সুন্দর এক যুবক। মাথায় কোঁকড়ানো একরাশ চুল। প্রশস্ত ললাট। দীপ্তিময় চেহারা। সমস্ত মুখে ছড়িয়ে আছে অপূর্ব এক প্রতিভা। যেন শিশির স্নিগ্ধ একটা ফুল ।
যুবকের নাম ইউসুফ ইবনে হুসাইন। কালের পরিক্রমায় তিনি হয়েছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় কামেল বুযুর্গ। ইবাদত, মুজাহাদা ও মারেফাতের সাধনায় তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ সাধকদের অন্যতম। বহু অলী আল্লাহর তুলনায় তিনি লাভ করেছিলেন দীর্ঘ জীবন। ফলে অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশী ইবাদত করার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। জন্মস্থান ‘রা’ প্রদেশে হওয়ায় সকলেই তাকে ইউসুফ ইবনে রায়ী (র.) বলে ডাকতো।
ইউসুফ রায়ী (র.) তখন বয়সে তরুণ। একদিন তিনি কোন এক কাফেলার সহযাত্রী হয়ে সফর শুরু করলেন। কাফেলার সাথে দীর্ঘদিন চলার পর এক সময় তিনি আরবের এক গোত্রের বাসভূমিতে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানকার পরিবেশ অত্যন্ত মনঃপুত হওয়ায় সঙ্গীদের সাথে সেখানেই তিনি বসবাস করতে লাগলেন ।
এদিকে আরব গোত্রপতির ছিল এক সুন্দরী কন্যা। তার মনোমুগ্ধকর রূপলাবণ্য বাস্তবিকই ছিলো অতুলনীয়। এ রূপের যেন শেষ ছিল না। এমনি মনোহারিণী রূপ কেউ দেখেনি কোন দিন। সত্যি এমন নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে বিরল।
আরব কন্যা অত্যধিক সুন্দরী হওয়ার কারণে তার রূপের খ্যাতি অল্প দিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল দিক দিগন্তে। সকলেই ভূয়সী প্রশংসা করতো ভার কমনীয় মোহনীয় রূপ লাবণ্যের। ফলে আরব ভূখন্ডে এমন সম্ভ্রান্ত ধনীর দুলাল খুব কমই ছিল যারা তাকে একান্ত করে কাছে পেতে অতি উৎসাহী ছিল না।
ঘটনাক্রমে একদিন আরবের এ অনিন্দ্য সুন্দরী নারী প্রবাসী যুবক ইউসুফ রায়ী (র.) কে দেখে ফেলে। ফলে প্রথম দৃষ্টিতেই তার হৃদয়ে বেজে উঠে নতুন প্রেমের মধুর সুর। যুবকের রূপ সৌন্দর্য আরবকন্যাকে পাগল করে তোলে। সে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে প্রবলভাবে। শয়নে স্বপনে সে কেবল তারই ধ্যান করে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে হৃদয়ে অংকুরিত প্রেম ভালবাসার চারা গাছটিও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। সে কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। অবশেষে একদিন গভীর রাতে সুযোগ পেয়ে সে নিজেই উপস্থিত হয় ইউসুফ ইবনে হুসাইন রায়ী (রা.) এর নিকট। অতঃপর ধীরে ধীরে ব্যক্ত করে হৃদয়ে পুঞ্জীভূত সমস্ত প্রেম-ভালবাসা আর মহব্বতের কথা। নিজেকে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয় তাঁরই চরণ তলে ।
কিন্তু কি আশ্চর্য। যে নারীর জন্য সকলেই পাগলপারা, যে নারীর ভুবন মোহিনী রূপ-সৌন্দর্যের কথা আলোচিত হয় প্রতিটি যুবকের মুখে, যে নারীকে দেখলে মনে হয় আসমান থেকে নেমে আসা বেহেশতের হুর, সেই নারীর দিকে
একবার চোখ তুলেও তাকালেন না পূর্ণ যৌবনের অধিকারী হযরত ইউসুফ ইবনে হুসাইন রায়ী (র.)।
গভীর রাত। নির্জন প্রহর। দু’জন মাত্র লোক। একজন মানব আরেকজন মানবী। একজন নর আরেকজন নারী। একজন যুবক আরেকজন যুবতী। বিভিন্ন অলংকারে সজ্জিত হয়ে যুবতী নিজেকে বড় আকর্ষণীয় করে পেশ করছে যুবকের নিকট। মনের কথাটি নিবেদন করছে বড় চমৎকার ভঙ্গিমায়। বলছে, হে প্রবাসী যুবক! তুমি আমার দিকে একটি বার চোখ তুলে তাকাও। দেখ, কত রূপ- সৌন্দর্যের অধিকারিনী আমি। আমাকে পাওয়ার জন্য কত রাজা বাদশাহের ছেলেরা উদগ্রীব। সব কিছুর বিনিময়ে হলেও তারা আমাকে কাছে পেতে চায়। কিন্তু আমি সবাইকে উপেক্ষা করে আজকের এই গভীর রাতে তোমার দরবারেউপস্থিত হয়েছি। নিবেদন করছি আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় দীর্ঘদিন যাবত লালিত সমস্ত প্রেম ভালবাসা। আর তুমি কিনা আমার দিকে একটি বারের জন্যেও চোখ তুলেও তাকাচ্ছ না! হে যুবক! আমার মনে হয় তুমি আমাকে চিনতে পারনি।
হযরত ইউসুফ (র.) মেয়েটির কথা শুনলেন। তার মস্তক নিম্নমুখী। মেয়েটির কথা শেষ হলে তিনি বললেন, আমি তোমাকে ভাল করেই চিনেছি। তুমি এই এলাকার গোত্রপতির সুন্দরী কন্যা তা আমার অজানা নেই। তোমার রূপের প্রশংসা আরবের সর্বত্র হয়ে থাকে তাও আমি জানি। কিন্তুএতটুকু বলে ইউসুফ (র.) থেমে গেলেন। কি যেন বলতে গিয়েও বলতে ,।পারলেন না। মেয়েটি বলল, কিন্তু কি? একটু বুঝিয়ে না বললে আমি বুঝব কি করে?
ইউসুফ (র.) বললেন, হে যুবতী! তুমি হয়তো জান না, জানার কথাও নয়। তুমি আমার কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে আল্লাহর ভয়ে আমার হৃদয়ে যে কম্পন শুরু হয়েছে তা এখনো থামেনি। তুমি যতক্ষণ এখানে থাকবে ততক্ষণ তা থামবে বলেও মনে হয় না। হে যুবতী। আমি জানি, আমার অজান্তেই তুমি আমাকে ভালবেসে ফেলেছ। স্থান দিয়েছো হৃদয়ের অতি গভীরে। কিন্তু আমি যে আল্লাহকে ভয় করি। এখন আমি তোমার খাহেশ পূর্ণ করলে দুনিয়ার কেউ হয়তো জানবে না, কিন্তু সেই আল্লাহর দৃষ্টি থেকে আমি কিভাবে বাঁচব, যিনি সমুদ্রের গভীর তলদেশে এক খন্ড প্রস্তর খন্ডের ভিতরে ছোট্ট পিপীলিকা সম্পর্কেও সম্যক অবহিত। উহাকে তিনি যেমন দেখেন তেমনি তার চলার আওয়াজও তিনি শুনেন। সুতরাং যদি আমরা পরস্পর এখন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ি তাহলে তাঁর কাছে আমরা কি জবাব দেব? যদি তিনি হাশরের ময়দানে লক্ষ-কোটি মানুষের সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেন, হে ইউসুফ! তোমাকে তো আমি অপরূপ সৌন্দর্য আর ভরা যৌবন এজন্য দান করি নি যে, তুমি উহাকে অসৎ পথে ব্যবহার করবে! ব্যয় করবে অবৈধ উপায়ে । তাহলে
আমি কি উত্তর দেব? কিভাবে আমি রাব্বুল আলামীনের সামনে মুখ দেখাব এতটুকু বলে হযরত ইউসুফ (র.) থামলেন। এরপর আরব কন্যা নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করল। কিন্তু যখন তার একীন হলো- কোন অবস্থাতেই এই যুবককে রাযী করানো সম্ভব হবে না তখন সে নিরাশ হয়ে চলে গেল।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর ইউসুফ (র.) স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কায়মনোবাক্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে মহান আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। মোটকথা, বেগম ফুলাইখার আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করে হযরত ইউসুফ (আ.) যেমন দরজার দিকে দৌড়ে গিয়েছিলেন, তেমনি তিনিও অনিন্দ্য সুন্দরী আরব কন্যার প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তিনিও উক্ত এলাকা ছেড়ে সাথে সাথে অন্য এক অচেনা এলাকায় চলে গেলেন ।
রাত এখনো শেষ হয় নি। রাতে একদন্ড ঘুমুতে না পারায় এবং দীর্ঘ পথ সফর করে আসায় স্বাভাবিক কারণেই যুবক ইউসুফ (র.) এর দেহে একটু ক্লান্তিভাব এসে পড়েছিল। ফলে শত চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। অল্পক্ষণের মধ্যেই হাঁটুর উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঐ সময় তিনি স্বপ্নে দেখলেন, মনোরম স্থানে তিনি উপস্থিত। অসাধারণ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এমন সুন্দর ও হৃদয় জুড়ানো দৃশ্য জীবনেও তিনি দেখেন নি। তিনি আরও দেখলেন, একদল লোক সবুজ রংয়ের পোষাক পরিহিত। তাদের মাঝে একজন অভিসুন্দর সুপুরুষ একটি কারুকার্যখচিত আসনে উপবিষ্ট।
এই সুন্দর দৃশ্যটি যুবক ইউসুফ (র.) এর মন কেড়ে নিল। তিনি কিছুক্ষণ অপলক নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর পরম বিস্ময়ের সাথে ঐসব লোক ও অতিসুন্দর পুরুষটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন।
জবাবে একজন বললেন, ভাই! যাদেরকে সবুজ কাপড় পরিহিত দেখছেন, তাদের সবাই ফিরিশতা। আর যিনি সুন্দর আসনে নযর কাড়া রূপ নিয়ে বসে আছেন, তিনি হলেন, আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ (আ.)
ইউসুফ রায়ী (র.) জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের আগমনের উদ্দেশ্য কি?
জবাবে লোকটি জানালো, আমরা এখানে হযরত ইউসুফ রায়ী (র.) এরসাথে মোলাকাত করতে এসেছি।
হযরত ইউসুফ রায়ী (র.) বলেন, মানুষরূপী ফিরিশতার কথা শুনে আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে কেঁদে ফেললাম এবং মনে মনে ভাবলাম, আহা! আমি কত অধম ও নগণ্য ব্যক্তি। দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে কত ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে আমার। অথচ আমারই সাথে কিনা ইউসুফ (আ.) এর ন্যায় মহান নবী সাক্ষাত করতে এসেছেন।
আমি এসব কথা চিন্তা করে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম। চরম বিশ্বয় নিয়ে বিচরণ করতে লাগলাম কল্পনার সুবিশাল রাজ্যে। এরই মধ্যে হঠাৎ দেখলাম স্বয়ং হযরত ইউসুফ (আ.) আপন আসন থেকে উঠে এসে আমার সাথে আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর তার পার্শ্বে স্থাপিত আসনটিতে হাত ধরে আমাকে বসিয়ে দিলেন। তাঁর এসব আচরণ দেখে আমার বিস্ময়ের মাত্রা আরও বহুগুণে বেড়ে গেল। আমি তাঁকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, হযরত! আপনার মতো মহান পুরুষ আমার মতো সাধারণ ও অধম ব্যক্তিকে কেন এত বেশী সম্মান প্রদর্শন করছেন তা কিছুতেই আমার বুঝে আসছে না।
হযরত ইউসুফ (আ.) বললেন, আপনার এই বিরল সম্মান লাভের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। আর তা হলো, আরবের সেই রূপসী আমীর কন্যা যখন রাতের নির্জন আঁধারে আপনার দ্বারা অবৈধ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল আর আপনি তখন আল্লাহর ভয়ে তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে নিজেকে পাপ • থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে গিয়েছেন। স্বয়ং আল্লাহ পাক এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে সমস্ত ফিরিশতা ও আমাকে ডেকে বললেন, হে ইউসুফ! ফুলাইখা যেমন নির্জন কক্ষে আপনাকে পাপ কর্মে আহবান করায় আপনি আমার ভয়ে ছুটে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন, তেমনি আপনার নামের আরেক ইউসুফ আরবের এক সুন্দরী কন্যার প্রেম নিবেদন উপেক্ষা করে নিজেকে পাপ থেকে বিরত রেখেছে। তার এই কর্মে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। সুতরাং আপনি একদল ফিরিশতাসহ তাকে এই সুসংবাদ জানিয়ে আসুন যে, আল্লাহ তাআলা আজকের আচরণে সীমাহীন খুশি হয়ে আপনাকে তার খাছ অলীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। আল্লাহ পাকের এই নির্দেশ পালনের জন্যেই আমি আপনার নিকট এসেছি।