- নাহমাদুহু নুসাল্লি ওয়া নুসাল্লি আ’লা সিরাজুম মুনিরা ওয়ার রায়ুফুর রাহিম।।আম্মা বা’দঃ-
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন নাযিল করেছেন মানুষের জন্য উপদেশ ও জীবন বিধান হিসাবে। এ লক্ষ্যেই তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার প্রতি : ‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’(মুহাম্মাদ : ২৪) কুরআন নিয়ে যতই চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা হবে অন্তরে কুরআনের আবেদন ও কুরআনের প্রতি ভক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষের স্বভাব চরিত্রে, আচার-আচরণে এর প্রভাব পড়বে। তাই তো আমরা দেখি উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন: ‘তাঁর চরিত্র ছিল আল কুরআন।’ (মুসলিম)
কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনকে নিজের জীবনের পাথেয় হিসেবে নিয়েছিলেন। এতে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেছেন এবং নিজ জীবনে তা পূর্ণাঙ্গরূপেবাস্তবায়ন করেছেন। আমরা আজ কুরআন পাঠ করি কিন্তু তা আমাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। আমাদের জীবনাচারে পরিবর্তন সূচিত করে না। কারণ আমরা কুরআনের মর্ম নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা করি না। আলী রা. বলেছেন, ‘যে কুরআন পাঠে চিন্তা-ভাবনা নেই, সে পাঠে কোনো কল্যাণ নেই।’ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, ‘আজ তোমরা সূরা ফাতেহা থেকে নিয়ে শেষ পর্যস্ত এমনভাবে কুরআন খতম করো যে, একটি হরফও বাদ পড়ে না। কিন্তু বাস্তব কথা হল, সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন বাদ পড়ে যায়।’ আমরা সূরা আল আসর পাঠ করি। তা মুখস্থও করেছি । জীবনে কতবার যে পাঠ করেছি তার হিসেব তো নিজের কাছেও নেই; কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি ছোট এই সূরাটির মধ্যে আল্লাহ তাআলা কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখেছেন। কত চমৎকার হেদায়েত রেখেছেন ক্ষুদে এ সূরাটির মধ্যে। ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির স্পষ্ট সনদ রেখেছেন তিনি মাত্র তিন আয়াত বিশিষ্ট এ সূরার মধ্যে। সাহাবায়ে কেরামের অনেকের সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা যখন একজন অপর জনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতেন তখন সূরা আল আসর পাঠ করে শুনাতেন। (তাবরানি, হায়সামি ফি মাজমাআয যাওয়ায়েদ)
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যদি কুরআনে অন্য কোনো সূরা নাযিল না করে শুধু সূরা আল আসর নাযিল করতেন তাহলে এটা মানুষের হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট হত।'(মিফতাহুস সাআদাহ : ইমাম শাফেয়ি) যদি কেউ এ সূরায় গভীরভাবে দৃষ্টি দেয় তাহলে সে তাতে একটি উন্নত, সুন্দর, শান্তিময়, পরিপূর্ণ এবং সবার জন্য কল্যাণকর সমাজের চিত্র দেখতে পাবে। (আদওয়াউল বায়ান : ৯/৫০৭) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ সূরাটি শুরু করেছেন ‘ওয়াল আসর’ শব্দ দিয়ে। ইরশাদ হয়েছে- ‘আসরের শপথ।’ (১)
‘আসর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে?
‘আসর’ শব্দের দুটো অর্থ : এক. যুগ বা সময়। দুই. আসরের নামাজের সময়, যার আগমন হয় জোহরের নামাজের সময় শেষ হওয়ার পর এবং শেষ হয় সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ তাআলা কোনটির শপথ করেছেন? সময়ের শপথ না আসরের ওয়াক্তের শপথ? সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল তিনি ‘আসর’ বলতে এখানে সমস্ত সময়ের শপথ করেছেন। করেছেন যুগের শপথ। আর যুগের গর্ভেই এক জাতির উত্থান ঘটে, অন্য জাতির ঘটে পতন। রাত্রি আসে। যায় দিন। পরিবর্তিত হয় পরিবেশ ও মানব সমাজ। এমন সব পরিবর্তন আসে যা মানুষ কল্পনা করতে পারে না। কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত কখনো বা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পরিবর্তন আসে এ সময়ের ব্যবধানেই। তাই এ যুগ বা সময় বড় বিস্ময়কর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানব, দানব, জীব-জন্তুসহ তাবৎ সৃষ্টিকুলের জন্য। এটা বুঝানোর জন্যই আল্লাহ তাআলা সময়ের শপথ করেছেন। (আত তিবইয়ান ফি আকসামিল বায়ান : ইবনুল কায়্যিম আল জাওযি)
কোনো বস্তু বা বিষয়ের শপথ করলে তার অস্বাভাবিক গুরুত্ব বুঝায়। সময় এমনই এক বিস্ময়ের আধার যে, আমরা জানি না অতীতকালে এটা কি কারণে হয়েছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে। এমনকি আমাদের নিজেদের জীবন, নিজের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা বলতে পারি না যে আগামী কালকের পরিবশেটা ঠিক আজকের মত থাকবে কি থাকবে না। দেখা যায় মানুষ নিজ সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। আগামীকাল এটা সে বাস্তবায়ন করবে। অর্জন করবে এটা সেটা অনেক কিছু। সে দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে। সব উপকরণ থাকে হাতের নাগালে। সব মাধ্যম ও ফলাফল থাকে আপন নখদর্পনে। কোনো কিছুরই অভাব নেই। তবুও এ ‘সময়’ নামক বস্তুটির ব্যবধানে এমন কিছু ঘটে যায় যা তার সব কিছুকে তছনছ করে দেয়। সে ভাবতেই পারে না- কেন এমন হল। অনেক বড় বড় হিসাব সে মিলিয়েছে কিন্তু এর হিসাব সে মেলাতে পারছে না। এটাই হল ‘সময়’। আল্লাহ তাআলা এর প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই বলেছেন, ‘ওয়াল আসর’ – শপথ সময়ের।
এ থেকে আমরা জীবনের জন্য সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ হলেন মহান। তিনি মহান বস্তু ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর শপথ করেন না। তাফসিরবিদ ইকরামাসহ অনেকে বলেছেন, ‘আসর’ বলতে এখানে আসরের নামাজের সময়ের শপথ করা হয়েছে। কেননা আসর নামাজের সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ ইবনে জারির আত তাবারী রহ. বলেছেন, ‘সঠিক কথা হল এখানে ‘আসর’ বলতে আল্লাহ তাআলা ‘সময়’ কে বুঝিয়েছেন। যুগের অপর নাম সময়। সকাল, বিকাল, দুপুর, রাত, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী, সহস্রাব্দ ইত্যাদি সব কিছুই বুঝায় এ ‘আসর’ বা ‘সময়’ নামক শব্দ। (জামেউল বায়ান : ১৫/২৮৯) যদি এ সূরাটির প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে যে, সময়টাকে সকল যুগে টেনে নেয়া হয়েছে। মানুষকে সময়ের মধ্যে আবদ্ধ করা হয়েছে। সময় ছাড়া মানুষের জীবন যেমন সচল নয়, তেমনি সময় ব্যতীত তাদের কোনো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতও নেই।
দ্বিতীয় আয়াত : ‘অবশ্যই মানুষ ক্ষতিতে নিপতিত।’
যদিও এখানে ইনসান বা মানুষ শব্দটি এক বচনে ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু তার পূর্বে জাতিবাচক আলিফ লাম ব্যবহার করে পুরো মানব জাতিকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পুরো মানবগোষ্ঠি ক্ষতিগ্রস্ত। তারা সকলে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে যাদের মধ্যে চারটি গুণ আছে তারা ব্যতীত। এ চারটি গুণের অধিকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত নয়। তারা লাভবান সর্বদা। লাভবান ইহকাল ও পরকালে। পরবর্তী আয়াতে এ চারটি গুণের কথাই বর্ণিত হয়েছে।
তৃতীয় আয়াত : ‘তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’
চারটি গুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এক. ঈমান
দুই. সৎকাজ বা আমালে সালেহ
তিন. অন্যকে সত্যের পথে আহবান
চার. অন্যকে ধৈর্যের উপদেশ দান
একজন মুসলিম শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে না। নিজের সুখে সন্তুষ্ট থাকে না। যেমন সে নিজের দুঃখেই শুধু ব্যথিত হয় না। অন্যের কথা চিন্তা করতে হয় তাকে। অন্যের কল্যাণে কাজ করতে হয়। অন্যের দুখে দুখী ও অন্যের সুখে সুখী হওয়া তার কর্তব্য। এজন্য এ চারটি গুণের প্রথম দুটো গুণ নিজের কল্যাণের জন্য আর পরের গুণ দুটো হল অন্যের কল্যাণের জন্য। প্রথম গুণ দুটো দ্বারা একজন মুসলিম নিজেকে পরিপূর্ণ করে, আর অপর দুইগুণ দ্বারা অন্যকে পরিপূর্ণ করার প্রয়াস পায়। প্রথম গুণটি হল ঈমান। এটা একটা ব্যাপকভিত্তিক আদর্শের নাম। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ মুজাহিদ রহ. বলেছেন, ঈমান হল, আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা, তাঁর একত্ববাদকে সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ করা। তাঁর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে সবগুলোকে মেনে নেয়া এবং সর্বক্ষেত্রেই তার কাছে জওয়াব দিতে হবে এ আদর্শ ধারণ করা। (তাফসিরে তাবারি)
ঈমানের পর নেক আমল বা সৎকর্মের স্থান। সৎকর্ম কম বেশি সকল মানুষই করে। তবে ঈমান নামক আদর্শ তারা সকলে বহন করে না। ফলে তাদের আমল বা কর্মগুলো দিয়ে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। সৎকর্মশীল মানুষগুলো যদি ঈমান নামের আদর্শকে গ্রহণ করে তাহলে এ সৎকর্ম দ্বারা তারা দুনিয়াতে যেমন লাভবান হবে আখেরাতেও তারা অনন্তকাল ধরে এ লাভ ভোগ করবে। আর যদি সৎকর্মের সঙ্গে ঈমান নামের আদর্শ না থাকে, তাহলে সৎকর্ম দিয়ে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে কিছুটা লাভবান হলেও আখেরাতের স্থায়ী জীবনে এটা তাদের কোনো কল্যাণে আসবে না। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমে ঈমানের কথা বলেছেন। সৎকর্ম হল, যা কিছু ইসলাম করতে বলেছে সেগুলো পালন করা আর যা কিছু নিষেধ করেছে সেগুলো থেকে বিরত থাকা। হতে পারে তা ফরজ, ওয়াজেব, সুন্নাত, মুস্তাহাব বা নফল। আর বর্জনীয় বিষয়গুলো বর্জন করে চলা। হতে পারে তা হারাম, মাকরূহ।
যখন মানুষ ঈমান স্থাপন করল, তারপর সৎকর্ম করল, তখন সে নিজেকে পরিপূর্ণ করে নিল। নিজেকে লাভ, সফলতা ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করল। কিন্তু ঈমানদার হিসাবে তার দায়িত্ব কি শেষ হয়ে গেল? সে কি অন্য মানুষ সম্পর্কে বে-খবর থাকবে? কিভাবে সে এত স্বার্থপর হবে? অন্য সকলকে কি সে তার যাপিত কল্যাণকর, সফল জীবনের প্রতি আহবান করবে না? কেনই বা করবে না? সে তো মুসলিম। তাদের আভির্ভাব ঘটানো হয়েছে তো বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্য। আর এ জন্যই তো মুসলিমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। আল্লাহ তাআলা তো বলেই দিয়েছেন: ‘তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (আলে ইমরান : ১১০) অতএব নিজেকে ঠিক করার পর তার দায়িত্ব হবে অন্যকে কল্যাণের পথে আহবান করা। তাই ঈমান ও সৎকর্ম নামক গুণ দুটো উল্লেখ করার পর আল্লাহ তাআলা আরো দুটো গুণের কথা বললেন : ‘আর তারা পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ সত্যের দিকে মানুষকে আহবান করা, এ আহবান করতে গিয়ে ও আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে যে সকল বিপদ-মুসিবত, অত্যাচার-নির্যাতন আসবে তাতে ধৈর্য ধারনের জন্য একে অন্যকে উপদেশ দেয়া কর্তব্য। প্রশ্ন হতে পারে সত্যের মধ্যেই তো ধৈর্য আছে। ধৈর্য তো হক বা সত্যের একটি। তাহলে এটা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলে কি হত না? কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বুঝাতে সাধারণভাবে তা উল্লেখ করা হলেও আবার বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। পরিভাষায় এটাকে বলা হয় : ذكر الخاص بعد العام কোনো বিষয় অর্জন করা সহজ হতে পারে কিন্তু সেটি ধরে রাখা ও তার ওপর অটল থাকা ততটা সহজ নাও হতে পারে। আর এ জন্যই প্রয়োজন ধৈর্য ও সবরের।
সূরা থেকে অর্জিত শিক্ষা ওমাসায়েলসমূহ :
১- এ সূরার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, চারটি বিষয় অর্জন করা আমাদের জন্য জরুরি :
এক. ইলম বা জ্ঞান অর্জন। ইলম ব্যতীত ঈমান স্থাপন সম্ভব নয়। ঈমানের জন্য কমপক্ষে তিনটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। (ক) আল্লাহ তাআলাকে জানতে হবে। (খ) তাঁর রাসূলকে জানতে হবে। (গ) তাঁর প্রেরিত দীন-ধর্মকে জানতে হবে। এগুলো জানার পরই তার ওপর ঈমান আনা সম্ভব। ইরশাদ হয়েছে: ‘অতএব জেনে নাও যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য।’ (মুহাম্মাদ : ১৯) আমরা দেখলাম, এ আয়াতে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর প্রতি ঈমান আনার পূর্বে জানতে বলেছেন অর্থাৎ ইলম অর্জন করতে বলেছেন। তারপর ইস্তেগফার তথা আমল করতে বলেছেন।
দুই. ইলম অনুযায়ী কাজ করা। তিনটি বিষয় -আল্লাহ, রাসূল ও দীন সম্পর্কে ইলম অর্জন করে আল্লাহর প্রতি ঈমান স্থাপন করার পর সেই ইলম বা জ্ঞান অনুযায়ী আমল করতে হবে।
তিন. অন্যকে এই ইলম ও আমলের দিকে আহবান করতে হবে বা দীনে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে।
চার. ধৈর্য ধারন করা। ইলম, ঈমান, আমল ও দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সকল বিপদ-মুসীবত, দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তাতে ধৈর্য ধারণ করতে হবে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এছাড়া সকল প্রকার বিপদ মুসিবতে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
২- আল্লাহ তাআলা ‘আল আসর’ তথা সময়, হায়াত, যুগের শপথ করেছেন। এ শপথের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সময় ও জীবনের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। মানুষের আয়ু কত মূল্যবান তা অনুধাবন করতে বলেছেন। তেমনি ‘আল আসর’ এর কসম করে যা বলেছেন সেটারও গুরুত্ব বুঝিয়েছেন তিনি। আর তা হল; মানুষ ক্ষতিতে নিপতিত। মানুষ ধ্বংসের দিকে ধাবিত। তাই ক্ষতির পথ ছেড়ে তাকে লাভ ও কল্যাণের পথে আসতে হবে। যারা ক্ষতিগস্ত হচ্ছে তারা কিন্তু সময়টাকে বর্ণিত কাজগুলোতে লাগাচ্ছে না বলেই তারা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
৩- আল্লাহ তাআলা যুগের শপথ করেছেন। যুগে যুগে যা কিছু ঘটেছে সেগুলো ইতিহাস। তাতে রয়েছে মানুষের জন্য শিক্ষা ও নসিহত। যুগে যুগে অত্যাচারী শক্তিধর জাতির পতন ঘটেছে। নির্যাতিত দুর্বল জাতির উত্থান হয়েছে। এসবই মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর সর্বময় ক্ষমতার প্রমাণ।
৪- মানুষ দুনিয়াতে আয়ু পার করে বার্ধক্যে উপনীত হয় বটে কিন্তু সে লাভবান হয় না। তবে যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, মানুষকে সত্যের পথে আহবান করেছে, ধৈর্য ধারণ করেছে তারা এর ব্যতিক্রম। তারা বৃদ্ধ অক্ষম হয়ে গেলেও তাদের নামে সৎকর্ম যোগ হতে থাকে। যেমন আবু মুসা আশাআরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একাধিকবার বলতেশুনেছি-‘কোন মানুষ যখন সৎকর্ম করতে থাকে, পরে তাকে রোগ-ব্যধি পেয়ে বসে অথবা সফর অবস্থায় থাকে, তখন তার কর্ম বিবরণীতে সে আমলগুলো লেখা হতে থাকে, যেগুলো সে সুস্থ ও গৃহে থাকাবস্থায় করে আসছিল।’ (বুখারি, জিহাদ অধ্যায়)
৫- মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকভাবে হতে পারে : প্রথম.কুফরি করার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: ‘আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহি পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শির্ক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।‘ (যুমার : ৬৫)
দ্বিতীয়. মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম কম হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজদের ক্ষতি করল।‘ (মুমিনূন : ১০৩)
তৃতীয়. সত্য তথা ইসলাম গ্রহণ না করে অন্য আদর্শ গ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : ‘আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আলে ইমরান : ৮৫)
চতুর্থ. ধৈর্য ধারণ না করে হতাশ হয়ে পড়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :‘মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছে, যারা দ্বিধার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোনো বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ (হজ : ১১)
৬- ঈমানের আভিধানিক অর্থ, সত্যায়ন করা, স্বীকার করা, মেনে নেয়া। পারিভাষিক অর্থ, হাদিসে জিবরিলে বর্ণিত ঈমানের যে ছয়টি ভিত্তি আছে তার সবগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। একটু বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ঈমান হল : অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা, মুখ দিয়ে স্বীকার করা আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা।তাই শুধু বিশ্বাস দিয়ে কাজ হবে না, যদি না সে বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা হয়।
৭- আমর বিল মারুফ ওয়ান নাহি আনিল মুনকার অর্থাৎ অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার গুরুত্ব অনুধাবন করা যেতে পারে। সত্যের পথে মানুষকে আসার উপদেশ দেয়া মানে সৎকাজের আদেশ করা। এর জন্য প্রয়োজন হবে ধৈর্যের। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লুকমান হাকিমের উপদেশ উল্লেখ করেছেন। সেখানেও এ বিষয়টি দেখা যায়। লুকমান তার ছেলেকে বলেছিলেন :’হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।‘ (লুকমান : ১৭)
৮- আমালে সালেহ বা সৎকর্মের মধ্যে হুকুকুল্লাহ (আল্লাহর অধিকার) ও হুকুকুল ইবাদ (মানুষের অধিকার) দুটোই অন্তর্ভুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির গুরুত্ব দেয়ায় কাজ হবে না। তাওহিদে বিশ্বাস, ঈমানে কামেল, ইবাদত-বন্দেগি, ফরজ-ওয়াজিব ও সুন্নাত-মুস্তাহাব আমলগুলো যেমন সৎকর্ম তেমনি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী-সহযাত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ, তাদের অধিকার সংরক্ষণ করাও সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। দেখুন কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের অধিকার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের কথাও বলেছেন : ‘তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, ইয়াতিম, মিসকিন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শবর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (নিসা : ৩৬)
৯- সবর বা ধৈর্য তিন প্রকার :
(ক) আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ করা। তাঁর আদেশ নির্দেশগুলো মানতে গিয়ে অধৈর্য না হওয়া। এটাকে বলা হয় : الصبر على طاعة الله
(খ) আল্লাহর অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলোর ধারে কাছে না গিয়ে ধৈর্য অবলম্বন করা। এটাকে বলা হয় : الصبر عن معصية الله
(গ) উপস্থিত বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করা। এটাকে বলা হয় : الصبر على أقدار الله
১০- সূরা আল বালাদেও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়ার নির্দেশ এসেছে, সেখানে এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যেমন : ‘অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের। তারাই সৌভাগ্যবান।’ (৯০ঃ১৭ ) এ আয়াতে মুমিনদের গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, তারা ধৈর্য ধারণ আর পরস্পরকে দয়া-অনুগ্রহ করার উপদেশ দেয়। তারা ডানদিকের দল। তাই একজন মুমিন যেমন নিজে ধৈর্য ধারণ করে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়, তেমনি সে নিজে দয়া অনুগ্রহ করে ও অন্যকে দয়া অনুগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
আল্লাহ আমাদেরকে সূরা আল আসরের শিক্ষাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য তাউফিক দান করুন।