আধ্যাত্মিক জগতের মহান স¤্রাট খাজা আব্দুর রহমান চেীহরভী
খন্দকার মোহাম্মদ আল ইমরান
বিদগ্ধ জনে জানে-
“চৌহর” নামে ভূ-খন্ডখানি, প্রথিবীর কোনখানে?
সেখানে জন্ম কোন শুভক্ষণে এক মহা সাধকের,
রাজত্বতার হৃদে হৃদে সব নবীপ্রেম বাহকের।
কবি হাফিজ আনিসুজ্জামান’র কবিতার উপরের পংক্তিমালা পড়েই কৌতুহল সৃষ্টি হয় ‘চৌহর’ নামের সেই পবিত্র ভূ-খন্ডখানি কোথায়? জানার জন্যে। আর সেখানে জন্ম নেয়া দিব্যজ্ঞানী মহা সাধক- কে? যাঁর হৃদয়ে হৃদয়ে সব নবী প্রেম বাহকের রাজত্ব।
‘চৌহর’ ভূ-খন্ড চেনর জন্যে কবি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। শর্তটা হচ্ছে- বিদগ্ধ জ্ঞানী হতে হবে নয় তো সম্ভব নয়। আসলেই সত্যি জ্ঞানী-সাধক, মহাপুরুষ এদের চিনতে জ্ঞানেরই প্রয়োজন। স্থানটা চিনতে প্রথমে সেই ‘চৌহর’-এ জন্ম নেয়া মহাসাধককে চিনতে হবে। কারণ এই স্থানটাতো পাকিস্থানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এবোটাবাদ জেলার অঁজপাড়া গ্রাম। “ইন্নাল খারাবা ইয়াকূনু মাআল্লাহি ইমারাতান ওয়া বুসতানা” অনাবাদী প্রত্যেক জমিই আল্লার স্মরণে আবাদ হয়, ফুলে-ফলে, সবুজ-শ্যামল বাগিচায় রূপ নেয়। দিব্য জ্ঞানী আল্লার এই মহান অলি এই ভূমিতে জন্ম নিয়েছেন বলেই আর এর এতো নাম দাম-এতো সম্মান ‘চৌহর’ আর বলা যায় না, বলতে হয় ‘চৌহর শরীফ’। কবির দার্শনিক যুক্তি খুব সুন্দরই হয়েছে, সেই বিদগ্ধজনেই জানবে ‘চৌহর’ পবিত্র ভূমির মর্যাদা যে, বিদগ্ধজন চিনবে সেই মহাপুরুষকে, সেই মহাসাধক কে? কি তাঁর পরিচয়? কেন মানুষ আজো তাঁকে ভক্তিভরে স্মরণ করে, কবিরা থাঁর শানে কবিতা তাঁর শানে কবিতা লিখে, সাহিত্যিকরা তাঁকে নিয়ে রচনা করে দীর্ঘ প্রবন্ধ। তবুও শেষ হয় না। তাঁর যথাযোদ্য স্তÍতি হয় না; হওয়ার কথাও নয়, তিনি অসাধারণ-অনন্য সাধারণ অবাক হওয়ার কথা, মক্তবে শুধু কোরআন শরীফটা হিফজ করেছে। আর কোনো মাদ্রাসায় স্কুলে পরেড়ন নি, অজ্ঞরজ্ঞান শিখেন নি লিখার অনুশীলন করেন নি। দুনিয়ার কোন পূঁথিগত বিদ্যা না পড়ে, কোন উস্তাদের কাছে না গিয়ে তিনি যে অসাধারণ এক গ্রন্থ রচনা করেছে- যার লিখন শৈলী, শব্দ চয়ন ও বর্ণনার ধারাবাহিকতা, তদুপরি পবিত্র কোরআন ও হাদীসের নিগুঢ় তথ্য ও রহস্যবলীর বর্ণনা, ভাব ও বক্তব্য যা অসাধারণ জ্ঞানী এবং তথ্য জ্ঞানী পন্তিতদেরকেও হতভম্ব করে তোলে। এ কোন জ্ঞান? যা প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডিতে না গিয়েও অজর্ন করা যায়? এ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞান।এ জ্ঞান খোদা প্রদত্ত ঐশী জ্ঞান। যাকে বলে “ইল্মে লাদুনী।” এ জ্ঞান যার তার ভাগ্যে জোটে না। এ জ্ঞানের জন্য সাধনা করতে হয়। কষ্ট করতে হয়, আর আল্লাহ্ ও রাসূলের পথে নিরবিচ্ছন্ন সাধনা করলে আল্লাহ্ ও তার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁর জন্য আদি-অন্ত সকল প্রকার জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। সে রকম আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ কে সন্তুষ্ট করে তিনি সেই অসাধারণ জ্ঞানভা-ারের মালিক হয়েছেন বলেই তাঁকে বলা হয় ‘মা’আরেফে উলূমে লাদুন্নিয়া’র প্র¯্রবণ।
এ মহান ব্যক্তিত্ব ‘মা’আরেফে লাদুন্নী’র প্রস্্রবণ, উলুমে ইলাহীর ধনভান্ডার, শরীয়তের অসাধারণ জ্ঞানী, তরীকতের মুর্শিদ, হাক্বীকতের গুপ্ত রহস্যাবলীর অন্তরদ্রষ্টা, খলীফা-ই-শাহে জিলান, খাজায়ে খাজেগান হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহ্রভী রাহ্মাতুল্লাহি আলাইহি পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এবোটাবাদ জেলার পবিত্র ভূমি ‘চৌহর’ শরীফে হিজরী ১২৬২ মোতাবেক ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এক প্রসিদ্ধ বুযুর্গ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত চৌহ্রভী রাহ্মাতুল্লাহি আলাইহি ৮ বয়সেই বছর পিতৃ¯েœহ হতে বঞ্চিত হন। ছোটবেলায় পবিত্র কুরআন হিফ্জ করেন। পিতার ইন্তেকালের পর কিশোর চৌহ্রভী নফ্স শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রথম সোপান হিসেবে ক্রমাগত চল্লিশ দিন আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে শুরু করলেন কঠোর রিয়াযত। এ রকম, কঠোর কঠিন কষ্টসাধ্য অনুশীলন (রিয়াযত) দ্বারা শারীরিক ও চারিত্র্যিক যাবতীয় অন্ধকার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিশ্চিহ্ন করে তিনি রূহানী শক্তি অর্জন করতে নিজেকে সক্ষম করে তুলেন।
খাজা চৌহ্রভী রাহ্মুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন মাতৃগর্ভের অলি। পবিত্র কুরআন হিফ্জ করা ছাড়া বাকী তাফসীর, হাদীস, ফিক্বহ ও উসুল ইত্যাদির শিক্ষা প্রচলিত নিয়ম মতে কোন প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষকের কাছে গিয়ে অর্জন করেন নি। তাঁর বুযুর্গ পিতা হযরত খাজা ফক্বীর মুহাম্মদ খিজরী রাহ্মাতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও কৃপাদৃষ্টিতে ছোটবেলা হতেই হযরত চৌহ্রভী রাহ্মাতুল্লাহি আলাইহি বেলায়তের মক্বাম (মর্যাদা) অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে উপযুক্ত মুর্শদের হাতে বায়’আত গ্রহণের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতায় আরো উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হন। ফলে কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ ও ফতোয়ার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন না করেও তিনি আধ্যাতিœক জ্ঞানবলে এসব বিদ্যায় পরিপূর্ণ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তাঁর রচিত ঐ মহান গ্রন্থই তাঁর জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানের ধারক হওয়ার উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে। একটি গ্রন্থ রচনা করেই তিনি আর অমর-অক্ষয়। যে গ্রন্থের নাম ‘মোহায়্যিরুল উকুল ফি-বয়ানে আওসাফি আক্বলিল উকুল মজমূ’আহ্ সালাওয়াতির রাসূল।’
এ দরূদ শরীফের সুবিশাল ত্রিশ পারা আল্ মুসাম্মাবিহী স্মবলিত কিতাবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র গুণগত বৈশিষ্ট্য ও অপূর্ব সৌন্দর্যের বর্ণনা। এমন শৈল্পিক বাচনভঙ্গি ও অভিনব ঢংয়ে বর্ণনা করা হয়েছে যা অধ্যয়নে বড় বড় আলিম ও পরিপক্ব সূফীতত্ত্ববিদগণও একেবারেই বিস্ময়ে হতবাক। এই একখানি গ্রন্থই এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। কারণ এই বিশাল গ্রন্থটি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শানে রচিত সর্ববৃহৎ দরূদ শরীফ বলার সাথে সাথে এ কিতাবকে তাফসীর, হাদীস, ফিক্বহ, উসুল, মানতেক, বালাগাত, আকাঈদ, ইতিহাস, সূফীতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, শরীয়ত, ত্বরীক্বত দর্শন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ তথা ‘ইনসাইক্লোপিডিয়া’ বলেও গবেষকগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
হযরত চৌহ্রভী রাহ্মাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন একনিষ্ট সুন্নত-ই-নববী সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অনুসারী। তিনি নিজের আধ্যত্মিক অবস্থানকে লোকজন হতে সর্বদা গোপন রাখতেন। তাঁর চরিত্রে বিনয়, নম্রতা, সহনশীলতা ও ধৈর্য এবং গরীব-মিসকিনদের প্রতি, দয়া ভালবাসা প্রভৃতি গুণ ফুটে উঠে। তাঁর চরিত্রে ছিলো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সুন্দরতম চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। উঠা-বসা, খানা-পিনা, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সকল বিষয়ে সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অনুসরণ অনুকরণের প্রতি তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিলো। জীবন অবধি শরীয়ত ত্বরীক্বত মাযহাব মিল্লাতের খিদমত করেছেন নিষ্ঠার সাথে প্রতিষ্ঠা করেছেন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান “হরিপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসা।” মাযহাব মিল্লাতের খিদমতের জন্য গড়ে তুলেছেন আমাদের জামেয়ার’র প্রতিষ্ঠাতা সৈয়্যদুল আউলিয়া শাহ্ সৈয়্যদ আহ্মদ সিরিকোটী রাহ্মাতুল্লাহি আলাইহি’র মতো শরীয়ত ত্বরীক্বতের বিজ্ঞ আলেম-ওলামা, ভক্ত-অনুরক্ত যোগ্য খলিফাবৃন্দ। যাঁদের মাধ্যমে এ মিশন জারী থাকবে ক্বেয়ামত পর্যন্ত। তাঁর রূহানী ফয়েজ বরকত লাভে ধন্য হয়ে দুনিয়ার মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে চিরদিন। আর ভক্তিভরে জানাবে লক্ষ কোটি শ্রদ্ধা, সম্মান আর সালাম।
“খাজায়ে খাজেগান খাজা আব্দুর রহমান
উছ্ নগীনে বেলায়ত পে লাখোঁ সালাম”।