একবার নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার বাগানে তাশরীফ নিয়ে গেলেন, সেখানে একটি কাফেলা তাঁর সামনে এসে পড়লাে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন: তােমরা এখানে কেন এসেছাে? তারা বললাে: আমরা এখানে খেজুর নিতে এসেছি, তাদের নিকট লাল উট ছিলাে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন: তােমরা এই উটটি আমার কাছে বিক্রি করবে? তারা বললাে: জি হ্যা! এতাে সা’খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করে দিবাে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন: আমি এখানে উট কিনার নিয়্যতে তাে আসিনি, তাই মূল্য সাথে আনিনি। আমি শহরে গিয়ে এর মূল্য পাঠিয়ে দিবাে। (একথা বলে) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের লাগাম ধরলেন এবং চলতে লাগলেন, কাফেলার সদস্যরা যতক্ষণ পর্যন্ত হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি কে দেখা যাচ্ছিলাে, ততক্ষণ দেখতেই রইলাে, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি তাদের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, তখন তাদের যেন হঠাৎ হুশ ফিরে এল। তারা হুযুরকে দেখতে দেখতে তাঁর সৌন্দর্যের মধ্যে যেন হারিয়ে গিয়েছিল।
তারা পরস্পর বলতে লাগলাে যে, এটি আমরা কি করলাম, আল্লাহর শপথ! আমরা উটটি এমন একজনকে দিয়ে দিলাম যাকে আমরা চিনিও না এবং না তাঁর থেকে আমরা মূল্য আদায় করেছি। আমরা কথায় লিপ্ত ছিলাম আর সে লােক আমাদের উট নিয়ে গেলাে। এমন সময় যে মহিলা তাদের সাথে ছিলাে, সে বললাে: আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর চেহারা দেখেছি, তাঁর চেহারা চৌদ্দ তারিখের রাতের চাঁদের টুকরাে ছিলাে। আমি তােমাদের উটের জামিনদার, যদি তিনি (হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাশরীফ নিয়ে না আসেন তবে আমার থেকে মূল্য নিয়ে নিও। [১]
আল্লাহু আকবার! এ আবার কেমন সৌন্দর্য। পৃথিবীতে কি এমনো মানুষ আছে যাকে দেখে মানুষ তার সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে যায়। তার দামি একটা পণ্য নিয়ে যায় অথচ তার দাম চাওয়ার হুশটা পর্যন্ত থাকে না। হ্যা আছেন। আমার হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আছেন। এবং তাঁর মতো সৌন্দর্য আর কারো নেই।
.
অনুরূপভাবে এক মহিলা, যার নাম ছিলাে উম্মে মা’বাদ। তিনি আকায়ে দু’আলম, নবীয়ে মুহতাশাম, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সৌন্দর্য্য ও লাবণ্যকে খুবই সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। ওলামায়ে কেরাম হুযুরের সৌন্দর্য বর্ণনায় যার বর্ণনাটিকে খুবই প্রাধান্য দেন।
তিনি বলেন: আমি এমন একটি সত্বা দেখেছি, যাঁর সৌন্দৰ্য্য ছিলাে প্রকাশ্য, যাঁর চেহারা সুন্দর এবং মােবারক গঠন খুবই উন্নত ছিলাে, খুবই সুন্দর, খুবই চমৎকার ছিলাে, চোখ কালাে এবং বড়, পলক লম্বা, তাঁর আওয়াজ প্রতিধ্বনিত, ঘাঁড় উজ্জল, আর দাঁড়ি মােবারক ঘন ছিলাে। উভয় ভ্রু চিকন এবং মিলিত ছিলাে। তাঁর মােবারক দৈর্ঘ্যও ছিলাে মধ্যম, এমন বেশি লম্বা ছিলেন না যে দেখে খারাপ লাগবে, আর না এতাে খাটো ছিলেন যে, দেখে নগন্য মনে হবে।
দূর থেকে দেখলে খুবই প্রভাবময় এবং সুন্দর ও লাবণ্যময় দেখা যেতাে আর যখন কাছ থেকে দেখা হতাে তখন এর চেয়েও অনেক বেশি সুদর্শন ও সুন্দর দেখা যেতাে। [২]
এ কেমন অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। যার শরীর মোবারক এর প্রত্যেকটা অঙ্গের সৌন্দর্যকে আলাদা আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কি বলব তাঁর শান। একটা ছন্দই মনে বারবার আসে,
‘মোস্তাফা আপ কে যেছা কোই আয়া হি নেহি, কেসে ভি আতা যাভ আল্লাহ নে বানায়া হি নেহি’
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তায়ালা আপন মাহবুব কে কিরুপ অশেষ এবং উন্নত সৌন্দর্য এবং লাবণ্য দান করেছেন যে, যারা দেখত শুধু তাকিয়েই থাকতাে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আকৃতির পাশাপাশি তাঁর মোবারক চরিত্রও ছিল খুবই উত্তম। তাঁর চরিত্রের মতো কারো চরিত্র ছিল না। আর এমন চরিত্র কিয়ামত পর্যন্ত কারো হবেও না।
অনেক লােক এমন হয় যে, যদি তাদের সাথে কুশল বিনিময় পর্যন্ত সম্পর্ক হয়, তবে তাদের খুবই নেককার এবং উত্তম চরিত্রের মনে হয়। কিন্তু যখন তাদের সাথে লেনদেন করা হয় বা আত্মীয়তার সম্পর্ক করা হয়, তবে তাদের প্রকৃত অবস্থা জানা যায় যে, কতটুকু নেক এবং কিরূপ চরিত্রবান। কিন্তু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিষয় এমন ছিলাে না।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাে পরিপূর্ণ উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। শিশু হােক বা বড়, পুরুষ হােক বা মহিলা, বৃদ্ধ হােক বা যুবক, মালিক হােক বা গােলাম সবার সাথেই আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণ এতােই উন্নত হতাে যে, লােকেরা প্রভাবিত হয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করতাে। তাঁর সৎচরিত্রের প্রতি প্রভাবিত হয়ে অপরিচিতরাও আপনজন মনে করতাে।
যারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থেকে দূরে থাকতাে তারাও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সাদিক ও আমীন (সত্যবাদী ও আমানতদার) বলতাে, যারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে লেনদেন করতাে এবং অমুসলিম হতাে, তারাও হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়ে যেতাে এবং যদি লেনদেনকারী মুসলমান হতাে তবে, তাদের ঈমান সতেজ হয়ে যেতাে এবং তারা তাঁর নামে নিজের প্রাণও উৎসর্গ করে দিতে কুণ্ঠিত হতেন না।
তাঁর উম্মত হয়ে যদি আমরা চিন্তা করি, তবে আমাদের পরিবার, প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজনরা অসন্তুষ্ট দেখা যাবে, আমাদের সাথে লেনদেন, কাজকর্ম এবং অন্যান্য বিষয়ের ব্যাপারে ভয় করে। এরূপ কেন? তবে আমরা অসৎ চরিত্র, অহঙ্কার, কথায় কথায় ঝগড়া করার মতাে মন্দ অভ্যাসে গ্রেফতার নইতাে? সুতরাং যখনই কারাে সাথে কোন বিষয়ে সম্পৃক্ততা হয়, তবে আমাদের চেষ্টা এটাই হওয়া উচিৎ যে, তাদের সাথে সদাচরণ করা। কেননা সদাচরণ খুবই সুন্দর এবং উন্নত গুণাবলী, যার কারণে পরও আপন হয়ে যায়, সদাচরন দ্বারা অমুসলিমও মুসলমান হয়ে যেতাে।
সচ্চরিত্রবানকে সমাজে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকেও সৎ চরিত্রের দৌলত দ্বারা সম্পদশালী করুক।
রেফারেন্সঃ
[১] দালাইলুন্নাবুয়ত লিল বায়হাকীম, ৫/৩৮১।
[২] সবলূল হুদা ওযার রিশাদ, ৩/২৪৪।