হাযরাত আলী রাঃ মদীনা তাইয়্যিবাহ ছেড়ে পুরোপুরিভাবে কুফায় চলে এলেন। ইসলামী সালতানাতের রাজধানী বানালেন কুফাকে। তার সাথে আব্দুল্লাহ বিন সাবার অনুসারী এবং উসমান রাঃ এর হত্যাকারী বিদ্রোহী দলও কুফায় চলে আসে।
হাযরাত আলী রাঃ কুফাকে রাজধানী বানানোর প্রধান কারণ ছিল, কুফার লোকেরা নিজেদের শিয়া বা আলীর দল বলে নিজেদের পরিচয় দিতো। আহলে বাইতের মোহাব্বতের কথা মুখ ভরে বলতো। কিন্তু এসব শিয়া নামধারীরা ছিল এক নাম্বার মিথ্যুক, চালবাজ এবং ধুরন্ধর ও স্বার্থপর লোক।
কুফার লোকেরা সব শিয়া ছিল একথা নির্দ্ধিধায় শিয়াদের গ্রহণযোগ্য বই ‘মাজালিসুল মু’মিমীন’ এর মাঝে নিম্নোক্ত শব্দে এসেছেঃ
ومجمل القول: لا حاجة بإقامة دليل على تشيع الكوفة، والسنى الكوفى خلاف الأصل ويحتاج لإقامة الدليل، وإن كان أبو حنيفة كوفيا (مجاليس المؤمنين، المجلس الأول فى ذكر بعض الأماكن المختصة بالأئمة وشيعتهم-125
و بالجمله تشيع اهل كوفه حاجت باقامه دليل ندارد و سنى بودن كوفى الاصل خلاف اصل محتاج بدليل است و اگرچه ابو حنيفه كوفى باشد
মোটকথা হল, পুরো কুফার শিয়া হওয়া এতোটাই পরিস্কার যে, এর উপর দলীল পেশ করারই কোন দরকার নেই। বরং কুফীদের সুন্নী হবার দলীল পেশ করা প্রয়োজন। যদিও ইমাম আবূ হানীফা কুফী ছিলেন।
রেফারেন্স
মাজালিসুল মু’মিনীন, আরবী সংস্করণ-১২৫, ফার্সি সংস্করণ-৫৬।
এরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়, শিয়াদের লিখিত বাংলা অনূদিত বই ‘বেলায়েতের দ্যুতি’ এর ৪৪৬ পৃষ্ঠায়। সেখানে লেখা হয়েছেঃ
‘যদিও ইমাম (আঃ) মদীনার বিরাট সংখ্যক লোকজন নিয়ে রওয়ানা হন এবং মাঝপথেও কিছু লোক তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়, কিন্তু ইমামের অধিকাংশ সৈন্য এবং তাঁর জন্য প্রাণোৎসর্গকারীরা ছিলো কূফা ও তার পার্শবর্তী এলাকার লোক।
রেফারেন্স
বেলায়েতের দ্যুতি-৪৪৬।
কুফার এ সমস্ত শিয়ারা বাহ্যিকভাবে যদিও হাযরাত আলী রাঃ এর ভক্ত হবার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো, কিন্তু আসলে ছিল এক নাম্বার ধোঁকাবাজ ও প্রতারক। সেই সাথে চরম স্বার্থপর। হাযরাত আলী রাঃ তাদের প্রতারণা ও ধোঁকাবাজীতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। শিয়াদের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মোল্লা বাকের মাজলিসী লিখেনঃ
وقد ورد فى جملة من الأخبار المعتبرة أنه عليه السلام لما ضاق صدره من عدم نصرة قومه، وكفرهم ونفاقهم، وأتى عسكر معاوية إلى الأنبار وأطراف مملكته، فأغاروا عليها ولم يخرج إليهم أحد من أصحابه، قال عليه السلام فى خطبة طويلة: أما والله لوددت أن ربى قد أخرجنى من بين أظهركم إلى رضوانه، ……… وقد خاب من افترى، ونجا من اتقى وصدق بالحسنى (جلاء العيون، الفصل الثانى فى بيان إخبار الله ورسوله-203
গ্রহণযোগ্য বর্ণনায় এসেছে যে, যখন হাযরত আলী রাঃ তাঁর সাথীদের নাফরমানী, মুনাফিকী, কুফরী এবং বিরোধিতায় অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন, অপরদিকে হাযরাত মুয়াবিয়া রাঃ এর বাহিনী তাঁর রাষ্ট্রের দিকে ধেয়ে আসছে, কিন্তু তাঁর সাথী কেউ তাঁকে সহযোগিতা করছিল না, তখন মাওলানা আলী রাঃ তাঁর এক লম্বা খুতবায় ইরশাদ করেন, আল্লাহর কসম উঠিয়ে দুআ করি যে, আল্লাহ আমাকে তোমাদের থেকে উঠিয়ে নেন এবং জান্নাতের বাগানে স্থান দেন। ……….তারপর বলেন, হে আল্লাহ! তুমি জানো যে, আমি তাদের উপর বিরক্ত, আর তারাও আমার উপর বিরক্ত, হে আল্লাহ তুমি আমাকে মৃত্যু দিয়ে তাদের থেকে মুক্তি দাও, আর তাদের উপর এমন ব্যক্তিকে চাপিয়ে দাও, যাতে আমাকে স্মরণ করে।
রেফারেন্স
জালাউল উয়ূন, মোল্লা বাকের মাজলিসীকৃত, আরবী সংস্করণ-২০৩, উর্দু সংস্করণ-১/২৮৪।
শিয়াদের সবচে’ বিশুদ্ধ গ্রন্থ ‘নাহজুল বালাগাহ’ এর বক্তব্যটি আরো স্পষ্টঃ
যখন আমিরুল মোমেনিন উত্তরোত্তর সংবাদ পেতে লাগলেন যে, মুয়াবিয়া রাঃ এর জনগণ একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে এবং ইয়ামেন থেকে তার অফিসার উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও সাঈদ ইবনে নিমরান মুয়াবিয়া রাঃ এর লোক বুসর ইবনে আরতাঁতের নিকট পরাজিত হয়ে পিছু হটে এসেছে, তখন আমিরুল মোমেনিন মাওলানা আলী রাঃ তাঁর লোকদের জিহাদে বিমুখতা ও তাঁর সাথে মতদ্বৈধতার কারণে বিচলিত হলেন । তিনি মিম্বারে উঠে। এ খোৎবা প্রদান করেন। কুফা ব্যতীত আমার জন্য আর কিছুই রইল না। যা আমি সংকীর্ণ ও প্রশস্ত করতে পারি। (হে কুফা) তোর দশা যদি এ রকমই হয় যে, তোর ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বইতেই থাকবে তবে আল্লাহ তোকে ধ্বংস করুক। তারপর তিনি একটা কবিতার দুটি পংক্তি আবৃত্তি করলেনঃ হে আমার ! তোমার পরম পিতার দোহাই, এ পাত্র থেকে আমি সামান্য একটুখানি চর্বি পেয়েছি, যা পাত্র খালি করার পর পাত্রের গায়ে লেগেছিল।
আমি জানতে পারলাম যে, বুসর ইয়ামেন দখল করে নিয়েছে। আল্লাহর কসম, এসব লোক সম্পর্কে আমি চিন্তা করে দেখেছি। এরা সহসাই সারা দেশ কেড়ে নিয়ে যাবে। কারণ তারা বাতিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেও একতাবদ্ধ। অথচ তোমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকেও ঐক্যবদ্ধ নও, তোমরা দ্বিধাবিভক্ত। ন্যায়ের পথে থাকা সত্ত্বেও তোমরা তোমাদের ইমামকে অমান্য কর। আর বাতিল পথে থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের নেতাকে মান্য করে। তারা তাদের নেতার প্রতি সম্পূর্ণরূপে আস্থাবান; আর তোমরা তোমাদের ইমামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কর। তাদের শহরে তারা কল্যাণকর কাজ করে; আর তোমরা তোমাদের শহরে অকল্যাণকর কাজ কর। যদি আমি তোমাদের একটা কাঠের গামলার দায়িত্বও দেই, আমার মনে হয়, তোমরা তার হাতল নিয়ে পালিয়ে যাবে। হে আমার আল্লাহ, তারা আমার প্রতি নিদারুণভাবে বিরক্ত; আমিও তাদের প্রতি বিরক্ত। তারা আমাকে নিয়ে ক্লান্ত; আমিও তাদের নিয়ে ক্লান্ত। তাদের চেয়ে ভালো কোন জনগোষ্ঠী আমাকে দিন এবং আমার চেয়ে মন্দ কোন নেতা তাদেরকে দিন।
রেফারেন্স
বাংলা নাহজ আল বালাগা-৪৭-৪৮।
শিয়া মতবাদের সবচে’ গ্রহণযোগ্য হাদীসের কিতাব ‘আলকাফী’ তে আসছেঃ-
موسى بن بكر الواسطي ، قال : قال لي أبو الحسن (ع) : لو ميزت شيعتي لم أجدهم الا واصفة ، ولو امتحنتهم لما وجدتهم الا مرتدين ،
মুসা বিন বকর ওয়াসিতী বলেন, আমাকে হযরত আলী রাঃ বলেছেন, যদি আমি আমার শিয়াদের যাচাই করে দেখি, তাহলে তাদেরকে শুধুমাত্র বাগাড়ম্বরই পাবো। আর যদি আমি তাদের পরীক্ষা করে দেখি, তাহলে দেখা যাবে এরা সবাই মুরতাদ।
রেফারেন্স
আলকাফী, মুহাম্মদ বিন ইয়াকূব কিলানীকৃত-৮/১২৪।
নাহজুল বালাগায় এক স্থানে শিরোনাম এমন ‘নিজের অনুচরদের (শিয়াদের) ভর্ৎসনা’। যার অধীনে হাযরাত আলী রাঃ এর একটি খুতবা আনা হয়। যাতে হাযরাত আলী রাঃ তাঁর কুফার অনুচরদের (শিয়াদের) প্রতি তার কষ্ট, বিতৃষ্ণা ও বিরক্তি পরিস্কারভাবে বিবৃত করেন। তিনি বলেন, “মানুষ শাসকের অত্যাচারের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে; আর আমি আমার প্রজাদের অত্যাচারকে ভয় করি।”। একটু পর বলেনঃ “আমি সকাল বেলা তোমাদেরকে সোজা করি কিন্তু বিকাল বেলায় তোমরা ধনুকের পিঠের মত বাঁকা হয়ে আমার কাছে আস। আমি তোমাদেরকে সোজা করতে গিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি আর তোমরাও অশোধনীয় হয়ে পড়েছো।” একটু পর আরো বলেনঃ “আল্লাহর কসম! দিনারের সাথে দিরহাম বিনিময়ের মত মুয়াবিয়া যদি তোমাদের দশজনকে নিয়ে তদ্বিনিময়ে তার একজন আমাকে দিত আমি তাতেই সন্তুষ্ট হতাম। হে কুফাবাসীগণ (শিয়াগণ)! তোমাদের নিকট হতে আমি পাঁচটি জিনিসের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এ গুলো হল, কান থাকা সত্ত্বেও তোমরা বধির, কথা বলার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তোমরা বোবা, চোখ থাকা সত্ত্বেও তোমরা অন্ধ, যুদ্ধে তোমরা খাঁটি সমর্থক নও এবং বিপদে তোমরা নির্ভরযোগ্য ভ্রাতা নও। তোমাদের হাত মাটি দ্বারা ময়লাযুক্ত হোক (অর্থাৎ তোমরা অপমানিত ও লজ্জিত হও)। ওহে তোমাদের উদাহরণ হলো চালকবিহীন উটের পালের মত যাদের একাদিক হতে জড়ো করলে অন্যদিকে ছড়িয়ে যায়। আল্লাহর কসম, আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, যদি পুরোদমে যুদ্ধ বাঁধে তবে তোমরা আবি তালিবের পুত্রকে ছেড়ে এমনভাবে দৌঁড়ে পালাবে যেভাবে সম্মুখভাগ উলঙ্গ হওয়া মেয়েলোক পালায়।
রেফারেন্স
নাহজ আলবালাগা, বাংলা অনুবাদ- ১১৯-১২০।
এ সমস্ত ধুরন্ধর শিয়াদেরই একদল অবশেষে খারেজী মতাদর্শ গ্রহণ করে। যারা হযরত মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যা না করে তার সাথে সন্ধি চুক্তি করায় হযরত আলী রাঃ কে কাফির বলতে শুরু করে। খুব দ্রুত তাদের কিছু সাথীও জুটে যায়। কারণ কুফার লোকেরা শিয়া হলেও এরা প্রথমসারীর গাদ্দার ও প্রতারক।
অবশেষে হাযরাত আলী রাঃ নাহরাওয়ানের যুদ্ধে এসব খারেজীদের কোমড় ভেঙ্গে দেন। পরাজিত এসব খারেজীরা এবার যুদ্ধের পথ ছেড়ে ভিন্নভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের মনস্ত করে।
হাযরাত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে হাযরাত আলী রাঃ এর সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের পারস্পরিক শান্তি ও শৃঙ্খলা আবার ফিরে আসে। মুসলমানদের খুনে মুসলমানদের হাত রক্তাক্ত হবার লজ্জাজনক অধ্যায়ের বাহ্যিক পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা তা কিছুতেই বরদাশত করতে পারেনি। তাই নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে।
মুহাম্মদ বিন আবু বকর নামে এক কমবখত আব্দুর রহমান বিন মুলজিম নামক ঘাতককে মিশর থেকে কুফায় প্রেরণ করে। বলে রাখি, আব্দুর রহমান বিন মুলজিম প্রথম জীবনে শিয়া ছিল এবং সিফফিনের যুদ্ধে মাওলানা আলী রাঃ এর পক্ষে হয়ে যুদ্ধ করেছিল।
রেফারেন্স
তারিখে ইবনে মিশরী ও সিয়ারু আ’লামীন নুবালা।
অভিশপ্ত আব্দুর রহমান বিন মুলজিম শিয়া বাহ্যিকভাবে হাযরাত আলী রাঃ এর সাথে ভালবাসা ও মোহাব্বতের দাবী করতো। কুফায় এসে হাযরাত আলী রাঃ এর হাতে খিলাফতের বাইয়াত নিতে চায়। কিন্তু হাযরাতে আলী রাঃ তার বাইয়াত নিতে অস্বিকৃতি জানান। এ লোক লাগাতার তিন দিন পর্যন্ত বাইয়াত হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। বাধ্যগত থাকার অঙ্গীকার করতে থাকে। অবশেষে হাযরাত আলী রাঃ এ অভিশপ্তকে তার অঙ্গীকারের উপর বিশ্বাস করে তাকে বাইয়াত করে নেন।
রেফারেন্স
তাবকাতে ইবনে সাদ-৩/১৫৯, উর্দু সংস্করণ।
এবার সে বাহ্যিকভাবে হাযরাত আলী রাঃ এর শিয়া বা মোহাব্বতারীদের দলে শামিল হল। মুখে মুখে হাযরাত আলী রাঃ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো। আর তলে তলে মুসলমানদের পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত করতে ভয়ানক ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। সে ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্নতাবাদী খারেজীদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকে।
সেই সময় মিল্লাতে ইসলামিয়ায় তিনজন ব্যক্তিত্ব সর্ব সাধারণ্যের কাছে সর্বাধিক মানব্যর ছিলেন। যারা জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধিমত্বা, দ্বীনের জন্য কুরবানী, তাক্বওয়া পরহেযগারী ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। যাদের প্রতিজন পুরো মুসলিম মিল্লাতকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা রাখতেন। প্রতিজন কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম ছিলেন।
তাদের একজন হলেন, আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাঃ। অপরজন কাতিবে ওহী আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ। তৃতীয়জন হলেন মিশর বিজেতা হযরত আমর বিন আস রাঃ।
ইসলামের দুশমন শক্তি চিন্তা করল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিন ব্যক্তিত্বকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ শঙ্কা থেকেই যাবে যে, মুসলমানরা এ তিন জনের কোন একজনের নেতৃত্বে আবার একতাবদ্ধ হয়ে কাফির মুশরিকদের ঘুম হারাম করে দিবে।
মুনাফিক গোষ্ঠি একথা ভাল করেই জানতো যে, মুসলমানদের একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একতাবদ্ধতা তাদের জন্য মৃত্যুতুল্য। মুসলমানদের বিভেদ, বিবাদই হল, তাদের জন্য শক্তি ও কামিয়াবীর চাবিকাঠি।
মুসলমানদের একতাবদ্ধ হবার এ তিন পথিকৃত দুনিয়াতে থাকলে তাদের জন্য কখনোই শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব হবে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, যে কোন মূল্যে এ তিন ব্যক্তিত্বকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
অভিশপ্ত খারিজীদের তিন ব্যক্তি আব্দুর রহমান বিন মুলজিম, বারর বিন আব্দুল্লাহ তামিমী এবং আমর বিন বরক তামিমী মক্কায় একত্র হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, ইসলামের এ মহান তিন পুরোধাকে ৪০ হিজরীর রমজানের ১৭ বা ২১ তারিখে হত্যা করা হবে। যেন মিল্লাতে ইসলামিয়া অভিভাবকশূণ্য হয়ে যায়। একতাবদ্ধ হবার আর কোন জায়গা বাকি না থাকে।
হাজরাত মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যার দায়িত্ব বারক বিন আব্দুল্লাহ তামিমী গ্রহণ করে। হাযরাত আমর বিন আস রাঃ কে হত্যার দায়িত্ব নেয় আমর বিন বকর তামিমী। আর আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাঃ কে হত্যার দায়িত্ব গ্রহণ করে মাওলানা আলী রাঃ এরই শিয়া অভিশপ্ত আব্দুর রহমান বিন মুলজিম।
এ তিন বদবখত স্বীয় কাজ আঞ্জাম দিতে নিজ নিজ লক্ষ্যবস্তুর দিকে রওনা হয়ে যায়।
নির্ধারিত তারিখে মিশরের কেন্দ্রীয় মসজিদে খঞ্জর নিয়ে ফজরের নামাযের সময় আমর বিন বকর তামিমী হযরত আমর বিন আস রাঃ কে হত্যার উদ্দেশ্যে পজিশন নিয়ে বসে থাকে। সৌভাগ্যবশত সেদিন শারিরীক অসুস্থ্যতার কারণে আমর বিন আস রাঃ মসজিদে আসতে পারেননি। নামায পড়ান হযরত খারেজা বিন হুজাফা। তাকেই আমর বিন আস মনে করে আমর বিন বকর তামিমী হামলা করলে খারেজা বিন হুজাইফা শহীদ হয়ে যান।
অন্যদিকে বরক বিন আব্দুল্লাহ তামিমী দামেশকের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ফজরের নামাযের সময় আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যার জন্য হামলা করে। কিন্তু আঘাত ভুল করায় হাজরাত মুয়াবিয়া রাঃ আহত হলেও শহীদ হওয়া থেকে রক্ষা পান। আল্লাহ তাআলা তাকে রক্ষা করেন।
অপরদিকে আব্দুর রহমান বিন মুলজিম কুফার জামে মসজিদের বাহিরে আমীরুল মু’মিনীন হাযরাত আলী রাঃ এর অপেক্ষায় ছিল। যখন তিনি আসলেন তখন শিয়া অভিশপ্ত ইবনে মুলজিম বিষমাখা তলোয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করলো। ফলে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।
রেফারেন্স
আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, বাংলা সংস্করণ- ৭/৫৭৮-৫৮৫,
তারীখে তাবারী, আরবী সংস্করণ- ৫/১৪৩-১৪৯,
তবক্বাতে ইবনে সাদ, উর্দু সংস্করণ-৩/১৬১।
শিয়ারা হাযরাত হাসান রাঃ কেও হত্যা করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। শিয়ারা ঈমাম হাসান রাঃ কে সওয়ারীতে আরোহী অবস্থায় বর্শার আঘাত করে আহত করেছিল।
রেফারেন্স
আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৪, বাংলা সংস্করণ-৮/৪০,
তারীখে তাবারী-৫/১৫৯, উর্দু সংস্করণ-৪র্থ খ-, ১ম অংশ, পৃষ্ঠা-২৪।
হাযরাত হাসান রাঃ এর আর বুঝতে বাকী রইল না যে, শিয়ারা মুখে মুখে আমাদের বন্ধু হবার ভান করলেও এরা সবাই ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন। তাই এদের কথা মানা ও তাদেরকে সঙ্গী বানানো যেমন নিজের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি মুসলমানদের একতা ভ্রাতৃত্বের জন্য এরা হুমকি। চরম স্বার্থপর ও প্রতারক এরা।
সুতরাং মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিচুক্তিই একমাত্র সমাধান। মুসলমানদের একতা ও ভ্রাতৃত্বই পারে এসব কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে।
তাই তিনি দৃৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন যে, মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন। সিদ্ধান্ত যখন শিয়াদের সামনে পেশ করলেন, তখন তারা যারপরনাই আশ্চর্য হল, এবং চরম বিরোধীতা করল। শিয়াদের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থে এ বিষয়ে কী লিখা হয়েছে, তা একটু দেখে নেইঃ-
فقالوا: والله يريد ان يصالح معاوية ويسلم الأمر إليه كفر والله الرجل كما كفر أبوه، فانتهبوا فسطاطه حتى أخذوا مصلاه من تحته، ونزع مطرفه عبد الرحمن بن جعال الأزدى وطعنه جراح بن سنان الأسدى فى فخذه (مناقب آل ابى طالب-4/38)
(যখন শিয়ানে আলীরা একথা জানতে পারল যে, হযরত হাসান রাঃ মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধি করতে চাচ্ছেন তখন) তারা বলতে লাগল, আল্লাহর কসম! হাসান রাঃ মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধি করতে চাচ্ছেন এবং আমীরত্ব তার কাছে হস্তান্তর করতে চাচ্ছেন। আল্লাহর কসম! তিনিতো তার বাবার মতই কুফরী করছেন। একথা বলে তারা হযরত হাসান রাঃ এর তাঁবুতে হামলে পড়ে। তার নিচ থেকে জায়নামায টেনে নিয়ে যায়। আব্দুর রহমান বিন জাআল তার কাঁধ থেকে চাদর নিয়ে যায়। আর যাররাহ বিন সিনান তার রানের উপর বর্শার আঘাত দিয়ে তাকে আহত করে ফেলে।
রেফারেন্স
মানাকিবে আলে আবী তালেব, শিয়া লেখক আবূ যাফর মুহাম্মদ বিন আলীকৃত-৪/৩৮, কাশফুল গুম্মাহ ফী মা’রিফাতিল আয়িম্মাহ, শিয়া আবুল হাসান আলী বিন ঈসা বিন আবিল ফাতাহ ইরবিলীকৃত-২/৩৩৯।
প্রসিদ্ধ শিয়া ঐতিহাসিক মাসঈদী লিখেছেনঃ
يا أهل الكوفة، لو لم تذهل نفسى عنكم إلا لثلاث خصال لذهلت: مقتلكم لأبى، وسلبكم ثقلى، وطعنكم فى بطنى، وإنى قد بايعت معاوية، فاسمعوا له وأطيعوا (مروج الذهب ومعادن الجوهر للمسعودى-3/9)
[হযরত হাসান রাঃ তার শিয়াদের রেখে হযরতে মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধি করে তার বাইয়াত গ্রহণের কারণ সম্পর্কে বলছেন] হে কুফাবাসী! তোমাদের তিনটি ব্যবহারের কারণে আমার মন তোমাদের থেকে উঠে গেছে। একটি হল, তোমরা আমার বাবাকে হত্যা করেছো, আমার সম্পদ লুণ্ঠন করেছো, আমার পেটে বর্শা মেরে আমাকে আহত করেছো। নিশ্চয় আমি মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছি, সুতরাং তোমরা তার কথা শোন এবং তার আনুগত্ব কর।
রেফারেন্স
মুরাওয়াজুয যাহাব, শিয়া ঐতিহাসিক মাসঈদীকৃত-৩/৯, এছাড়া দ্রষ্টব্য-তারীখে তাবারী-৫/১৫৯, উর্দু সংস্করণ-৪খ-, প্রথমাংশ, পৃষ্ঠা-২৪।
সম্মানিত পাঠক/পাঠিকাগণ! একটু ভাবুন! হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিচুক্তি ও তার বাইয়াত গ্রহণের কারণেহ হযরত হাসান রাঃ এর উপর আক্রমণ করা হল। তাকে গালাগাল করা হল। কাফের বলা হল। এমনকি হযরত আলী রাঃ কেউ কাফের বলা হল। হযরত হাসান রাঃ এর গায়ের চাদর ছিনিয়ে নেয়া হল। তার জায়নামায টেনে নিয়ে গেল। হযরত হাসান রাঃ কে বর্শার আঘাতে রক্তাক্ত করা হল।
প্রশ্ন হল, এই কমবখত লোকগুলো কারা? তারা নিজেদের কী বলে পরিচয় দিতো? নিজেদের কী নামে ডাকতো?
প্রশ্নগুলোর ফায়সালা আমি আপনি বা অন্য কোন ঐতিহাসিক করার বদলে আমরা দেখি হযরত হাসান রাঃ তাদের ব্যাপারে কী মন্তব্য করেছেন?
শিয়া মতবাদের গ্রহণযোগ্য কিতাব ইহতিজাযে তাবরিসীর একটি ইবারত দেখে নেইঃ-
أرى والله أن معاوية خير لى من هؤلاء يزعمون أنهم لى شيعة، ابتغوا قتلى وانتهبوا ثقلى، وأخذوا مالى، والله لئن آخذ من معاوية عهدا احقن به دمى، وأومن به فى أهلى، خير من أن يقتلنى فتضيع أهل بيتى وأهلى، والله لو قاتلت معاوية لأخذوا بعنقى حتى يدفعونى إليه سلما (الاحتجاج للطبرسى-2/9)
আল্লাহর কসম! আমি মনে করি যে, মুয়াবিয়া আমার কাছে ঐ লোকদের চেয়ে উত্তম যারা নিজেদের বিষয়ে দাবী করে যে, তারা আমার শিয়া। এই শিয়ারাই আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে, আমার সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছে এবং আমার মাল লুণ্ঠন করেছে। আল্লাহর কসম! যদি আমি মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করি, তাহলে এর দ্বারা আমার প্রাণ রক্ষা পাবে, এবং আমার পরিবার নিরাপদ হবে। তাহলে এটিতো এর চেয়ে উত্তম যে, শিয়ারা আমাকে হত্যা করবে এবং এর ফলে আমার পরিবার ও সংসার ধ্বংস হবে। আল্লাহর শপথ! যদি আমি মুয়াবিয়ার সাথে যুদ্ধ করি, তাহলে এ শিয়ারাই আমাকে ঘাড় ধরে মুয়াবিয়ার কাছে সোপর্দ করবে।
রেফারেন্স
আলইহতিযায, আবূ মানসূর আহমাদ বিন আলী বিন আবী তালিব তাবরিসীকৃত-২/৯।
হযরত হাসান রাঃ এর উপরোক্ত বক্তব্যটি আবার পড়ুন। ভাবুন। কী বলছেন হযরতে হাসান রাঃ। নিজেদের শিয়া দাবী করা লোকগুলো বিশ্বস্ত না গাদ্দার? শিয়া মতবাদের দ্বিতীয় ইমাম হযরত হাসান রাঃ কসম করে বলছেন এসব শিয়াদের তুলনায় হযরতে মুয়াবিয়া রাঃ অনেক উত্তম। এরকম সঙ্গীন মুহুর্তেও হযরতে মুয়াবিয়া রাঃ তার সহযোগিতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়। হযরতে হাসান রাঃ এর সাথে সন্ধি করতে হযরতে মুয়াবিয়া রাঃ ইচ্ছা প্রকাশ করে চিঠি লিখেছেন।
শুধু তা’ই নয়, হযরত হাসান রাঃ এমন কথাও জানতে পারেন যে, এসব শিয়া নামধারী গাদ্দারগুলো গোপনে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর কাছে পত্রের মাধ্যমে জানায় যে, তিনি যেন তারাতারি হামলা করেন। তিনি হামলা করলে এরা হযরত হাসান রাঃ কে বন্দি করে তার হাতে হস্তান্তর করবে।
রেফারেন্স
শিয়া মতবাদের গ্রহণযোগ্য কিতাব কাশফুল গুম্মাহ ফী মা’রিফাতিল আয়িম্মাহ-২/৩৩৯।
হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সাদা কাগজে সাইন করে হযরত হাসান রাঃ এর কাছে পত্র প্রেরণ করেন। যাতে তিনি স্পষ্ট করেই লিখেন যে, হযরত হাসান রাঃ যে কোন শর্ত ইচ্ছে লিখে দিতে পারেন, সকল শর্ত মেনেই সন্ধি করতে প্রস্তুত আছেন মুয়াবিয়া রাঃ।
রেফারেন্স
তারীখে ইবনে খালদুন আরবী-২/৬৪৮, উর্দু সংস্করণ-১ম খ-, প্রথমাংশ-৪৪১,
তারীখে তাবারী, আরবী-৫/১২৬, উর্দু এডিশন, ৪র্থ খ-, প্রথমাংশ, পৃষ্ঠা-২৬।
শিয়াদের নিকট গ্রহণযোগ্য ও তাদের লিখিত কিতাবে এসেছে যে, হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সন্ধি করার জন্য যে পত্র প্রেরণ করেন, তার সাথে হযরত হাসান রাঃ এর শিয়া দাবীকারী ব্যক্তিদের গাদ্দারীর একটি প্রমাণপত্র প্রেরণ করেন। যা হাসান রাঃ এর শিয়ারা মুয়াবিয়া রাঃ এর কাছে প্রেরণ করেছিল। যাতে লেখা ছিল যে, মুয়াবিয়া রাঃ যদি হাসান রাঃ এর সাথে যুদ্ধ করেন, তাহলে এসব শিয়ারা হযরত হাসান রাঃ কে তার হাতে সোপর্দ করে দিবে। [কাশফুল গুম্মাহ-২/৩৪০]
অবশেষে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে হযরত হাসান রাঃ বিশাল হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে ৫ বছরের দীর্ঘ মতভেদকে মিটিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রকে একতার প্লাটফর্মে আনার লক্ষ্যে সন্ধির পথকে বেছে নেন। মাত্র ছয় মাসের খিলাফত শেষে হযরত হাসান রাঃ খিলাফতের দায়িত্ব মুয়াবিয়া রাঃ এর কাছে হস্তান্তর করে ৪১ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে। নামকাওয়াস্তে কতিপয় শর্ত দিয়ে বাইয়াত গ্রহণ করে নেন।
অবশেষে হযরত কায়স বিন সাদ এবং ইবনে আব্বাস রাঃ এর সকল শর্ত মুয়াবিয়া রাঃ মেনে নেন। ফলে তারাও বাইয়াত গ্রহণ করলে আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর খিলাফত বিষয়ে সকলের ঐক্যমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ কারণেই এ বছরকে ঐক্যের বছর হিসেবে অভিহিত করা হয়।
রেফারেন্স
তারীখে তাবারী, আরবী-৫/১৬৪, , উর্দু, ২য় খ-, প্রথমাংশ, ২৭-২৮ পৃষ্ঠা,
আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৫, বাংলা সংস্করণ-৮/৪১,
তারীখে ইবনে খালদুন, আরবী-২/৬৫০, উর্দু সংস্করণ-২/৪৪২,
শিয়াদের কিতাব কাশফুল গুম্মাহ-২/৩৪১।
এরপর থেকে মুসলমানদের পুরানো ঐতিহ্য আবার ফিরে আসে। ৫ বছর যাবত ইসলামের যে বিজয় অভিযান থমকে ছিল তা আবার নতুন করে শুরু হয়। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ইসলাম পৌছে দেবার মিশন আবার পুরোদমে চলতে থাকে।
এই শিয়ারাই ইমাম হুসাইন রাঃ কে চিঠি দিয়ে ডেকে তার সাথে দাগাবাজি করেছিল এবং তার সাথে যুদ্ধ করেছিল।
শিয়াদের গোমরাহী থেকে মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ হিফাজাত করুন। আমীন।