আমিরুল মুমিনিন খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহু

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

স্মরণ—–

আমিরুল মুমিনিন খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)

………………………………

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী

……………………………………

জিগরবন্দে মুস্তাফা ওয়া জাহরা, রায়হানে দিলে মুর্তাজা, কুররাতুল আইনে সাইয়্যিদা জাহরা, সাহেবুল জুদে ওয়াস সাখা, আমিরুল মুমিনিন, খলিফাতুল মুসলেমীন হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী পরিবারের উজ্জল নক্ষত্র ও আহলে বায়তের অন্যতম সদস্য। তিনি হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রথম ও জেষ্ঠ্য সন্তান। তাঁর কুনিয়ত আবু মুহাম্মদ এবং উপাধি তাকি ও সাইয়্যিদ। তিনি তৃতীয় হিজরির ১৫ রমযান মুতাবিক ৬২৫ খৃ. মদীনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর জন্মে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও সকল মুসলমান আনন্দিত হন। আল্লাহর রাসূল তাঁর কানে আযান দেন এবং খেজুর চিবিয়ে তাঁর মুখে দেন। [আবু দাউদ, হা. নং ৫১০৫, শোয়াবুল ইমান, ৬: ৩৯০।

জিবরাইলের নাম নিয়ে আগমন

হযরত জিবরাইল আলায়হিস সালাম বেহেস্তের একটি বস্ত্রখন্ডে তাঁর নাম লিখে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপহার স্বরুপ আনয়ন করেন। [শাওয়াহেদুন নবুয়ত, ২২৯]

তিনি আপাদমস্তক প্রিয় নবীর মতো

তাঁর আকার আকৃতি আপাদমস্তক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের অনুরূপ। একদিন হযরত ফাতিমা তার কলিজার টুকরা হাসানাকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। হযরত আলীও সেখানে ছিলেন। বাচ্চাকে আদর করে বললেন, দেখ! দেখ! এ যতটা আল্লাহর রাসূলের মতো, ততটা তার বাপের মত না। [আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮: ৩৫।]

হাসান ও হোসাইন জান্নাতি নাম সমূহের দু’টি নাম

হযরত ইমরান বিন সুলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাসান ও হোসাইন জান্নাতিদের নামসমূহের দুটি নাম। যে দুটি নাম জাহেলি যুগে কারো নাম হিসেবে রাখা হয় নি। [ইবনে হাজর মক্কি, আস সাওয়ায়েকুল মুহরাকা, ১৯২, ইবনে আসির, উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, ২: ২৫।]

হযরত ইমাম হাসানের কারামত

একবার হজ্জের মওসুমে তিনি পায়েহেটে মক্কা মুকাররমায় গমন করছিলেন। পথিমধ্যে তাঁর পদদ্বয় ফুলে গেলো। তাঁর এক গোলাম আরজ করলো, কোনো সওয়ারীতে সওয়ার হয়ে যান, যাতে ফুলা কমে যায়। তিনি তার আবেদন কবুল করলেন না। বরং বললেন, তুমি নিকটেকেই কোথাও একটি গৃহে পৌছে এক হাবশিকে দেখতে পাবে। তার কাছে কিছু তেল থাকবে। তুমি তা ক্রয় করে নিবে। তার সাথে কোনোরূপ ঝগড়া বিবাদ করবে না।

গোলাম বললো, আমার পিতা মাতা আপনার কদমে উৎসর্গ হোক। আমরা কোথাও কোনো লোক দেখি নি, যার কাছে এমন মহৌষোধ আছে। এখানে কোথায় পাওয়া যাবে? কিন্তু পরবর্তী মনজিলে পৌছার পরই সেই হাবশি দৃষ্টিগোচর হলো। হযরত হাসান বললেন, এই হাবশি সম্পর্কেই আমি তোমাকে বলছিলাম। যাও, তার কাছ থেকে তেল ক্রয় করে আনো এবং মূল্যও দিয়ে এসো। গোলাম হাবশির কাছে গিয়ে তেল চাইলো। হাবশি জিজ্ঞাসা করলো, এ তেল কার জন্যে ক্রয় করছো? সে বললো, হযরত ইমাম হাসানের জন্যে। হাবশি বললো, আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলো। গোলাম তাকে সেখানে পৌছালে হাবশি বললো, আমি আপনার গোলাম। আপনার থেকে তেলের মূল্য নিবো না। আপনি কেবল আমার স্ত্রীর জন্যে দোয়া করুন। সে এখন প্রসব বেদনায় কাতর। দোয়া করুন যাতে আল্লাহ তাকে সর্বাঙ্গ সুস্থ একটি শিশু দান করেন। তিনি বললেন, নিজের ঘরে ফিরে যাও। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে তেমনি একটি শিশু দান করবেন, যেমনটি তুমি চাও। সে আমার অনুসারী হবে। হাবশি ঘরে ফিরে ঘরের অবস্থা তাই দেখতে পেলো যেমন ইমাম হাসান বলেছিলেন।

হযরত ইমাম হাসানের বদান্যতা

হযরত হাসান (র.) ছিলেন অত্যন্ত দানশীল একজন ব্যক্তি। কেননা, তিনি তো যে পরম দানশীল নানার নাতী যাকে আল্লাহ তায়ালা সকল ধন-সমম্পদের মালিক বানিয়েছেন। আল্লাহ ছিলেন দাতা আর তিনি ছিলেন বন্টনকারী। যিনি ছিলেন আল্লাহর জগতের সবচেয়ে দানশীল। যার যবান থেকে কোনোদিন না শব্দ বের হয় নি। যে যেটা চেয়েছেন তাকে সেটাই দিয়েছেন। তিনি যখন দান করতেন তখন উদার হস্তে দান করতেন যেতার অভাবের কোনো আশঙ্খায় থাকতো না। তাই সেই নবীর দৌহিত্রের মধ্যে এ দানশীলতার ঝলক দেখা যায়। তার দানশীলতার অনেক ঘটনা হাদিস ও ইতিহাসের কিতাবে পাওয়া যায়।

মুহাম্মদ বিন সিরিন বলেন, হযরত হাসান (র.) একবার এক ব্যক্তি এক লক্ষ দিরহাম দান করেন। একবার জনৈক ব্যক্তিকে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে শুনলেন, হে আল্লাহ! আমাকে দশহাজার দেরহামের মালিক বানিয়ে দাও। তৎক্ষণাৎ হযরত হাসান এসে এক খাদেম মারফত তার জন্য দশহাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন।

হযরত হাসানের জীবনে এমন অনেকবার ঘটেছে যে, তিনি তার সমস্ত সম্পদ দুভাগ করে আল্লাহর রাস্তায় বন্টন করে দিয়েছেন। একবার হযরত মুআবিয়া তার জন্য একলক্ষ দিরহাম পাঠালেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তা উপস্থিত লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। প্রত্যেকের ভাগে দশ হাজার দিরহাম পড়েছিলো।

একবার হযরত উসামা বিন যায়েদ (র.)-এর অসুস্থতার কথা জানতে পেরে তাকে দেখতে যান। তাকে খুব বিষন্ন মনে হলো। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার চিন্তার কারণ কি? আপনি তো আল্লাহর রাসূলের প্রিয় পাত্র। দুঃখ-ভারাক্রান্ত গলায় তিনি বললেন, আমি ষাটহাজার দেরহাম ঋণী। আদায় করার কোনো উপায় দেখছি না। হযরত হাসান বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। সেগুলো আদায়ের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। এ কথা শুনে হযরত ওসামা বিন যায়েদ-এর মুখে প্রশান্তির আভা ফুটে উঠলো। [হাসান বিন আলী বিন আবি তালিব: ২৯৭।]

তাকওয়া পরহেজগারি ও বিনয়

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের খান্দান সম্বন্ধে এক ব্যক্তিকে হযরত হাসান বাড়াবাড়ি করতে দেখলেন। তাদের প্রশংসা বর্ণনায় সে সীমালঙ্ঘন করছিলো। তিনি বললেন, মন্দ হোক তোমার! আমাদের ভালোবাসা কেবল আল্লাহর জন্য। আমরা আহলে বায়তরা আল্লাহর আনুগত্য করলে আল্লাহর জন্যই আামদের ভালোবাসো। আর যদি তার অবাধ্য হই তাহলে আল্লাহরই জন্য আমাদের ঘৃণা করো।

তিনি আরো বলেন- আল্লাহর শপথ! আমাদের অবাধ্যদের না আল্লাহ দ্বিগুণ শাস্তি দেন এবং একথা বলেন যে, তোমরা রাসূলের সন্তান হয়ে আমার অবাধ্যতা করেছো। তদ্রƒপ আমার এ আশা জাগে যে, আমাদের থেকে যে আল্লাহর আনুগত্য করবে, তাকে অন্যদের থেকে দ্বিগুণ সওয়াব দেবেন। তাই আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাদের সম্বন্ধে সত্য কথা বলো। এতেই তোমর কল্যাণ রয়েছে, আর এতেই আমরা সন্তুষ্ট থাকবো। [তাবকাতে ইবনে সাদ, ৫: ৩১৯, ৩২০।]

হযরত হাসানের দিন রাত কিভাবে অতিবাহিত হতো

তাঁর দিন রাত আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হতো। মানুষের সেবায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। একবার হযরত মুয়াবিয়া মদিনার জনৈক ব্যক্তিকে বললেন, হাসানের কার্যক্রম সম্পর্কে আমাকে জানান। সে ব্যক্তি তার দিবারাতের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে বললেন, হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু ফজরের নামায পড়ার পর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদেই আল্লাহর যিকির করতে থাকেন। ইশরাকের নামাযের পর বিভিন্ন গোত্রের নেতৃবর্গ তার পাশে বসে আলোচনা করেন। যেখান থেকে উঠে উম্মুহাতুল মুমিনদের নিকট যান এবং তাদের সালাম জানান। অনেক সময় কিছু হাদিয়াও নিয়ে যান। এরপর তিনি ঘরে আগমন করে ইবাদতে রাত অতিবাহিত করেন। [আল বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮: ৩৮।]

এটা শুনে মুয়াবিয়া বললেন, আমাদের মধ্যে এ সৌন্দর্য কোথায়!

হযরত ইমাম হাসানের ওফাত

কথিত আছে যে, তাকে বিষ প্রদান করা হয়েছিলো। তাঁর ওফাতের সময় হযরত হোসাইন তাঁর শিয়রে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে আপনাকে বিষ দিয়েছে বলে আপনি সন্দেহ করেন? তিনি বললেন, আমি যাকে সন্দেহ করি যদি সে প্রকৃতই বিষদাতা হয়ে থাকে, তবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। আর যদি সে না হয়, তবে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি অভিযুক্ত হোক তা আমি চাই না।

তাঁর ওফাতের তারিখ ও সন নিয়ে মতবিরোধ আছে। কারো কারো মতে, ২৮ সফর, কারো মতে ২৯ সফর। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রবিউল আওয়ালের ৫ তারিখ ৫০ হিজরিতে হয়েছিলো। কারো মতে ৪৯ হিজরি।

[আরো বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত আহলে বায়তে রাসূল (দ.) কিতাবটি দেখুন।]

………………………………………

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী

তারিখ: 09/05/2020 ইং

……………………………………….

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment