কিভাবে যাওয়া যায়:
সিলেট রেল স্টেশন অথবা কদমতলী বাস স্ট্যান্ড এ নেমে রিকশা বা সিএনজি অটোরিকশাযোগে মাজারে যাওয়া যায়। রিকশা ভাড়া ২০-২৫ টাকা, সিএনজি ভাড়া ৮০-১০০ টাকা।সুরমা নদী পার হয়ে মূল শহরে এসে মাজার এ পৌছাতে হয়। মাজার গেট রোড এ অনেকগুলো আবাসিক হোটেল রয়েছে।
হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। তিনি ছিলেন ওলিকুল শিরোমণি। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিন (র.) এর ওপর রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচার এবং এর প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়। কেউ কেউ সিলেটকে পূণ্যভূমি অভিধায়ও অভিহিত করেন।
আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল
কথিত আছে, প্রাচ্যদেশে আসার পূর্বে শাহজালাল (র.) এর মামা মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর (র.) তাঁকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।’
হযরত শাহজালাল (র.) বিশিষ্ট শিষ্য শেখ আলীকে এই মাটির দায়িত্বে নিয়োগ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, যাত্রাপথে বিভিন্ন জনপদের মাটির সাথে যেন এই জনপদের মাটির তুলনা করে তিনি দেখেন। পরে এই শিষ্যের উপাধি হয় চাষণী পীর। সিলেট শহরের গোয়াইপাড়ায় তাঁর মাজার বিদ্যমান।
সিলেটের মাটির সাথে আরবের মাটির মিল পাওয়ায় হযরত শাহজালাল (র.) সিলেটে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। সিলেটে তেল ও গ্যাস পাওয়ায় আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল প্রমাণিত হয়েছে।
গজার মাছ
হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরে রয়েছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের পশ্চিম কোণে ছোট মাছ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। পুকুরে অজুর ব্যবস্থাও আছে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগে পুকুরের প্রায় ৭শ’রও বেশি গজার মাছ হত্যা করা হয়। ফলে পুকুরটি গজার মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছগুলোকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। পুকুরটি মাছ শূন্য হয়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (র.) এর অপর সফরসঙ্গী মৌলভীবাজারের শাহ মোস্তফার (র.) মাজার থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ২৪ টি গজার মাছ এনে পুকুরে ছাড়া হয়। বর্তমানে পুকুরের গজার মাছের সংখ্যা কয়েক শ’তে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়।
জালালী কবুতর ও নিজাম উদ্দিন আউলিয়া
হযরত শাহজালাল (র.) এর আধ্যাত্নিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া(র.) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালী কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলের বংশধর এবং জালালী কবুতর নামে খ্যাত। সিলেটে জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতর বধ করে না এবং খায় না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। শাহজালালের (র.) মাজার এলাকায় প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়। মাজার কর্তৃপক্ষ এসব কবুতরের খাবার সরবরাহ করে থাকেন।
রাজস্বমুক্ত কসবে সিলেট
হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন কামনাবাসনামুক্ত নির্লোভ সূফি সাধক। কথিত আছে, দিলস্নীর সম্রাট তাঁকে নবাবী প্রদান করে একটি সনদ পাঠান। হযরত শাহজালাল (র.) তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, তিনি সংসারবিরাগী ফকির, তাঁর নবাবীর প্রয়োজন নেই। এক পর্যায়ে সম্রাট তাঁকে সিলেটের জায়গীর গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। হযরত শাহজালাল (র.) তাতেও রাজি হননি।
শেষে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি হযরত শাহজালালের (র.) প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে সিলেট শহরকে রাজস্বমুক্ত (কসবে) বলে ঘোষণা দেন। এ কারণে আজো সিলেট শহরের ভূমি রাজস্ব থেকে মুক্ত।
জমজমের কূপ ও ঝরণা
লোকশ্রম্নতি আছে যে হযরত শাহজালাল (র.) একটি কূপ খনন করার আদেশ দিয়ে প্রার্থনা করেন আলস্নাহ যেন এই কূপটিকে জমজমের কূপটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেন। এরপর তিনি লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঘাত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে এই কূপটির সাথে জমজমের কূপের মিলন ঘটে গেল। তারপর এর চারপাশ পাকা করে দেওয়া হলো এবং উত্তর পার্শ্বে দুটি পাথর বসিয়ে দেওয়া হলো-যা থেকে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়।
ডেকচি
মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছেন বলে জানা যায়। মীর মুরাদ ঢাকার হোসেনী দালান তৈরী করেন। যদিও ডেকচিগুলোতে রান্নাবান্না হয় না, তবুও কথিত আছে প্রত্যেকটিতে সাতটি গরম্নর মাংস ও সাত মণ চাল এক সাথে রান্না করা যায়। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ডেকচিগুলোতে প্রচুর টাকাপয়সা দান করেন।
চিলস্নাখানা
মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রীলঘেরা তারকাখচিত ছোট্ট যে ঘরটি রয়েছে, এটি হযরত শাহজালালের (র.) চিলস্নাখানা। স্থানটি মাত্র দু’ফুট চওড়া। কথিত আছে যে, হযরত শাহজালাল (র.) এই চিলস্নাখানায় জীবনের ২৩ টি বছর আরাধনায় কাটিয়েছেন।
শাহজালালের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি
হযরত শাহজালাল (র.) কেবল একজন পীর ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বীর মোজাহিদ। তার ব্যবহৃত তলোয়ার, খড়ম, প্লেট এবং বাটি দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। দরগার দক্ষিণ দিকে দরগাহ মাদ্রাসা বিল্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এই পথ দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পর বাঁ দিকের বাড়িটি মুফতি নাজিমুদ্দিন আহমদের। এই বাড়িতে হযরত শাহজালালের (র.) তলোয়ার ও খড়ম সংরক্ষিত আছে। প্লেট ও বাটি সংরক্ষিত আছে দরগাহ’র মোতওয়ালিস্নর বাড়িতে। এগুলো দেখতে প্রতিদিন উৎসুক মানুষের ভীড় জমে।
দরগাহ মসজিদ
বাংলার সুলতান আবু মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিশে আতার আমলে ১৪০০ সালে দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৭৪৪ সালে বাহরাম খাঁ ফৌজদারের সময় এটি পুনর্নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের অন্যতম একটি মসজিদ।
হযরত শাহজালালের (র.) সিলেট আগমন
হযরত শাহজালাল (র.) আরবের ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা মাহমুদ বিন মোহাম্মদ ছিলেন কোরায়শ বংশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁকে পীরদের পীর হিসেবে অভিহিত করা হতো। তিনি বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁর মা ছিলেন সৈয়দ বংশের এক মহীয়সী নারী। শাহজালালের (র.) বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। মায়ের মৃত্যুরপর মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে লালনপালন করেন। তিনি ভাগ্নেকে এমনভাবে বড় করতে চান যাতে তিনি পা–ত্য ও বৈদগ্ধের স্তরে গিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন। ধীরে ধীরে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকে।
কথিত রয়েছে, একদিন সৈয়দ আহমদ কবির তাঁর নিজ গৃহের ভেতর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে এসে হযরত শাহজালালের (র.) হাতে দিয়ে বললেন, ভারতবর্ষের দিকে বেরিয়ে পড়ো এবং যে মাটির সাথে এ মাটির রূপ-রস-ঘ্রাণের সাদৃশ্য খুঁজে পাবে সেখানে এই মাটি ছড়িয়ে দিয়ে আস্তানা গাড়বে। শাহজালাল (র.) তাঁর পীরের কথা অনুযায়ী হাজী ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কিছু শিষ্য নিয়ে ভারতবর্ষের দিকে রওয়ানা হলেন। প্রথমে তিনি নিজ বাসভুমি ইয়েমেনে এসে পৌঁছেন। এসময় ইয়েমেনে এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি বিষপানে হযরত শাহজালালকে (র.) বধ করার চেষ্টা চালান। কিন্তু হযরত শাহজালালের (র.) কৌশলের কাছে রাজার দুরভিসন্ধি পরাজিত হয়। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শেখ আলি ক্ষমতায় অভিষিক্ত হন। শেখ আলি হযরত শাহজালালের (র.) গুণ ও কোমলমতির পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি হযরত শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী হলেন। হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর পীরের দেওয়া মাটি শেখ আলির হাতে দিয়ে বললেন, আমরা যখন যেখানে গিয়ে পৌঁছাব, সেখানকার মাটির সঙ্গে এ মাটির রূপ-রস-গন্ধ তোমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে- এটাই হল তোমার কাজ। শেখ আলিকে জিহবা দিয়ে চুষে মাটি নিরীক্ষণ করতে হতো। সে কারণে আজো তাঁকে চাষণির পীর হিসেবে অভিহিত করা হয়।
হযরত শাহজালাল (র.) যখন দিলস্নীতে পৌঁছান, তখন সেখানকার বিখ্যাত পীর ছিলেন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। তিনি প্রকৃত অর্থেই অনুধাবন করতে পারলেন হযরত শাহজালাল (র.) একজন দরবেশ। তিনি ছাই রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার হিসেবে পাঠিয়ে তাঁকে তার দরবারে নিমন্ত্রণ জানালেন।
হযরত শাহজালাল (র.) যখন সিলেটে আসেন-তখন এখানে গোবিন্দ নামক এক রাজার রাজত্ব ছিল। এ রাজ্য জাদুটোনার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাজা গোবিন্দের জন্মস্থান গৌড়ে থাকায় তাকে গৌড়গোবিন্দ নামে ডাকা হতো। হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সঙ্গীরা যখন গৌড় রাজ্য অধিকার করেন-তখন রাজা গৌড় ছেড়ে সিলেটে আশ্রয় নেন এবং নিজেকে রাজা বলে দাবি করতে থাকেন। ওই সময় সিলেট শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত টুলটিকর নামক স্থানে শেখ বোরহান উদ্দিন নামক একজন মুসলমান থাকতেন। বোরহান উদ্দিন ছিলেন নিঃসমত্মান। আলস্নাহর কাছে অনেক প্রার্থনার পর তিনি একটি পুত্র সমত্মান লাভ করলেন। তাঁর সমত্মানের আকিকা উপলক্ষে তিনি একটি গরম্ন কুরবানি দেন। এসময় একটি কাক অথবা একটি চিল এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে গৌড়গোবিন্দের গৃহপ্রাঙ্গণে ফেলে দিল। কুসংস্কার আশ্রিত রাজা ভীষণ রাগান্বিত হলেন। তিনি বোরহান উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে তাঁর হাতের কব্জি কেটে দিলেন এবং তার নিষ্পাপ শিশুকে জবাই করে হত্যা করলেন। এতে বোরহান উদ্দিন নিরূপায় হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে। একদিন বোরহান উদ্দিন গোপনে শহর ছেড়ে দিলস্নীর সুলতান আলাউদ্দিন ইবনে মাহমুদ শাহের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি সুলতানের কাছে তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করলেন। সুলতান এ মর্ম পীড়াদায়ক কাহিনী শুনে ভীষণ আঘাত পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বোরহান উদ্দিনের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর ভাতিজা সিকন্দর শাহকে সসৈন্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সিকন্দর গাজি ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে সোনারগাঁয়ে আস্তানা গাঁড়লেন। খবর পেয়ে গৌড়গোবিন্দ তার জাদুকরদের ভৌতিক শক্তির সাহায্যে সিকন্দর গাজির সৈন্যদের ওপর জাদুমিশ্রিত অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে সিকন্দর গাজির সৈন্যরা পরাস্ত হয়। এরপর ঘটনাক্রমে শাহজালালের (র.) সাথে দেখা হয় সিকন্দর গাজির। তখন তাঁদের সৈন্য সংখ্যা তিন শত ষাট-এ গিয়ে দাঁড়াল। সিকন্দর গাজি তার সকল কথা শাহজালালকে (র.) সবিস্তারে জানালেন। তিনি তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘আমিও এসেছি সকল অপশক্তি ধ্বংস করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, তাই তুমি যদি সিলেট-বিজয় করতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পার।’
হযরত শাহজালাল (র.) যোদ্ধাগণকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ব্রহ্মপুত্রের তীরে পৌঁছে দেখলেন এখানে কোনো নৌকা নেই। তিনি তার মুসালস্না(জায়নামাজ) বিছিয়ে দিয়ে সকলকে নিয়ে নদী পার হন বলে লোকশ্রম্নতি রয়েছে। তাঁরা যখন সিলেটের চৌকি পরগনায় পৌঁছলেন, তখন গৌড়গোবিন্দের সৈন্যরা তাঁর প্রতি অগ্নিবাণ ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় তা প্রতিহত করলেন, যা ফিরে গিয়ে গৌড়গোবিন্দের আস্তানায় অন্ধকার জালের সৃষ্টি করল। এ দৃশ্য দেখে সৈন্যরা ঘাবড়ে গেল। এ খবর শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন গৌড়গোবিন্দ নিজেও। এ অবস্থায় হযরত শাহজালাল (র.) বরাক নদীর তীরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু এখানেও পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আবারও তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে নদী পার হন বলে লোকশ্রম্নতি আছে। তারপর সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে জালালপুর পরগণায় এসে পৌঁছেন। এসময় গৌড়গোবিন্দ একটি বিশাল লোহার কামান হাতির ওপর সওয়ার করে শাহজালালের কাছে পাঠালেন। রাজার দূতরা জানাল, তিনি যদি ধনুতে শরযোজনা করতে পারেন, তাহলে তিনি তার জাদুটোনা থেকে বিরত থাকবেন এবং বিনাযুদ্ধে রাজ্যভার ছেড়ে দেবেন। শাহজালাল (র.) তার শর্ত মেনে নেন। এরপর হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর সফরসঙ্গী নাসিরউদ্দিনকে ধনুতে শরযোজনা করতে বললেন। কিন্তু তা খুবই কষ্টকর ছিল। নাসিরউদ্দিনের এ অবস্থা দেখে হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা তাঁকে সহযোগিতা করেন। সঙ্গে সঙ্গে নাসিরউদ্দিন সফল হন। এই অসাধ্য সাধন দেখে চারদিক থেকে হর্ষধ্বনি ওঠে এবং আকাশবাতাস প্রকম্পিত হয়। এরপর কামানটি গৌড়গোবিন্দের দিকে এগিয়ে আসে। কোনোক্রমে রাজা পলায়নের উদ্দেশ্যে কাছাড়ের পথ ধরলেন। এরপর থেকে তার আর কোনো হদিস মেলেনি।
হযরত শাহজালাল (র.) এখানে রাজ্য জয় করে দেখেন তাঁর পীর সৈয়দ আহমদ কবিরের দেওয়া এক মুঠো মাটির সাথে এখানকার মাটির অদ্ভূত মিল রয়েছে। তিনি সিলেট শহরের দরগা মহলস্নায় একটি ছোট্ট টিলায় তাঁর আস্তানা গাড়লেন। এখানে বসেই এবাদত-বন্দেগি করতে থাকেন। তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে, পরগণায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেন। শুধু ইয়েমেনের রাজপুত্র, হাজি ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কয়েকজন খাদেমকে তাঁর কাছাকাছি রাখেন বলে জানা যায়। এখান থেকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং নিজের আস্তানাকে ধ্যান ও সাধনার এক অনুপম লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেন। হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন কিংবদমিত্মতুল্য। জাতিধম,র্ বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের আধ্যাত্নিক শক্তি যোগাচ্ছেন এই সাধক পুরম্নষ।
বাংলা ভাষায় লেখা সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’-এ বলা হয়েছে-হযরত শাহজালাল (র.) যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তাঁর কবরের চারপাশে ছোট্ট দেওয়াল তোলা হয়। পাশেই বানানো হয় একটি মসজিদ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্নিক পুরম্নষ হযরত শাহজালাল (র.) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে আগমন করেন। তিনি ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে ইমেত্মকাল করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। এজন্যই হযরত শাহজালালকে (র.) বলা হতো মজররদ।