আগন্তুক ৫ম পর্ব

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

৫ম পর্ব

এরপর আমরা লেখা শেষের প্রশ্নোত্তর পর্বটা একটু দেখবো। টিভি দেখার ফলে মনের উপর কি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে? টিভি দেখার কারণে যখন আপনি মনকে একখানে আটকে ফেলেন, তখন আপনি অন্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হন – যা মস্তিষ্কের বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করবে। একটা বাচ্চার সাথে যদি কথা বলা না হয়, খেলা না হয়, তাকে স্পর্শ করা না হয় তাহলে তার মস্তিষ্কের আকার ২০-৩০% ছোট হয়ে যায়। ছোঁবেন কখন, আপনি তো অফিসে! আপনার স্ত্রীও অফিসে।

কথা বলারও সময় নেই। টেলিভিশনের কথা না, আপনার নিজের কথা বলার কথা বলছি আমরা। প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, একটা প্রাণীকে আটকে রেখে যদি অন্য প্রাণীদের খেলা দেখতে দেয়া হয় – টিভির মতো যেখানে আপনার নিজের নড়াচড়া নাই কিন্তু আপনি নড়াচড়া দেখছেন – তাহলে দেখা গেছে, প্রাণীটা যত বেশি দেখেছে, তত বেশি তার মস্তিষ্কের আকার কমে যাচ্ছে। এরপর ব্যাপারটা টিভির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে দেখা যাবে, টিভি শুধু দুইটা ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করে – দেখা আর শোনা। 

এতে করে আপনার চিন্তাশক্তি কমে যাচ্ছে, মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে, কল্পনাশক্তি কমে যাচ্ছে – আপনি লিখতে-পড়তে পারবেন না, আপনার কোন মনোযোগ থাকবে না!

এখানে একজন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি? শিশুচিকিৎসক সুজান পরামর্শ দিলেন,

১) যতটা সম্ভব টিভি বন্ধ করে রাখুন।

এটা খুবই সাধারণ কথা। আমাদের বাসায় বারো বছর টিভি চলে না। বাসায় দুইটা বাচ্চা আছে, একজন এগার বছর অন্যজন আট, জীবনে কোনদিন টিভি দেখেনি তারা। তাদের মস্তিষ্কের গ্রহণক্ষমতা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না – বড়টা নিজে নিজে কুরআন দেখতে দেখতে পড়তে শিখেছে। আসহাবে রাসূলের কাহিনী, ইবন কাসীর তার পড়া শেষ। কেন? তার তো “ইনপুট” দরকার! তার মস্তিষ্ক কিন্তু খালি! এবং তার কত প্রশ্ন – জীবন নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে! টেলিভিশন দেখা বাচ্চারা কিন্তু কোন প্রশ্ন করবে না। তার প্রশ্ন করার কিছু নাই, ওখানেই সে সব দেখছে।

২) বাচ্চাদের বই পড়ে শোনাবেন – যেটা আমাদের মায়েরা, খালারা বা বড় ভাই-বোনেরা করেছে – বিশেষ করে ছবি ছাড়া বই।

আজকাল দেখবেন পুরো বইজুড়ে শুধু ছবি, এক লাইন লেখা। উনি কিন্তু উল্টা বলছেন, পুরোটা লেখা, একটু হয়ত ছবি থাকতে পারে। এতে কী হবে? সে কল্পনা করতে শিখবে। মুসলিম পরিবারে ছবি ছাড়া গল্প বলা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমরা যখন নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) গল্প বলি আমরা কি ছবি দেখাই? আর প্রচুর গল্প বলবেন।  ইনশাল্লাহ আমরা যারা মুসলিম আমরা নবী-রাসূলের গল্প, সাহাবীদের গল্প, কুরআন-হাদীসের গল্প বলব। আজকাল অনেক সাহিত্য আছে যেখান থেকে আমরা পড়তে পারি।

৩) প্রকৃতি! প্রকৃতি! প্রকৃতি!

যার যতটুকু সময় ও সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন, প্রকৃতির কাছে বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন। যতবার সম্ভব। প্রতিটি সম্ভাব্য ছুটিতে। এমনকি প্রতি সপ্তাহ শেষে যদি পারেন – ঘাস, মাটি, পোকা, বালু, কাদার ভেতর নিয়ে যাবেন। ধৈর্যের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে প্রকৃতি। একটা গাছ পুঁতল, পানি দিল কিন্তু গাছটা মরে গেল। গাছ মরতেই পারে। শিক্ষা না এটা? আমার একটা ছোট ভাই ছিল, আব্বা-আম্মার অনেক আদরের কিন্তু মারা গেছে। মরতে পারে না? প্রকৃতি আপনাকে ধৈর্য শিখাবে। আপনি ধাক্কা খাবেন না। বুঝবেন যে সবকিছু ধীরে ধীরে হয়। “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” উল্টা জিনিস হচ্ছে “ডিলেইড গ্রাটিফিকেশন” (বিলম্বে তৃপ্তি)। এর উদাহরণ কী? রোজা! সারাদিন অপেক্ষার শেষে পানি খেতে পারবেন। প্রকৃতি আপনাকে এই শিক্ষা দিবে। মানুষের চরিত্রে এটা গড়ে তোলা দরকার। “নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূন্য থাক” – এটা কাফেরের দর্শন। আর ইসলামের মূল শিক্ষায় রয়েছে পরীক্ষা শেষের ফলাফল – কষ্ট করে ক্ষেতে বীজ বুনে, ফসলের জন্য যেমন আপেক্ষা করতে হয়। নগদ তেমন কিছুই পাবার নেই যেন, যতটুকু দরকার সেটুকু গ্রহণ করে আল্লাহ-নির্ধারিত নিয়মে ও আল্লাহর আনুগত্যে জীবন কাটাতে পারলে, আপনার জন্য রয়েছে জান্নাত। আল্লাহর রাসূলের ওই হাদীস, সমুদ্রের পানিতে আঙ্গুল ডুবিয়ে নিয়ে আসলে যা আঙ্গুলে লেগে থাকে সেটুকু দুনিয়ার জীবন। আর সমুদ্রে যেটুকু পানি রয়ে গেল, তা হোল আখিরাতের অনন্ত জীবন। তাহলে একজন মুসলিম কোন অবস্থায় এই দুনিয়ার জন্য আখিরাতকে নষ্ট করবে না। বরং, আখিরাতে প্রাপ্তির জন্য সে এখানে ধৈর্যধারণ করবে। সে এখানে ত্যাগ করবে, কষ্ট করবে, চোখমুখ বুঁজে থাকবে, সহ্য করে যাবে অনেক কিছু।

এরপর লেখিকা সুজান বলছেন, প্রকৃতি হচ্ছে পর্যবেক্ষণের বড় শিক্ষক। এর রঙগুলো দেখার মতো – আর তা সবগুলো ইন্দ্রিয়কে উজ্জীবিত করে তোলে। একটা ফুল-ফোটা সর্ষেক্ষেত আর কিছু দিয়ে বর্ণনা করা যায়? এরপর উনি বলছেন, আজ অনেক বাচ্চা আছে যারা প্রকৃতির কাছে যেতে আগ্রহ পায় না, বলে ‘তোমরা যাও আমি এখানে বসে কার্টুন দেখি বা গেম খেলি।’ আছে না এমন? নড়তে চায় না। মুরগী (ফ্রাইড চিকেন) খেতে খেতে এরা মোটা হয়ে গেছে। ফাস্টফুড কিন্তু “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন”, মানে রান্নার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই – সেই ধৈর্যও নেই। এক্ষুণি দরকার আমার – সুতরাং পয়সা দিয়ে ফাস্টফুডের দোকান থেকে মুহূর্তে কিনে নিয়ে আসতে চাই!

যাহোক, উনি বলছেন অনেকসময় যারা টিভি দেখে, প্রকৃতিকে তাদের বোরিং মনে হয় কারণ তারা টিভির দ্রুতলয়ের অ্যাকশনে খুবই অভ্যস্ত হয়ে যায়। ‘টুং-টুং’, ‘ব্যাঙ’, ‘দুম-দুম’ গুলি ইত্যাদি শব্দ আছে না? এর বিপরীতে প্রকৃতিকে তাদের নীরব, অ্যাকশনবিহীন মনে হয়। প্রকৃতিতে যে কোন জিনিস কিন্তু ধীর, শান্ত, শান্তিপূর্ণ। সেখানে একটার পর একটা ঘটনা ধীরে ধীরে ঘটে, প্রকৃতির কর্মকান্ডের প্রত্যাশায় ধৈর্যের ব্যপার রয়েছে।

৪) আপনার নিজের ও বাচ্চার ইন্দ্রিয়ের প্রতি মনোযোগ দিন।

মাঝে মাঝে বাচ্চাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে দেখতে পায় কি না জিজ্ঞেস করবেন। এমন কিন্তু হয় যে একটা বাচ্চা এক চোখে দেখে না অনেকদিন – অথচ বাবা-মা জানেই না, কারণ সে অ্যাডজাস্ট করে নেয়। তাকে জিজ্ঞেস করবেন কোনটা কী রঙ বোঝার জন্য যে সে “কালার ব্লাইন্ড” কি না। সে সবরকম স্বাদ, গন্ধ চিনতে পারে কি না – অনেক মানুষ আছে সব ধরনের স্বাদ, গন্ধ পায় না। এগুলো নিজেরটা ও বাচ্চারটা পরীক্ষা করে দেখবেন।

৫) শিশুদের হাত, পা ও পুরো শরীর ব্যবহার করে অর্থবহ কাজ করতে দিন।

খেয়াল করবেন সে হাত, পা, সম্পূর্ণ শরীর ব্যবহার করছে কি না। তাকে মাঠে ঘাটে ছেড়ে দিন, ও দৌড়াক, আছাড় খাক, হাত-পা ছিলুক – এগুলো সব প্রয়োজনীয়!

এই ছিল শিশু বিশেষজ্ঞ সুজানের ৫টি পরামর্শ।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment