বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আকীকা করার নিয়ম: আজকে আলোচনা করতে চাই আকিকা দেওয়ার সঠিক নিয়ম কানুন ও আকিকার দোয়া সম্পর্কে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সন্তানের সাথে আকিকা জড়িত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার থেকে কষ্ট দূর করে দাও (অর্থাৎ তার জন্য একটি আকিকার পশু যবেহ কর এবং তার মাথার চুল ফেলে দাও)। আকিকার পশু জবাই করার দোয়া।
বুখারী, মিশকাত হা/৪১৪৯ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
আকিকা শব্দের অর্থ কি ও আকিকা কাকে বলে
আকিকা শব্দটি আরবি; এটি আরবি عَقٌّ শব্দ থেকে নির্গত; এর অর্থ হচ্ছে কাটা, পৃথক করা। পারিভাষিক অর্থে সপ্তম দিনে নবজাতক শিশুর মাথার চুল ফেলার সময় যবেহকৃত পশুকে আকিকা বলা হয়।
আল-মুজামুল ওয়াসীত্ব।
আকিকার ইতিহাস
(১) বুরাইদা (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগে আমাদের কারও সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার পক্ষ হতে একটি বকরী যবেহ করা হত এবং তার রক্ত শিশুর মাথায় মাখিয়ে দেওয়া হত। অতঃপর ইসলাম আসার পর আমরা শিশু জন্মের সপ্তম দিনে বকরী যবেহ করি এবং শিশুর মাথা মুন্ডন করে সেখানে জাফরান মাখিয়ে দেই (আবু দাউদ)। রাযীন এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐ দিন আমরা শিশুর নাম রাখি।
মিশকাত হা/৪১৫৮ ‘যবেহ ও শিকার’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
(২) হযরত আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, হাসান -এর আকিকার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কন্যা ফাতেমাকে বলেন, হাসানের মাথার চুলের ওজনে রুপা ছাদাক্বা কর। তখন আমরা তা ওজন করি এবং তা এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) বা তার কিছু কম হয়।
তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৫৪; আহমাদ, ইরওয়া হা/১১৭৫।
উল্লেখ্য যে, ‘চুলের ওজনে স্বর্ণ অথবা রৌপ্য দেওয়ার ও সপ্তম দিনে খতনা দেওয়ার বিষয়ে বায়হাক্বী ও ত্বাবারাণী বর্ণিত হাদীস যঈফ।
আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৮৩, ৩৮৫ পৃঃ।
আকিকার বিধান কি
আকিকা করা সুন্নত। সাহাবী, তাবেঈ ও ফকীহ বিদ্বানগণ প্রায় সকলেই এতে একমত। হাসান বাছরী ও দাউদ যাহেরী একে ওয়াজিব বলেন। তবে আহলুর রায় (হানাফী) গণ একে সুন্নাত বলেন না। কেননা এটি জাহেলী যুগে রেওয়াজ ছিল। কেউ বলেন, এটি তাদের কাছে ইচ্ছাধীন বিষয়।
ইবনে কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৮৬; নায়ল ৬/২৬০ পৃঃ।
নিঃসন্দেহে এটি প্রাক-ইসলামী যুগে চালু ছিল। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরন পৃথক ছিল। ইসলাম আসার পর আকিকার রেওয়াজ ঠিক রাখা হয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরনে পার্থক্য হয়। জাহেলী যুগে আশুরার সিয়াম চালু ছিল। ইসলামী যুগেও তা অব্যাহত রাখা হয়। অতএব প্রাক-ইসলামী যুগে আকিকা ছিল বিধায় ইসলামী যুগে সেটা করা যাবে না, এমন কথা ঠিক নয়।
আকিকার গুরুত্ব ও ফজিলত
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সন্তানের সাথে আকিকা জড়িত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার থেকে কষ্ট দূর করে দাও (অর্থাৎ তার জন্য একটি আকিকার পশু যবেহ কর এবং তার মাথার চুল ফেলে দাও)।
বুখারী, মিশকাত হা/৪১৪৯ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
(২) রাসূল (সা) বলেন, প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়।
আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আহমাদ; ইরওয়া হা/১১৬৫।
ইমাম খাত্তাবী বলেন, ‘আকীকার সাথে শিশু বন্ধক থাকে’-এ কথার ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, যদি বাচ্চা আক্বীকৃা ছাড়াই শৈশবে মারা যায়, তাহলে সে তার পিতা-মাতার জন্য কিয়ামতের দিন শাফাআত করবে না। কেউ বলেছেন, আকিকা যে অবশ্য করণীয় এবং অপরিহার্য বিষয়, সেটা বোঝানোর জন্যই এখানে ‘বন্ধক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিশোধ না করা পর্যন্ত বন্ধকদাতার নিকট বন্ধক গ্রহীতা আবদ্ধ থাকে।
শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২৬০ পৃঃ ‘আকিকা’ অধ্যায়।
সাহেবে মিরকাত মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, এর অর্থ এটা হতে পারে যে, আকিকা বন্ধকী বস্তুর ন্যায়। যতক্ষণ তা ছাড়ানো না যায়, ততক্ষণ তা থেকে উপকার গ্রহণ করা যায় না। সন্তান পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। অতএব এজন্য শুকরিয়া আদায় করা তাদের উপর অবশ্য কর্তব্য।
মিরক্বাত শরহে মিশকাত (দিল্লী ছাপা, তারিখ বিহীন) আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ ৮/১৫৬ পৃঃ।
(৩) সাত দিনের পূর্বে শিশু মারা গেলে তার জন্য আকিকার কর্তব্য শেষ হয়ে যায়।
নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।
আকিকার পশু কয়টি ও কেমন হতে হবে
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছাগ হোক বা ছাগী হোক, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি আকিকা দিতে হয়।
নাসাঈ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৫২, ৪১৫৬; ইরওয়া হা/১১৬৬।
পুত্র সন্তানের জন্য দুটি দেওয়াই উত্তম। তবে একটা দিলেই চলবে।
আবু দাউদ, মিশকাত হা/৪১৫৫; নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২,২৬৪ পৃঃ।
ছাগল দু’টিই কুরবানীর পশুর ন্যায় ‘মুসিন্নাহ’ অর্থাৎ দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত ওয়ালা হতে হবে এবং কাছাকাছি সমান স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। এমন নয় যে, একটি মুসিন্না হবে, অন্যটি মুসিন্না নয়।
নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২ পৃঃ; আওনুল মাবুদ হা/২৮১৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
একটি খাসি ও অন্যটি বকরী হওয়ায় কোন দোষ নেই।
(২) ত্বাবারাণীতে উট, গরু বা ছাগল দিয়ে আকিকা করা সম্পর্কে যে হাদিস এসেছে, তা ‘মওযূ’ অর্থাৎ জাল।
আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৬৮।
তাছাড়া এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আমল নেই।
আকিকা কত দিনে করতে হয়
(১) রাসূল (সা) বলেন, প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সাথে বন্ধক থাকে; অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়।
(২) সাত দিনের পর ১৪ ও ২১ দিনে আকিকা দেওয়ার ব্যাপারে বায়হাকী, ত্বাবারাণী ও হাকেম বুরায়দা ও আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসকে শায়খ আলবানী যঈফ বলেছেন।
ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭০।
(৩) শাফেঈ বিদ্বান গণের মতে সাত দিনে আকিকার বিষয়টি সীমা নির্দেশ মূলক নয় বরং এখতিয়ার মূলক। ইমাম শাফেঈ বলেন, সাত দিনে আক্বীকার অর্থ হল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আকিকা করবে না। যদি কোন কারণে বিলম্ব হয়, এমনকি সন্তান বালেগ হয়ে যায়, তাহলে তার পক্ষে তার অভিভাবকের আকীকার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সে নিজের আকীকা নিজে করতে পারবে।
নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।
উল্লেখ্য যে, নবুয়ত লাভের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের আকীকা নিজে করেছিলেন বলে বায়হাকীতে আনাস (রা) বর্ণিত হাদীছটি মুনকার বা যঈফ।
নায়লুল আওত্বার ৬/২৬৪ পৃঃ।
বরং এটাই প্রমাণিত যে, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার আকিকা করেন ও ‘মুহাম্মদ’ নাম রাখেন।
বায়হাকী, দালায়েলুন নবুওয়াত (বৈরুত ১৯৮৫) ১/১১৩ পৃঃ; সুলায়মান মানসুরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্লী, ১৯৮০) ১/৪১ পৃ।
আকিকার পশু জবাই করার দোয়া
আলা-হুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, আক্বীক্বাতা ফুলান। বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার। এ সময় ‘ফুলান’-এর স্থলে বাচ্চার নাম বলা যাবে।
মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, আবু ইয়ালা, বায়হাকী ৯/৩০৪ পৃঃ; নায়ল ৬/২৬২ পৃঃ।
মনে মনে নবজাতকের আকিকার নিয়ত করে মুখে কেবল ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবর’ বললেও চলবে।
আকিকার গোস্ত বন্টনের নিয়ম
(ক) আকিকার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় তিন ভাগ করে একভাগ ফকির-মিসকিনকে ছাদাক্বা দিবে ও এক ভাগ বাপ-মা ও পরিবার খাবে এবং এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে হাদিয়া হিসাবে বন্টন করবে।
বায়হাক্বী ৯/৩০২ পৃঃ।
চামড়া বিক্রি করে তা কুরবানীর পশুর চামড়ার ন্যায় ছাদাক্বা করে দিবে।
ইবনে রুশদ কুরতুবী, বিদায়াতুল মুজতাহিদ (রাবাত, মরক্কো: ১৪১৯ হিঃ) ১/৪৬৭ পৃঃ।
আকিকার অন্যান্য মাসআলা
(ক) আকিকা একটি ইবাদত. এর জন্য জাঁকজমকপূর্ণ কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ উপলক্ষে আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে উপঢৌকন নেওয়ারও কোন দলিল পাওয়া যায় না।
(খ) আকিকা ও কুরবানী দুটি পৃথক ইবাদত। একই পশুতে কুরবানী ও আকিকা দু’টি একসাথে করার কোন দলিল নেই।
(গ) আকীকা ও কুরবানী একই দিনে হলে সম্ভব হলে দু’টিই করবে। নইলে কেবল আকিকা করবে। কেননা আকিকা জীবনে একবার হয় এবং তা সপ্তম দিনেই করতে হয়। কিন্তু কুরবানী প্রতি বছর করা যায়।
(ঘ) পিতার সম্মতি ক্রমে অথবা তার অবর্তমানে দাদা, চাচা, নানা, মামা যে কোন অভিভাবক আকিকা দিতে পারেন। হাসান ও হোসায়েন -এর পক্ষে তাদের নানা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আকিকা দিয়েছিলেন।
আবু দাউদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪১৫৫।
(ঙ) শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর হাদিস পন্থী কোন দ্বীনদার আলেমের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁর নিকট থেকে শিশুর ‘তাহনীক’ করানো ও শিশুর জন্য দুআ করানাে ভাল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা করতেন।
মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪১৫১ ‘আকীকা’ অনুচ্ছেদ।
তাহনীক অর্থ খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে বাচ্চার মুখে দেওয়া; হিজরতের পর মদিনায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুহাজির সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিয়ে তাহনীক’ করেছিলেন; এভাবে তিনিই ছিলেন প্রথম সৌভাগ্যবান শিশু যার পেটে প্রথম রাসূলের পবিত্র মুখের লালা প্রবেশ করে; পরবর্তী জীবনে তিনি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন; আনসারগণ তাদের নবজাতক সন্তানদের রাসূলের কাছে এনে ‘তাহনীক’ করাতেন; আবু তালহা (রাঃ) তার সদ্যজাত পুত্রকে নিয়ে রাসূলের কোলে দিলে তিনি খেজুর তলব করেন; অতঃপর তিনি তা চিবিয়ে বাচ্চার গালে দেন ও নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ’।
ইবনে কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৯০ পৃঃ।
তাহনিক করার পর শিশুর কল্যাণের জন্য দোয়া করবেন- ‘বা-রাকাল্লাহু আলায়েক’ ‘আল্লাহ তােমার উপরে অনুগ্রহ বর্ষণ করুন।
মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা : তারিখ বিহীন) ৮/১৫৫ পৃঃ।