আবহমান কাল থেকে নেককার মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত রীতি হলো তারা ‘রামাদ্বানুল মুবারক’ মাসে শবীনা করে থাকে। কখনো দু’রাতে, কখনো তিন রাতে তারাবীহ নামাযে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করে। কোন কোন বুযুর্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা রামাদ্বান ছাড়াও প্রতিদিন একবার কুরআন শরীফ পূর্ন তিলাওয়াত করেন। এ সব কিছু বৈধ এবং ছাওয়াব। তবে শর্ত হচ্ছে এমন দ্রুত তিলাওয়াত করবে না যাতে কুরআনে কারীমের হুরূফ তথা বর্ণগুলো যথাযথভাবে তিলাওয়াত না হয়। আলস্য নিয়েও তিলাওয়াত করবে না।
অথচ গায়রে মুকাল্লিদ ওহাবীরা এটাকেও হারাম বলে। সারারাত সিনেমা দর্শকদেরকে মন্দ বলে না, কিন্তু রাতভর কুরআন তিলাওয়াতকারীদেরকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে থাকে। তাদের উপর শিরক বিদআতের ফাতওয়া লাগায়। তাই শবীনা পড়ার প্রমাণসহ নিচে আলোচনা করা হল।
শবীনার প্রমান
এক রাতে কুরআনে করীম খতম করা ছাওয়াব এর কাজ। এর প্রমান স্বরূপ কুরআন, হাদীস, যুক্তি এমন কি ওহাবীদের কিতাবাদির দলীলাদি লক্ষ্য করুন।
(১) কুরআনে করীম স্বীয় মাহবূবকে সম্বোধন করে বলেছে-
يَا اَيُّهَا الْمُزَمِّلُ-قمِ الْلَّيْلَ اِلَّا قَلِيْلًا-نِّصْفَهُ اَوِانْقُصُ مِنْهُ قَلِيْلًا-اَوْزِدْعَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْاَنَ تَرْتِيْلًا
ওহে বস্ত্রাবৃত! প্রেমাস্পদ! রাতের কিছু অংশ ছাড়া সারারাত জাগ্রত থেক। রাতের অর্ধাংশ বা তার চেয়ে কিছু কম। অথবা তার চেয়ে কিছু বেশী করো আর থেমে থেমে কোরআন তিলাওয়াত কর।
এআয়াতে করীমায় হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কে প্রায় সারারাত নামায পড়ার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে সারারাত ইবাদত করা ফরয ছিলো। অল্প সময় বিশ্রামের জন্য রাখা হয়েছিলো। আবার এক বছর পর এ ফরযিয়্যাত রহিত হয়ে গেলো। কিন্তু ইস্তিহবাব তথা মুস্তাহাব হওয়াটা বাকী রয়েছে। এখানে যে ব্যক্তি শবীনায় সারা রাত জাগ্রত থাকে অল্প সময়েই ঘুমায় সে এ আয়াতের উপরই আমলকারী। কিন্তু আবশ্যক হলো শবীনা সেই পড়বে যে ব্যাক্তি কুরআন বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারে যা তারতীলের নির্দেশ থেকে বুঝা যায়।
(২) ইমাম মুসলিম ও বুখারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) থেকে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে চন্দ্রগ্রহণের নামাযের উল্লেখ রয়েছে। এর কয়েকটি শব্দ এরূপ-
فَقَامَ قِيَامًا طَوِيْلًا نَحْوَا مِنْ قِرَاءَةِ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম চন্দ্র গ্রহণের নামাযে প্রায় সুরা বাকারা পড়ার পরিমাণ দীর্ঘক্ষন ক্বিয়াম করলেন।
বুঝা গেল যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সল্লাম চন্দ্র গ্রহনের নামাযে সূরায়ে বাক্বারা অর্থাৎ আড়াই পারার সমান তিলাওয়াত করেছেন। শবীনায় প্রতি রাকআতে দেড় পারা পড়া হয়। যখন এক রাকআতে আড়াই পারা পড়াটা প্রমানিত হলো তাহলে দেড় পারা পড়াতো অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই বৈধ।
(৩) আবু দাঊদ হযরত হুযায়ফা (রাদ্বি.) থেকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর তাহাজ্জুদ সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার শেষের কয়েকটি শব্দ এরূপ-
فَصَلَّى اَرْبَعَ رَكْعَاتٍ قَرَ أَفِيْهِنَّ الْبَقْرَة وَالِ عِمْرَ انَ وَالنِّسَاءَ وَالْمَائِدَةَ وَالْاَنْعَامَ
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম চার রাকআত তাহাজ্জুদ পড়েছেন। যেখানে সূরা বাক্বারা, আলে ইমরান, সুরা নিসা, সুরা মায়িদাহ ও সুরা আনআম তিলাওয়াত করেছেন।
দেখুন! নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম) চার রাকআত তাহাজ্জুদে প্রায় আট পারা অর্থাৎ প্রতি রাকআতে প্রায় দু’পারা তিলাওয়াত করেছেন। শবীনায় প্রতি রাকআতে এ পরিমান পড়া হয় না। প্রতি রাকআতে দেড় পারা পড়া হয়। তাহলে এটা (শবীনা) কেন হারাম হলো?
(৪) ইমাম মুসলিম ও বুখারী (রাদিঃ) হযরত মুগীরা ইবনে শো’বা (রাদ্বিঃ) থেকে বর্ণনা করেন-
তিনি বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম রাতের নামাযে এত অধিক সময় কিয়াম ফরমালেন যে, তার উভয় পা মুবারক ফুলে গেলো। বলা হলো ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? অথচ আপরার উম্মতের আগে-পরের পাপ ক্ষমা করা হয়েছে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না?
এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল ইবাদতের মধ্যে কষ্ট করা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত। আর কোন শবীনায় কোন মুমিনের পা ফুলে গেলে সেটা তার সৌভাগ্য। কারণ একটা সুন্নাত পালন হলো। ওহাবীদের নিজেদের তো ইবাদত করার তাওফিক হয় না। অন্যদেরকেও ইবাদত থেকে বাধা দিচ্ছে।
(৫) তাহাবী হযরত ইবনে সীরীন থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ كَانَ تَمِيْمُ الدَّارِىْ يُحْيِى اللَّيْلَ كُلَّهُ بِالْقُرْ انِ كُلِّه فِى رَكْعَةٍ
তিনি বলেন, হযরত তামীম দারী (রাদিঃ) সারারাত জাগ্রত থাকতেন এবং প্রতি রাকআতে সম্পূর্ন কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন।
শবীনার ক্ষেত্রে তো বিশ রাকআত তারাবীহতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা হয়। হযরত তামীম দারী সাহাবীয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক রাকআতেই সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন।
(৬) তাহাবী হযরত ইসহাক ইবনে সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন-
عَنْ أَبِيْهِ عَنْ عَبْدُ اللهِ بْنِ الزُّبَيْرِ أَنَّهُ قَرَأ الْقُرْاَنَ فِىْ رَكْعَةٍ
তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাদ্বিঃ) এক রাকআতে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করেছেন।
(৭) আবু নু্আইম ‘হুলিয়া’তে হযরত উসমান ইবনে আবদুর রহমান তাইমী থেকে বর্ণনা করেন-
তিনি বলেন, আমাকে আমার পিতা বলেছেন, আজ আমি সারারাত মাক্বামে ইবরাহীমে জাগ্রত থাকব। আমি ইশার নামায শেষ করে মাক্বামে ইবরাহীমে র্পৌঁছলাম। আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম। হঠাৎ একজন আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তিনি ছিলেন হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাদ্বি.)। তিনি সূরা ফাতিহা দিয়ে কিরআত শুরু করলেন। এরপর তিনি পড়তেই থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কুরআন খতম করে ফেললেন। এরপর তিনি রুকূ করলেন এবং সিজদা করলেন। অতঃপর স্বীয় জুতোদ্বয় নিলেন। আমি জানি না তিনি ইতিপূর্বে আরো নামায পড়েছেন কিনা।
(৮) আবূ নু্আইম ‘হুলিয়া’ গ্রন্থে হযরত ইবরাহীম নাখঈ থেকে বর্ণনা করেন –
كَانَ اَسْوَدُ يَخْتِمُ الْقُرْاَنَ فِىْ رَمْضَان فِىْ كُلِّ لَيْلَتَيْنِ وَكَانَ يَنَامُ بَيْنَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ
হযরত আসওয়াদ (রাদ্বি.) রামাদ্বান মাসে প্রতি দু’রাতে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন এবং মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ঘুমাতেন।
(৯) তাহাবী হযরত হাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেন-
عَنْ سَعِيْدِ ابْنِ جُبَيْر أَنَّهُ قَرَأَ الْقُرْاَنَ فِىْ رَكْعَةٍ فِى الْبَيْتِ
সাহাবী হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাদ্বি.) বায়তুল্লাহ শরীফে এক রাকআতে সম্পূর্ণ কুরআন পড়েছেন।
এ হাদিস শরীফ সমূহ দ্বারা প্রমানিত হলো যে, অধিক রাত্রি জাগরণ, নামায পড়া, প্রতিদিন নামাযে কিয়াম করা যাতে পা ফুলে যায়, এক রাকআতে আড়াই পারা তেলাওয়াত করা রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত এবং এক রাত, দু’রাত বরং এক রাকআতে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ পড়া সাহাবায়ে কিরাম এর সুন্নাত। যে ব্যাক্তি শবীনাকে হারাম অথবা শিরক বা ফিসক বলে সে খাঁটি মুর্খ।
(১০) মিরকাত শরহে মিশকাত, ‘তিলাওয়াতুল কুরআন’ অধ্যায়ে ৬১৫ পৃষ্ঠায় সাহাবায়ে কেরামের রীতি এ ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে-
فَخَتَمَهُ جَمَاعَةٌ فِىْ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ مَرَّةً وَاَخَرُوْنَ مَرَّتَيْنِ وَ اَخَرُوْنَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ وَخَتَمَهُ فِى رَكْعَةٍ مَّنْ لَايُحْصَوْنَ كَثُرَةً
একটি দল দিনে ও রাতে একবার কুরআন শরীফ খতম করলেন, আরেক দল দু’বার এবং কেউ কেউ তিন বার। প্রতি রাকআতে সম্পূর্ন কুরআন তিলাওয়াত কারী অসংখ্য।
বিবেকেরও চাওয়া এটাই যে, শবীনা ইবাদত হারাম নয়। কেননা ইবাদতের ছাওয়াব কষ্টের পরিমাণ অনুযায়ী অর্জিত হয়। গ্রীষ্মকালীন রোযা, তরবারীর জিহাদ, কষ্ট করে হজ্ব পালনের ক্ষেত্রে ছাওয়াবই অর্জিত হবে, আযাব (শাস্তি) নয়। এটা কিভাবে হতে পারে যে, মুসলমান রবের সন্তুষ্টির জন্য সারারাত নামাযও পড়বে, কুরআন শরীফও তিলাওয়াত করবে, আর ছাওয়াবের পরিবর্তে আযাব পাবে? কুরআনের একটি হরফ পড়লে দশটি নেকী রয়েছে। তাহলে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ পড়ার কারণে নেকীর পরিবর্তে উল্টো আযাব হবে? হযরত দাউদ (আঃ) মুজিযা স্বরূপ অল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ ‘যবূর’ শরীফ পড়ে নিতেন, যা হাদীস শরীফে বিদ্যমান। তাহলে যদি এক রাতে সম্পূর্ণ কুরাআন পড়ার জন্য আযাব হয়’ তবে তো ‘নাউযুবিল্লাহ’ দাউদ আলাইহিস সালাম ওহাবীদের কথা মতো সম্পূর্ণ যাবূর পড়ার কারণে গুনাহগার হবে। রব তাআলা বুঝ দান করুন।
সুক্ষ্মরস : ওহাবীরা নিজেদের কিতাব ‘আরওয়াহে ছালাছায়’ তাদের মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী ইসমাঈল সাহেবের ফাযাইল (মর্যাদা) বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছে, মৌলভী ইসমাঈল সাহেব আছর থেকে মাগরিবের মধ্যে কুরআন করীম খতম করতেন। লোকেরাও তার কাছ থেকে এ সময়টুকুর মধ্যে সম্পূর্ণ কুরআন শুনেছেন। এখন আমরা ওহাবীদের থেকে জানতে চাই, তোমরা আমাদের ইমামে আযম আবূ হানীফা (রাদ্বি.) কে এ জন্যই নিন্দা ঠাট্টা করো, আর তাঁকে গালি দাও।
কারণ তিনি রামাদ্বান মাসে প্রতিদিন দিনের বেলা একবার ও রাতে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। বলো-তোমাদের ইসমাঈল তো আছর থেকে মাগরিবের মধ্যেই একবার কুরআন খতম করে নিতেন। তিনিও এ অভিশম্পাত ও ঠাট্টার উপযোগি কিনা? তিনিও ফাসিক ফাজির হলেন কি না? না তোমাদের ইমাম যা করে তা বৈধ? জবাব দাও। -সুত্রঃ জা’আল হক ৩য় খন্ড-