অধ্যক্ষ আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রহ.)’র জীবন ও কর্ম

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

নাম ও জন্মস্থান

তাঁর নাম মুহাম্মদ আব্দুল জলিল। পিতার নাম মুন্সী আদম আলী মোল্লা এবং মাতার নাম মালেকা খাতুন। তিনি ছিলেন চার বোন ও ছয় ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।

১১ সেপ্টেম্বর রোজ শনিবার ১৯৩৩ সাল (২৬ শে ভাদ্র, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর-এর অধিনস্ত আমিয়াপুর গ্রামে জন্ম লাভ করেন।

তিনি হাফেয এম.এ জলিল ও অধ্যক্ষ এম.এ জলিল নামেও পরিচিত। লকব শাইখুল মুদাররিসীন (যা তাঁর পৈত্রিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত)।

বংশ পরিচয়

দিল্লীর বুযুর্গ ফিকাহবিদ, মুফাচ্ছির এবং বাদশাহ আলমগীরের ছেলের ওস্তাদ হযরত মোল্লা আহমদ জিয়ুন রহ. ছিলেন আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল রহ.-এর বংশের পূর্ব পুরুষ। হযরত মোল্লা আহমদ জিয়ুন রহ . রচিত ফিকাহ নীতি শাস্ত্র ’নূরুল আনওয়ার’ গ্রন্থখানি দুনিয়াব্যাপী সমাদৃত এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ফাযিল জামাআতের পাঠ্যভুক্ত কিতাব।

১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের কারণে ইংরেজ কর্তৃক মুঘল সালতানাতের পতনের পর হযরত মোল্লা জিয়ুন রহ.-এর বংশধরগণের একটি শাখা প্রাণভয়ে তৎকালীন ত্রিপুরা, বর্তমান কুমিল্লার ময়নামতিতে হিজরত করে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কালক্রমে ঐ বংশই বর্তমান মতলব (উত্তর), চাঁদপুরস্থ আমিয়াপুর গ্রামে বসবাস করতে থাকে।

মাতার দিক দিয়েও তিনি ছিলেন সৌভাগ্যবান। তাঁর সম্মানিত নানাজান হযরত ভোলা গাজী মিয়াজী রহ. ছিলেন একজন কামেল অলি এবং বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন যিনি নিজ হাতে কুরআন কপি করে এবং মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

মৃত্যুর পর জ্বীনেরা এসে রাতের আঁধারে তাঁর কবরের পাশে আলো জ্বালিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতো, যা সর্বজন বিদিত। মতলব উত্তরের একই গ্রামের মিয়াজী বাড়িতে তাঁর সম্মানিত নানাজানের কবর অবস্থিত।

শিক্ষাজীবন

আল্লামা এম এ জলিল (রহ.) প্রথমে মক্তবে কুরআন মাজিদ ও কিছু কিতাব শিক্ষা করেন। ৪র্থ শ্রেণী পাস করার পর হিফজ আরম্ভ করেন এবং ১৯৫২ সালে দু’বছর তিন মাসে হিফজ শেষ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে  আলিয়া মাদ্রাসায়  ভর্তি হয়ে  দাখিল, আলিম, ফাযিল  ও  কামিল (হাদীস)  ১ম  বিভাগে বৃত্তিসহ  (১৯৫৬-১৯৬৪ ইং  সালে) উত্তীর্ণ  হন।  তারপর  ইন্টারমিডিয়েট, ডিগ্রি  এবং    এম    এ   (জেনারেল   ইতিহাস)    উচ্চতর   দ্বিতীয় বিভাগে   স্টাইপেন্ডসহ (১৯৬৪-১৯৭০)  পাস  করেন।

কর্মজীবন

১৯৭০  সালে  জেনারেল  শিক্ষা  সমাপ্তির  পর ১৯৭২ সালে   কলেজে অধ্যাপনা  শুরু   করেন।  ছাগলনাইয়া কলেজ ও নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজে ১৯৭৫ ইং সাল পর্যন্ত ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেন। উচ্চতর শিক্ষালাভের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে তিনি চট্টগ্রাম শহরে ১৯৬৪-৭৮ ইং পর্যন্ত হযরত তারেক শাহ্ রহ. দরগাহ মসজিদে ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপনার ফাঁকে ১৯৭৩ ইং সালে এক বছর অগ্রণী ব্যাংকে প্রবেশনারী অফিসার হিসাবে কাজ করে ইস্তফা দেন। ১৯৭৩ ইং সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হাজীগঞ্জ বড় মসজিদে ১৯৭৫ সালে ছয় মাস ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করে ইস্তফা দিয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম চলে যান। চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে ১৯৭৭ সালে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদে ছিলেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ ইং সাল পর্যন্ত মধ্যখানে ৪ বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর ইমাম ট্রেনিং প্রজেক্ট ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে ডাইরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে পুনরায় যোগদান করেন  এবং   এখান থেকে  অবসর   গ্রহণ করেন।

সাংগঠনিক অবদান

অধ্যক্ষ এম. এ জলিল রহ. এর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি আহলে সুন্নাতের নির্বাচিত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।

রচনাবলী

তফসির গ্রন্থ, বুখারী শরীফসহ তাঁর লিখিত, অনুদিত ও সম্পাদিত অনেক গুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১| অসমাপ্ত তাফসিরগ্রন্থ জলিলুল বয়ান ফী তাফসিরীল কোরআন।
২| বোখারী শরীফের বঙ্গানুবাদ।
৩| নূরনবী।
৪| ইরফানে শরীয়াত।
৫| হায়াত মউত কবর হাশর।
৬| মিলাদ ও কিয়ামের বিধান।
৭| শিয়া পরিচিতি।
৮| বালাকোট আন্দোলনের হাকিকত।
৯| গেয়ারবী শরীফের ইতিহাস।
১০| কারামাতে গাউছুল আযম।
১১| ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] ও না’ত লহরী।
১২| আহকামুল মাযার।
১৩| প্রশ্নোত্তরে- আকায়েদ ও মাছায়েল শিক্ষা।
১৪| ফতোয়ায়ে ছালাছা।
১৫| ফতোয়ায়ে ছালাছীন।
১৬| ইসলাহে বেহেশতী জেওর।
১৭|সফরনামা আজমীর
১৮| কালেমার হাকিকত।
১৯| রহমাতুল্লিন আলামীন।

দ্বীনি খেদমত

সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে বাতিল ফের্কার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অধ্যক্ষ এম.এ জলিল (রহ.) বে-মেছাল ভূমিকা রাখেন।ওলী-আল্লাহ বিদ্বেষী, জঙ্গীবাদী গোষ্ঠির বিরুদ্ধে তাঁর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা আজ তাঁকে এক কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে। যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট। বিভিন্ন ইসলামী সেমিনার, ওয়াজ-মাহফিল, মসজিদের মিম্বরে জুমুআয় প্রদত্ত তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শ্রোতাদের ইসলামের সঠিক রূপরেখার নির্দেশনা প্রদান করতো।

দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা

তিনি রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শরিয়ত ও তরিকত প্রচারের কেন্দ্র শাহজাহানপুর গাউছুল আযম জামে মসজিদ ও তাঁর নিজ গ্রামে বিবি  ফাতেমা মহিলা দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং  ১৯৯৯  সাল  থেকে মাসিক  সুন্নীবার্তাও প্রকাশ শুরু করেন।

বিদেশ ভ্রমণ

আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রহ.) ১৯৮০ সালে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ করেন। ভারতের আজমীর শরীফে হযরত খাজা গরীব নওয়াজ রহ. ও বেরেলী শরীফে আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত শাহ্ আহমদ রেজা খান বেরলভী রহ.-এর মাযার শরীফ যিয়ারত করে ফয়েয ও বরকত লাভ করেন।

১৯৮২ সালে ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে বাগদাদে অনুষ্ঠিত মোতামারে ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছীন প্রতিনিধি দলের সাথে গমন করেন।

সেই সাথে পবিত্র হজ্ব ও মদিনা মুনাওয়ারায় রাসূল করীম [ﷺ]-এঁর রওযা মুবারক যিয়ারত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। কারবালা ও বাগদাদ শরীফে গাউছুল আযম রহ.-এর মাযারসহ অসংখ্য ওলী ও নবীর মাযার শরীফ যিয়ারত করেন।

১৯৮৪ ইং ও ১৯৮৫ ইং সালে দু’বার ইরাক সরকারের আহ্বানে পুনরায় জমিয়াতুল মোদাররেছীনের প্রতিনিধি হিসাবে ইসলামী সম্মেলনে যোগ দান করেন এবং সেই সাথে যথাক্রমে হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেন।

খেলাফত লাভ

১৯৯৭ সনের ২৪শে নভেম্বর ইরাক সফরকালে বাগদাদ শরীফের মোতাওয়াল্লী সাইয়্যেদ আবদুর রহমান জিলানী (রহ.) তাঁকে কাদেরিয়া তরিকার খেদমত করার জন্য হস্ত লিখিত খেলাফতনামা প্রদান করেন।

ইন্তেকাল

ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষ ২০০৯  সালের  ২৩’শে সেপ্টেম্বর  বুধবার ৭৬ বছর বয়সে নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে দিদারে ইলাহীতে মিলিত হন।  চাঁদপুরস্থ মতলব উত্তর-এর   অধীনস্থ আমিয়াপুরে বিবি  ফাতেমা মহিলা দাখিল মাদ্রাসার কাছেই মা-বাবার কবরের পাশে তাকে শায়িত করা হয়।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment