হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (রাদি আল্লাহু আনহু)’র জীবনী ও উপদেশাবলী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (রাদি আল্লাহু আনহু 

জন্মঃ-  ৮৩ হিজরী সনে /৭০৩ খৃষ্টাব্দ। শাহাদাত ১৫ শাওয়াল মতান্তরে ১৫ই রজব ১৪৮ হিজরী/ ৭৬৬ খৃষ্টাব্দে, ৬৫ বছর বয়সে

মহানবী হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জীবনাদর্শ রেখে গেছেন, তাঁর সুযোগ্য সোনালী ও জ্যোর্তিময় উত্তরপুরুষের দল সে মহান আদর্শকে ধারণ করে এসেছেন যুগের পর  যুগ ধরে। নুর নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  এই আলোকিত ও পূণ্যার্হ অনুগামীদলের প্রথম যে কাফেলা তাঁরা ইতিহাসে সাহাবী নামে পরিচিত। সাহাবীগণের অনুসারী যাঁরা তাঁদেরকে ‘তাবেয়ী’ নাম দেয়া হয়েছে।  আর তাবেয়ীগনের পরবর্তী যুগের সত্যাভিসারী সেনানীগণ ‘তাবে তাবেয়ী’ নামে চিহ্নিত। তাবেয়ীগণের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় সাধকপুরূষ হচ্ছেন – হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (রাদি আল্লাহু আনহু)। মদীনায় মুনাওওরায় ৮৩ হিজরী সনে /৭০৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী অর্থাৎ ইমাম আল বাকীর। তাঁর পূন্যশীলা মাতা উম্মে ফারওয়া ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদি আল্লাহু আনহু) এঁর প্রপৌত্রী । প্রকৃত নাম জাফর ইবনে মুহাম্মাদ এবং তাঁর ডাক নাম ‘আবু আবদিল্লাহ্’।  নিজ নামের চাইতে ‘আস সাদিক’ বা  সত্যবাদী উপাধিতেই তিনি মুসলিম জাহানে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা মুহাম্মাদ আল বাকীর (রাদি আল্লাহু আনহু) এঁর জ্যেষ্ঠপুত্র।  প্রখ্যাত সাধক হজরত দাউদ তায়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এবং ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন তাঁর সমসাময়িক।

 হযরত আলীর (রাদিআল্লাহু আনহু) যোগ্য উত্তরসূরী এই মহা পুরূষ ছিলেন আহলে বাইতের সদস্য এবং প্রসিদ্ধ বারোজন ইমামের একজন। তিনি বহুসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছন। কুরআন ও ফিকাহ শাস্ত্রে তিনি অসাধারন ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।  একজন বিশিষ্ট পন্ডিত, সুসাহিত্যিক ও আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাঁর প্রগাঢ় পান্ডিত্য ও গুনাবলী, চরিত্রের উর্ধ্বগামী পবিত্রতা ও সত্যতা তদীয় বংশের শত্রু দেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। ইলমে মারিফাতের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বিশেষভাবে প্রজ্ঞাবান। অর্থাৎ শরীয়ত ও মারিফাত উভয়ক্ষেত্রেই তাঁর অসামান্য দখল ছিল। 

হিযরী দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে আব্বাসীয় খলীফা আল মানসুর বাগদাদের মসনদে আসীন হন। হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক(রাদি আল্লাহু আনহু) এঁর আলোকময় ব্যক্তিত্বের যশ -খ্যাতি, জনগনের উপর তাঁর বিশাল প্রভাব, তাঁর প্রতি জনগনের অঢেল ভক্তি ও ভালবাসা নতুন খলীফাকে বিশেষভাবে চিন্তিত করে তুলল। কে জানে, হয়তো একদিন তিনিই খিলাফতের দাবী করে বসবেন ? অথবা তাঁর ভক্তজনেরাই মানসুর এর স্থলে ইমাম জাফর আস সাদিক (রাদি আল্লাহু আনহু) কে  একদিন বাগদাদের তখতে বসিয়ে দেবেন ?  আশু সিংহাসনচ্যুতির শংকাগ্রস্থ খলীফা তাই কালবিলম্ব না করে ইমাম জাফর আস সাদিককে (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) গ্রেফতার করে দরবারে নিয়ে এলেন, তাঁকে হত্যার কুমতলবে। কিন্তু আল্লাহ্-র একি  অপার মহিমা ! ইমাম জাফর আস সাদিক(রাদি আল্লাহু আনহু) কে দরবারে ঢুকতে দেখে খলিফা আল  মানসুর এর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কী অপার্থিব আলোর দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করছে ইমাম জাফর আস সাদিক (রাদি আল্লাহু আনহু) এঁর পবিত্র চোখ-মুখ !ভয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাাঁড়ালেন ক্ষমতাভিমানী খলীফা। তারপর ইমাম জাফর আস সাদিককে (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) অভ্যর্থনা জানিয়ে সসম্মানে সিংহাসনে এনে বসালেন। কী করতে চেয়েছিলেন ? আর কী হয়ে গেল ? খলীফা নিজের আসন ছেড়ে বসে পড়লেন মহাতাপসের পায়ের কাছে। ইমাম সাহেবের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন, “বলুন,আপনার কি প্রয়োজন? ”ইমাম সাহেব উত্তর দিলেন, “আমার কোন প্রয়োজন নেই।  শুধু অনুরোধ এটুকু যে, ভবিষ্যতে আমাকে এভাবে ডেকে এনে আমার ইবাদাতের বিঘ্ন ঘটাবেন না”। খলীফা আল মানসুর তাঁকে সেমতো কথা দিয়ে সসম্মানে বিদায় দিলেন। ইমাম জাফর আস সাদিক (রাদি আল্লাহু আনহু) এঁর যেভাবে এসেছিলেন,  সেভাবেই খলীফার দরবার  কক্ষ পরিত্যাগ করলেন।  কিন্তু তাঁর অপরিসীম আধ্যাত্মিক শক্তির বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া তখনও শেষ হয়নি। বরং তা আরো অধিকতর সক্রিয় হলো। তিনি বিদায় নিতেই খলীফা অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। অজ্ঞান অবস্থাতেই  তার তিন ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজন ও সভাসদবর্গ হতবাক। কোথা থেকে যে  কী হয়ে গেল, তা কেউই বুঝে উঠতে পারলেন না।  অবশেষে মানসুর চেতনা ফিরে পেলেন।  শুভাকাংখীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন এক অত্যাশ্চর্য ঘটনার কথা। খলীফা বললেন,“ যখন ইমাম জাফর আমার দরবার কক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন আমি দেখলাম তিন তিনটি অতি বিষধর সর্প ফনা তুলে আমাকে বলছে, ‘দেখ, মানসুর! জাফর সাদিকের কোন ক্ষাতিসাধন করার চেষ্টা যদি কর, তাহলে আমরা তোমাকে দংশন  করবো। ’ ঐ ভয়ংকর সাপর ভয়েই আমি অমন সুন্দর ব্যবহার করে তাঁকে বিদায় দিলাম। কিন্তু মনের ভয় তখনো কাটেনি, তাই মুর্ছা গিয়েছিলাম”।  সুবহান আল্লাহ্ ! যারা আল্লাহ্-র ধ্যানে মগ্ন থাকেন, অর্থাৎ  আল্লাহ্ পাকের পথের পথিক যারা, মহান আল্লাহ্তায়ালা নিজেই তাঁদের রক্ষাকর্তা হয়ে যান। পৃথিবীর কোন শক্তিই তাঁদের কোন রকম ক্ষাতিসাধন করতে পারে না।                    

একদিন একলোক ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) কে বললেন, “আপনার মধ্যে বাহ্য ও গুপ্ত উভয়গুনই আছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, আপনি যেন নিজেকে কিছুটা বড় মনে করেন”। উত্তরে হযরত জাফর সাদেক (রহঃ) তাকে বললেন, “আমার যা কিছু নিজস্ব গৌরব সব আমি মুছে ফেলেছি। তবে কিছু কিছু আল্লাহ প্রদত্ত গৌরব থাকে, যা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়। সেখানে মানুষের কোন হাত থাকে না। সুতারাং তাকে অহমিকা বলা যায় না”।           

হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক’র (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বানীসমুহঃ

১। শেষ বিচারের দিনে নানাজী হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি প্রশ্ন করেন, “ তুমি কেন আমার তাবেদারী করলেনা ?” তখন কী জবাব দেবো, সে ভয়েই আমি সব সময় তটস্থ থাকি।

২। যে লোক আরাম ও নিরাপত্তা কামনায় ইবাদাত করে, আর ইবাদতের পর আত্মশ্লাঘা করে, সে আল্লাহ্ থেকে দুরে সরে যায়। যে লোক ইবাদাত বন্দেগী করে নিজেকে আবেদ বলে ঘোষনা করে, সে পাপী। আর যে লোক পাপ কাজ করে লজ্জা পায় সে আল্লাহ্-র অনুগতদের অন্তর্ভূক্ত হয়। 

৩। যে লোক কোন অন্যায় কাজ করার আগেই পাপের কথা ভেবে তাওবা করে,  সে আল্লাহ্-র নৈকট্য লাভ করে। 

৪। বংশ দিয়ে কোন কিছু হয়না। আমল বা সাধনা দরকার। আমলেই মানুষের মুক্তি আনে। 

৫। আল্লাহ্-র জিকির এর অর্থ হলো, তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে অন্যসব বস্তুকে একেবারে ভুলে যাওয়া।

৬। জান্নাত ও জাহান্নামের ব্যঞ্জনা রয়েছে এ পার্থিব জীবনেই। মানুষের সুখ শান্তি হচ্ছে জান্নাতের রূপ। আর তার দুঃখকষ্টের যন্ত্রনাই হলো জাহান্নামের প্রতীক। 

৭। যিনি তাঁর সর্বস্ব আল্লাহ্-র কাছে সমর্পন করেন একমাত্র তিনিই জান্নাতের অধিকারী। আর যে প্রবৃত্তি বা নফসের হাতের ক্রীড়নক জাহান্নামই তার চিরস্থায়ী আবাসস্থল । 

৮। জ্ঞানী সে ব্যক্তি, যিনি দুটি ভালো কাজের মধ্যে বেশী ভালোটি আর দুটি মন্দ কাজের মধ্যে কম মন্দটি গ্রহণ করেন। 

৯। পাঁচ শ্রেণীর লোকের সাথে সম্পর্ক রাখবে না। তারা হচ্ছেঃ

১। মিথ্যাবাদী -এদের সাথে চলাফেরা করলে বা তার কথা বিশ্বাস করলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে।   

২। কৃপণ – নিজের সঞ্চয়ের স্বার্থে সে মানুষের ক্ষতি সাধন করবে।  

৩। দয়াহীন ব্যক্তি -বিপদের সময় সে কোন দয়া করবে না,ফলে সর্বনাশ অনিবার্য ।

৪। কাপুরূষ – প্রয়োজনের সময় সে কোন কাজে আসবে না। বিপদে ফেলে রেখে সে নিজ নিরাপত্তার খোঁজ করবে।  

৫। ফাসিক – এদের লোভ লালসা অন্তহীন। নিজের স্বার্থে কাউকে খুন করতে এরা পিছপা হয়না।

ওফাত-  দ্বিতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলীফা আবু জাফর আল মানসুর এর রাজত্বকালে ৫ই রজব, ১৪৮ হিজরী/ ৭৬৬ খৃষ্টাব্দে, ৬৫ বছর বয়সে বিষ প্রয়োগে এ মাহন সাধক প্রবরকে হত্যা করা হয়। মদীনা মুনাওয়ারায় জান্নাতুল বাকীতে পিতা ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকীর (রাদি আল্লাহু আনহু) এঁর কবরের পাশেই মহা মনীষী হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক এর (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) শেষ শয্যা রচিত হয়েছে।   

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment