৬ আয়াতবিশিষ্ট এই সুরাখানিও অবতীর্ণ হয়েছে মহাপুণ্যধাম মক্কায়।
হজরত ইবনে আব্বাস থেকে তিবরানী ও ইবনে আবী হাতেম বর্ণনা করেছেন, একবার কুরায়েশেরা রসুল স.কে আহ্বান জানালো এবং বললো, মোহাম্মদ! শোনো, আমরা তোমাকে এতো ধন-সম্পদ দিবো, যাতে করে তুমি হয়ে যেতে পারো মক্কার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদপতি। আর যে রমণীকে তুমি বিয়ে করতে চাও, তার সঙ্গেই আমরা তোমাকে দিবো পরিণয়বদ্ধ করে। বিনিময়ে আমরা শুধু চাই, তুমি আমাদের দেব-দেবীদের দুর্নাম করবে না। অথবাঃ এক বৎসর তুমি আমাদের দেব-দেবীদের উপাসনা যদি করো, তবে পরের বছর আমরা উপাসনা করবো তোমার আল্লাহ্র। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ থাকবে না। রসুল স. বললেন, দেখি! আমার পরম প্রভুপালয়িতা এ সম্পর্কে কী নির্দেশ দান করেন। ওয়াহাবের বক্তব্যানুসরণে আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কুরায়েশরা বলেছিলো, তোমার ও আমাদের মধ্যে মীমাংসা হোক এভাবেঃ এক বছর তুমি আমাদের মাবুদ গুলোর ইবাদত করো, আর এক বছর তোমার আল্লাহ্র ইবাদত করবো আমরা। এভাবেই বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে আমাদের উভয়ের ধর্মমত।
সাঈদের বর্ণনা থেকে ইবনে আবী হাতেম উল্লেখ করেছেন, একবার ওলীদ ইবনে মুগীরা, আস ইবনে ওয়াইল, আসওয়াদ ইবনে আবুল মুত্তালিব এবং উমাইয়া ইবনে খালফ রসুল স. সকাশে উপস্থিত হয়ে প্রস্তাব রাখলো, মোহাম্মদ! এসো আমরা এক সঙ্গেই সব করি। পূজা করি আমাদের দেব-দেবীদের এবং তোমার আল্লাহ্র। তাদের এমতো অপবচনের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়ঃ
সূরা কাফিরূনঃ আয়াত ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬
১. বল, ‘হে কাফিররা!
২. ‘আমি তাহার ‘ইবাদত করি না যাহার ইবাদত তোমরা কর
৩. এবং তোমরাও তাঁহার ইবাদতকারী নহ যাঁহার ইবাদত আমি করি,
৪. ‘এবং আমি ইবাদতকারী নহি তাহার, যাহার ইবাদত তোমরা করিয়া আসিতেছ।
৫. ‘এবং তোমরাও তাঁহার ইবাদতকারী নহ, যাঁহার ইবাদত আমি করি।
৬. ‘তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার।’
প্রথমে বলা হয়েছেঃ ‘ক্বুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূণ’। একথার অর্থঃ হে আমার রসুল! আপনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলুন, হে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীরা! এভাবে এখানে সম্বোধন করতে বলা হয়েছে তাদেরকে, যারা রসুল স. এর কাছে উত্থাপন করেছিলো সত্য-মিথ্যার মিশ্রণের প্রস্তাব। আল্লাহ্পাক জানতেন, তারা চিরসত্যপ্রত্যাখ্যানকারী। তাই তিনি রসুল স. কে এখানে সম্বোধন করতে বলেছেন এভাবে।
পরের আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আমি তার ইবাদত করি না, যার ইবাদত তোমরা করো’(২)। একথার অর্থঃ তোমরা ইবাদত করো অলীক দেব-দেবীদের। ওরকম অযথার্থ ইবাদত তো আমি করি না। করবোও না কোনো কালে। এখানে বক্তব্যটির শুরুতে ব্যবহার করা হয়েছে নেতিবাচক ‘লা’। এভাবে এখানে একথাটিই বুঝানো হয়েছে যে, অংশীবাদিতা ও বিশ্বাসের মিশ্রণ চিরনিষিদ্ধ। বায়যাবী লিখেছেন, শুধু ‘লা’ (না) ভবিষ্যতকালার্থক। অর্থাৎ এখন যা হচ্ছে না, তা ভবিষ্যতেও হবে না।
এরপরের আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছেঃ ‘এবং তোমরা তার ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি (৩) এবং আমি ইবাদতকারী নই তার, যার ইবাদত তোমরা করে আসছো’ (৪)। এই বক্তব্যটিও ভবিষ্যতকালজ্ঞাপক। অর্থাৎ আমি যে এক-একক-অবিভাজ্য সত্তার ইবাদত করি, তাঁর ইবাদত তোমরা যেমন এখন করো না, তেমনি করবে না ভবিষ্যতেও।
‘মান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় বিবেকসম্পন্নদের ক্ষেত্রে এবং বিবেকহীনদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘মা’। কিন্তু এখানে বিবেকবানদের ক্ষেত্রে ‘মা’ ব্যবহৃত হয়েছে কেবল শাব্দিক সামঞ্জস্য রক্ষাকল্পে। অর্থাৎ এখানে ‘মা’ আনা হয়েছে আগের আয়াতের ‘মা’ এর সঙ্গে সমতা রক্ষার্থে। এভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে কেবল পারসžরিক উপাস্যের গুণাগুণের প্রতি। বিবেকবান-বিবেকহীনের প্রসঙ্গটিকে সামনে আনা হয়নি। ‘মা’ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ধাত্যর্থে। এভাবে বক্তব্যটি দাঁড়িয়েছেঃ আমি যেমন কোনোদিন তোমাদের কাল্পনিক দেব-দেবীদের পূজা করবো না, তেমনি তোমরাও কোনোদিন আরাধনা করবে না মহাসৃষ্টির মহাপ্রভুপালয়িতার।
এরপরের আয়াতে (৫) বলা হয়েছেঃ ‘এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি’। বাক্যটি আগের বাক্যেরই পুনরাবৃত্তি। অধিকাংশ ভাষাবিদ বলেন, কোরআন যেহেতু আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে, সেহেতু এর প্রকাশভঙ্গি হবে আরবী ভাষার রীতি অনুসারেই। সম্বোধনরীতিও হবে তেমনই। আর আরবীতে বার বার একই কথা বলা হয় বক্তব্যের গুরুত্ব প্রকাশার্থে। যেমন বাক্যসংকোচনের উদ্দেশ্য থাকে বক্তব্যসংক্ষেপণ। এখানেও সেরকমই করা হয়েছে। কুরতুবী বলেছেন, এখানে একত্ববাদ ও বহুত্ববাদের বক্তব্যগত সম্মিলন ঘটার ফলে বাক্যগুলিও হয়ে পড়েছে পুনরাবৃত্তিমূলক। কেননা বক্তব্যটি এসেছে কাফের কুরায়েশদের একটি নির্দিষ্ট অপপ্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে। তারা বলেছিলো, একবছর আমরা হবো বহুত্ববাদী, আর এক বছর একত্ববাদী। কিন্তু এরকম হওয়া যে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, সে কথাটিও এখানে বার বার উচ্চারণ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরকমও বলা হয়েছে যে, প্রতিটি বাক্যের প্রথম ‘মা’ যোজক এবং পরের ‘মা’ ধাতুমূলক। অর্থাৎ উপাস্যের একিভূতী এবং ইবাদতের একিভূতীর অবাস্তবতা বুঝানোই এখানে উদ্দেশ্য।
শেষোক্ত আয়াতে (৬) বলা হয়েছেঃ ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার’। এই আয়াতের দু’টি বাক্যই বিজ্ঞপ্তিমূলক। কিন্তু এমতো ভাবনার কোনো অবকাশ নেই যে, বক্তব্যটির (তোমাদের দ্বীন তোমাদের) দ্বারা এখানে কাফেরদের কুফরীর ব্যাপারে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, অথবা মুসলমানদেরকে জেহাদ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বরং বলা যেতে পারে, এই আয়াতে প্রকাশ করা হয়েছে পূর্ববর্তী বক্তব্যের গুরুত্ব ও পরিণতিকে। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা জেহাদের আয়াতকে রহিত করা হয়েছে, এরকম ভাবা যেতেই পারে না। কুফরী যেহেতু কল্যাণকর নয়, সেহেতু এরকম চিন্তাও অসমীচীন যে, সমঝোতার মাধ্যমে এখানে ইমানদার ও কাফেরদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে স্ব স্ব অবস্থানে থাকতে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, এর পরেও রসুল স. বার বার কাফের কুরায়েশদেরকে ইমান ও ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা তাঁকে এবং তাঁর প্রিয় সহচরবর্গকে দিয়েছে নানা প্রকারের যাতনা। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের মর্মার্থ এরকম হওয়াই সমীচীন যেঃ তোমরা প্রতিফল লাভ করবে তোমাদের কৃতকর্মের এবং আমি লাভ করবো আমার কৃতকর্মের প্রতিফল।
ইতোপূর্বে সুরা যিলযালের তাফসীরের একস্থানে হজরত আনাস ও হজরত ইবনে আব্বাসের এক হাদিসে বলা হয়েছে, রসুল স. বলেছেন, পুণ্যের দিক দিয়ে সুরা কাফিরূন সমগ্র কোরআনের এক চতুর্থাংশের সমান। জননী আয়েশা বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, কতোই না উত্তম হতো, যদি ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজে পাঠ করা হতো সুরা কাফিরূন এবং সুরা ইখলাস। ইবনে হিশাম। ওরওয়া ইবনে নওফেল ইবনে হজরত মুয়াবিয়া বর্ণনা করেছেন, আমার পিতা একবার রসুল স.কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহ্র বার্তাবাহক! আমাকে এমন একটি সুরা শিক্ষা দিন, যা আমি পাঠ করতে পারি রাতে শয্যাগ্রহণকালে। তিনি স. বলেছিলেন, সুরা কাফিরূন পাঠ করো। কেননা এতে রয়েছে অংশীবাদিতার প্রতি তীব্র অনীহা।
হজরত যোবায়ের বর্ণনা করেছেন, রসুল স. একবার আমাকে বললেন, তুমি কি চাও, প্রবাসকালে তোমার বাসস্থান হোক সর্বোন্নত এবং পাথেয় হোক সর্বাধিক? আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি স. বললেন, সর্বদা পাঠ কোরো সুরা কাফিরূন, ইখলাস, নাসর, ফালাক্ব ও নাসঃ এই পাঁচটি সুরা। আর প্রতিটি সুরা আবৃত্তির শুরু থেকে শেষে পাঠ কোরো বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। হজরত যোবায়ের বলেছেন, আমি ছিলাম বিত্তশালী। কিন্তু প্রবাসে আমি হয়ে যেতাম দুর্দশাকবলিত। পাথেয় হয়ে যেতো নিঃশেষ। কিন্তু যখন থেকে প্রবাসকালে আমি এই পাঁচটি সুরা পাঠ করতে শুরু করলাম, তখন থেকে দুর্দশা আমার নাগাল পেতো না। পাথেয় থাকতো প্রচুর। গৃহে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত আমি প্রাচুর্যের মধ্যেই থাকতাম।
হজরত আলী বলেছেন, একবার রসুল স.কে দংশন করলো একটি বৃশ্চিক। তিনি স. সঙ্গে সঙ্গে লবণ ও পানি আনতে বললেন। আর ক্ষতস্থানে লবণ পানি প্রবাহিত করে দিতে দিতে দম করতে লাগলেন সুরা কাফিরূন, সুরা ফালাক, সুরা নাস পড়ে পড়ে। আল্লাহই সমধিক অবগত।