অগণিত কারামতের ধারক গাউসুল আ’যম (কলাম -১)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান

ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে হযরত বড়পীর গাউসুল আ’যম মুহিউদ্দীন শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শুভ আবির্ভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতমন্ডিত। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির শেষার্ধে একদিকে ইসলামের শত্রুদের নানাবিধ চক্রান্ত, অন্যদিকে বিভিন্ন ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট জনগোষ্ঠী এবং উদাসীন শাসকবর্গের অস্বাভাবিক আদর্শচ্যুতির কারণে মুসলমানদের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়েছিলো, সর্বোপরি যখন মুসলিম সমাজে দ্বীন-ইসলাম মৃতপ্রায় হয়ে পড়লে একজন অসাধারণ বেলায়তী শক্তি সম্পন্ন সংস্কারক ও পুনরুজ্জীবিতকারীর জন্য আর্তনাদ ধ্বনিত হচ্ছিলো, ঠিক তখনই শায়খ ‘মুহিউদ্দীন গাউসুল আ‘যম শাহানশাহে বাগদাদের শুভ জন্ম হয়েছিলো। তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত ‘গাউসিয়াত-ই কুবরা’র অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ক্ষমতাবলে দ্বীন-ইসলামকে সার্বিকভাবে পুনর্জীবিত করেন। তাঁর পবিত্র জন্ম, শিক্ষার্জন, রিয়াযত ও সংস্কার পদ্ধতি ও এর সুদূরপ্রসারী সুফল ইত্যাদি -সবই কারামত বা অলৌকিকই ছিলো। তাঁর এ কারামতের সংখ্যাও অগণিত। বিশ্ব বরেণ্য অনেক বিজ্ঞ ইমাম ও ওলামা-ই কেরাম তাঁর কারামতগুলো অতি নির্ভরযোগ্য পন্থায় লিপিবদ্ধ করেছেন। যার ফলে হুযূর শাহানশাহে বাগদাদের কারামত ও গাউসিয়াতের বিষয়টি মানব সমাজের সর্বস্তরে সবিশেষ প্রসিদ্ধ। আমি এ নিবন্ধে হুযুর গাউসে পাকের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তার ওই অসংখ্য কারামতের কিছুটা উল্লেখ করে বরকত হাসিল করার প্রয়াস পেলাম।

জন্ম শরীফ
ওলীকুল শিরোমণি গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী কুদ্দিসা সিররুহ ৪৭০হি., ১ রমযানুল মুবারক জুমাবার সুবহে সাদিক্বের কিছু পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। এটাই প্রসিদ্ধতম অভিমত। জন্মস্থান- অনারবীয় ভূখন্ড তাবারিস্তানের পাশে ‘গীল’ বা ‘গীলান’, আরবীতে ‘জীল’ বা ‘জীলান’। আঠার বছর বয়সে তিনি বাগদাদে তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানেই ৯০/৯১ বছর বয়সে তাঁর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁর মাযার শরীফ অবস্থিত। [সূত্র- ‘আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্’ কৃত- ইমাম হাফেয ইবনে কাসীর দামেস্কী এবং নাফহাতুল উন্স’ কৃত- আল্লামা আব্দুর রহমান জামী]

অবশ্য, শায়খ আবুল ফাদ্বল সালিহ্ জীলী বলেছেন, হুযূর গাউসে পাকের জন্মসাল ৪৭১ হি.। তারিখ ও সময়ে উভয়ে একমত। এ মতভেদের কারণ হচ্ছে হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে এ সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, “যে বছর আমি বাগদাদ এসেছি, তখন ছিলো ৪৮৮ হিজরী আর আমার বয়স ছিলো আঠার বছর।” হুযূর গাউসে পাকের এ উক্তি থেকে কেউ বুঝে নিয়েছেন যে, তখন তাঁর আঠার বছর পূর্ণ হয়েছে। আর কেউ কেউ মনে করেছেন যে, তখন তিনি অষ্টাদশ বছরেই ছিলেন। এরপর কেউ কেউ ইমাম ইয়াফি’ঈর কথামত হযরত গাউসুল আ’যমের জন্মসাল ৪৭০ হিজরী লিখেছেন, আর কেউ কেউ শায়খ আবুল ফাদ্বলের কথামতো ৪৭১ হিজরী লিখেছেন। আবজাদের হিসাবানুযায়ী, আরবী (ইসক্ব) শব্দে তাঁর জন্মসাল প্রকাশ পায়, অর্থাৎ ৪৭০, অথবা (আশিক্ব) থেকে, অর্থাৎ ৪৭১ হিজরী।

উল্লেখ্য, এ পবিত্র জন্ম থেকেই তাঁর কারামত প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি ১ রমযান জন্মগ্রহণ করতেই সেদিন থেকে রোযা পালন করেন। সারাদিন তিনি মায়ের দুধ পান করেন নি। এমনকি অন্যান্য মুসলমানকেও রোযা পালনের সুযোগ করে দেন। কারণ, পূর্ববর্তী দিন ছিলো ২৯ শা’বান। আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন। তাই আকাশে ওই দিন সন্ধ্যায় রমযানের চাঁদ দেখা যায়নি। তাই এ দিনটি কি ৩০ শা’বান, না ১লা রমযান এতে সন্দেহ ছিলো। উল্লেখ্য, তাঁর আম্মাজানের বর্ণনানুসারে, পুরো শৈশবে তিনি এভাবে রোযা পালন করেছেন। শত চেষ্টা করেও তাঁকে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুধ পান করানো যেতো না। সুবহানাল্লাহ।

এটাতো হযরত গাউসূল আ’যমের জন্মকালের কারামত। মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় তাঁর কারামত আরো আশ্চর্যজনক। তা হচ্ছে- মাতৃগর্ভেই তিনি পবিত্র ক্বোরআনের আঠার পারা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তাঁর আম্মাজান আঠার পারার হাফেযা ছিলেন। তিনি প্রতিদিন এ আঠারা পারা অবশ্যই তিলাওয়াত করতেন। তার নিকট শুনে মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় তিনি এ আঠার পারা মুখস্থ করে ফিলেছিলেন। তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় এভাবে যে, ইসলামী নিয়মানুসারে শৈশবে তাঁকে মক্তবে সর্বপ্রথম সবক দেওয়ার সময় ওস্তাদ মহোদয় বললেন, পড়ো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। অমনি শিশু গাউসুল আ’যম জীলানী ‘বিসমিল্লাহ শরীফ’ পাঠ করার পর সূরা ফাতিহা পাঠ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি একটানা ১৮ পারা তিলাওয়াত শেষ করতে থাকলেন। আর সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনতে রইলেন। এটা কিভাবে সম্ভব হলো জানতে চাওয়া হলে এ মাদারজাত ওলী বলেছিলেন- মায়ের গর্ভে থাকাকালে মায়ের তিলাওয়াত শুনেই তিনি এ আঠার পারা মুখস্থ করে ফেলেছেন।

তাছাড়া, গর্ভে থাকাবস্থায় মায়ের আব্রূ রক্ষার ঘটনা (কারামত) ও সবিশেষ প্রসিদ্ধ। হযরত বড়পীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর বয়স যখন দশ বছর, তখন একদিন তিনি এক কথার জবাবে আপন আম্মাজানকে বললেন, “আপনার গর্ভে থাকাস্থায় আমিও আপনার উপকার করেছিলাম।” আম্মাজান অবাক হয়ে গেলেন আর বললেন,“তা কিভাবে?” তিনি বললেন, “একদিন আপনি ঘরে একা ছিলেন। তখন এক ভিক্ষুক এসে কিছু খাদ্য চেয়েছিলো। ঘরের বাইরে থেকে সে অসহনীয় ক্ষুধার কথা উল্লেখ করে বারংবার খাবার চাচ্ছিলো। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে এ বলে চলে যাবার মনস্থ করলো ‘হায়! আজ হয়তো ক্ষুধার জ্বালায় মরেই যাবো।”
এটা শুনে, হে আম্মাজান, আপনার মনে দয়া ঢেউ খেললো। আপনি পর্দার আড়ালে নিম্নস্বরে ভিক্ষুকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য বারান্দায় খাবার দিয়েছি। সেখানে গিয়ে খেয়ে নাও। পর্দার আড়ালে থেকে তিনি এ খাবার দিয়েছিলেন। ভিক্ষুকও খাবারটুকু আহার করলো। কিন্তু এরপর তার মনে শয়তানী খেয়াল চেপে বসলো। সে কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে আন্দর মহলের দিকে পা বাড়াতে লাগলো। অমনি একটি গায়েবী বাঘ এসে উক্ত ভিক্ষুককে মেরে ফেলেছিলো। আর আল্লাহ্ তা’আলা আপনার আব্রæ রক্ষা করেছিলেন। বলুন তো ওই বাঘ কে ছিলো? আম্মাজান বলেন; কিন্তু বাঘটির রহস্য কি ছিলো, তুমি বলো! তিনি বললেন, “আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে ওইদিন আমার রূহ আপনার গর্ভ থেকে বের হয়ে বাঘের সূরত ধরে ওই শয়তান ভিক্ষুককে হত্যা করেছিলো। এটা শুনে ওই রত্মগর্ভা আম্মাজান আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন। [সূত্র- ‘মু’জিয়া-ই আম্বিয়া ও কারামতে আউলিয়া]

বাক্যকাল ও ছাত্র জীবন:
তিনি নিজেই বাল্যজীবনের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- আমি আমার সমবয়সী ছেলেদের সাথে কখনো খেলাধূলার দিকে অগ্রসর হতে চাইতাম; কিন্তু আমি অদৃশ্য থেকে আওয়াজ শুনতাম “আবদুল ক্বাদির! খেলাধূলা থেকে বিরত থাকো।” আমি ভয় পেয়ে যেতাম আর দৌড়ে গিয়ে আমার মায়ের আঁচলের নীচে আশ্রয় নিতাম। কখনো ঘুমানোর ইচ্ছা করলেও একই ধরনের আহবান শুনতাম, “তোমাকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়নি, ওঠো!” বাল্যকালে আমি শিশুসূলভ আচরণে এক গাভীর লেজ ধরে টান দিতেই সেটা বললো, “আবদুল ক্বাদির, এতদুদ্দেশ্যে তুমি সৃষ্ট হওনি।” সাথে সাথে আমি সেটা ছেড়ে দিলাম এবং অজানা ভয় আমাকে পেয়ে বসলো। হযরত বড়পীর গাউসুল আ’যমকে যখন মক্তবে পাঠানো হতো, তখন একদল ফিরিশ্তা তাকে মক্তবে পৌছিয়ে দিতেন। মক্তবে ছাত্রদের ভিড়ের কারণে বসার জায়গা থাকতো না। হঠাৎ সকলে গায়বী আওয়াজ শুনতে পেতো- تفسحوا لولى الله (তোমরা আল্লাহর ওলীর জন্য জায়গা করে দাও)!
উক্ত মক্তবের আরেক দিনের ঘটনা। এক দরবেশ মক্তবে আসলেন। হুযূর গাউসে পাক আগমন করলে এক গায়বী আওয়াজ শুনতে পেলেন, “তোমরা আল্লাহ্র ওলীর জন্য জায়গা করে দাও।”
তখন ওই দরবেশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন –
سيكون له شأن عظيم – يعظم فلا يمنع ويتمكن فلا يحجب – ويقرب فلايمسك –
অর্থাৎ: এ বালক অবিলম্বে অতিমাত্রায় উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবেন। তিনি বিনা বাধায় সম্মানিত হবেন।
তিনি বিনা অন্তরালে মিলন লাভে সক্ষম হবেন। তিনি নৈকট্য লাভ করে ধন্য হবেন, তাঁকে রুখা যাবে না।
হুযূর গাউসে পাক বলেছেন, দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আমি এ দরবেশের সাক্ষাৎ পেয়েছি। তখন বুঝতে পেরেছিলাম- তিনি অন্যতম আবদাল ছিলেন।

কৈশোর ও উচ্চশিক্ষার জন্য বাগগদাদ যাত্রা
বাল্যকালেই হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পিতা ইন্তিকাল করেন। তিনি ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্য ৪০টি দিনার তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ হুযূর গাউসে পাকের আম্মাজানের নিকট রেখে যান। এ কারণে হুযূর শাহানশাহে বাগদাদকে পিতার সংসারের হালও ধরতে হলো। সুতরাং তিনি একদিন গাভী নিয়ে মাঠে যাচ্ছিলেন। গাভীটি পেছনের দিকে ফিরে মানুষের মতো বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বললো-
ياعبد القادر مالهذا خلقت الا بهذا امرت –
অর্থাৎ, এ কাজের জন্য না আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, না আপনাকে এ কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গাভীর মুখে এ সতর্কবাণী শুনে তিনি বুঝতে পারলেন এক মহান কাজের জন্য তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ওই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে দ্বীনী উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে। সুতরাং তিনি উচ্চ শিক্ষার্জনের জন্য বাগদাদ চলে যেতে মনস্থ করলেন এবং আপন মায়ের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলেন। বার্দ্ধক্যেও একমাত্র পার্থিব অবলম্বন আপন পুত্রকে অশ্রূসজল নয়নে বিদায় দিতে সম্মত হন তিনি। তখন বাগদাদ নগরী যেমন ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, তেমনি বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চারও কেন্দ্রস্থল ছিলো। সুতরাং হুযূর গাউসে পাক এক ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে বাগদাদেও উদ্দেশে রওনা হন। তখন তাঁর বয়স আঠার বছর আর মায়ের বয়স আটাত্তর বছর। দ্বীন ও মাযহাবের খাতিরে এ মহীয়সী, জ্ঞান ও গুণবতী মহিলা আপন সন্তানের পড়ার খরচ বাবদ স্বামীর প্রদত্ত ওই গচ্ছিত ৪০ টি দীনার সন্তানের জামার বগলের নীচে পকেট সেলাই করে ওই পকেটে দিয়ে বললেন- “তোমাকে আল্লাহ্র দরবারে সোপর্দ করলাম।” আর নসীহত করলেন, “কখনো যে কোন অবস্থায় মিথ্যা বলবে না। কারণ সত্যবাদিতা মানুষকে বিপদমুক্ত করে ও উন্নতির দিকে নিয়ে যায়।”

ডাকাতদলের কবলে এবং কারামত প্রকাশ
বাগদাদ যাত্রার ঘটনা হুযূর গাউসে পাক নিজেই বর্ণনা করেছেন, “মায়ের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমি কাফেলার সাথে বাগদাদ অভিমুখে রওনা হলাম। হামদান ছেড়ে অল্প কিছুদূর অগ্রসর হতেই অশ্বারোহী ৬০ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল আমাদের কাফেলার উপর চড়াও হলো। কাফেলার মালসামগ্রী ও টাকা-পয়সা সবই ছিনিয়ে নিলো। এরপর আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বললো- “হে বালক! তোমার নিকট কিছু আছে কি?” আমি মায়ের উপদেশ মোতাবেক বললাম, “হ্যাঁ, আমার নিকট ৪০টি স্বর্ণমূদ্রা আছে।” একথা শুনে তার বিশ্বাস হলো না। সে আমাকে ধরে তাদের সর্দারের নিকট নিয়ে গেলো। ডাকাত সর্দার আমাকে কর্কশ ভাষায় বললো, “তোমার নিকট কি আছে? আমি বললাম, “চল্লিশটি দিনার। আমার আম্মাজান দিনারগুলো আমার বগলের নীচে জামার সাথে সেলাই করে দিয়েছেন। আর বলেছেন, আমি যেন কোন অবস্থায় মিথ্যা না বলি। আমি মায়ের আদেশ পালন করেছি।”
গাউসে পাকের মুখ মুবারকে একথা শুনে ডাকাত সর্দারের মনের পট পরিবর্তিত হয়ে গেলো, সে কেঁদে ফেললো। আর বললো, “হায়, এ ছোট বালক তার মায়ের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেনি। আর আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ আল্লাহর সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করে আসছি। আল্লাহর কত বান্দার জান-মাল হনন ও হরণ করেছি।” সাথে সাথে সে তার দলবলসহ গাউসে পাকের পায়ে লুটিয়ে পড়লো এবং তাঁর হাতে খালেস নিয়্যতে তাওবা করে খাঁটি মু’মিনে পরিণত হলো। উল্লেখ্যে, এ ডাকাত সর্দারের নাম আহমদ বদভী এবং সে ও তার দলের এ ষাটজন ছিলো গাউসে পাউসে পাকের প্রথম মুরীদান।

মাদরাসা-এ নেয়ামিয়ায় ভর্তি ও অধ্যয়ন
হুযূর গাউসে পাক ৪০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ৪৮৮ হিজরীতে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সে বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসা-ই নেযামিয়া’য় ভর্তি হন। এখানে দীর্ঘ ৮ বছর কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তাফসীর,হাদীস, ফিক্বহ, তাসাউফ, আরবী সাহিত্য ইত্যাদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
পঁচিশ বছর বয়সে তিনি শরীয়তের ১৩ টি শাখায় ও তরীক্বতের বিভিন্ন মক্বামের যাবতীয় জ্ঞানার্জন সমাপ্ত করেন। বলাবাহুল্য,তখন মাদরাসা-ই নেযামিয়ার যুগশ্রেষ্ঠ বরেণ্য মুফাস্সির, মুহাদ্দিস ও শিক্ষকমন্ডলী শিক্ষা দান করতেন। তন্মধ্যে সাহিত্যিক হাম্মাদ ইবনে মুসলিম, মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে হাসান বাক্বেল্লানী ও ফক্বীহ কাযী আবূ সা’ঈদ মাখযূমী আলায়হির রাহমাহ তো শ্রেষ্ঠ ওলীও ছিলেন। হুযূল গাউসে পাকে তাঁর হাতে বায়’আত গ্রহণ করে ত্বরীক্বতের জ্ঞানর্জন এবং রিয়াযতও আরম্ভ করেন। এভাবে তিনি একদিকে অপ্রতিদ্ব›দ্বী আলিম-ই দ্বীন হয়েছিলেন, অন্যদিকে তরীক্বতের অনেক উচ্চ আসনেও আসীন হন তিনি বলেছেন-
درست العلم حتى صرت قطبا
ونلت السعد من مولى الموالى –
অর্থাৎ- আমি শিক্ষার্জন কিংবা শিক্ষাদান করতে করতে বেলায়তের উচ্চতর স্তর, ‘কুত্বব’-এর মর্যাদায় পৌছে গেছি। আর মহান মুনিব আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আমি এ সৌভাগ্য লাভ করেছি। [ক্বসীদা-ই গাউসিয়া শরীফ]

কঠোর রিয়াযতে মনোনিবেশ ও গাউসিয়াতে কুবরা অর্জন

তিনি আরো দীর্ঘ পঁচিশ বছর ত্বরীক্বতের কঠোর রিয়ায়তে রত হয়েছিলেন এবং ৫০ বছর বয়সে গিয়ে, ৫২১ হিজরীতে সংসারী হতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হন ও তা পালন করেন।
হুযূও-ই আকরাম এরশাদ করেন, “যুদ্ধের ময়দানে শক্রর সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে ছোটতর জিহাদ। নাফসের সাথে জিহাদ করা হচ্ছে বড় জিহাদ। অর ষড়রিপুর সমষ্টি হচ্ছে নাফ্স। ‘নাফসে আম্মারাহ্’ (মন্দ কাজের নির্দেশাদাতা) হচ্ছে অতি শক্তিশালী। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দরকার কঠোর সাধনা। আর যথানিয়মে এ কঠোর সাধনা হচ্ছে ত্বরীক্বতের কাজ। এজন্য দরকার কোন ওলী ও পীরের সান্নিধ্য। এ করণেই আল্লাহ তা’আলা ক্বোরআনে এরশাদ করেছেন- “ওয়াবতাগূ-ইলায়হিল ওসীলাহ্” (এবং তোমারা তার দিকে ওসীলা বা মাধ্যম তালাশ করো)। এ দুটি আয়াতে কামিল পীরের হাতে বায়’আত গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। [সূত্র- তাফসীরে-ই রুহুল বয়ান]
সুতরাং হুযূর গাউসে পাক সর্বপ্রথম হযরত আবূ সা’ঈদ মাখযূমীর হাতে বায়’আত গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর এ নির্দেশ পালন করলেন। তারপর থেকে শুরু করলেন কঠোর রিয়াযত বা সাধনা।

উল্লেখ্য, হুযূর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ছাত্রজীবনেই হযরত আবূ সা’ঈদ মাখযুমী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নিকট বায়’আত গ্রহণ করে ত্বরীক্বতের রিয়াযত আরম্ভ করেন। ৫১৩ হিজরীর ১ মুহাররম তিনি ওফাত পান। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি হুযূর গাউসে পাককে খিলাফতের খিরক্বাহ্ প্রদান করে যান। এ প্রসঙ্গে হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলঅ আনহু বলেন, “একদিন আমার খুব ক্ষুধা পেলো। তখন আমার পীর-মুর্শিদ হযরত মাখযূমী বললেন, তুমি আমার বাড়ি চলো। একথা বলে তিনি বাড়িতে চলে গেলেন। কিন্তু আমার লজ্জাবোধ হওয়ার কারণে আমি যেতে ইতস্ততা বোধ করলাম। তখন হযরত খাদ্বির আলায়হিস সালাম এসে আমাকে সেখানে যেতে তাকিদ দিলেন। আমার মুর্শিদের বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম তিনি আমার জন্য ঘরের দরজায় অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘আবদুল ক্বাদির! আমার দাওয়াত দেওয়া যথেষ্ট ছিলো না? আবার হযরত খাদ্বির আলায়হিস সালামকেও বলতো হলো? এ কথা বলেই তিনি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসলেন এবং নিজ হাতে আমাকে খাওয়াতে লাগলেন। আমি অনুভব করতে লাগলাম- এটা শুধু খাবারই ছিলো না, বরং তার হাতের প্রতিটি লোকমায় আমার অন্তরদৃষ্টি আলোকিত হয়ে যেতে লাগলো। এর পরে তিনি আমাকে ‘খিরক্বাহ’ বিশেষ পোষাক) পরিয়ে দিলেন। এ খিরক্বাহ্ পরার পর থেকে আমার উপর নানাবিধ রহমত, বরকত ও তাজাল্লী অধিক পরিমাণে প্রকাশ পেতে লাগলো।
তাছাড়া, হযরত আবূ সা’ঈদ মাখযূমীর বাগদাদ শরীফেল ‘বাবুশ্ শায়খ’ নামক স্থানে একটি উচ্চমানের মাদরাসাও ছিলো। ইনতিক্বালের পূর্বে তিনি মাদরাসার দায়িত্বভারও হুযূর গাউসে পাকের উপর অর্পণ করে যান। ৫১৩ থেকে ৫৬১ হিজরীতে ওফাতের পূর্বে পর্যন্ত তিনি এ মাদরাসা পরিচালনা করে যান। বলাবাহুল্য, ইসলামের যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে অগণিত আলিম বের হন এ মাদরাসা হতে। উক্ত মাদরাসা প্রাঙ্গণেই হুযূর গাউসে পাকের মাযার শরীফ অবস্থিত। এর পাশে রয়েছে হাজার হাজার কিতাবসমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এ সময়ে তিনি মাদরাসারও বহু সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করেছিলেন।

ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পঁচিশ বছর বয়সে তিনি জাহেরী ইলম অর্জন সমাপ্ত করে অপ্রতিদ্ব›দ্বী আলিম হন। তাঁর পরবর্তী ২৫ বছর যাবৎ বাতেনী জ্ঞানর্জন ও রিয়াযতে অতিবাহিত করেন। এ রিয়াযতকালে তিনি আধ্যাত্মিকতার বহু কষ্টকর সোপান পাড়ি দেন। এক সময় তিনি শহর ছেড়ে ইরাকের বিরান উপত্যকাগুলোতে একাকী কালযাপন করতে থাকেন এবং কঠোর রিয়াযতে মশগুল হন। এ রিয়াযতকালের সূচনাতেই হযরত খাদ্বির আলায়হিস সালাম তার সঙ্গ দেন। তিনি আত্মপ্রকাশ করে হুযূর গাউসে পাক থেকে ওয়াদা নিলেন যেন তিনি তার বিরোধিতা না করেন, বরং তার দিক-নির্দেশনানুসারে রিয়াযত করতে থাকেন। সুতরাং এরপর একদিন এসে একটি নিদির্ষ্ট জায়গায় হুযূর গাউসে পাককে বসিয়ে তিনি পুনরায় না আসা পর্যন্ত ওখানেই রিয়াযত করতে বলে চলে যান। দীর্ঘ এক বছর পর তিনি পুনরায় এসে দেখা দিলেন এবং পুনরায় একই নির্দেশ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। এভাবে পরপর তিন বছর যাবৎ ওই স্থানে তাঁকে রিয়াযত করান। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দুনিয়ার অগণিত প্রবৃত্তি বিভিন্ন মনোরম সূরতে এসে সেদিকে হুযূর গাউসে পাককে ফেরাতে চেষ্টা করে; কিন্তু আল্লাহ্র অনুগ্রহক্রমে এগুলো তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করতে পারেনি; বরং কঠোর বিরোধিতার মাধ্যমে তিনি সেগুলোর প্রত্যেকটা জয় করলেন।

এ তিন বছর পর তিনি নাফসকে আরো কঠিন কষ্টের ভাট্টিতে নিক্ষেপ করেন। এক বছর যাবৎ তিনি পানি পান করা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করলেন। শুধু জঙ্গলী শাক-পাতা খেয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। তারপর এক বছর যাবৎ শুধু পানি পান করে দিনাতিপাত করেন। খাদ্য মোটেই গ্রহণ করেন নি। তৃতীয় বছর পানাহার ও শয়ন পর্যন্ত পরিহার করেন। যে সময়সীমার মধ্যে হুযূর গাউসে পাক রিয়াযত ও নাফসের বিরুদ্ধে সাধনার কঠিন সোপানগুলো অতিক্রম করেছিলেন, তখন শয়তানের ফিৎনাপূর্ণ অব্যাহত হামলা চলতে থাকে। কিন্তু প্রতিটি মোড়ে শয়তান তাঁর নিকট পরাজিত হতে থাকে। এদিকে তিনি রূহানিয়াতের উঁচু থেকে উঁচুতর স্তরে পৌছতে থাকেন। তার এ মর্যাদার শীর্ষে পৌছানো শয়তানের বরদাশ্ত হচ্ছিলো না। একদিন শয়তান হুযূর গাউসে পাককে বললো, “আপনিতো আমাকে ও আমার দলবলকে পরাস্ত করে ফেলেছেন, আমাদের কোন ক্ষমতাই আপনার নিকট চলছে না। সুতরাং আমরা আপনার নিকট অনুগত হয়ে থাকতে চাই।” হুযূর গাউসে পাক বললেন, “লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা-বিল্লাহ! আমি তোর কোন কথাই বিশ্বাস করি না। যা এখান থেকে! ইত্যবসরে গায়ব থেকে একটি হাত বের হয়ে শয়তানের শাথার সজোরে আঘাত করলো। এর চোটে সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।

আরেকবার শয়তান আগুনের লেলিহার শিখা নিয়ে হুযূর গাউসে পাককে হামলা করলো। হুযূর গাউসে পাক ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়লেন। সে পালিয়ে গেলো কিন্তু আবার এসে হামলা করার জন্য উদ্যত হলো। তখন একজন অশ্বারোহী আত্মপ্রকাশ করলেন এবং তাঁর হাতে একটি তলোয়ার দিয়ে গেলেন। এটা দেখে শয়তান পালিয়ে বাঁচলো। কিন্তু সে তৃতীয়বার আরেক ফাঁদ রচনা করে হুযূর গাউসে পাকের সামনে আসলো। সে এবার এসে একেবারে হতাশাগ্রস্তের আকারে বসে কাঁদতে লাগলো। হুযূর গাউসে পাক তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। শয়তান বললো, “আপনি আমার দিকে এভাবে দেখছেন কেন? আমি তো আপনার দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে হতাশ হয়ে গেছি।” হুযূর গাউসে পাক বললেন, “আমি তোকে মোটেই বিশ্বাস করি না।” শয়তানের বিরুদ্ধে এমন দৃঢ়তা দেখে শয়তান এবার জাহেরীভাবে হামলা বাদ দিয়ে তার বিরুদ্ধে গোপনে ‘শির্কে খাফী’ (গোপন শির্ক) -এর অগণিত জাল বুনতে লাগলো। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাঁকে প্রত্যেকবার রক্ষা করেছেন। এবার সে তাকে মাখলূক্বের ভালবাসা ও পার্থিব আত্মীয়তার প্রতি মনোনিবেশ করাতে চাইলো। সেদিকেও তিনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না। এতেও শয়তান অকৃতকার্য হলো। আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহক্রমে এ ধরণের সব ক’টি হামলার সফল মোকাবেলা করে তিনি সফল হন। এবার শয়তান তাকে জ্ঞানগত বিষয়ে প্ররোচনা দিতে লাগলো। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা অতি প্রসিদ্ধ।

একদা হুযূর গাউসে পাক এমন এক মরুভুমি বা জঙ্গলে চলে গেলেন, যেখানে খাদ্য ও পানীয়ের নাম-নিশানা পর্যন্ত ছিলো না। কয়েক দিন যাবৎ তিনি একটানা ইবাদত-রিয়াযত করার পর তার ক্ষুধা ও পিপাসা হলো। কিন্তু দেখতে দেখতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলো এবং মুঘলধারে বৃষ্টি হলো। তিনি তৃপ্তি সহকারে বৃষ্টির পানি পান করলেন। ফলে মেঘের ফাকে এক উজ্জ্বল আলো দেখতে পেলেন এবং তা আসমানের প্রান্তগুলোতে প্রসারিত হলো। আর তা থেকে আওয়াজ আসতে লাগলো, “আবদুল ক্বাদির! আমি তোমার খোদা! আজ থেকে আমি তোমার জন্য হারাম জিনিষগুলো হালাল করে দিলাম। নামাযও ক্ষমা করে দিলাম।” তিনি এটা শুনতেই পড়তেন, “আঊযুবিল্লাহি মিন্শ্ শায়ত্বানির রাজীম। (অর্থাৎ আমি ধিক্কৃত শয়তান থেকে আল্লাহ্রই আশ্রয় গ্রহণ করলাম। ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কু¡ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম।” তৎক্ষণাৎ ওই আলো নিভে গেলো ও সেখানে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লো। আর আওয়াজ আসলো, “আবদুল ক্বাদির! তোমাকে তোমার ইলম রক্ষা করেছে। অন্যথায় আমি তোমার মতো অনেক দরবেশ ও ইবাদতপরায়নকে এভাবে পথভ্রষ্ট করেছি।” তিনি জবাব দিলেন, হতভাগা শয়তান! আমাকে আমার রব রক্ষা করেছে; আমার ইলম নয়।” এটা শুনে শয়তান একেবারে হতাশ হয়ে গেলো।

মোটকথা, এমন কঠিন থেকে কঠিনতর এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক মনযিলগুলো অতিক্রম করার পর আল্লাহ তা’আলা তার সামনে তার বাতিনকে প্রকাশ করে দিলেন। এবারও তিনি মানবীয় ইচ্ছার বহু পঙ্কিলতা দেখতে পান। সেগুলো থেকেও তিনি পবিত্রতা অর্জন করলেন।

মাতৃগর্ভ থেকে ওলী হয়ে দুনিয়া এসেও তিনি অসাধারণ রিয়াযত ও ইবাদত করেছেন। তিনি চল্লিশ বছর যাবৎ নিয়মিতভবে এশার ওযূ দিয়ে ফজরের নামায পড়েছেন। অর্থাৎ সারারাত জেগে ইবাদত করেছেন। দীর্ঘ পনের বছর যাবৎ এশার নামাযের পর এক খতম ক্বোরআন পড়তেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবৎ ইরাক্বের পাহাড়ে ও জঙ্গলে কঠিন রিয়াযত করেছেন। এভাবে তিনি ‘গাউসুল আ’যম’ ও ‘কুত্ববুল আকতাব’-এর উচ্চ আসনে আসীন হলেন। তারপর বাগদাদ শরীফে অবস্থান করার মনস্থ করলেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা অন্যায়- অবিচার রাশি- রাশি পাপাচারের অবস্থা দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে একদা বাগদাদ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, যাতে নিজের দ্বীন ও ঈমানকে অনায়াসে হিফাযত করতে পারেন। কিন্তু তিনি গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান –
كنتم خير امة اخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر –
(তরজমা: তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত, যারা মানুষের কল্যাণার্থে বের হয়; তোমরা ভাল কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।)
এই আহবানে বলা হয়েছে- ‘মাখলূকের উপর তোমার উপর বড় হক রয়েছে। তাদেরকে হিদায়ত করা তোমার দায়িত্ব। তুমি ওখানেই থাকো। আল্লাহ সর্বশক্তিমান তোমার দ্বীন ও ঈমানকে হিফাযত করবেন। এ গায়েবী আহবান শুনে হুযূর গাউসে পাক বাগদাদেই স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর আরম্ভ করলেন দ্বীন-মাযহাবের খিদমত, সমাজ-সংস্কার। ‘গাউসুল আ’যম’ হিসেবে রূহানী জগতের দায়িত্বাবলীও তিনি এখান থেকে পরিচালনা করতেন। ‘বাহজাতুল আসরার’ গ্রন্থখানা পাঠ করলে এ সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া যাবে।

৫০ বছর বয়সে তিনি হুযূর-ই আকরামের ইঙ্গিতে শাদী করে সংসার-জীবনের সূচনা করেন। তাঁর চার বিবির ঘরে সর্বমোট ৪৯ জন ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরাও জগৎ বিখ্যাত বুযুর্গ ছিলেন এবং দ্বীন ও মাযহাবের বহু খিদমত আঞ্জাম দেন।
ইতোপূর্বে হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী ‘মুহিউদ্দীন’ (ইসলামকে পুনরায় জীবিতকারী) উপাধি লাভ করেন। ঘটনািিটও প্রসিদ্ধ। তিনি ৫১১ হিজরীর এক জুমাবারে বাগদাদ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। রাস্তার পাশে জরাজীর্ণ ও শীর্ণকায় এক বৃদ্ধকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। লোকটি হুযূর গাউসে পাককে সালাম দিয়ে বললো, “আমি শক্তিহীন আমাকে ধরে তুলুন।” তিনি তাকে তুলতে ধরার পর সে সবল সুস্থ হয়ে গেলো। আর আরয করলো, “আমি আপনার নানার ধর্ম ইসলাম। মানুষের আকারে আপনার সামনে পেশ হয়েছি। আমার মতো ইসলাম ধর্ম দুর্বল হয়ে পড়েছে। আপনার হাতের স্পর্শে সেটা পৃথিবীতে পুনরায় নবজীবন লাভ করলো।” এদিকে আল্লাহ তা’আলা তার ‘মহিউদ্দীন’(ইসলামকে পুনর্জীবিতকারী) উপাধিটা প্রসিদ্ধ করে দিলেন। তিনি জুমা পড়ানোর জন্য জামে মসজিদে প্রবেশ করতেই সবাই তাঁকে ‘মুহিউদ্দিন’ বলে সম্বোধন করতে লাগলো।
তাঁর গাউসিয়াতের মহামর্যাদা এও ছিলো যে, তাঁর কদম শরীফ সমস্ত ওলীর গর্দানের উপর। ৫৫৯ হিজরীতে, অর্থাৎ তাঁর ইনতিক্বালের তিন বছর পূর্বে এক রাতে তিনি বাগদাদে ওয়ায করছিলেন। ওই মজলিসেই ওয়াযের এক পর্যায়ে বললেন-
قدمى هذه على رقبة كل ولى الله –
 (আমার এ কদম প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপর)। এটা শুনার সাথে সাথে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকল ওলী নিজ নিজ গর্দান ঝুঁকিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত খাজা মু’ঈন উদ্দীন চিশতী আলায়হির রাহমাহ তখন খোরাসানের এ পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তিনি সেখান থেকে বাগদাদের ওই ঘোষণা শুনতে পান এবং সাথে সাথে গর্দান ঝুঁকিয়ে দিলেন বললেন-
بل قدمك على راسى وعينى –
(অর্থাৎ আপনার চরণযুগল বরং আমার মাথায় ও চোখে স্থাপন করে নিলাম)।

হুযূর গাউসে পাকের ওয়ায মাহফিলে ৬০-৭০ হাজার শ্রোতা হতো। এখানেও তার কারামত ছিলো আশ্চর্যজনক। প্রথমত: তাঁর আওয়াজের স্বাভাবিক শব্দ এত বড় বড় জমায়েতের সামনের লোকেরা যেভাবে শুনতে পেতেন, তেমনি ভাবে মজলিসের শেষপ্রান্তের লোকেরাও সমানভাবে শুনতে পেতেন। দ্বিতীয়ত: তাঁর ওয়াযের প্রভাব এতো প্রখর ছিল যে, সাথে সাথে তা শ্রোতাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করতো এবং তারা আল্লাহ ও রসূলমূখী হয়ে মুত্তাক্বী-পরহেযগারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতেন। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে প্রধানতম কারণ ছিলো এ যে, খোদ হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে তাঁর মুখে সাতবার এবং এর পরবর্তীতে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম ছয়বার থুথু শরীফ দিয় ওয়াজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাঁর ওয়াযে অপূর্ব ও অবর্ণনীয় তা’সীর বা প্রভাব দেখা দিলো। তাছাড়া, তার অন্যান্য খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতার উপর ‘মদীনাতুল ইলম’ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও ‘বাবু মদীনাতিল ইলম’ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র এ অমূল্য বদানত্য সোনায় সোহাগা হয়েছিলো। তিনি ইসলামী বিশ্বে ত্বরীক্বাহ-ই ক্বাদেরিয়ার প্রবর্তন করেন। চিশতিয়া, নক্শবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া তরীক্বাও তার হাতে প্রবর্তিত হয়।

আ’লা হযরত বলেন- অর্থাৎ চিশ্ত, বোখারা, ইরাক ও আজমীর।এমন কোন ক্ষেত্র (সিলসিলাহ্) রয়েছে, যাতে গাউসুল আ’যম জীলানী কুদ্দিসা সিররুকা, আপনার বৃষ্টি বর্ষিত হয়নি। অর্থাৎ সব ক’টি তরীক্বা আপনারই বদান্যতায় প্রবর্তিত হয়েছে। [হাদাইক্বে বখশিশ]

তিনি তদানীন্তনকালে যে সব বদ-মাযহাব ও ভ্রান্ত ফির্ক্বা মাথাচাড়া দিয়েছিলো সব ক’টির বিদঘুটে চেহারার মুখোশ উন্মোচন করেন এবং স্থায়ীভাবে খন্ডন করেন। যেমন খারেজী, রাফেজী ও মু’তাযিলা ইত্যাদি ভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলো মাথাচাড়া দিয়ে সরলপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয় থেকে আল্লাহ ও রসূলের ভালবাসা দূরীভুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো। হুযূর গাউসে আ’যম অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাদেরকে চিহিৃত ও দমিত করে তদস্থলে আহলে সুন্নাতের আক্বীদাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাছাড়া, বাগদাদের রাজপ্রাসাদ থেকে আরম্ভ করে সমাজের সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত তার সংস্কারের বরকতমন্ডিত ছোঁয়া পেয়ে ধন্য হয়েছিলো। রাজনৈতিকভাবেও মুসলমানগণ সারা বিশ্বে পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলো। অগণিত মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা রূহানীভাবে তার বেলায়তী ক্ষমতার সাহায্য পেয়ে ধন্য হয়েছে এবং হচ্ছে।
হুযূর গাউসে পাকের লিখনীগুলোও তার জ্ঞান-গভীরতা এবং অসাধারণ বেলায়তের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। নির্ভরযোগ্য বর্ণনাদি অনুসারে হুযূর গাউসে পাক ৬৯ টি কিতাব রচনা করেছেন। তন্মধ্যে নিম্নলিখিত কিতাবগুলো সবিশেষ প্রসিদ্ধ – ১. জালাউল খাতির ফিল বাত্বিনি ওয়ায যাহির, ২.আল- ফাতহুর রাব্বানী ওয়াল ফায়দ্বুর রাহমানী (ফুতূহুল গায়ব), ৩. আল-গুনিয়াহ্ লিত্বা-লিবী ত্বারীক্বিল হক্ব (সংক্ষেপে গুনিয়াতুত তালিবীন), ৪. সিররুল আসরার ওয়া মাযহারুল আনওয়ার ফী-মা ইয়াহতাজু ইলায়হিল আবরার, ৫. আদাবুস্ সুলূক ওয়াত্ তাওয়াস্সুলু ইলা মানাযিলিল মুলূক, ৬. ইগাসাতুল আরিফীন ওয়া গায়াতুল ওয়াসিলীন, ৭. দু’আউ ওয়া আওরাদুল ফাতহিয়্যাহ; দো’আ-উল বাসমালাহ, ৮. আল- হিযবুল কবীর, ৯. আওরাদুল আইয়্যামি ওয়াল আওক্বাত, ১০. রিসালাতুন ফিল আসমা-ইল আযীমাহ, ১১. আত্বত্বরীক্ব ইলাল্লাহ্, এব ১২. কিতাবুন ফিল ফিক্বহি ওয়াত তাসাওফ।

হুযূর গাউসে পাক কাব্য রচনায়ও দক্ষহস্ত ছিলেন। তাঁর ‘ক্বসীদাহ-ই লামিয়াহ’ (ক্বসীদাহ-ই গাউসিয়া) বিশ্বে খুব প্রসিদ্ধ এবং অতি ভক্তি সহকারে পঠিত হয়। তা ছাড়া, তার ‘ক্বসীদাহ-ই বাইয়্যাহ’ও উল্লেখযোগ্য।

মোটকথা, হুযূর গাউসে পাকের পূর্ণ জীবদ্দশাই অলৌকিকতায় পূর্ণ। তাঁর প্রতিটি বিষয়ে ও কাজে কারামতই প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে তাঁর জীবনে যত বেশী কারামত প্রকাশ পেয়েছে পৃথিবীর অন্য কোন ওলীর এত কারামত প্রকাশ পায়নি। ইমাম ইয়াফে’ঈ বলেছেন, তাঁর কারামতের আধিক্য ‘তাওাতুর’ এর সীমা পর্যন্ত পৌছে গেছে। অর্থাৎ তার জীবদ্দশা থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি যুগে এতবেশী কারামত প্রকাশ পেয়েছে যে, সেগুলো গণনা করাও সম্ভবপর নয়। আর এতগুলো বর্ণনাকরী একসাথে কোন মিথ্যা ও বানোয়াটের আশ্রয় নেয়া সম্ভব নয়। শায়খ আলী ইবনে হায়তী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি বলেছেন, “আমি হুযূর গাউসে পাকের সমসাময়িক কোন ওলীর মধ্যে এত বেশী কারামত দেখিনি। দারা শিকূ এবং মুহাদ্দিসে দেহলভীও একথা তাদের রচনাদিতে উল্লেখ করেছেন।  (চলবে)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment