس تأليفًا لمن يعاديه. فكيف ينفر عن رسول الله ﷺ مع أنه أعظم الخلق مرتبة في الدين والدنيا وهو محتاج إليه في كل أموره؟! فكيف لا يصبر على سماع كلامه؟! وهو بعد الملك يسمع كلام من يشتهه في وجهه. فلماذا لم يسمع كلام النبي ﷺ ؟! وكيف يتخذ النبي ﷺ كاتبًا من هو في هذه الحالة؟!) ا.هــ.

অর্থ: ইবনু তাইমিয়্যাহ আরো বলেন, অতঃপর হযরত মু’য়াবিয়া (রা.)-এর জীবনী হতে সর্বজনজ্ঞাত যে তিনি অত্যন্ত সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছিলেন, এমন কী তাদের প্রতিও যারা তাঁর ক্ষতি করতে চাইতো। তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যখন তিনিই হলেন দুনিয়া ও আখেরাতে সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান, আর হযরত মু’য়াবিয়া (রা.) হলেন তাঁর নিজস্ব যাবতীয় বিষয়ে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখাপেক্ষী? এটা কীভাবে সম্ভব যে হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভাষণ শোনার ক্ষেত্রে অসহ্য বোধ করতেন? তাঁর শাসনামল প্রতিষ্ঠার পরে তাঁরই মুখের ওপর যারা তাঁকে গালি দিতো তাদেরকে তিনি সহ্য করতেন। তাহলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভাষণ তিনি শ্রবণ করবেন না কেন? অধিকন্তু, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত কিছু জেনে শুনে তাঁকে কাতেবে ওহী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেনই বা কেন?

তৃতীয় বর্ণনাটি

حديث ((يطلع عليكم من هذا الفج رجل يموت على غير ملتي))!!

অর্থ: এই গিরিপথ দিয়ে তোমাদের সামনে উদয় ঘটবে এমন এক ব্যক্তির, যে আমার উম্মত/সম্প্রদায় হতে বিচ্যুত হয়ে মারা যাবে। [নোট: ইমাম ইবনু জারীর তাবারী (রহ.) তাঁর ‘তারীখ’ (৫/৬১৮) গ্রন্থে ২৪৮ হিজরী সালে সংঘটিত ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন; ওই বছরের ১১তম দিবস জুমু’আ/শুক্রবার মানুষেরা বলেন যে আব্বাসীয় খলীফা আল-মু’তাদিদ আদেশ দেন আব্বাসীয় খলীফা আল-মা’মূনের নির্দেশে সংকলিত হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি লা’নত/অভিসম্পাতমূলক একখানি গ্রন্থ যেনো বের করা হয় মিম্বরগুলোতে পাঠের উদ্দেশ্যে! ওই বইয়ে অভিযোগ করা হয় যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন – ((يطلع عليكم من هذا الفج رجل من أمتي يحشر ـ على غير ملتي)) – অর্থাৎ “আমার উম্মতের মধ্য হতে এক ব্যক্তি এই গিরিপথ দিয়ে তোমাদের সামনে উদিত হবে, যার হাশর/পুনরুত্থান হবে আমারই সম্প্রদায়ের বাইরে;” আর মু’য়াবিয়া (রা.) আবির্ভূত হন; আরো রয়েছে হাদীস – ((إذا رأيتم معاوية على منبري فقتلوه)) – মানে “তোমরা যখন আমার মিম্বরের ওপর মু’য়াবিয়াকে দেখবে তখন তাকে হত্যা কোরো;” এবং হাদীস – ((لعن الله القائد والسائق والراكب)) – অর্থ: “আল্লাহতায়ালা উটের পরিচালনাকারী, সওয়ারী ও তাড়া দানকারীর প্রতি লা’নত দিন;” এবং অন্যান্য ধরনের অশ্লীলতা যা কোনো মুসলমান উচ্চারণ করতে লজ্জা বোধ করবেন।]

আল-বালাযুরী ‘আল-আনসাবুল আশরাফ’ (১২৬) গ্রন্থে বলেন:

বকর ইবনুল হায়সাম বলেছেন আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবদুর রাযযাক্ব, তিনি বলেছেন আমাদের কাছে মা’মার বর্ণনা করেছেন ইবনু তাঊস্ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি কায়সান হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস্ (রা.) হতে, যিনি বলেন:

كنت جالساً عند رسول الله ﷺ فقال: ((يطلع عليكم من هذا الفج رجل يموت على غير ملتي)) قال: وكنت تركت أبي قد وضع له وضوء فكنت كحابس البول مخافة أن يجيء. قال: فطلع معاوية، فقال النبي ﷺ ((هذا هو)).

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সান্নিধ্যে বসেছিলাম যখন তিনি ফরমান, “এই গিরিপথ দিয়ে তোমাদের সামনে উদয় ঘটবে এমন এক ব্যক্তির, যে আমার উম্মত/সম্প্রদায় হতে বিচ্যুত হয়ে মারা যাবে।;” আর আমি (আবদুল্লাহ) আমার পিতা (আমর ইবনে আস)-কে ছেড়ে এসেছিলাম তাঁর জন্যে অযূর পানি রাখার পর – অতঃপর আমি এমনই এক ব্যক্তির মতো ছিলাম যার প্রস্রাবের বেগ আটকে রাখা হয়েছিলো এই ভয়ে যে আমার পিতা আসবেন। এরপর মু’য়াবিয়া (রা.) আবির্ভূত হন এবং প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফরামান, “এই সেই ব্যক্তি।”

ইমাম তবারানী (রহ.) অনুরূপ একটি বর্ণনা হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাম উল্লেখ ছাড়াই উদ্ধৃত করেছেন। 

ইমাম ইবনু হাজর হায়সামী মক্কী (রহ.) ‘মজমাউয্ যওয়াঈদ’ (৫/২৪৩) গ্রন্থে বলেন:

((رواه كله الطبراني وحديثه مستقيم وفيه ضعف غير مبين وبقية رجاله رجال الصحيح)).

অর্থ: এটা পুরোটাই বর্ণনা করেছেন আত্ তবারানী; আর এর ইসনাদে রয়েছেন মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনু রাহূইয়্যাহ, যাঁর বর্ণনাগুলো সাধারণতঃ ভালো, তবে তাঁর এমন কিছু দুর্বলতা বিদ্যমান যা স্পষ্ট নয়/ব্যাখ্যাতীত; আর বাকি বর্ণনাকারীবৃন্দ সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই বর্ণনায় একটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন যার শব্দচয়ন নিম্নরূপ – 

((يطلع عليكم رجل من أهل النار)).

অর্থ: তোমাদের মাঝে আবির্ভূত হবে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত এক ব্যক্তি…। 

এই বর্ণনাটি ‘আল-মুনতাখাবু মিনাল-ঈলাল’ গ্রন্থের প্রথম বর্ণনাটিরই অনুরূপ; আল-খাল্লাল (রহ.) বলেন (২২৮):

(سألت أحمد عن حديث شريك عن ليث عن طاوس عن عبد الله بن عمرو قال: قال رسول الله ﷺ: ((يطلع عليكم رجل من أهل النار)) فطلع معاوية). 

অর্থ: আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে জিজ্ঞেস করি এই বর্ণনাটি সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে শারীক হতে, তিনি তাউস্ হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর হতে, যিনি বলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মাঝে আবির্ভূত হবে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত এক ব্যক্তি;” আর এরপর আমীরে মু’য়াবিয়া (রা.) আবির্ভূত হন। 

ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উত্তরে বলেন:

إنما ابن طاوس عن أبيه عن عبد الله بن عمرو أو غيره شك فيه.

অর্থ: অবশ্যই এটা বর্ণিত হয়েছে তাউস্ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর হতে অথবা তিনি ভিন্ন অন্য কারো কাছ থেকে, যিনি এটা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন।

আল-খাল্লাল (রহ.) বলেন:

رواه عبد الرزاق عن معمر عن ابن طاوس، قال: سمعت فرخاش يحدث هذا الحديث عن أبي عن عبد الله بن عمرو.

অর্থ: আবদুর রাযযাক্ব এটা বর্ণনা করেন মা’মার হতে, তিনি ইবনে তাউস্ হতে, যিনি বলেন, “আমি শুনেছি আল-ফারখাশকে এই হাদীসটি বর্ণনা করতে আমার পিতা হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর হতে।” [নোট: মূল লিপিতে এভাবেই এসেছে, তবে এতে ত্রুটি দৃশ্যমান। হয়তো সঠিক শব্দচয়ন হবে – ‘আমি শুনেছি আল-লায়েসকে বর্ণনা করতে…।’ – আস্ সুবাঈ]

ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই বর্ণনাটির ত্রুটি উল্লেখ করেছেন ‘আত্ তারীখুল আওসাত’ (৭১) গ্রন্থে, যা’তে তিনি বলেন:

ويروى عن معمر عن بن طاوس عن أبيه عن رجل عن عبد الله بن عمرو رفعه في قصته وهذا منقطع لا يعتمد عليه. 

অর্থ: এই ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে মা’মার হতে, তিনি ইবনে তাউস্ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি কোনো (অজ্ঞাত) ব্যক্তি হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে; কিন্তু এর ইসনাদ (সনদ) ছেদপ্রাপ্ত, (তাই) নির্ভরযোগ্য নয়।

ইবনে তাইমিয়াহ নিজ ‘মিনহাজুস্ সুন্নাহ (৪/৪৪৪) গ্রন্থে বলেন:

((هذا الحديث من الكذب الموضوع باتفاق أهل المعرفة بالحديث)) ا. هــ.

অর্থ: হাদীসশাস্ত্র বিশারদদের ঐকমত্য অনুসারে এই বর্ণনাটি মিথ্যে ও বানোয়াট। 

এর পাশাপাশি আল-বালাযুরীর শিক্ষক বকর ইবনে হায়সামের কোনো জীবন-বৃত্তান্ত আমি (আস্ সুবাঈ) পাইনি। 

আর ইসহাকের বর্ণনাটি, যিনি এটা যৌথভাবে বর্ণনা করেন, তিনি হলেন ইসহাক ইবনে ইবরাহীম আদ্ দাবারী আস্-সান’আনী; তিনি আল-মালিকীর দাবিকৃত ইসহাক ইবনে ইসরাঈল নন, যেহেতু ইসহাক ইবনে ইসরাঈল যদিও আল-বালাযুরীর শিক্ষকদের মধ্য হতে ছিলেন, তবুও তিনি ইসহাক ইবনে ইবরাহীম আদ্ দাবারীর বৈসাদৃশ্যস্বরূপ আবদুর রাযযাক্ব হতে হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে জ্ঞাত নন।

ইবনে আদী ‘আল-কামিল’ (১/৩৪৪) পুস্তকে বলেন:

((قال إسحاق بن إبراهيم بن عباد أبو يعقوب الدبري الصنعاني استصغرني عبد الرزاق، أحضره أبوه عنده وهو صغير جداً فكان يقول: قرأنا على عبد الرزاق أي قرأ غيره وحضر صغيراً وحدث عنه بحديث منكر)).

অর্থ: ইসহাক ইবনে ইবরাহীম বিন আব্বাদ আবী ইয়াকূব আদ্ দাবারী আস্ সান’আনী বলেছেন, “আবদুর রাযযাক্ব আমাকে খুব ছোট বিবেচনা করেছিলেন।” তাঁর পিতা তাঁকে (ইমাম সাহেবের মজলিশে) অত্যন্ত কম বয়সে নিয়ে এসেছিলেন; তখন তিনি বলতেন, “আমরা আবদুর রাযযাকের কাছে পড়ি।” আসলে অন্যরা পড়তেন আর তিনি ছোট ছিলেন। তিনি আবদুর রাযযাক হতে মুনকার/অসমর্থিত হাদীসসমূহ বর্ণনা করতেন (যা সহীহ হাদীসের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতো)।

ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) ‘শরহু ঈলালিত্ তিরমিযী’ (২/৫৮১) গ্রন্থে ইবরাহীম আল-হারবীকে উদ্ধৃত করেন যিনি বলেন: 

((مات عبد الرزاق وللدبري ست سنين أو سبع سنين))

অর্থ: আবদুর রাযযাক ইন্তিকালপ্রাপ্ত হন যখন আদ্ দাবারী ৬ বা ৭ বছর বয়সী (শিশু) ছিলেন।

أقول وعبد الرزاق الصنعاني: ثقة إمام إلا أنه قد تغير حفظه و رواية المتأخرين عنه دون رواية المتقدمين في الصحة. والدبري إنما سمع منه بعد ما عمي وتغير حفظه. وقد روى عبد الرزاق أحاديث منكرة في فضل آل البيت ومثالب معاوية.

অর্থ: আমি (শাইখ সুবাঈ) বলি, আবদুর রাযযাক্ব ছিলেন সিক্বা তথা বিশ্বস্ত (হাদীসের) ইমাম; ব্যতিক্রম শুধু এই যে তাঁর জীবনের সায়াহ্নে তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়েছিলেন। কাজেই তাঁর থেকে শেষদিকের (মুতা’খিরীন) বর্ণনাকারী শিষ্যদের (গৃহীত) বর্ণনাসমূহ তাঁরই থেকে প্রথমদিকের (মুতাকাদ্দেমীন) বর্ণনাকারীদের (গৃহীত) বর্ণনাসমূহের মতো সহীহ/বিশুদ্ধ হয়নি। আর আদ্ দাবারীর বিষয়টি হলো, তিনি আবদুর রাযযাক্ব দৃষ্টি ও স্মরণশক্তি হারানোর পরেই তাঁর থেকে বর্ণনাসমূহ শুনেছেন। অধিকন্তু, আবদুর রাযযাক্ব আ’লে বাইত (রা.)-বৃন্দের ফযীলত সম্পর্কে এবং হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর দোষত্রুটি-বিষয়ক কিছু সংখ্যক মুনকার (সহীহর পরিপন্থী) হাদীস বর্ণনা করেছেন। 

قال ابن عدي في ((الكامل)) (344/1) عنه: ((نسبوه للتشيع وروى أحاديث ولما رواه في مثالب غيرهم مما لم أذكره وأما الصدق فإني أرجو أنه لا بأس به إلا أنه قد سبق منه أحاديث في أهل البيت، ومثالب آخرين مناكير)) فنص ابن عدي رحمه الله على أن له أحاديث في الفضائل والمثالب مناكير.

অর্থ: ইবনে আদী (রহ.) আল-কামিল (১/৩৪৪) গ্রন্থে বলেছেন, “তাঁরা তাঁর (মানে আবদুর রাযযাক্বের) প্রতি শিয়া মতবাদ-প্রবণতার দোষারোপ করেছেন; আর তিনিও আহলে বাইত (রা.)-এর ফযীলত বর্ণনা করেছেন যা অন্যদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেনি। আর এই দিকটি নিয়েই তাঁর কড়া সমালোচনা হয়েছে; তাঁর এ সকল বর্ণনা এবং এর পাশাপাশি তাঁর কৃত অন্যদের দোষত্রুটিসম্বলিত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে আমি উল্লেখ করবো না। তাঁর সততার প্রশ্নে আমি তাঁকে ক্ষতিকর বিবেচনা করি না, ব্যতিক্রম স্রেফ আহলে বাইত (রা.)-এর ফযীলত-সংক্রান্ত কিছু বর্ণনা এবং অন্যদের দোষত্রুটিসম্বলিত কিছু বর্ণনা যা মুনকার হাদীস (বিশুদ্ধতম হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার ভিত্তিতে)” [ইবনে আদী]। এটা ইবনে আদী (রহ.)-এর একটা দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য এ মর্মে যে ইমাম আবদুর রাযযাক্ব হতে ফযীলত ও দোষত্রুটির বর্ণনাসম্বলিত এমন হাদীসসমূহ বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো বৈধ নয় (মানে মুনকার হাদীস)।

ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) ‘শরহু ঈলাল আত্ তিরমিযী’ গ্রন্থে (২/৫৮০) বলেন:

((وقد ذكر غير واحد أن عبد الرزاق حدث بأحاديث مناكير في فضل علي وأهل البيت فلعل تلك الأحاديث مما لقنها بعد أن عمي كما قال الإمام أحمد والله أعلم وبعضها مما رواه عنه الضعفاء ولا يصح)).

অর্থ: “… এবং একাধিক ব্যক্তি ‘আব্দুর রাজ্জাক’ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে তিনি ইমামে ‘আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) এবং মহান আহলে বাইত (রা.)-এর গুণাবলী সম্পর্কে মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছেন। সম্ভবত এই বর্ণনাগুলো তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর তাঁকে সরবরাহ করা হয়েছে, যেমনটি ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন, আর আল্লাহই (এ বিষয়ে) ভালো জানেন। এই ধরনের কিছু বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর কাছ থেকে দুর্বল বর্ণনাকারীদের দ্বারা সেগুলো বর্ণিত হয়েছে এবং তাই সেগুলো সঠিকভাবে তাঁর প্রতি আরোপিত নয়।”

ইমাম যাহাবী (রহ.) ইসহাক্ব ইবনে ইবরাহীম আদ্ দাবারী সম্পর্কে বলেন:

((قال ابن عدي استصغر في عبد الرزاق قلت سمع من عبد الرزاق كتبه وهو ابن سبع سنين أو نحوها وروى عنه أحاديث منكرة فوقع التردد فيها هل هي من قبل الدبري وانفرد به أو هي محفوظة مما انفرد به عبد الرزاق وقد احتج بالدبري جماعة من الحفاظ كأبي عوانة وغيره)). 

অর্থ: “ইবনে আদী (রহ.) তাঁকে ইমাম আবদুর রাজ্জাক (রহ.) থেকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে খুব কম বয়সী মনে করেছিলেন। আমি বলি, তিনি ইমাম আবদুর রাজ্জাক (রহ.-এর কাছ থেকে শুনেছিলেন, আর তিনি এটা লিখেছিলেন যখন তাঁর বয়স প্রায় সাত বছর; এবং তিনি তাঁর কাছ থেকে অনেক মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে যে এই মুনকার হাদীসগুলো ইমাম আবদুর রাজ্জাক্ব (রহ.) থেকে আদ্ দাবারীর একক বর্ণনা কিনা, নাকি সেগুলো ইমাম আবদুর রাজ্জাক (রহ.)-এরই একক বর্ণনা। আবু আওয়ানার মতো কিছু হুফফায আলেম আদ্ দাবারীর বর্ণনার উপর নির্ভর করেছেন।” [আল-মুগনিউ ফীদ্ দুআফায়ে, ১/৬৯]

ইবনু সালাহ তাঁর ‘মুকাদ্দিমাহ’ (৩৫৫) গ্রন্থে বলেন:

((وجدت فيما روى الطبراني عن الدبري عنه أحاديث استنكرتها جدًا فأحلت أمرها على ذلك)).

অর্থ: “আমি কিছু রওয়ায়াত তথা বর্ণনা পেয়েছি, যেগুলো ইমাম তবরানী (রহ.) আদ্ দাবারী থেকে বর্ণনা করেছেন; যেগুলো ছিল অতি মুনকার (পর্যায়ের)। তাই আমি ওরই ভিত্তিতে এর বিধানকে বিবেচনায় নিয়েছি (যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে)।”

এই হাদীসের সমর্থন আরেকটি ইসনাদ-সূত্রে

১/ এই হাদীসের সমর্থন রয়েছে আবূ নু’আইম কর্তৃক প্রদত্ত বর্ণনার সূত্রে ‘তারীখে ইসফাহান’ (২/৭৭) গ্রন্থে, যা বর্ণিত লাইস্ হতে, তিনি তাউস্ হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে, যিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

((يطلع عليكم رجل من يثرب على غير ملتي فظننت أنه أبي وكنت تركته يتهيأ فاطلع فلان)).

অর্থ: “ইয়াসরিব হতে এমন এক ব্যক্তি আবির্ভূত হবে, যে আমার মিল্লাত/সম্প্রদায়বহির্ভূত।” ইবনে আমর (রা.) বলেন, “আমি ভেবেছিলাম ওই ব্যক্তি আমার বাবা হবেন, যখনই আমি তাঁকে (ধরে) তুলছিলাম তাঁর প্রস্তুতি গ্রহণকালে, আর অমনি অমুক এসে উপস্থিত হন।”

২/ এই হাদীসটি আল-বালাযূরী কর্তৃক ‘আনসাবুল আশরাফ’ (৫/১৩৪) গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে শারীকের সূত্রে, তিনি তাউস্ হতে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে একই মানে সহকারে।

প্রথম ইসনাদে রয়েছেন লাইস্ ইবনে আবী সুলাইম ইবনে যুনাইম, আল-কুরাশী (মওলা/গোলামসূত্রে); আবূ বকর, যাকে আবূ বকর আল-কুফী বলেও ডাকা হয়।

(ক) আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন – مضطرب الحديث ولكن حدث عنه الناس – অর্থাৎ, তাঁর হাদীস বর্ণনায় চরম অসঙ্গতি রয়েছে (মুদতারিবুল হাদীস); কিন্তু কিছু মানুষ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। [আদ্ দু’আফাউল্ কবীর, ১৬/৪]

(খ) ইবনু মাঈন তাঁর সম্পর্কে বলেন – ضعيف – “দুর্বল।” [তারীখু ইবনু মাঈন, আদ্ দূরী হতে বর্ণনা, ১/১৫৮]

(গ) ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ তাঁর কাছ থেকে কোনো বর্ণনা করেননি, এবং ইবনে উবায়নাহ (রহ.) লাইস্ ইবনে আবী সুলাইমের বর্ণনাগুলোকে দুর্বল বিবেচনা করেছিলেন।

(ঘ) ইবনে আবী হাতিম (রহ.) বলেন – سمعت أبي وأبا زرعة يقولان: ليث لا يشتغل به، هو مضطرب الحديث، قال: وقال أبو زرعة ليث بن أبي سليم لين الحديث لا تقوم به الحجة عند أهل العلم بالحديث – আমি আমার পিতা ও আবূ যুরআহ’কে বলতে শুনেছি, “লাইস্ ইবনে আবী সুলাইম বেশ দুর্বল (হাদীস বর্ণনায়); সে মুদতারিবুল হাদীস।” ইবনে আবী হাতিম আরো বলেন যে আবূ যুরআহ বলেছেন, “লাইস্ অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী; তাঁর বর্ণনাগুলো হাদীসবেত্তাদের দৃষ্টিতে (স্বকীয়) কর্তৃত্বশীল দলিল হিসেবে গৃহীত নয়। [আজ্ জারহু ওয়াত্ তা’দীল, ৭/১৭৮]

(ঙ) ইবনে আদী (রহ.) ‘আল-কামিল’ (৬/৮৯) গ্রন্থে বলেন – له أحاديث صالح، وقد روى عنه شعبة والثوري ومع الضعف الذي فيه يكتب حديثه – তাঁর (মানে লাইস্ ইবনে আবী সুলাইম) বর্ণিত কিছু হাদীস গ্রহণযোগ্য; এবং সর্ব-ইমাম শু’বাহ (রহ.) ও সুফিয়ান সাওরী (রহ.) তাঁর থেকে (হাদীস) বর্ণনা করেছেন। দুর্বলতা সত্ত্বেও তাঁর থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করা যায়। [আল-কামিল, ৬/৮৯]

(চ) ইবনে সা’আদ (রহ.) বলেন – كان رجلاً صالحاً عابداً وكان ضعيفاً في الحديث يقال: كان يسأل عطاء وطاووساً ومجاهداً عن الشيء فيختلفون فيه فيروي أنهم اتفقوا من غير تعمد – তিনি পুণ্যবান ও আবেদ তথা ইবাদতকারী ছিলেন; (তবে) তিনি বর্ণনাকারী হিসেবে দুর্বল। কথিত আছে যে তিনি সর্ব-ইমাম আতা’ (রহ.), তাউস্ (রহ.) ও মুজাহিদ (রা.)-কে কোনো কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন আর তাঁরা তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করতেন। অথচ তিনি তা অনিচ্ছাকৃত এমনভাবে বর্ণনা করতেন যেনো তাঁরা তাঁর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। [আত্ তাবাক্বাতুল কুবরা, ৬/৩৪৯]

(ছ) ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) বলেন – اختلط في آخر عمره فكان يقلب الأسانيد ويرفع المراسيل ويأتي عن الثقات بما ليس من حديثهم تركه القطان وابن مهدي وابن معين وأحمد – তাঁর জীবনের শেষদিকে স্মৃতিভ্রম ঘটে; তখন তিনি ইসনাদগুলো অদল-বদল/ওলট-পালট করে ফেলতেন, এবং ছেদপ্রাপ্ত সনদগুলোকে সংযুক্ত করতেন, আর বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের নামে এমন সব হাদীস বর্ণনা করতেন যা তাঁরা বর্ণনা করেননি। আল-কাত্তান (রহ.)-এর পাশাপাশি সর্ব-ইমাম ইবনে মাহদী (রহ.), ইবনে মাঈন (রহ.) ও আহমদ হাম্বল (রহ.) তাঁকে (মানে তাঁর বর্ণনাগুলোকে) বাদ দেন। [আল-মাজরূহীন, ২/২৩৭]

(জ) ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন – قال محمد كان أحمد يقول ليث لا يفرح بحديثه قال محمد وليث صدوق بهم – মুহাম্মদ (রহ.) বলেছেন, লাইস্ সম্পর্কে আহমদ (রহ.) বলতেন যে তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো প্রীতিকর ছিলো না। মুহাম্মদ (আরো) বলেন, লাইস্ সত্যবাদী হলেও ভুল করতেন। [আল-ঈলালুল কবীর, ২৯৩; আত্ তাহযীব, ৮/৪১৮]

(ঝ) আল-হাকিম আবূ আহমদ (রহ.) বলেন – ليس بالقوي عندهم – তাঁদের (মানে হাদীসবিদবৃন্দের) মতানুসারে তিনি শক্তিশালী (বর্ণনাকারী) নন। 

(ঞ) আল-হাকিম আবূ আব্দীল্লাহ (রহ.) বলেন – مجمع على سوء حفظه – তাঁদের (মানে মুহাদ্দেসীনের) মাঝে ঐকমত্য রয়েছে যে তাঁর স্মৃতি দুর্বল। 

(ট) আল-জূযাজা’নী (রহ.) বলেন – يضعف حديث – তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো দুর্বল। [আহওয়ালুর রিজা’ল, ৯১ নং জীবনী]

এর দ্বিতীয় ইসনাদে আছেন শারীক ইবনে আব্দীল্লাহ আল-কাজী; তাঁর বিস্তারিত বিবরণ ইতিপূর্বে লাইসের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে।

এই বর্ণনার সম্পূরক বর্ণনাসমূহও বিদ্যমান

নাসর ইবনে মুযাহিম বর্ণনা করেছেন ‘সিফফীন’ (২১৭) গ্রন্থে জা’ফর ইবনে যিয়াদ আল-আহমার সূত্রে (তরীক্বে), তিনি লাইস্ হতে, তিনি মুজাহিদ (রা.) হতে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে।

নাসর ইবনে মুযাহিম বর্ণনা করেছেন ‘সিফফীন’ (২১৯) গ্রন্থে শারীক সূত্রে (তরীক্বে), তিনি লাইস হতে, তিনি তাউস্ হতে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এ শব্দচয়নে – رجل يموت حين يموت على غير سنتي – “এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করবে এবং যখন সে মারা যাবে তখন তা হবে আমার সুন্নাতের বাইরে (মানে বিচ্যুতিতে)।”

নাসর ইবনে মুযাহিম বর্ণনা করেছেন ‘সিফফীন’ (২১৭) গ্রন্থে জা’ফর ইবনে যিয়াদ আল-আহমার সূত্রে (তরীক্বে), তিনি লাইস হতে, তিনি মুহারিব ইবনে দিছার হতে, তিনি হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এ শব্দচয়নে – يموت معاوية على غير ملتي – “মুয়াবিয়া মৃত্যুবরণ করবে আমার মিল্লাত তথা ধর্মের বাইরে (মানে পথভ্রষ্টতায়)।” 

বস্তুতঃ এই সম্পূরক বর্ণনাগুলো সবই নাসর ইবনে মুযাহিম হতে বর্ণিত, যিনি একজন রাফেযী শিয়া; যিনি মাতরূক তথা হাদীসশাস্ত্রে প্রত্যাখ্যাত। তাঁর দুর্বলতা সম্পর্কে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে; এর পাশাপাশি লাইস ইবনে আবী সুলাইমের দুর্বল স্মৃতি সম্পর্কেও বলা হয়েছে।

এসব বর্ণনার তালিকায় দ্বিতীয়টি, যার ইসনাদে শারীক আল-কাজী রয়েছেন, তাঁরও স্মৃতি দুর্বল বলে বিবেচনা করা হয়েছে, বিশেষ করে বিচার বিভাগে পদ লাভের পরে তিনি যেসব বর্ণনা পেশ করেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে।

ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘ফাতাওয়া’ (৪/৪৭২) গ্রন্থে কী সুন্দর বলেছেন:

معاوية ثبت بالتواتر أنه أمره النبي ﷺ في كتابه (كذا بالأصل والصواب {بكتابة}) الوحي وولاه عمر بن الخطاب الذي كان من أخبر الناس بالرجال وقد ضرب الله الحق على لسانه وقلبه ولم يتهمه في ولايته وقد ولى رسول الله ﷺ أباه أبا سفيان إلى أن مات النبي ﷺ وهو على ولايته فمعاوية خير من أبيه وأحسن إسلاماً من أبيه باتفاق المسلمين وإذا كان النبي ﷺ ولى أباه فلأن تجوز ولايته بطريق الأولى والأحرى، ولم يكن من أهل الردة قط ولا نسبه أحد من أهل العلم إلى الردة فالذين ينسبون هؤلاء إلى الردة هم الذين ينسبون أبا بكر وعمر وعثمان وعامة أهل بدر وأهل بيعة الرضوان وغيرهم من السابقين الأولين من المهاجرين والأنصار والذين أتبعوهم بإحسان إلا ما لا يليق بهم. 

অর্থ: এটা বিভিন্ন বিশুদ্ধ বর্ণনার (পুনরাবৃত্তির) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে আমীরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ)-এর প্রতি ওহী-লেখক হিসেবে ওহী/ঐশীবাণী লিপিবদ্ধ করার জন্যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর শাসন করার জন্যে তাঁকে নিযুক্ত করেন খলীফা হযরত ‘উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), যিনি মানুষদের মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি দক্ষ ছিলেন এবং যাঁর জিহ্বা ও অন্তরে  আল্লাহ সত্য স্থাপন করেছিলেন, এবং হযরত ‘উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর মনে এই এখতিয়ার হযরত মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহই ছিলো না। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন (যাহেরী/প্রকাশ্য) জীবদ্দশায় হযরত মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর পিতা হযরত আবূ সুফিয়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে শাসন পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এটা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেসাল শরীফ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। হযরত মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পিতার চেয়ে উচ্চস্তরে ছিলেন, এবং ইসলামে উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন; তাই যদি তাঁর পিতাকে শাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে, তবে তিনি তাঁর পিতার চেয়েও এর জন্যে বেশি যোগ্য ছিলেন। তিনি নবীয়ে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বেসালের পরে ধর্মত্যাগী বা ধর্মদ্রোহী ছিলেন না এবং আলেম-উলামার মধ্যে কেউই তাঁর প্রতি এর কোনোটার দোষারোপ করেননি। যারা তাঁর প্রতি এ দোষারোপ করে, তারা সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রতি, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ সাহাবা, আল-রিদওয়ানে আনুগত্যের শপথ গ্রহণকারী এবং প্রাথমিক যুগের মুহাজির ও আনসার সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দ হতে শুরু করে হযরত মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে পরম কৃতিত্বের সাথে অনুসরণকারীদের সবার প্রতিও অনুরূপ দোষারোপ করে থাকে।

ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘ফাতাওয়া’ (৪/৪৭৬) গ্রন্থে বলেন:

((وأما قول القائل: إيمان معاوية كان نفاقا فهو أيضا من الكذب المختلق فإنه ليس في علماء المسلمين من اتهم معاوية بالنفاق بل العلماء متفقون على حسن إسلامه وقد توقف بعضهم في حسن إسلام أبي سفيان ـ أبيه ـ وأما معاوية وأخوه يزيد فلم يتنازعوا في حسن إسلامهما كما لو يتنازعوا حسن إسلام عكرمة بن أبي جهل وسهيل بن عمرو وصفوان بن أمية وأمثالهم من مسلمة الفتح وكيف يكون رجلا متوليا على المسلمين أربعين سنة نائباً ومستقلاً يصلي بهم الصلوات الخمس ويخطب ويعظهم ويأمرهم بالمعروف وينهاهم عن المنكر ويقيم فيهم الحدود ويقسم بينهم فيأهم ومغانمهم وصدقاتهم ويحج بهم ومع هذا يخفي نفاقه عليهم كلهم؟ وفيهم من أعيان الصحابة جماعة كثيرة.

بل أبلغ من هذا أنه ـ ولله الحمد ـ لم يكن من الخلفاء الذين لهم ولاية عامة من خلفاء بني أمية وبني العباس أحد يتهم بالزندقة والنفاق وبنو أمية لم ينسب أحد منهم إلى الزندقة والنفاق وإن كان قد ينسب الرجل منهم إلى نوع من البدعة أو نوع من الظلم لكن لم ينسب أحد منهم من أهل العلم إلى زندقة ونفاق وإنما كان المعروفون بالزندقة والنفاق وكذلك رمي بالزندقة والنفاق قوم من ملوك النواحي الخلفاء من بني بويه وغير بني بويه فأما خليفة عام الولاية في الإسلام فقد طهر الله المسلمين أن يكون ولي أمرهم زنديقا منافقا فهذا مما ينبغي أن يعلم ويعرف فإنه نافع في هذا الباب واتفق العلماء على أن معاوية أفضل ملوك هذه الأمة فإن الأربعة قبله كانوا خلفاء نبوة وهو أول الملوك كان ملكه ملكاً ورحمة)). 

অর্থ: যারা দাবি করে হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঈমান ছিলো নিফাক্ব/কপটতাপূর্ণ তথা ভন্ডামিপূর্ণ, তাদের এ কথা মনগড়া ও মিথ্যা। মুসলমানদের মধ্যে কোনো আলেমই হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে ভণ্ডামির দায়ে অভিযুক্ত করেননি। বস্তুতঃ তাঁরা ইসলাম-ধর্মে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে একমত। যদিও তাঁর পিতা হযরত আবূ সুফিয়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে কারো কারো আপত্তি ছিলো, তবু তাঁরা সবাই হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এবং তাঁর ভাই ইয়াজিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলামে শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে একমত, ঠিক যেমনটি তাঁরা ‘ইকরিমা ইবনে আবি জাহল, সুহাইল ইবনে আমর, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া প্রমুখ যাঁরা মক্কা বিজয়ের সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের ইসলামে শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেননি।

কোনো ব্যক্তি কীভাবে চল্লিশ বছর ধরে মুসলমানদেরকে শাসন করেন, রাজ্যশাসন প্রতিনিধি ও (পরবর্তীকালে) স্বাধীন শাসক উভয় হিসেবে, এবং কীভাবে তিনি তাঁদের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ইমামতি করেন, খুতবা দেন, সৎ পরামর্শ দেন, সৎ কাজে উপদেশ দেন, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করেন, শাস্তির দণ্ডবিধি জারি করেন, তাঁদের মধ্যে গনীমত ও দান-খয়রাত বণ্টন করেন এবং তাঁদের সাথে হজ্জ্বব্রতের তীর্থযাত্রা করেন? এটা কীভাবে সম্ভব হলো যে তিনি তাঁর নিফাক্ব/কপটতা তাঁদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলেন এমনি এক যুগে, যখন ঊর্ধ্বতন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী তাঁদের মাঝে উপস্থিত?

আল্লাহরই জন্যে সমস্ত প্রশংসা এই কারণে যে, এ বাস্তবতার চেয়েও বড় সত্য হলো উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলীফাবৃন্দ যাঁরা সাধারণ এখতিয়ার বা কর্তৃত্ব সংরক্ষণ করতেন, তাঁদের কারো বিরুদ্ধে কখনোই ধর্মদ্রোহিতা/গোমরাহী বা কপটতার অভিযোগ আনা হয়নি, যদিও তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে বিদ’আতের ও নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু উলামাবৃন্দের কেউই তাঁদেরকে পথভ্রষ্ট/ধর্মদ্রোহী বা মোনাফেক বলে অভিযুক্ত করেননি। যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হয়েছিলো, তারা আধা-স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের ছিলো, যেমন বনী বূয়ীহ এবং অন্যান্য ক্বওম। সাধারণ শাসকদের প্রসঙ্গে আল্লাহ মু’মিনদের ওপর একজন গোমরাহ বা মুনাফিক শাসক বসানো থেকে তাঁদেরকে পবিত্র রেখেছেন, আর এটা জ্ঞাত হওয়ার যোগ্য এবং এক্ষেত্রে উপকারীও। উলামাবৃন্দ একমত যে হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এই উম্মাহর সর্বোত্তম রাজ্যশাসক ছিলেন, যেহেতু তাঁর পূর্ববর্তী চারজন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত খলীফা ছিলেন, তাই তিনি ছিলেন রাজ্যশাসকদের মধ্যে প্রথম যাঁর শাসনামল ছিল রহমতের তথা করুণাপূর্ণ।

ইবনে তাইমিয়া একই বইয়ে (৩৫/৬২) আরো বলেন: 

((و{معاوية، وعمرو بن العاص، وأمثالهم} من المؤمنين لم يتهمهم أحد من السلف بنفاق)).   

অর্থ: এবং সর্ব-হযরত মু’য়াবিয়া, আমর ইবনুল আস্ প্রমুখ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ঈমানদারবৃন্দেরই অন্তর্ভুক্ত; সালাফ তথা প্রাথমিক যুগের মুসলিমবৃন্দের কেউই তাঁদেরকে মোনাফেকীর দায়ে অভিযুক্ত করেননি।

*আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’র পক্ষে জবাব [পর্ব-১৩১]*

মূল: সা’আদ ইবনে দায়দা’ন আস্-সুবাঈ

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Sa’ad ibn Dhaydaan al-Subayi’s online book “In Defense of Mu’awiyah (Ra:).” Translator: Kazi Saifuddin Hossain; post – 131]