আকিদায়ে খতমে নবুয়ত: কাসেম নানতুবি ও মির্যা কাদিয়ানি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ (দ্বিতীয় পর্ব)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী

……………………………..

খাতামুন নবীয়্যিনের অর্থে বিকৃতি:

আমাদের প্রিয় নবী রাসূলে আকরাম (দ.) খাতামুন নবীয়্যিন- সর্বশেষ নবী। নবীগণের শেষ। নবীগণের অগমনধারা সমাপ্তকারী। তাঁর পরে কোন নবী আসবে না। সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হিসেবে নবীজির আগমনের পর নবুয়ত ও রেসালতের এ ধারা বন্ধ হয়ে গেছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا ﴾

(মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন, তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী) [আল কুরআন, আহযাব ৩৩: ৪০]

রাসূলে আকরাম (দ.) খাতামুন নবীয়্যিন-সর্বশেষ নবী এটা নসসে কতয়ী দ্বারা প্রমাণিত। হাদিসে মুতাওয়াতির দ্বারা প্রমাণিত। সাহাবোয়ে কেরাম থেকে এ পর্যন্ত যত মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, মুজতাহিদ ফকিহ ও ইমাম সকল ইমাম ও মুসলিম উম্মাহর ইজমা বা ঐক্যমত।

কিন্তু দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী ক্বাসেম নানূতভী কোরআন পাকের বাণী ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’র এমন মনগড়া ও নতুন অর্থ গ্রহণ করেছেন যা দ্বারা প্রিয় নবীর ‘শেষ নবী” হওয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং এটা কুরআন হাদীস ও ইজমোয়ে উম্মতের বিপরীত। কুরআন, হাদিস, তাফসীর ও ইজমায়ে উম্মত এবং মুসলিম মিল্লাতের ঐক্যবদ্ধ আকিদা ও বিশ্বাস হলো, কুরআন করীমের বাণী খাতামুন নবীয়্যিনের অর্থ হলো- রাসূলে আকরাম (দ.) সর্বশেষ নবী। এটা ইবারাতুন নস দ্বারা প্রমাণিত। কুরআনে করীমে যে আকিদা ও নজরিয়া বর্ণনা করার জন্য এ শব্দাবলী মওজুদ আছে সেখানে এর অর্থ শেষ নবী। তাঁর পরে কাউকে নবুয়ত দেয়া হবে না। এ বিষয়েও মুসলিম মিল্লাত ঐক্যবদ্ধ যে, রাসূলে আকরাম (দ.) আখেরী নবী-সর্বশেষ নবী। এটাই মুসলিম মিল্লাতের আকিদা ও বিশ্বাস এবং এটা তাঁর সবচেয়ে বড় ফজিলত বৈশিষ্ট্যও। ওলামায়ে কেরাম এও বলেছেন যে, নবীজীকে সর্বশেষ নবী মানা জরুরীয়তে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকলেই খাতামুন নবীর অর্থ বলেছেন আখেরী নবী-শেষ নবী। এ অর্থ ছাড়া কুরআনের বাণী- “খাতামুন নবীয়্যিনের” অন্য কোন অর্থ না রাসূল থেকে বর্ণিত, না সাহাবী ও তাবেয়ীন থেকে বর্ণিত, না আয়িম্মায়ে মুজতাহেদীন থেকে বর্ণিত, না ওলামায়ে মুতাকাদ্দেীন ও মুতাআখখেরীন থেকে বর্ণিত। সুতরাং কুরআনের উপরিউক্ত বাণী “খাতামুন নবীয়্যিন” অর্থ শেষ নবী-আখেরী নবী স্বীকার করা জরুরীয়তে দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। আর এ আকিদাও জরূরীয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত যে, সর্বশেষ নবী হওয়ার মধ্যে তাঁর জন্য বড় ফজিলত রয়েছে। আর জরুরীয়াতে দ্বীনের কোন একটিও অস্বীকারী কাফের হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কুরআনের এ অর্থ যে গ্রহণ করবে না সে কাফের। “খাতামুন নবীয়্যিনের” এ অর্থ ভিন্ন অন্য কোন অর্থ গ্রহণ করা বা এতে তাবিল করা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। বরং খাতিমুননবিয্যিনের এ অর্থ ভিন্ন কেউ অন্য অর্থ গ্রহণ করলে তাকে ওলামায়ে কেরাম কাফের ও হত্যা করতে বলেছেন। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ) কিন্ত নানুতুবীর মতে, সর্বশেষ নবী হওয়ার আকিদাকে সাধারণ লোকের খেয়াল সাব্যস্ত করেছেন এবং আওয়ামের ধারণা বলেছেন। প্রকাশ্য অর্থকে বাদ দিয়ে ভিন্ন অর্থ করেছেন, মুর্খদের ধারণা বলেছেন।

তিনি লিখেছেন-

بعد حمد و صلاۃ کے قبل عرض جواب یہ گذارش ہے کہ اول معنی خاتم النبین معلوم کرنے چاہئیں تاکہ فہم جواب میں کچھ وقت نہ ہو سو عوام کے خیال میں تو رسول صلعم کا خاتم ہونا بایں معنی ہے کہ آپ کا زمانہ انبیاء سابق کے زمانہ کے بعد اور آپ سب میں آخری نہیں ہیں مگرا ہل فھم پر روشن ہوگا کہ تقدم یا تاخر زمانی میں بالذات کچھ فضیلت نہیں پھر مقام مدح میں ولکن رسول اللہ و خاتم النبین فرما نا اس صورت میں کیوں کر صحیح ہو سکتا ہے –

অনুবাদ: হামদ ও সালাতের পর জবাব পেশ করার পূর্বে নিবেদন এ যে, প্রথমে ‘খাতামান্নবিয়্যীন’র অর্থ করা চাই, যাতে জবাব অনুধাবন করতে কিছুক্ষণও দেরী না হয়। সুতরাং সাধারণ (মুর্খ) লোকদের ধারণায় তো রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতাম’ (সর্বশেষ নবী) হওয়া এ অর্থে যে, তাঁর যুগ পূর্ববর্তী নবীগণের যুগের পরে এবং তিনি সকলের মধ্যে শেষ নবী। কিন্তু বুঝশক্তি সম্পন্নদের নিকট এ কথা সুস্পষ্ট যে, যমানা আগে পরে হবার মধ্যে মূলতঃ কোন ফজিলত নেই। অতঃপর প্রশংসার স্থানেولکن رسول اللہ و خاتم النبین (কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল ও সর্বশেষ নবী) এরশাদ করা এমতাবস্থায় কিভাবে শুদ্ধ হতে পারে? [তাহযিরুন নাস: 3, কুতুবখানা রহীমিয়া, দেওবন্দ]

দেখুন! নানুতভী সাহেব এ ইবারতে কোরআন করীমের সর্বযুগে অগণিত বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত অর্থকে অস্বীকার করেছেন। কেননা, কোরআন-ই পাকে যে ‘খাতামুন্নাবিয়্যান’ (শেষ নবী) শব্দটা এসেছে সেটার অগণিত সূত্রে বর্ণিত অর্থ হচ্ছে আখেরুন্নবিয়্যীনই (অর্থাৎ সর্বশেষ নবী)। এটাকে “সাধারণ বা অবুঝ-মুর্খ লোকের খেয়াল” বলে সাব্যস্ত করে প্রকৃতপক্ষে তিনি এর মাধ্যমে ক্বোরআন করীমের অগণিত সূত্রে বর্ণিত অকাট্য অর্থকেই অস্বীকার করেছেন। নবীর শেষ নবী হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। অসংখ্য মুতাওয়াতির হাদীসকে অস্বীকার করেছেন। সমগ্র উম্মতের ইজমাকে অস্বীকার করেছেন এবং রাসূলে আকরাম (দ.) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, আয়েম্মায়ে মুজতাহেদিন, ওলামায়ে মুতাকাদ্দেীন ও মুতাআখখেরীন সহ সকল মুসলিম মিল্লাতকে আওয়াম বা অবুঝ-মূর্খ বানিয়ে ফেলেছেন! সমগ্র মুসলিম ‍উম্মাহর সকলে নবীকে শেষ নবী মানার কারণে মুর্খ হয়ে যায় তাহলে সেই আহলে ফাহম বা জ্ঞানী লোক কে- যে খাতামুন্নবিয়্যিন অর্থ শেষ নবী ভিন্ন অন্য অর্থ করেছেন?

পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে খতমে নবুয়তের (আল্লাহর হাবীব যে সর্বশেষ নবী) এ আকিদার উপর সর্বশেষ হামলা এসেছে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মাধ্যমে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির ছত্রছায়ায় বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সর্বশেষে সে নিজেকে নবী দাবি করে বসে। সেও কুরআনের আয়াত খাতামুন নবিয়্যিনের অপব্যাখ্যা করেছিলো এ রকম যা বর্ণনা করেছেন কাসেম নানুতুবী।

মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রাথমিক অবস্থায় তার মনোভাব গোপন রাখে। পর্যায়ক্রমে মুজাদ্দিদ, মাহদী, প্রতিশ্রুত মসীহ, জিল্লী নবী, বুরুজী নবী, সহায়ক নবী ও সর্বশেষে স্বতন্ত্র পয়গাম্বর দাবি করে তার স্বরূপ প্রকাশ করে। যারা গোলাম আহমদকে নবী বলে বিশ্বাস রাখে তাদেরকে কাদিয়ানী দল বলা হয়ে থাকে।

দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা কাশেম নানুতুবির ভুল ব্যাখ্যা কাদিয়ানীদের নবী দাবি প্রমাণের পথ আরো প্রশস্ত করে দিয়েছে।যেটাকে তারা তাদের পক্ষে বড় দলিল মনে করে। উল্লেখ্য যে, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ইং সনে যখন পাকিস্তান জাতীয় সংসদে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে প্রমাণাদি উত্থাপন করা হচ্ছিল তখন কাদিয়ানী প্রতিনিধি মীর্জা নাসের নিজেকে মুসলমান দাবি করার স্বপে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা কাছিম নানুতবীর লিখিত ‘তাহজিরুন্নাছ’ কিতাব থেকে উপরিউক্ত উদ্ধৃতিকে দলিল হিসেবে পেশ করেছিলো।

কাছিম নানুতবী লিখিত উপরোক্ত এবারতের উত্তর মুফতি মাহমুদসহ সংসদে উপস্থিত কোন দেওবন্দীদের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতাদর্শী জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান এর নির্বাচিত সাংসদ যথাক্রমে আল্লামা শাহ আহমদ নূরানী ও আল্লামা আব্দুল মোস্তফা আজহারী উভয়ে বজ্রকন্ঠে গর্জে উঠলেন আর বললেন, আমরা উক্ত উদ্ধৃতির লেখক ও সমর্থক উভয় শ্রেণীকে এভাবে কাফির মনে করি, যেভাবে কাদিয়ানীদেরকে মনে করি।

ওহাবী-দেওবন্দিরা খতমে নুবুয়ত সম্মেলন করে, কাদিয়ানীকে কাফের মনে করে কিন্তু তারা এখনও কাশেম নানুতুবির বক্তব্য সঠিক মনে করে। তাদের অনুসারীরা হরহামেশা তাদের আলেমদের নবীর সমতুল্য দাবি করছে, হাদীসের শিক্ষার্থীদের রুহানী সাহাবী বলছে। বাংলাদেশে কিছু দেওবন্দি ও কওমি আলেম তাদের আলেমদেরকেও নবীর সমতুল্য, হাদিসের দরসে অংশগ্রহণকারীদের রুহানি সাহাবী বলাসহ বিভিন্ন অপব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। আর এ অপব্যাখ্যার অন্তরালে প্রকৃপক্ষে খতমে নুবুয়ত অস্বীকার করছে। কিন্তু তাদের শীর্ষ পক্ষ থেকে এখনও এর কোন জবাব আসে নি। এ থেকে তাদের উভয়ের দাবি এক মনে হয় এবং তাদের পরস্পর মিল রয়েছে। এ ব্যাপারে দেওবন্দি ও কওমি ওলামায়ে কেরামের সুস্পষ্ট বক্তব্য দাবি করি। অন্যথায় তারাও তেমনি কাফির যেভাবে কানিয়ানিরা কাফির। কারণ, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী তারপরে কোন নবী আসবে না, এ কথায় যারা সন্দেহ করে বা অপব্যখ্যা করে তারা সকলেই কাফির। তাদের কুফরির ব্যাপারে যারা সন্দেহ করবে তারাও কাফির।

(চলবে)

………………………….

ড. এ. এস. ইউসুফ জিলানী

07/10/2023 ইং

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment